মরদেহ ছড়ায় শুভ্র মোমবাতির ঔজ্জ্বল্য

কারও কারও জন্ম রক্তপথে হাঁটবার জন্য। বিপ্লবের জন্য। শুভ্র মোমবাতি থেকে ঔজ্জ্বল্য ছড়ানো এক বিপ্লবীর নাম আর্নেস্তো চে গুয়েভারা সেরেনা। আমৃত্যু বিপ্লবী চে গুয়েভারা। বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি চে। বিপ্লবী চে বাংলাদেশে অজানা নয়। চে’র ছবি ছাপানো টি-শার্ট গায়ে তরুণ হেঁটে যায় আত্মবিশ্বাসে। চে’র ছবি ছাপানো ক্যাপ মাথায় যুবক হেঁটে যায় চির উন্নত মম শির। ১৯৬৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেই যেন দ্বিতীয় জন্ম নিলেন তিনি। আর বিশ্বময় অসংখ্য তরুণের স্বপ্নের নায়ক, বিপ্লবের জীবন্ত আইকন হয়ে উঠলেন। বিপ্লবের আলোয় তিনি যে কেবল নিজ ভূখণ্ড রাঙিয়ে ছিলেন তা নয়, তাবত বিশ্বে বিপ্লব থেকে সাহিত্যে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তার যাপিত জীবন দিয়ে। 

১৯২৮ সালের ১৪ জুন তাঁর জন্ম আর্জেন্টিনার রোসারিওতে। মানুষের প্রতি চে’র অনুভব, আজীবন ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার টানে নিপীড়িত মানুষের জন্য কিছু করতে পারার তাগিদই তাকে ঘর ছাড়া করেছিল, নির্লোভ করেছিল। ঘর-সংসার, সরকারের উচ্চপদ ও খ্যাতির মোহ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এক জ্বলে ওঠা মশাল- অরণ্য যোদ্ধা হয়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত  মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া- সবটাই কেবল বিপ্লবের জন্যই নয় বিশ্ব সাহিত্যেরও অনুপ্রেণা। বিশ্বে সম্ভবত এমন কোনো ভাষা নেই, যে ভাষায় লেখা হয়নি চে’কে নিয়ে কোনো কবিতা। সেসব কবিতায় বারবার ঘুরে এসেছে সেই বিপ্লবীর চিত্রকল্প যিনি চেয়েছিলেন সবার জন্য সমান একটি পৃথিবী, চেয়েছিলেন সেই পৃথিবীর মানুষেরা বেঁচে থাকবে স্বাধীনভাবে সমান অধিকার নিয়ে। 


১৯৬৭ সালে ৯ অক্টোবর বেরিয়েস্তোস সরকার এবং ওয়াশিংটনের নির্দেশে চে গুয়েভারাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। হত্যার পর যেন তিনি আরও প্রবলভাবে জেগে উঠেছিলেন যিনি জীবিতের চাইতেও অধিক জীবিত। যুগ যুগ ধরে তারুণ্যের ও বিপ্লবের প্রতীক হয়ে রয়েছেন চে।

আমি তাঁকে প্রথম দেখি আমার তরুণ বয়সে ‘চে গুয়েভারা’র ডাইরির পাতায়। সেটি চে-র বিপ্লবী জীবনের শেষ অধ্যায়ের দিনপঞ্চি। এটি ৭ নভেম্বর ১৯৬৬ থেকে ৭ আক্টোবর ১৯৬৭, বলিভিয়ান বাহিনীর হাতে আহত অবস্থায় বন্দি হওয়ার আগ পর্যন্ত একটি গেরিলা ইউনিটের প্রতিদিনের ঘটনা  লেখা একটি ডাইরি। ডাইরিটি একটি ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে। সেই ডাইরি পড়তে পড়তেই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম চের প্রতি। চে গুয়েভরা-ছাত্রজীবনে স্বপ্ন ছিল একজন বিখ্যাত গবেষক হবেন। তবে ডাক্তারি পড়াকালীন যৌবনের দিনগুলোতে অন্য আরেক জীবন, অন্য  আরেক জগতের হাতছানি বারবার তাকে ঘরছাড়া করত।

দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চল, ইন্ডিয়ান বসতি, তামার খনি, কুষ্ঠ কলোনির রোগাক্রান্ত দারিদ্রপীড়িত নির্যাতিত মানুষগুলোর কাছে। সঙ্গী হতেন বছর কয়েকের বড় আলবার্ত গ্রনাডোস। নিত্যসঙ্গী হাঁপানি রোগ নিয়েই চে চষে বেড়িয়েছেন ল্যাাটিন আমেরিকার পাহাড় অরণ্যে, লোকালয়ে। খুঁজে ফিরেছেন আমেরিকার প্রাচীন ইতিহাস, প্রচীন ইনকা ও মায়া সভ্যতার পিঠস্থান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ভ্রমণ পথে স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে প্রচুর সময় কাটাতেন। ছাত্রজীবনে কোনো সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও বাস্তব পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা ও বিস্তর পড়াশোনার মধ্য দিয়ে তার একটি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। তরুণ চিকিৎসক চে গুয়েভারার জীবনযাত্রা আমূল পাল্টে যায় জুলাই ১৯৫৫, মেক্সিকো সিটিতে যখন তার সঙ্গে কিউবার মনকাড়া সেনা গ্যরিসন হামলার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে দেখা হয়। সে সময়ে দু’জনেই অনেকটা পোড় খাওয়া বিপ্লবী।


চে ম্যক্সিকো সিটিতে বিচিত্র পেশায় জড়িয়ে ছিলেন। পকেটের অবশিষ্ট টাকা দিয়ে একটা ক্যামেরা কিনেছিলেন, সেটি দিয়ে পার্কের মধ্যে ছবি তোলা ব্যবসা শুরু করেন। একজন মেক্সিকান স্টুডিও মালিকের ল্যাবরেটরিতে এইসব ছবি প্রিন্ট করাতেন। পথে পথে ঘুরে ছবি তোলার খরিদ্দার জোগাড় করতেন। চে স্থানীয় একটি প্রকাশনা সংস্থার বই ফেরিও করেছেন। নতুন নতুন বই দেখা ও কেনার সুযোগ মিলবে বলে এক সময় একটি বই প্রদর্শীতে রাতের পাহারাদারের কাজও করেন। এ সময়ে তিনি মেক্সিকোর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে লেকচার দিতেন। কার্ডিওলজি ইনস্টিটিউটে বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ করেন। একটি ফরাসি হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে বিড়ালের ওপর গবেষণা কাজ পরিচালনা করেন। মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় হাসপাতালের চাকরিটা চে গুয়েভারার জীবনে কিছুটা ভারসাম্য এনে দেয়। মেক্সিকোর আবহাওয়া, মেক্সিকোর জীবন ও সংস্কৃতি চের জন্য আনন্দ ও সুখের হাওয়া বইয়ে দেয়। এই মেক্সিকো সিটিতেই হিলদা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে চে গুয়েভারার বিয়ে হয় এবং সন্তানের জনক হন তিনি। আরও একটি কারণে মেক্সিকো সিটি চে গুয়েভারার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার জীবনের ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের ঘটনাটি ঘটে এখানেই। এই শহরে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে চের সাক্ষাৎ সেই ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের ঘটনা।

একজন অগ্রসর মানুষ হিসেবে আর্নেস্টো চে গুয়েভার মানবিক জ্ঞান মার্কসবাদকে গ্রহণ করেছিলেন, বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসেবে নয়। এজন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধার আড়ালে চে-র মধ্যে লুকিয়ে আছে এক সংবেদনশীল মানুষ। এক যুদ্ধ শেষে তিনি ছুটে গেছেন আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে। মাত্র এগারো বছর বয়সে এক বিচিত্র কারণে কিউবার প্রতি অনুরক্ত চে ছিলেন দাবা খেলার দারুণ ভক্ত। তিনি প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসতেন। কবিতা ভালোবাসতেন। নিজেও কবিতা লিখতেন। পাবলো নেরুদার বিদায় কবিতাটি ছিল তার প্রিয়। বিপ্লবী এবং কবি  এক হয়ে মিশেছে তার মধ্যে। আজীবন সত্য, জ্ঞান এবং বিপ্লবের সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ চে তার জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানালোচনা অব্যাহত রাখেন। এই হলো চে গুয়েভারা। চে-র তুলনা চে নিজেই।

বলিভিয়ার বিপ্লবী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে যাওয়ার আগে এক বিদায় পত্রে চে তার বাবা মা কে লেখেন .... ‘আমি আমার আচার আচরণে খুবই একরোখা, তাই তোমরা কখনো আমাকে বুঝতে পারোনি। আমাকে বুঝতে পারা সহজ ছিল না; কিন্তু আজ তোমরা আমাকে বিশ্বাস কর।’ এরকম একরোখা এবং অকপট একজন মানুষ এখন পর্যন্ত তরুণ সমাজে বিপ্লবী চেতনার আইকন। চে গুয়েভারার জন্মদিনে তার প্রতি বিপ্লবী সালাম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //