আহমদ ছফা প্রণীত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক

এক.
যদ্যপি আমার গুরু নামে প্রচারিত, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ল্যাসিক হয়ে উঠেছে। আহমদ ছফার রাজ্জাকনামায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে দেখি নির্জলা ঢাকাইয়া বুলিতে বাতচিত করছেন। এ এক আজব ব্যাপার। যে কোনো বিচারে অধ্যাপক রাজ্জাক বাংলাদেশের অভিজাত ভদ্র লোকশ্রেণির মানুষ। এ কোটার লোকজন বিশুদ্ধ কলকাত্তাই প্রমিতে কথাবার্তা বলাটিকে সংস্কৃতিবান হওয়ার পূর্বশর্ত গণ্য করেন। অথচ রাজ্জাক সাহেব দেখছি কোনো চাপ না-নিয়ে দিব্যি ঢাকাইয়্যা ভাষায় কথা বলছেন। তাও ‘কেমন আছি, কী করছি’ টাইপের কথাবার্তা হলে এক কথা। তাঁর বাতচিতের সীমানা কলা ও সমাজবিদ্যার আকাশ-পাতাল। দুনিয়ার বিকশিত এলাকাগুলোতে জ্ঞান নামে যা কিছু জাহির আছে, অধ্যাপক রাজ্জাককে তার নিচে নামতে দেখি না। সবটিই দেখি, তিনি অপ্রমিতে সামলে ফেলছেন। আহমদ ছফা পর্যন্ত এ ব্যাপারে এক টুকরা কৈফিয়ত না দিয়ে পারেননি।

প্রথমবার দেখা হওয়ার পরে প্রফেসর রাজ্জাক সম্পর্কে তাঁর ধারণা কী হয়েছিল, সে ফিরিস্তি সংক্ষেপে টানতে গিয়ে আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘... তিনটে জিনিস আমার মনে দাগ কেটে বসে গিয়েছে। প্রথমত, তাঁর চোখের দৃষ্টি অসাধারণ রকম তীক্ষ্ণতা। একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে। দ্বিতীয়ত, ঢাকাইয়া বুলি তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন, তাঁর মুখে শুনলে এই ভাষাটি ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়। তৃতীয়ত, আমাকে তিনি মৌলবি আহমদ ছফা বললেন কেনো? আদর করে বললেন, নাকি অবজ্ঞা করলেন?’ (পৃ. ১৮ [পৃষ্ঠাসংখ্যা নির্দেশিত হয়েছে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় মুদ্রণ, মে ২০০০ থেকে])

দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে- এ কথার সাদা অর্থের বাইরেও সরল মর্মার্থ আঁচ করা কঠিন নয়। পুরো বইতে অধ্যাপক রাজ্জাকের যে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় আছে, তা যদি চর্মচক্ষুর তীক্ষ্ণতায় ধরা দিয়ে থাকে, বিস্ময়ের কারণ নেই। তদুপরি যারা আহমদ ছফার রূপকপ্রীতির সঙ্গে পরিচিত, তাদের কাছে এ ধরনের কিছু-একটা পয়লা পাঠেই ধরা পড়ার কথা। ‘মৌলবি’ সম্বোধন নিয়া আমরা পরে আলাপ করব। আপাতত ‘ঢাকাইয়া বুলি’র কাছে ফেরা যাক। ছফা বলছেন, অধ্যাপক রাজ্জাক ঢাকাইয়া বুলি ব্যবহার করেন ‘অবলীলায়’। শব্দটি ছফা যে অর্থেই ব্যবহার করুন না কেন, তাঁর প্রস্তাবিত চরিত্রটির ক্ষেত্রে এর গভীর তাৎপর্য আছে। গত কয়েক দশক ধরে ঢাকার সংস্কৃতিবান ভদ্র সমাজের একরোখা প্রমিত প্রীতির বিপরীতে, নানান কিসিমের অপ্রমিতের বাড়বাড়ন্ত আমরা দেখেছি। লেখায় বা বলায় প্রমিতের বাইরের কোনো কোনো রূপ নির্মাণের বিভিন্ন কসরতও লক্ষ্য করেছি। বাংলা ভাষার ইতিহাস-প্রশ্নে প্রফেসর রাজ্জাকের গভীর সচেতনতার প্রেক্ষাপটে তাঁর মুখের বুলিকে সে ধরনের কোনো আয়োজন হিসেবে পড়ার সুযোগ আছে; কিন্তু আর সব ব্যাপারে যেমন, তেমনি ভাষা-প্রশ্নেও একটি মত-মর্জিতে খুঁটি গেঁড়ে বৃত্ত রচনার ব্যাপারটি রাজ্জাক সাহেবের ধাতের সঙ্গে যায় না। কাজেই এটি বলার অবকাশ সামান্যই থাকে যে, তিনি তাঁর স্বভাবের বাইরে গিয়ে ভাষা-বিপ্লবের অংশ হিসেবে ঢাকাইয়া বুলি জারি রেখেছেন। কথাটি অন্তত এক জায়গায় ছফা প্রশ্ন আকারে তুলেছেন:

আমার [ছফার] দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনে কোনোদিন বদরুদ্দীন উমরের বউয়ের বাংলা উচ্চারণ শুনছেন নিহি?
আমি বললাম, না, আমি শুনিনি।
এক্কেরে বিশুদ্ধ বাংলা কয়, উচ্চারণ নিখুঁত। আপনেগো উচিত তার বাংলা পাঠ ক্যাসেট কইরা রাখা। পরে খুব কামে আইব।
আমি বললাম, আপনি ত স্যার ঢাকার বাংলা বলেন, আমাদেরকে কেন পশ্চিম বাংলার উচ্চারণরীতিটি অনুসরণ করতে বলছেন?

স্যার কথাটি পাশ কাটিয়ে গেলেন। (পৃ. ৯৩-৯৪)

আসলে পাশ কাটিয়ে যাননি। ভিন্নভাবে যা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আপাতত বলা যাক, ছফার আবদুর রাজ্জাক সম্ভাব্য কোনো ভোজেই আপত্তি করেন না। সারা দুনিয়াই তাঁর সম্পদ। কলকাতায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে উপাদেয় ভোজ জমা হয়েছে অনেক দশকের চর্চায়, তাতে বিরাগের কোনো চিহ্ন তাঁর মধ্যে, অন্তত ছফা-প্রস্তাবিত রূপে, দেখা যায়নি। তিনি শুধু ‘নিজে’র সুরতটি ভুলতে চান না। সঙ্গে মেজবানের সুরতটিও মনে রাখতে চান। আর যে-পটভূমিতে মেহমান ও মেজবান আছে বা ছিল, সে পটভূমি থেকে ভোজটিকে আলগা করে ফেলেন না। এ জায়গায় সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর একজন কাছের মানুষ হতে পারেন। বোঝাবুঝির স্বার্থে। যাই হোক, কলকাত্তাই প্রমিতে তাঁর আপত্তি সে কারণেই কোনো অ্যাসেন্সিয়াল কিছু নয়। যারা উত্তরাধিকারসূত্রে বা সাংস্কৃতিকভাবে সে জবান এস্তেমাল করতে পেরেছেন, তাদের প্রতিও তাঁর একবিন্দু বিরাগ নেই। আবার এটিও তিনি মনে করেন না, ভদ্রলোক সাজার মরিয়া চেষ্টায় সে জবান নিজের জিবে-গলায় তুলে নিতেই হবে। নিজের ঢাকাইয়া বুলিটি তিনি নিশ্চয়ই বেড়ে ওঠার বিশেষ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেরণায় নিজের জবানে এস্তেমাল করেছেন; কিন্তু তাকেই অন্যের জন্য কর্তব্য আকারে পেশ করেননি। এ কারণেই বলেছি, অধ্যাপক রাজ্জাকের ক্ষেত্রে ‘অবলীলা’ কথাটির একটি প্রসারিত অর্থ আছে। 

আহমদ ছফা অবশ্য আরও আগে বেড়েছেন। বলেছেন, রাজ্জাক সাহেবের মুখে ঢাকাইয়া বুলিটি ‘ভদ্রলোকের ভাষা মনে হয়’। 

কথাটি প্রাথমিকভাবে খানিকটা আপত্তিকর। সেদিকটিকে পাত্তা না দিয়ে পড়লে কথাটির মানে দাঁড়ায়, আমাদের চেনা-জানা ভদ্রলোকদের বুলিতে কথা না বললেও রাজ্জাক সাহেবকে নিছক ভাষাভঙ্গির কারণে ভদ্র শ্রেণির কোঠায় ফেলতে কোনো অসুবিধা হয় না; কিন্তু কথাটির আরও অন্তত দুটি অর্থ করা যায়, আধুনিক বাংলা ভাষার ব্যবহারিক ইতিহাসের দিক থেকে যেগুলোর প্রায়োগিক মূল্য অসামান্য। প্রথমত, ভদ্র লোকের ভাষা স্রেফ ভাষা হিসেবে আলাদা কোনো গুণ বহন করে না; বরং ভদ্র লোকদের জবানে ঠাঁই পাওয়াই তার চেকনাই ও জেল্লার উৎস। অর্থাৎ, আবদুর রাজ্জাকদের মতো ভদ্র লোকরা কথা বললেই কেবল ঢাকাইয়া বুলি ভদ্র লোকদের ভাষা হয়ে উঠবার পারে। দ্বিতীয়ত, ভাষায় আপনি কী বলছেন, তার ওপরই আসলে ব্যবহৃত ভাষার ওজন নির্ধারিত হবে। রাজ্জাক সাহেব যা বলতেন, তাতে তাঁর বুলি ওজনদার না হয়ে পারেইনি। 

প্রত্যক্ষভাবে ছফা যা উচ্চারণ করেছেন, তার বাইরেও যদ্যপি আমার গুরু বইতে ঢাকাইয়া বুলির অন্য বিশেষ মরতবা আছে। এই ভাষা বইটির শুধু চরিত্রায়ণের অংশ নয়, আবহেরও অচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাজ্জাক ছফার ইন্টারন্যাশনাল হলে এঁচোড়-ভর্তি টিফিন-ক্যারিয়ারের বাটি পৌঁছে দেয়, সুলতানের গাঁজা খাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে, গলায় গামছা লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় কৃষকের মতো, লুঙ্গি পরে বাজার করে এবং প্রায়ই রান্না-বান্নায় অংশ নেয়, বই জড়ো করে ভাঙা চৌকির পায়া বানায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বা কিসিঞ্জারের সঙ্গে মোলাকাত করতে যাওয়া রাজ্জাক, জ্ঞানজগতের গা-জোয়ারি সিদ্ধান্তে ক্ষেপে-ওঠা রাজ্জাক, আর ছফার জন্য ইন্ডিয়া থেকে কাশ্মীরি শাল বয়ে-আনা রাজ্জাক আহমদ ছফার উপন্যাসিক প্রতিভার তুঙ্গতম স্পর্শে একাকার হয়ে যে-আবদুর রাজ্জাক পয়দা করে, ঢাকাইয়া বুলি তার কোনো অলংকারবিশেষ নয়। একটি উদাহরণ দিয়ে কথাটা আবার বলা যাক।

তপন রায়চৌধুরীর আত্মজৈবনিক রচনা রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চার পাঠকরা ‘বাঙাল’ ভাষার কুশলী ব্যবহার এবং হাস্যরস সৃষ্টির মুনশিয়ানার বিস্তর তারিফ করেছিলেন। প্রশংসাটি যোগ্য পাত্রেই পড়েছে। এ ভাষার ব্যবহার তাঁর সুখ্যাত বাঙালনামায়ও যথেষ্ট আছে। একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে, শেষোক্ত বইয়ের ‘বাঙাল’ ভাষা তপন রায়ের আত্মতার অংশ নয়। ভাষাভঙ্গিটি তিনি তাঁর যাপিত জীবনের সহচরদের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা হিসেবে কখনোই ব্যবহার করেননি, কেবল মনে মনে বলা কথাগুলোই এ ভাষায় ফেঁদেছেন। বাঙালনামায় ‘বাঙাল’ ভাষা তাঁর সৃষ্টিশীল রসাবেশ ও বৈচিত্র্য তৈরির অলঙ্কার বিশেষ। সাহিত্যিক গুণের দিক থেকে কলাটি দুর্দান্ত হয়েছে; কিন্তু আত্মতার বাহন হয়নি। পরিমাণে আরও বেশি হলেও রোমন্থনের ‘বাঙাল’ভাষা বিষয়েও একই কথা খাটে। ছফা-প্রণীত আবদুর রাজ্জাকের বিষয়টি ঠিক বিপরীত। সেখানে আলঙ্কারিক অভিলাষ নেই, স্বাতন্ত্র্য তৈরির বাসনা নেই, বড়কে চ্যালেঞ্জ করা বা ছোটকে বড় করে তোলার কসরত নেই; অথচ চেষ্টা-তদবির ছাড়া একেবারেই পারিপার্শ্বিক-ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে তাঁর বুলি বড় ঘটনা হয়ে হাজির হয়েছে। 

এতকিছু সত্ত্বেও, অথবা এসব কিছুসহ আমরা রাজ্জাক সাহেবের ঢাকাইয়া বুলিকে তাঁর আরও বিশিষ্টতার একটি বিষয় হিসেবে পড়তে পারতাম। এই লোক চাকরির উন্নতির জন্যও কলম ধরে না, বিয়ে-থা না করেও দিব্যি সংসার করেন। ব্যাখ্যা করা যায় না- এমন সব কারণে গুরুতর লোকদের গুরুত্ব পায়, অথচ তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য ভদ্রগোছের এক সেট জামা-কাপড় মজুদ রাখে না। ইত্যাদি। দশের মধ্যে এগারোতম হিসেবে তাঁর ঢাকাইয়া বুলিকে আমরা অনায়াসেই এ তালিকায় ফেলে দিতে পারতাম। বাদ সেধেছে আহমদ ছফার বয়ানে বাংলা ভাষা বিষয়ে তাঁর এমন কিছু কথাবার্তা, অন্য অনেকে জনমভর সাধনা করে যেগুলো আবিষ্কার করেছে, অথবা আদৌ বুঝে না-উঠেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। কথাটিকে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখবার সুযোগ আছে। সে কারণেই প্রমাণ দাখিলের স্বার্থে লম্বা উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

‘তিনি একজন সাহেবের নাম উচ্চারণ করলেন, ... সেই সাহেব নাকি একশো বছর আগে লিখে গিয়েছেন, বেঙ্গলে ঢাকা জেলার মানুষেরা বিশুদ্ধ বাংলায় কথাবার্তা কয়। ... বাংলা ভাষার মধ্যে যে পরিমাণ এলিট মাস (mass গ্যাপ এরকম দুনিয়ার অন্য কোনো ভাষার মধ্যে খুঁইজ্যা পাইবেন কি-না সন্দেহ। আধুনিক বাংলা ভাষাটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সংস্কৃত অভিধান দেইখ্যা বানাইছে। আসল বাংলা ভাষা এইরকম আছিল না। আরবি ফারসি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষার লগে মিশ্যা ভাষার একটা স্ট্রাকচার খাড়া অইছিল। পলাশির যুদ্ধের সময়ের কবি ভারতচন্দ্রের রচনায় তার অনেক নমুনা পাওয়া যাইব। ব্রিটিশ শাসন চালু অইবার পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা আরবি ফারসি শব্দ ঝাঁটাইয়া বিদায় কইর‌্যা হেই জায়গায় সংস্কৃত শব্দ ভইর‌্যা থুইছে। বাংলা ভাষার চেহারা কেমন আছিল, পুরানা দলিলপত্র খুঁইজ্যা দেখলে কিছু প্রমাণ পাইবেন।

আমি বললাম, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা যে গদ্যরীতিটা চালু করেছিলেন, সেটি তো স্থায়ী হতে পারেনি। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এসে বাংলা গদ্যের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন এবং রূপান্তর ঘটে গেছে। 

‘পরিবর্তন ত অইছে; কিন্তু কীভাবে অইছে এইটা দেখন দরকার।’ 

‘আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে পরিবর্তনটা হয়েছে। স্যার বললেন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা ভাষার স্ট্রাকচারটা খাড়া করেছিলেন, তার লগে ভাগীরথী পাড়ের ভাষার মিশ্রণে আধুনিক বাংলা ভাষাটা জন্মাইছে। আধুনিক বাংলা বঙ্গসন্তানের ঠিক মুখের ভাষা না, লেখাপড়া শিখ্যা লায়েক অইলে তখনই অই ভাষাটা তার মুখে আসে।’ (পৃ. ৯৩-৯৪)

খুব জরুরি নয়, তবু ধরে নিচ্ছি, ওপরের কথাগুলোর মূল কাঠামো রাজ্জাক সাহেবেরই বলা। ছফার নিজের চিন্তায় এ দিকগুলোর প্রাধান্য থাকলে তাঁর অন্য লেখালেখিতে উল্লেখ পাওয়া যেত।

প্রথম বাক্যের ‘বিশুদ্ধ বাংলা’ কথাটি খুব সুবিধার হয়নি। সেদিকটি বাদ দিলে আদত কথাটি বিধ্বংসী। পুরোনা শহর হিসেবে, এবং বিশিষ্ট শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ঢাকার ভাষার যে-একটি ‘জুতসই’ ভদ্রলোকি কেতা বিকশিত হয়েছিল, হতে বাধ্য, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তার মানে অবশ্য এ নয়, ওই বিলুপ্ত ভাষারীতি পুনরুদ্ধারের আয়োজনে এখন সদলবলে নেমে পড়তে হবে; কিন্তু এ অনুসন্ধানের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বুঝে ওঠার মতো মেরুদ- নতুন ঢাকার নাগরিকরা এখনো পেয়ে উঠেনি। রাজ্জাক সাহেবের আন্দাজের মধ্যে, দেখতে পাই, হিসাবটা পাকাপোক্তভাবেই ছিল। এর পরের কথাগুলো, আহমদ ছফার শব্দ ধার করে বলা যায়, এক-একটা মণিমুক্তা। পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার একটি উত্তুঙ্গ সম্মিলনে মানুষ জটিল বিষয়গুলোকে হাতের তালুতে রেখে দেখার মতো করে দেখতে পারে। এর প্রতিটি সে মাত্রার সিদ্ধান্ত।

বাংলা ভাষায় ‘এলিট-মাস গ্যাপ’ দুনিয়ার চেনা অভিজ্ঞতার মধ্যে সর্বোচ্চ, এ কথাটি পরিষ্কারভাবে বলেছেন শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৭৭ সালে, আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাচরণেরই সমর্থন হিসেবে, ১৮৭৮ সালে। প্রফেসর রাজ্জাক-যে শোনা কথা চালান নেই, সে প্রমাণ পাই পরের বাক্যগুলোতে। দুটি কথা আছে সেখানে। প্রথমত, আঠার শতকে বাংলার একটি আলাদা কাঠামো ছিল, ভারতচন্দ্রের লেখায় যার উদাহরণ মেলে, আর পাওয়া যায় প্রায় যে কোনো পুরোনা দলিল-দস্তাবেজে; কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা সংস্কৃত অভিধান ঘেঁটে নতুন ভাষা পয়দা করেছেন। তার মানে নতুন ভাষায় মুখের ভাষার আদলটি রক্ষিত হয়নি। ভাষা এসেছে ‘কলম থেকে মুখে’, যে কথাটি অন্য অনেকের মধ্যে প্রমথ চৌধুরীও প্রচার করেছেন। দ্বিতীয়ত, পণ্ডিতেরা ‘আরবি-ফারসি শব্দ ঝাঁটাইয়া বিদায় কইর‌্যা হেই জায়গায় সংস্কৃত শব্দ ভইর‌্যা থুইছে’। গত কয়েক দশকে হাজার হাজার পৃষ্ঠার গবেষণা থেকে এ বিষয়ে আমাদের যে-জ্ঞান হয়েছে, তার ওপর ভর করে নিশ্চিন্তে বলা যায়, ‘ঝাঁটাইয়া বিদায় করা’ এবং ‘ভইর‌্যা থোয়া’- এ দুই প্রকাশভঙ্গির বাইরে অন্য কিছু এ অবস্থাকে এতটা জুতমতো প্রকাশ করতে পারত না। রাজ্জাক সাহেবের বিবরণীতে ‘সাহেবপক্ষ’ বাদ পড়েছে। উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াটাও চাপা পড়ে গেছে। অবশ্য তিনি যা বলেছেন, তা উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াই বটে। এ পরিভাষা তখনো চালু হয়নি। 

এরপরের কথাটি, এ বিষয়ক প্রায় তাবত লেখালেখির সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে বলতে পারি, কোথাও বিশ্লেষিত হয়নি। এমনকি আসলে এত নিখুঁতভাবে উত্থাপিতও হয়নি। উনিশ শতকের দানবাকৃতির সংস্কৃতায়নের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের ভদ্রলোকসমাজ প্রায় একযোগে বলে ওঠেন, পুরনো বাংলায়ও সংস্কৃতায়ন হয়েছে, আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলাচর্চার দোষ বঙ্কিম পর্যন্ত আসতে আসতেই কেটে গেছে। এ কথাগুলো এত উপরিতলের যে, এগুলো ঠিক আলোচনার যোগ্যই নয়; কিন্তু উনিশ শতকের ভাষাচর্চার দোষ শনাক্ত করা খুব সহজও নয়। কারণ, ওই ভাষায় জগদ্বিখ্যাত সাহিত্য রচিত হয়েছে, আর ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে মশহুর যাবতীয় চর্চার আধারও ওই ভাষাচর্চা। আবদুর রাজ্জাক দুই বাক্যে যে ফয়সালা করলেন, তা ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা ও বর্তমানকে এক পাত্রে সুচারুভাবে মিশিয়েছে। চলিত বাংলাটি কৃষ্ণনগরীয় ভাষার ছাদে তৈরি- এই প্রচলিত প্রবাদকে খারিজ না করেই তিনি প্রকৃত প্রক্রিয়াটি সামনে নিয়ে এলেন। আসলে কৃষ্ণনগরীয় ছাদ থেকে লেখার ছাদটি তৈয়ার হয়নি, বরং লেখার ভাষার সঙ্গে নদীয়া মিশেছে। তার ফল হয়েছে মর্মান্তিক। ‘পড়াশোনা শিখে’ লায়েক হওয়ার পরেই কেবল ভাষাটি মুখের মাপে ধরা পড়ে, তার আগে নয়- এ উচ্চারণে বাংলা ভাষার উপনিবেশজনিত সংকটের, আমার জানা, সর্বোত্তম বিবরণটি আছে।

বলছিলাম, ছফা নিবেদিত আবদুর রাজ্জাকের ‘ঢাকাইয়া বুলি’ শুধু অন্তরঙ্গ নয়, আরও বহু-বিচিত্র মাত্রাযুক্ত। আমাদের পরবর্তী আলোচনা থেকে তার আরেক মাত্রার হদিশ পাওয়া যাবে। 

উপরে আধুনিক জমানার বাংলাভাষা চর্চা সম্পর্কে আবদুর রাজ্জাকের যে গভীর প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া গেছে, তার নিরিখে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, সচেতনভাবেই তিনি মুখের বুলি থেকে কলকাত্তাই প্রমিত পরিহার করেছেন। বস্তুত ঢাকার বাংলা চর্চাকারীদের যে অংশ কলকাত্তাই প্রমিতে ইমানদার, আর যে-অংশ ওই প্রমিতের বিরোধিতা করাকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রধানতম কর্তব্য মনে করেন, উভয় দলের জন্যই এ সিদ্ধান্ত সুবিধাজনক; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যদ্যপি আমার গুরু বইয়ে পর্যাপ্ত উদাহরণ দিয়ে দেখাচ্ছে, এ সূত্র দিয়ে রাজ্জাককে কায়দা করা যাবে না। উনিশ শতকি কলকাত্তাই প্রমিতে উৎপাদিত মিঠাই-মণ্ডায় রাজ্জাকের মোটেই বিরাগ দেখা যায়নি। অনুবাদের জন্য তিনি একবার বাছাই করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই বাংলার ব্রত। কলকাতায় উনিশ শতক সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বাংলা ভাষার নানামুখী চর্চা। রামমোহন রায়ের নামে প্রচারিত প্রায় যাবতীয় কৃতিত্ব খারিজ করে তিনি বড় করে তুলেছেন তাঁর বাংলা লেখা ও ব্যাকরণ রচনাকে। বলেছেন, তাঁর গুণের তো অভাব ছিল না। অনেক ভাষা জানতেন; কিন্তু চর্চা করেছেন প্রধানত বাংলা। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেও মূল্যায়ন করেছেন একই ভিত্তিতে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাচর্চা, তার যে কোনো রূপে, প্রফেসর রাজ্জাকের কাছে মূল্যবান।

এর গোড়ায় আছে তাঁর খাঁটি বুর্জোয়া মন। রাজ্জাককে কিছুতেই ভাষাকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী বলা যাবে না, বাংলাদেশ আন্দোলনে সর্বসমর্থন এবং সক্রিয়তা সত্ত্বেও; কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চাকেই তিনি সার্বিক উন্নতির পয়লা শর্ত মনে করতেন। যে উৎসাহে তিনি বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাচর্চাকে গভীরভাবে অনুমোদন করেছেন, সে একই ন্যায়ে মনোযোগী ছিলেন পূর্ব বাংলা ও বাঙালি মুসলমানের বাংলায়। খেয়াল করেছেন, মোহিতলাল মজুমদার পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণ একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। মনে রেখেছেন, পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণের মতো বাঙালি মুসলমানের উচ্চারণ ভঙ্গি ও লব্জ আধুনিক ইতিহাসে ব্যাপক অপরায়ণের শিকার হয়েছে। জসীমউদ্দীনের উচ্চারণে ‘ছ’-এর ব্যবহার ও আহমদ ছফাকে বরাবর ‘মৌলবি’ সম্বোধন হয়ত সেই স্মৃতিকে জ্যান্ত রাখার এক ব্যক্তিগত উদ্যম। তার মানে আবার এই নয়, তিনি অন্যদেরকেও সে উচ্চারণে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা-তদবির করবেন। যা গেছে, তা ফিরে আসে; কিন্তু কী রূপে এবং তাৎপর্যে ফিরে আসে, তা নির্ধারণ করাই বস্তুত ঐতিহাসিক ও বুদ্ধিজীবীর প্রধান কাজ। ছফা যদি জিজ্ঞাসা করতেন, আপনি নিজে যা বলেন, তা অন্যদের বলতে উৎসাহিত করেন না কেন, আহমদ ছফার রাজ্জাক হয়ত মুখ বাঁকিয়ে বলতেন, ‘মারামারি করমু নিহি!’

ভাষা-প্রশ্নে রাজ্জাকের এ অবস্থানই হলো খাঁটি লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি। বলতে পারি, আহমদ ছফা পূর্ববঙ্গ, বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশের জন্য এক লিবারেল আইকন খুঁজেছেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে। অন্য অনেক কিছুর মতো উদারনীতিরও স্থান-কাল আছে, বিশিষ্ট রূপ ও প্রকাশ আছে। বাংলাদেশের বিশেষ বাস্তবতায় সে রূপের প্রকাশ দেখি আহমদ ছফা প্রণীত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকে। তাই তাঁকে টেক্সট ধরে ছফা হয়ত বাংলাদেশের জন্য জরুরি বর্গ, যেমন, পরিচয়ের রাজনীতি, আধুনিকতা, সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি, গণতন্ত্র, জাতীয় উন্নতি ইত্যাদি ধারণার পর্যালোচনা ও রূপ প্রণয়ন করতে চেয়েছেন।

দুই.
‘বামনের দেশে মহাকায়’ বলে একটি কথার প্রচলন করেছিলেন বোধ হয় হুমায়ুন আজাদ। আবদুর রাজ্জাক প্রসঙ্গে ছফাও প্রায় একই ধরনের কথা বার-কয়েক উচ্চারণ করেছেন। তাঁর রাজ্জাক-যে মহাকায়, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু ওই কায়া তিনি কীভাবে হাসিল করলেন, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিশেষ সুলভ নয়। যদ্যপি আমার গুরুতেও নেই, অন্য যেসব বিবরণী পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোতেও নেই। বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন; কাজেই তাঁর বদলির চাকরি ছিল, আর এক ধরনের সচ্ছলতা ছিল, এটি বলা যায়। নজরুল ঢাকায় এসে নিজের প্রাণচাঞ্চল্য, গান এবং আড্ডায় প্রচুর মানুষকে দেওয়ানা বানিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুসহ বহুজনের জবানে সে সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় আবদুর রাজ্জাকও ছিলেন। তিনি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। তাতে বোঝা যায়, আগ্রহের একটা প্রসারিত মাত্রা, আর তার পক্ষে সক্রিয়তা সে কিশোরকালেই রাজ্জাকের মধ্যে বিকশিত হয়েছিল। আরও বলা যায়, পরিবারে এসব ব্যাপারে আশকারা পাওয়ার একটা বাস্তবতাও ছিল; কিন্তু এটুকুতে বিশেষ কিছু বোঝা যায় না। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে লাস্কির ছাত্র হিসেবে এবং নিজের প্রণোদনায় রাজ্জাক বোধ হয় নিজেকে বেশ কতকটা তৈয়ার করেছিলেন; কিন্তু তাঁর জীবনদৃষ্টির প্রধান অনেকগুলো দিক তার আগেই খাড়া হয়ে গিয়েছিল বলে পর্যাপ্ত ইশারা পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই বলা যায়, ছফা-প্রণীত আবদুর রাজ্জাকের পটভূমি বেশ কতকটা আবছাই থেকে গেছে। 

লেখালেখির মধ্য দিয়ে ওই কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটলে তাঁর হয়ে-ওঠার পটভূমি মোটামুটি আন্দাজ করে নেওয়া যেত। তা না হওয়ায় তাঁকে আমরা পাচ্ছি পূর্ণ বিকশিত প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি হিসেবে, যাঁর বিকাশ রেখাটি রহস্যময়। তাঁকে নিয়ে দিল্লিস্থ ইলাস্ট্রেটেড উইকলি পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে প্রতিবেদক তাঁকে গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। আহমদ ছফা জানাচ্ছেন, ঢাকায়ও তাঁকে অনেকে ডায়োজিনিস বলে ডাকতেন। ওই প্রতিবেদনে তাঁকে ছয় দফার মূল প্রণেতা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। ডিক উইলসন তাঁর বিখ্যাত কেতাব এশিয়া অ্যাওয়েকস-এর উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, ‘টু আবদুর রাজ্জাক অব ঢাকা, হু ব্রট ইস্ট ইন মাই মাইন্ড’। কিসিঞ্জারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার জন্য ছাত্র-বাছাইয়ের কাজ কিসিঞ্জার দিয়েছিলেন আবদুর রাজ্জাককে। কিসিঞ্জার ঢাকায় এলে অন্য অনেকের সঙ্গে রাজ্জাকও তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে আর সবাইকে কিসিঞ্জার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর ছাত্র হিসেবে; কিন্তু আবদুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে বলেন, ‘হি ওয়াজ মাই কলিগ’।

দেশেও তাঁর বিস্তর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধুসহ আগের বড় নেতাদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত খায়খাতির ছিল। যোগাযোগ ছিল জ্ঞানজগতের বিশিষ্ট প্রায় সবার সঙ্গে। দেশি-বিদেশি বিস্তর লোককে জায়গামতো কাজের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। দেশে-বিদেশে গবেষণায় সাহায্য করেছেন বহুজনকে। তাঁর পরামর্শ সরাসরি বা অন্যের মারফত রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী বহু ব্যাপারে কার্যকর হয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে। 

সেই গরিব ঢাকায় কিংবদন্তি হয়ে ওঠার জন্য এগুলোই যথেষ্ট ছিল। যে লোক লেকচারার থেকে প্রমোশন পেয়ে সহকারী অধ্যাপক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন না, সত্যিকার অর্থে লেখালেখি করলেন না এক কলমও, তিনি কীভাবে দেশ-বিদেশের কামিয়াব মানুষজনকে এ মাত্রায় ভজিয়েছেন, তা রহস্যই বটে। আহমদ ছফার মারফত তাঁকে আমরা প্রথম থেকেই দেখছি বিছানায় উবু হয়ে আছেন বইয়ের ওপর। তাহলে তাঁর বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পকর্টি রচিত বা রক্ষিত হতো কীভাবে? অনেককেই তাঁর বাড়িতে আসতে দেখা গেছে। তার মধ্যে দেশি-বিদেশি বিদ্বান ও প্রভাবশালী মানুষজন আছেন। প্রশ্ন হলো, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক রক্ষার কায়দা-কানুন কেমন ছিল?

যদ্যপি আমার গুরুতে তার হদিশ না মিললেও বিকশিত-প্রকাশিত রাজ্জাকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মোলাকাতের সুযোগ আমাদের হয়েছে। সেখানে দেখছি, তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য নিষ্কাম জীবনচর্যা। তাঁর যৌনজীবন সম্পর্কে কিছু বলা নেই। বন্ধু-বান্ধবের কথাও খুব একটি সামনে আসেনি। প্রচলিত অর্থে তিনি সংসারও করেননি। লিখে বা পড়িয়ে খ্যাতি অর্জনের জন্য একতিল শ্রম ব্যয় করেননি। এমনকি হাতের কাছ দিয়ে চলে যেতে দিয়েছেন প্রায় হয়ে-আসা পিএইচডি ডিগ্রিটিও। এ প্রেক্ষাপটে যদি তাঁর যাবতীয় তৎপরতার আভ্যন্তর-প্রেরণা খুঁজতে যাই, সম্ভবত আমাদের চেনা কোনো ছকেই তাকে পাওয়া যাবে না। ছফা জানিয়েছেন, তিনি রাজ্জাকের মধ্যে দেশ ও মানুষের জন্য এক নিঃশর্ত অঙ্গীকার লক্ষ্য করেছেন। সেটি ঠিকই আছে; কিন্তু এরকম অঙ্গীকারওয়ালা অন্য মানুষজনের সঙ্গেও রাজ্জাককে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। ছফার চরিত্রায়ন থেকে আমরা নিশ্চিতভাবে কেবল তাঁর জীবনদৃষ্টি ও চিন্তাপদ্ধতির এক অতি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছাদ আবিষ্কার করতে পারি।

তাতে দেখা যাবে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক সীমানা ঈর্ষণীয় রকমের প্রসারিত। সমর সেন প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেছিলেন, এই মানুষটির চিন্তা-ভাবনার রেঞ্জ আছিল অনেক বড়। লাস্কি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য : মানুষের চিন্তাকে উসকে দেবার বিশেষ ক্ষমতা ছিল লাস্কির। এ দুটি কথা প্রায় আক্ষরিক অর্থে প্রযোজ্য ছফার রাজ্জাকের ক্ষেত্রে। সাধারণভাবে আমরা যাকে শিল্পকলা বলতে পারি, তাতে অধ্যাপক রাজ্জাকের বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিনিবেশ ছিল। বৃহত্তর ও গভীরতর অর্থে সমাজবিদ্যা ছিল তাঁর একাডেমিক চর্চার এলাকা। আজকালকার দিনে যাকে 

সংস্কৃতি অধ্যয়ন শাস্ত্র নামে চেনা হয়, রাজ্জাকের আগ্রহের বহু কিছু সে এলাকায় পড়বে। ইতিহাস এবং নৃবিদ্যা অর্থে মানববিদ্যায়ও তাঁর আগ্রহের কমতি ছিল না। দর্শনশাস্ত্রে তাঁর বিশেষ অনুরাগের কোনো পরিচয় অবশ্য আহমদ ছফার বিবরণী থেকে পাওয়া যায় না। এ দিকটি বাদ দিলে জ্ঞানজগতে প্রফেসর রাজ্জাকের আগ্রহ ও উৎসাহকে এনলাইটেনমেন্ট-পরবর্তী ইউরোপীয় ভাবুকদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সে জমানায় পশ্চিমে পলিটিক্যাল ইকোনমি বা সম্পর্কশাস্ত্র যে-ধরনের সামগ্রিকতা নিয়ে বিকশিত হয়েছিল, রাজ্জাকের প্রবণতায় তার প্রত্যক্ষ ছায়া দেখা যায়। জ্ঞান ও বিবেচনাকে আলাদা আলাদা খোঁপে ভাগ করে চর্চার যে-রেওয়াজ পরের জমানায় পশ্চিমে এবং খানিকটি আমাদের এখানেও বিকাশ লাভ করেছিল, রাজ্জাক ঠিক সে ধাঁচের মানুষ ছিলেন না। 

তাঁর বিদ্যাচর্চায় গভীরতা ও প্রসারতা ছিল। ছফাকে তিনি যে-আঙ্গিকে বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করিয়েছেন, তা থেকে এর পরিচয় পাওয়া যায়। একবার তাঁর অভিধান নিয়ে কাজ করার কথা জানিয়েছেন ছফা। সেটি লেখা আকারে পরিণতি না পেলেও তাঁর পড়াশোনার ধরনের একটা নজির হিসাবে বিবেচ্য। গবেষণার ব্যাপারে যে-কটি উল্লেখ যদ্যপি আমার গুরুতে পাওয়া যায়, তার সবগুলোই পশ্চিমা একাডেমির গুণ-মানকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

সাহিত্য ও শিল্পকলাবিষয়ক মত ও পর্যবেক্ষণগুলো তাঁকে চিনে ওঠার কার্যকর সোপান। শিল্পকলাকে তিনি দেখেছেন ইতিহাস ও জনসমাজের সঙ্গে মিলিয়ে। সঙ্গত কারণেই আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সে কলকাত্তাই হোক আর পশ্চিমা হোক, তাঁর মনোযোগ পায়নি। ছফাকে একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের সাহিত্যের লোকদের লেখার মধ্যে ছানা জিনিস বিশেষ থাকে না’। ছফা-যে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়েছেন ‘ইকোনমিক্স’ শাস্ত্রে, তা তাঁর মতে, বিরাট ইতিবাচক ঘটনা। আমাদের সাহিত্য-বিষয়ক লেখালেখি সম্পর্কে রাজ্জাকের এই মত তিরিশের দশক থেকে আজ অবধি আমাদের প্রভাবশালী সাহিত্যসমালোচনার বা সাহিত্যকেন্দ্রিক বিবেচনার টিঙটিঙে শরীরটিকে উদাম করে দেয়। পাশাপাশি জয়নুলের ছবি বা টলস্টয়ের উপন্যাস বিষয়ক মন্তব্য, শেক্সপিয়রের সাইলক এবং সে সূত্রে শেক্সপিয়র সম্পর্কে মূল্যায়নের ধরন তাঁর নিজের গোত্রপরিচয় চিনিয়ে দেয়। উপন্যাসকে তিনি পড়তে চান সোস্যাল ডিসকোর্স হিসেবে। সালমান রুশদির উপন্যাস পড়ে লেখকের রচনারীতির সৌকর্যে শুধু বেচইন হয়ে থাকেন না, এক অন্য ধরনের ব্যাপক মূল্যায়নেও পৌঁছান।

অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের পড়াশোনা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন থেকে তাঁকে নিখুঁতভাবে একজন উদারনীতিবাদী মানুষ হিসেবে পাওয়া যায়। জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্মাণ ও বিকাশের যে পন্থা তিনি বরাবর প্রস্তাব করে গেছেন, তাও একই ঘরানার। বাংলাদেশের এই কিসিমের অন্য বেশিরভাগ মানুষজনের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এই যে, আধুনিকতার নামে পশ্চিমায়ন তাঁকে একবিন্দুও কাবু করতে পারেনি। এ জাতীয় বটিকা তিনি সেবন করেননি। পশ্চিমা জ্ঞানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মোটেই অধীনতামূলক নয়- ব্যবহারিক ও উপযোগিতামূলক। ঠিক একই রকম একটি সার্বিক সিদ্ধান্ত তিনি কলকাতা সম্পর্কেও নিতে পেরেছেন। শিল্পকলার বা সংস্কৃতির বা সামগ্রিক জীবনযাপনের কোনো আরোপণমূলক বাটখারা তিনি মান্য করেননি। অথচ নিজেরটিই সেরা, এরকম কোনো গোয়ার্তুমিও তাঁর মধ্যে প্রকাশ পায়নি।

ছফার রাজ্জাককে দুই ক্ষেত্রে কখনো আপস করতে দেখি না। এক. গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতা-সম্পর্কের অসম দশা তৈয়ার করেননি। দুই. কোনো সিদ্ধান্তেই মিথে ভর করেননি। উপনিবেশিত এবং মিথ-আক্রান্ত ঢাকায় একজন বিদ্যাজীবীর এর চেয়ে বড় গুণ আর কী হতে পারে!

কিন্তু গুণ যাই হোক, উদারনৈতিক মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাধারণ দোষও বেশ বর্তেছিল রাজ্জাক সাহেবের ব্যক্তিত্বে। ইউরোপে লিবারেল হিউম্যানিজম বিকাশের কালে রাষ্ট্র নামের বৃহৎ কাঠামোর বুনিয়াদ পোক্ত হওয়ার কারণে, এবং তারই অংশ হিসাবে অপরাপর ছোট কাঠামোগুলোর বিকাশের প্রেক্ষাপটে, ব্যক্তির ওপর গুরুত্বারোপের প্রবণতা কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর হয়নি; কিন্তু আমাদের এ দিকে ব্যক্তি যতটা এসেছে, কাঠামো তার পাইর পাইও আসিনি। অধ্যাপক রাজ্জাকের সামগ্রিকতাবাদী দৃষ্টি এবং বহুক্ষেত্রে কাঠামোর বিচারপূর্বক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিবেচনার ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রধান থেকে গেছে। সারাজীবনই তিনি সম্ভাবনাময় এবং গুণী মানুষদের নানাভাবে উজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্তত ছফার মধ্যস্থতায় আমরা যতটা জেনেছি, তাতে ব্যক্তিকে মূল্যায়নের বা বিচারের ধরনটিও তাঁর একই কিসিমের ছিল। এমনকি সক্রিয়তার প্রধান এলাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও তাঁর কাঠামোগত সংস্কারের কোনো প্রস্তাব পাওয়া যায় না। 

সমস্যাটি প্রবল হয়েছে তখনই, যখন সময় বা কাঠামোকে মূল্যায়নের বেলায়ও ব্যক্তিই প্রধান থেকে গেছে। অথবা, ব্যক্তিকে বিচারের ক্ষেত্রে ভিত্তি ও উপরি-কাঠামোর বাস্তবতা প্রায় উপেক্ষিত থেকেছে। এমনিতে মূল্যায়নের খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কিছু বাটখারা দেখতে পাই ছফার বিবরণীতে। রাজ্জাক প্রায়ই ব্যবহার করেছেন কিছু গল্পগাছা, যেগুলো ব্যক্তিকে একেবারে ভেতর থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তদুপরি প্রধান কৃতিত্ব বা অবদান সাব্যস্তকরণেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি চমকপ্রদ; কিন্তু সময় ও প্রেক্ষাপটের তুলনায় ব্যক্তিকে এতটা কর্তাসত্তা দেওয়া কি সঙ্গত? যদ্যপি আমার গুরুর বহু উদাহরণ থেকে একটিমাত্র উল্লেখ করি। রাজ্জাকের বিচারে বঙ্কিমের মন ছোট ছিল। একটি অন্যরকম তথ্যও তিনি দিয়েছেন। বঙ্কিম পড়াশোনা করেছিলেন মহসিন ফান্ডের টাকায়। কাজেই মুসলমান-বিরোধিতার ভেতর দিয়ে তিনি ঋণশোধ করেছেন। উনিশ শতকের কলকাতার কাঠামোগত বিশ্লেষণের কোনো অবকাশ না রেখে এ রকম বঙ্কিম-বিচার কাজের হতে পারে না। উল্লেখ্য, পরে আহমদ ছফা নিজেও বঙ্কিমের মূল্যায়নে সময়ের তুলনায় বা কাঠামোর তুলনায় ব্যক্তিকে অতিরিক্ত মূল্য দিয়েছেন। কাজেই রাজ্জাকের পদ্ধতিতে তাঁর বিরাগের কারণ ঘটেনি।

অবশ্য ছফার হাতে অন্তত আরও দুটি মোক্ষম উপাদান ছিল, যা দিয়ে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাককে কার্যকরভাবে মিলিয়ে দেওয়া গেছে। এক. রাজ্জাক তাঁর সীমানা ঠিক করেছিলেন দেশ বা জনগোষ্ঠী; কিছুতেই কোনো দল, গোষ্ঠী বা মতাদর্শ নয়। তাঁর প্রীতি বা সমর্থন পেয়েছেন, ধরা যাক, বদরুদ্দীন উমর, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং আহমদ হাসান দানী। নজরকে একটু প্রসারিত করে ছোট খোঁপগুলোর ঊর্ধ্বে উঠে তিনি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি বা সামগ্রিক অগ্রগতির নিরিখে ব্যক্তিকে বিচার করতে পারতেন। তাতে বাঙালি মুসলমানের প্রাধান্য ছিল; কিন্তু বাঙালি হিন্দু বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর প্রতি বিরাগের বালাই ছিল না। কাজেই জাতীয়তাবাদী না হলেও এক ধরনের জাতীয় ভাব তাঁর বিবেচনায় সবসময়েই ছিল। দুই. আর ছিল দরদ। সহানুভূতিও বলা যেত। লিবারেল হিউম্যানিস্ট ডিসকোর্সে এই সহানুভূতিটি একটি খুব জরুরি উপাদান। সুবিধাপ্রাপ্ত ও বিকশিত ব্যক্তিদের তৎপরতাই যদি লিবারেল ডিসকোর্সের প্রধান ভিত্তি হয়, তাহলে ছোটলোকদের কী হবে! দুটি পথ খোলা থাকে। একদিকে ভাবা হয়, বিকশিত মন চুইয়েপড়া আলোরভিত্তিতে গরিবের মনের অন্ধকার দূর করবে। অন্যদিকে, একই রাষ্ট্রের অথবা জাতির অথবা ভাষার মানুষ হিসেবে পিছিয়েপড়া অংশের জন্য থাকবে সহানুভূতি। আবদুর রাজ্জাকের মধ্যে এ বস্তু ষোল আনা দেখি; কিন্তু তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতার ধরন, এবং সার্বিক বিবেচনাবোধে আরেকটু বেশি কিছু দেখি। বিশেষত বাঙালি মুসলমান এবং বাংলাদেশের মানুষদের জন্য। ব্যক্তি-নির্বিশেষে সম্ভাবনা দেখামাত্রই তিনি যে উৎসুক হয়ে উঠতেন, তাকে পশ্চিমা অর্থে সহানুভূতি দিয়ে বর্ণনা করা বোধ হয় কঠিন।

ছফার আবদুর রাজ্জাককে দেখি নিজেকে পুরাপুরি গরহাজির রেখে অন্যের ডিমে তা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রেসে যাওয়া এবং ইন্টারন্যাশনাল হলে কাঁঠালের এঁচোড় পৌঁছে দেওয়ার ঘটনার কথা এ মর্মে স্মরণ করা যাক। দুই ক্ষেত্রেই দীন-মলিন বেশ আর ঢাকাইয়া বুলির আবদুর রাজ্জাককে সাবঅলটার্ন গোত্রের দু’জন মানুষ পাত্তা দেয়নি। রাজ্জাকও নিজেকে উপস্থাপন না করেই ফিরে যান আপন ডেরায়। এই যে উপস্থিত হওয়া এবং নিজেকে জানান না-দিয়েই ফিরে আসার মধ্য দিয়ে লুকিয়ে ফেলা- এই বৈপরীত্যে ছফার রাজ্জাক সবচেয়ে ভালোভাবে মূর্ত হয়েছেন। উপন্যাসিক ছফার অসামান্য চরিত্রায়ণে প্রবল-প্রতাপ প্রজ্ঞাবান রাজ্জাকের বিপরীতে এই গরহাজির রাজ্জাককেও লুঙ্গি পরে, ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে, গামছা-গলায় ঘুরতে দেখা যায়। ‘প্লেইন লিভিং’-এর বিপরীতে ‘হাই থিংকিং’ কথাটির এর চেয়ে প্রকট কোনো মূর্তি বোধ হয় কল্পনা করা যায় না; কিন্তু কথাটির অন্য গভীরতর তাৎপর্য আছে। রাজ্জাক যদি বাজারে স্বমূর্তিতে হাজির থাকতেন, তাহলে প্রভাবশালী বয়ান থেকে নিজেকে কতটা হেফাজত করতে পারতেন, তা বলা মুশকিল। তাঁর চাপা-পড়া ডিসকোর্সে প্রভাবশালী বয়ানের টুকরা-টাকরা খাদ হয়ে মিশে যাওয়া রোধ করা হয়তো সম্ভব হতো না। ভদ্রলোক সমাজে সক্রিয় সেই রাজ্জাকও দেশের বিপুল আপামর জনতার জন্য সহানুভূতি বিলাতে পারতেন, যেমন ভদ্রলোকদের কেউ কেউ বিলান; কিন্তু চাপা-খাওয়া বয়ানের গরহাজির রাজ্জাক চাপা-খাওয়া বিপুল মানুষের কাতারভুক্ত হয়ে পড়েন নিজের গরহাজিরার মধ্য দিয়ে। তাতে ওই মানুষেরা হয়ে ওঠে তাঁর নিজেরই প্রলম্বিত অস্তিত্ব। এমতাবস্থায় প্রজ্ঞাবান রাজ্জাকের সিদ্ধান্ত ও তৎপরতায় দরদি মনের কার্যকর প্রতিফলন দেখা যায়। 

এই দরদি-প্রজ্ঞাবান চরিত্রের ওপর যে কোনো মূল্যের বাজি ধরা যেতে পারে। আহমদ ছফা তা-ই করেছেন।

তিন.
সাধারণভাবে বাংলাদেশের মানুষদের আর বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বোঝার জন্য অধ্যাপক রাজ্জাক এবং তাঁর প্রজন্মের মানুষেরা বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। ব্রিটিশ-ভারতীয় রাজনীতির শেষ আমলের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছেন তাঁরা, এরপর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে পৌঁছেছেন বাংলাদেশে। আহমদ ছফাদের প্রজন্ম এবং তার আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতাটি একেবারেই আলাদা। তাঁরা জঙ্গি পাকিস্তানের বর্ণবাদ মোকাবেলা করে যৌবন কাটিয়েছেন, আর শেষে পাকিস্তানবাদ পরিহার করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হিসেবে থিতু হয়েছেন। কাজেই এ প্রজন্মের মানুষ জ্ঞাত পাকিস্তান আন্দোলন ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের পার্থক্য হয়তো করতে পারতেন; কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে সে পার্থক্য উপলব্ধি করার সুযোগ তাঁদের কম ছিল। বাংলাদেশ আমলে প্রবলভাবে সক্রিয় ভদ্রলোক বুদ্ধিজীবী শ্রেণির এ দুই প্রজন্ম- ছফাদের প্রজন্ম এবং তার আগের প্রজন্ম- ষাটের দশকের জরুরি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার জন্য ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন কলকাতায় উৎপাদিত ‘বাঙালি’ পরিচয়ের ওপর। একেবারেই সরল ঐতিহাসিক কারণে তাঁদের মনোজগৎ থেকে পাকিস্তান আন্দোলনের বাস্তবতা কেবল মুছে যায়নি, একটা বিপরীত বস্তু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

মুশকিল হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্র, তার জনগোষ্ঠীগত বিন্যাস, এবং তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা বাংলাদেশ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন করে তৈরি হয়নি। এর বড় অংশই নির্ধারিত হয়েছিল সাতচল্লিশের আগে এবং সাতচল্লিশের ‘আজাদি’তে। ষাটের দশকের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রচ-তায় ওই দুই প্রজন্ম সে বাস্তবতাকে হয় মুছে দিতে চেয়েছে, অথবা বৈপরীত্যে স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। ঠিক এখানেই তার আগের প্রজন্মের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আহমদ ছফার আবদুর রাজ্জাক এ প্রজন্মের মানুষ। এ প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে অন্য ধরনের সংকট দেখতে পাই। ব্রিটিশ-ভারতীয় বাংলায় মুসলমান মধ্যবিত্ত হিসেবে জীবনযাপনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তাঁদের অনেকেই পাকিস্তান আন্দোলনের আবেগ থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে আলাদা করতে পারেননি। ফলে বাংলাদেশ আন্দোলনকে ধারাবাহিক মুক্তি-সংগ্রাম হিসেবে বুঝতে তাঁদের অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। 

এ সংকটকে আমরা মতাদর্শিক সংকট হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারি। মতাদর্শ যদি বাস্তবকে অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়ামক হয়ে ওঠে, তাহলে গোঁড়ামিই হয় তার পরিণতি। বাংলাদেশ আমলে বেড়ে ওঠা নাগরিকদের একাংশ পরিষ্কার শনাক্ত করতে পারেন, পাকিস্তান আন্দোলন যেমন এ রকম মতাদর্শিক গোঁড়ামির জন্ম দিয়েছিল, ঠিক তেমনি বাংলাদেশ আন্দোলনের জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শও নানা ধরনের গোঁড়ামির উৎস হয়েছে। কথাটিকে আরেকভাবে ব্যাখ্যা করা যাক। অভিজ্ঞতার যে-প্রচ-তায় কেউ একজন জীবন কাটায়, তার পক্ষে ওই অভিজ্ঞতার বাইরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে ওঠে; কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে সামষ্টিক যাপনের নানা তল থাকে, থাকে স্থান-কালের দিক থেকে দূরবর্তী অভিজ্ঞতা। সেগুলোকে সমীকৃত না করে দেশ-জাতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায়ই সংকীর্ণ সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়। একমাত্র জ্ঞান ও জ্ঞান-উদ্ভূত প্রজ্ঞা দিয়েই এ দুই সংকীর্ণতা- মতাদর্শিক ও প্রত্যক্ষ বাস্তবকে- অতিক্রম করা সম্ভব। যে জ্ঞান প্রজ্ঞায় পৌঁছায় না, কেবল জাহের তথা ফ্যাশনেই আটকে থাকে, তার পক্ষে প্রত্যক্ষবাদী ঘটনাস্তর ফুঁড়ে আলো আবিষ্কার করা সম্ভব হয় না। 

আহমদ ছফার আবদুর রাজ্জাককে এরকম আলোর মিছিলে শামিল দেখতে পাই। ব্রিটিশ-ভারতীয় হিন্দু-প্রাধান্যের বাংলায় বড় হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁকে-যে বিশেষভাবে রূপায়িত করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে যদুনাথের সিদ্ধান্ত পড়ে কম বয়সেই তাঁর ‘মুখ তিতা’ হয়ে উঠেছিল, আর অমলেশ ত্রিপাঠির লেখা কংগ্রেসের ইতিহাস পড়ে পরিণত বয়সে তাঁর মনে হয়েছে, ‘এক্কেবারে মনগড়া সব কথা লেইখ্যা থুইছে’; কিন্তু ওই অবস্থান রাজ্জাকের শুরুর বিন্দু মাত্র, শেষ নয়; আর ওই অবস্থান তাঁকে সম্প্রদায়ের ব্যাপারে মনোযোগী করলেও সাম্প্রদায়িক করে তোলেনি, বরং সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবশালী সংজ্ঞায়নকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, পাকিস্তান তাঁর কাছে প্রচ- বাস্তবের কৌশলগত সুরাহা হিসেবেই গ্রাহ্য হয়েছে, কোনো প্রকার ভাবাদর্শিক আদর্শ হয়ে ওঠেনি। সে কারণেই বাংলাদেশ আন্দোলনের কোনো স্তরেই তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করেননি। আবার, বাংলাদেশ আন্দোলনের কারিগরদের একটি বড় অংশের সঙ্গে সক্রিয় সখ্য সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা-অর্জন তাঁর কাছে কোনো পরম মোক্ষ ছিল না। জনগোষ্ঠীর উন্নতি-প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং কর্মকা-কে তিনি প্রশ্ন করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ তিনি মতাদর্শের চেয়ে বাস্তবকে প্রাধান্য দিতে পেরেছেন, আবার বাস্তবকেন্দ্রিক হওয়ার কূপম-ূকতা এড়াতে পেরেছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দৌলতে। তারও গোড়ায় আছে দরদ- জনগোষ্ঠীর বিকাশের লড়াইকে দরদি মন নিয়ে দেখতে পেরেছেন বলেই সাতচল্লিশ ও একাত্তর তাঁর কাছে কোনো বিপরীত সত্য হিসেবে আবির্ভূত না-হয়ে ধারাবাহিক সংগ্রামের বিভিন্ন পর্ব হিসেবে ধরা দিয়েছে। এ দিক থেকে আহমদ ছফা রাজ্জাককে পেয়েছেন আক্ষরিক অর্থেই এক ত্রিকালদর্শী প্রাজ্ঞ পণ্ডিত হিসাবে।

এই ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত, আহমদ ছফার ভাষ্য মোতাবেক, ‘নানা স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন একতরফা মতামত দিয়ে বসেন, যেটা সমাজের মানুষ বরদাশ্ত করতে অনেক সময়ই প্রস্তুত নয়।’ ছফার দিক থেকে কথাটির বাচ্যার্থের তুলনায় ব্যঞ্জনার্থই কাজের জিনিস। কারণ এরকম মতামত দিতেন বলেই, দিতে পারতেন বলেই, আসলে অধ্যাপক রাজ্জাক ছফার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর লোকে সেগুলো-যে খোলা দিলে গ্রহণ করতে পারবে না, তা তো বলাই বাহুল্য। কারণ পুরো ব্যাপারটিই প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী ডিসকোর্সের বিপরীতে চাপা-পড়া ন্যায় অনুসন্ধানের মামলা। আর রাজ্জাকের ক্ষেত্রে এগুলো ঠিক ‘মতামত’মাত্র নয়, তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব ও চিন্তাপদ্ধতির সারমর্ম। বলা যায়, তিনি জ্ঞান, চিন্তা আর জানাশোনায় গভীর ছিলেন বলেই এ ধরনের বড় সিদ্ধান্ত অনায়াসেই প্রকাশ করতে পেরেছেন। আর এভাবেই তার মতামমত বা পর্যবেক্ষণগুলো সারগর্ভ এবং আলাদা হয়েছে। 

ছফা যাকে রাজ্জাকের স্পর্শকাতর মতামত বলেছেন, বাংলাদেশ আমলের কয়েকজন ব্যক্তি সম্পর্কে মন্তব্য বাদ দিলে তার প্রায় সবটাকেই, স্থান-কাল ও বিষয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও এক শিরোনামে আঁটিয়ে নেওয়া যাবে। একে বলা যায়, উনিশ শতকের কলকাতার ‘ক্রিটিক’। বাংলাদেশের ত্রিকালস্পর্শী ইতিহাস বিষয়ে আমরা আগে যে-ইশারা দিয়েছি, তার কারণেই উনিশ শতকের ক্রিটিক এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাজ্জাকদের পরের অন্তত দুই প্রজন্মে, বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমিতে, ‘বাঙালি’ পরিচয়-নির্মাণের সূত্র ধরে, ঢাকায় উনিশ শতকের ওই মহিমান্বিত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমাদের প্রভাবশালী বয়ান-নির্মাতারা খুব সামান্যই খেয়াল করেছেন, কলকাতায় উৎপাদিত বর্গগুলো আদর্শ হিসেবে আরোপণমূলক কায়দায় অনুসৃত হওয়ায়, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর চিন্তাপদ্ধতি ও জ্ঞানতত্ত্বের প্রশ্রয়ে এসব বিষয়ে সবসময়ই ভিন্নমত জানিয়ে গেছেন। এখন আমাদের হাতে উনিশ শতককে পড়ার নানা সুবিধাজনক কলাকৌশল আছে। উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার দিক থেকে আরও সন্তোষজনকভাবে আমরা কাজটি করতে পারছি। রাজ্জাকদের কালে এসব ধারণার বিকাশ ঘটেনি। ঔপনিবেশিক শাসনের ব্যাপারে রাজ্জাকের অবস্থান মধ্যবর্তী- খুব জঙ্গি নয়, আবার ভুলেও থাকেননি। তাঁদের কালে সম্ভবত, হিন্দু-মুসলমান বিরোধের সংকট তীব্রতর হওয়ার কারণে, প্রত্যক্ষ ইংরেজ-বিরোধিতা খানিকটা কমে এসেছিল। সেকালের মানুষজন, যেমন আবুল মনসুর আহমদ বা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের রচনাও একই সাক্ষ্য বহন করছে। তবে অধ্যাপক রাজ্জাক ভিন্ন প্রক্রিয়ায় কার্যকর সব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন। 

তিনি আসলে উনিশ শতকে কলকাতায় সংঘটিত রেনেসাঁর ধারণাই বাতিল করে দিয়েছেন। স্থান ও কালের বিশাল পটভূমিতে উনিশ শতকের ঘটনাবলিকে স্থাপন করে তিনি দেখতে পেয়েছেন, সেখানে আলোর তুলনায় অন্ধকার মোটেই কম পয়দা হয়নি। বড় মানুষদের রেফারেন্স নিঃসন্দেহে উনিশ শতকীয় আলোর প্রধান ভিত্তি। অধ্যাপক রাজ্জাক এ তালিকার এক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া আর কাউকে বড় মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেননি। ওই বড় মানুষদের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন অনতিক্রম্য সংকীর্ণতা; আর তাঁদের কাজকর্মকেও তিনি সংকীর্ণ পটভূমিকায় নিষ্পন্ন তৎপরতা হিসেবেই দেখেছেন। ক্ষুদ্র সমাজের গণ্ডি এড়িয়ে বৃহৎ হিন্দু সমাজেও তার কোনো প্রভাব পড়েনি; মুসলমান সমাজ তো দূরের কথা। সিপাহি বিদ্রোহে কলকাতার ভদ্রলোক শ্রেণির কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই, তাঁর মতে, পুরা ব্যাপারটি উদাম হয়ে যাবে। যেমনটা আগেই বলেছি, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, একমাত্র বাংলা ভাষার চর্চাকেই রাজ্জাক উনিশ শতকের কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্ত বোঝার জন্য রাজা রামমোহন রায় বিষয়ক বিবেচনা স্মরণ করা যেতে পারে।

রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্ব বোঝার জন্য অধ্যাপক রাজ্জাক উর্দূ কবি মীর সওদার উদাহরণ টেনেছেন। ছোট ছোট গল্পগাছা ব্যক্তিকে বোঝার ক্ষেত্রে রাজ্জাক সাহেবের এক প্রধান অবলম্বন। এক্ষেত্রেও তিনি একই পথ ধরেছেন। রামমোহন রায়কে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন বাহাদুর শাহ। বিলাত পাঠানোর কালে তিনি সে উপাধি দেন। তখন তাঁর নিজেরই রাজত্ব নেই; কিন্তু রামমোহন রায় সে উপাধি আমৃত্যু ব্যবহার করে নামের সঙ্গেই স্থায়ী করে গেছেন। অন্যদিকে, রামমোহন রায়ের সমসাময়িক মীর সওদা একবার বসেছিলেন অযোধ্যার বাজারে। তখন নবাব এসেছেন বাজার দেখতে। লোকজন তাজিম দেখাতে দেখাতে অস্থির। সওদা এক দোকানে বসে হুকা খাচ্ছিলেন। তাকে খবর দেওয়া হলো, নবাব এসেছেন, তার সঙ্গে দেখা করে আসা উচিত। জবাবে মীর সওদা নাকি বলেছিলেন, ‘মাইভি উর্দূ জবান কা নওয়াব হ্যায়। মগর কৌন পুঁছে?’ 

রামমোহন রায়ের ব্যক্তিত্ব তালাশ করার এ কথা অনেকেই হয়ত অনুমোদন করবেন না। শুধু এটুকু হলে আমরাও একে উল্লেখযোগ্য মনে করতাম না; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মিথের বাঁধন আলগা করে দেওয়ার বাইরে ব্যক্তি রামমোহন সম্পর্কে রাজ্জাক সাহেবের বিশেষ বিদ্বেষ নেই। পরিষ্কার বলেছেন, তাঁর ‘যোগ্যতা আছিল অঢেল’। লিখতে পারতেন আরবি, উর্দূ, ফারসি, সংস্কৃত, ইংরেজি ইত্যাদি অনেক ভাষা; কিন্তু ‘ডাইনে বামে না তাকাইয়া হি চুজ টু রাইট ইন বেঙ্গলি’। বাংলায় লেখা এবং বাংলা ব্যাকরণ লেখাই, রাজ্জাকের মতে, রামমোহন রায়ের সবচেয়ে বড় কাজ। তাহলে ‘ভারতবর্ষের আধুনিকতার জনক’ হিসেবে রামমোহন রায়ের ধর্মসংস্কার প্রসঙ্গে অধ্যাপক রাজ্জাকের মূল্যায়ন কী? না। তিনি একে বড় কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। কেন? ভারতবর্ষে রামমোহনের মতো ধর্মপ্রচারক আগে অনেকেই ছিলেন। রামমোহন সে ধারার শেষ মানুষ। কাজেই এটাকে এত বড় করে দেখা ইতিহাসসম্মত নয়। 

অধ্যাপক রাজ্জাকের জ্ঞানতত্ত্ব ও চিন্তা পদ্ধতির রোশনাই বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। যাদের ইতিহাস শুরু হয় ১৮০১ সাল থেকে, অথবা ১৮১৫ সালে রামমোহনের কলকাতায় আসার পর থেকে, তাদের হাতে তথ্য-উপাত্ত থাকলেও অনুধাবন করা সহজ নয়, ভারতবর্ষে ধর্মসংস্কারক বড় মানুষদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। সমাজ-সংস্কৃতি ও দার্শনিক প্রত্যয়ের দিক থেকে ওই সংস্কারকদের অনেকেই খুব উঁচু দরের। তার চেয়ে বড় কথা, খোদ রামমোহনের কালেই এ ধরনের অনেকগুলো ধর্মসংস্কার আন্দোলন চলমান ছিল। উনিশ শতকের অন্যতম আলেম অক্ষয়কুমার দত্তের ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায় কেতাবেই তার উল্লেখ আছে; কিন্তু তথ্যের হাজিরা ইতিহাস দৃষ্টির নিশ্চয়তা দেয় না। মিথের বিপরীতে ইতিহাসে উত্তরণের জন্য চাই নিরাসক্তি। অধ্যাপক রাজ্জাক দুনিয়ার আর দশ জায়গার মতো ভারতবর্ষের ইতিহাসকেও দেখতে পেরেছেন গতি-স্থিতি এবং ছেদ ও ধারাবাহিকতার সমন্বয়ে। কাজেই তাঁর কাছে উনিশ শতক অন্ধকারের বিপরীতে আলো নয়, কিংবা চূড়ান্ত ছেদ নয়। রামমোহন রায় ছেদের সঙ্গে সঙ্গে ধারাবাহিকতা হিসাবেও পাঠ্য। 

কিন্তু এটুকু বললেই সংকটের সুরাহা হচ্ছে না। রামমোহন রায়ের সঙ্গে ‘আধুনিকতা’র তকমা আঁটা আছে। ফলে আগের জমানার সঙ্গে ছেদের দাবিটা বৈধ হয়েছে। ওই আধুনিকতার কিনারা না করে ধারাবাহিকতার দাবি ধোপে টিকবে না। দেখা যাচ্ছে, রাজ্জাক সাহেব এ তত্ত্ব-তালাশ করেই মাঠে নেমেছেন। আমাদের কালে উনিশ শতকের ‘আধুনিকায়ন’কে ‘পশ্চিমায়ন’ ও ‘উপনিবেশায়ন’ ধারণা দুটি দিয়ে বিশ্লেষণ করার সুবিধা হয়েছে। আগে তা ছিল না। অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর নিজের বাটখারায় উনিশ শতকের আধুনিকতাকে মেপেছেন :

‘আধুনিকতা জিনিসটারেও ত ভালা কইর‌্যা বুঝন লাগব। আধুনিকতা জিনিসটি বেবাক দুনিয়ায় একই সময়ে আইছে। দশ বছর আগে কিংবা দশ বছর পরে। বিলাতে রেলগাড়ি চালু অওনের দশ বছর পরে ইন্ডিয়াতে রেল আইয়া গেছে। বঙ্কিম মারা গেছেন আঠারশো তিরানব্বই [চুরানব্বই] সালে। আর টলস্টয় মারা গেলেন উনিশশো এগারো সালে। বঙ্কিমের তুলনায় টলস্টয় দীর্ঘ জীবন পাইছিলেন। সেই দিক দিয়া দেখতে গেলে টলস্টয় বঙ্কিমের কন্টেম্পরারি। দুইজনের লেখার কন্টেন্ট মিলাইয়া দেখেন। টলস্টয় কমন ম্যানকে কী চৌকে দেখছেন, আর বঙ্কিম কী চৌকে দেখছেন। শুধু টলস্টয় আর বঙ্কিম কেন ইউরোপের লিটারারি স্টলওয়ার্ট ফ্লবেয়ার, মোপাসাঁ, চেখভ, টুর্গেনিয়েভ, গোগল, জোলা সকলে একটা বিশেষ সময়ের মানুষ। এদের লগে আপনে রবীন্দ্রনাথরেও ধরবার পারেন।’ (পৃ. ৫৯)

দুটি বড় ঘটনা ঘটেছে এখানে। শুধু কলকাতার উনিশ শতক দিয়ে কলকাতার আধুনিকতা বিচড়ানোর বদলে একটি বড় পটভূমির মধ্যে ফেলে দেখার আয়োজন হয়েছে। অন্যদিকে, আধুনিকতার আলোয় বেচইন ভদ্রসমাজকে একটু চেখে দেখার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

কিন্তু উনিশ শতকের আলো এত উজ্জ্বল হয়েছে যে, আগের জমানার অন্ধকারের বিপরীতে। অধ্যাপক রাজ্জাকের কাছে ওই আলো-যে অত নির্মল ঝরণাধারা নয়, তার অন্যতম প্রধান কারণ, তিনি আগের জমানায়ও বিস্তর আলো দেখতে পান। তিনি সমাজ-প্রগতির ধারণাকে বাতিল করেননি, আধুনিকতার প্রকল্পকেও অস্বীকার করেননি; শুধু উনিশ শতকীয় রেনেসাঁ-প্রযোজিত ‘মধ্যযুগীয়’ অন্ধকারের অনৈতিহাসিক মিথকে খানিকটা চটকে দিয়েছেন। ছফা-প্রযোজিত রাজ্জাকের জবান থেকে এরকম দুই টুকরা নমুনা পেশ করছি। এক. পুরনো বাংলার সামন্তযুগীয় অন্ধকারের ধারণা তিনি বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁর মতে, ঠিক ইউরোপীয় অর্থে ফিউডাল সিস্টেম ভারতে ছিল না। মোগল আমলে জমিদার জমির মালিক ছিল না, এবং জমিদারিও বংশানুক্রমিক ছিল না। তবু ইন্ডিয়ার অন্য কোনো কোনো অংশের সমাজ বা গ্রাম-কাঠামোয় ওই ধরনের ব্যবস্থা কিছু কিছু দেখা যায়; কিন্তু বাংলা অঞ্চলে একেবারেই নয়। তার প্রমাণ, প্রফেসর রাজ্জাকের দুর্দান্ত শনাক্তি, বাংলার গ্রাম-সংগঠন। ফিউডাল লর্ডের আস্তানা ঘিরে অন্য বসতি গড়ে ওঠাই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়ার বৈশিষ্ট্য। বাংলায় এ বস্তু একেবারেই নেই। এ মর্মে অধ্যাপক রাজ্জাক পুরনো বাংলার সমুদ্র-বাণিজ্যের কথা তোলেন। বাণিজ্য এরকম সচল থাকে, যেখানে চাঁদ সওদাগরের মতো চরিত্র রচিত হয় সাহিত্যে, সেখানে সামাজিক সচলতাও থাকে। ওই সমাজকে আর যাই হোক, সামন্ততান্ত্রিক বলা যায় না। দুই. দ্বিতীয় উদাহরণটা আহমদ ছফার কলমে রাজ্জাকের জবানেই বলা যাক : ‘ইংরেজ আসার পরে এই দেশের রেভিনিউ সিস্টেমের মধ্যে যে চেঞ্জ আইছে সেইটা শুধু বঙ্কিম না, কেউ বুঝবার পারে নাই। সায়েন্টিস্ট নিউটন আছিলেন মিন্ট মাস্টার। সে সময়টা আওরঙ্গজেবের আমল, ইন্ডিয়ার মানিটারি সিস্টেম যে-কোনো ইউরোপীয় দেশের চাইতে অনেক বেশি সুপিরিয়র আছিল।’ (পৃ. ৮৭-৮৮)

পুরনো জমানায় অন্ধকার এঁকেই উনিশ শতককে ফকফকা করে তোলা হয়েছিল। বিপরীতে প্রফেসর রাজ্জাক উনিশ শতকীয় মিথকে দেখেছেন ক্রিটিক্যালি, আর পুরনো জমানার চাপা-দেওয়া আলোটা একটু উসকে দিয়েছেন। তাতেই বিবেচনা ও মনোযোগের ঐতিহাসিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের, এবং বিশেষত বাঙালি মুসলমানের জন্য কাজটি বিশেষভাবে জরুরি। কারণ ওপারে অত আলো কল্পনা করে চোখ ধাঁধিয়ে ফেললে এপারে নজর দেওয়া অসম্ভব; আর সেই মিথিক্যাল আলোয় গড়া বাটখারায় যদি এপারকে মাপা হয়, তাহলে অন্ধকার ছাড়া কিছুই মিলবে না। পূর্ববঙ্গ ও বাঙালি মুসলমান অতিশয় আলোকিত ছিল, এমন দাবি আবদুর রাজ্জাক একবারের জন্যও করেননি; ছফা তো নয়ই; কিন্তু অন্ধকার ধরে নিয়ে আরোপণমূলক বাটখারায় যদি মাপা-মাপি চলতে থাকে, তাহলে ইতিহাসের জটগুলো কখনোই ছুটবে না। অথচ, আমাদের প্রভাবশালী চর্চায় দশকের পর দশক এ ঘটনাই ঘটছে। ছফার রাজ্জাক প্রজ্ঞার গভীরতায় এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতায় সে গিট্টু খুলে দিলেন। এখন ছফার পক্ষে আমাদের জন্য জরুরি আরও কিছু সওয়াল রাজ্জাক-সমীপে পেশ করা সম্ভব হবে।

চার.
যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের পদ্ধতিগত দিক নিয়ে একটি কথা তোলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বইটিতে আহমদ ছফা এক ধরনের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কাঠামো তৈরি করে তাঁর বিবরণী পেশ করেছেন। কোথাও গোপনে, কোথাও সরাসরি। যেমন- ৫৮-৬০- এ তিন পৃষ্ঠায় ব্যাপারটি ঘটেছে বেশ প্রত্যক্ষভাবে। নিজের মতকে ছফা রেখেছেন ঢাকার প্রভাবশালী ও প্রায় সর্ববিস্তারী মতের প্রতিনিধি হিসেবে। আর অধ্যাপক রাজ্জাকের মতকে উপস্থাপন করেছেন তার এন্টিথিসিস হিসেবে। আখেরে খ-নের বিশেষ জো না থাকায় বা ভিন্নমত উৎপাদনে সাফল্য না থাকায়, এন্টিথিসিসই জয়যুক্ত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা দেখব, থিসিসগুলো মুখ্যত মিথধর্মী; তথ্য-উপাত্তের বদলে ভিত্তি মেনেছে আরোপিত ধারণা বা আদর্শকে। বিপরীতে রাজ্জাকের মধ্যে মতাদর্শিক আরোপণ প্রায় গরহাজির। তাঁর মতের প্রতিষ্ঠা ঘটেছে তথ্যের ভিত্তিতে; নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার নিরিখে। পুরা প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক রাজ্জাক বয়স ও অভিজ্ঞতাজনিত কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছেন। আহমদ ছফা তাঁকে সে সুবিধা দিতে সম্মতও ছিলেন। লক্ষণবিচারে মনে হয়, ‘স্পর্শকাতর মন্তব্যে ওস্তাদ’ রাজ্জাককে দিয়ে ছফা সাম্প্রদায়িকতা বা সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির মতো আমাদের অঞ্চলের অতি-স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজের কথা বলিয়ে নিতে চেয়েছেন। 

অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর যৌবনের একাংশ কাটিয়েছেন ব্রিটিশ ভারতে। উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তখন অনেক বেশি মারমুখো অবস্থায় ছিল। বর্গটি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে থাকবে। যদ্যপি আমার গুরুতে এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন আছে। বিস্ময়কর নয় যে, এ বইতে বহু ব্যক্তির ভালো-মন্দ মূল্যায়নে তাঁর কাছে প্রধান বিবেচ্য ছিল সাম্প্রদায়িকতা। ছফা-প্রণীত রাজ্জাকের চরিত্রায়ণের দিকটি বোঝার জন্য সেটি জরুরি হয়তো, কিন্তু বর্তমান আলোচনায় আমরা অন্য একটি দিকে নজর দিতে চাই। 

বিবাদমান দুই পক্ষ যদি পরস্পরকে সাম্প্রদায়িকতায় অভিযুক্ত করতে থাকে, তাহলে অভিযোগ উত্থাপনের সক্ষমতায় এবং সংজ্ঞায়নে জিত হবে ক্ষমতাবান পক্ষটির। সাধারণভাবে ভারতের ইতিহাসে, এবং বিশেষভাবে বাংলার ইতিহাসে তাই ঘটেছিল। রাজনীতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বহুক্ষেত্রে মুসলমানপক্ষ মুখের লড়াই ও কলমি লড়াইয়ে পরাস্ত হয়ে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র তকমা পেয়েছিল। তার ফল হয়েছে এই যে, পরবর্তীকালে ওই পুরানা ধারণাই দুই পক্ষের হাতে উৎপাদিত-পুনরুৎপাদিত হয়ে বহু মিথ বা মিথ্যাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে সত্য হিসেবে। ঠিক এখানেই অধ্যাপক রাজ্জাকের সাক্ষ্যের গুরুত্ব। একদিকে তিনি দেখাচ্ছেন, নিছক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সম্প্রদায়গত নাম নিয়ে রাজনীতি করতে বাধ্য হলেও, কিংবা আত্মপরিচয়ের নানা খাতে ‘মুসলমান’ শব্দটি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়লেও, এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার আবশ্যিক কোনো যোগ ছিল না; অন্যদিকে, ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায় নিজেদের রাজনীতি এবং অন্য নানা পরিচয়ে সম্প্রদায়ের নাম ব্যবহার না করেই অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। উল্লেখ্য নিজ সম্প্রদায়কে রেয়াত দিয়ে দায়-দায়িত্ব অন্য সম্প্রদায়ের ঘাড়ে চাপানোর কোনো চেষ্টা অধ্যাপক রাজ্জাকের কথাগুলোতে দেখা যায়নি। তিনি কেবল ঐতিহাসিক বিবরণীতে দীর্ঘকাল প্রাধান্য পাওয়া এবং লোক-ধারণায় জেঁকে বসা, ক্ষমতা-সম্পর্কের অসমতা শমিত করতে চেয়েছেন।

ছেচল্লিশের দাঙ্গায় সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা এরকম একটা প্রসঙ্গ। কলকাতায় সেকাল থেকে শুরু করে পরের জমানায় অনবরত উচ্চারিত হয়ে হয়ে এ কথা বেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যে, সরকার প্রধান হিসাবে সোহরাওয়ার্দি তাঁর গুণ্ডাদের কাজে লাগিয়ে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিলেন। তার চেয়ে গুরুতর অভিযোগ, সোহরাওয়ার্দী এ কাজে পুলিশকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নিজের অর্থাৎ মুসলমান পক্ষে। এ কথা প্রমাণ করা গেলে পুরো ঘটনার জন্য মুসলমান পক্ষকে দায়ী করা যাবে এক লহমায়। আজতক এ বয়ানই প্রভাবশালী রয়ে গেছে। অধ্যাপক রাজ্জাক এ মর্মে একটি ছোট্ট প্রশ্ন তুলেছেন মাত্র। বলেছেন, কলকাতা পুলিশে তখন কেবল এক-চতুর্থাংশ ছিল মুসলমান সম্প্রদায়ের। বাকিরা ছিল হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী। তাহলে এই জনমিতির একটি পুলিশ ফোর্সকে সোহরাওয়ার্দি হিন্দু-কতলের জন্য কী কৌশলে ব্যবহার করলেন? ব্যাস, এটুকুই। কলকাতার দাঙ্গার অনেক রহস্য আজও উন্মোচিত হয়নি। রাজ্জাক সাহেব এ বাবদ মুসলমান সম্প্রদায়কে রেয়াত দেওয়ার কোনো চেষ্টাও করেননি; কিন্তু যে প্রভাবশালী বয়ান আমাদের ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তের স্পর্শকাতর এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, সে মিথকে খানিকটা ইতিহাসের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। 

খোদ পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লিগ এবং দেশ-বিভাগ নিয়েও তিনি একই ভঙ্গিতে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাঁর ভঙ্গিটিকে বলতে পারি, বিদ্যমান প্রভাবশালী ডিসকোর্সকে সমস্যায়িত করা। তিনি দেখাচ্ছেন, দ্বিজাতিতত্ত্ব রাজনৈতিক ময়দানে ঘোষিত হবার বহু আগেই বাংলা অঞ্চলের সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক উৎপাদনগুলোতে এ তত্ত্বের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। উনিশ শতকের কলকাত্তাই মধ্যবিত্তের উত্থান-বিকাশ ও সামগ্রিক তৎপরতার কোনো অংশেই মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্থান ছিল না। শুধু ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণে মুসলমান সমাজ অংশ নিতে পারেনি- এ গালগল্প রাজ্জাক সাহেব অনুমোদন করেননি। তিনি দেখাচ্ছেন, ঘটনাটি ঘটানো হয়েছিল ‘ডেলিবারেটলি’। কথাটি প্রমাণের জন্য এক ভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করেছেন তিনি:

‘উপন্যাস অইল গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স। বেঙ্গলে হিন্দু মুসলমান শত শত বছর ধইর‌্যা পাশাপাশি বাস কইর‌্যা আইতাছে। হিন্দু লেখকেরা উপন্যাস লেখার সময় ডেলিবারেটলি মুসলমান সমাজরে ইগনোর কইরা গেছে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম 

থাকলেও থাকবার পারে। বড় বড় সব হিন্দু লেখকদের কথা চিন্তা কইর‌্যা দেখেন। তারা বাংলার বায়ু, বাংলার জল এই সব কথা ভালা কইর‌্যাই কইয়া গেছে; কিন্তু মুসলমান সমাজের রাইটফুল রিপ্রেজেন্টেশনের কথা যখন উঠছে সকলে এক্কেরে চুপ। মুসলমান সমাজরে সংস্কৃতির অধিকার থেইক্যা বঞ্চিত করার এই যে একটা স্টাবর্ন অ্যাটিটিউড হেই সময়ে তার রেমেডির অন্য কোনো পন্থা আছিল না।’ (পৃ. ৫৮)

কাজেই মুসলমান সমাজের অপরায়ণ ঘটেছিল আগেই। সম্প্রদায়ের নাম দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্দোলন করতে পরিস্থিতির কারণেই তারা বাধ্য ছিল। কারণকে আলোচনায় না এনে ফলকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ দিয়ে ব্যাখ্যা করার যে-রেওয়াজ বাংলা মুল্লুকের দুই এলাকায় সুপ্রতিষ্ঠিত, তার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা এবং জ্ঞানগত দীনতাকে অন্য অনেকের মতো অধ্যাপক রাজ্জাকও চিনিয়ে দিয়েছেন মাত্র। তিনি আরেকটি কথা বলতে ভোলেননি। দ্বিতীয় বাংলা ভাগ প্রসঙ্গ। আগে থেকেই 

কথাটি অনেকে বলেছেন- আবুল হাশিম তো বটেই, এমনকি মৌলানা আজাদ পর্যন্ত। আর আজকাল জয়া চ্যাটার্জি, আয়েশা জালাল, যশবন্ত সিং প্রমুখের কল্যাণে ধারণাটি খানিকটা জনপ্রিয়ও হয়েছে। কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগ বা জিন্নাহ বাংলা অঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতাটি নিজ জিম্মায় রাখেননি। বাংলা এক রাখার প্রস্তাবই তাদের প্রায় যে কোনো প্রস্তাবে মুখ্য ছিল; কিন্তু বাঙালি হিন্দুসমাজ বাংলা ভাগ করাকে জরুরি মনে করেছিল। এখন এ জন্য এই হিন্দুসমাজকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। পরিস্থিতি বিচার করেই আলোচনাটি তুলতে হবে। ঠিক তেমনি বাংলা অঞ্চলের সম্প্রদায়কেন্দ্রিক রাজনীতির দায়টি একচেটিয়া মুসলমানদের ঘাড়ে চাপানোর কসরত শুধু অনৈতিহাসিক নয়, শুধু মিথ্যা নয়, জঘন্য অপরাধও বটে। 

বাংলা অঞ্চলে সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনা সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ধারণাটির যেসব ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা এখানে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চালু হয়েছে, আহমদ ছফা খানিকটা নিজে, খানিকটা অধ্যাপক রাজ্জাকের জবানিতে, সে প্রসঙ্গ তুলেছেন। আমরা সে আলোচনায় যাব না। বরং ওপরে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে যে আলাপ করেছি, একেবারেই তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে বাংলাদেশে সেক্যুলার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লিগ এবং বাঙালি মুসলমানের তৎপরতার যে- একটা বিরোধমূলক ধারণা প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে সম্পর্কে যদ্যপি আমার গুরুর ভাষ্য উপস্থিত করব।

বঙ্কিমের উপন্যাসগুলো যখন প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন বটতলা থেকে ছাপানো বিস্তর পুথিও বাজারে আসছিল। এ দুইয়ের তুলনা করে অধ্যাপক রাজ্জাক একটি মজার জিনিস সামনে এনেছেন। তাঁর মতে, ‘পুঁথির বিষয়বস্তু এক্কেরে সেক্যুলার, কিন্তু চিন্তাপদ্ধতি মধ্যযুগীয়। বঙ্কিমের চিন্তা আধুনিক, কিন্তু বিষয়বস্তু ধর্মীয়।’ প্রভাবশালী ধারণার প্রতিনিধি সেজে ছফা কথাটার প্রতিবাদ করেন : ‘বঙ্কিমের সব রচনার বিষয়বস্তু তো ধর্মীয় নয়’। অধ্যাপক রাজ্জাকের হাজির-জবাব : ‘ওই অইল একই কথা, রিভাইভালিস্ট স্পিরিট অ্যান্ড মডার্ন স্পিরিট এ ওর গায়ে ঠেস দিয়া খাড়াইয়া আছে।’ 

রাজ্জাকের কথা থেকে আরেকটি উদাহরণ দেই। ভারতের স্বাধীনতা উপলক্ষে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত লাইফ ম্যাগাজিন নাকি একটি প্রচ্ছদ কাহিনি ছেপেছিল। প্রচ্ছদের ছবিটা ছিল এরকম : ‘অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠানে নেহরু খালি গায়ে বইস্যা মন্ত্র পড়ছেন। তাঁরে ঘির‌্যা বইয়া আছেন মন্ত্রিম-লী বেদির চারপাশে। বেদি থেইক্যা দূরে খাড়াইয়া আছেন দুইটা মানুষ- আম্বেদকর আর মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। অনুষ্ঠানটা অইতাছে বেদের নিয়মানুসারে। সেইখানে অহিন্দুর থাকনের পারমিশন নাই। লাইফ ম্যাগাজিন একটা মজার ক্যাপশন দিছিল- বার্থ অব এ সেক্যুলার স্টেট।’ (পৃ. ৭৭-৭৮)

যে প্রশ্নটি সামনে আনার জন্য আহমদ ছফা আবদুর রাজ্জাক মারফত কথাগুলো তুললেন, সেটি খুব সরল প্রশ্ন নয়। বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দুত্ববাদের একটি আধুনিক রূপ দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ভারতের ইতিহাসে এটিই বঙ্কিমচন্দ্রের সবচেয়ে বড় অবদান হলেও, কথাটি অনেকেই আড়াল করতে চান। অনেকে আবার ‘ব্রিটিশ’দের জায়গায় কৌশলগত কারণে ‘মুসলমান’ লিখেছেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে বঙ্কিমের সম্পর্ক বেজায় খারাপ ছিল [রায় বাহাদুর উপাধির তথ্য জানা সত্ত্বেও] ইত্যাদি কথা বলেন। ব্যাপারটি ভালো কি খারাপ, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। বঙ্কিমচন্দ্র কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাও এখানে জরুরি নয়। প্রশ্ন হলো, কোন ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে দুই বাংলার ভদ্রলোক-সমাজ এভাবে বঙ্কিম পড়ার প্রেরণা বোধ করেন? ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বিষয়েও একই কথা। সবাই জানেন, ভারত আজাদির দিনটি পিছিয়েছিল ¯্রফে ধর্মীয় কারণে। ভারত রাষ্ট্রটির ভিত্তি-যে হিন্দুত্ব, এর বাইরে রাষ্ট্রগঠনের উপাদানগত আর কোনো মিল-যে ভারতীয়দেও নেই, তা-ও সবার জানা। কনফেডারেশন গড়ার ব্রিটিশ প্রস্তাব জিন্নাহর সমর্থন সত্ত্বেও কংগ্রেসের বিরোধিতার জন্যই যে বাস্তবায়িত হয়সি, সেটিও কোনো চাপা-পড়া তথ্য নয়। কংগ্রেস কেন্দ্রীয় হিন্দু রাষ্ট্রই চেয়েছিল। ফলে লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের ছবিটি মোটেই কোনো আচানক আবিষ্কার নয়। এ ব্যাপারে ইতিহাসপাঠের কোনো একগুঁয়ে অবস্থান নিয়ে কাউকে, বা কোনো সম্প্রদায়কে, বা এমনকি কোনো অবস্থানকে কালিমালিপ্ত করাও, যদ্দুর ধারণা করা যায়, অধ্যাপক রাজ্জাক বা আহমদ ছফার লক্ষ্য নয়। বরং লক্ষ্য পরের প্রশ্নটি, এতসব প্রকাশিত প্রত্যক্ষ তথ্য-উপাত্তকে কোন কৌশলে পাশ কাটিয়ে ভারত রাষ্ট্র, কংগ্রেস, গান্ধি, বেঙ্গল কংগ্রেস অথবা কলকাতার হিন্দু ভদ্রলোক-সমাজ বাংলা অঞ্চলের যাবতীয় ন্যারেটিভে অব্যাহতভাবে সেক্যুলার থেকে যায়! 

অধ্যাপক রাজ্জাক পরের উদাহরণটি দিতেও ভোলেননি। তিনি ছফাকে বিচড়ে দেখতে বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া বিপুল গ্রাজুয়েট এবং সাহিত্যিক এতটি সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কীভাবে আবির্ভূত হলো। রাজ্জাকের হিসাবটা, কোনো আরোপণমূলক আদর্শ সংজ্ঞায়ন থেকে আসেনি বলেই, একেবারে সোজা। তিনি পরিষ্কার শনাক্ত করতে পারেন, ইসলামি থিয়োলজিতে সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির বিরাট অবস্থান আছে এবং সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমাজের সেক্যুলারায়নে মুসলমানদের বড় ভূমিকা ছিল। আর বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠী বরাবরই অস্তিত্বের লড়াইয়ে শামিল ছিল। তার লড়াই-সংগ্রাম বরাবরই দুনিয়াবি এবং সে অর্থে সেক্যুলার। পাকিস্তান আন্দোলনের কালেও, বাংলাদেশ আন্দোলন পর্বেও। তিনি জানেন, ‘বাঙালি মুসলমানসমাজের সেক্যুলারিজমের বিকাশের প্রক্রিয়াটি সমাজের ভিতর থেকে, বাঙালি মুসলমানের সামাজিক অভিজ্ঞতার স্তর থেকে বিকশিত করে তুলতে হবে’। কোনো আরোপিত আদর্শের ভিত্তিতে জাতিবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ এ প্রক্রিয়াকে কেবল পিছিয়েই দিতে পারে, আর অমূলক হাহাকার তৈরি করতে পারে; এভাবে কোনো কার্যকর প্রক্রিয়ায় শামিল হওয়া যাবে না। সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রশ্নে এসব জরুরি জিজ্ঞাসার দিকে আহমদ ছফা প্রণীত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রবলভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

পাঁচ.
বাস্তবের আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে আহমদ ছফার কিছু অস্বস্তি ছিল। মূল আপত্তিটা ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এবং সে সমর্থনের পেছনের যুক্তিগুলোকে শেষ পর্যন্ত ন্যায্য মনে করতে থাকা। অন্তত একবার ছফা একে তুলনা করেছেন কম বয়সে পাওয়া আঘাতের সঙ্গে। যৌবনে সে আঘাত হয়ত ভুলে 

থাকা যায়; কিন্তু বুড়ো হলেই আবার জেঁকে বসে। আরেকবার ছফা মুসলিম লীগার রাজ্জাকের জন্য ‘এ ট্রটস্কিয়াইট এ্যামাং দ্য মুসলিম লিগারস’ বলে একটা সমঝোতামূলক অবস্থান সাব্যস্ত করেছেন। রাজ্জাক সাহেব অবশ্য এ ব্যাপারে নির্বিকার। পাকিস্তান আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের প্রতি তিনি শুধু-যে সমর্থন বজায় রেখেছেন তা নয়, এর পেছনের যুক্তিগুলোকে বরাবর অনিবার্য হিসেবে উত্থাপন করেছেন। ঢাকার প্রভাবশালী ডিসকোর্সে অভ্যস্ত ছফা তাতে বিশেষ স্বস্তি বোধ করেননি; কিন্তু নিপুণ লিখিয়ে হিসেবে সেই অস্বস্তিগুলোকে তিনি বইয়ের সামগ্রিক বিবরণীর কার্যকর অংশ করে তুলতে পেরেছেন।

আগেই বলেছি, ওই অস্বস্তিকর ‘সত্য’গুলি যদ্যপি আমার গুরুর চিন্তাপদ্ধতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ। বইটির সংলাপধর্মী-দ্বন্দ্বমূলক নাটকীয়তার প্রধান উৎস চাপা-পড়া অস্বস্তিকর ডিসকোর্সের প্রত্যয় এবং বিজয়। সে বন্দোবস্তও লেখক নিপুণভাবে তৈরি করেছেন। দিল্লিস্থ ইলাস্ট্রেটেড উইকলি প্রচার করেছিল, ছয় দফা প্রস্তাবের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রাজ্জাক সাহেবের। এ সিদ্ধান্তে আহমদ ছফার কোনো ভিন্নমত তো নেই, তদুপরি তিনি নিজ জবানিতে জানাচ্ছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণা বিকশিত করার পেছনে এককভাবে প্রফেসর রাজ্জাকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। বাস্তবের অথবা স্বপ্রণীত আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে তাঁর আরও দুটি মন্তব্য আছে এ বইতে। তিনি মনে করেন, বাঙালি মুসলমানের বুদ্ধিবৃত্তিক সাবালকত্ব অর্জনে সবচেয়ে বড় অবদানটি রাজ্জাক সাহেবের। আরও মনে করেন, শিখা আন্দোলনের মর্মবেগ তাঁকে স্পর্শ করেনি। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের সারবাহী এই শেষোক্ত মন্তব্যের মতো অন্তর্ভেদী অবলোকন হয়ত ছফার পক্ষেই সম্ভব।

তাহলে দাঁড়াল কী? একজন জিন্নাহ-ভক্ত মুসলিম লীগার যে-প্রেরণায় পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রায় একই প্রেরণায় বাংলাদেশ আন্দোলন করেছেন। তিনি উদারনীতিবাদী, সেক্যুলার এবং গণতান্ত্রিক। মানুষের মুক্তি-সংগ্রামই তাঁর কাছে বড় সত্য। আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা, সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে অন্য পটভূমিতে উৎপন্ন সংজ্ঞা ও মিথ তিনি খরিদ করেন না। বরং জ্ঞান-উদ্ভূত প্রজ্ঞার জোরে দুনিয়া ছেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার বরাতে তিনি নিজ জনগোষ্ঠীর সাবালকত্ব কামনা করেন। সেই বৃহৎ দুনিয়ার মধ্যে উনিশ শতকের কলকাতার বাংলাচর্চাও সাদরে গৃহিত হয়। তাঁর সাক্ষ্য আরও একটা কারণে মূল্যবান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বাস্তব ইতিহাস নির্ধারিত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতে, পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে। তিনি এ তিন আমলেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এরকম একজন মহাকায়ার বিপরীতে ছফা নিজের তরফে অথবা অন্যদের বরাতে উপস্থাপন করেছেন অনেক অনেক আপত্তি, যেগুলি মিথধর্মী, অনৈতিহাসিক এবং আরোপণমূলক আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। 

লেখকের নিজের প্রশ্ন, অন্যদের বরাত, রাজ্জাক সাহেবের কথকতা ও বাস্তবের জীবন, অন্যসব চরিত্র আর উদ্ধৃতি ইত্যাদি সবকিছু মিলে যদ্যপি আমার গুরুর দুই মলাটের মাঝখানে যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে, সন্তোষজনক দূরত্বে গিয়ে দেখলে তার গড়ন এ রকম দাঁড়াবে : দুইপক্ষ পরস্পর মিলে-ঝুলে আছে; কিন্তু দ্বন্দ্বটাও বেশ প্রকট আর গভীর। ঠিক এ ভাবনায় এসে মনে হয়, বইটি ছফার এক বানোয়াট রচনাÑ ঠিক উপন্যাসের মতোই বানানো। বলা যায়, যদ্যপি আমার গুরু আহমদ ছফার উপন্যাসিক প্রতিভার এক অতুলনীয় প্রকাশ। বইতে তার কিছু ইশারাও আছে।

ছফা বলেছেন, এটি নিছক সাক্ষাৎকারধর্মী রচনা নয়। সরদার ফজলুল করিমের মতো বিষয়নিষ্ঠাও তিনি দেখাতে পারেননি। আরও বলেছেন, রাজ্জাক সাহেব যে স্পিরিটে কথাগুলি বলেছেন, তা তিনি রক্ষা করতে পেরেছেন কি-না, তাতে সন্দেহ আছে। এসব ভনিতাকে কি আমরা ¯্রফে বিনয় হিসেবে পড়ব? যদি পড়িও, তাতে শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এক জায়গায় পরিষ্কার বলেছেন, এ বইয়ে রাজ্জাক কতটা, আর ছফা কতটা, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। আর সব মিলিয়ে তার চেষ্টা ছিল প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সমস্ত ব্যক্তিত্বটি স্পর্শ করা। যারা বাস্তবের ইমানদার হিসেবে অধিবিদ্যক যে কোনো সম্ভাবনায় গোস্বা হন, তাঁরাও নিশ্চয় স্বীকার করবেন, কথাসাহিত্যে যাকে চরিত্রায়ণ বলা হয়, যদ্যপি আমার গুরুতে তার রীতিমতো কুশলী প্রদর্শনী আছে। সময়ের পরিকল্পনাটাও করা হয়েছে নিখুঁতভাবে। বর্তমান স্থান-কালের মিলনবিন্দুতে চক্রাকারে ভিড় করেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের তিন কাল। আর এভাবেই মূর্তিমান হয়েছেন এক ত্রিকালজ্ঞ পণ্ডিত। একে উপন্যাস ভাবতে নারাজ হলে আপনি পরিকল্পিত চরিত্রায়নও বলতে পারেন। 

জরুরি প্রশ্ন হলো, আহমদ ছফার জন্য এ চরিত্রটির দরকার পড়ল কেন? দরকার ছিল। ছফা বাংলাদেশ আন্দোলন পর্বের মানুষ। এ সময়ে জন্ম-নেওয়া এবং বাংলাদেশ আমলের নানা বাঁক বদলে প্রতাপশালী হয়ে-ওঠা চিন্তা ভাবনার মধ্যেই তিনি কাজ করেছেন। উনিশ শতকের আলোয় অন্য বেশিরভাগের মতো তাঁরও আস্থা ছিল; কিন্তু একজন সচল-সক্রিয় সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি প্রভাবশালী ডিসকোর্সের নানা গোঁজামিল টের পেতেন। দেশের মানুষের প্রতি অঙ্গীকার যদি মতাদর্শিক বা আদর্শবাদী অবস্থানের চেয়ে জোরালো না হতো, তাহলে তিনি আরামে সাহিত্যকর্ম ও বুদ্ধিজীবিতা চালিয়ে যেতে পারতেন; কিন্তু প্রথম থেকেই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণে প্রভাবশালী চিন্তা-ভাবনার অনেক অনুমান ও প্রত্যয় তাঁর কাছে গোলমেলে ঠেকছিল; আর ছফার পাঠকমাত্রই জানেন, গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাঁর ভিন্নমত ক্রমেই প্রবলতর হচ্ছিল। যদ্যপি আমার গুরুকে বলতে পারি, তাঁর সেই অসুখী চৈতন্যের প্রবলতম প্রকাশ, যেখানে নিজের বাস্তবলিপ্ত অংশকে নিজ নামে আর আকাক্সক্ষার দিকটাকে অধ্যাপক রাজ্জাকের বরাতে বিন্যস্ত করে তিনি জরুরি ইশতেহার প্রকাশ করলেন।

আহমদ ছফা প্রণীত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রধান গিঁটগুলো আলগা করার- মীমাংসা যদি নাও হয়- সম্ভবত সর্বোত্তম প্রয়াস। 

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //