বর্তমানে দেশে ফ্যাশনে সচেতন তরুণ-তরুণীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে হ্যান্ড প্রিন্টের ব্যবসার সম্ভাবনাও বাড়ছে। এই ব্যবসায় সফল হতে অনেক বেশি দক্ষ হতে হয় বিষয়টি সেরকমও নয়। অনেক তরুণ-তরুণী এ ব্যবসার মাধ্যমে বেকারত্ব ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাত্র কয়েক হাজার টাকা নিয়েই হ্যান্ড প্রিন্টের ব্যবসা শুরু উদ্যোক্তা আফরোজা হাসানের।
আফরোজার প্রতিষ্ঠানের নাম, ‘এএমপি প্যাশন মোড (AMP Passion MODE)’।
এই উদ্যোক্তার বাবা ছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার প্রথম চশমা ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ। গ্রামের বাড়ি ঢাকা হলেও জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জে। ঢাকার বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছেন আফরোজা।
উদ্যোক্তা আফরোজা হাসান সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, ‘স্নাতক অধ্যয়নের সময় ঢাকার স্বনামধন্য স্কুল সানরাইজ স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। স্নাতক শেষে নিজের কলেজে ‘ওয়ালি নেওয়াজ খান কলেজে’ তার চাকরি হয়। ততদিনে সংসারজীবনে পদার্পণ করে ফেলেছিলেন। একইসাথে এক কন্যা সন্তানের মা বনে যান।
‘মেয়েকে ছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময় থাকতে হবে বলে পরবর্তীতে চাকরিজীবনকে বিদায় জানিয়েছি। নিজের ইচ্ছাকে সেক্রিফাইস করেছি। একসময় সংবাদ উপস্থাপিকা হতে চেয়েছিলাম।’ টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) খণ্ডকালীন সংবাদ উপস্থাপিকার দায়িত্বও পালন করেছেন। মেয়েকে সময় দিতে গিয়ে সেই চাকরিও আর করা হয়ে উঠেনি। এছাড়া বাংলাদেশ বেতারের অনিয়মিত আবৃত্তি শিল্পীর তালিকায় আফরোজা রয়েছেন।
২০০০ সালে আফরোজা কলকাতার এক প্রতিযোগিতায় অভিনয়ে ২০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) চ্যানেলে তার অভিনীত ধারাবাহিক নাটক ‘চন্দ্রাবতী‘ প্রচারিত হয়, এই নাটকটি এটিএন এবং একুশে টিভিতেও প্রচারিত হয়েছে সে সময়ে। এই নাটকের সহশিল্পী ছিলেন টনি ডায়েস, তনিমা হামিদ এবং শংকর শাঁওজাল।
তিনি বিটিভির বেশ কিছু ডকুমেন্টরিতেও কাজ করেছেন। তাছাড়া ছাত্রজীবনে রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের কিছু প্রোগ্রামে সম্পৃক্ত ছিলেন।
নানা অঙ্গনেই তার অর্জন রয়েছে। তবুও নিজের এককভাবে কোনো পরিচয় খুঁজে পাচ্ছিলেন না আফরোজা। একটা সময় নিজের বড় মেয়ের উৎসাহে বনে যান উদ্যোক্তা। তারপর থেকেই নিজের মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে শুরু করে তার।
ব্যবসার পথচলার সময়ের কথা বলতে গিয়ে আফরোজা জানান, করোনাকালীন সময়ে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্নটা নতুন করে মাথায় আসে। তার বড় মেয়ের উৎসাহে তিনি আরো বেশি অনুপ্রাণিত হন।
তিনি বলেন, আমি বেশ ছোট থেকেই ড্রেস ডিজাইন করতাম। ফ্যাশন বুঝতাম। ২০০১ সালে এক বান্ধবীকে নিয়ে নিজের বাসার একটা রুমে ড্রেস ডিজাইনের কাজে নেমে পড়েছিলাম। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছিলাম ‘নকশা’। সেই থেকে উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন মনে গেঁথে ছিলো। কিন্তু পড়ার চাপে সেটা চালানো সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর পরে ফের ২০২০ সালের ৯ অক্টোবর থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা শুরু।
তিনি আরো বলেন, সত্যিকারে অর্থে, অনলাইন ব্যবসার পরিসর যে এতো বিস্তৃত কোভিড সিচুয়েশনের আগে সেভাবে কখনো ভাবিই নি। সারাক্ষণ দুই মেয়ে আর সংসার নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকতাম যে, অনলাইনে বসা হতোনা। করোনাকালে হাতে সময় একটু বেশি ছিলো। সারাক্ষণ বাসাতেই থাকতাম। তখন অনলাইনে ব্যবসার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি। সাহস করে শুরু করি।
আফরোজা হাসান জানান, তিনি মাত্র তিন হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পণ্য বাছাইয়ে তিনি নিজের স্বতঃস্ফূর্ত আর স্বকীয়তাকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
তিনি জামদানি ভীষণ পছন্দ করেন। আর দেশীয় মসলিন, সিল্ক, খাদি এই মূল উপাদানগুলোতে শিল্পীর তুলিতে আঁকা প্রতিটা ক্যানভাস। এগুলোই তার প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণীয় পণ্য।
এছাড়া তার প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজে বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন কভার থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর নানা ধরনের পণ্য রয়েছে।
তার ফেসবুক পেইজে মূলত হ্যান্ডপেইন্ট প্রাধান্য পায় বেশি। এছাড়া ব্লকের কাজও চলে সমান তালে।
কর্মীর বিষয়ে জানান, জামদানি তৈরির জন্য তার দুজন নিজস্ব তাঁতি আছেন। আফরোজা নিজে তাদেরকে ডিজাইন, কালার বলে দেন আর কর্মীরা তৈরি করে দেন। এছাড়াও অন্যান্য তাঁতিদের কাছ থেকেও জামদানি এনে থাকেন। সম্পূর্ণ ঢাকাই জামদানী সরবরাহ করেন।
তিনি নারায়ণগঞ্জ শহরের আশেপাশে থেকে এগুলো সংগ্রহ করে থাকেন। জামদানি শাড়ি ছাড়াও থ্রি পিস, পাঞ্জাবি বানান তিনি। আর হ্যান্ডপেইন্টের জন্য তার নিজস্ব আর্টিস্ট রয়েছে। তারা সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী। কেউ আবার ঢাকার বাইরেও কাজ করছেন। তার এই টিমে কাজ করছেন প্রায় ১০ জন।
ব্লকের কাজও চলে, বিছানার চাদর আর থ্রি বা শাড়ি ব্লক করে সেল করা হয়। ডিজাইনগুলো নিজস্ব। এই টিমে লোক সংখ্যা ৫ জন। এছাড়াও অনলাইনের কাজের জন্য তিনজন মডারেটর, দুজন পার্সোনাল ডেলিভারি ম্যান এবং একজন অফিস সহকারী রয়েছে।
প্রতিষ্ঠান নিয়ে আফরোজা জানান, তার বাসায় কিছু কাজ করা হয়। আর বেশির ভাগ কাজ আর্টিস্টরা নিয়ে গিয়ে কাজ করে দিয়ে যান। সেজন্য আলাদা ফ্যাক্টরি এখনো করা হয়নি। তবে তার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে একটি ফ্যাক্টরি গড়ে তুলবেন। বর্তমানে অনলাইনেই বিজনেস করছেন। পেইজের নাম দিয়েছেন ‘AMP Passion MODE’.
আফরোজা হাসান দেশের ও দেশের বাইরে রপ্তানি নিয়ে বলেন, ‘আমি নিয়মিত রপ্তানি করি না। আমেরিকাতে তিনবার আমার পেইজের বেশ কিছু পণ্য পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড থেকে অনেকে বাংলাদেশে অবস্থান করা তাদের স্বজনদের জন্য আমার পণ্য কিনেছেন ‘
তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশেই মোটামুটি তিনি পণ্য বিক্রি করেছেন। সেটা অবশ্য ডিপেন্ড করে আমার সময় দেবার উপর এবং অর্ডারের উপর। বর্তমানে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা আয় হয়।
ব্যবসা করার মূল কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি আকাশ ছুঁতে পারতাম। শুধু সন্তান-সংসারের জন্য সব ত্যাগ করেছি। কারণ আমার মূল লক্ষ্য সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করা। আমি চাকরিতে জয়েন করলে ওদের দেখার কেউ নেই। বাবা মা দুজনেই ব্যস্ত থাকলে কাজের লোকের কাছে বাচ্চারা মানুষ হবেনা। শেষে নিজের পদ পদবির জন্য নিজের লক্ষ্য মিস হয়ে যাবে, এটাই মনে হতো বারবার। মেয়ে অসুস্থ থাকত প্রতি মাসে। তাই ওকেই পুরো সময়টা দিতে হতো। এখন মেয়ে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছে ওর মায়ের ত্যাগের পাল্লা বেশ ভারি। তাই ওর আগ্রহেই উদ্যোক্তা হওয়া।
‘এছাড়া বাঙালি নারীর ভীষণ দুর্বলতা শাড়ির প্রতি। তাই সেই চিন্তা মাথায় রেখে শুধুমাত্র দেশীয় মোটিফ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। কারণ খুব সামান্য হলেও যদি দেশকে কিছু দিতে পারি তাহলে সেটাই হবে মূল প্রাপ্তি। দেশীয় জামদানি, মসলিন, খাদিতে দেশীয় ফুল পাখি আর গ্রামীণ দৃশ্য ছড়িয়ে দিতে চাই দেশ এবং দেশের বাইরে।’
ভবিষ্যতে নিয়ে পরিকল্পনা সম্পর্কে আফরোজা বলেন, অফলাইনে কাজ করার ইচ্ছা আছে। আর নারীদের সহযোগিতা করতে চাই নিজের পেইজের মাধ্যমে। যারা সুনিপুণ কাজ জানে অথচ প্লাটফর্ম পায়না, তাদের জন্য কিছু করতে চান তিনি।
এএমপি প্যাশন মোড (AMP Passion MODE) এর ফেসবুক পেইজে যেতে এই লিঙ্কে https://www.facebook.com/amppassionmode ক্লিক করুন।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ফ্যাশন উদ্যোক্তা আফরোজা হাসান পণ্য
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh