বাংলার বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক

গাঙ্গেয় বদ্বীপে যুগে যুগে অনেক খ্যাতিমান মানুষের জন্ম হয়েছে। রাজনৈতিক সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। অনাদিকাল থেকে উপমহাদেশ বিদেশিদের কাছে বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্র। কারণ, ফলে-ফুলে-শস্যে, মাছে-ভাতে ছিল পরিপূর্ণ মানবিক সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রথম কুঠারাঘাত করে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে আসা সাদা চামড়ার ব্রিটিশ বেনিয়ারা। ওরা, মুখ-মুখোশের আড়ালে সত্যিকারের উদ্দেশ্য গোপন করে ব্যবসার ডালা নিয়ে এসে, এক সময়ে ছলে বলে ষড়যন্ত্রে হত্যায় লুণ্ঠনে আত্মপ্রতারণায় দখল করে নেয় প্রথমে বাংলা, পরে গোটা উপমহাদেশ। এবং সাদা চামড়ার বেনিয়ারা যখন উপমহাদেশে শাসনের চাবুকে রক্তাক্ত করে তুলছে, সেই রক্ত মাটির আর্ত চিৎকারের সময়ে বরিশালের চাখারে জন্ম নেন ফজলুল হক। পুরো নাম আবুল কাশেম ফজলুল হক।

১৮৩৭ সালের ২৯ অক্টোবর জন্ম নেন তিনি। পিতা ছিলেন সেই সময়ে বরিশালের খ্যাতনামা আইনজীবী ওয়াজেদ আলী। শৈশব থেকে মেধাবী ফজলুল হক ছিলেন মেধাবী, মননশীল। একই সঙ্গে তিনি বাংলা আরবি, উর্দু এবং ফারসি ভাষা শিখতেন। চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে প্রথম শ্রেণির বৃত্তি নিয়ে ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে প্রবেশিকা পাস করেন ফজলুল হক। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা ও গণিতে অনার্সসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৫ সালে গণিতে এমএ পাস করেন ফজলুল হক। ১৯৯৭ সালে বিএলএল পাস করে খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার আশুতোশ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

  • বরিশালের চাখারের ফজলুল হক কলকাতার মেয়র হয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি, তিনি বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও নিবেদিত হয়ে কাজ শুরু করলেন। রাজনীতির ফলাফলে তিনি ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হলেন

১৯০৬ সালে সরকারি চাকরিতে জয়েন করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করলেও শিগগিরই ব্রিটিশ সরকারের নীতির সঙ্গে তেজস্বী ফজলুল হক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন এবং চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার আইন ব্যবসায় ফিরে আসেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে আইন ব্যবসায় এসে বাংলার এবং উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন পুরোপুরি। তার রাজনীতি ছিল সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। সেই সময়ের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের কাজের মূল্যায়ন করে, দেখা যায় আবুল কাশেম ফজলুল হকের রাজনীতি ছিল সত্যিকার অর্থেই জনগণের পক্ষে, সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত।

১৯১৩ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা সেই সময়ে সরকারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল। কেননা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা বা প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছিল, সেই অব্যবস্থাপনা দূর করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। সেই সভায় তরুণ বাঙালি রাজনীতিবিদ আবুল কাশেম ফজলুল হককে যুক্ত করা মানে, তিনি নিজেকে সেই সময়েই প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

১৯২০ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন মন্টেগু- চেমসফোর্ড কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন ফজলুল হক। বাংলার প্রান্ত অঞ্চল থেকে একজন বাঙালি হিসেবে সেই ব্রিটিশ রাজত্বের কালে আবুল কাশেম ফজলুল হক ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কর্মময় বাঙালির চিন্তা ও চেতনা। ১৯৩০-৩১ এবং ১৯৩১-৩২ সালে বিলেতে অনুষ্ঠিত উপমহাদেশ সম্পর্কে রাজনৈতিক বৈঠকে যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। সেখানে ফজলুল হকের বক্তৃতা অনেকের দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৩৫- ৩৬ সালে ফজলুল হক কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন। মনে রাখা দরকার, যত সহজে লিখলাম তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন, ঘটনা তত সহজ ছিল না। সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল ছিল। সেই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করে ফজলুল হক প্রথম মুসলমান হিসেবে কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বরিশালের চাখারের ফজলুল হক কলকাতার মেয়র হয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি, তিনি বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও নিবেদিত হয়ে কাজ শুরু করলেন। রাজনীতির ফলাফলে তিনি ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হন। আবুল কাশেম ফজলুল হক বরিশালের মানুষ। জন্ম নিয়েই দেখেছেন ব্রিটিশ শাসিত দেশে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট। দেখেছেন কুশিক্ষা ও এর প্রভাবে বিধ্বস্ত মানুষের বেদনাদায়ক জীবনযাত্রা। অশিক্ষার অন্ধকার আর কুসংস্কারের খড়গ থেকে মুক্তির জন্য দরকার শিক্ষা। শিক্ষা গ্রহণ করলে মানুষ বিকশিত হয়, বুঝতে পারে নিজের অধিকার। সেই অধিকারের প্রশ্নে ফজলুল হক এই অঞ্চলে একের পর এক গড়ে তুলতে লাগলেন স্কুল কলেজ। আজ, একবিংশ শতকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালে আলোর যত ক্ষুদ্র ট্যানেলই দেখতে পাই না কেনো, সেই ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হকের ভূমিকাই ছিল প্রধান। তিনি জানতেন, গোটা উপমহাদেশে মুসলমানদের দারুল হরব নামক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে মুসলমানরা অনেক অনেক পিছিয়ে আছে জ্ঞানে বিজ্ঞানে। জ্ঞানে এবং বিজ্ঞানে বিকশিত হতে না পারলে একটা জাতি-সম্প্রদায় হিসেবে বাঙালি মুসলমানেরা টিকে থাকতে পারবে না। যিনি নেতা হন, তিনি অনেক দূরের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। যেমন দেখতে পেয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রথম নির্বাচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক। তার অবদানে এখন বাংলার মুসলমানরা একটু হলেও আলোর দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।

বাংলা ও বাঙালির রাজনীতির ক্ষেত্রে আবুল কাশেম ফজলুল হকের অবদান অপরিসীম। তিনি কেবল বাংলা ও বাঙালির নেতা ছিলেন না, ছিলেন গোটা উপমহাদেশের নেতা। যদিও, মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে, কিন্তু কালের যাত্রায় সেই মুসলিম লীগ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা উপমহাদেশে। উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনীতি ও আর্থ সামাজিক চেতনা বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় মুসলিম লীগ। ইতিমধ্যে ব্রিটেন থেকে লেখাপড়া শেষ করে বোম্বের সন্তান মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মুসলিম লীগে আসেন। কংগ্রেস চাইছে স্বাধীনতা, ব্রিটিশদের কাছ থেকে। ইতিমধ্যে মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। রাজনীতির মাঠে অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ১৯৪০ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি উত্থাপন করলেন ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। তিনি যখন সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করলেন, তখন জিন্নাহসহ মুসলিম লীগের শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সবাই করতালির সঙ্গে বাংলার প্রধানমন্ত্রীকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানালেন। মুসলিম লীগপ্রধান মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাতে জানাতে বললেন, ওয়েল কাম বেঙ্গল অব টাইগার। সেই থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলার বাঘ বা শের-ই-বাংলা নামে ঘরে ঘরে নন্দিত হয়ে আসছেন। এবং সেই সভায় তিনি পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যা কালের ধারাবাহিকতায় দুই পাকিস্তানের একটি পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত আজ।

১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে শের-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। জমিদার শ্রেণির হাতের কবল থেকে বাংলার কৃষকদের মুক্তির লক্ষ্যে তিনি ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করে কৃষকদের জীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই সময়ের জাতীয় রাজনীতিবিদরা একত্র হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুসংগঠিক ভূমিকায় বাঙালিদের একতাবদ্ধ করেছিলেন। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন শের-ই-বাংলা, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই তিন নেতার সম্মিলিত উদ্যোগে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে নির্বাচনে বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগ মুছে যায়, জেগে ওঠে বাঙালির চেতনা বিকেলের আলো।

বাংলাদেশ ও বাঙালির জাগরণে শের-ই-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের অবদানের যথার্থ মূল্যায়ন এখনো হয়নি। ইতিহাসের নিক্তিতে সেই সময়কে ধারণ করে শের-ই-বাংলাকে নতুন প্রজন্মে গবেষণা করার এখনই উপযুক্ত সময়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //