সুজেয় শ্যাম। একটি গানের সূর্য। সে সূর্য অস্তপারে ডুবে গেল। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ অক্টোবর দিবাগত রাত ৩টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এ নক্ষত্রের বর্ণাঢ্য সংগীত ক্যারিয়ার। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদান চিরদিন মনে রাখবে জাতি। তার সুরারোপিত গান স্বাধীনতা যুদ্ধে ছিল যেন একেকটি কামান। যে গানগুলো রয়ে যাবে চিরকাল। তার গানগুলো বাজবে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে।
‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম’ সুজেয় শ্যামের সুরে এই গান যুদ্ধকালীন জাগ্রত করেছে যোদ্ধাদের। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নয়টি গানে সুর করেছিলেন বিখ্যাত এই সংগীত পরিচালক। যেগুলো একাত্তরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতারে সম্প্রচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- ‘মুক্তির একই পথ সংগ্রাম’, ‘ওরে শোনরে তোরা শোন’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আজ রণ সাজে বাজিয়ে বিষাণ’, ‘আহা ধন্য আমার’, ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’।
একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ গান এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর প্রথম গানটির সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম। গীতিকার শহীদুল আমিনের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটির সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শাহীন সামাদ বলেন, ‘গান যে হয়ে উঠতে পারে নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের বজ্রনিনাদ, পরাধীনতার শিকড় ছেঁড়ার বড় অস্ত্র- নতুন করে তার প্রমাণ পেয়েছি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে। তখনকার একেকটি গান ছিল মুক্তিকামী বাঙালির বড় এক হাতিয়ার। সম্মুখযোদ্ধা থেকে শুরু করে প্রত্যেক বাঙালিকে সেই গানগুলো একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র ছিনিয়ে আনার শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। সেই গানগুলোর স্রষ্টা যারা, তাদেরই অন্যতম একজন ছিলেন সুজেয় শ্যাম।’
সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে একুশে পদক এবং এর আগে ২০১৫ সালে পান শিল্পকলা পদক।
সুজেয় শ্যাম ১৯৪৬ সালের ১৪ মার্চ সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অমরেন্দ্র চন্দ্র শাহ ছিলেন ‘ইন্দ্রেশর-টি’ নামের একটি চা-বাগানের মালিক। তার শৈশব কেটেছে সিলেটের চা-বাগানে। দশ ভাই-বোনের মধ্যে সুজেয় ছিলেন ষষ্ঠ।
গিটার বাদক ও শিশুতোষ গানের পরিচালক হিসেবে ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চট্টগ্রাম বেতারে কর্মজীবন শুরু হয় সুজেয় শ্যামের। পরে তিনি ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন সুজেয় শ্যাম। ঢাকাই চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য তিনবার শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশ বেতারের প্রধান সংগীত প্রযোজক পদ থেকে ২০০১ সালে অবসরে যান সুজেয় শ্যাম।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই সুরকারের আক্ষেপ ছিল অনেক। তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের আর কেউ খবর নেয় না। বিটিভি এবং বাংলাদেশ বেতার থেকে মাঝে মাঝে ডাকে কাজের জন্য। আর কোনো টেলিভিশন আমাকে ডাকে না। আগে বিভিন্ন দিবসে যেমন- ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এলে আমরা সময় পেতাম না। সব টিভি চ্যানেল ডাকত। এখন কেউ ডাকে না।’ সুজেয় শ্যাম আপনি এক দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। আপনার আর কোনো আক্ষেপ নেই, আর কেউ ডাকবে না। আপনি শান্তিতে থাকুন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সুজেয় শ্যাম অস্তপারে গানের সূর্য বিনোদন সংগীত
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh