সিনেমা যেখানে ভাষা

পুরাণে আছে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক সময় একই ভাষায় কথা বলত। পরে তারা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেলে, তাদের ভাষা হলো ভিন্ন ভিন্ন। একে অপরকে বোঝার আর ক্ষমতা থাকল না তাদের। 

মানুষের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির শুরুও হলো সেখান থেকেই। এই ভুল বোঝাবুঝি থেকেই শুরু হলো যুদ্ধ, হিংসা, হানাহানি। বিভাজন বাড়ল। কাঁটাতার আর সীমানার বেড়াজালে আটকা পড়ল মানুষ। এই দমবদ্ধ অবস্থা থেকে রেহাই পেতে কিছু মানুষ বেছে নিল শিল্পের ভাষা। গান গেয়ে, কবিতা লিখে, ছবি এঁকে তারা যোগাযোগ করতে চাইল সব মানুষের সাথে। জাতিগত ভেদাভেদ আর সীমানার বাইরে বের হওয়ার আমন্ত্রণ জানাল তারা। তারই ধারাবাহিকতায় মানুষের ইতিহাসে যুক্ত হলো সিনেমা। 

সিনেমা এমন এক ভাষা নিয়ে হাজির হলো, যা বুঝতে মানুষের প্রথাগত ভাষার প্রয়োজন হলো না। দৈনন্দিন শব্দ-বাক্যের বাইরে মানুষ তার পৃথিবীকে পাঠ করল সিনেমার ভাষায়।

সিনেমা নিজেই একটা ভাষা

কিছু না বলেও সিনেমা অনেক কিছু বলে দিতে পারে। এটাই সিনেমার শক্তি। সিনেমার অনন্যতা। সিনেমা ভাষাহীনকে ভাষা দেয়। কারণ সিনেমা নিজেই একটা ভাষা। অন্যান্য ভাষার মতোই এর আছে অক্ষরমালা। সিনেমার অক্ষরমালা- সময়, স্থান, ছবি, শব্দ, আলো, চরিত্র, সংলাপ, সংগীত ও সম্পাদনা। এই অক্ষরমালা দিয়ে আমরা আমাদের অনুভূতি ও ভাবনা প্রকাশ করতে পারি। 

অন্য কোনো ভাষা বা মাধ্যমে এই অক্ষরমালা নেই। সিনেমা সিনেমাময় (Cinematic) ভাষায় যেভাবে ভাবনাকে প্রকাশ করতে পারে তা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামি বলেছেন- ‘সিনেমা বৈশ্বিক ভাষা, আমরা একে কোনো একটা বিশেষ সংস্কৃতিতে আটকে ফেলতে পারি না।’ 

অন্যদিকে আমেরিকান নির্মাতা ডেভিড লিঞ্চ বলেন, সিনেমা তার কাছে একটা ভাষা। এমন এক ভাষা যা বিশাল, বিমূর্ত সব বিষয় ব্যক্ত করতে পারে।

সিনেমার অক্ষরমালা

সিনেমার অক্ষরমালাকে নানাভাবে সাজানো যায়। কখনো ছোট ছোট শট দিয়ে বানানো যায় সিনেমা, আবার কখনো লম্বা লম্বা শট দিয়ে। অনেকটা, গল্প বা কবিতা লিখতে গিয়ে ছোট ছোট বাক্য অথবা লম্বা লম্বা বাক্য ব্যবহার করার মতো। আবার টানা এক শটের সিনেমাও আছে। যেমন- বাংলাদেশের সিনেমা ‘৭২০ ডিগ্রি’ কিংবা রাশিয়ান সিনেমা ‘রাশিয়ান আর্ক’।

আবার সংলাপবিহীন সিনেমাও আছে। এক্ষেত্রে শুধু ছবি আর শব্দ দিয়ে তৈরি করা হয় সিনেমার জগত। বাংলাদেশ থেকে নির্মিত ‘একটি একঘেয়ে ফিল্ম’ এমনই একটি উদাহরণ। আবার অনেকে সিনেমাকে শুধুমাত্র ভিজ্যুয়াল মাধ্যম মনে করেন, তারা ভুলে যান শব্দের কথা। অথচ সিনেমার অনন্যতা লুকিয়ে আছে শব্দের মাঝে। 

আব্বাস কিয়ারোস্তামির সিনেমা ‘দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস’-এ কয়েকটি চরিত্রকে আমরা গোটা সিনেমায় কখনই দেখতে পাই না। আমরা শুধু তাদের সংলাপ শুনতে পাই। অথচ আমাদের কখনই মনে হয় না যে, তাদের আমরা দেখতে পাইনি। 

আসলে, যখন আমরা সিনেমা দেখতে বসি, ফ্রেমে বেশির ভাগ সময় আমরা একটি দিকই দেখতে পাই। অন্যান্য দিকগুলো- ডান, বাম, ওপর, নিচ, পেছন-এ সবই উন্মোচিত হয় শব্দের সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। আবার শব্দের সাথে ব্যবহার করতে হয় নৈঃশব্দ্যকেও। সিনেমার মাঝে হঠাৎ কোনো নৈঃশব্দ্য কিংবা একটা ব্ল্যাক ফ্রেম আমাদের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে। 

সিনেমার আরেকটা শক্তি হচ্ছে, আপাত গুরুত্বহীন কোনো চরিত্র কিংবা ঘটনাকে সে ভাষা দেয়। ছোট কোনো বিষয় যে আসলে ছোট নয়, তা আমাদের বুঝিয়ে দেয় সিনেমা। কিয়ারোস্তামি তার এক কর্মশালায় বলেছিলেন- ‘বহুকাল আগে আমি একটা হাইকু কবিতা পড়েছিলাম। কবিতাটা বলছে- হিরোশিমার সব খবরই প্রচারিত হয়েছে, সব খবরই লিপিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু একটা প্রজাপতির ডানা যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এই খবর তো কেউ দিল না।’

সিনেমার ভাষা তৈরি করতে কী লাগে

হাঙ্গেরির পরিচালক বেলা তার বলেন, ‘আপনি যদি সত্যিকারের চলচ্চিত্র নির্মাতা হন, তাহলে আপনার নিজস্ব শৈলী থাকবে, নিজস্ব ভাষা থাকবে। আর এটা নির্ভর করছে আপনার সাংস্কৃতিক পটভূমি, ইতিহাস ও অবশ্যই আপনার বাজেটের ওপর।’ 

সিনেমা পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়

আর সব ভাষার মতো সিনেমার ভাষাও যুগ যুগ ধরে পরিবর্তিত হয়ে আসছে। সিনেমা যখনই কোনো গোঁড়ামিতে আক্রান্ত হয়েছে তখনই কোনো না কোনো চলচ্চিত্র নির্মাতা এসে ভেঙে দিয়েছের প্রথার দেয়াল। যেমন- জ্যঁ লুক গোদার, জোনাস মেকাস, আব্বাস কিয়ারোস্তামি কিংবা শান্তাল আকেরমান। 

কিয়ারোস্তামি দেখিয়েছেন সিনেমার কাব্যিক সম্ভাবনা। গোদার আবিষ্কার করেছেন সম্পাদনার নতুন শৈলী। জোনাস মেকাস দেখিয়েছেন প্রতিদিনের ডায়রি এন্ট্রির মতো হতে পারে ‘ডায়রি ফিল্ম’। 

অন্যদিকে শান্তাল আকেরমান গৃহস্থালি আর দৈনন্দিন ঘটনাবলিকে নিয়ে গেছেন অন্য উচ্চতায়, যেমন করে কেউ কখনো ভাবেনি আগে। যারা সিনেমাকে শুধু একটা নিয়মের গণ্ডিতে দেখতে চান তাদের কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন এমন পরিচালকরা। তারা দেখিয়েছেন- তুমি যেভাবে বল শুধু সেভাবেই সিনেমা হয় এমন না; সিনেমা এভাবেও হয়।

আমাদের ভাষা হবে সিনেমা

আমরা যারা সিনেমা বানাতে এসেছি, তারা অন্যরা যেভাবে পৃথিবীকে দেখছে সেভাবে দেখব না। আমরা দেখব সিনেমার ভাষায়। আর এই ভাষা দেখে যেমন আলোড়িত হবে এখানকার মানুষ, তেমনি আলোড়িত হবে পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের মানুষ। এটাই সিনেমার সৌন্দর্য। যে কারণে আমরা অন্য একটি অঞ্চলের সিনেমা দেখে আলোড়িত হই। 

সিনেমার ভাষা বোঝা তাই জরুরি। সিনেমার ভাষা অন্য কোনো মাধ্যমের ভাষার সাথে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে। যেমন কবিতা ও থিয়েটার এক বস্তু নয়। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি আছে। আর এ ভাষায় আমাদের জানিয়ে দিতে হবে আমাদের দৈনন্দিন কমেডি আর ট্র্যাজেডি। আমাদের জানাতে হবে হেমলেট কিংবা ইদিপাসের ট্র্যাজেডিই একমাত্র ট্র্যাজেডি নয়।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //