সোহারাব হোসেন: এক উজ্জ্বল কথাকার

সোহারাবদার কথা মনে পড়লে আমার চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে ওঠে- কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিটের আনন্দমোহন কলেজের বার্সার রুম, যেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী পরিবৃত হয়ে বসে আছেন তিনি। ঘরটা মাঝারি সাইজের। মাঝখানে বড় একটা টেবিল। তার তিনপাশে গোটা ছয়েক চেয়ার ও একটি পুরনো দিনের দু’পাশে হাতল দেওয়া কাঠের বেঞ্চ, তাতে হেলানও দেওয়া যায়। আরেক পাশে গোটা দুয়েক স্টিলের আলমারি। টেবিলে সোহারাবদার দুটি বা তিনটি চশমা, চোখের দুরারোগ্য রোগের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় যা তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করতে হয়।

সেই রুমে কাউকে কোনো লেখা হয় তিনি ডিকটেট করছেন, বা কারও লেখা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কখনো বা তাদের হাত থেকে লেখাটি নিয়ে আতস কাচের চেয়েও পুরু, মোটা চশমা পরে কাগজটি চোখের প্রায় কাছে এনে লেখাটির কোনো অংশ পড়ে নিচ্ছেন। আর তারপর তাদের বোঝাচ্ছেন কী কী করলে লেখাটি আরও ভালো, আরও মনোগ্রাহী হবে। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে কলেজে যে ক’বার গিয়েছি কখনো সোহারাবদাকে একা বসে থাকতে দেখিনি। সবসময় তাঁর ঘরে চার-পাঁচজন ছাত্রছাত্রী আছেই। আসলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ মোহন কলেজের বাংলার এই অধ্যাপকের জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। সদাহাস্যময় এই মানুষটি শুধু তো তাদের শিক্ষক নন, তিনি তাদের বন্ধুও। এই ঘরের আড্ডায় বসে এটা সমসময়ই মনে হয়েছে।

কিন্তু কে এই সোহারাবদা? তাঁকে নিয়ে এত কথার আয়োজনই বা কেন? বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সকল সচেতন পাঠকই তাঁকে জানেন। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাটের সাংবেড়িয়া নামক প্রায় অজপাড়া-গাঁ থেকে উঠে আসা সোহারাব হোসেন (১৯৬৬-২০১৮) আমাদের সময়ের বাংলার এক উজ্জ্বল কথাকার। তিনি এমনই এক ব্যতিক্রমী কথাকার যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই আমাদের।

তাঁর লেখা ‘মহারণ’, ‘মাঠ জাদু জানে’, ‘সরম আলির ভুবন’ যেমন সময়ের দলিল- তেমনি তাঁর ‘সহজ বাউল’ বাউলদের নিয়ে এক আকর গ্রন্থ। গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুতোষ রচনা- এই সব ক্ষেত্রেই অবাধে বিচরণ করেছেন তিনি। তাঁর গল্প-উপন্যাসে অবলীলায় উঠে এসেছে গ্রামবাংলা, তার সোঁদা মাটির গন্ধ, বাঙালি মুসলমান সমাজ, বস্তুবাদী দর্শন, ভোগবাদ, যৌনতার অন্য স্বর, সম্পর্কের টানাপড়েন, রূপকথার আধুনিক কথন, আরও কত্ত কী! এর পাশাপাশি তিনি এক আপসহীন আদর্শ শিক্ষক, যার সঙ্গে থাকতে পারলে ছাত্রছাত্রীরা ভারি আনন্দে নির্ভার থাকে।

সোহারাব হোসেনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ সম্ভবত ২০০৩-এর মাঝামাঝি সময়ে। তারিখটা আজ আর মনে নেই। তবে স্পষ্ট মনে পড়ে-  বারাসাতের কোনো এক বইয়ের দোকানে বন্ধু মারুফ আলাপ করিয়ে দিয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তার কিছুদিন আগে, জানুয়ারি ২০০৩-এ কবি জসীমউদ্দীনের জন্মশতবর্ষে আমার সম্পাদিত পত্রিকা দীপনের ‘জসীমউদ্দীন সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়েছে। সেটা হাতে পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন, আর আমার হয়েছিল আক্ষেপ। মনে হচ্ছিল, আহা, আর কিছুদিন আগে যদি আলাপ হতো! তাহলে ‘জসীমউদ্দীন সংখ্যা’র জন্য তাঁর কাছে থেকে চমৎকার একটা লেখা পেতে পারতাম।

যদিও এর পরের বছরেই সে আক্ষেপ মিটে গিয়েছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মশতবর্ষে দীপনের ‘সৈয়দ মুজতবা আলী সংখ্যা’য় তিনি লিখলেন ‘মুজতবা-গল্পের নন্দনবিশ্ব’। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অসামান্য সে-লেখাটি পাঠকমহলে বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। তার পর থেকেই সোহারাব হোসেন আমার ‘সোহারাবদা’ হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন দীপন-এর অন্যতম লেখক আর আমাদের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড’। প্রতিটি সংখ্যার কাজ শুরুর আগে ও পরে চলতে থাকল তাঁর সঙ্গে আমার অনিবার্য কথোপকথন; তাঁর নিয়ত পরামর্শে দীপনকে আরও উন্নত, আরও সমৃদ্ধ করে তোলার চলমান প্রক্রিয়া।

এভাবেই অন্তরঙ্গতায় কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। কখন-সখনও তাঁর বাড়ি গিয়েছি। কথা হয়েছে তাঁর স্ত্রী-পুত্র- মুনিয়া ভাবি ও সোহমের সঙ্গে। একদিন আমার বন্ধু অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দেখা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে; আমার আরেক বন্ধু যাদবপুরের বাংলার অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক বরেন্দু ম-লের কক্ষে। পুরুলিয়ার পঞ্চকোট কলেজ থেকে তৌহিদ তখন রিফ্রেশার কোর্স করতে এসেছে। সে কয়েকদিন আগে গিয়েছিল সোহারাবদার বাড়ি।

তৌহিদ কথায় কথায় জানাল, সোহারাবদার চোখের অবস্থা এখন ভয়ানক খারাপ। একটা চোখে প্রায় দেখতেই পাচ্ছেন না। খুব শিগগির অপারেশন করতে হবে। খবরটা শুনে খুব মুষড়ে পড়েছিলাম। সোহারাবদা তার অনেক আগে থেকেই চোখের সমস্যায় ভুগছেন। তা সত্ত্বেও চোখের ব্যথাকে বেমালুম হজম করে অনলস লিখে চলেছেন একের পর এক গ্রন্থ; কিন্তু এই সময়টায় অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে তাঁর লেখালিখি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেল। তাঁর মতো এমন এক প্রতিভাধর লেখকের জন্য এ ভারি কষ্টের সময়। অপারেশন হয়ে গেল। কিছুদিন পর আমি ফোন করতেই জানালেন, এখন আগের চেয়ে ভালো আছেন; কিন্তু আমরা দেখলাম, তাঁর আর একটি নতুন চশমা হয়েছে, যার কাচ আতস কাচের চেয়েও পুরু। তবু মেজাজ হারাননি সোহারাবদা। এতকিছুর পরও তিনি সদা হাস্যময়। যেন এ এক অতি সাধারণ ঘটনা।

কেমন মানুষ ছিলেন সোহারাবদা? এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কি কঠিন? মাঝারি উচ্চতার ফর্সা, স্বাস্থ্যবান, সদাহাস্যময় মানুষটির সবচেয়ে বড় গুণ হলো- তিনি যে কোনো সদ্য-পরিচিতকে সহজেই আপন করে নিতে পারতেন। প্রথম দিনেই সদ্য-আলাপিত ব্যক্তির মনে হতো তিনি কোনো স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, যে স্বজন তাঁর বহু দিনের চেনা। আর তাই সদ্য পরিচিতের বেড়া চুরমার করে তাঁদের সে-আলাপ এক অন্তরঙ্গ কথোপকথনের অভিমুখে যাত্রা করত।

সে যাত্রায় কোনো স্বার্থের ঠোকাঠুকি নেই, বরং আছে এক আনন্দময় মত বিনিময়ের সহজিয়া উষ্ণতা। আর আমরা যারা তাঁর বহুদিনের পরিচিত, তাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সহোদরের মতো। তেমন সহোদর যিনি অনায়াসে ধরিয়ে দেন ভুল, আর ভালো কিছু করে ফেলতে পারলে আমাদের চেয়ে তাঁরই আনন্দ হয় বেশি। এ আমার দীর্ঘ দিনের অনুভূতি। তাঁর অন্য পরিচিতজনরাও আশাকরি এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন। 

চোখ যেমন সোহারাব হোসেনের লেখার ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, তেমনি তাঁর দৃঢ় মনোভাবও তাঁকে চাকরি ক্ষেত্রে আরও উঁচু পদে যাওয়ার গতিপথকে রুদ্ধ করেছে। বারবার নানা কূট রাজনীতির শিকার হয়েছেন তিনি। আসলে কারও ‘মোসাহেব’ হতে পারেননি বলেই যোগ্যতার অধিক থাকা সত্ত্বেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হতে পারেননি। যদিও এ নিয়ে সোহারাবদার কোনো আপসোস ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন-  যোগ্যজনরা তাঁকে ঠিকই মনে রাখবেন।

সমাজে, বিশেষত বাঙালির এখন চরিত্র লক্ষণই হলো- কে কাকে টেনে নিচে নামাতে পারে। ছলে বলে কৌশলে দাবিয়ে রাখার এই প্রক্রিয়া এতটাই সক্রিয় যে, আমরা যোগ্যতমকে বাহবা জানাতেও কুণ্ঠা বোধ করি। রাজনৈতিক নেতাদের জয়গান গেয়ে তাদের ‘নিজের লোক’ হয়ে উঠে মধ্য ও নিম্ন  মেধার এই ‘যোগ্যতম হয়ে ওঠা’র ঘটনাবলি আমাদের কোন ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলেছে!

রক্ত-মাংসের সোহারাব হোসেন আজ আর আমাদের মধ্যে নেই; কিন্তু বাড়িতে যখন পত্রিকার কাজ নিয়ে বসি- তখন তিনি আমার কাছে প্রবলভাবে উপস্থিত থাকেন। মৃত্যু সংবাদ পেয়েও তাঁকে শেষ-দেখা দেখতে যাওয়ার সাহস হয়নি আমার। সোহারাবদার ওই নিষ্প্রাণ মুখ আমি দেখব কীভাবে? আমি যে চিরটা কাল তাঁর সেই হাসিমাখা মুখটাকেই এ বুকে ধারণ করতে চাই। তার হাসি, কথা বলার ধরন, কাছে টেনে নেওয়ার সহজাত অভ্যাস আমাকে যে আরও নমনীয়, আরও মাটির কাছাকাছি টেনে নিয়ে যায় প্রায়।

আমার প্রবন্ধের পত্রিকা ‘দীপন’ নিয়ে সোহারাবদা খুবই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতেন। একবার তাঁর বারাসাতের বাড়িতে রাত্রিযাপনের সময় তুমুল আড্ডার মাঝে সোহারাবদা আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর অন্যতম সেরা দুই গ্রন্থ ‘মহারণ’ ও ‘সরম আলির ভুবন’। ‘মহারণ’-এর পাতা খুলে দেখি, সোহারাবদা লিখেছেন- 

সংস্কৃতির মহারণ লড়ছে যে

জুলফিকার

স্নেহাংশু সমীপে-

সোহারাব হোসেন

একুশ/বারো/দু’হাজার চোদ্দো।

জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী-ই বা হতে পারে। 

আসলে আমার সোহারাবদা তাঁর নিজের মতো করেই এক ভুবন তৈরি করে নিয়েছিলেন। এক নান্দনিক ভুবন- যেখানে গল্পকার-প্রাবন্ধিক-গবেষক-ঔপন্যাসিক সোহারাব হোসেন মুনিয়াভাবি, সোহম, তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী ও পরিচিতজনদের নিয়ে এক হার না মানা জীবনচর্যায় মেতে থাকতেন। তাঁর ভাবনা ও কাজে আমরা যেন এক যৌথখামারের ছবি দেখতে পাই, যেখানে সোহারাব হোসেনকে কেন্দ্র করে সমস্যাদীর্ণ এই আবহে আমাদের দৈনন্দিন যাপন আরও সহজ, সুন্দর ও অমলিন হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //