ওয়েব সিরিজ বিতর্ক, ক্ষুব্ধ দর্শক

বাংলাদেশের বিনোদন জগতে গত এক মাস ধরে বেশ উত্তপ্ত। তার কারণ হচ্ছে ওয়েব সিরিজ। একপক্ষ বলছেন, ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে? আবার অনেক নির্মাতা বলছেন, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে? এই বিতর্কে দেশের শিল্পী ও নির্মাতারা ভাগ হয়ে গেছেন।

ঘটনার সূত্রপাত দুটো ওয়েব সিরিজ প্রসঙ্গে। সিরিজ দুটি নির্মাণ করেছেন নাট্য নির্মাতা শিহাব শাহিন ও ওয়াহিদ তারেক। শিহাব শাহীন বানিয়েছেন ‘আগস্ট ১৪’ ওয়েব সিরিজটি। যার গল্প তৈরি হয়েছে ঐশী নামের একজন টিনএজারের আলোচিত ঘটনা অবলম্বনে। আর ওয়াহিদ তারেক ‘বুমেরাং’ বানিয়েছেন এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার নিয়ে। ঘটনা দুটিই বর্তমান সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক।

অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় সব তারকারা। আজাদ আবুল কালাম, মৌটুসী বিশ্বাস, শ্যামল মওলা, হিল্লোল, ইমি, অর্ষা, তাসনুভা তিশা, আবু হোরায়রা তানভীরসহ অনেক জনপ্রিয় তারকা। তাহলে বিতর্কের জন্ম দিলো কেন? খুব আগ্রহ নিয়ে সিরিজ দুটি দেখলাম। সিরিজ দুটোতেই রয়েছে একাধিক চুমো ও যৌন দৃশ্য। বিতর্কের সূত্রপাত এজন্যই। দৃশ্যগুলোর স্ক্রিনশট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই ওয়েব সিরিজ দুটি আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। তাই এর বিরুদ্ধে সরব অনেকেই। সমালোচনার মুখে সরিয়ে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু কনটেন্ট। এই কাজ দুটির সঙ্গে জড়িত অভিনেতাদের সমালোচনা করছেন তারা। কিন্তু যারা এ সিরিজগুলোতে তারা কী ভাবছেন?

‘বুমেরাং’ এ অভিনয় করেন হিল্লোল। তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, গল্প এবং দৃশ্যের প্রয়োজনে আমি অভিনয় করেছি। এটা নেগেটিভলি দেখলে নেগেটিভ। আমি একজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট হিসেবে সাবলীল অভিনয়টা করে গেছি।

অভিনেত্রী মৌটুসী বিশ্বাস বলেন, একজন অভিনেত্রী হিসেবে আমি আমার কাজটা করেছি। এটা শুধু চরিত্রের প্রয়োজনে করা। দর্শকের প্রতিক্রিয়া থাকতেই পারে।

আজাদ আবুল কালাম বলেন, এটি নিয়ে কথা বলাটাও রুচির মধ্যে পড়ে না। দুনিয়া কোথায় চলে গেছে আর আমরা কাদা ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে আটকে আছি। আর যে কারণে আমার কাজটি নিয়ে এত বাজে কথা হচ্ছে, আমি নিশ্চিত তা ৯৯ ভাগ লোক দেখেননি। শুধু কারও শেয়ার দেয়া স্ক্রিনশট দেখে তারা হুজুগে গা ভাসাচ্ছেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, ধরেন আমাদের দেশের একজন অভিনেত্রীকে হলিউডে সুযোগ দেয়া হলো। সেই সিনেমায় একটি সাগর পাড়ের দৃশ্য রয়েছে। তাহলে কি তিনি শাড়ি পরে সেই দৃশ্য করবেন? পরিচালক তা মেনে নেবেন? এখানে জাত যাওয়ার কিছু নেই। আমরা তো এ ধরনের কাজ দেশের বাইরে নিয়মিতই দেখছি। ২০২০ সালে এসেও আমাদের এমন ঠুনকো বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে ভাবিনি!

অর্ষা বলেন, আমি আসলে এ নিয়ে একদম চিন্তা করি না। শুধু এটুকু বলতে চাই, এ ধরনের কাজ আমাদের দেশীয় অ্যাপেও দেড় বছর আগে থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু এটি ইউটিউবে চলে আসায় এতো আলোচনা হচ্ছে। এটি একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু। দর্শক আর কত দিন গৎবাঁধা গল্প দেখবে? এখন দর্শক খুনটা খুনের মতোই দেখতে চায়, মানুষের সম্পর্কগুলো বাস্তবর মতোই দেখতে চায়। আমরা শুধু সেই বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছি। তবে প্রযোজকরা কেন তাদের কমিটমেন্ট রক্ষা না করে এটি পাবলিকলি প্রচার করেছে, তা নিয়ে নিশ্চয়ই পরে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তানভীর বলেন, আমরা কি এমন করেছি যে এত কথা হচ্ছে, সেটিই বুঝতে পারছি না। এখানে যে গল্পটি নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে তা নির্মিত হয়েছে ঐশীর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। সবাই জানেন, তার জীবনে ড্রাগস আর যৌনতা ছিলো। তাহলে সেই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে এই দুটি জিনিস ছাড়া কীভাবে সম্ভব? তেমনি আমার চরিত্রটিও ডিমান্ড করে যে দৃশ্য আমি করেছি। এটা সেসব মানুষের হীনমন্যতা, যারা নেতিবাচক কথা বলছেন। জানি না, তারা কেন নেতিবাচক কথা বলছেন?

‘আগস্ট ১৪’ -এর নির্মাতা শিহাব শাহীন বলেন, ২১৭ মিনিটের সিরিজটাতে শুধুমাত্র একটি চরিত্রের (পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে) কিছু ডায়লগ ব্যবহার করা হয়েছে যেটা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। অথচ যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো আগেও বহু সিরিয়ালে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো নতুন কোনো শব্দ না। তাহলে কেন বিতর্ক হচ্ছে? জবাবে  বলেন, আমিও বুঝতে পারছি না৷ দেশের বাইরের ওয়েব সিরিজ নিয়ে তো এতদিন কথা হয়নি? এখন যখন দেশে এগুলো নির্মাণ শুরু হয়েছে, তখনই কেউ কেউ এর সমালোচনা করছেন।

এটাতো শুনলেন যারা অভিনয় করেছেন তাদের কথা। যারা বিতর্ক তৈরি করেছেন তারা কি বলছেন এবার তা জানা যাক।
ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ও নির্মাতা এস এ হক অলীক তার ফেসবুকে পোস্টে লেখেন, আধুনিক হওয়া ভালো কিন্তু এমন আধুনিক হওয়া উচিত নয়। যে আধুনিকতা নিজের পরিবারকে লজ্জার মধ্যে ফেলে। সাহস দেখানো ভালো কিন্তু এমন সাহস দেখানো উচিত নয়, যে সাহস দেখানোর জন্য অতীতের সকল ভালো কাজ ঢাকা পড়ে যায়। স্বাধীনতা ভালো, কিন্তু এমন স্বাধীনতা ভালো নয়, যে স্বাধীনতা নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একজন লেখক, একজন পরিচালক এবং একজন অভিনয় শিল্পীর আরও বেশি সচেতন হওয়া উচিত।


অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম বলেন, আমি ওয়েব সিরিজগুলোর বিষয়ে জেনেছি। এটাকে ভালোভাবে দেখছি না। আমরা খুবই মর্মাহত। আমাদের দেশে এখনো ওপেন কোনো কিছু আসেনি। আমাদের কালচার সেভাবে গড়ে ওঠেনি। পরিমিতিবোধ থাকতে হবে। যা এই ভিডিও কন্টেন্টগুলোতে নেই। আমরা সবাই বিব্রত। দুই একদিনের মধ্যে আমরা চিঠি দেবো তথ্য মন্ত্রণালয়ে। ইউটিউবে কন্টেন্ট প্রকাশের ক্ষেত্রে কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সে বিষয়ে নীতিমালা থাকতে হবে।

ওয়েব সিরিজ দুটি নিয়ে কথা হয় কয়েকজন দর্শকের সঙ্গে। ঢাকার শান্তি নগরে থাকেন ফয়সাল শামীম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন। তিনি অবসর সময়টাতে তিনি এই দুটি সিরিজ দেখেছেন। তার মন্তব্য হচ্ছে সময়ের প্রয়োজনে গল্পটি ভালো। তবে সমস্যা হচ্ছে এ ধরনের গল্প আমাদের ধর্মীয় অনুশাসন বা সমাজের সঙ্গে যায় না। আরও একটু মার্জিতভাবে উপস্থাপন করার দরকার ছিলো।

পুরান ঢাকার ওয়ারির লায়লা নূর জানান, ওয়েব সিরিজে যা দেখানো হচ্ছে দেশ এটা দেখার জন্য প্রস্তুত না। শ্লীলতা বা অশ্লীলতাই একটা আপত্তির জায়গা। দুর্নীতি বা এ ধরনের অনাচার নিয়ে কিন্তু এসব সিরিজ হয়না, সেক্স আর ভায়োলেন্স নিয়ে হয়। সিরিজ দুটি আমি দেখেছি। গল্প দুটোতে ভাষার চরম বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।

লালবাগের গৃহিনী নাদিয়া মাহবুব বলেন, আমাদের দেশে সুন্দর একটি সংস্কৃতি রয়েছে। তা ধ্বংস হতে দিতে পারি না। এখন বাইরের জগতে অনেক কিছুই হচ্ছে। সেটা যদি ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে আপনার ঘরের মধ্যে চলে আসে তাহলে তো বিপদ। এখন অনেক নির্মাতা প্রয়োজন না হলেও বেডরুমের একটা দৃশ্য ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। বেডরুমে স্বামী-স্ত্রী কী করছেন, ওই দৃশ্য হয়তো সেখানে প্রয়োজনই নেই। এমনভাবে অনেক কাজ হচ্ছে, যা নিয়ে আমার মনে হয় চিন্তা করার সময় এসেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //