ইসলামি শিল্পকলা: বিকল্প শিল্পচর্চার ধারা

দ্বৈরথে-দ্বন্দ্বে
ইসলাম ও শিল্পকলা নিয়ে চারপাশে নানা আলোচনা-সমালোচনা বিদ্যমান। বিগত দিনে আমরা দেখেছি-ধর্মনিষ্ঠ হতে গিয়ে মুসলিম সমাজের অনেক শিল্পী ছবি আঁকায় শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর যুক্ত রাখতে পারেননি। সর্বতভাবে সুন্দরের সাধনা বা চারু-কারুর চর্চা থেকে ছুটি নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

মিসরীয় সুপণ্ডিত ইউসুফ আলকারদাভি (১৯২৬) তার ‘শিল্পকলা ও ইসলাম’ গ্রন্থে বলেছেন, মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যাপারগুলোর মধ্যে বিনোদন ও শিল্পকলা সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত বিষয়গুলোর একটি। যদিও বাস্তবে এটি আমরা মনে রাখি না।

ফলে লোকেরা এ বিষয়ে হয় অত্যাধিক বাড়াবাড়ি করে, নয়তো খুব বেশি শিথিলতা প্রদর্শন করে। কারণ, এগুলো যতটা না মানুষের জ্ঞান ও বিবেচনাবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত, তারচেয়েও বেশি আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কারণে এগুলোর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন হয়, তেমনি অন্যদিকে কঠোরতা ও বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেও এগুলোকে কাজে লাগানো যায়।

অনেকে মুসলিম সমাজের এমন একটি চিত্র তুলে ধরেন, যাতে মনে হয় এখানে কেবল ইবাদত বন্দেগি এবং কাজ আর কাজ নিয়েই পড়ে থাকতে হয়। আনন্দ-বিনোদন, হাসি-উল্লাস, গানের কোনো স্থানই যেন এখানে নেই! এই সমাজে অট্টহাসি বা মুচকি হাসি, প্রফুল্ল মন বা হাসিখুশি চেহারা- এসবের কোনোটাই যেন জায়েজ নয়!

এদের ঠিক বিপরীত ধরনের কিছু মানুষও রয়েছে, যারা নিজের কুপ্রবৃত্তির খায়েশ মেটাতে লাগামহীন জীবনযাপন করে। তারা তাদের পুরো জীবনটাকেই খেল-তামাশায় পরিণত করেছে। বৈধ-অবৈধ, আবশ্যিক-অবাঞ্ছিত, হালাল-হারামের মাঝে যত পার্থক্য রয়েছে, সবগুলোকে তারা ঘুচিয়ে দিয়েছে।

এই সংকট নোবেলজয়ী তুর্কি ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের (১৯৫২) হৃদয়েও ঝড় তুলেছে। তাই বিষয়টি নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তিনি। যার নাম ‘আমার নাম লাল’ (মাই নেইম ইজ রেড)। দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথের মাঝখানে থেকে বিকল্প এক শিল্পকলা আমাদের অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে। যে শিল্পকলা নির্বাক বয়ানে এগিয়েছে বহুদূর। এর সূচনা কয়েক শতাব্দী আগে। যার নাম ইসলামি শিল্পকলা।

উন্নত মম শির
সভ্যতার ইতিহাস যত পুরনো, শিল্পকলার ইতিহাসও তত পুরনো। তবে ইসলামি শিল্পকলার ইতিহাস শুরু হয়েছে সপ্তম শতাব্দী থেকে। মদিনারাষ্ট্র সূচিত হবার পরই এই বিকল্প শিল্পধারাটি বিকশিত হতে থাকে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি শিরকমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন। ‘ইসলাম পূর্বযুগের আরবেরা তাদের দেবীসমূহ, যেমন-লাত, আল উজ্জা এবং মানাত-এর ছবিই শুধু পূজা করত না, পবিত্র কাবাগৃহের মাঝে তাদের মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত করে রাখত। অবশ্য তখন কাবাগৃহে শুধু এই তিনেরই নয় বরং আরো বহু দেব-দেবীর মূর্তি সংরক্ষিত হত। মহানবী (সা.) এখানে নবী ইবরাহিম, ইসমাইল ও ঈসা (আ.)-এর মা মরিয়ম (আ.)-এর মূর্তি দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।’ এ মত-জার্মান পণ্ডিত মুরাদ হফম্যানের (১৯৩১-২০২০)।

অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে মিসরীয় পণ্ডিত ড. হোসাইন হায়কলের (১৮৮৮-১৯৫৬)। তিনি বলেন, ‘মহানবী (সা.) কাবা ঘরের ভিতরের দেয়ালে বিভিন্ন নবী ও ফেরেশতার ছবি দেখতে পান। এই সব ছবির হাতে জুয়া আর ভাগ্য পরীক্ষার তীর ছিল। তিনি কাঠের তৈরি একটি কবুতরও দেখতে পান। তিনি কবুতরটি নিজ হাতে ভেঙে মাটিতে ফেলে দেন। হযরত ইবরাহিমের ছবিটি তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর বলেন, আল্লাহতায়ালা এটি ধ্বংস করুন। এতে আমাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইব্রাহিমকে জুয়া খেলারত দেখানো হয়েছে। অথচ জুয়ার তীরের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না। হযরত ইবরাহিম ইহুদি কিংবা খ্রিস্টানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী এবং একনিষ্ঠ মুসলমান। মুশরিকদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ফেরেশতাদের ছবি খোদাই করা হয়েছিল সুন্দরী নারীদের আকৃতিতে। তিনি এসব ছবি ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কাবা ঘরের আশপাশেও প্রতিমা ছিল। কুরাইশরা ও অন্যরা এসবের পূজা করত। এগুলো কাবাঘরের প্রাচীরে শক্ত করে লাগানো ছিল। হোবল দেবতা কাবা ঘরের ভেতরে রাখা হয়েছিল। মক্কা বিজয়ের প্রথম দিনেই কাবাঘর ও আশপাশের সব প্রতিমা ভেঙেচুরে ফেলা হয়।’ এভাবেই একেশ্বরবাদকে উচ্চকিত করা হয়। এখান থেকেই নতুন সৌন্দর্য চর্চা শুরু হয়। ধর্মচর্চার সমস্ত স্তরে দেবচিত্রসমূহের বা যে কোনো চিত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কোরআনে ঘোষিত হয়েছে-বান্দা প্রার্থনা করলে আল্লাহ সবকিছু মাফ করবেন। কিন্তু মূর্তি পূজককে কখনো ক্ষমা করবেন না। (৪:৪৮)

ক্ষতি নয়, বেশি লাভ
তবে চূড়ান্ত বিচারে চিত্র বা মূর্তির সাহায্যে উপস্থাপনের ওপর ইসলামের যে নিষেধাজ্ঞা তা ক্ষতিকারক না হয়ে লাভজনক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কারণ এর ফলে নতুন বা বিকল্প শিল্পকলার উদ্ভব হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা না থাকলে মানুষ হয়তো কোনোদিনই জানত না, যেমন জড়িত লতাপাতার নকশা (Arabesque design) যা মোজাইক এবং খোদাই শিল্পে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, ক্যালিগ্রাফি এবং পুস্তক অলঙ্করণ ইত্যাদি। ক্রমে কোরআনিক ক্যালিগ্রাফি ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের একটি মৌলিক ও প্রাথমিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।

আমরা লক্ষ্য করেছি, ইসলামি শিল্প খুবই জটিল শিল্প, কারণ এই শিল্পের বিস্তৃতি অনেক বেশি ছড়ানো এবং নানান দেশের মুসলিমরা সাড়ে ১৪০০ বছর ধরে এই শিল্পের চর্চা করছে। আজ এটি শুধু একটি বিশেষ গোষ্ঠীর শিল্প নয়, এটি কোনো বিশেষ সময়ের শিল্পও নয়, অথবা কোনো জায়গা বা আঁকা-আঁকির মতো নির্দিষ্ট গণ্ডির শিল্প নয়। এই শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রই অনেক বিস্তৃত। ইসলামি স্থাপত্য যেমন অনেক বেশি বিস্তৃত, ঠিক তেমনি ইসলামি ক্যালিগ্রাফি বা লিখন শিল্প, আঁকা-আঁকি, গ্লাসে তৈরি কারুকাজ, ইসলামিক মৃৎশিল্প, টেক্সটাইল শিল্পে কারুকাজ, ইসলামি এমব্রয়ডারি ইত্যাদি ক্ষেত্রের পরিসরও কম নয়। এটি শুধু ধর্মীয় শিল্প নয়, ধনী এবং সব ধরনের মুসলিম সমাজের একটি শিল্প। তবে এ শিল্পকলার ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে শিল্পীদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। তত্ত্বের বেড়াজালে আটকে অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্পচর্চা।

শেষ পর্যন্ত মুসলিম শিল্পীদের হাতে এক বৈচিত্র্যময় শিল্পসম্ভার গড়ে উঠেছে। সমস্ত শিল্পই মানুষের আত্মপ্রকাশের অদম্য আবেগকে বহন করছে। ইসলামের শুরুর দিকে শরীয়তি বিধি নিষেধের চাপ প্রবল থাকার পরও সমাজের মানুষেরা শিল্পিসত্তা আত্মপ্রকাশের যে পথটি খুঁজে নিয়েছিল নিঃসন্দেহে সেটি অলঙ্করণ শিল্প। চৌদ্দ শতকের একটি ফার্সি বিশ্বকোষ ‘নাফাইস আল কানুন’ গ্রন্থে ইসলামি শিল্পকলা ও বিজ্ঞান প্রসঙ্গে লেখক মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ আল আসালি লিপিকলা বিষয়ে নবির একটি বাণী উদ্ধৃত করেছেন- ‘হস্তলিপির সৌন্দর্য তোমাকে অর্পণ করা হয়েছে, কারণ এটি হল মানুষের প্রাত্যহিক খাদ্য অর্জনের অন্যতম উপায়।’ অসংখ্য নজির আছে, যাতে দেখা যাবে লিপিকলার প্রতি শরীয়তি উৎসাহ ও প্রেরণা ছিল। প্রথম থেকেই আত্যন্তিক এবং তার উদ্দেশ্য ছিল পবিত্র কোরআন কপি বা লিপিবদ্ধ করা। বাদশাহ-সুলতানদেরও অনেকে তা নিজের হাতেই করেছেন পুণ্যার্জনের অভিপ্রায়ে। ভারতে মুগল বাদশাহ আওরঙ্গজেব, তার আগে তুর্কি সুলতান নাসির উদ্দিন প্রমুখ করেছেন। এগারো শতকের শেষদিকে গজনির সুলতান ইবরাহিম ইবনে মাহমুদ যতদিন বেঁচে ছিলেন, প্রতি বছর কোরআন কপি করে মক্কায় পাঠাতেন। মুসলিম সমাজে লিপিকলার পেছনে ধর্মীয় প্রেরণা মৌল একটি কারণ হওয়ার দরুন বিশেষ করে আরবি-ফার্সি লিপি, যার উদ্ভব আরামীয় লিপি থেকে (আরামীয় লিপির উদ্ভব ফিনিসীয় লিপি থেকে), ক্রমশ একটি পৃথক শিল্পকলার আবির্ভাব ঘটায় এবং তার প্রভাব চিত্রকলার ওপরও গিয়ে পড়ে।

মানুষের মনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক রূপ হচ্ছে শিল্পকলা। শিল্পী তার কল্পনা ও প্রতিভার সঙ্গে দক্ষতা ও রুচির সমন্বয়ে শিল্প সৃষ্টি করেন। শিল্পী তার সৃষ্টির আনন্দ থেকে শিল্প সৃষ্টি করেন বলে কোনো বাঁধাধরা নিয়মের অধীনে শিল্পকে ফেলা যায় না। শিল্পীর কাজ হচ্ছে শিল্পকলার মাধ্যমে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে সম্প্রসারিত করা, আমাদের কল্পনার পরিধি বাড়িয়ে তোলা।  

একইবৃন্তে দুটি কুসুম

শিল্পকলার প্রধান দুটি ধারা একইবৃন্তে দুটি কুসুম বা ফুল চারুশিল্প (Fine Arts) ও কারুশিল্প (Crafts)। চারুশিল্প শিল্পীর সৃষ্টিশীল মনের একান্ত নিজস্ব সৃষ্টি। এর কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা নেই। সৃষ্টির আনন্দে মনের তাগিদ থেকেই তার উৎপত্তি। এটি আমাদের মনে আনন্দ জোগায়, দৃষ্টিকে আনন্দ দেয়। চারুশিল্প আমাদের মানসিক প্রয়োজনে কাজে লাগে। আর কারুশিল্প যদিও শিল্প, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এর উৎপত্তি জীবিকা অর্জনের তাগিদে এবং মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন থেকে।


  • ইসলামের প্রথম আবির্ভাবের পর তার শিল্পকলায় কিছু বাইজান্টাইন ও পারসিক প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে এই প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামি শিল্পকলা সম্পূর্ণ নতুন একধারার উদ্ভাবন করে। উমাইয়া খেলাফতকে বিবেচনা করা হয় ইসলামি শিল্পকলার প্রারম্ভিক যুগ হিসেবে

চারুশিল্পের মধ্যে আছে চিত্রকলা, ভাস্কর্য, খোদাই শিল্প, নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্য, গদ্যসাহিত্য, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি। কারুশিল্পের মধ্যে আছে মৃৎশিল্প, বুনন, তাঁত, চর্ম, বাঁশ, বেত, কাঠ ও নানারকম ধাতুর তৈরি ব্যবহারিক শিল্প।

আমরা আগেই বলেছি ইসলাম শুধু একটি আচারসর্বস্ব ধর্মই নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ বিধান হওয়ার কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের পদচারণা বিদ্যমান। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ইসলাম তার স্বতন্ত্রতার ভিত্তিতে নিজস্ব এক অবস্থান করে নিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের সর্বত্রই শিল্প ও স্থাপনার মধ্যে এই স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অবস্থান লক্ষণীয়।

খ্রিস্টীয়, ইহুদি এবং বৌদ্ধ শিল্পকলার সঙ্গে তুলনা করলে এটা স্পষ্ট হবে- অপরাপর শিল্পকলা যেখানে শুধুই ধর্ম আশ্রিত, সেখানে ইসলামি শিল্পকলা ধর্ম এবং জাগতিক উভয় প্রয়োজনকেই পূরণ করেছে।

মানে না বাধা
ইসলামের প্রথম আবির্ভাবের পর তার শিল্পকলায় কিছু বাইজান্টাইন ও পারসিক প্রভাব থাকলেও পরবর্তীতে এই প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামি শিল্পকলা সম্পূর্ণ নতুন একধারার উদ্ভাবন করে। উমাইয়া খেলাফতকে বিবেচনা করা হয় ইসলামি শিল্পকলার প্রারম্ভিক যুগ হিসেবে।

ইসলামে যদিও মানুষ অথবা প্রাণির ছবি অঙ্কনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তথাপি বিভিন্ন শিল্পকলায় তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব অঙ্কন শুধু ব্যক্তিগত ও জাগতিক নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; মসজিদসহ অন্যান্য সাধারণ স্থাপনায় প্রাণির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। সমগ্র ইসলামি শিল্পকলার ইতিহাস যদি বিবেচনায় নেওয়া হয় তাহলে দেখা যাবে, এই শিল্পকলা চারটি মৌলিক উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। চারটি উপাদান হচ্ছে-

১. ক্যালিগ্রাফি

ইসলামি শিল্পকলায় ক্যালিগ্রাফির বহুল ব্যবহার করা হয়েছে। অন্যান্য সকল শিল্পীর মধ্যে ক্যালিগ্রাফারদের সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করা হতো। কেননা কোরআনের লিখনশৈলীর সঙ্গে এই শিল্পটি জড়িত ছিল। অবশ্য শুধু কোরআনের আয়াতই ক্যালিগ্রাফির বিষয়বস্তু ছিল না, বরং কোরআনের আয়াত ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন উক্তি, কবিতার পঙক্তি প্রভৃতি ক্যালিগ্রাফির বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

বিভিন্ন ভবনের অলঙ্করণে ক্যালিগ্রাফির বিপুল ব্যবহার প্রচলিত ছিল। টাইলসে অলঙ্করণ, কাঠ খোদাই অথবা কাপড়ে ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনের মাধ্যমে বিভিন্ন ভবনে অলঙ্করণ করা হতো।

২. জ্যামিতিক নকশা
শিল্পকলায় প্রথম জ্যামিতিক নকশার প্রচলন মুসলমানদের হাতেই সূচিত হয়। ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত আট কোণাকার তারকা এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। দেয়ালে মোজাইক বা কাঠের কাজের মাধ্যমে এই নকশা অঙ্কিত হতো।

আরব গণিতবিদদের কাছে জ্যামিতি ছিল চরম আগ্রহের বিষয় এবং তারাই ইসলামি শিল্পকলায় জ্যামিতিক নকশার বহুল প্রচলন করেন।

ইসলামি বিশ্বের সর্বত্রই বিভিন্ন স্থাপনার অলঙ্করণে জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

৩. ফুল-পাতার নকশা
জ্যামিতিক নকশার মতই বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ ও ফুল-পাতার নকশাও ইসলামি শিল্পকলায় খুবই সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ইসলামি শিল্পকলায় এরূপ নকশার এক নতুনতর ধারার উদ্ভব ঘটে এটিই সেই Arabesque.
বিবিধ বস্ত্রখণ্ড যেমন- পোশাক, মাদুর, কার্পেট, গালিচা প্রভৃতিতে এই প্রকার নকশার বহুল ব্যবহার হতে থাকে।

৪. জীবিত প্রাণীর অঙ্কন
জীবিত প্রাণীর অঙ্কন যদিও ইসলামি শরীয়তে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, তথাপি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রাণীর চিত্রাঙ্কনের অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যায়। তবে তা অন্য তিনটি উপাদানের মতো বিপুলভাবে প্রচলিত ছিল না।

সাধারণত বিভিন্ন গ্রন্থের অলঙ্করণের জন্যই প্রাণীর চিত্র সংযোজন করা হতো। ফার্সি মহাকাব্য শাহনামা এক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এ ছাড়া ওসমানী ও মুঘল আমলের বিভিন্ন গ্রন্থেও চিত্রের সংযোজন করা হয়।

ষোড়শ শতাব্দীতে এসে প্রতিকৃতি অঙ্কনের প্রচলন ঘটে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনার বিষয়ভিত্তিক চিত্রের অঙ্কনও এ সময় ব্যাপকহারে প্রচলিত হয়।

শিল্পের ইতিহাসে সমৃদ্ধতম একটি শাখা হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি শিল্পকলার আলোচনার পরিমাণ খুবই অল্প। প্রথমত পাশ্চাত্যের শিল্প বিশেষজ্ঞদের পক্ষপাতদুষ্টতা এবং ভাষাগত পার্থক্যও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে এখন অনেকটাই আলোয় উদ্ভাসি হচ্ছে ইসলামি শিল্পকলার বিষয় আশয়।

আমরা জেনেছি, আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল পাবলো পিকাসোর (১৮৮১-১৯৭৩) জন্ম স্পেনের আনদানুমিয়া অঞ্চলে। এই অঞ্চল আরবদের অধীনে ছিল ৭শ’ বছরের মতো। এখানকার নকশায় ইসলামী জ্যামিতিক ধারার প্রভাব খুবই স্পষ্ট। এমনকি পিকাসোর ছবিতেও একসময় জ্যামিতিক নকশার প্রভাব দেখা যায়।
বিখ্যাত শিল্পী আঁরি মাতিস (১৮৬৯-১৯৫৪) তার ছবির অনুপ্রেরণা পান ইরানি গালিচা থেকে। তার ছবির রঙ ও ফর্ম গালিচা থেকে নেওয়া।



জগত ঘুরিয়া শেষে
আমেরিকার কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড ম্যারির অধ্যাপক ও শিল্প সমালোচক অলুদামিনি অগুন্নাইক- বলেন, ‘যারা ইসলাম ও তার সভ্যতার সঙ্গে অপরিচিত, তাদের কাছেও ‘ইসলাম’ পরিচয় করিয়ে দিতে বলা হলে আমি তাদেরকে পরামর্শ দেব না কোরআনের কোনো অনুবাদ পড়তে; না পরামর্শ দেব ইসলামী আইন, ধর্মতত্ত্ব অথবা দর্শন পড়তে; কিংবা পাশ্চাত্যে ইসলামকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জনপ্রিয় বইয়ের কোনো একটি পড়ার জন্য। বরং আমি তাদেরকে পরামর্শ দেব ‘আরবি মাকামে’ (এক ধরনের সুর-তাল) কোরআনের তেলাওয়াত শোনার জন্য; অথবা ছুলুছ বা কুফিক ক্যালিগ্রাফি হরফে লেখা কোরআনের সোনালি-রূপালি রঙের ওসমানি মাসহাফ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে; অথবা ফেজ শহরের কারাউইয়্যিন, ইস্পাহানের শায়খ লুৎফুল্লাহ বা কায়রোর ইবনে তুলুন মসজিদ দেখতে; অথবা বলব কবি হাফিজ, আমির খসরু কিংবা ইবুনুল ফরিদদের সংগীত শোনার জন্য।

ইসলামি সভ্যতার এইসব সেরা সেরা শিল্পকর্ম ওহির সৌন্দর্য ও সত্যকে এমন নিগূঢ়ভাবে প্রকাশ করে, সাধারণভাবে যা ইসলাম সম্পর্কিত প্রবন্ধ বা বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। পাশ্চাত্যে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে ইসলাম নিয়ে সেখানে আগ্রহের একটি প্রমাণ হলো, পশ্চিমা সমাজ থেকে অনেক মানুষ স্পেনের ‘আলহামরা’ ও ভারতের ‘তাজমহল’ এর স্থাপত্যকলা দেখার জন্য; পাশাপাশি ইসলামি ক্যালিগ্রাফি ও অনু-চিত্রকলা দেখে বিমুগ্ধ হতে এবং ট্রাডিশনাল ইসলামি সংগীতের কনসার্ট উপভোগ করতে অগ্রিম টিকিট কেনার জন্য অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে।

তার আরও মত : ‘অনেকের কাছে, ইসলামি শিল্পকলার নির্বাক থিওলজিকাল বয়ান সবচেয়ে চমকপ্রদ প্রবন্ধের চেয়ে আরও গভীর ও স্পষ্টভাবে ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং এর সৌন্দর্য মজবুত যুক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্পষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য। কোরআন সিলজিসম (syllogism) বা গদ্যময়-যৌক্তিকপ্রমাণ আকারে নাযিল হয়নি বরং এমনভাবে নাযিল হয়েছে যেন তেলাওয়াত করা যায়, যার অনুপম ভাষাগত সৌন্দর্য প্রতীক, কাহিনি, রূপকালঙ্কার এবং কাব্যিক-ছন্দে পূর্ণ। কোরআনের এ রূপগত সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে ইসলামের প্রথম যুগে অনেকে মুসলিম হয়ে যান। ফিক্হ অথবা কালাম শাস্ত্রের প্রথমদিকের বই প্রকাশ হওয়ার আগেই প্রথম প্রজন্মের মুসলিমদের সময় ইসলামি স্থাপত্যকলার সেরা সেরা কাজগুলো নির্মিত হয়েছিল। যেমন, তিউনিশিয়ার মসজিদে কারাওইন ও জেরুজালেমের কুব্বাত আস সাখরা। এ সময়টায় এক অভিনব ক্যালিগ্রাফি শিল্প এবং পুরা নতুন একটি সাহিত্যিক ধারা আরম্ভ হয়। আইন ও ধর্মতত্ত্বের মত যদিও চিত্রকলা এবং শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা ইসলামি সভ্যতার অনুপম নন্দনতত্ত্ব (aesthetics) ট্র্যাডিশনের জন্য অপরিহার্য ও জরুরি ছিল, কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান সময়ে এদের কদর নাই বললে চলে। যদিও এটি মানবজাতির সকলের জন্য এক উল্লেখযোগ্য ক্ষতি, বিশেষ করে এটি মুসলমানদের জন্য দুঃখজনক। যেহেতু হাদিসে আসছে, “আল্লাহ সুন্দর, এবং তিনি সৌন্দর্যকে ভালোবাসেন, তাই সৌন্দর্য থেকে উদাসীন হওয়া আল্লাহর প্রতি উদাসীনতার সমান।”


যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে
ইসলামি শিল্পকলার পূর্ণ বিকাশ ঘটে ৮০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। কয়েক শতাব্দিতে যে দীপ্তি এবং ঔজ্জ্বল্য পৃথিবীর কাছে উপস্থিত করেছে তা পাশ্চাত্য সভ্যতা ও পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার সঙ্গে বিচার করলে অতুলনীয় বলে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে যখন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার একটি আড়ষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল, একটি দূরন্ত নির্জনতা ছিল, তখন ইসলামি সভ্যতা স্বচ্ছন্দ উন্মুক্ততায় পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়েছে। মূলত মুসলমানদের কারণে পাশ্চাত্য শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল। যাকে আমরা রেনেসাঁ বলি অর্থাৎ ইউরোপীয় রেনেসাঁ, ইসলামের সংস্পর্শে না এলে তা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। মুসলমানরা স্পেন দখল করেছিল এবং তার ফলে ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে নতুন জাগৃতির সাড়া পড়েছিল। এটা না বললে নয়- ইসলামের বিশিষ্টতা এখানে যে, ইসলাম পৃথিবীর সকল ধর্ম এবং সভ্যতার প্রতি সহিষ্ণু ছিল। এ সহিষ্ণুতার নিদর্শন আমরা পাইÑ যখন দেখি ইসলাম তার পূর্ববর্তী সকল সভ্য জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেছে। গ্রীক সভ্যতা এবং বিজ্ঞানও মুসলমানদের কারণেই সম্মানিত এবং সংরক্ষিত হয়েছিল এবং তাদের মাধ্যমেই সমগ্র ইউরোপে পরিচিত হয়েছিল। সুতরাং একথা বলা যায় যে ইসলাম শুধু একটি ধর্ম হিসেবে আসেনি, একটি আশ্চর্য সভ্যতা হিসেবে এসেছে। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, প্রশাসনের ক্ষেত্রে, বাণিজ্যসহ আরও বহুবিধ ক্ষেত্রে মুসলমানরা পৃথিবীকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং এ সমস্ত ক্ষেত্রে ইসলামের অগ্রযাত্রা সুদূর চীনদেশ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল।

যারা এ ধরনের একটি নতুন প্রাণবন্ত সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল শিল্পজগতেও তারা অসামান্য চাতুর্যের নিদর্শন রেখে দিয়েছে। ইসলামে যেহেতু প্রাণীর চিত্রকর্ম নিষিদ্ধ তাই তাদের সৃষ্টিকর্ম শিল্পের অন্যান্য দিকে প্রসারিত হয়েছিল। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্থাপত্য শিল্প। চিত্রকলার বিকল্প হিসাবে অন্য যে শিল্পটি রূপ লাভ করে তা হচ্ছে হস্তলিখন শিল্প।

পারলৌকিক জীবনকে মানব সমাজের চূড়ান্ত ঠিকানা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রতিটি ধর্মের মতো ইসলামও ‘শিল্পের জন্য শিল্পকলা’র চর্চাকে সমর্থন করে না। ইসলামি জগৎ সর্বদাই তার স্বস্তিকর মধ্যপন্থা অবলম্বনের কারণে কখনো বিস্মৃত হয়নি যে, জীবনের যাবতীয় সুন্দর ও উত্তম জিনিসগুলোর (যেমন খাদ্য ও পানীয়) আস্বাদ গ্রহণ করাও পুণ্যের কাজ।

এ ছাড়া ইসলামি শিল্পসৌন্দর্যবোধের নৈতিক ভিত্তিমূলে রয়েছে এই বিশ্বাস যে, আল্লাহতায়ালা নিজে সম্পূর্ণ নিখুঁত (আল কামিল) হবার কারণে তিনি স্বয়ংসুন্দর, আর স্বয়ংসুন্দর যিনি তিনি নিত্য সুন্দরকেই ভালোবাসেন (ইন্নাল্লাহা যামীলুন, ইউহিব্বুল যামাল-আল হাদিস) এজন্যই ইসলাম এই বিকল্প শিল্পকলা হিসেবে মোহনীয় সৌন্দর্যসমেত সাহিত্য, পুস্তক শিল্প, ক্যালিগ্রাফি, ক্ষুদ্রাকৃতি চিত্রকর্ম, স্থাপত্য শিল্প এবং কোরআন আবৃত্তিকে উঁচুস্থানে নিয়ে গিয়েছে। যে কারণে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে বহুশিল্পী এই বিকল্প শিল্পকলা চর্চাকে নিজের নিয়তির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

তথ্যসূত্র
১. মুরাদ হফম্যান, ইসলাম দি অলটার নেটিভ, অনু: মইন বিন নাসির (ইফাবা: ঢাকা; ২০০৯ খ্রি.)।
২. সৈয়দ আলী আহসান, শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য, (শিল্পকলা একাডেমি: ঢাকা; ১৯৮৩ খ্রি.)।
৩. সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব ও অন্যান্য, (মিত্র ও ঘোষ প্রা.লি.: কলকাতা; ২০১৩ খ্রি.)।
৪. সৈয়দ আলী আহসান, মহানবী, (অনির্বাণ: ঢাকা; ২০১১ খ্রি.)।
৫. ড. মুহাম্মদ হুসাইন হয়কল, মহানবীর জীবন চরিত, (ইফাবা: ঢাকা; ২০১০ খ্রি.)।
৬. ড. সাধনকুমার ভট্টাচার্য, শিল্পতত্ত্ব-পরিচয়, (দেজ পাবলিশিং: কলকাতা; ২০১৩ খ্রি.)
৭. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মুসলিম চিত্রকলা, (বাংলা একাডেমি: ঢাকা; ১৯৭৯ খ্রি.)
৮. ইউসুফ আল কারদাভি, ইসলাম ও শিল্পকলা, অনু: মাহফুজুর রহমান, (খাইরুন প্রকাশনী: ঢাকা; ২০০৭ খ্রি.)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //