বায়ুমণ্ডলের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হলো কার্বন। জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন- কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামেও এ গ্যাস সঞ্চিত থাকে। এই জ্বালানি পোড়ানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় এবং একে গ্রিনহাউস গ্যাস বলে। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাষ্প এবং ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের মতো গ্যাস মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী। শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিনিয়ত এই গ্যাস নিঃসরণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছে। এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেখানে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়।
তবে উন্নত দেশগুলো যাতে শিল্পের অগ্রগতি বজায় রাখতে পারে, সে জন্য ‘কার্বন ট্রেডিং’ নামে একটি নতুন ধারণার প্রচলন ঘটে। এই পদ্ধতিতে যে দেশ নির্ধারিত সীমার চেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করবে, তারা সেই পরিমাণ ‘কার্বন ক্রেডিট’ অর্জন করবে, যা বিশ্ববাজারে বিক্রি করা যাবে। অন্যদিকে যেসব দেশ সীমার চেয়ে বেশি নিঃসরণ করবে, তারা এই ক্রেডিট কিনে তাদের নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকার সুযোগ পাবে। এই চুক্তির ফলে উন্নত দেশগুলো অর্থের বিনিময়ে তাদের কার্বন নিঃসরণের বৈধতা পাচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ তো কমছেই না, বরং কার্বন ক্রেডিট কিনে নিয়ে দায়মুক্তি পাচ্ছে এবং অবাধে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে।
যেভাবে হয় কার্বন বাণিজ্য: কার্বন ক্রেডিট পরিমাপ করা হয় কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য মেট্রিক টনে। আর এর লেনদেন হয় বাজারভিত্তিক মেকানিজমে। তবে বাজারের অবস্থা, প্রকল্পের ধরন ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে কার্বন ক্রেডিটের মূল্যে ব্যাপক হেরফের হতে পারে। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের আমলে প্রতি টন কার্বন ডাই-অক্সাইডে কার্বন ক্রেডিটের মূল্য ছয়-সাত ডলারে উঠে যায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে তা এক-দুই ডলারে নেমে আসে।
কার্বন ক্রেডিট কীভাবে কাজ করে: গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমায় বা করে না- এমন সব প্রকল্পের মাধ্যমে কার্বন ক্রেডিট অর্জন করা যায়। এই প্রকল্পগুলো অনেকভাবে নেওয়া হতে পারে- বায়ু, সৌর, জল ও ভূ-তাপীয় বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উদ্যোগ; ভবন, কারখানা বা পরিবহন ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়ায় এমন জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রকল্প; নতুন বন তৈরি বা ক্ষয়প্রাপ্ত জমি পুনরুদ্ধারে বনায়ন ও পুনর্বনায়ন প্রকল্প; ভাগাড় থেকে নিঃসৃত মিথেন ধরে রাখার প্রকল্প প্রভৃতি। এই প্রকল্পগুলো সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করা হয় এবং জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের (ইউএনএফসিসি) মতো স্বীকৃত তৃতীয় পক্ষের সংস্থা দ্বারা প্রত্যায়িত হয়। প্রত্যয়নের পর একটি প্রকল্প কার্বন ক্রেডিট অর্জন করতে থাকে। এই ক্রেডিট কার্বন বাজারে বিক্রি বা লেনদেন করা যায়, যা দেশ, ব্যবসা ও ব্যক্তিদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে বরাদ্দের অস্তিত্বই নেই, সেই ক্রেডিট হস্তান্তরের প্রশ্নটি অবান্তর। এটি কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না। বাস্তবে উদ্বৃত্ত বরাদ্দের বিক্রয় প্রক্রিয়াটি রাষ্ট্রগুলোর কাছে এখন পর্যন্ত তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। চীনের কিছু কোম্পানি কার্বন ক্রেডিট অর্জন এবং তা বিক্রির জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসের কৃত্রিম উৎপাদন শুরু করেছে। ইদানীং ভারতেও এই অসাধু প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটি কার্বন বাণিজ্যের জন্য আরো একটি অশনিসংকেত।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির শীর্ষে থাকলেও বাংলাদেশ এর জন্য দায়ী নয়। কিয়োটো প্রোটোকলে কার্বন নিঃসরণের যে মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার চেয়েও কম কার্বন নির্গত হচ্ছে। এ দেশে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুন্দরবন, যার কার্বন শোষণের ক্ষমতা অনেক বেশি। এ জন্য সরকার সুন্দরবন ছাড়াও আরো ১১টি বনকে কার্বন বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করছে। ২০০৬ সালে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) তাদের প্রথম ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম প্রকল্পটি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনে নিবন্ধিত করার সময় প্রথমবারের মতো কার্বন ক্রেডিট থেকে আয় করে বাংলাদেশ। এর পর থেকে ইডকল প্রায় ২.৫৩ মিলিয়ন কার্বন ক্রেডিট বিক্রি করে ১৬.২৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে, বর্তমান বিনিময় হারে যা ১৭০ কোটি টাকার সমান। এই কার্বন ক্রেডিট আয়ের বেশির ভাগই এসেছে উন্নত রান্নার চুলা (আইসিএস) থেকে। বাকি আয় এসেছে সোলার হোম সিস্টেম থেকে।
ক্রেতা কারা: কার্বন ক্রেডিট মূলত এক ধরনের অনুমোদন, যার মাধ্যমে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি এক টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বা অন্য কোনো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অধিকার লাভ করে। কার্বন ক্রেডিটের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো কার্বনের ওপর মূল্য ধার্য করে এর নিঃসরণ কমাতে উৎসাহ দেওয়া। যেসব কোম্পানি স্বেচ্ছায় অথবা নিয়ম মেনে কার্বন নিঃসরণ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে এবং যেসব কোম্পানির নিজস্ব কার্বন নিঃসরণে ভারসাম্য আনতে হবে, তারাই কার্বন ক্রেডিটের ক্রেতা। এমন কয়েকটি কোম্পানি হলো মাইক্রোসফট, রয়্যাল ডাচ শেল, বিপি, টোটাল এসই, নেসলে, গুগল, অ্যাপল, অ্যামাজন, ডেল্টা এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ারলাইনস, কোকা-কোলা, জেনারেল মটরস, জেপিমরগ্যান চেজ ও গোল্ডম্যান স্যাকস।
কেন কার্বন বাজারের বিষয়টি বিতর্কিত: সমালোচকরা মনে করেন যে কার্বন ট্রেডিং ধনী দেশগুলোকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এড়িয়ে যেতে সহায়তা করে, তারা তাদের দূষণকারী কার্যক্রম বজায় রাখতে যতটুকু ক্রেডিট ক্রয় করা প্রয়োজন ততটুকু ক্রয় করে থাকে।
আরেকটি সমস্যা হলো কার্বন লিকেজ- এটি ঘটে মূলত যখন কোম্পানিগুলো তাদের দূষণকারী কর্মকাণ্ড এমন দেশে নিয়ে যায় যেখানে কার্বন নির্গমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না, তাই তাদের উৎপাদিত দূষণ মোকাবিলায় নিজেদের ক্রেডিট দিতে হয় না। এই ঝুঁকি রোধে ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম বা সিবিএএম অনুমোদন করে, যার অধীনে ইইউ আমদানিকারকরা নিজ ব্লকের বাইরে থেকে ক্রয় করা পণ্য থেকে কার্বন নির্গমনের খরচ নিশ্চিত করে এবং এটি এমনভাবে করা হয় যেন তারা ইইউ নির্গমন ট্রেডিং সিস্টেমের অংশ।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্বন ট্রেডিং কোনো ভালো উদ্যোগ নয়। বরং এটি উন্নত বিশ্বের একটি পরিকল্পিত ফাঁদ। আপাতদৃষ্টিতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে মনে হলেও অদূর ভবিষ্যতে এ দেশগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh