ডিয়ার ডিরেক্টর অ্যান্ড পোয়েট, গুড বাই

মরে যাওয়া পাখিটা শিশুপুত্র মাটিতে পুঁতে দিয়ে বলল, বাবা, আমাদের পাখিগাছ জন্মাবে। সেই গাছে যত পাখি বসবে সব আমাদের পাখি। তখন তোমাকে আর পাখি শিকার করতে দূরের জঙ্গলে যেতে হবে না। অবশ্য সেই শিশুপুত্রও মরে যায় কদিন পরেই। পাখি শিকার করে শহরের বাবুদের কাছে বিক্রি করে চলা জীবন লখাইয়ের। লখাই কি আর একা? ঘরে সোমত্ত বউ আছে। বউয়ের দিকে নয়, হতদরিদ্র লখাইয়ের নজর পাখির দিকে। পুঁজির কত ক্ষমতা, বউ একদিন মহাজনের ফড়িয়ার সঙ্গে চলে যায় স্বামী লখাইকে ছেড়ে। পরদিন ভোরে অনেক পাখি এসে বসে বিছানায় শুয়ে থাকা লখাইয়ের শরীরের ওপর। লখাইয়ের ঘরের বারান্দায়, চালের ওপর আসে দল দল পাখি। লখাই ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে, বালিভূমির ওপর হাঁটে, ক্রমেই নিজের দুই হাত পাখির মতো দুই পাশে মেলে দিয়ে সব হারানো লখাই দৌড়ায়, যেন বা লখাই পাখি হয়ে মিশে যায় সমুদ্রের ওপরে উড়ে যাওয়া একদল পাখির সঙ্গে। ‘চরাচর’ দেখেছি বেশ কবার। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র অন্যান্য ছবিও প্রায় সবই দেখেছি। কবি তিনি, তিনি ভালো বাংলা ছবির নির্মাতা। ৭৭ বছর বয়স্যা প্রয়াত হলেন। শূন্যতা তৈরি হলো তাঁর, ছবি নির্মাতার, কবির। 

‘দূরত্ব’, ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘উড়োজাহাজ’, ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘কালপুরুষ’, ‘ফেরা’, ‘তাহাদের কথা’- এসব ছবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র। বিস্তৃত পরিসরে তাঁর ছবিকে নিয়ে লিখব হয়তো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটি দেখলাম, কবি ও পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত চলে গেলেন। সত্যি, বাংলা ছবির একজন বড় পরিচালকের অন্তর্ধান হলো। এ খবরে ব্যক্তিগতভাবে আমি মর্মাহত, ব্যথিত। প্রিয়জন হারালাম। 

কমলকুমার মজুমদারের গল্প ‘তাহাদের কথা’ চিত্রায়ণে দেখেছি, এক স্বদেশী বিপ্লবী জেল খেটে মুক্তির পর বাড়ি ফিরেছেন। তার জেলে থাকার সময়ে দেশ শুধু স্বাধীনই হয়নি, ভাগও হয়ে গেছে। কোনো কিছুই হয়তো আর আগের মতো নেই। সময় চলে গেছে। স্বদেশী বিপ্লবী তার স্ত্রীর কাছে রাতে শুয়ে বুঝতে পারেন, জেলজীবন তার শরীর থেকে যৌবন যৌনতাও নিয়ে গেছে। কেবল মনের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে জেলে যাওয়ার আগের সেই স্ত্রীসঙ্গমের স্মৃতি। কত বদলে গেছে চারপাশ। এই বদল ধরতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত


যেন বা আমাদের শৈশব লুকিয়ে আছে তাঁর ছবিতে। কৌতূহলী এক বিষণ্ণ কিশোর যেন বা হেঁটে যাচ্ছে তাঁর ছবির ভেতর দিয়ে। বিষণ্ণ তবু স্বপ্নময় চোখ। ব্যক্তির ভেতরের অভিপ্রায়, ভাঙন তিনি নির্মাণ করেছেন সুনিপুণভাবে। বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে যেন বা তাঁর ক্যামেরা দাঁড়িয়ে আছে ট্রাইপডে, ধরছে উঁচুনিচু ভূমির উপর দিয়ে মানুষের হেঁটে যাওয়া। যেন বা তাদের ঘরের গল্প লিখছেন তিনি ক্যামেরায়। যেন বা কোথাও এক মায়াবী চাঁদ ঝুলে আছে এখনো, সেইখানে ছোট্ট ঘরের জানালায় চোখ মেলে তাকাচ্ছে ভালোবাসা। সমাজ ও মানুষের প্রতি এক মমতাময় আচরণ রেখে গেছেন তিনি তাঁর কাজের ভেতর দিয়ে। 

কমলকুমার মজুমদারের গল্প ‘তাহাদের কথা’ চিত্রায়ণে দেখেছি, এক স্বদেশী বিপ্লবী জেল খেটে মুক্তির পর বাড়ি ফিরেছেন। তার জেলে থাকার সময়ে দেশ শুধু স্বাধীনই হয়নি, ভাগও হয়ে গেছে। কোনো কিছুই হয়তো আর আগের মতো নেই। সময় চলে গেছে। স্বদেশী বিপ্লবী তার স্ত্রীর কাছে রাতে শুয়ে বুঝতে পারেন, জেলজীবন তার শরীর থেকে যৌবন যৌনতাও নিয়ে গেছে। কেবল মনের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে জেলে যাওয়ার আগের সেই স্ত্রীসঙ্গমের স্মৃতি। কত বদলে গেছে চারপাশ। এই বদল ধরতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ‘কালপুরুষ’-এ উপস্থাপিত পিতাপুত্রের সম্পর্ক ও সংকট। পুঁজিবাদী পুরুষতন্ত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোথাও মাঠের মধ্যে অবস্থিত পতিতালয়ে জন্ম নিয়ে বড় হওয়া কিশোরীর আকাঙ্ক্ষা ও আকাঙ্ক্ষা নিহত হওয়ার ছাপচিত্র। কিশোরী তার পতিতা মায়ের ঘরের জানলা দিয়ে চাঁদ দেখছে, মানুষ সে সময় চাঁদে যাচ্ছে সে খবরও ছাপা হচ্ছে কাগজে। পুঁজির দাপট ও যৌনতা পরিষ্কার করেই মেলে ধরেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বাংলা ছবির নির্মাতাত্রয়ী সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন। কলকাতার ছবিতে এরপরেই কি ক্রিটিক ও শুভান্যুধায়িরা বলবেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র নাম? 

সত্যজিৎ রায়রা কিশোরগঞ্জের মানুষ, ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ঢাকায়, যদিও পারিবারিকভাবে ঘটক পরিবার রাজশাহী ও পাবনার লোক এবং মৃণাল সেন ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে ফরিদপুর থেকে চলে যান কলকাতায়। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনের মানুষ গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত রাও কলকাতায় চলে যান। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র মামা হচ্ছেন সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। এ রচনায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র কবিতা নিয়ে কথাবার্তা একদম অনুপস্থিত থেকে গেল। 

শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরিতে চলচ্চিত্র উৎসব চলছিল এবং বুদ্ধ দা’র ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছিল উৎসবের একটি ছবি। লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে একটি চেয়ারে বসেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আমি তাঁকে একলা পেয়ে এগিয়ে যাই এবং প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত?’

কলকাতার কবি আমার দিকে তাকালেন এবং মাথা নাড়লেন। বললাম, ‘আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।’ তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং আমাকে পত্রিকার লোক মনে করে বললেন, ‘বিনোদন সাংবাদিকদের সাথে আমি কথা বলি না।’ আমি বললাম, ‘গৌতম ঘোষ দস্তিদার সম্পাদিত চলতি সংখ্যা ‘রক্তমাংস’ পত্রিকার আপনার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পড়লাম। আমি কবিতা লিখি। সিনেমা দেখি। বিনোদন সাংবাদিকতা করি না।’

কোথাও আমার লেগেছিল তাঁর কথায়, মনে ঝাল জমেছিল। আমার নাম জানতে চাইলে বললাম, এবং তিনি আমাকে বললাম, ‘ওহ কালীকৃষ্ণ গুহদের ‘দরগারোড’ এ কি আপনার একটা দীর্ঘ কবিতা ছাপা হয়েছে?

‘জি’ তখনকার দিনে নেট আসেনি। সোশ্যাল সাইট ছিল না। ফেসবুক ছিল না। তবে লিটল ম্যাগাজিন ছিল। লিটল ম্যাগাজিন খুব শক্তিশালী কিছু ছিল মাধ্যম হিসেবে। আমার ‘জি’ বলা শুনে তিনি বুঝলেন, হয়তো আমাকে কিছুটা ধরতেও পারলেন। বললেন, ‘তাহলে আগামীকাল সকাল ১১টায় আসেন, লা ভিঞ্চি হোটেলে।’

পরদিন ঢাকায় ছিল হরতাল এবং হালকা হালকা বৃষ্টি। সেই সিডি-নির্ভর সিনেমা দেখার দিনে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র ছবির আরেকজন একনিষ্ঠ দর্শককে নিয়ে আমরা হেঁটে হেঁটেই কারওয়ানবাজার যাই। হরতাল থাকায় হাঁটতে হলো এবং হাঁটতে হাঁটতে আমরা খানিকটা ভিজেও গেলাম। আমরা বলতে আমি আর শিল্পী ধ্রুব এষ। লা ভিঞ্চিতে আধা ঘণ্টার শিডিউল ছিল কিন্তু আমরা হোটেলের বুফেতে আড্ডা দিলাম ৪/৫ ঘণ্টা। ধ্রুব এষ তাঁর অলঙ্করণে করা একটি ছড়ার বই উপহার দিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে। খুব খুশি হলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তাৎক্ষণিক ৪ লাইনের একটি ছড়াও বানিয়ে শোনালেন। সেই ছড়ার বইটি ছিল কবি আল মাহমুদের। ঘণ্টা পাঁচেক বোঝাপড়া। আমি এবং ধ্রুব এষ আর বুদ্ধ দা, একটা ম্যারাথন আড্ডা, টেবিলে, মুখোমুখি। দাশগুপ্ত’র সঙ্গে ছিলেন কলকাতার একজন ফিল্ম ক্রিটিক। এখন তাঁর নাম আমার মনে নেই। সেই ক্রিটিক লোকটার খুব ইলিশ খিচুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে, ‘লাল দরোজা’র কাস্ট অভিনেত্রী চম্পার বাসায় সেই খিচুড়ি রান্না হচ্ছিল। তাদের ইলিশ খাওয়ার লোভেই আমাদের আড্ডা সমাপ্ত সেদিনের মতো। 

আমার একটি কবিতার বই উৎসর্গ করি এই নির্মাতাকে; কিন্তু বইটির একটি কপি কীভাবে পৌঁছবে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র হাতে? ফোন করলাম একদিন ভারতীয় দূতাবাসের কবিতাপ্রাণ সেক্রেটারি অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। অভিজিৎ দা বললেন, ‘বইয়ের একটি কপি যদি আমাকে দাও, তাহলে আগামীকালই আমি কলকাতা যাচ্ছি। ছুটিতে থাকব কয়েক দিন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’র হাতে তোমার কবিতার বই পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারি।’ সেভাবেই, কবিতার বইয়ের দুটি কপি পাঠালাম গুলশানে, ভারতীয় দূতাবাসের সেক্রেটারি অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। বই পৌঁছে গেল। আমার সেই কবিতার বই ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে’র প্রকাশনা বেঙ্গল ক্রিয়েশনস। 

তারপর আর দেখা নেই, কথা নেই। একদিন দেখলাম, ধ্রুব এষ ‘উড়োজাহাজ’ এর পোস্টার করছেন। একাধিক ডিজাইন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত দেখে যেটা পছন্দ করেন। 

ধ্রুব এষ বললেন, ‘উনি খুব খুশি, উড়োজাহাজ-এর পোস্টার ডিজাইন সবগুলাই পছন্দ করেছেন।’ 

আমি কাঁটা নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত। খবর পাচ্ছিলাম, বুদ্ধ দা কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। ভেবেছি, সুস্থ হয়ে উঠলেই আড্ডা দিতে যাব, কলকাতায়। আড্ডা হবে কবিতার, আড্ডা হবে ছবির। কবিতা আর ছবি তো আমাকেও অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে আর আপনার সঙ্গে আমার জমেছে যে কারণে। ভেবেছিলাম, আমি আপনার একটা সাক্ষাৎকার নেব। ছবি ও কবিতার অন্দরমহলের খবর নেব। অন্তরমহলের খবর নেব। ভালোবাসার গল্পই তো আড্ডা, কী নারী কী পুরুষে। 

হলো না। আর হবে না। কোনও অনুষ্ঠানে ঢাকায় এসে যেমন ফোন করে বললেনও, “তোমার কবিতার বই ‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন অ্যা ডে’ পেয়েছি। ঢাকায় দুইদিন আছি। এসো, আবার আড্ডা হবে।” 

কীভাবে হবে? আপনি তো চলে গেলেন! মর্মাহত হলাম। আজ আপনার জন্যে অন্তরলালিত ভালোবাসা জানাচ্ছি। ডিয়ার ডিরেক্টর অ্যান্ড পোয়েট, গুড বাই...

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //