অ্যালসিনো অ্যান্ড দ্য কনডোর

জীবন বাস্তবতার সমান আয়না

বাংলাদেশে বিকল্প সিনেমা আন্দোলন যখন জোরদার হচ্ছে, তখন একদল মানুষ চলেছে আরও একটি মহাদেশে নিজেদের সিনেমার মধ্যে দিয়ে বিপ্লব ঘটাতে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, তাদের এ বিপ্লব কোনো সৌখিনতার গল্প নয়, যেটা সচরাচর এদেশে ঘটে থাকে। শখের বশে সিনেমা নয়- সেখানে সিনেমা হয় জীবনের প্রয়োজনে। সিনেমা করার জন্য সেখানে এসে জড়ো হন সিনেমার মানুষেরা, আসলে বলছি বিপ্লব করার জন্য জড়ো হন সেখানে মানুষ। এটা একটি মহাদেশের গল্প বলছি। এ গল্প সবার জন্য হয়ে ওঠে এ কারণে, যে তারা জীবন থেকে উপলব্ধি করতে পারে সবটাই।

যে অঞ্চলের কথা বলছি, সেটি লাতিন আমেরিকা। লাতিন আমেরিকায় চলচ্চিত্র বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ প্রথা অব্যাহত 

থাকবে। কেননা, এখানকার চলচ্চিত্র- মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে, মানুষকে নাড়া দেয়। লাতিন আমেরিকান দেশ ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া, কিউবাসহ আরও ছোট ছোট রাজ্যের চিত্র পরিচালকরা রাজনীতি ও বিপ্লব- এই দুটি বিষয়কেই ভীষণভাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন তাদের সিনেমায়। মূলত তারা সিনেমার বিষয় নির্বাচনে নিজেদের সমাজ-মাটি ও মানুষের কথা ভাবেন। এ প্রসঙ্গে লাতিন আমেরিকার ছোট্ট দেশ চিলির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সত্তরের দশকের প্রথম পর্বেই চিলির বিপ্লবী সরকার আলেন্দের পতনের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী দালালেরা দখল করে নেয় জনগণের দুর্গ চিলি। বিপ্লবী চিত্রপরিচালক যেমন প্যাট্রিসিও গুজম্যান, মিগুয়েল লিটিন, রউল রুইজ সকলে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলেন, কেউ কেউ দেশও ছাড়লেন। তারা ছিলেন শিল্পী, ক্যামেরার শিল্পী- শিল্পকে তারা কিন্তু বাঁচিয়ে রাখলেন, এ অবস্থাতেও ছবি তৈরি কিন্তু বন্ধ রইল না। আশপাশের রাজ্যে তারা আশ্রয় নিলেন, ছবি করলেন। বিপ্লবী ছবিই করে চললেন। বিষয় ওই একই রাখলেন, জনগণের বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। চিলি তথা সব লাতিন আমেরিকার মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস বিবৃত হলো ছবির গাম্ভীর্যে, ভাবনার দ্যোতনায় এবং বিপ্লবী যুক্তিবাদে।

লাতিন আমেরিকার আলেন্দের দেশ চিলি। মানুষের বিদ্রোহী ভূমিকার লড়াকু দেশ চিলি। সেই চিলির বিদ্রোহী পরিচালক হলেন মিগুয়েল লিটিন। লিটিন চিলি ছেড়ে তার বিপ্লবের ছবি করলেন ‘অ্যালসিনো অ্যান্ড দ্য কনডোর’ বিপ্লবী সরকারের দেশ নিকারাগুয়াতে। সহযোগিতা করল কিউবা। সম্প্রতি লিটিনের সেই বিপ্লবী ছবি ‘অ্যালসিনো অ্যান্ড দ্য কনডোর’ আমার দেখা হলো। ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন- আমার কাছের দুই বন্ধু, তালাত আর শেহজাদ। ওরাও সিনেমার মানুষ। ভিন্নধারার সিনেমায় ওদের আগ্রহ। বয়স হয়েছে; কিন্তু দু’জনের এখনো সিনেমা হয়নি। সে না হোক, সিনেমার জন্য ওরা প্রাণান্তকর এটাই জরুরি। স্বপ্ন আর ভালোবাসা যদি এক হয়ে যায় তবে কী আর কথা থাকে, ওরা হলেন তাই। সিনেমার জন্য আমাদের প্রাণান্ত ভাবনা ও চেষ্টা, আমি কেবল দর্শক, সমালোচক আর নির্মাতা। তবে এটাও ঠিক পৃথিবীর ভালো ভালো এবং সেরা ছবি দেখবার যে সাধ ছিল- তা পূরণে আমার ভেতরকার চেষ্টা ছিল বলেই আমি সিনেমা দেখতে পারি। আমার দুই বন্ধুকে ধন্যবাদ অন্তত এ সিনেমাটির নাম আমি জানতাম না ওরা না বললে, দেখাও হতো না হয়তো- যা দেখি তিনে মিলেই দেখি এ এক আনন্দ বলা চলে।

‘অ্যালসিনো অ্যান্ড দ্য কনডোর’ লিটিনের বিপ্লবী ডায়ালেকটিকসের ছবি। ছবিটি তৈরি হয়েছিল ১৯৮২ সালে, কিন্তু এর প্রারম্ভিক মুক্তি ঘটে পহেলা মে ১৯৮৩ সালে। ছবিটির গল্প লেখক পেদ্রো প্রাদো। তিনি ছিলেন, চিলির জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া লেখক। এ ছবিটি নিয়ে বলবার রয়েছে অনেক- শুরুতেই নিপীড়িত জনগণের অভ্যুত্থানের ছবি। বিপ্লবের ছবি। বিষয়ের শুরুতে আমরা দেখি সাম্রাজ্যবাদী দানবদের নিরন্তর আকাশে ছুটে চলার দৃশ্য। সঙ্গে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত অগ্নিবর্ষণের রক্তিম আস্ফালন। মানুষকে লুটিয়ে দেয় শস্যক্ষেত্রের সবুজ চাদরে। দানা বাঁধে শ্রেণিশত্রুরা নীরবে। নানামুখী সব শত্রু। খেটে খাওয়া মানুষেরা ধরা পড়ে সাম্রাজ্যবাদী চক্রে। চলে আস্ফালন, নিপীড়ন আর অত্যাচার। সব কিছু কাটা কাটা চিত্রের সারিবদ্ধতায় মন্তাজ হয়ে অত্যাচারের কাহিনী লাল হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। 

ছোট ছেলে আলসিনোর চোখ দিয়ে আমরা এতক্ষণ সব দেখি। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীরা ধীরে ধীরে নেমে আসে শোষকের ভূমিকায়। কুব্জ পৃষ্ঠ অ্যালসিনো বুঝতে পারে ‘অ্যামস্টারডাম’ উচ্চারণের অর্থ পরাধীনতা। সেই সঙ্গে আমরা দেখি জনগণের বিপ্লবী ভূমিকার চিত্র। মাটির মানুষেরা সজ্জিত হয় অস্ত্রসজ্জায়। প্রস্তুতি নেয় শ্রেণিশত্রু খতমের। মুক্তিযোদ্ধারা জনগণের বিপুল সহায়তায় সশস্ত্র বিপ্লবে এনে দেয় কনডোর ভূমিতে জনগণের স্বাধীনতা। রক্তাক্ত সংগ্রামে অ্যালসিনো তুলে ধরে শেষ আগ্নেয়াস্ত্রটি। সে একজন বিপ্লবী ‘ম্যানুয়েল’ হয়ে যায়। মিগুয়েল লিটিন সাহসের সঙ্গে বলে চলেন, তার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার কথা অ্যালসিনোর চোখ দিয়ে, চেতনা দিয়ে। লিটিন নতুন বিপ্লবী শব্দ চয়ন করে নেন, যোদ্ধাকে চিহ্নিত করেন ‘ম্যানুয়েল’ নামের অন্তরালে। আমাদের শুনিয়ে দেন বিপদে আমরা যেন সবই ‘ম্যানুয়েল’ হয়ে উঠতে পারি। ‘ম্যানুয়েলের’ আর এক নাম বিপ্লবী শপথ। মিগুয়েল লিটিন বিপ্লবকে হাজির করেছেন খুব স্বভাবিকভাবে, দেশজ মৃত্তিকার মতো নরম করে, বহমান শোণিতের চ্যালেঞ্জের ধারায়। সঙ্গে প্রতিটি ছবির ফ্রেমকে করেছেন সাবলীল কিন্তু কঠিন। ক্যামেরার রঙের বহমানতায় সবুজ, লাল, ফিকে- সব চলন্ত মানুষ মোটিফের সাযুজ্যে অর্থবহ হয়ে ওঠে। বিষয় ও আঙ্গিক হয়ে ওঠে পরস্পরের পরিপূরক। লিটিনের কাটিং আরও সুন্দর। তার প্রতিটি কাটিংয়ে বিষয়ের মেজাজ বিপ্লবের চরম অর্থটুকুকে পরম সূক্ষ্মতায় পরিবেশন করতে সক্ষম হয়।

মিগুয়েল লিটিন দিল্লিতে জুরি সদস্য হয়েছিলেন চলচ্চিত্র উৎসবে একবার। সেখানে তিনি খুব জোরের সঙ্গে বলেছিলেন সেদিন- ‘We regard our people as our only masters. Our cinema should find its roots in our people. I think that our self expression through cinema, must be to fight for our liberty. We should show the feelings of our people and their attitude towards freedom. The liberation of our people should be the main idea behind the creation of our films. This attitude of our film people, added to the revolutionary spirit of our people, would be our aesthetic.’ 

জানি না- এ ছবি কতজন মানুষ দেখেছেন। তবে পৃথিবীর সব মানুষের এ ছবি দেখা উচিত, কেননা- মানবতার কথা, মানুষের কথা বলতে এসেছেন এই ছবির পরিচালক। সুতরাং পরিশেষে একথা বলতে চাই, লিটিনের ছবি নিপীড়িত মানুষের কাছে বিপ্লবী ইস্তেহার হোক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //