চলচ্চিত্রের বেহাল দশা, কমেছে পারিশ্রমিকও

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে প্রভাব পড়েছে দেশের চলচ্চিত্রশিল্পেও।  অন্যান্য সেক্টরের মতো ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রভাব পড়েছে। অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং বন্ধ আছে। এতে করে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অনেক শিল্পী ও কলাকুশলীরাও বিপাকে। কমে যাচ্ছে তাদের পারিশ্রমিকও।

১ জুন থেকে শুরু হয় ছোট ও বড় পর্দার শুটিং। ১৪টি সংগঠন বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে গত ২৮ মে শুটিং শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। করোনার কারণে শুটিং নিয়ে অনেকের দ্বিমত থাকলেও বেশ কিছু নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী সংগঠনের শর্ত মেনে শুটিং করছেন। গত ১৯ মার্চ থেকে সব ধরনের শুটিং বন্ধ হয়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় করোনাভাইরাসের এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং কতোটা সম্ভব, আর কতোটা হচ্ছে?

প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, জুন থেকে লকডাউন শেষ হয়েছে। সব কিছু খোলা হয়েছে। আমাদের শুটিং বন্ধ রেখে লাভ কি। এমনিতে অনেক চলচ্চিত্রের শুটিং বন্ধ আছে। অনেক প্রযোজক-পরিচালক শুটিং শুরু করতে চান। আমাদের চলচ্চিত্রের অবস্থা খারাপ।

পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার গণমাধ্যমকে বলেন, করোনার এই পরিস্থিতিতে শুটিং বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তবু এভাবে তো সব বন্ধ রাখা যায় না। শুটিং স্পটে কেউ আক্রান্ত হলে তার জন্য প্রযোজক-পরিচালক দায়ী থাকবেন। তাই খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে শুটিংয়ে।

অনেক শিল্পীর মতো করোনায় বিপাকে রয়েছে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ও পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রে অভিনয় করা নায়িকা নুসরাত ফারিয়া। মার্চ মাসে তার পাঁচটি চলচ্চিত্রের কাজ চলছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সেগুলোর সবগুলোই এখন বন্ধ হয়ে রয়েছে।

নায়িকা নুসরাত ফারিয়া একটি গণমাধ্যমকে বলেন, এখন বলা যেতে পারে, মার্চের ১১ তারিখ থেকে একেবারেই আমি ঘরে বসে রয়েছি। কারণ তখন থেকেই কলকাতার ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। এখন কলকাতায় স্বল্প পরিসরে শুটিং শুরু হয়েছে, বাংলাদেশেও কয়েকটি জায়গায় শুটিং হচ্ছে। কিন্তু সেই স্বল্প পরিসরে শুটিং করাটা আসলে কতটুকু নিরাপদ?

এভাবে সীমিতভাবে অল্প টাকায়, কম টেকনিশিয়ান ও আর্টিস্টকে দিয়ে কাজ করে কি আসলে সেই একইরকম কোয়ালিটি প্রোডাক্ট পাওয়া সম্ভব? এতো বাধা যখন চলে আসে, তখন একটাই সমাধান যে এখন কাজ না করা। চলচ্চিত্রের শুটিং করার সময় নায়ক-নায়িকাদের অনেক সময় ঘনিষ্ঠ বা কাছাকাছি দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়। কিন্তু এখন সামাজিক দূরত্বের যে কথা বলা হচ্ছে, তা মধ্যে সেসব দৃশ্যে অভিনয় করা কতটা সম্ভব?


নুসরাত বলছেন, হয়তো প্রযুক্তি, ক্লোজআপ শট ইত্যাদি ব্যবহার করে কাছাকাছি না গিয়েও সেরকম দৃশ্য তৈরি করা যাবে, কিন্তু তাতে কি সেই মানসম্পন্ন ফলাফল পাওয়া যাবে? পুরোপুরিভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত পুরোপুরি শুটিং শুরু করা কতোটা ঠিক হবে, সেটা তিনি ভাবছেন। কিন্তু এর ফলে একটা অনিরাপত্তা বোধ, এটা উদ্বেগও তৈরি হচ্ছে।

দেশে আরো অনেক খাতের মতো করোনা সংক্রমণের প্রভাব পড়েছে দেশটির বিনোদন শিল্প- চলচ্চিত্র জগতেও। ভাইরাসের কারণে অনেকটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে রঙিন এই দুনিয়া। প্রায় তিন মাস ধরে দেশের চলচ্চিত্রের সব ধরণের কর্মকাণ্ড বন্ধ রয়েছে। শুটিং হচ্ছে না, নতুন সিনেমার মুক্তি নেই, প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ। জুন মাসের পাঁচ তারিখ থেকে একজন পরিচালক শুটিং করতে শুরু করলেও অন্যরা এখনো কাজ শুরু করেননি। নায়ক-নায়িকারও এই পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে আগ্রহী নন।

অনেকগুলো সফল ছবির মেকআপ আর্টিস্ট সবুজ খান বলেন, মার্চের পর থেকেই কাজকাম নেই, সবাই সংকটে আছি। ইনকাম সোর্স বন্ধ হয়ে গেছে, সবাই জমানো টাকা ভেঙ্গে খাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই আমরা বসে আছি। আমাদের সহকারী যারা কাজ করে, তারা আরও সমস্যার মধ্যে আছে। এই মাসের পাঁচ তারিখ থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বড় আকারে শুটিং শুরু হয়নি। বড় বড় শিল্পীরা কেউ আসছেন না।

জানা গেছে, শীর্ষ নায়ক-নায়িকারা জানিয়ে দিয়েছেন, করোনাভাইরাসের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত তারা শুটিং করবেন না। দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বছরে ৫০টির মত সিনেমা মুক্তি পায়। সব মিলিয়ে হাজার কোটি টাকার এই শিল্পে এর মধ্যেই সাড়ে তিনশো কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

বিনোদন সাংবাদিক অপূর্ণ রুবেল বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে দুইটি করে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা। তবে সব সপ্তাহে সেরকম সিনেমা মুক্তি পায় না। দেখা যায় মাসে পাঁচ ছয়টি সিনেমা মুক্তি পায়। বছরে প্রায় ৫০টির মতো সিনেমা মুক্তি পায়। কিন্তু ১৮ মার্চের পর থেকে মার্চ মাস থেকে শুরু করে জুন মাস শেষ হতে চললো, এখন পর্যন্ত নতুন কোন সিনেমা মুক্তি পায় নি। পুরো বিনোদন শিল্পই একপ্রকার স্থবির হয়ে রয়েছে।

গত ১৮ই মার্চ থেকে সিনেমার শুটিং বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের প্রযোজক সমিতি। পাঁচই জুন থেকে শুটিং চালুর অনুমতি দেয়া হলেও শুধুমাত্র একটি সিনেমার শুটিং হয়েছে বলে জানা গেছে।

প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের শিল্পটা তিনটা স্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমটা হলো যারা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসে সবেমাত্র ছবি মুক্তি দিয়েছিলেন। সেগুলোর চলা বন্ধ হয়ে গেলো। কিছু শুটিং চলছিল, সেগুলো মাঝপথে আটকে গেলো। অনেকের সেন্সর করে মুক্তির অপেক্ষা করছিলেন, তাদের টাকাও আটকে গেল। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে নববর্ষে আর ঈদে নতুন ছবি মুক্তি দিতে না পারায়। সারাবছর ছবি মুক্তি দিয়ে আসলে আমাদের তেমন কোন সুবিধা হয় না। কিন্তু যে কয়েকটা বড় উৎসবের ওপর সারাবছর আমরা বেঁচে থাকি।

তিনি বলেন, যেমন নববর্ষ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা। দুইটা উৎসব চলে গেল, ঈদুল আযহায় কি হবে, সেটাও এখনো কোন সিদ্ধান্ত নাই। পুরো শিল্পের ক্ষতি হিসাব করলে এর মধ্যেই সাড়ে তিনশো কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, কারো হাতে কাজ নেই। কোন প্রযোজক বিনিয়োগ করছে না। যেসব ছবি শুরু হয়েছিল, সেগুলো বন্ধ হয়ে আছে। ফলে এক কথায় বলা যায়, কোন পরিচালক এখন আর ভালো নেই। সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছেন। তারা আবার শুটিং শুরু করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পুরোপুরি শুরু করা যায়নি। টুকটাক ডাবিং, এডিটিং এসব হচ্ছে। শুটিং শুরু হতে ঈদুল আযহা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

তারপরেও তা ঠিক মতো শুরু হবে কিনা, সেটি নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি কি হবে, তার ওপর। করোনা মোকাবেলায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা কী এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ? এর মধ্যেই একশোটি সিনেমা নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছে বাংলাদেশে প্রযোজকরা। কষ্টে থাকা চলচ্চিত্র কর্মীদের সাহায্যে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ পেলেও প্রণোদনার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সিনেমা হল খোলা হলে পুরনো ভালো ছবি নতুন করে চালানোর কথা ভাবছে প্রযোজক সমিতি।

ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ বাংলাদেশ ৮৮টি সিনেমা হল চালু ছিল। কিন্তু নতুন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর এর কতোগুলোকে আবার চালু পাওয়া যাবে, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে।

বিনোদন সাংবাদিক অপূর্ণ রুবেল বলেন, আগে থেকেই বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমছে। অনেক হল মার্কেট হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের ভাড়া দিতে হয়, কর্মীদের বেতন-ভাতা আছে। এভাবে মাসের পর মাস বন্ধ থাকলে এদের অনেকগুলোই আবার সিনেমা চালানোর জন্য নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না।


ঢাকার একটি নামী সিনেমা হল মধুমিতার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, অনেক বছর ধরেই আমাদের সিনেমা হলগুলো সংকটে ভুগছে। কারণ ভালো ছবি নেই, ফলে সিনেমা হলগুলোর সংখ্যা কমতে কমতে ১৪০০ থেকে ১২০০, সেখান থেকে তিনশো, এখন একশোয় এসে ঠেকেছে। আসলে চালু আছে ৮৮টি। তারপরেও কনটেন্টের অভাবে ব্যবসা করার মতো সিনেমা পাওয়া যায় না, ব্যবসা হয় না। এখন করোনা এসে সেই কফিনে লাস্ট পেরেক ঠুকে দিয়েছে। পরিস্থিতি যদি ভালোও হয়, তাহলেও সিনেমা হলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে হল চালু রাখা- এসব কারণে আমার মনে হয় অনেক হল খুলবেই না।

তিনি বলেন, এসব নিয়ম মানতে হলে যেসব বাড়তি খরচ হবে, অনেক মালিক সেটা বহন করতে পারবে না। ফলে আপাতত আমাদের সিনেমা হল খোলার কোন সম্ভাবনা নাই। এভাবে চলতে থাকলে এখন যে ৮৮টি সিনেমা হল চালু আছে, তার ৩০/৪০টি একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।

চলচ্চিত্র শিল্লীরা আশঙ্কা করছেন, যারা চলচ্চিত্রে ইনভেস্ট করেন তারা কেউ বিদেশ থেকে এসে ইনভেস্ট করেন অথবা এখানকার কোনো শিল্পপতি। করোনা ভাইরাসের এই দুর্যোগের মধ্যে পড়ে হয়তো দেখা যাবে তার অন্যদিকে ক্ষতি হয়ে গেছে, ফলে এখন আর সে চলচ্চিত্রে ইনভেস্ট করতে আগ্রহী হবে না এই মুহূর্তে। ফলে চলচ্চিত্র শিল্পে আবারো একটা দুর্যোগের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। তবে বৈশ্বিক এই দুর্যোগে ক্ষতি হলেও মানুষের সুরক্ষার কথা বেশি ভাবছে প্রেক্ষাগৃহগুলো।

এদিকে করোনায় সিনেমা হল বন্ধ থাকায় ঈদের সিনেমায় শাকিব যে সাফল্যের দেখা পেয়ে থাকেন এবার সেটিও হয়ে ওঠেনি। ফলে সুপারস্টারের রাজত্ব হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে এক যুগের বেশি এককভাবে শীর্ষ নায়কের স্থান দখল করে রাখা শাকিব কি ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত? হয়তো হ্যাঁ কিংবা না। পারিবারিক জীবনের নানা টানাপড়েনের কারণে এই নায়কের ইমেজে দাগ লেগেছে। অপু-শাকিবের বিবাহ বিচ্ছেদ দুই তারকার ভক্তদের মনেও বিভেদ তৈরি করেছে।

চলচ্চিত্র নির্মাণ বন্ধ, যৌথ প্রযোজনার সিনেমা নির্মাণ আইনের কারণে বন্ধে কলকাতার ছবিতেও কাজ হচ্ছে না শাকিবের। এদিকে চলচ্চিত্র পাড়ায় গুঞ্জন উঠেছে নতুন ছবিতে কাজের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন শাকিব। এমন অবস্থায় শাকিবের শত্রুভাবাপন্ন প্রযোজনা সংস্থা শাপলা মিডিয়ার ছবিতে নাকি আবারো দেখা যেতে পারে নায়ককে। তবে এই নায়ককে নিতে নাকি ওই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

শাকিব খান সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন ৩৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। সম্প্রতি চলচ্চিত্রের নাজুক অবস্থায় পরিচালকরা এত টাকা খরচ করে শাকিব খানকে নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন। ফলে শাকিবের হাতে কমতে থাকে ছবির সংখ্যা। এমন অবস্থায় শাকিব নিজের পারিশ্রমিক কমাতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি পারিশ্রমিক নিচ্ছেন ২০-২২ লাখ টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, শাকিব তার পারিশ্রমিক কমিয়ে নেতৃস্থানীয় বেশ কিছু প্রযোজককে ফোনও দিয়েছেন তাকে নিয়ে ছবি বানাতে। শাকিবের বর্তমান যা অবস্থা তাতে তার পারিশ্রমিক আরো কমে যাবে। শীর্ষ নায়কের যখন এই হাল তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রেও যে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //