আলমগীর খান
প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২১, ০৮:৫২ পিএম
জাপান তেমনই একটি বতিক্রমী দেশ সার্বজনীন মানসম্মত শিক্ষাকে যারা উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করেছে এবং শিক্ষা কী যুগান্তকারী পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে তার অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল যেকোনো দেশের জন্য ওই দেশটি নিশ্চিতভাবেই অনুসরণীয়। ড. মঞ্জুরে খোদা জাপানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং তার একাডেমিক গবেষণার বিষয় ছিলো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ও জাপানের শিক্ষা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা। তার ফল ‘জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা’ বইটি ২০২০ সালে প্রকাশ করেছে দ্যু প্রকাশন।
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিককে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে জাপান যে উন্নয়ন-সাফল্য অর্জন করেছে, তার গল্প এ বই। আশ্চর্য হলো জাপান এ শিক্ষাটি গ্রহণ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে আর তা কাজে লাগিয়েছে পশ্চিমের চেয়েও ভাল করে। অথচ অনুকরণ করতে গিয়ে জাপানিরা তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে একটুও হারায়নি, বরং আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। তুলনামূলক আলোচনায় লেখক বলেছেন, ‘১৮৭১ সালে জাপানে সবার জন্য বাধ্যতামূলক একমুখী শিক্ষা চালু করা হয়, এবং ৩০ বছর পর (১৯০৫) বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় শতকরা ৯৫.৬ ভাগ।’
অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও শিক্ষার কিছু অগ্রগতি হলেও ১৯৯১ সালের পূর্ব পর্যন্ত সর্বজনীন শিক্ষা চালু করা যায়নি। দেশে প্রাথমিক পর্যায়েই কেবল ১০ ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি, এবং জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার তিনটি ধারা চালু আছে।’ জাপানিদের মাঝে তাই গড়ে ওঠে একাত্মতা ও সৌহার্দ্য, আর আমাদের সমাজে শিশুরা বড় হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিদ্বেষ ও বিরোধের মনোভাব নিয়ে। লেখক বলেছেন, জাপানিরা আপনার জন্য যেটুকু করবে বলে কথা দেবে, কাজ করে দেবে তার বেশি। সেখানে সরকারি-বেসরকারি অফিসে বা ব্যাংকে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যেখানেই হোক না, কর্মীরা প্রকৃত অর্থেই মানুষকে সেবা করে থাকে, আপনার জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। সবাই কর্মী। জাপানি সমাজ সৌন্দর্যের পূজারী। শৃঙ্খলা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তাদের শিশুকালেই শিক্ষার মাধ্যমে রক্তের মাঝে গেঁথে দেয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকে শিশুদের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩ ঘণ্টা করে নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ শিক্ষা অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, স্বাধীন চিন্তা ও আত্মনির্ভরশীলতা থেকে জীববৈচিত্র্যের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রসারিত।
জাপানে প্রত্যেক শিশু পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়। প্রায় প্রত্যেক অভিভাবকেরই ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, কিন্তু সেটা তারা সন্তানের সহপাঠীকে দেখাতে স্কুলে নিয়ে যায় না। একে অপরকে সহযোগিতা করার শিক্ষাই তাদের প্রাথমিকের মূল শিক্ষা। বইটিতে তাদের মনুষ্যত্ব, ত্যাগ, সততা, অন্যকে সেবার আনন্দ ইত্যাদির অনেক উদাহরণ দেওয়া আছে। দক্ষতা অর্জনের চেয়েও প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিনয়-শিষ্টাচার, সৌন্দর্যবোধ ও নৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে আত্মিক বিকাশ লাভ জাপানে শিক্ষার মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
মাতৃভাষা ছাড়া জাপানিরা কোনো কাজই করে না। অথচ জাপানি ভাষা সঠিকভাবে শেখা বাংলার চেয়ে কয়েক গুণ কঠিন। জাপানি ভাষায় অক্ষর শিখতে হয় প্রথমে ১০০৬টি ও পরে আরও ১১৩০টি। মঞ্জুরে খোদার কথায়- ‘তারা যেকোনো বিষয়ের জ্ঞানই মাতৃভাষার মাধ্যমে অর্জন করে। প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণাও তারা তাদের নিজস্ব ভাষার মাধ্যমেই করে থাকে। ... বিশে^র যেকোনো ভাষায় প্রকাশিত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক ও নন-অ্যাকাডেমিক বই-পুস্তক-জার্নাল ও গবেষণাপত্র তাদের ভাষায় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়।’
জাপানি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় প্রাকপ্রাথমিক থেকে, শতভাগ শিশুর জন্য। প্রত্যেক শিশু বিদ্যালয়ে যায়, কেউ ক্লাস বাদ দেয় না, কেননা বিদ্যালয় হচ্ছে শিশুদের পরম আনন্দের জায়গা। সেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একত্রে বসে খাবার খায়। ফি বছর একখান করে চূড়ান্ত পরীক্ষার বালাই নেই। স্কুলে কোনো শিশু অকৃতকার্য হয় না, যদি কেউ অকৃতকার্য হয় সে তার শিক্ষক, কেননা দায়িত্ব শিক্ষকের, সাফল্য শিশুর। সেখানকার সমাজে শিক্ষকরা পরম সম্মানিত ও নিবেদিত-প্রাণ। জাপানে সবচেয়ে মেধাবীরাই কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারেন। শিক্ষকের বেতন সেখানে যেকোনো সরকারি চাকুরির চেয়ে বেশি।
জাপানে আমাদের মত এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ বলে কিছু নেই, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ তাদের শিক্ষারই অন্তর্গত। আমাদের মত তাদের সমাজে ‘বাইরের বই’ বলে কিছু নেই, ভাল বই মাত্রই তাদের কাছে পাঠ্য ও প্রয়োজনীয়, বাইরের জিনিস নয়। আবার দেখা যায়, জাপান যখন প্রাথমিক শিক্ষার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, আমাদের ব্রিটিশ-প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে কিছু কেরানি ও সুবিধাভোগী মানুষ তৈরিতে ব্যস্ত।
এ বইয়ে আলোচনা করা হয়েছে জাপানে শিক্ষার উন্নয়নে মেইজি সরকারের অনন্য ভূমিকা ও কনফুসিয়ান শিক্ষার উল্লেখযোগ্য প্রভাব নিয়ে। তবে জাপানের বিশেষত্ব হচ্ছে শিক্ষাকেই তারা তাদের উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যেহেতু দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ নেই বললেই চলে, তারা শিক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রত্যেক নাগরিককে সম্পদে পরিণত করার সাধনা করেছে, অর্থাৎ মানবসম্পদ তৈরি করেছে ও এদিক থেকে পৃথিবীতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশের জন্য জাপান অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে দু দেশের মাঝে অনেকরকম মিল আছে। দুই শতাব্দী আগে যে মিল আরও বেশি ছিলো, এখনকার যেসব বিরাট অমিল তার বেশিরভাগটাই ইতিহাসের তৈরি, প্রাকৃতিক নয়। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা তাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি শিক্ষণীয়।
ড. মঞ্জুরে খোদার লেখা ‘জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা’ বইটি পাঠিকা-পাঠককে জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা বুঝতে ও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো দেখতে সহায়তা করবে। নীতিনির্ধারকদেরকে সহায়তা করবে শিক্ষায় আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে ও সদিচ্ছা হলে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে।
জাপানের উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা
ড. মঞ্জুরে খোদা
প্রকাশন : দ্যু প্রকাশন
প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০২০
দাম : ৪০০ টাকা
ABOUT CONTACT ARCHIVE TERMS POLICY ADVERTISEMENT
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ | প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ
প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী | ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
© 2021 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh