‘দুই কন্যা আমাদের ভালোবাসাকে পূর্ণ করেছে’

মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী দম্পতি। শোবিজে তারা ক্লিন দম্পতি হিসেবেও পরিচিত। ১৯৯৩ সালে এ দম্পতি বিয়ের পিঁড়িতে বসে। সেই থেকে এখন অবধি একই ছাদের নিচে প্রেম-ভালোবাসায় ভরে উঠেছে তাদের সংসার। তমা ও শ্রীমা নামের দুই কন্যা আলোকিত করে রেখেছে তাদের ঘর। সংসার জীবন-অভিনয় ও সমসাময়িক নানা বিষয়ে এই গুণী তারকা দম্পতির সঙ্গে খোলাখুলি আড্ডার গল্প তুলে ধরেছেন এন ইসলাম।

রোজী সিদ্দিকী

চঞ্চল কিংবা আদুরে চরিত্রগুলোতে দারুণ অভিনয় করেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী। জন্ম সিদ্দিকবাজারে হলেও পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা মতিঝিলে। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়েছেন। মতিঝিলের স্কুলে পড়াশোনার সময় তার নাচে হাতেখড়ি হয়। আর মঞ্চ নাটক দিয়েই অভিনয় জগতে প্রবেশ করেন তিনি। মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে রোজী বলেন, “মমতাজউদদীন স্যারের হাত ধরে ‘থিয়েটার আরামবাগ’-এর সঙ্গে যুক্ত হই। ১৯৮৯ সালের দিকে থিয়েটারে নাম লেখাই। তার আগে মতিঝিলের স্কুলে পড়াশোনার সময়ই আমার নাচে হাতেখড়ি হয়। মতিঝিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিশু সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। থিয়েটারের পর মমতাজউদদীন স্যারের হাত ধরেই বিটিভিতে এনলিস্টেড হওয়া।” 

থিয়েটারের শুরুর দিকের সেই সময়কে সোনালি দিন আখ্যা দিয়ে রোজী বলেন, “সোনালি সেই দিনগুলো কখনো ভোলার নয়। সে সময় সেলিম, ফরীদি ভাই, বিলু ভাই, খাইরুল ইসলাম পাখি ভাই, সুবর্ণা আপা, আসাদ ভাই, কামাল ভাই, ফারুক ভাইসহ অনেকেই বেইলী রোডের মহিলা সমিতির বারান্দায় আড্ডা দিত। আমরা তাদের বাঘের মতো ভয় পেতাম। তবে ঢাকা থিয়েটারে সুবর্ণা আপা আমাকে প্রথম থেকে কাপড় পরিয়ে দিতেন। খুবই আদর করতেন আমাকে। কখন যে চোখের পলকে দিনগুলো চলে গেছে। এখন ভাবলে মনে হয় এই তো সেদিন সব কিছু ঘটেছে।” 

এ দলের হয়ে মঞ্চে তার উল্লেখযোগ্য নাটক হলো ‘হাত হদাই’, ‘প্রাচ্য’, ‘বন পাংশুল’, ‘ধাবমান’ ইত্যাদি।

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে সুখ-দুঃখে একই ছাদের নিচে বসবাস করছেন দুজন। বিয়ের প্রথম দিনটি থেকে আজ অবধি ভালোবাসার এতটুকু কমতি নেই তাদের কাছে। জানতে চাই, দুজনের সম্পর্কটা শুরু হলো কীভাবে? উত্তরে হেসে রোজী বলেন, “সে সময় ‘রাক্ষুসী’ নাটকে আমাকে হিন্দু বৌ সাজতে হতো। লাল টুকটুকে সিঁদুর পরতাম। সেলিমসহ অনেকে তাই এটা দেখার জন্য আমাকে দেখতে চাইত। তবে টেলিভিশনে রাবেয়া খাতুনের ‘মোহর আলী’ নাটকে সেলিম আর আমি একসঙ্গে অভিনয় করি। ওই নাটকের সবাই সবসময় পলিটিক্স করত আমাদের নিয়ে। চাইত যে দুজনের সঙ্গে একটা ভাব হোক। আসলে আমাদের সম্পর্ককে বলা যায় যৌথ প্রযোজনার রিলেশন। আমাদের প্রথম নাটকের সময় সবাই চাইত আমাদের মধ্যে যেন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে সময় একবার এমন হয়েছে যে, একটি দৃশ্যে ছিল নৌকার সিন। আমাদের দুজনকে উঠিয়ে দিয়েছে সবাই। অনেকক্ষণ হওয়ার পরও কাট আর কেউ বলে না।” এভাবেই আসলে শুরু।

পরে সেলিম সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান রোজীর বাবার কাছে। তিনি ভেবে দেখার জন্য একটু সময় চান। কিন্তু তারা তাদের বিজয় নিশ্চিত করতে ১৬ ডিসেম্বরই বিয়ে করার জন্য মনস্থির করে ফেলেন। 

বিয়ের পর থেকেই তাদের বোঝাপড়াটা বেশ ভালো। সুখেই চলছে তাদের সংসার। কাজের ফাঁকে বছরে দু-একবার তারা বেরিয়ে পড়েন ঘুরে বেড়াতে। রোজীর ভাষ্যে, ‘বছরে অন্তত দুবার করে হানিমুনে যাই আমরা।’ এমনকি হানিমুন নিয়ে রোজী জানালেন মজার এক তথ্যও। বিয়ের রাতেই নাকি সেলিমের কাছে রোজীর বায়না ছিল সমগ্র ভারত ঘুরে দেখানোর। আর এই শর্ত পূরণ করতে সেলিম রাজি হয়েছিলেন এই শর্তে যে, রোজী কোনোদিন মশারি টানাতে পারবে না। এমনই মজার শর্ত আর দুষ্টুমিমাখা ভালোবাসার সুতোয় অপূর্ব এক দাম্পত্য জীবন। 

দীর্ঘদিনের সংসার জীবন। নিশ্চয়ই মনোমালিন্যও থাকে। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে রোজী বলেন, “সংসার জীবনে বিশ্বাস হলো মূলমন্ত্র। দুজন মানুষের পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে সংসার টিকে থাকে না। দিন শেষে আমাদের পরিবারের প্রতি মনোযোগী থাকা উচিত বলেই মনে করি।” যোগ করেন তিনি, “ও খুবই রাগী। এমনও হয়েছে, রাগ করে আমাদের ১৯ দিন কথাই বন্ধ ছিল। এটাও দাম্পত্য জীবনের অন্য রকম সৌন্দর্য। মান-অভিমান, ভালোবাসা, মন্দবাসা, রাগ-এসব নিয়েই চলছি আমরা।”

 অভিনয় ও সংসার-দুটোকে সমানতালে সমন্বয় করে কাজ করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী। সংসার গোছানো ও সন্তানদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে অভিনয়ও কমিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েরা বড়, তাই এখন মঞ্চ, টেলিভিশন আর চলচ্চিত্রে সমানতালে কাজ করছেন।

রোজীর কাছে দীর্ঘ সংসার জীবনের সেরা অর্জন তাদের দুই মেয়ে। তিনি বলেন, “তমা ও শ্রীমা দুই কন্যা আমাদের ভালোবাসাকে পূর্ণ করেছে। তাদের নিয়েই আমাদের সুখের সংসার।”

অভিনয় জীবন নিয়ে রোজী বলেন, প্রত্যেক শিল্পীর একটা স্বপ্নের চরিত্র থাকে বলে আমি মনে করি। কারও সেটি পূরণ হয়, কারও হয় না। তবে শিল্পীরা হলেন কাদা মাটির মতো। নির্মাতা যেমন খুশি তেমনভাবে সাজিয়ে নিতে পারেন। 

রোজী-সেলিমের অভিনয় জীবনের অনেকটা জুড়ে আছে হুমায়ুন ফরীদির নাম। তাই অভিনয় জীবনে কোনো শিল্পীর কথা মনে দাগ কেটে আছে কিনা জানতে চাইলে রোজী বলেন, হুমায়ুন ফরীদি ভাইয়ের একটি কথা আজও আমার মনের ভেতরে গেঁথে গেছে। আমাকে এজন্য আবার জন্মভূমি নাটকের বিজলি চরিত্রের কথা বলতে হবে। একদিন ফরীদি ভাই আমাকে অনেক বোঝান। তিনি বলেন, তুই তো ভাগ্যবতী এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিস। সবার কপালে এত জনপ্রিয়তা লেখা থাকে না। রমজান চরিত্রটি যেমন সবার মনে দাগ কেটেছে, বিজলি চরিত্রটিও। তুই এখন থেকে একা একা চলবি। শপিং করবি, বাইরে বের হবি। ফরীদি ভাইয়ের কথাগুলো আজও খুব মনে পড়ে।

শহীদুজ্জামান সেলিম 

সেলিম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় যুক্ত হন নাট্য আন্দোলনে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে ঢাকা থিয়েটারে মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন। এখনো আছেন, তবে অনিয়মিতভাবে। সেলিম জানান, সেসময় আমাদের মঞ্চের অনেক শক্তিমান অভিনেতার সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। তখন আমাদের পরিবেশটাই খুব সুন্দর ছিল। সন্ধ্যায় মানুষ দলে দলে মঞ্চ নাটক দেখার জন্য আসত। আমাদেরও প্রতিদিন মিলনমেলা হতো।

দুজনের প্রেম ও বিয়ে প্রসঙ্গে সেলিম বলেন, ৯১ বা ৯২-এর দিকে রোজীকে আমি দেখেছি। ও তখন রিহার্সেল শেষ হলে প্রতিদিন ঢাকা থিয়েটার ও নাগরিক মহিলা সমিতির বাইরের সিঁড়ির দুই পাশে বসে আড্ডা দিত। আমি ওকে পাই রাক্ষুসীতে। তবে রোজীর সঙ্গে আমার ভালো করে পরিচয় হয় নাটক মোহর আলীতে। এই নাটকের সময় আমার জীবনে একটা ট্রানজিশন চলছিল। ভেবেছিলাম কখনো বিয়েই করব না। তবে রোজীকে ভালো লেগে যায়। তাকে ডেকে একদিন বললাম, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তুমি যদি রাজি থাক তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে পারি। তখন রোজী বলে, আপনি আমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেন। 

দুই মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার সেলিম-রোজীর। প্রায় ৩০ বছরের সংসার জীবন। নিশ্চয়ই মনোমালিন্যও থাকে! দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হয়? সেলিম বলতে শুরু করেন, সংসার জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এক সঙ্গে চলতে গেলে অনেক কিছু ঘটে। তাই বলে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে হবে এটা বিশ্বাস করি না। সত্যি বলতে অনেক অমিল থাকা সত্ত্বেও আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। এটা হলো একটা অলিখিত বোঝাপড়া। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ায় সমস্যা হলে এই দীর্ঘ সময় ধরে কি একই ছাদের নিচে থাকতে পারতাম? মেয়েদের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি, এটাই বড় অর্জন বলে মনে করেন সেলিম।

দুজনই এখনো নিয়মিত অভিনয় করছেন। অভিনয় নিয়ে কোনো আফসোস আছে কি? সেলিম বলেন, দর্শক ভালোবাসে বলেই এখনো নাটক-সিনেমাতে অভিনয় করছি। যতদিন দর্শক চাইবে এভাবে কাজ করতে চাই। এছাড়া একজন অভিনেতা সব সময় চেষ্টা করে ভালো কিছু করতে। তার চাহিদার কোনো শেষ নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার আক্ষেপ থাকবে। আমারও একটা আক্ষেপ এখনো আছে। কিন্তু সেটা কী, জানি না। 

সেলিমের সঙ্গে আলাপচারিতায় অবধারিতভাবে উঠে আসে হুমায়ুন ফরীদির প্রসঙ্গ। স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন, ফরীদি ভাই মজার মানুষ ছিলেন, তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব মাথায় মাথায়। আড্ডা হতো প্রায় দিনই। তাকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাকে চূড়ান্তভাবে মিস করি। আমার জীবনে তিনি সিংহভাগ জায়গা দখল করে আছেন। রোজীর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারেও ফরীদি ভাইয়ের অবদান অনেক। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করি তিনি তখন নাট্য সম্পাদক ছিলেন। আমার থেকে ৪ বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু ছিলেন সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতো। আমার যত বড় বড় মঞ্চের চরিত্র পাওয়া সেগুলো তারই অবদান।

শোবিজ দুনিয়ার এ সময়টা নিয়ে সেলিম বলেন, বর্তমান সময়টা অনেক বেশি অস্থির। সবাই অল্প সময়ে শোবিজে তারকা হতে চায়। কেউ কেউ রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য একমাত্র মাধ্যম হিসেবে মিডিয়াকে বেছে নেয়। কিছুদিন আগেই রুচি নিয়ে আমাদের বিভিন্ন গণমাধ্যমে শ্রদ্ধেয় মামুনুর রশীদের একটা কথা আসে। সত্যি এখন মানুষ যা পাচ্ছে তাই নিচ্ছে।

সেলিম আরও বলেন, একজন প্রকৃত শিল্পীকে অবশ্যই ভালো মানুষ হতে হবে। ভালো মানুষ হওয়ার পাশাপাশি তার অভিনয়কে ভালোবাসতে হবে। কেউ যদি তার কাজকে ভালো না বাসে কাজও তাকে ভালোবাসবে না। অনেকে অভিনয় জগতে আসে। কিন্তু কতজন টিকে আছে? কেউ কেউ অনেক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরও হারিয়ে গেছে। দর্শক তাকে মনে রাখেনি। 

রোজীও তার কথায় সহমত জানিয়ে বলেন, একজন শিল্পীকে সবার আগে ভালো মানুষ হতে হবে। কারণ তাকে অনেকে দেখবে। তার গুণগুলো সাধারণ মানুষ গ্রহণ করবে। কাজের ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই শিল্পী মনে হওয়া চাই। যদি সে তার কাজকে সঠিকভাবে ভালো না বাসে তাহলে অনেকের মতো তাকেও হারিয়ে যেতে হবে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //