মাতৃভাষা

দুনিয়ায় অনেক রকম অদ্ভুত প্রশ্ন আছে। ‘বাঙ্গালী মুছলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দ্দু না বাঙ্গালা?’ এই প্রশ্নটা তাহার মধ্যে সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত। নারিকেল গাছে নারিকেল ফলিবে, না বেল? যদি কেহ এই প্রশ্ন লইয়া আমাদিগের সহিত তর্ক করিতে আইসেন তাহা হইলে আমরা তাহার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হইবার পরিবর্ত্তে বন্ধুদিগের নিকট হইতে চাঁদা সংগ্রহ করিয়া তাহাকে বহরমপুরের টিকিট কিনিয়া দিতে চেষ্টা করিবো।

মুছলমান যেদিন হইতে বঙ্গজননীকে নিজের মাতৃভূমিরূপে বরণ করিয়াছে, সেইদিন হইতে সংবাদপত্রে আলোচনা বা সাহিত্য-সমিতিতে প্রস্তাব উপস্থাপন না করিয়াও সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে বঙ্গভাষাকে তাহারা আপনার মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে। বঙ্গে মোছলেম ইতিহাসের সূচনা হইতে আজ পর্যন্ত বাংলা ভাষাই তাঁহাদের লেখ্য ও কথ্য মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিয়াছে এবং ভবিষ্যতেও মাতৃভাষারূপে ব্যবহৃত হইবে।

এ দেশে মুছলমানের প্রাদুর্ভাব আর বঙ্গভাষার উৎকর্ষ- ইতিহাসের একই পৃষ্ঠায় লিখিত আছে। মুছলমান বঙ্গভাষাকে নিজের মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই বরং তাহারাই যে বঙ্গভাষার প্রথম পৃষ্ঠপোষক ও উৎসাহদাতা ছিলেন ইতিহাস এ কথার সাক্ষ্য দিতেছে।

দীর্ঘ ছয়টি শতাব্দী অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে, যখন বঙ্গভাষা নিতান্ত দীনহীনা বেশে তখনকার বিদ্ব্যোৎসমাজের ও হিন্দু নরপতিদিগেরও নিকট আশ্রয় ভিক্ষা করিয়া হতাশ হইয়াছিল, যখন ‘ললিত-লবঙ্গলতা পরিশীলন- কোমল মলয়-সমীরের’ ন্যায় পদ আওড়াইতে না পারিলে কেহ লোকের নিকট শিক্ষিত বলিয়া পরিচিত হইতে পারিতেন না, যখন বঙ্গভাষায় শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদকগণের জন্য তখনকার ব্রাহ্মণ পন্ডিতরা ব্রাহ্মণঘাতী ইত্যাদি মহাপাতকীদিগের জন্য নির্ধারিত ‘রৌরব’ নামক ভীষণ নরকের ব্যবস্থা করিতেছিলেন, বঙ্গভাষায় সেই অতি কঠিন বিপদের সময় মুছলমানই তাঁহাকে পঞ্চগৌড়েশ্বরের মণিমুক্তা বিখচিত রাজসিংহাসনে বসাইয়া রাজ রাজেশ্বরী করিয়া দিয়াছিলো।

গৌড়ের মুছলমান সম্রাটগণের দরবারে বঙ্গভাষার এই প্রতিপত্তি দেখিয়া অধীন হিন্দুরাজা এবং জমিদারগণও ক্রমে তাহার প্রতি সম্মান দেখাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তাই ত নছির শাহকে সম্বোধন করিয়া অমর কবি বিদ্যাপতি ‘চিরঞ্জীব বহু পঞ্চ গৌড়েশ্বর’ বলিয়া আশীর্বাদ করিয়াছিলেন।

কৃত্তিবাস, কাশীরাম, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, বিদ্যাপতি, যশোরাজ খান, গুণরাজ খান, বিজয়গুপ্ত, কবিরাজ কৃষ্ণদাস প্রভৃতি প্রথম যুগের মহাকবিগণকে আশ্রয় ও উৎসাহ দিয়া নছির শাহ, হোসেন শাহ, পরাগল খাঁ, ছোটে খাঁ, মাগন ঠাকুর প্রভৃতি আমাদের পূর্ব পুরুষগণই বঙ্গভাষার গৌরব- সৌধের ভিত্তি স্থাপন করিয়া গিয়াছেন।...

... ভক্তগণের আন্তরিক সেবা ব্যতীত কোনো ভাষাই সাহিত্যে পরিণত হইতে পারে না। আবার যে জাতির নিজস্ব সাহিত্য না, জগতে জাতি হিসাবে তাহার কোনো অস্তিত্ব নাই। কাল-চক্রের আবর্ত্তন-বিবর্ত্তনে পড়িয়া সকল মানব সমাজকে এক এক সময় অতি মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হইতে হয়।

এই সময় একমাত্র তাহাদের জাতীয় সাহিত্যই তাহাদিগকে বাঁচাইয়া রাখিতে পারে। এই সকল কারণে মাতৃভাষার সেবা করা প্রত্যেক দেশবাসী ও প্রত্যেক মানবের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক হইয়া দাঁড়ায়। শরীর রক্ষার জন্য যেমন বিভিন্ন খাদ্য হইতে বিভিন্ন রস গ্রহণ করিতে হয়, (যে ব্যক্তি যত অধিক পরিমাণে বিভিন্ন বস্তুর রস গ্রহণ করিতে পারে, তাহার দেহ ততই হৃষ্ট-পুষ্ট ও সুকান্তি বিশিষ্ট হয়), ঠিক সেইরূপ মাতৃভাষার মধ্যবর্ত্তিতায় বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন ভাষার অফুরন্ত জ্ঞান-ভান্ডার হইতে রস সঞ্চয় করিয়া সাহিত্যের পুষ্টি সাধন করিতে হয়। মানব দেহের ন্যায় সাহিত্যেও নানাবিধ বিভিন্ন রকমের রস ও ভাব সঞ্চিত ও সংগৃহীত হওয়া আবশ্যক।...

... মাতৃভাষার সেবা করা প্রত্যেক মুছলমানের পক্ষে একান্ত কর্তব্য হইলেও আমাদের আলেমগণ ধর্মের হিসাবে মাতৃভাষার সেবা করিতে বাধ্য। এ সম্বন্ধে আমি আঞ্জুমানে ওলামার আনুষ্ঠানিক সভার অভিভাষণে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছি। এছরাইল বংশের মধ্যে যুগে যুগে এবং দেশে দেশে নূতন নবী ও নূতন কেতাব আসিয়াছিল, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস এই যে ইসলাম সকল দেশের, সকল যুগের, সকল জাতির সাধারণ ধর্ম এবং আমাদের হযরত শেষ নবী, তাঁহার পর আর কোন নবী বা পয়গম্বর আসিবেন না।

এখন জিজ্ঞাস্য এই যে, এছলামের সত্যগুলিকে জগতের সকল দেশে সকল যুগে সকল জাতির মধ্যে প্রচার করিবেন কাহারা? ইহার উত্তরে কথিত হইয়াছে, ‘ওলামা ও উম্মাতিকা আম্বিয়ায়ে বাণি এছরাইল’, অর্থাৎ এই শেষ নবীর উম্মতের আলেমগণই পূর্বযুগের নবীগণের কর্তব্য সমাধা করিবেন।

সুতরাং আমরা দেখিতে পাইতেছি যে, বাঙ্গালার আলেমগণই বঙ্গদেশের ধর্ম প্রচারের জন্য দায়ী। ভাষা সমস্যার সমাধান স্বয়ং কোরআনই করিয়া দিতেছে। ‘অ-মা আর-ছালনা মির্রাছুলেন, ইল্লা বে- লেছানে কাত্তমেহি লে-য়ুবায়্যোনা লাহুম’ ইহার ভাবার্থ এই যে প্রচারক ও উপদেষ্টা নিজের জাতিকে মাতৃভাষার দ্বারাই ধর্মোপদেশ প্রদান করিবেন নচেৎ তিনি অন্যের ভাষা অবলম্বন করিলে তাঁহার উদ্দেশ্য সফল হইবে না।

এই কারণে আল্লাহতাআলা প্রত্যেক জাতির নিকট তাহাদের মাতৃভাষা ভাষী নবীদিগকে পাঠাইয়াছেন। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের আলেম মহোদয়গণ আজও কোরআনের নির্ধারিত চিরাচরিত ঐশিক বিধানের প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য প্রদর্শনে কুণ্ঠিত হইতেছেন। বঙ্গীয় আলেম সমাজের প্রভাব যে শিক্ষিত সমাজ হইতে কমিয়া যাইতেছে, সাধারণভাবে তাহাদের সাধনা যে সিদ্ধিলাভ করিতে পারিতেছে না, মাতৃভাষার অনভিজ্ঞতা তাহার একটা প্রধান কারণ।

পূর্বের আলেমগণ কেবল মাতৃভাষার পারদর্শিতা লাভ করিয়া ক্ষান্ত হন নাই, হিব্রু, গ্রীক, সংস্কৃত, লাটিন প্রভৃতি সমস্ত ভাষা আয়ত্ত করিয়া তাহার জ্ঞানভা-ারকে সম্পূর্ণ রূপে নিজস্ব করিয়া লইয়াছিলেন। আর আমরা নিজেদের মাতৃভাষাটাও শিখিতে পারিব না, ইহা অপেক্ষা ক্ষোভের কথা আর কি হইতে পারে? অনেকে আবার বাঙ্গালার পরিবর্তে উর্দ্দুতে কথোপকথন করাই গৌরবজনক মনে করেন, কিন্তু অধিক স্থলে উর্দ্দুর যে প্রকার আদ্যশ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করা হয়, তাহার শুনিয়া হাস্য সম্বরণ করা কষ্টকর হইয়া দাঁড়ায়। নব্য আলেম সমাজ আজ ইহা সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন, ইহা আনন্দের কথা।

আলেম সমাজের মধ্যে আজ হইতে অর্ধ শতাব্দী পূর্বে এই কর্তব্যবোধের সূচনা হইয়াছে, এবং বঙ্গভাষার সেবায় মনোযোগী না হওয়ায় যেখানে তাহা-দিগের প্রতি অনুযোগের যথেষ্ট ন্যায্য কারণ আছে, সেইখানে আনন্দ ও গৌরবের সহিত বলা যাইতে পারে যে, তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ কেবল মাতৃভাষার সেবকই নহেন বরং মাতৃভাষার সেবার পথ-প্রদর্শকের আসন পাইবার যোগ্য।

বাঙ্গালা ভাষায় কথা বলা এবং বাঙ্গালী নামে পরিচিত হওয়া যখন শিক্ষিত মুছলমানদিগের নিকট অকৌচিত হইত, সেই সময় আমাদের আলেমগণই সর্বপ্রথম বঙ্গভাষার সেবায় মনোযোগ প্রদান করিয়া ছিলেন। বঙ্গীয় মুছলমান সমাজের মধ্যে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র, যে একজন ‘ মৌলবী’ কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছিল, একথা শুনিলে অনেকে হয়তো আশ্চর্য্যবোধ করিবেন।

...মুছলমানী বাঙ্গালার ‘কটমটবুলি’ আর চলিবেনা। কাজেই আমাদের “শিক্ষিত” সমাজের কবিকে এখন সাধু-ভাষার আশ্রয় লইতে হইবে। সাধু-ভাষঅর আশ্রয় লওয়ার বিরুদ্ধে মত দিবার মত অসাধু কাজ আর কি হইতে পারে? কিন্তু অসাধু মুছলমানী বাঙ্গালা আর সাধু মুছলমানী বাঙ্গালায় প্রভেদ কোথায়, আমাদিগকে ইহা ভাল করিয়া বুঝিয়া দেখিতে হইবে। বাঙ্গালা ভাষঅর রীতি-নীতি ও বাঙ্গালা ব্যাকরণের ধারাপদ্ধতি বজায় রাখিয়া যদি তাহাতে দরকার মত অন্য ভাষার কতকগুলি শব্দ ব্যবহার করা হয়, তাহা হইলে সে বাঙ্গালা কি অসাধু হইয়া যাইবে?

তাহা হইলে আজ-কালকার শিক্ষিত হিন্দু সমাজের কথিত ভাষাকে একেবারে ঘোর অসাধু বলিতে হইবে? সাধারণভাবেও শত শত আরবী, পার্সী এবং আজকাল ইংরাজী শব্দ বাঙ্গালা ভাষায় এমন বেমালুমভাবে দখলী-স্বত্ব করিয়া লইয়াছে যে সেগুলিকে বে-দখল করিয়া দিলে বাঙ্গালীকে একেবারে বোবা হইয়া বসিতে হইবে। সেগুলি যখন সকলের বহাল তবিয়তে বিনা ওজর আপত্তিতে চলিয়া যাইতেছে, তখন আমাদের দরকার মত দুই-চারিটা আরবী-পার্সী শব্দ ব্যবহার করিলে ভাষার সাধুতার খর্ব বা হানি হইবে কেন? ধর্মের বিশিষ্টতার খাতিরে ঐ শব্দগুলি না চালাইয়া আমাদের কোন চারা নাই।

এ সম্বন্ধে সাহিত্যের উপর আদালতে ফয়সলা হইয়া গিয়াছে যে, যে সকল শব্দ হাল বন্দোবস্তের পূর্বে ভাষার দফতরে নাম জারি করিয়া লইয়াছে, তাহাদিগকে কায়েমী স্বত্ব দিতে তরফ ছানীরও কোন ওজর-আপত্তি থাকিতে পারে না। এতদসত্ত্বেও আমাদের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা কেন যে আমাদিগকে আল্লাহ, রসুল, নামাজ, রোজা প্রভৃতি শব্দকে ভিটাচ্যুত করিবার উপদেশ দিতেছেন, আমি তাহা বুঝিতে অক্ষম। ঐ সকল শব্দ বর্জন করিয়া যে ভাষা হইবে, তাহা ‘সাধু’ হইতে পারে, কিন্তু বাঙ্গালী মুছলমানের মাতৃভাষা তাহা নহে।

সাহিত্য আদালতের এই ফয়সলা ছাড়া যুক্তির দিক দিয়া আলোচনা করিলেও, এই আরবী-পার্সী শব্দগুলির স্বপক্ষে বলিবার কথা অনেক আছে। তাহার মধ্যে একটা কথা এই যে, ঐ সকল শব্দের ঠিক প্রতিশব্দ বাঙ্গালা ভাষায় পাওয়া যায় না। ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট বাঙ্গালা শব্দগুলির সঙ্গে সম্পর্ক হিন্দুর বিশ্বাস ও সংস্কারের, সুতরাং পৌত্তলিক ভাবের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। আল্লাহর স্থলে ঈশ্বর হইতেই পারে না। আল্লাহ মৌলিক শব্দ, এক আল্লাহ ব্যতীত কুত্রাপি তাহার ব্যবহার হইতে পারে না।

...তবে যুগপদভাবে আমি ইহাও স্বীকার করিব যে, বিশেষ আবশ্যক না হইলে অপ্রচলিত নূতন আরবী-পার্সী শব্দের আমদানী করা বা জেদ করিয়া বাংলার মধ্যে কতকগুলি কঠিন আরবী পার্সী শব্দ চালাইয়া দিবার চেষ্টার কোন মূল্য নাই। ন্যূনাধিক দুই সপ্তাহের কথা, জনৈক ভদ্রলোক (ভদ্রলোক বিশেষণটার এখানে অপপ্রয়োগ হইল কি?)

একজন মুছলমান ব্যারিষ্টারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য হাইকোর্টের বার লাইব্রেরীতে গমন করিয়াছিলেন। আলাপ প্রসঙ্গে তিনি- অবশ্য বাঙ্গালা ভাষায়- বলিতে আরম্ভ করিলেন, “এক জমানা হ’তে যনাবের কদম বুছীর শরফ হাছেল করার এশতিয়াকে মনে খুবই এজত্রার ছিল, কিন্তু কেছমতের গর্দ্দেশে এতদিন নায়াজ হাছেল করার এত্তেফাক ঘটে নাই।” (কথাগুলি যথাসম্ভব অবিকল উদ্ধৃত হইল।) এ বদর্চ্চাচি বাঙ্গালা চালাইতে আমরা যেমন অসম্মত, সেইরূপ সেইরূপ “বাণীর সেবা-মন্দিরে প্রবেশ করত মা বাগদেবীর পূজা” করিতেও আমরা নারাজ। ইহাতে “ভাগ্য লক্ষ্মী সুপ্রসন্ন” না হইলে লাচার!

...আমাদের দেশের উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি ইংরাজী ভাষার মিডিয়মে শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। ইহা যে অন্যায় ও ক্ষতিজনক দেশের চিন্তাশীলও মনীষীবর্গ সকলেই প্রায় একবাক্যে একথা স্বীকার করিয়াছেন। বিদেশী ভাষা আয়ত্ত করিয়া তাহার মধ্য দিয়া জ্ঞান আহরণ করা বহু আয়াস, সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। আমাদের ছাত্রেরা জ্ঞানানুশীলনের উপকরণ স্বরূপ এই ইংরাজী শিখিতে শিখিতেই হাঁপাইয়া পড়ে- জ্ঞানের সেবা করিবার মতো উদ্যম ও সময় তাহাদের থাকে না।

জ্ঞানকে দেশে স্থায়ী ও সাধারণ অধিকারভুক্ত করিতে হইলে দেশের স্থায়ী ও সাধারণ ভাষায় তাহার শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করিতে হইবে। ইংরাজী মিডিয়মের দ্বারা তাহা হইতে পারে না। অতীতের আরব এই সত্য বুঝিয়াছিল বলিয়া এক শতাব্দী মধ্যে ইউরোপের শিক্ষাগুরুর আসন লাভ করিতে পারিয়াছিল। জ্ঞান-গরিমায় আরবজাতির বিরাট সত্তা জগদ্বাসীর নিকট হইতে সম্মান লাভ করিয়াছিল- জ্ঞানে বিজ্ঞানে আরব জগতের আদর্ম হইয়াছিল।

বর্তমানের নব্য জাপান আজ এই সত্য উপলব্ধি করিয়াছে বলিয়া আজ শুধু এশিয়ারই নহে, বরং গোটা বিশ্বের সম্মুখে, জাতির হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। মাতৃভাষার সাহায্যে জ্ঞানের অনুশীলন যে কিরূপ সফল এবং কিরূপ ব্যাপক হইয়া দাঁড়ায়, জাপানী ভাষায় এমন সব বই পড়েছে যে আমাদের শিক্ষিত লোকেই সে সব পড়ে না। আমার বাড়ীর বালিকা দাসী যখন বল্লে যে, তার ‘সাধনা’ পড়তে ভাল লাগে, তখন বিস্মিত হয়েছিলুম।

তারপর যখন দেখালো যে ‘সাধনা’র জাপানী অনুবাদ তার হাতে আছে, তখন আরও বিস্মিত হলুম। সেখানকার সাধারণ ব্যক্তি সমাজে যাদের বড় স্থান নয়- তারা সকলেই উৎসাহের সঙ্গে জ্ঞানালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছে। নূতন যুগের নূতন রস, নূতন বার্ত্তা তাদের মনকে অভিষিক্ত করেছে। এর প্রধান কারণ মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বের জ্ঞানের রস পেয়েছে।” আরবও ঠিক এমনই করিয়া বিশ্বের সকল ভাষা ও সকল জ্ঞানের রস, আপনাদের মাতৃভাষার মধ্য দিয়া পান করিয়াছিল। আমাদিগকেও তাহাই করিতে হইবে। এজন্য আবশ্যক মত নূতন নূতন পরিভাষা গড়িয়া লইতে হইবে।

বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সম্বন্ধে আমাদিগকে প্রথমে মাতৃভাষার ভান্ডার খুঁজিয়া দেখিতে হইবে। তাহাতে যদি ঠিক শব্দ পাওয়া না যায়, তাহা হইলে বিদেশী পরিভাষার ধাতুগত অর্থ লইয়া মাতৃভাষার নূতন শব্দ গড়িয়া লইতে হইবে। এই নূতন শব্দগুলির ‘ধাতু’গত অর্থের এবং যতদূর পারা যায় উচ্চারণের সঙ্গে মূল পরিভাষার উচ্চারণও ধাতুগত অর্থের সামঞ্জস্য রাখিয়া চলিবার চেষ্টা করিতে হইবে।

এই হিসাবে “হাইড্রোজেন” ও “নাইট্রোজেনে”র স্থলে “আদ্রজন” ও “ নেত্রজন” সকল দিক দিয়া বেশ খাপ খাইয়া যায়। যেখানে এইরূপ খাপ খাওয়ান সহজ না হয়, সেখানে মূল পরিভাষাগুলিকে চালাইয়া দেওয়াই সুবিধাজনক বলিয়া বোধ হয়। এরূপ স্থলে বহু কষ্ট-কল্পনার সাহায্য লইয়া ঐ স্থলে ‘অপভাস্কর অম্ল’ এবং ‘ভাস্করসক্ষক্লোরিদ’ চালাইবার চেষ্টা সঙ্গত হইবে বলিয়া বোধহয় না।

প্রাচীন আরব পন্ডিতগণ ঠিক আমাদের ন্যায় সমস্যায় উপনীত হইয়া মাতৃভাষার মধ্য দিয়া ল্যাটিন, গ্রীক ও সংস্কৃতের পরিভাষাগুলোকে যে নীতি অনুসারে অনূদিত ও নিজস্ব করিয়া লইয়াছিলেন, উপরে তাহারই আভাস দেওয়া হইল। আমার বোধ হয় ইউরোপও স্বীয় শিক্ষাগুরুর অবলম্বিত নীতির অনুকরণ করিয়া এই সমস্যার সমাধান করিয়াছিল। তাই ইউরোপীয় জ্থাবিজ্ঞানের সকল অংশেই আজ আমরা শত শত আরবী বা আরবী ফর্মায় ঢালা শব্দের প্রচলন দেখিতে পাইতেছি।....

....উপসংহারে সর্বাপেক্ষা আবশ্যকীয় এই হিন্দু-মুছলমানের মিলন প্রসঙ্গের উল্লেখ করিয়া মধুরেণ সমাপয়েৎ করিবো। হিন্দু-মুছলমান বঙ্গ-জননীর যুগল সন্তান। রাজনীতিক্ষেত্রে আজ উভয় ভ্রাতা পরস্পরকে আলিঙ্গন দিতে পারিয়াছে, ইহা সুখের কথা। এই মিলন পরস্পরে স্বার্থের অনুরোধেই ঘটিতেছে, তবুও ইহা প্রার্থনীয়।

কিন্তু সাহিত্য- ক্ষেতে হিন্দু-মুছলমানের যে মিলন হইবে, তাহাতে স্বার্থের সম্বন্ধ থাকিবে না। সে মিলন অতি পবিত্র এবং অতি দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইবে। সাহিত্যের মধ্য দিয়াই হিন্দুমুছলমান পরস্পরকে সত্যিকার ভাই বলিয়া চিনিতে পারিবে, সেই শুভদিনের সূত্রপাত হইয়াছে। চিন্তাশীল ও দেশ-হিতৈষী ব্যক্তিগণ আর কোন্দল, কলহ ও হিংসাবিদ্বেষপূর্ণ সাহিত্য পছন্দ করিতেছেন না।

আসুন, আমরা অপ্রীতিকর অতীতকে ভুলিয়া গিয়া মাতৃভাষার আঁচল ধরিয়া মুক্তি ও মহত্ত্বের দিকে অগ্রসর হই এবং সকলে মিলিয়া কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিশাইয়া আজ বঙ্গের নগর প্রান্তর মুখরিত করিয়া তুলি-

“আজি শুভলগ্নে ভাই, ভুলে যাও মম

অতীতের শত অপরাধ,

আমিও তোমারে ক্ষমি’ প্রীতিভরে আজি

  ভাঙ্গিতেছি ভিন্নতার বাঁধ!

 তোমার যে দেশ সে যে আমারো স্বদেশ

উভয়ের এক জন্মভূমি,

এক গঙ্গাজলে তোষে দোহে চিরদিন

হিমাদ্রির পাদদেশ চুমি।’

সকল শব্দ সকল ভাষা, সকল সাহিত্য, সকল ভাব, সকল ছন্দ, সকল তান, সকল সুর, সকল স্বর ও সকল গান আবহমান কাল হইতে যে মহা-আকরের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহার নিকট শক্তি-সাফল্যের প্রার্থনা করিয়া আমি এই অভিভাষণের উপসংহার করিতেছি।

(তথ্যসূত্র : তৃতীয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলন- সভাপতির ভাষণের (সংক্ষিপ্ত রূপ), বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা মাঘ ১৩২৫)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //