সালভাদর দালির খেয়ালিপনা

চিত্রকর সালভাদর দালি ছিলেন ভীষণ খেয়ালি মানুষ। শৈশব থেকেই দালি চাইতেন মানুষ তাকে অবাক বিস্ময়ে দেখুক। বলুক, ওই তো দালি যাচ্ছে! কেবল সাধারণ মানুষ নয়, তিনি নিজের পরিবারেরও বিশেষ মনযোগ চাইতেন।

অসংখ্য উদ্ভট ঘটনার সৃষ্টি করে যৌবনেই দালি পৌঁছে যান স্পেনীয়দের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পরে যখন নিউইয়র্ক যান, তখন অপরিচিত নিউইয়র্কবাসীর কাছে নিজেকে তুলে ধরতে দালি রাস্তায় ঘণ্টা নিয়ে হাঁটতেন।

যখন মনে হতো পথচারীরা তাঁর ওপর দৃষ্টি দিচ্ছে না, অথবা বেশি মানুষের সমাগম যেখানে-তিনি সেখানে একটানা ঘণ্টা বাজাতে শুরু করতেন। ফলে জনসাধারণ তাঁকে দেখতে বাধ্য হতো।

তাঁর এমন কান্ডের সুবাদে অল্প কদিনেই দালি শহরের খুব পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন। দালিকে রাস্তায় হাঁটতে দেখলেই পথচারীরা উদগ্রীব থাকত- এই বুঝি উদ্ভট কিছু ঘটল। অনেক সমালোচক তাই মন্তব্য করেছেন- দালি তাঁর বিচিত্র, অস্বাভাবিক কর্মকান্ড দ্বারা আগে জনপ্রিয় হয়েছেন, পরে হয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী!

চিত্রকর হিসেবে দালি ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান। স্কুল পর্যায় শেষে তিনি ভর্তি হলেন মার্দ্রিদ একাডেমি অব আর্টে, সেখানে ভর্তি হবার কদিন না যেতেই দালি দাবি করলেন, একাডেমিতে একজন ছাড়া সব শিক্ষক শিক্ষকতা করার অযোগ্য! আরেকবার পরীক্ষার হলে দালি শিক্ষকদের বললেন-‘দুঃখিত, কিন্তু এখানে উপস্থিত তিনজন অধ্যাপকের চেয়ে নিজেকে অধিক যোগ্য মনে করি। অতএব, এই কমিটি দ্বারা পরীক্ষিত হতে আমি অস্বীকার করছি।’

উদ্ভট কথা আর কর্মকান্ডের জন্যে এখানে পড়াকালীন তিনি একবার জেলও খাটেন। পরবর্তীতে দালিকে একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯২৫ সালে দালি আবার এখানে ভর্তি হন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই তাঁকে আবারও একাডেমি ছাড়তে হয়। কেননা কর্তৃপক্ষ এবার স্বীকার করে বললেন, ‘সালভাদর দালিকে শেখানোর মতো বিদ্যা এখানে আর কারও নেই।’

তখন সালভাদর দালির বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর! অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী দালি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে নিজেকে ‘জিনিয়াস’ বলতেন। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন- ..স্বীকার করছি, ১৯২৯ সাল থেকে আমি যে একজন জিনিয়াস, সে ব্যাপারটা সচেতনভাবে আমার কাছে ধরা পড়ে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন- ‘প্রতিদিন সকালে আমি যখন জেগে উঠি, আমি আমার সেই সর্বোচ্চ আনন্দ লাভ করি-সালভাদর দালি হবার আনন্দ।’ 

দালি যে ধরনের গোঁফ রাখতেন, সম্ভবত বিশ্বের কেউ এর আগে এমন অদ্ভুত সরু গোঁফ দেখেনি। দালির ছবির মতোই তাঁর গোঁফ ছিল জনপ্রিয়। গোঁফ ছিল খুবই সরু, আর নানা ঢংয়ে বাঁকানো। তাঁর এই গোঁফের ব্যাপারে মানুষজনের আগ্রহ ছিল প্রচুর।

দালি একবার দর্শনার্থীদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তারা কি আমার ছবি দেখতে আসে? মোটেও না! তাদের সবার আগ্রহ আমার গোঁফের ব্যাপারে। মহৎ চিত্রকল্প সাধারণ মানুষের দরকার নাই। দরকার খালি একটা জম্পেশ গোঁফ!’ তাই চিত্রশিল্পী দালি, ব্যক্তি দালি ও গোঁফঅলা দালির মধ্যে আনন্দপ্রিয় মানুষ হয়তো সবার আগে গোঁফঅলা দালিকেই বেছে নেবে।

দালি নিজেই বলতেন, কোনোদিন মানুষ হয়তো এই গোঁফজোড়ার মতোই অদ্ভুত আরেকটা সত্য আবিষ্কার করবে- ‘ও হ্যাঁ, সালভাদর দালি? ওই গোঁফঅলা? সম্ভবত ছবিটবি আঁকত!’ ব্যক্তি হিসেবে তো বটেই, শিল্পী হিসেবে তাঁর পাগলামি ছিল অভাবনীয়।

একবার মরিস নামে এক ব্যবসায়ী তাঁর নতুন শো-রুম সাজসজ্জার জন্য দালিকে নিয়োগ করলেন। মরিসের উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত কাউকে দিয়ে শোরুমের সাজসজ্জা করলে মানুষজন তাতে আকৃষ্ট হবে। ব্যবসায়ের ব্যাপক প্রচার হবে। তাই তিনি দালিকে ঠিক করেছিলেন।

কারণ দালি ততদিনে জনপ্রিয়, বিশ্বের মানুষের কাছে আগ্রহের অন্যতম বিষয়। কিন্তু শো-রুম উদ্বোধনের দিন যতই এগোচ্ছে, মরিস দেখলেন দালি কোনো কিছুই করেননি। মরিস জানতে চাইলে দালি বলেন, উদ্বোধনের দিনই তাঁর কাজ সুসম্পন্ন হবে। শোরুম উদ্বোধনের দিনে আবারো সেই দালিচিত কাজটি হলো। সবাই এসে দেখলেন স্যুররিয়ালিজমের মহান শিল্পী শোরুমের একটি কাচের পাত্রে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন! আর এ খবর পেয়ে সাংবাদিক, কৌতূহলী মানুষজন ছুটতে লাগলেন মরিসের শোরুমের দিকে। হাজার হাজার মানুষ সেদিন এলো দালির এই কান্ড দেখতে।

দালি মরিসকে হেসে বললেন- কেমন হলো সাজসজ্জা!

দালি মনে করতেন খেয়ালিপনা তাঁর প্রকৃতিগত। তিনি বলতেন, ‘আমি চাই বা না চাই, খামখেয়ালিপনা আমার নিয়তি।’ তিনি ভাবতেন তিনি নিয়তিকে এড়াতে পারছেন না। তাঁর আত্মজীবনীতে জানিয়েছেন, ১৯২৮ সালে ফিগেরাসে তিনি আধুনিক চিত্রকলা বিষয়ে বক্তব্য রাখছিলেন।

সে অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন শহরের মেয়র। দালির বক্তব্য শেষ হতে না হতেই তিনি হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। কোনো কোনো পত্রিকা ঘটনা সম্পর্কে লিখল- সালভাদর দালির ভাষণের গভীরতার ভার সইতে না পেরে মেয়র সাহেব মারা গেছেন! দালি মনে করতেন অশুভ কিছুর যেন তাঁর বক্তৃতার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আছে।

আরেক বছর বার্সেলোনায় একটি নাট্যশালায় যেদিন তাঁর বক্তৃতা দেওয়ার কথা সেখানে সেদিন সকালে আগুন ধরে যায়। এছাড়া বক্তব্য রাখতে গিয়ে দালি একবার একজন ডাক্তারের ক্রোধের আগুনে পড়েন। ডাক্তার দালিকে খুন করতে উদ্যত হয়। এমন অসংখ্য ঘটনা- যেমন দালির জীবনকে বর্ণিল করেছে, তেমনি করেছে রহস্যময়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //