হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-নন্দনতত্ত্ব

হুমায়ুন আজাদ আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিক হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত; নিজেও কবিতা লেখার ফিরিস্তি হিসেবে সেই পরিচয়কে বিশেষভাবে জাহির করেছেন নানান জায়গায়। শিল্পের নির্মাণে এবং শিল্পের উপস্থাপন-কৌশলের বেলায়ও, আংশিকভাবে, এই বিষয়টি সত্য বলে প্রতীয়মান হবে তাঁর সাহিত্যের বেলায়। ১৯৯৮ সনে প্রকাশিত তাঁর কাব্যসমগ্রের ভূমিকায় হুমায়ুন আজাদ নিজেই বলছেন, সৌন্দর্য তৈরি করাই তাঁর সাহিত্যের প্রধান উদ্দেশ্য।

তবে হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য নির্মাণে যে ধরনের চিন্তা-প্রক্রিয়া বিদ্যমান ছিল, সেই চিন্তা-প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে এই বিষয় স্পষ্ট হয় যে, তাঁর সাহিত্য কোনো একটি নির্দিষ্ট নন্দনতত্ত্বের ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কেউ কেউ, যারা নানান কারণে হুমায়ুন আজাদকে বিরোধিতা করে কথা বলেন, তাঁদের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে নিশ্চয়- আর তা হলো হুমায়ুন আজাদের সব লেখা-পত্তর না পড়েই মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া। এটা সাংঘাতিকভাবে একটা বাজে প্রবণতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ কেউ নন্দনতত্ত্বের হিসেবে হুমায়ুন আজাদকে পুরোপুরি ‘আধুনিকতাবাদী সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের’ লোক হিসেবে বিবেচনা করেন; কিন্তু তাঁর সমগ্র সাহিত্য-পাঠ করলে এই মন্তব্য মিথ্যে হিসেবে উঠে আসে। আজাদের কবিতাকে আদতে দু’ভাবে পাঠ করা সম্ভব- কেবলই সাহিত্যের জন্য সাহিত্য-এই নন্দনতত্ত্বের তীব্রতায়; এবং একইসঙ্গে সমাজের নানান কর্মকাণ্ডের চাপে-তাপে সৃষ্ট সাহিত্যের হিসেবে।

আজাদের সাহিত্য-বিশ্বাস তাঁর সাহিত্য-জীবনের প্রথমদিকে আবর্তিত হয়েছে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ মতবাদকে ঘিরে। এবং এই মতবাদ খাতা-কলমে টিকিয়েও রেখেছিলেন আজাদ, বাস্তবে এর প্রমাণ তাঁর কবিতা-পাঠের বেলায়ও মেলে; কিন্তু এই বিশ্বাসের ফাটল ধরে গেছে নানান প্রক্রিয়া-প্রভাবে, সে বিষয় কেউ আর বাতিল করে দিতে পারেননি; পারা সম্ভব নয়। বিশেষ করে যে রাষ্ট্রে হুমায়ুন আজাদের ঘর-বসতি ছিল, যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত জীবনযাপন করেছেন, সেই রাষ্ট্রের নানান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক তৎপরতা তাঁকে ভাবিয়েছে ভিন্নভাবে। ভাবতে বাধ্য হন যে কোনো লেখকই; কিন্তু সেই ভাবনা যে কেবল ভাবনায়ই সীমাবদ্ধ থেকেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। সেই সব চিন্তা নানানভাবে বিবর্তিতও হয়েছে। সেই বিবর্তনই নানাভাবে বদলে ফেলেছে হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-নন্দনতত্ত্বকে। সেই প্রভাব হুমায়ুন আজাদও বাতিল করে দিতে পারেননি।
‘আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিল/ শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,/ এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।/আমার দুঃখ,/তোমার স্বপ্ন দেখার জন্য/ আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম। (তোমার দিকে আসছি)’ কিংবা ‘চোখের মতোন সেই ইস্টিমার/ নীল নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে গাঢ় বেগে/যারা শুয়ে আছে পাটাতনে/ প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় বিভিন্ন শ্রেণিতে/ তারা আমার গভীর আত্মীয়। (অলৌকিক ইস্টিমার)’ এভাবে কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে বুঝি আধুনিকতার ভেতর থেকেও তিনি আলাদা হয়ে ওঠেন।

তবুও যতই তিনি আধুনিকতাবাদী সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের সমর্থক হন না কেন, তাঁর কবিতায় ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ বিষয়টা কার্যকর হলেও তিনি নানাভাবেই তাঁর সাহিত্যে এক করে ফেলেছেন রাষ্ট্র-সম্পর্কিত নানান বিষয়। তাই গাসেৎপন্থী যে সাহিত্য নন্দনতত্ত্বের সমর্থক হিসেবে হুমায়ুন আজাদকে বিবেচনা করা হয়- তা সর্বাংশে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

আজাদ কবিতাকে কেবলই সাহিত্যের জন্য নির্মাণ করেছেন- এমন কথা তিনি অনেক স্থানেই বলেছেন। এবং একইসঙ্গে তিনি এ বিষয়ে লেখাজোখাও জারি রেখেছেন। বিশেষ করে তাঁর শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ-প্রক্রিয়াকেই তিনি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। এ বিষয় একেবারেই মিথ্যে নয়, সত্যতা আছে এই বিষয়ের; কিন্তু একইসঙ্গে এই ধারায় কবিতা রচনা করার পরও সমাজ-সম্পৃক্ত কবিতার বেলায়ও কম যাননি হুমায়ুন আজাদ। তিনি একইসঙ্গে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’-এই নন্দনতত্ত্বে আস্থাশীল থেকে লিখেছেন কবিতা। সেই সব কবিতায় অনেকটা বোদলেয়ার ও হোসে অর্তেগা ঈ গাসেৎ-এর সাহিত্য-তত্ত্ব অবলম্বনে কবিতা-পথ পেয়েছে। আবার ভিন্ন দিকে তিনি রাষ্ট্রের নানান কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করেও কবিতা লিখেছেন।

এর জন্য হুমায়ুন আজাদের ওপর সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার জন্য যে সমস্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল, সেই সমস্ত আন্দোলন। এই বিষয়সমূহ দ্বারাও তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী এই আন্দোলনের নানান প্রভাব গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল হুমায়ুন আজাদকে। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারাও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তিনি। এই আন্দোলনসমূহ, সবই প্রভাবক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতায়। যদি কেউ বলে দেয় এই যে পরিবর্তন তা কি খারাপ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে? এ ব্যাপারে বলতে হবে বিষয়টা একেবারেই তেমন নয়। কারণ সাহিত্যে সাহিত্যিক ক্রমাগত বদলে যেতে থাকবেন, এটাই একজন ভালো সাহিত্যিকের বড়ো গুণ হিসেবে বিবেচিত হবে, হওয়া উচিত। হুমায়ুন আজাদ মূলত সেটাই করেছেন তাঁর সাহিত্যে। তিনি কবিতা লেখার বেলায়ও এই বিষয়টা মেনে চলতে পেরেছেন।

ভাষা আন্দোলন ও ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেমন তাঁর মানস-জগতে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল, তেমনি করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নানান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় চড়াই-উৎরাইও হুমায়ুন আজাদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান আধিপত্য, ধর্মীয় মৌলবাদের নানান চিহ্ন-বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল হুমায়ুন আজাদকে। এই বিষয়সমূহ হুমায়ুন আজাদ তাঁর প্রবন্ধ-সাহিত্য এবং কথাসাহিত্যে সবচেয়ে ভালোভাবে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টা যে কবিতায় করেননি, তেমনও নয়। তিনি কবিতায়ও বিষয়টা এনেছেন। তবে কবিতার নির্মাণ তো আর সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো নয়। কবিতা কোনো কথাই সরল করে বলে না। নানান হেঁয়ালি তৈরির মাধ্যমেই কবিতা তৈরি হয়। হুমায়ুন আজাদ এই বিষয়ে তো পণ্ডিত ছিলেন। ফলে এই কাজটা তিনি করেছেন।

ফলে কেবলই বোদলেয়ার কিংবা গাসেৎ-এর উদাহরণ টেনে হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যকে বিমানবিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ফেলে দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না। তিনি যদিও নানান জায়গায় সাহিত্যের শুদ্ধতা বিষয়ে কথা বলেছেন- তা তিনি যতোই বলেন না কেন- তা মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না, যদি কেউ তাঁর সমগ্র সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ করেন। কারণ তাঁর সাহিত্য-পাঠের মাধ্যমেই যে কেউ স্পষ্ট হবেন যে তিনি কোন ধরনের সাহিত্য বিষয়ে কথা বলেছেন।

ফলে সবশেষে এই কথা বেশ জোর দিয়ে বলতে হবে যে, কোনো একক নন্দনতত্ত্ব-সূত্রে হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-পাঠ সম্ভব নয়। হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য, বিশেষ করে তাঁর কবিতা, যে কোনো আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ের ধার ধারে না বলে, যে কথা প্রচলিত আছে- সেই কথার হিসেবে বলতে হয় যে, নন্দনতত্ত্বের একক হিসেবে নয়, নন্দনতত্ত্বের বহুসূত্রের হিসেবেও হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য-পাঠ সম্ভব।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //