শিখা গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা

ষোড়শ শতক, সে সময়। সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় কুসংস্কারসহ যাবতীয় অন্ধতার চোখে চোখ রেখে অনন্ত প্রস্তর ভেঙে এক আলোর বাহার মানবের সামনে নিয়ে এসেছিল ইউরোপীয় চিন্তক ও দার্শনিকরা- ফলরূপে উন্মোচিত হলো ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগের দ্বার। বহুকাল পরে হলেও ভারত উপমহাদেশে আবারও সেই ধারাবাহিকতায় জ্বলে ওঠে আলো, ঘটে চিন্তার জাগরণ ও প্রগতির বিস্তার। ধর্মের মতো শক্ত বেড়ি ছুড়ে ফেলবার ব্যাপারটি কোনোকালেই এত সহজ ছিল না এখানে, তবে ঊনিশ শতকে কলকাতায় এই কর্মের হাল শক্ত হাতে ধরেন একদল তরুণ, ডিরোজিওর নেতৃত্বে। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, বঙ্কিম প্রমুখের হাত ধরে শাণিত হয় সে সময়ের চিন্তার গতি। 

একে উপমহাদেশীয় নবজাগরণ হিসেবে দেখা হলেও এটি ছিল অসম্পূর্ণ কিংবা খণ্ডিত। কারণ বৃহত্তর মুসলিম সমাজকে দূরে রাখা হয়েছিল এই আন্দোলন থেকে। হিন্দু মধ্যবিত্তকে কেন্দ্র করেই এগোচ্ছিল বিকাশের স্রোত। ছিটকে থাকা বাঙালি মুসলমান তা ক্রমেই টের পেতে থাকে, স্বতন্ত্রতায় জাগরণী কণ্ঠ গড়ে উঠতে সময়টি হয়ে আসে বিংশ শতাব্দীর বিশ দশক। 

‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ঠ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’- এই মন্ত্রকে সামনে রেখে পুনর্জাগরণের আন্দোলনে এক নতুন মুখপত্র যাত্রা শুরু করে ‘শিখা’ নামে। পত্রিকাটি ছিল ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ সম্পাদিত মুসলিমদের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার এক আলোকবর্তিকা।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র সভাপতিত্বে, ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংগঠনিক দায়িত্ব পড়েছিল মুসলিম হলের ছাত্র এএফ আবদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেন, ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল কাদির প্রমুখের ওপর। নেপথ্যে দায়িত্বরত ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ ও যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক কাজী আনোয়ারুল কাদীর। 

মুসলিম সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা হলো, তবে শিল্পগুণে স্বতন্ত্রতা সত্ত্বেও মুসলিম সাহিত্যকে আলাদা করে দাঁড়াবার সুযোগ দেয়নি কলকাতার বিশেষ সাহিত্যবোদ্ধারা। মূলে লুকিয়ে ছিল ধর্মীয় রাজনীতি। তবে শিখা পত্রিকা যাত্রা শুরু করবার পর, মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে আন্দোলনের পুরোধা আবুল হোসেন এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন- ‘কেহ হয়তো মনে করবেন এ সমাজের নাম মুসলিম সাহিত্য সমাজ হওয়ায় হিন্দু সাহিত্যিকদের কোনো সম্পর্ক এতে নেই; কিন্তু, এই বার্ষিক রিপোর্ট হতে আপনারা বুঝবেন যে এ সমাজ কোনো একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয় কিংবা এ কোনো এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য গঠিত হয়নি। সাহিত্য সৃষ্টি এর উদ্দেশ্য, আর সেই সাহিত্যে মুসলমানের প্রাণ ও জীবন ফুটিয়ে তোলাই ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য।’ সাহিত্য সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকে আশ্রয় করেছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজ। মুসলিম সাহিত্য-সমাজের মূলমন্ত্র ছিল, বুদ্ধির মুক্তি। বুদ্ধির মুক্তি বলতে তারা বুঝতেন, অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মানুষের বিচারবুদ্ধিকে মুক্ত করা; তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

 ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর প্রকাশ হওয়ার পর সমাজের স্বার্থবাদী সমাজপতিদের চাপে পড়ে তাদের রোষানলে পত্রিকাটি প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অধ্যাপক আবুল হুসেনের ইস্তফা দেওয়ার কারণেই মূলত শিখার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯২৯ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি মুসলিম সাহিত্য সমাজ থেকে ইস্তফা দেন। এর আগের দিনই তাকে আহসান মঞ্জিলে ডেকে নিয়ে তার বিরুদ্ধে বিচারালয় বসানো হয়। তাকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সাবধান করা হয়। তিনি পরবর্তিতে ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে ইস্তফা দেন এবং চলে যান কলকাতায়।

শিখা পত্রিকার প্রকাশিত পাঁচটি সংস্করণে সম্পাদকমণ্ডলী যথাক্রমে আবুল হুসেন (প্রথম সংস্করণ), কাজী মোতাহার হোসেন (দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংস্করণ), মোহাম্মদ আবদুর রশীদ (চতুর্থ সংস্করণ) এবং আবুল ফজল (পঞ্চম সংস্করণ)। তবে সম্পাদক যারাই থাকুক না কেন মূল সম্পাদনার দায়িত্বে থাকতেন- আবুল হুসেন। পত্রিকাটি চালানোর অর্থের জোগান দিতেন তিনি।

তাদের কার্যবিবরণী ও বার্ষিক মুখপত্র বিশ্লেষণ অনুসারে, সংগঠনটি যে নবজাগরণের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজকর্ম ও সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিল তার মূলে ছিল আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল পাশার উদ্যম, ভারতের নবজাগরণে বিভিন্ন মনীষীর প্রয়াস ও মানবতার উদ্বোধনে সর্বকালের চিন্তাচেতনার সংযোগ।

এ পুনর্জাগরণী সংগঠনের লেখকরা তাদের চিন্তাধারাকে বাঙালি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনটি পথ অবলম্বন করেছিলেন- পত্রপত্রিকা প্রকাশ, সাময়িক অধিবেশন ও বার্ষিক সম্মেলনের ব্যবস্থা এবং গ্রন্থরচনা ও প্রকাশ।

মূলত তৎকালীন সমাজে মুসলমান জনগোষ্ঠীর নিজেদের চিন্তা ও সাহিত্যের দিশা হিসেবে উঠে আসে ‘শিখা’ পত্রিকার লেখাগুলো। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেছে। ‘শিখা’র প্রতিটি সংখ্যায় স্বতন্ত্রভাবে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কেন্দ্র করে নিজেদের লেখা সম্পাদনা করা হতো। লেখা থাকত ইতিহাসের চমৎকার সব অধ্যায় নিয়ে। এ ছাড়াও ধর্মের উল্লেখ্যযোগ্য বিষয় নিয়ে প্রতিটি সংখ্যায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হতো। সেখানে লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজের প্রচলিত কুসংস্কারের বিষয়ে সজাগ করা এবং সমাজে নারীদের নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির চেষ্টা জারি ছিল। তারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নারীদের পিছিয়ে রাখার পক্ষে ছিলেন না। 

বাংলার মুসলিম মুক্তচিন্তার আন্দোলন ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ যখন মুখ থুবড়ে পড়ল, তখন থমকে গেল বুদ্ধিচর্চার এই পত্রিকাটি। সেখানে থেমে না গিয়ে মহাসমারোহে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারলে হয়তো- এই বাংলার ইতিহাসটা অন্যরকম হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //