লালিত্যময় প্রবন্ধগ্রন্থ

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে প্রবন্ধ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা। তবে বাংলাদেশি প্রকাশনার গতিধারা জরিপ করলে এমনটা বিবেচনা করা যায় না। কারণ, লেখকগণ এ দেশে যে হারে কবিতা, গল্প ও উপন্যাস প্রকাশ করেন, প্রবন্ধগ্রন্থ রচিত ও প্রকাশিত হয় তার চেয়ে কম। এর কারণ কি? প্রবন্ধের কি পাঠক নেই? আমার কাছে তেমন মনে হয় না। তথ্যনির্ভর ও মানসম্পন্ন প্রবন্ধগ্রন্থের পাঠক আছে। তবে সম্প্রতি অধিকাংশ প্রবন্ধগ্রন্থ রচয়িতা পাঠকের সামনে তথ্যনির্ভর ও হৃদয়গ্রাহী মানের প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করতে পারছেন না। তারপরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে যে কিছুসংখ্যক ভাল মানের প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হচ্ছে না এমন নয়। 

এ বছর বইমেলা করোনার কারণে জমে না উঠলেও দুই হাজার ৬৪০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যবারের মত মানসম্পন্ন বই এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় প্রকাশিত বইয়ের পৃথক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, বাংলা একাডেমির তৈরিকৃত নতুন বইয়ের পরিসংখ্যানে ঢাকা ছাড়া অন্য বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রকাশিত বইগুলোর সংখ্যা যোগ করা হয় না। তবে এ সত্য স্বীকার্য, রাজধানী ছাড়াও অন্যান্য বিভাগ ও জেলা শহর থেকেও অনেক নতুন বই প্রকাশিত হয়। ওইসব বইগুলোর মধ্যেও অনেক মানসম্পন্ন বই থাকে। ওপরে উল্লিখিত খুলনা থেকে প্রকাশিত আলোচ্য বই দুটি এমন মানসম্পন্ন প্রবন্ধগ্রন্থের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিষয়বস্তু হিসেবে এ বইদুটি শরীরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি নির্বাচনী বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে। লেখক দুটি গ্রন্থে যেসব প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তার সবই প্রকাশিত। প্রবন্ধগুলো বিষয়বস্তুর সীমারেখা অতিক্রম করেনি। ‘প্রসঙ্গ নির্বাচন কমিশন’ গ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত সবগুলো প্রবন্ধই নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত। একইভাবে অন্য বইটির সবগুলো প্রবন্ধও বাংলাদেশের নির্বাচনকেন্দ্রিক। এ সকল বিষয়ের ওপর এত বেশি প্রবন্ধ অন্য কোনো বাংলাদেশি লেখক লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। লেখক নির্বাচন বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ। দেশে ও বিদেশে তার এ বিষয়ক উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণামূলক প্রকাশনা রয়েছে। এ কারণে উপস্থাপিত বিষয়ে মুন্সিয়ানা থাকায় লেখকের পক্ষে এমন জটিল বিষয় নিয়ে সহজ করে লেখা সম্ভব হয়েছে। এ জন্য সব শ্রেণির পাঠকের কাছে এ গ্রন্থদুটি উপভোগ্য হবে মনে করা যায়। কঠিন বিষয়কে সহজ করে উপস্থাপনের কলাকৌশল যে লেখক ভালই রপ্ত করেছেন তা আলোচ্য গ্রন্থ দুটি পড়লে সহজেই বোঝা যায়। 

ড. আখতার আলোচ্য গ্রন্থদুটিতে নানা রকম নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি সাহিত্যের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত ভাষার এক মেলবন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার লেখার উপস্থাপনা ভঙ্গিমা প্রাঞ্জল, বিশ্লেষণ গবেষণাধর্মী ও তথ্যনির্ভর, পরিসংখ্যানের ব্যবহার সহজবোধ্য এবং বর্ণনা সংক্ষিপ্ত ও সুখপাঠ্য। প্রবন্ধের বইগুলোতে কিছুসংখ্যক প্রবন্ধের শেষ পৃষ্ঠায় অনেকক্ষেত্রে অনেকটা অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। লেখক এ ক্ষেত্রে ওই স্পেস ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত ছবি ব্যবহারের নতুনত্ব যোগ করেছেন। এতে পাঠক প্রবন্ধটি পাঠ করার পর কিছুটা বিনোদিত হয়ে নিরুদ্বিগ্ন ও সতেজ মন নিয়ে পরবর্তী প্রবন্ধের পাঠ শুরু করতে পারবেন। এ জন্য লেখককে বাড়তি পরিশ্রম করে ছবি নির্বাচন ও ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে সবচেয়ে ভালো হয়েছে বইয়ের গেটআপ, মেকআপ এবং এর বক্তব্যধর্মী প্রচ্ছদ। দৃষ্টিনন্দন এ বইদুটো দেখলেই যে কোনো পাঠকের হাতে নিতে ইচ্ছে করবে। ‘প্রসঙ্গ নির্বাচন কমিশন’ গ্রন্থটির প্রচ্ছদে চমৎকারভাবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্টতা ও দুর্বলতা এবং ‘বাংলাদেশি নির্বাচন’ শীর্ষক গ্রন্থটিতে নির্বাচনের লাশ হয়ে যাওয়ার বিমূর্ত শৈল্পিক উপস্থাপনার জন্য প্রচ্ছদশিল্পী মইনুল আলমকে বিশেষ কৃতিত্ব দেয়া যায়।

সবশেষে বলা যায়, খুলনার অধ্যয়ন পরিষদ জাতীয় সঙ্কটবিজড়িত ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে গণতন্ত্রের এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় সময়োপযোগী এ গ্রন্থদুটি প্রকাশ করে অবশ্যই দেশপ্রেমিক সুধীমহলের প্রশংসা পাবে। সার্বিক পর্যালোচনা ও নিরীক্ষার পর নির্দিধায় বলা যায়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার আলোচ্য গ্রন্থদুটি রচনার মাধ্যমে প্রবন্ধ সাহিত্যকে পাঠকগ্রাহী ও অধিকতর লালিত্যময় চরিত্র প্রদানে সক্ষম হয়েছেন। আমি নতুন বৈশিষ্ট নিয়ে প্রকাশিত ব্যতিক্রমী চরিত্রের এ গ্রন্থদুটির সাফল্য কামনা করি। আশা করি দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রপ্রিয় লেখক, গবেষক ও পাঠকগণ এ দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থদুটিকে সমাদরের সঙ্গে তাদের পড়ার টেবিলে জায়গা দিবেন।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //