সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় অবক্ষয় ও সভ্যতা

‘অবক্ষয়’ শব্দটি খুব বেশি সহজবোধ্য নয়। সিকদার আমিনুল হক এ কথাটি হয়তো খুব ভালো করেই জানতেন। আর তা জানতেন বলেই বিষয়টিকে তিনি এড়িয়ে যাননি। সৃষ্টিতত্ত্ব ও ধ্বংসতত্ত্ব খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। সৃষ্টিতত্ত্ব না জানলে অবক্ষয়বাদ সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যায় না। সভ্যতার শুরু থেকেই অবক্ষয়বাদের উৎপত্তি। দূরের কার্নিশ থেকে সিকদার আমিনুল হক তা পুরোপুরি অবলোকন করেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি তা দেখেছেন এবং আমাদের দেখিয়েছেন। আমরা আজও তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তিনি যখন লেখেন : পেয়েছি নিজের কর, কররেখা ছাড়া/ উদ্ভ্রান্ত দিনের মুকুর/ বিবস্ত্র সবুজ হ্রদে, পাখির পালকে/ উগ্র চিহ্ন দুরন্ত দুপুর।/ উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ ভালোবাসো তুমি/ আমি শুধু পূজারী পুকুর। (১৯৭৫ : ২৯)

সিকদার আমিনুল হক এখানে ‘কররেখা ছাড়া’, ‘উদ্ভ্রান্ত দিনের মুকুর’, ‘বিবস্ত্র সবুজ হ্রদ’, ‘উগ্র চিহ্ন’, ‘দুরন্ত দুপুর’, ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ ভালোবাসো তুমি’ এবং ‘আমি শুধু পূজারী পুকুর’ শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। কবিতাটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন, প্রতিটি উপমায় কবির ক্ষোভ, কষ্ট, অভিমান ঝরে পড়েছে। তার কর, কররেখাবিহীন খাঁ খাঁ করছে, তার মন ভালো নেই। অদৃশ্য মানসিক উন্মুখতায় তিনি অবক্ষয়জারিত। কোনো রহস্যময় বৈপরীত্য তাঁর চেতনাকে গ্রাস করেছে, যা তিনি প্রতিচিত্র হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী গাছ’ আর ‘পূজারী পুকুর’ শব্দ দুটি অস্বাভাবিক প্রকরণগত বোধকতায় নিমজ্জিত। তিনি চিত্রকল্প এবং উপমাকে প্রেমিকার মতো ভালোবেসে উপস্থাপন করেন যা পাঠকচিত্ত আলোড়িত করে খুব সহজেই। তিনি তৃষ্ণিত শাবকের মতো হৃদয়ের অতৃপ্ততাকে কবিতার ছত্রে ছত্রে গেঁথে নির্মাণ করেন এক মোহনীয় প্রতিমার। নৃসিংহ মুরারি দে তার অবক্ষয়বাদ গ্রন্থের প্রাক্কথনে লেখেন: ‘মানুষ জন্মগতভাবে অসভ্য। সভ্যতা তাঁর নিজস্ব অর্জন। জ্বর যেমন অস্বাভাবিকতা। অসভ্যতা কিন্তু ঠিক তেমন নয়। অসভ্যতা মানুষের স্বাভাবিকতা। অসভ্যতার অবস্থান অস্বাভাবিকতায়। এই ‘অ’ প্রধান জীবনযাপনের জন্যেই জীবজগতে মানুষ অনন্য, যার কোন বিকল্প নেই। বিকল্পহীনতার জন্যেই মানুষ জীব জগতে শ্রেষ্ঠ। মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই।’ (নৃসিংহ মুরারি দে ২০০৭ : ৭) 

মানুষ যে সভ্যতাকে অর্জন করেছে নিজের চেষ্টায়, তিলে তিলে এবং ধীরে ধীরে। সেই সভ্যতাকে আবার মানুষই ধ্বংস করে নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়োজনে। সভ্যতার অপমৃত্যুতে যে অবক্ষয়ের জন্ম হয়, সিকদার আমিনুল হক যেনো সেই কুৎসিত পরাবাস্তবতার অনুসন্ধান করেছেন স্বীয় বোধের তাগিদে। তিনি লেখেন- ‘আলোর জায়গাটুকু কেন অন্ধকারের তাঁবুতে ঢেকে দিলে? কোন যুক্তিতে এই আত্মত্যাগ? পুরোহিতের তর্জনীর সামনে নিষ্ফল অভিনয়... একদণ্ডও ভালোলাগে না ঊষর মরুর বুকে ক্ষণ বিস্মৃতির মরীচিকা। গৃহ তো গৃহ, যেখানে খিলখিল হাসির উৎসব নেই, তাকে কী করে বেদনার মুকুট পরাবো?’ (১৯৭৫ : ৬১)

শুধু অন্ধকার থাকলে ধরে নেওয়া যেত, আলোর জন্মই হয়নি। কিন্তু এখানে তো আলো ছিল। তবে কেন এই আত্মত্যাগ? এটা কি শুধুই আত্মত্যাগ নাকি বাধ্যগত বিসর্জন? যদি তাই হবে তবে পুরোহিতের সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয়ের কি প্রয়োজন, এমন প্রশ্ন তো স্বাভাবিক নিয়মে চলে আসতেই পারে। কবি তো প্রথম স্তবকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি যদি তখন কোনো চিহ্ন তুলে ধরতুম, তা’হলে তোমাদের চোখে গভীর অবিশ্বাসই ঝলসে উঠতো’ (১৯৭৫ : ৬০)। এটা তো স্পষ্ট মানবিক বিপর্যয়। তাহলে তো সভ্যতার অপমৃত্যু অবশ্যই হয়েছে। এই যে অবক্ষয়, এখানে অসভ্যতা হয়তো নেই কিন্তু বিপর্যয় তো ঘটেছে-ই। সিকদার আমিনুল হক এভাবেই তাঁর কবিতায় অবক্ষয় ও সভ্যতাকে খুঁজে বেড়ান। তাই তো তিনি লেখেন : ‘মন-ও যথেষ্ট নয়, চাই ধ্যান, চাই পাতা ঝরা,/ মাঝে-মাঝে ঝড়ো দিন-সমুদ্রের কর্কশ সাঁতার, পথে-পথে সরীসৃপ, আকাশের গূঢ় অন্ধকার/ হঠাৎ জাগায় ক্লান্তি, পেতে চায় শান্ত পান্থশালা।’ (১৯৭৯ : ৯)

মানব ও সভ্যতার বিকাশমান ধারায় মন-ই যথেষ্ট নয়, তার জন্য গভীর ধ্যানের প্রয়োজন রয়েছে। সভ্যতার সঙ্গে এই মতাদর্শের সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যও যাই থাকুক না কেন, মতাদর্শের আবর্তে মানুষের নৈতিক চেতনার অবক্ষয় কখনো কখনো জরুরি হয়ে পড়ে। অবক্ষয়জারিত মানুষ শুধু যে ঝরা পাতা, ঝড়ো দিন, কর্কশ সাঁতার বা আকাশের গূঢ় অন্ধকার ঠেলে ঠেলে সভ্যতাকে খুঁজে বেড়ান শুধু তাই নয়। ক্লান্তিতে তিনি শান্ত পান্থশালা চান এবং তার মনও বৈষয়িক ও মানসিক আত্মকেন্দ্রিকতায় নিপতিত হয়। আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে শুরু আত্মনির্ভরতায় সৃষ্ট অবক্ষয় সিকদার আমিনুল হকের চৈতন্যকে গ্রাস করে। তিনি মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেও বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে মুক্তি পেতে চান, ওষ্ঠের সঙ্গে ওষ্ঠের চুম্বন প্রত্যাশী হয়ে সভ্যতাকে আলিঙ্গন করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে। ‘আমি স্নাত, আমার ঈশ্বর শুদ্ধ করে দুই তীর-পড়ে থাকে বালি আর বালি’ (১৯৭৯ : ৯)। এই আকাঙ্ক্ষাও কবির অন্তরে ফল্গুধারার মতো বহমান থাকে এবং তিনি সভ্যতার অন্বেষণে পাড়ি দেন প্রবল স্রোতের সাগর। কেননা তিনি জানেন এই সভ্যতার পতন হলেই সভ্যতাকে গ্রাস করে নেবে অবক্ষয়; কিন্তু কবি মন সর্বদা স্বপ্নে বিভোর, তাই চৈতন্যে ভিড় করে থাকে আবহমান সময়ের বৈরী হাওয়া। তিনি শব্দের সাগরে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকে সভ্যতার জন্য নির্মাণ করেন সংস্কৃতির মাচা। আর তার ওপর সভ্যতার লতানো শরীর বিছিয়ে দিয়ে নির্মাণ করেন কাব্যের মজবুত অট্টালিকা। এখানে সংস্কৃতি ও সভ্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তাই তো কবি খুব সচেতনভাবেই বাস্তবতার প্রকাশ ঘটান, শুধুই কল্পনাতাড়িত নয়। বরং চেতনায় ও অবচেতন সত্তার স্বার্থক সম্মিলন। তিনি তার বিশ্লেষণে গলির খুব জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর মুনশিয়ানা আমিত্বের দাবিদার। আর সভ্যতার মূল উৎস তো আমিত্বের মধ্যেই নিহিত থাকে। 

‘যাকেই দেখো না তুমি, আমি কিন্তু তোমাকেই দেখি, তোমাকে ছাড়া তো কিছুই দেখি না’ (১৯৮২ : ১১)! এই লাইনটির মধ্যেই নিহিত রয়েছে কবির নন্দনচিন্তা। তিনি তাঁর কল্পনার রানীকে খুঁজে না পেলেও বারান্দাকে দেখেন আর এই ফ্ল্যাট বাড়িটার ‘প্রৌঢ় ছায়া’ গিলে খান চোখ দিয়ে। ‘প্রৌঢ় ছায়া’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি তার নিরলস কাব্য সাধনায় প্রতীকী ব্যবহারের মূর্ছনার কথা সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি যেন যুগ যুগ ধরে এ দৃশ্য অবলোকন করছেন। তিনি শীর্ণ নর্দমায় বেড়ালের চলাফেরা আর দাঁত ভাঙা প্লাস্টিক চিরুনি কুড়ানো ছেলেটাকে দেখেছেন। তিনি মনে করেন কাকের চোখে প্রখর ঘৃণা ঝরে পড়ছে তথাপি অপচয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রেম। তিনি প্রেমের অবক্ষয় দেখেছেন শিশুর বলের মতো ছুটে চলেছে। এমন অবক্ষয় দেখে কবি ক্রমশ গাঢ় হয়ে পড়েছেন। এই বারান্দাকে তিনি দূরবীনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই দূরবীনে পৃথিবীর সবকিছু স্পষ্ট হলেও কবির কল্পনার রানী অস্পষ্ট হয়ে অধরাই থেকে গেলেন। তিনি যে কাব্যিকতা করেছেন তা পাঠক মাত্রকেই নাড়া দিয়ে যায়। বাস্তব ও কল্পনার সম্মিলনে এমন মিথষ্ক্রিয়ার ব্যবহার বাংলাকাব্যে খুবই বিরল। আবার কবি শামসুর রাহমানের মতো নাগরিকতাও তাঁর কবিতার শরীরে নানা ব্যাঞ্জনার সৃষ্টি করেছে। 

বস্তুত তাঁর কবিতাতেই ঠাঁই পেয়েছে নাগরিক চেতনা আর নগর প্রকৃতির নানা পরাবাস্তবতা। ইন্দ্রিয়ঘন পরাবাস্তবতার যে কাব্যিক বিন্যাস তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতার শরীরে তা আমাদের চেতনাকে আক্রান্ত করে প্রবলভাবে। ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি, সংসার, শিল্প-সাহিত্য, শিক্ষার মতো উপাদানগুলো যখন অবক্ষয়ের করালগ্রাসে আক্রান্ত হয় তখন কবিমন ব্যথিত হয়। মধ্যরাতের তারপাশা (চট্টগ্রাম) কবিকে স্পর্শ করে, তিনি জাহাজের ডেকের ওপর পদশব্দ আর রাতজাগা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পান। তিনি ক্রোধমত্ত পদ্মার আক্রোশে পাড় ভাঙার শব্দ শুনতে পান আর দূর গ্রামে কুকুরের পদচারণা। নাগরিক বিষাদ আর হতাশাঘেরা অবক্ষয় কবিতার শরীরে নাগরিকচেতনার নিস্তরঙ্গ প্রভাব ফেলেছে। রোমান্টিক কবিতার ক্ষেত্রেও কবি সিকদার আমিনুল হক নিবিড় চর্চা আর কঠিন সাধনায় একটা জগৎ সৃষ্টি করেছেন।

কিন্তু সেখানেও তিনি হতাশার বা অবক্ষয়ের গন্ধ খুঁজে পান। কবি কাকে খুঁজতে আসেন কিন্তু তা এলোমেলো আড্ডায় কেন? আর কেন-ই বা সে লতাগুল্ম হয়ে প্রতীক্ষার অর্থ খুঁজে পায় না? হলুদ কলঙ্ক মেখে সে তো স্যাঁতসেঁতে নিরালায় বসে আছে কিংবা মজা পুকুরের কচুরিপানার মতো নিষ্প্রাণ সবুজ। তাহলে এখানে তো অবক্ষয় সুস্পষ্ট। আয়নায় নিজের মুখ আর শ্বেতবর্ণ চুল দেখে বিস্মিত হন। নানাভাবে তা আড়ালের ব্যর্থ চেষ্টা করেন যদিও এই রুক্ষ বাস্তবতার অর্থ তিনি জানেন। সবকিছু জেনেও ভালোবাসার গভীর আবেগে তিনি নিজেকে বিস্ফারিত করেন। বিষাদ, হতাশা আর ক্লান্তি তাকে রোমান্টিক কবিদের মতো আচ্ছন্ন করে রাখে। তিনি জানেন, কোনো ভাবাবেগে প্রেমের কবিতাকে নান্দনিক করে তুলতে হয়, তুলে আনতে হয় অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্ত থেকে মোহনীয় লোকালয়ে। ‘বাঘিনীর প্রেম’ কবিতায় তিনি লেখেন : দারুণ ঠুনকো সখে আবর্জনা বাড়ে/ জড়ো করি যতো,/ পতঙ্গ লুকোয় ঘাসে, তুমি অন্য ঘরে/ অন্যদের মতো। (১৯৮৭ : ৪৪)

মানুষের মনোবিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ও স্পর্শকাতর অংশের নাম প্রেম বা ভালোবাসা, যা এই কবিতায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। কবি বুকভরা মান্ধাতার আশা নিয়ে নষ্ট বিবেচনায় বিভোর। ভালোবাসার অবক্ষয় থেকেই তো তিনি বলেছেন প্রেমে পড়ে নির্ঘাত পতন। তবুও মোহ ক্রীতদাসের মতো আমাদের কামনাতাড়িত করে প্রতিনিয়ত। এইরকম ঠুনকো শখে শুধু আবর্জনা বাড়ে। বস্তুত সবাই স্বার্থপরের মতো প্রয়োজন ফুরালে কেটে পড়ে। যখন তিনি লেখেন : রেখে দাও। প্রৌঢ়ের বিলাস নিদ্রা, আর কিছু নয়।/ কেন আনো জঙ্ঘা, জানু; ক্যাভিয়ার, তীব্র লাল মদ/ শরীর নেয় না আর! বরঞ্চ পিচ্ছিল করে দাও।/ হতাশার পথ, ম্রিয়মাণ বেলা, হাঁটুর পতন-/ আমি নই ব্যতিক্রম, মরত্বের অভিপ্রায় জানি;/ বাঁচাই অশ্লীল কাজ- শাপভ্রষ্ট পেতে চাই ছুটি। (১৯৮৭ : ৫৪)

কবি সিকদার আমিনুল হক তাঁর প্রেমের কবিতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন সব হতাশার চিহ্ন এঁকে দেন, যা তাঁর হৃদয়ের অনুভূতি প্রসূত চেতনার ফসল। প্রেমের ক্ষেত্রে আবেগের আতিশয্যকে আধুনিকতা আর বাস্তবতার মোড়কে ঢেকে জঙ্ঘা, জানু, ক্যাভিয়ার, লাল মদ ইত্যাদি উপমার অবতারণা করেন। ‘শরীর নেয় না আর’ (১৯৮৭ : ৫৪) লাইনটির পর ‘বরঞ্চ পিচ্ছিল করে দাও’ (১৯৮৭ : ৫৪) লাইনটি দুটি বিপরীতমুখী চেতনার সৃষ্টি করে কবির সৌন্দর্যবোধকে আমাদের সামনে সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি হতাশা ও অবক্ষয়ে নিপতিত সত্ত্বেও অমরত্বের অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতন। ‘বাঁচাই অশ্লীল কাজ-শাপভ্রষ্ট পেতে চাই ছুটি’ (১৯৮৭ : ৫৪) লাইনটির মাধ্যমে কতটা বিপরীতমুখী বাস্তবতাসমৃদ্ধ দার্শনিকতা এক সরলরেখায় এসে একীভূত হয়েছে কবির মননভূমিতে তার অপরূপ চিত্র বিনির্মিত হয়েছে। নাগরিক সভ্যতার বিস্তারে তিনি অস্বস্তিবোধ করছেন।

অভ্যস্ত রুটিনজীবনের বাইরে অন্য এক প্রভাব কবির চেতনাকে তাড়িত করছে। হতাশা এবং মৃত্যুচিন্তা সিকদার আমিনুল হকের লেখার এক প্রধান অনুষঙ্গ। বাহ্যজগতের স্পর্শে এবং মননবিশ্বের সমন্বিত সংরাগে কবির চেতনজগত ভীষণ রকমভাবে উদ্বেলিত মৃত্যুনামক প্রকৃতিগত পরাবাস্তবতায়। বৃদ্ধ বা বার্ধক্যকে সবাই উপেক্ষা করে বা করতে চায়। এতেই তিনি আবেগতাড়িত হয়ে বার্ধক্যকে অপরাধ বলে মনে করছেন। অনুপেক্ষণীয় মৃত্যুকে তিনি খুব কাছে দেখতে পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাই তিনি আত্মদহনে নিজেকে নানারকমভাবে অপরাধী মনে করছেন। অথচ এ রকম ছিল না তাঁর জীবন। জীবনে অনেককিছু ছিল। নারী, প্রেম, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সচ্ছলতা ও সফলতা সবকিছুই ছিল। কিন্তু এখন সবকিছু শেষ মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছুই নেই-অর্থহীন। এক নীলাভ ঘুম তাকে নীলিমায় ডাকছে। মৃত্যুভয় তাকে মানসিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মৃত্যুকে নিয়ে সিকদার আমিনুল হক যতরকম ফর্ম তৈরি করেছেন বাংলা কাব্যে তা সত্যিই বিরল। তিনি যখন লেখেন : ‘মৃত্যুভয়ের সংলগ্ন অন্ধকার এবং অন্ধকারের আরও সংলগ্ন অমরতার ভয়! যুদ্ধ, অমিত সৌন্দর্যের নারী ও নির্লজ্জ বন্য আদিম পাপ যতদিন না স্পর্শ করবে কোনো দীর্ঘ কবিতা-ততদিনই মৃত্যুভয়ের উত্তাপ আমাদের নিয়ে যাবে যৌবনহীনা বিলাপ আর দুর্গন্ধময় গণিকার ঘরে।’ (১৯৯১ : ৩২)

কবিতাটির প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মৃত্যু এবং মৃত্যুর ভয়াল অনুষঙ্গের ছোঁয়া। তিনি মনে করেন পৃথিবীতে মৃতের গল্পই বেশি। তিনি মনে করেন মৃত্যুভয় ঘিরে আছে এক ভয়াল অন্ধকার এবং অন্ধকারের আরও সংলগ্ন অমরতার ভয়। মৃত্যুকে উপেক্ষা করার সমিত সাহস ও শক্তি শুধু সিকদার আমিনুল হক কেন এই পৃথিবীর কারও নেই। আমরা তিলে তিলে মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে চলি। মৃত্যু মানেই ভয়াল অন্ধকার, যার অতলান্তে আমরা হারিয়ে যেতে আমরা দ্বিধান্বিত। কবি মনে করেন মানুষের শত্রু যেসব অপশক্তিগুলো আছে তাঁরা যতদিন না কোনো দীর্ঘ কবিতাকে স্পর্শ করবে ততদিন আমরা মৃত্যুভয়ের উত্তাপ উপলব্ধি করতে সমার্থক হবো না। দৈহিক অবক্ষয় মানুষকে ধীরে ধীরে মানসিক অবক্ষয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় এবং প্রতিটা মানুষ অবধারিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। 

সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় ভাষাবিন্যাস, উপমায়ণ, গঠনশৈলী সময়ের আবহে মাধুর্যমণ্ডিত। অবহেলায় হারিয়ে ফেলা সময়কে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। এখানে কবি অবক্ষয়িত সময়ের বিরূপ সময়কে সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন। কবির সময়চেতনা কবিতাটিকে ভিন্নরূপে অলংকৃত করেছে। সমকালের নানা দৃশ্যচিত্রের কাব্যিক বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে কবির আত্মক্ষয়ের কদর্যরূপ। তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর সামনে বাঁধার পাহাড় হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে পর্বত ক্রমশ বড়ই হচ্ছে, কেননা কবি অবহেলায় নষ্ট করছিলেন মহামূল্যবান সময়; কিন্তু তাঁর সকল দিক আলোকিত বলে কিছু ত্রুটিও তাকে আর আত্মপীড়নে ভোগাচ্ছে না। তবুও তার মনে পড়ে এই স্বাস্থ্য আর আয়ু ক্ষণকালের। যদিও তিনি শুধু একা নন আমরা সকলেই অতীতের ভুলগুলোকে বিস্তৃত করি। স্মৃতিকে যতই সম্বল ভাবা হোক না কেন, সে তো শুধু অতীতের কষ্টকেই দীর্ঘায়ু করে। তিনি নগ্নতাকে সিল্ক পরাবার বাসনা নিয়ে অকারণ দ্বন্দ্বময় যন্ত্রণাকে এড়িয়ে চলেন। মানুষের বিস্ময়কর আচরণ কি রকম রহস্যের মায়াজাল বিস্তৃত করে তা তিনি নানা দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে দেখিয়েছেন সিদ্ধহস্তে। কিন্তু কবি সিকদার আমিনুল হক বুকের নিভৃতে সযত্নে লালন করা সভ্যতা নিয়ে পারিপার্শ্বিকতাকে উপেক্ষা করলেও, তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি চারিদিক থেকে ছুটে আসা অবক্ষয়ের প্রবাহমানতা থেকে। 

তথ্যসূত্র :

১. নৃসিংহ মুরারি দে (২০০৭), অবক্ষয়বাদ, মহাদিগন্ত, কলকাতা।

২. সিকদার আমিনুল হক (১৯৭৫), দূরের কার্নিশ, মুক্তধারা, ঢাকা। (১৯৭৯), তিন পাপড়ির ফুল, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা। (১৯৮২), পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা, দেশ, ঢাকা। (১৯৮৭), বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে, অনিন্দ্য প্রকাশন, ঢাকা। (১৯৮৭), পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল, পালক পাবলিশার্স, ঢাকা। (১৯৯১), এক রাত্রি এক ঋতু, শিল্পতরু প্রকাশনী, ঢাকা। (১৯৯১), সতত ডানার মানুষ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা। (১৯৯৪), কাফকার জামা, ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কশপ, চট্টগ্রাম। (১৯৯৪), সুলতা আমার এলসা, ঐতিহ্য প্রকাশন, ঢাকা। (১৯৯৫), রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা, সন্ধানী প্রকাশনী, ঢাকা।  (১৯৯৭), বাতাসের সঙ্গে আলাপ, আজকাল, ঢাকা। (১৯৯৭), লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো, সানন্দ প্রকাশ, ঢাকা। (২০০০), শ্রেষ্ঠ কবিতা, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //