জীবনানন্দ পাঠ

জীবনানন্দের নীড় ও নিখিল, কাল ও ভূগোল অথবা কাব্যের ভাবসম্পদ

কালকে গালি দিও না, কারণ কালই হচ্ছে আল্লাহ
-আল হাদিস

প্রাক কথন ও প্রস্তাবনা 
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) তার কবিতার ‘অনুভূতি কাঠামোয়’ ‘ভেবেছেন’ সময় ও প্রকৃতির সত্তা নিয়ে, ইতিহাসের স্বভাব ও মানুষী পরিমণ্ডলের মানে নিয়ে, প্রেম ও জ্ঞান নিয়ে, চিন্তা করেছেন বিবিধ অস্তিত্বের স্বরূপ নিয়ে, এবং এই অর্থে, তিনি বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে এক বিরল ‘কাব্যপ্রতিভা’। কাব্যিক দাবির প্রতি সমঝোতা না করেই অনেক কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন দার্শনিক অনুসন্ধানের নিগূঢ় বয়ান। নিরবচ্ছিন্ন অনুভূতি প্রকাশের ছদ্মাবরণে পরিবেশিত হয়েছে বড় ভাব ও চিন্তা। আমার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, কলম দিয়ে দাগিয়ে দাগিয়ে খুব নিবিড় মনোযোগে জীবনানন্দ খুব কম মানুষই পড়েছে। পড়লেও অধিকাংশ কবিতাই রয়েছে অপঠিত। কবিতা পাঠে সহজ আনন্দের অভ্যাসে শুধু পঠিত হয় তার তথাকথিত প্রধান কবিতাগুলো। মনে রাখতে হবে, বড় কবির আপাত তুচ্ছ কবিতাও মহত্তের সম্ভাবনাক্রান্ত। কবিতার যে প্রচলিত ভাষা ও ভাবে আমাদের অভ্যস্ততা তাকে জীবনবাবু প্রশ্নবোধক করে তোলেন। স্বল্প ও ফরমায়েশি পাঠের ফলাফল হিসেবে উপস্থাপিত ও উপলব্ধ হয় জীবনানন্দের খণ্ডাংশ। আমাদের সমালোচক মহলে যেহেতু এক শব্দে, বা এক শব্দবন্ধে দাশকে প্রকাশ করার ইচ্ছা কাজ করে তাই প্রায়শই জীবনানন্দের অনেকাংশই চাপা পড়ে যায়, চাপা পড়ে থাকে। আমি জীবনানন্দকে বলি ‘মহাপ্রাণ’ এর কবি, সত্তাসন্ধানী কবিও। কেউ বলেন পরাবাস্তব, বা মায়াবাস্তবের কবি। কেউ বলেন, অগাধ জীবনের কবি, নক্ষত্রের কবি, মহাগোধূলির কবি, সময় চেতনা বা রাত্রি চেতনার কবি ইত্যাদি। নির্জনতার কবি, প্রকৃতির কবি এসব তো প্রায় প্রত্যাখ্যাত এপিথেট। যদিও মাত্রাভেদে সবগুলোতেই সত্যের উপাংশ আছে। জীবনানন্দের কাব্যে বৈপরীত্যের সম্মিলন ও চাপ আছে। কোনো মঞ্জিলেই জীবনানন্দ দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেন না, তা হোক বিশ্বাস বা অবিশ্বাস, ইতি বা নেতি, অস্তি বা নাস্তি, আশা বা নিরাশা, জীবন বা মৃত্যু। একবিংশ শতাব্দীর তত্ত্বজ্ঞানী পাঠক নিশ্চিত বুঝে যান জীবনানন্দের কবিতা ‘চূড়ান্ততাশূন্য মুক্তপাঠের নিদর্শন’। 

জীবনানন্দের একটি সংক্ষিপ্ত ইমেজ অন্য কবিতায় ফিরে আসে বিস্তৃত রূপে। একটি অপরিস্ফুট ভাব আরেক কবিতায় পায় প্রস্ফুটিত রূপ। এক পঙ্ক্তির ব্যাখ্যা করা যায় আরেক পঙ্ক্তি দিয়ে। জীবনানন্দ কাব্যে পুনরাবৃত্তিও সর্বাংশে অর্থহীন নয়। জীবনানন্দের প্রবন্ধের আলোকে তার কবিতা পড়লে আরেক নতুন তাৎপর্যে তিনি ধরা দেন। তার প্রবন্ধে কবিতার আত্মা, শরীর ও স্বভাব নিয়ে যে অতুলনীয় আলোকবিভা আছে, তা তার ভাবনার অন্তঃস্থল ও কবিতার অন্তরাত্মার সন্ধান পেতে আমাদের সাহায্য করে। আশ্চর্য হলো, তার প্রবন্ধ থেকে বিচ্ছুরিত অন্তদৃষ্টি তার কবিতার আপাত অস্পষ্টতাকে যতটা ফর্সা করে ততটা আর কিছুতে করে না। যা হোক, তার কবিতায় ডিপ হিস্টোরি ও সময়ের সত্তা নিয়ে যে ভাবনা আছে, ও জীব-জড়-মানুষ-নক্ষত্রালোক নিয়ে যে মহা ইতিহাসের বয়ান আছে তা-ও আলোচিত হয়নি বললেই চলে। কীভাবে সহস্র বছরের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রজ্ঞা অনুভবের কাব্যভাষায় জীবন্ত হয়ে ওঠে জীবনান্দে, তাও যে দেখিয়ে দেওয়ার দায় রয়ে গেছে। আসলে তার বহু একক কবিতা নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। জীবন বাবু কবি হলেও তার কাব্যের রয়েছে বিপুল দার্শনিক শক্তি, ও সম্ভাবনা। জীবনানন্দের কবিতায় স্বদেশ কল্পনা, দেশ, দেশহীনতা, রাষ্ট্র, জাতি-মহাজাতি বা সভ্যতা ভাবনাও বিশিষ্ট যা নিয়েও আলোকপ্রদায়ী লেখার অপ্রতুলতা তীব্র। জীবনানন্দে অতৃপ্ত-অপুরিত যৌনতার চাপ আছে, আছে অবচেতনের বিস্ময়কর আলো-আঁধারি। অবচেতনের প্রত্নকাঠামো ভাষায় ফলিয়ে তোলার প্রয়াসের উপস্থিতি থাকায় মনো বিশ্লেষণী পাঠেরও এক অপূর্ব আধার জীবনানন্দের কাব্য। জীবনানন্দের কাব্যে সবিশেষ আর নির্বিশেষের ক্রীড়া আর কর্তাবোধ ও কর্তাসত্তার পর্বান্তর তার দার্শনিক ব্যঞ্জনাকে আরও গর্ভবান করে। বিশ্বকবিতা ও জ্ঞানের অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনিন্দ্য মুহূর্তের এক কেলাসিত রূপ জীবনানন্দের ভেতরে আমরা লক্ষ্য করি। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে বলেছেন- ‘the breath and finer spirit of all knowledge’ । অর্থাৎ কবিতা সব জ্ঞানের নির্যাসকে ব্যবহার করে; কবিতা হচ্ছে- ‘the impassioned expression which is in the countenance of all Science.’ মানে, কবিতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বহিরঙ্গকে আবেগে অন্তর্দীপ্ত করে, অনুভবের কাঠামোয় তার সত্যতাকে যাচাই করে নেয়, নিতে চায় বা নতুন ‘বোধ’ বা ‘বোধি’রও জন্ম দেয়। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে এই কথাগুলো আরও সত্য। ইতিহাস ও সমাজদর্শন, মনস্ততত্ব, অস্তিত্ববাদ, শিল্পতত্ব, আধুনিক কবিতার ইতিহাস, ফেনোমেনোলজি ও কনটিনেনটাল ফিলসোফির অভিনিবিষ্ট পাঠের অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই শুধু জীবনানন্দের গভীর খনন সম্ভব বলে মনে হয়। বোঝা দরকার, অনুভূতিরও চিন্তাকাঠামো আছে। তাই কবিতাকে অনেক সময়ই চিন্তার ইতিহাসের সাপেক্ষেও উপলব্ধি করতে হয়। জীবনানন্দের কবিতার ভেতরে, তার আপাত অন্তর্মুখী ও অন্তরালপ্রেমী ব্যক্তিত্বের বিপরীতে, অনবরত বলে যাওয়ার একটা ব্যাপার আছে; নিরবচ্ছিন্ন ও বিপুল ভাবপ্রবাহের চাপ সামাল দিতে তাকে প্রায়শই দুই বা ততধিক শব্দ সহযোগে তৈরি করতে হয়েছিল বেশকিছু নতুন ফ্রেজ বা শব্দবন্ধ (যেমন, মানসসাধনশীত, দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার, আত্ম সমাহিতিকূট ইত্যাদি)। তার ভাবের অচিনপাখিকে ভাষার খাঁচায় নিবেদিত করতে তাকে চষে বেড়াতে হয়েছে ভাষার আদিগন্ত, গ্রাম-নগর, সংস্কৃত ও সেমেটিক শব্দ, মৌখিক ও লেখ্যরূপসহ নানা যুগ্মতা। 

সীমিত সাধ্যেও আমরা এ প্রবন্ধে জীবনানন্দের ভাবজগতের মৌল অনুষঙ্গগুলো সংক্ষেপে দাগিয়ে রাখতে চাই। জীবনানন্দের বহু বিচ্ছিন্ন পঙ্ক্তিতে, কখনো বা পঙ্ক্তি সমবায়ে ও প্রবন্ধের উচ্চারণের ভেতরে দার্শনিক চিন্তার যে উদ্ভাসন আছে সেগুলোর কয়েকটিকে সংক্ষিপ্ত পরিসরে নজরে আনা এ রচনার উপজীব্য। 

স্বনির্ভর অস্তিত্বের ইঙ্গিত, সত্তার স্বরূপ : ‘স্বপ্নের ভেতরে যাও; বস্তুর ভেতরে’
জীবনানন্দ দাশ মানুষ জীবন, জগৎ, সময় ও সত্তাকে এক বিস্তৃতপ্রাণ পরিসরের পরিপ্রেক্ষিতে দেখেন যেখানে একজনের অস্তিত্ব সচারাচার আরেকজনের সাপেক্ষে নির্ণিত হয় না। প্রত্যেক অস্তিত্বের ‘নিজত্ব’ আছে আর এই নিজত্ব সহযোগেই সকলে অবস্থান করে, গতিমান হয় বা স্থিত থাকে মহাবিশ্বের বিপুল প্রাণের প্রবাহে। জীবনানন্দের কবিতা নয় শুধু তার প্রবন্ধের ভেতরেও এই ভাবের ইশারা আছে। যেমন তিনি বলছেন, ‘প্রকৃতি, সমাজ ও সময়-অনুধ্যান কেউ কাউকে প্রায় নির্বিশেষে ছাড়িয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে না। অন্তত- মানবসমাজের ঘনঘটায় প্রকৃতি ও সময়- ভাবনা দূর দুর্নীরীক্ষ হয়ে মিলিয়ে যাবার মতো নয়’ (কবিতার আত্মা ও শরীর)। 

মানুষই সব কিছুর মানদণ্ড ও পর্যবেক্ষক, মানুষই মহাবিশ্বের কেন্দ্র- ইউরোপীয় রেনেসাঁর এই প্রতিপাদ্য জীবনানন্দ তার কাব্যে ও ভাবনায় প্রায়শই সমস্যায়িত করেন। স্পেনীয় শিল্প তাত্ত্বিক হোসে আরতেগা গাসেত আধুনিক শিল্পে মানব বিষয়ের সংকোচনের যে কথা বলেছিলেন এটি সেটা নয়। মানুষ জ্ঞাতা হিসেবে জ্ঞেয় বস্তুকে জানতে যে দূরত্বের শর্তের অধীন হয়, জীবনানন্দ তার প্রধান কিছু কবিতায় এই দূরত্বকে শূন্যে এনে বস্তুর নিজস্বরূপকে, যেন বা বস্তুকেই বলতে দেওয়ার দিব্যভাষার সম্ভাবনা রচনা করতে চান। জীবনানন্দ অনেক বিমূর্ততাকেও প্রাণসত্তায় সজীব করেন, বোধির আলোয় মূর্ত দেখান। জীবনানন্দীয় এই ভাবের বিস্তার ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের পূর্বাপরেই আছে। ‘সোনালি রোদ’ কথা কয়ে উঠে, ‘মহাদেশগুলো’ অবলোকনকামী ও বাঙ্ময় হয়, ‘নিস্তব্ধতা’ এসে জীবনের গাঢ় বেদনা নিয়ে বলে, ‘বোধ’ এসে জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়। এ কিন্তু ‘পারসোনিফিকেশন’ বা ‘প্যাথেটিক ফ্যালাসি’ নামি কাব্যকৌশল নয়, এ সত্তার স্বীকৃতি ও অনুভব। চারদিকে ‘প্রসন্ন প্রাণের স্রোত’। নদীর গোলাপি ঢেউ কথা বলে, দাঁড়কাক একা একা সারারাত জাগে। বস্তু, ভাব বা অন্য কোনো অস্তিত্বকে তাদের ‘স্বভাষা’য় তাদের প্রাণপ্রকাশের আকুতি জীবনানন্দের থাকে; কিন্তু যখন ‘বস্তুভাষা’কে মানব ভাষায় ও মানুষের অনুভবজাড়িত করে প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না তখন ভাষার ভেতরে প্রকট হয়ে ওঠে বেদনা ও বিষাদ। সত্তার স্বরূপ অনুসন্ধান প্রচেষ্টায় বস্তু ও মানুষের ভাষা ও অনুভবের এই দ্বন্দ্বজ্ঞান জীবনানন্দ কাব্যকে বহুমাত্রিক অর্থ ও ব্যঞ্জনা দেয়।

জীবনানন্দ যখন বলেন ‘সময় কোথাও/পৃথিবীর মানুষের প্রয়োজন জেনে বিরচিত নয়’ তখন সময়কে তিনি মানবসাপেক্ষ অস্তিত্ব হিসেবে ভাবেন না। সময়কে পরনির্ভর করে বুঝতে চান না তিনি। মানব সাপেক্ষতাকে প্রশ্ন করে সময়ের স্বয়ম্ভু অস্তিত্বকে তিনি চিহ্নিত করেন। ‘সময় নিজেই তবু সবচেয়ে গভীর বিপ্লবী’ (যাত্রী)। ‘তিমির সূর্যে’ কবিতায় কবি পাঠককে, ও নিজেকেও আহ্বান জানান, ‘স্বপ্নের ভেতরে যাও; বস্তুর ভেতরে’। আমাদের দেহের সঙ্গে সময়ের যে-সম্বন্ধের কথা বাউল দর্শনে আছে সেটা থেকে এক ভিন্ন বলয়ে জীবনানন্দের উপস্থিতি কি আমরা টের পাইনা? মনুষ্য ও পৃথিবী কেন্দ্রিক চিন্তা মানুষের এক অনতিক্রম্য ব্যাধি। নক্ষত্র আকাশ রাত্রি এগুলো শুধু পৃথিবীর নয়। জীবনানন্দ ঘোষণা করেন, ‘আকাশের প্রতিটি নক্ষত্র নিজ মুখ চেনাবার/মতোন একান্ত ব্যাপ্ত আকাশকে পেয়ে গেছে আজ’। মকর সংক্রান্তির রাতও শুধু পৃথিবীর নয়, তবু তাকে, কবির কাছে, পৃথিবীর মনে হয়। যা পৃথিবীর নয়, তবুও তাকে একান্ত পৃথিবীরই মনে করার চোরাটান বা এমবিভ্যালেন্স সম্পর্কে কবি সচেতন। এইভাবে জীবনানন্দ মানবকেন্দ্রিকতা ও পৃথিবীকেন্দ্রিকতাকে ছাপিয়ে প্রতিটি সত্তার স্বনির্ভরঅস্তিত্বের ইশারা দেন, যারা আবার এক মহাজাগতিক সূত্রে একে অপরের সঙ্গে লগ্নও বটে। এই উপলব্ধিকে জীবনানন্দের আধ্যাত্মিকতাও বলা যেতে পারে। 

জীবনানন্দের সভ্যতা, দেশ ও জাতি বিচার
‘ইতিহাস কেবলি আয়ত্ত হয়ে আলো পেতে চায়’ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়া ও ঔপনিবেশিক শোষণের পটভূমি জীবনানন্দ কাব্যের সভ্যতা ও শতাব্দী বিচারে অন্তঃসলিলা প্রবাহ হয়ে থাকে। ম্যাথু আর্নল্ড কবিতাকে বলেছিলেন- Criticism of Life বা জীবনের পর্যালোচনা। Mathew Arnold ভিকটোরীয় ইংল্যান্ডের মানুষের অসহায়ত্ত, অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা, আনন্দ ও আলোহীন জগতকে তার বিখ্যাত ‘ডোভার বিচ’ কবিতায় হাজির করেছেন এভাবে-

‘... the world which seems
To lie before us like a land of dreams,
Hath really neither joy, nor love, nor light,
Nor certitude, nor peace, nor help for pain;
And we are here as on a darkling plain
Swept with confused alarms of struggle and fight,
Where ignorant armies clash by night.’ (Dover Beach)

আর্নল্ড উপলব্ধি করেন, চারদিককার এই পরিব্যপ্ত অন্ধকারে এক মানুষের আরেক মানুষ বা মানুষীর প্রতি আস্থা ও ভালোবাসাই একমাত্র মানবিক বিকল্প: ‘Ah, love, let us be true/To one another’. নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও কল্পনা প্রতিভায় জারিত করে জীবনের এই পর্যালোচনা প্রত্যেক কবিকেই হাজির করতে হয়। কবিতায় ‘ইহজগতকে নতুন করে পরিকল্পিত হওয়ার সুযোগ’ দেন কবি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে, ইউরোপীয় কবিতা ও ভাবনার নিবিষ্ট পাঠক হিসেবে ইউরোপীয় আধুনিকতার মর্ম ও শাস তিনি আত্মস্থ করেছিলেন, ব্যবহারও করেছেন, এবং তার গভীর অন্তর্দৃষ্টির কারণে ওই আধুনিকতার খোলস, আবার, ছাড়িয়েও যেতে পেরেছেন। জীবনানন্দ একদিকে যেমন মানবকেন্দ্রিকতাকে প্রশ্নবোধক করেন, অন্যদিকে যা-কিছু মানবসম্পৃক্ত তাকেও তিনি তার পর্যবেক্ষণের অধীন করেন। জীবনানন্দের প্রসারিত হৃদয় আর মননে ধরা পড়ে ব্যক্তির নিঃসহয়তা, ‘নিরাশ্রয় মানুষের আত্মার ধিক্কার’ কিংবা আশা-নিরাশার দোলাচল, ব্যক্তি ও সমষ্টির সম্পর্ক, বিগত ও পতিত সভ্যতার ধুলো আর ছাই, নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন ও সাধ। জীবনানন্দ তার নিজ শতাব্ধীর নিগূঢ় ব্যবচ্ছেদ করেছেন। কবিতার মর্মে যে ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ থাকার কথা তিনি বলেছেন তা স্বকালের হৃদয়ের, সমকালের স্বভাব সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিকেও বোঝায়। 

Civilization and its discomtents (1929)The future of an illusion (1927), Why War (১৯৩২) রচনাগুলোতে সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই যে মর্মপীড়া তার মনস্তাত্তিক কারণগুলো আলোচনা করেছেন। বস্তুজগতের সংকটের উৎস হিসেবে মানুষের মনের গহণতলে তিনি নিবিড় অনুসন্ধান চালিয়েছেন। আমাদের দুর্দশার সঙ্গে আমরা যে সভ্যতা নির্মাণ করেছি তার সংযোগ আছে। সভ্যতার অগ্রগতির স্মারকচিহ্ন হিসেবে যা যা পরিগণিত তাতেই আছে সভ্যতার পুঁজও। ফ্রয়েড সভ্যতা বলতে বোঝান মানুষের সম্মিলিত অর্জন ও সেইসব রীতিনীতিকে যেগুলো মানুষকে বিরুদ্ধ প্রকৃতির হাত থেকে রক্ষা করে ও মানবজাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। মানুষের মধ্যে সহিংসতার যে আদিম প্রবৃত্তি আছে সভ্যতার রীতিনীতি ও আইন ব্যবস্থা তাকে মানবিকতার প্রলেপ লাগিয়ে রাখে নিয়ন্ত্রণ করে। এই instinctual aggressiveness ফিরে আসে সময় সুযোগ পেলেই। যুদ্ধের জন্যও রীতিনীতি তৈরি করে যুদ্ধের যে মানবিকায়ন করা হয়েছে তাও মানুষের মধ্যে এই প্রবৃত্তির উপস্থিতিরই স্মারক। ধর্ম কিংবা মতাদর্শের নামেও সে তার এই প্রবৃত্তিকে আড়াল করে, আবার একে ন্যায্যও প্রমাণ করতে চায়। ফ্রয়েড জানান, মানুষের অধিকারবোধ থেকেই জন্ম নেয় হিংসার (violence)। নিজের অধিকারের সুরক্ষার জন্য সে অপরের অধিকার কেড়ে নেয়, কিংবা হিংসা বা আরও নানারকম কারিগরি ব্যবহার করে নিজের ইডের (Id) পরিতৃপ্তি (pleasure principle) সাধনের জন্য সে অপরকে বশ করে, বা করতে চায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, নাজি উত্থান, হলোকাস্টের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে ফ্রয়েড মানব প্রকৃতির এক বিপুল নৈরাশ্যজনক ব্যাখ্যা হাজির করেন। মানবজাতির বিধ্বংসী প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করে আইনস্টাইনের কাছে লেখা পত্রে ফ্রয়েডের দাবি, মানুষের আক্রমণাত্মক স্বভাব নিরসনের কোনো উপায় নেই। তবে, তার মতে কিছুটা আস্থা আমরা পেতে পারি ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তির বিপরীতে সৃজনশীল প্রবৃত্তির (Eros) সাহায্য নিয়ে। এ ব্যাপারে তিনি গুরুত্ব দিতে চান আবেগের বন্ধনকে ও বৌদ্ধিক সংস্কৃতির নির্মাণকে। তার মতে আবেগের বন্ধন দুই রকম- ১. যৌনসম্পর্কের উদ্দেশ্য ছাড়াই মানুষকে ভালোবাসতে পারা, ২. বৃহত্তর মানব সমাজের অভিন্ন পরিচয় বোধ। তবে ফ্রয়েড মনে করেন, ভালোবাসাটা ঘৃণার চেয়ে কঠিন, ভালোবাসার কথা বলা যতটা সহজ করাটা ততটা নয়। আর বৌদ্ধিক সংস্কৃতির বিকাশ মানুষের আক্রমণ ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেও তাকে তুষ্টি দিতে পারে কিছুটা। মানুষের আগ্রাসী মনোভাবকে ও যুদ্ধকে নির্মূল করা অসম্ভব, শুধু সাময়িকভাবে সেগুলোকে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করা যায়, বা ভিন্ন সৃজনশীল পথে চালিত করা যায়। ফ্রয়েড মানুষের সুখী অতীতে বিশ্বাস করেন না; এমন কি, প্রকৃতিই যখন মানুষের সকল চাহিদা পূরণ করত, ও মানুষের বৃহত্তর কোনো সাংস্কৃতিক দাবি যখন ছিল না তখনো এই প্রবৃত্তিগুলো মানুষের মধ্যে ছিল বলে তিনি অনুমান করেন। জীবনানন্দ ‘অনন্দা’ কবিতায় বলেন, মানব প্রাণের রহস্যময় গভীর গুহার থেকে /সিংহ, শকুন, শেয়াল, নেউল ডাকে’। মানুষের লোভ, লালসা ক্ষমতা পিপাসা, স্বার্থদ্বন্দ (conflict of Interest) অন্তহীন যা থেকে জন্ম হয় আধুনিক সমাজে নৈরাজ্য। ফয়েডের ‘সিভিলাইজেশন’ শব্দটিকে আধুনিক সমাজ বা ইতিহাস দিয়েও প্রতিস্থাপিত করে পড়া যায়। 

জীবনানন্দ ‘সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি’ লক্ষ্য করেছেন, দেখেছেন ‘বড় বড় নগরীর বুক ভরা ব্যথা’ (মিতভাষণ)। ‘অন্ধকারের স্তনের ভেতর, যোনির ভেতর ঢুকে’ তিনি বুঝে নিতে চাইলেন ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ’; তার উপলব্ধিতে চকিতে ধরা পরে ‘মানুষের সভ্যতার বয়ঃসন্ধি দোষ/হয়তো কাটেনি আজো’। যদিও ‘মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে; মানুষের মন/ জানে জীবনের মানে: সকলের ভালো করে জীবনযাপন’ তবুও তার অপরিসীম লালসা, ক্ষমতার পিপাসা, অপরের মুখকে ম্লান করে দিয়ে নিজের অহম পরিতৃপ্ত করে দেওয়ার সাধ, অবৈধ সঙ্গমেচ্ছা ‘ইতিহাসকে অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন’ করে রাখে, ফলে ‘সকলের ভালো করে জীবনযাপন’ ও ‘শুভ রাষ্ট্র’ হয়ে উঠে ক্রমাগত সুদূরের স্বপ্ন-

চারদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়ের অলীক প্রয়াণ। 
মন্বন্তর শেষ হলে পুনরায় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া পিয় সাধ নেই। 
কেবলি আসন থেকে বড়, নবতর
সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো। (এইসব দিনরাত্রি) 

‘শতাব্দীর অন্তহীন আগুনের ভেতরে দাঁড়িয়ে’ জীবনানন্দ এই প্রশ্ন করেন ‘এ-আগুন এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো?’ আধুনিক সভ্যতা ও ইতিহাসের মর্মভেদী পর্যালোচনা করেছেন ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘ইতিহাস যান’সহ অজস্র্র কবিতায়। জীবনানন্দের সভ্যতা বিচার ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের আত্মীয়; কিন্তু ফ্রয়েডের চূড়ান্ত হতাশাবাদ জীবনানন্দে নাই। ‘হয়তো-বা অন্ধকারই সৃষ্টির অন্তিম কথা’ বলেও তিনি উচ্চারণ করতে পারেন ‘হয়তো-বা মানুষের শেষ পরিণতি গ্লানি নয়- মানুষের অগ্রসর আছে’ (মহাত্মাগান্ধী)। প্রকৃতি, নারী ও ইতিহাসের প্রাণপ্রাচুর্যের ভেতরে জীবনানন্দ লক্ষ্য করেন হৃদয়ের শশ্রুষা। যেমনঃ ‘ ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি-রাশি দুঃখের খনি/ভেদ করে শোনা যায় শুশ্রুষার মতো শত শত/শত জলঝর্ণার ধ্বনি’ (হে হৃদয়) অথবা ‘তবুও নদির মানে স্নিগ্ধ শুশ্রুষার জল, সূর্য মানে আলো এখনো নারী মানে তুমি... (মিতভাষণ)’ কিংবা ‘মানুষের মরুভূমি একখানা নীল মেঘ চায়’ ( তুমি আলো)। রবীন্দ্রনাথের পরম আশাবাদ আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘নিখিল নাস্তি’ আর ‘বিনষ্টির চক্রবৃদ্ধি’তে বিশ্বাসের মতো জীবনানন্দের ভাবজগৎ এতটা সরল নয়। আবার, সমন্বয়ীও নয়। বরঞ্চ, মানুষের সভ্যতা ও ইতিহাস সাদা ও কালোর সরল বিন্যাসে নয়, কোনো এক আশ্চর্য ধূসরতায় অবস্থান করে। তবুও, কোনো এক আদর্শ মানবসম্পর্কের কল্পনা কি উঁকিঝুঁকি দিয়ে ওঠেনি জীবনানন্দে?

ফ্রয়েড দবি করেন, সভ্যতার প্রগতি ও সঞ্চিত জ্ঞান আমাদের বেদনা ও মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। কবি ও দ্রষ্টার শঙ্কায় জীবনানন্দও বার বার প্রশ্ন করেন মানুষের দুই হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞানকে। যা-কিছুই এই ক্রুর সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে, যা কিছুই নির্মাণ করেছে ‘সভ্যতার এই আত্মরতি’ তাকেই তিনি সন্দিঘ্ন দৃষ্টিতে দেখেছেন, উন্মোচন করতে চেয়েছেন তাদের ভেতরের গলদ। 

‘আমরা অজ্ঞান নই-প্রতিদিনই শিখি, জানি, নিঃশেষে প্রচার করি, তবু 
কেমন দূরপনেয় স্খলনের রক্তাক্তের বিয়োগের পৃথিবী পেয়েছি।’
এই বিংশ শতকে অনেক বিদ্যার উত্তরাধিকারী আমরা কিন্তু তবুও ‘কোথাও কোনো প্রাণ নেই বলে অর্থময়/জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে’। এ যুগের বিজ্ঞান কবির কাছে ‘সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু’। বিজ্ঞানের মুক্তির প্রতিশ্রুতি ‘শোকাবহ প্রতারণা’, মুষ্টিমেয় মানুষের শক্তিমদমত্ততা প্রকাশের হাতিয়ার যে বিজ্ঞান কবি তাকেও সমালোচনা করেন ‘বিজ্ঞান নিজেও এসে শোকাবহ প্রতারণা করেই ক্ষমতাশালী দেখ’ (মহাত্মা গান্ধী)। নিজের আত্মার কাছ থেকেও মানুষ যেন পালিয়ে বেড়ায়, লোকসমাগমহীন অন্ধকারে হৃদয়কে ধ্যানমগ্ন ও অন্তশীল করে নিজের বিহ্বল আত্মাকে মানুষ একান্তে ‘আর শুধোয় না... অতীতের শুধানো প্রশ্নের উত্তর চায় না আর। (১৯৪৫-৪৬)’। প্রাণ ও প্রেমবিহীন এই জ্ঞান, প্রশ্নহীন-নিঃসংশয় প্রথানুগত এ-জ্ঞান আঁধারেরই ফলন বাড়ায়। টিএস এলিয়ট (১৮৮৮-১৮৬৫) সাহেবও অবলোকন করেন-

All our knowledge brings us nearer to our ignorance.
Where is the wisdom we have lost in knowledge?
Where is the knowledge we have lost in information? (The Rock)

তথ্যের ভেতরে হারিয়েছে জ্ঞান, জ্ঞানের ভেতরে হারিয়েছে প্রজ্ঞা, আর আমাদের সকল জ্ঞান অজ্ঞতার অন্ধকার দুয়ারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের। জীবনানন্দ যখন বলেন ‘গতির ব্যসন থেকে প্রগতি অনেক স্থিরতর’ তখন তিনি প্রাজ্ঞতার স্থৈর্য চান, প্রগতির স্থির প্রশান্তি যাচনা করেন। আমাদের বহিরাশ্রয়ী মানব স্বভাবকে অন্তর্দীপ্ত হওয়ার কথা পাড়েন। ফরাসি গতিতাত্তিক পল ভিরিলো জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৈবত্বে আস্থাশীল সমাজ তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে গতির যুক্তিকে (logic of speed)। এই সভ্যতার গতি আছে, প্রীতি ও স্বর্গ নেই। এই Dromology বা গতির যুক্তিকে প্রশ্ন করে কবি সন্ধান করেন এক ‘অনাগত উত্তোরণলোক’ এর। 

যেখানে সভ্যতার ক্লান্তি ও গতির অস্থিরতা নেই, বুদ্ধির জবরদখল নেই, ঔপনিবেশিক থাবা নেই এমন প্রকৃতির নিবিড় ও সর্বেন্দ্রিয় 

তৃপ্তিকর এক দেশের কল্পনা হাজির করেছেন জীবনানন্দ ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে। এই কাব্যগ্রন্থে রাষ্ট্রের ধারণার অপর পিঠে দেশের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ক্রমাগত। ‘রূপসী বাংলা’ জীবনানন্দের নীড় যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি পরিভ্রমণ করেন নিখিল।

ভূগোলের কাল, কালের ভূগোল : ‘ইতিহাস অনন্ত গণনাকাল সৃষ্টি করে চলে’ 
সমস্ত মহৎ কবিরাই ইতিহাসের স্বরূপ নিয়ে ভেবেছেন, তবে জীবনানন্দের ইতিহাস ভাবনার গভীরতা ও বৈচিত্র্যকে প্রায় কোনো কবিই ছুঁতে পারেননি। এ সূত্রে, ইয়েটসের ও জীবনানন্দের ইতিহাস ভাবনাকে আমরা তুলনায় আনতে পারি। এলিয়টের সময় ও ইতিহাস ভাবনার কিছু নির্যাস জীবনানন্দও ব্যবহার করেছেন আরও প্রসারিত ও গভীরতর তাৎপর্যে। 

ডব্লিউ বি ইয়েটসের ‘লেডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ এবং ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ কবিতাদ্বয়ে ইয়েটসের ইতিহাস কল্পনা বিধৃত আছে। প্রথম কবিতাটি ইতিহাসের পৌরানিক যুগের শেষে নতুন গ্রিক সভ্যতার সূচনার ইঙ্গিতবাহী। দ্বিতীয় কবিতাটি আধুনিক খ্রিস্টীয় ইতিহাস শেষে ঘোষণা করে ইতিহাসের অনাগত দানবীয় পর্যায়ের আগমন। 

ইয়েটসের কল্পনায় দেখা যায়, প্রতি দুই হাজার বছর পর পর দৈবিক ও মানবিকের মিলনে ইতিহাসের রেডিকাল পরিবর্তন সূচিত হয়। ‘লেডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ কবিতায় অপূর্ব রূপসী মানবী লেডার স্নানরত দেহ দেখে দেবরাজ জিউস কামার্ত হয়ে রাজহাঁসের রূপ ধরে মর্তে এসে মিলিত হয় লেডার সঙ্গে। সোয়ানরূপী জিউসের বিপুল পাখনার নিচে কম্পিত হতে থাকে লেডার দেহ। সোয়ানের ছন্দায়িত শরীর ও উষ্ণতা পিষ্ট ও তাপিত করতে থাকে লেডার বক্ষ ও ঊরু। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ব্যর্থ হয় লেডা। এক অত্যাশ্চর্য শিল্পশোভন মিলনদৃশ্য অঙ্কিত আছে এই কবিতায়। লেডার সঙ্গে জিউসের সহিংস সহবাসের ফলে হেলেন ও ক্লাইটেমনেস্ট্রার জন্মের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় এথেনীয় সভ্যতার; কিন্তু প্যারিসের সঙ্গে হেলেনের পলায়নে ধ্বংস হয় ট্রয়নগরী, আর ক্লাইটেমেনেস্ট্রার হাতে মৃত্যু হয় তার স্বামী আগামেমননের। যা হোক কবিতাটিতে, মিলন শেষে ক্লান্ত জিউসের উদাস চঞ্চু লেডার শরীর ছেড়ে দেওয়ার পর কবি প্রশ্ন করেন লেডা পেল জিউসের শরীরের শক্তি ও সহিংসতা; কিন্তু পেল কি তার জ্ঞান? (Did she put on his knowledge with his power...)। স্বর্গীয় জ্ঞানের এই অভাব ইতিহাসে আনে বিপর্যয়। জীবনানন্দের কাছেও জ্ঞান ও প্রেমের মিলনই ইতিহাসের অন্ধকারে সেরা শরণঃ

অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালোঃ

যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো। 

জ্ঞান, শারীরিক শক্তি বাপ্রযুক্তির সক্ষমতার সঙ্গে হ্দয় ও প্রাণের বিচ্ছেদের কারণে আধুনিক সভ্যতা ও ইতিহাসে যে-বিপর্যয় নেমে আসে তা নিয়ে জীবনানন্দও নিঃসংশয়। 

স্বর্গীয় হস্তক্ষেপে মাতা মেরির গর্ভে জন্ম নেয় জেসাস ক্রাইস্ট। ক্রাইস্টের অলৌকিক জন্ম নতুন ‘বিশ্ব ইতিহাস’ রচনা করে কারণ ইয়েটস সত্যিই মনে করেন, ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মানবের সঙ্গে দৈবিক শক্তির সংস্পর্স নতুন ইতিহাসের সম্ভাবনার মুহূর্ত রচনা করে। ইয়েটস তার ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’ কবিতায় দেখাচ্ছেন প্রতি দুই হাজার বছর পর পর ইতিহাস বাঁক নেয় বলে জেসাসের জন্মভূমি থেকেই জন্ম নিতে চলেছে এক দানবীয় শক্তি। ইতিহাসের গতি এক নৈরাজ্য থেকে আরওতর নৈরাজ্যের দিকে। ইয়েটসের ইতিহাস চেতনা ইউরোসেনট্রিক ও খ্রিস্টীয়। জীবনানন্দ এতটা নির্দিষ্ট নন সর্বদা; তিনি মহাপৃথিবীর মহাইতিহাস নিয়ে কথা বলেন, সত্তার বিশ্লেষণে ব্যক্তিমানুষ ও মানবের ইতিহাসকে পটভূমি হিসেবে রাখেন। মানুষের সম্মিলিত যে মহাস্মৃতির (Spiritus Mundi) কথা ইয়েটস ‘দ্বিতীয় আগমন’ কবিতায় বললেন তা ধারণ করে ভবিষ্য? নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। ভবিষ্যৎ নিয়ে এই উৎকণ্ঠা মানুষকে পরিচালিত করে বর্তমানকে পরিবর্তন করে নতুন ভবিষ্যতের রচনার দিকে। জীবনানন্দের কাব্যবিবেচনা এভাবে আপত্তি জানায় না।

জীবনানন্দের কোনো আনুষ্ঠানিক ‘ঈশ্বরে’ বিশ্বাস নেই। তবে, আমার ধারণা তার ‘দৈবে’ আস্থা ছিল। ‘দৈব’ মানে কি শুধু মানবোর্ধ্ব কোনো সত্তা? তা কিন্তু নয়। বরঞ্চ যা কিছু বৃহৎ পরিমণ্ডলে রূপায়িত হতে হয়, যেমন, যা সমষ্টির হাত দিয়ে বাস্তড়বায়িত হতে হয়, তা ব্যক্তির কাছে দৈব, বা ‘নিজ’ এর যে বিষয় নির্ধারিত হয় ‘অপর’ এর হাতে তা-ও ওই ব্যক্তির জন্য দৈব। ‘অপরের’ অতীতের যে পুঁজ ও পুষ্টির ওপর ‘আমাদের’ বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে, তা আমাদের জন্য দৈব। জীবনানন্দের কাছে, তাই, ইতিহাস মানে অপরতার প্রত্যয়। 

ফরাসি দার্শনিক ইমানুয়েল লেভিনা দেখাচ্ছেন, মানুষের সত্তার নির্ধারণ ঘটে অন্যের প্রতি সাড়া বা ডাক বোধ করার ভেতর দিয়েই। লেভিনা একে ‘Call of the other’ বলেন। এই অপরতার প্রত্যয়ের ভেতর দিয়ে মাইক্রো হিস্ট্রি গঠিত হয়, তা থেকেই আবার তৈরি হয় ম্যক্রো ইতিহাস। লেভিনীয় এই ভাব জীবনানন্দের ‘মানুষের কাছে মানুষের দাবির আশ্চর্য বিশুদ্ধতা (উত্তর সাময়িকী)’, ‘মানুষের কাছে মানুষের দাবি রয়ে গেছে ভেবে... (উপলব্ধি) ইত্যাদি অভিব্যক্তিতে লক্ষ্য করি। জীবনানন্দ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ইতিহাসের সমাপ্তি তত্ত্বে আস্থা রাখতেন না, বা তার এই বিশ্বাসও নেই যে, ইতিহাসের কোনো এক রূপই চূড়ান্ত। ‘পৃথিবীর রণ-রক্ত সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয় (সময়ের কাছে)’। জীবনানন্দের আস্থা নেই ঐতিহাসিক নির্ধারণবাদের, ইতিহাসের পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যে। আমাদের সামস্টিক ইতিহাস এক বিশৃঙ্খলা থেকে ধাবিত হচ্ছে আরওতর নৈরাজ্যের দিকে-ইয়েটসীয় এই বিশ্বাস জীবনানন্দের নয়। বরঞ্চ, Gerontion কবিতায় টিএস এলিয়টের-‘History, has many cunning passages and contrived corridor...’ জীবনানন্দের ভাবনার নিকটবর্তী। 

ইতিহাস এক অসীম সম্ভাবনার জমিন। ইতিহাসের ‘কঠিন নিয়ম’ও যেমন আছে তেমনি আছে তার খেয়ালি স্বভাবও। মকর সংক্রান্তির রাত কবিতার বন্ধনীতে কবি লিখছেন- ‘আবহমান ইতিহাস চেতনা পাখির মতোন’। পাখি উড্ডয়নশীল, তার সঙ্গে সম্পর্ক আছে ভূমি, বৃক্ষ ও আসমানের সঙ্গে। ডানার ভারসাম্যে ভর করে সে স্থির থেকেই গতিমান। সে নেমে আসে, আবার ঊর্ধ্বচারী হয়। অনাদিকাল থেকে পাখি এমনি। ইতিহাসেরও রয়েছে এমনি পক্ষিস্বভাব, খাঁচায় আবন্ধ থাকলেও বনের স্বপ্ন তার যায় না। পাখির উড্ডয়নের মতোই ইতিহাসের গতি সরল রৈখিক নয়। জীবনানন্দের কাছে ইতিহাসের চৈতন্য বা আত্মজ্ঞানের সঙ্গে তুলনীয় এই পাখি। নানা বিপ্লবে-সংক্ষোভে পাখিরূপী ইতিহাসের আত্মজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটে। জীবনানন্দের কবিতায় পাখি বার বার ফিরে আসে দার্শনিক উপমান হিসেবে। পাখির উপমায় জীবনানন্দ ইতিহাসের চাঞ্চল্য, বিস্তার, স্থিতি ও গতির এক আশ্চর্য আভাস আনলেন। 

ইতিহাসে সামস্টিক উদ্যোগ ও তৎপরতার ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি ব্যক্তির বাসনা, কল্পনা, ত্যাগ ও বিষর্জনও অমূল্য। ইতিহাস নির্মাণে কল্পনা ও আবেগের ভূমিকাকে জীবনানন্দের মতো আর কেউ এতটা স্পষ্ট করে বলেননি। মহাজিজ্ঞাসা কবিতায় তিনি জানান- মানুষ যদি ‘জাগতিক তিন ফুট কাহিনি’তে ‘হৃদয়ের নীলাভ আকাশ বিছিয়ে অসীম করে’ রেখে না যায় তবে ‘ইতিহাস অবিরল শূন্যের গ্রাস’। ‘পটভূমিবিসার’ কবিতায় কবি ‘গভীর ইতিহাস’কে সম্বোধন করে বলেন যে, তাকে সফল করতে আমরা ব্যক্তিকে বিসর্জন দিয়ে ‘মানবের প্রাণের সাগরে চলেছি’। ‘এইসব দিনরাত্রি কবিতা’তে জীবনানন্দের দিব্য চোখে উদ্ভাসিত হয় ইতিহাসের আরেক সত্য- ‘ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন কালের কিনারায়’। কালে কালে ইতিহাস হয় ও হয়েছে আমাদের অন্ধ প্রবৃত্তি ও কামনার বলি। 

জীবনানন্দের অজানা নয় যে, ইতিহাসকে শুভ পরিণামের দিকে নিয়ে যেতে হলে নানামাত্রিক আঘাত, লড়াই ও সংগ্রাম প্রয়োজন ‘কোথাও আঘাত ছাড়া অস্রসর সূর্যালোক নেই’। ইতিহাসের দ্বান্দিক গতির আভাস আনেন তিনি- ‘অনন্ত দ্বন্দ্বের কোলে উঠে যেতে হবে/ কেবলি গতির গুণগান গেয়ে’ এই উচ্চারণে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন কবি উইলিয়াম ব্লেকের এই উক্তির সঙ্গে, ‘Without contraries is no progression’ এবং কিছু পরিমাণে অবশ্যই হেগেলের ডায়লেক্টিকের সঙ্গে। তার বিশেষ কবিস্বভাবের কারণেও মানুষের বস্তুগত ও ভাবগত ইতিহাসের ডিনামিক্স বোঝা তার জন্য কঠিন ছিল না। 

অনেক সময় প্রশ্ন আসে ইতিহাস কি অতীত, বর্তমান নাকি ভবিষ্যতের বিষয়? অতীতের ফলের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, বর্তমানেই আমরা অতীতকে বিচার করি আর বর্তমানই প্রস্তুত করে ভবিষ্যৎ। তা-ই ইতিহাস আসলে বর্তমানই। আবার, বর্তমানও ক্রমাগত অতীত হয়ে যাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতও ‘আছে’ হয়ে আছে বর্তমানে। অতীতেরও নিকট ও দূর আছে, ভবিষ্যতেরও তাই; কিন্তু এই দূরত্ব বিচার ঘটে বর্তমানে দাঁড়িয়েই। আবার, এ কথাও সমান সত্য যে, ইতিহাস ভবিষ্যতেরও বিষয় কারণ দূর বা অদূর ভবিষ্যের লক্ষ্যেই বা আশাতেই আমাদের বর্তমানে বেঁচে থাকা, কিছু একটা নির্মাণ করতে থাকা, নির্মীয়মান হতে থাকা। জীবনানন্দ বলেন- ‘...আসন্ন কাল চিরকাল আগামীপ্রসবা’। 

এলিয়ট ফরমান-

Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained in time past.
(Burnt Norton, The Four Quartets)

এলিয়ট অনেক বেশি নির্দিষ্ট সময় প্রশ্নে, কিন্তু জীবনানন্দ অধিক ক্রীড়া ও লীলাময়। জীবনানন্দের ইতিহাস ভাবনার সবচেয়ে অভিনব দিক হচ্ছে, ইতিহাসের মানুষী রূপের বাইরে এক ‘মহাইতিহাস’ বা মহাজাগতিক ইতিহাস বা, বলা যেতে পারে, ডিপ হিস্টোরি এর ধারণা। সৃষ্টিবিশ্বের আশ্চর্য বৃহৎ প্রাণলোকের মধ্যে মানুষ আছে এক ক্ষুদ্রতম অবস্থানে। প্রান্তরের ঘাস থেকে নক্ষত্রলোক পর্যন্ত যে মহাপরিসর তাতে মানুষ বিন্দুসদৃশ। মানুষের সমাজ ছাড়াও আছে তারকাসমাজ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আলাদা সমাজ, আবার জড়মণ্ডলও প্রাণের আরেকরূপ। প্রাণের প্রতিটি পর্ব, স্তর ও রূপের সঙ্গেই মানুষের অন্বিত হয়ে চলতে হয়, হব। মানুষ যখন প্রাণলোকে নিজেই পরাক্রম প্রদর্শন করতে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে তার জন্য আত্মঘাতী, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘Steady state of dynamic balance’। একদিকে মানুষী জগতের ‘অসম্ভব বেদনা’ ও ‘অমোঘ আমোদ’ আর, অন্যদিকে, মানবের বাইরের সৃষ্টিলোকের নিজস্ব অস্তিমানতা ... সবটা নিয়েই সবার মহাজগৎ এই ব্যথা, ... এই প্রেম সবদিকে রয়ে গেছে, ... / কোথাও ফড়িঙে-কীটে, ... মানুষের বুকের ভিতরে, /আমাদের সবার জীবনে। (ক্যাম্পে)। মানুষের ইতিহাসকে জীবনের বা প্রাণলোকের ইতিহাস হিসেবে দেখবার প্রচেষ্টা আছে জীবনানন্দের কাব্যে। Crutzen I Edward Wilsin-এর মতো বিজ্ঞানীরা মহাজীবনের প্রেক্ষিতে মানুষের নতুন ইতিহাস রচনার যে-স্বপ্ন দেখছেন সেই ইতিহাসের কাব্যরূপ পাওয়া যায় জীবনানন্দে নিঃসন্দেহে-

‘প্রকৃতি মানুষ আর সময়ের নিজের স্বভাব 
জেনে নিতে হয় নদী প্রান্তরের ঘাসে 
এ ছাড়া আর কি সত্য ইতিহাস জানে?’ ( দুটি তুরংম)
‘মহাইতিহাস’ নিয়ে জীবনানন্দের একটি কবিতাই আছে। এই ইতিহাস রচিত হলে বিবিধ সত্তা ও অস্তিত্বের অন্য অর্থ তৈরি হবে
‘সেই মহা ইতিহাস এখনো আসেনি, তার কাছে
কাহিনির অন্য অর্থ, সমুদ্রের অন্য সুর, অন্য আলোড়ন। (মহাইতিহাস) 

জীবনানন্দের মানুষ ও মানব ‘মাটির নিঃশেষ সত্য দিয়ে গড়া হয়েছিল মানুষের শরীরের ধুলো’ 

জীবনানন্দ কাব্যের একটা বড় অংশে মানুষকে অবলোকন করা হয়েছে লিবারেল হিউম্যানিজম ধারণার ভেতর দিয়ে। জীবনানন্দের ভেতরেই, আবার, আছে মানুষের জটিল ও বিপরীতমুখী স্বভাবের উন্মোচন। ‘মানুষ ও মানব’ এর মধ্যে পার্থক্য জীবনানন্দের কাব্যের অন্যতম ভাবপরিসর। মানব বলতে জীবনানন্দ ইতিহাস পরম্পরায় গড়ে ওঠা মানুষের সামষ্টিক প্রকৃতিকে বোঝান। ‘মানুষেরা বার বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে’। শত-সহস্র বছরের পথপরিক্রমায় গড়ে উঠেছে মানুষের বর্তমান চৈতন্য ও সক্ষমতা। এই চৈতন্য বা বোধ বা সম্মিলিত অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে ব্যক্তি মানুষ। ব্যক্তি মানুষকে চিনে নিতে হয়, বুঝে নিতে হয়, নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হয় ওই ঐতিহাসিক মানবের সঙ্গে, তার যুগের সঞ্চয়ে নির্মিত, মার্ক্স কথিত, ওই প্রজাতি-সত্তাকে (species Being)। ব্যক্তি মানুষকে তার হৃদয়ের আলো জ্বেলে চিনে নিতে হয় তার ‘মানব’কে। ‘মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে ... আজ তার মানবকে কী করে চেনাতে পারে কেউ’। (জনান্তিক)। জীবনানন্দের কাছে, কোনো এক অজানিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত সৃষ্টি জগতের অনির্দিষ্ট যাত্রার কোনো এক পর্যায়ে ফলে উঠেছে মানুষ- 

‘আজকে মানুষ আমি তবুও তো ...সৃষ্টির হৃদয়ে 

হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল’ (সময়ের কাছে)

‘Deep History’ ধারণার অন্যতম প্রবক্তা Edward wilson বলেন, মানুষ যেদিন নিজেকে একটি প্রজাতি বলে চিনতে পারবে সেদিনই তার মঙ্গল। এটি জীবনানন্দেরও অন্যতম কাব্যিক সিদ্ধান্ত নয় কি?

দীর্ঘ সময়ের পটে ফেলে জীবনানন্দ মানুষকে দেখেন, দেখেন তার প্রেম ও বাসনাকে, তার হয়ে উঠাকে। মুহূর্তে উদ্ভাসিত মানুষকে তিনি যতটা দেখেন তারও বেশি তিনি অবলোকন করেন মানুষের এক মুহূর্তের ভেতরে শতাব্দীকালের জ্বলে থাকাকে। জীবনানন্দের মানুষ প্রায়শই বহু ভূগোল ও সময় পেরিয়া আসা মানুষ। ‘মানুষের পটভূমি হয়তোবা শাশ্বত যাত্রীর’। তাই তিনি তার বহুল প্রচারিত কবিতায় বলতে পারেন- ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, বা ‘ এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার বছর বয়সী আমি’। 

‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও/মানব থেকে যায়’ (মানুষের মৃত্যু হলে)। প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু আলাদা আলাদা। তবুও ব্যক্তির মৃত্যু সংকুচিত করে মানবতাকেও, যেমনটি কবি জন ডান বলেছেন; কিন্তু, ‘মানব’ নামক ধারণার মৃত্যু হয় না, যে ধারণা ব্যক্তি মানুষের মধ্যে উদিত থাকে। ইতিহাসের মূর্ত-নির্দিষ্ট মানুষের ভূমিকা ও সংকটকে তিনি তুলে আনলেও তার চোখ কখনোই সরে না ওই মানব থেকে। মানুষ একই সঙ্গে তার কাছে বিশেষ ও নির্বিশেষ। মানুষ, এমনকি বাংলাও, তার কাছে, ফরাসি দার্শনিক আলা বাদিও কথিত ‘ইউনিভার্সাল সিঙ্গুলার’। 

আবার, মিশেল ফুকো আমাদের জানালেন, মানুষ ধারণাটি সাম্প্রতিক আবিষ্কার, যেটি তার বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। মানুষ মুছে যাবে সাগর কিনারে বালিতে আঁকা মুখের মতো। (Man is only a recent invention, a figure not yet two centuries old, a new wrinkle in our knowledge,... he will disappear again as soon as knowledge has discovered a new form”)। মানুষ সম্পর্কে সপ্তদশ শতাব্দীতে যে লিবারাল হিউম্যানিশট ধারণা চালু হয়ছিল সেটা এখন প্রশ্নবোধক হয়ে উঠেছে। মানুষ সম্পর্কে এই উদারনৈতিক মানবতাবাদী ধারার সমাপ্তির আসন্নতাকেই ফুকো ‘ডেথ অব ম্যান’ বলেন, অর্থাৎ মানুষ সম্পর্কে একটি বিশেষ ধারণার সমাধির কথা তিনি তোলেন। দেকার্তের মানুষের চিন্তাকেই মানুষের অস্তিত্বের প্রমাণ ভাবা, ফ্রয়েড কতৃক মানুষের অবচেতন আবিস্কার, মার্ক্সের মানুষের শ্রমিকতার মাধ্যমে নিজেকে ও জগৎ পরিবর্তনের কর্তা ভাবার দীর্ঘ ঐতিহ্য পেরিয়ে মানুষকে তার সত্তার বহুমাত্রিকতায় ভাবার ঐতিহ্যের নানা চিহ্ন জীবনানন্দে পাওয়া যাবে। 

মানুষ থেকে ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে মানুষের কর্তাসত্তায় রূপান্তরের শ্রম, বেদনা ও বিস্ময়ের বহুমাত্রিক পরিচয় জীবনানন্দে লভ্য। কর্তাসত্তার ঐতিহাসিক সংকট ‘আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা’ জীবনানন্দের উন্মোচিত আধুনিক ব্যক্তির স্বরূপ, স্বাধীনতা ও সংকট বুঝতে আমরা বিবেচনায় নিবো ইউরোপীয় দুটি নাটকের ব্যক্তির চিত্রায়নকে। একটি গ্রিক ট্র্যাজেডিয়ান সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাস’, ও আরেকজন স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’। জীবনানন্দ কাব্যের ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতটুকুও নজরে রাখা দরকার। 

সফোক্লিসের রাজা ঈদিপাস নাটকে আমরা দেখি ভাগ্যের বিরুদ্ধে রাজা ঈদিপাসের একাকী-নিঃসঙ্গ লড়াই। যদিও ‘ভাগ্যের’ নিগূঢ় সে যতই ছিঁড়তে চায়, সে ততই জড়িয়ে পড়ে ভবিতব্যে। সমালোচকরা নাটকটিতে ঈদিপাসের পরাজয়ের মধ্যেও দেখতে পান মানুষের জয়। ঈদিপাস তার মাতাকে বিয়ে ও পিতাকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে নিয়তির অমোঘবাণীরই শিকার হয়; কিন্তু, ইদিপাসের সংগ্রামের মূল্য তার প্রচেষ্টাটুকুতে। তার ‘অপরাধ’ এর শাস্তির ভারও সে ছেড়ে দেয় না বিধাতার হাতে। নিজের চোখ উপড়ে ফেলে সে নিজেই, নিজেকে নিজেই নির্বাসন দেয়। পরাজয় সত্যেও গ্রিক ধ্রুপদী সাহিত্যে মানুষের ইচ্ছা ও কর্মতৎপরতার যে বিজয় দেখানো হয়, মানুষের যে- আনত অবয়ব প্রদর্শিত হয় তা থেকে রেনেসাঁ ও ‘হিউম্যানিজম’ ধারনার উদ্ভব। যা হোক, সফোক্লিসের ঈদিপাস নাটকের প্রায় তিন হাজার বছর পর রচিত হয় স্যামুয়েল বেকেটের ওয়েটিং ফর গডো নাটকটি। এ নাটকে আমরা দেখি উল্টো বয়ান। মানুষ (এস্ট্রাগণ ও ভ্লাদিমির) এখানে অপেক্ষা করে ভাগ্যকে বরণ করতে। বীরোচিত কর্মপ্রয়াস দিয়ে ঈদিপাস পালটে ফেলতে চায় এপোলোর ভবিষ্যদ্বাবাণী, নিজের ভাগ্যলিপি; অন্যদিকে, ওয়েটিং ফর গডোতে চরিত্ররা অপেক্ষা করে থাকে ভাগ্যকে বরণ করার জন্য। গডো নামে কেউ এসে তাদের জীবনের অর্থ দিবে, বেঁচে থাকার মানে জোগাবে, ‘মুক্ত’ করবে অস্তিত্বের অসহনীয় ঘেরাটোপ থেকে। গডো এক ব্যপ্ত অনুপস্থিতি কিন্তু সে উপস্থিত রাখে অর্থ (মিনিং), জীবনে, অপেক্ষায়। গডো এক Transcendental signifier যেন। নাটকে গডো আসে না, কিন্তু শেষ হয় না তাদের প্রতীক্ষারও। গডোর আগমণের প্রতিশ্রুতি জারি থাকে, এবং চরিত্ররাও বন্দি থাকে সময় ও কর্মের পুনরাবৃত্তে, চক্রাবর্তে। তাদের মুক্তি আর আসে না। 

নাটক দুটি বহু অর্থবোধক। প্রথমটিতে দেখানো হয়েছে মহাবৈশ্বিক পরিসরে এক লড়াকু মানুষকে; আর অন্যটিতে, দেখানো হয়েছে ধ্বংসস্তূপে ও ইতিহাসের মধ্যে প্রতীক্ষারত অবিচ্ছেদ্য দুটি মানুষ, যারা দু’জনে মিলে আসলে একজন, যারা ইদিপাসের মতো বীর নয়, হয়তো-বা কাপুরুষও নয় কিন্তু মুক্তির অন্বেষী- যে মুক্তিপিপাসা ‘কারও’ আগমনের প্রতীক্ষাতে প্রতীকায়িত। 

ইউরোপীয় সাহিত্যের এই দুটি নাটকে, সময়ের দুটি ভিন্ন পরিসরে মানুষের যে দুটি অবয়বকে তুলে ধরা হয়েছে জীবনানন্দ দাশ তাকে ছাপিয়ে ব্যক্তি ও তার কর্তাসত্তার আরও গভীরে প্রবেশ করেন। 

‘আট বছর আগে’ একদিন কবিতায় আমরা একজন ব্যক্তির ‘মরিবার সাধের’ খবর পাই। ওয়েটিং ফর গডো নাটকেও গডোর জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে এস্ট্রাগন ও ভ্লাদিমিরভাবে তারা আত্মহত্যা করবে, কিন্তু আত্মহত্যা করার জন্য আছে তাদের সামনে একটি মাত্র নরম গাছ, একজনই শুধু আত্মহত্যা করতে পারবে। একজন আত্মহত্যা করলে আরেকজন হয়ে যাবে একা, তাই তারা আত্মহত্যা না করারই সিদ্ধান্ত নেয়। ইডিপাস নাটকেও দেখি, জোকাস্টা আত্মহত্যা করেছিল কারণ সে জানতে পারে, যাকে সে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে ও যার সন্তানের মা হয়েছে সে আসলে তারই পুত্র। জোকাস্টার মতো ইডিপাসেরও আত্মহত্যার কথা ছিল কিন্তু সে করেনি। হয়তো বা তার মা, ও পরবর্তীতে স্ত্রী জোকাস্টা আত্মহত্যা করেছে বলে, অথবা পিতৃহত্যা ও ‘ইনসেস্ট’ এর মতো ‘অপরাধ’এর যোগ্য শাস্তি স্বেচ্ছামরণ নয় বলে। 

কিন্তু, আট বছর আগে কবিতায় যে ব্যক্তির ‘মরিবার সাধ হলো’ ও মরলো কি তার সংকট? কার্য-কারণ সম্পর্ক কি এ ঘটনার? জীবনানন্দ এ-কবিতার ব্যক্তিপুরুষটির আত্মহত্যা করার কোনো কারণ না থাকার কারণকেই আত্মহত্যার কারণ বলেছেন। এই যে ‘কারণহীনতার কারণ’ এইটা ব্যক্তিমানুষের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে জীবনানন্দ ভাবছেন কি? যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়না মানুষ সর্বদা, সে পরিচালিত হয় তার ‘সাধ’দ্বারা, ‘স্বাধীন’ ইচ্ছা দ্বারা; কিন্তু, প্রাণ নেওয়া খোদার অধিকার, প্রাণহরণ রাষ্ট্রের এখতিয়ার। খোদা ও রাষ্ট্র- এই দুই পরমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে ব্যক্তিকে তার স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্ত্বার প্রমাণ রাখতে হয়?ওই যে শিশু ও বধু শুয়ে ছিল তার পাশে তাদের প্রতি তার দায় ও টানের চেয়েও প্রবল হয়ে উঠলো কোনো সে বোধের বাস্তবতা?জীবনের সব প্রাপ্তির চেয়ে কোনো অপ্রাপ্তি তার কাছে আরও শক্তিমান হয়ে উঠলো? নাকি ‘পাওয়া’ তাকে ‘না-পাওয়া’র স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছে? নাকি মৃত্যুটুকু পেলেই জীবনের বৃত্ত পুরণ হয়, যেমনটি কীটসের ‘ওড টু নাইটেংগেল’ কবিতার কথকের ক্ষেত্রে দেখি? ‘ওড টু নাইটেংগেল’ কবিতায় অপূর্ব জ্যোস্নালোক, পুষ্পের শোভা ও সুঘ্রাণের অনির্বচনীয়তার মধ্যে কথকের স্বাদ জাগে বেদনাবিহীন মৃত্যুর, তেমনি? নাকি প্রাপ্তির সবটুকু পরিপূরণের পর একই প্রাপ্তি নিয়ে পুনরাবৃত্ত বেঁচে থাকা অর্থহীন? জীবনের প্রাপ্তিগুলো জীবনের বিস্ময়কে বিপন্ন করে- ‘বিপন্ন বিস্ময়’? নিজের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারাই কি ব্যক্তির ইচ্ছার সর্বোচ্চ স্বাধীনতা, এই ভাবেই কি ব্যক্তি কর্তা হয়ে উঠে? নাকি যে মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা দেয়, ব্যাখ্যা দেয়, ভাষ্য রচনা করে, কর্তা সে? ‘সে’ থেকে ‘আমি’, ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় সর্বনামের এই যে যাত্রা, আট বছর পরেও ঘটনাটির বর্ণনা চলতে থাকা যেন এই ঘটনার চক্রাবৃত্ত স্বভাবের ইশারা। চারদিকের বাহ্যজগতে উত্থিত ক্রমাগত জীবনের দাবি ও অন্তর্গত রক্তের ভেতরে মরণেচ্ছার দ্বান্দিকতার পটভূমিতে কবি এ কবিতায় আধুনিক ব্যক্তিমানুষের এক জটিল মনোপরিস্থিতি বুনন করেছেন। অভাব ও বাসনার প্রচলিত সম্পর্ক প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে এ কাব্যে উপস্থাপিত হয় এক ভিন্ন সমীকরণ। 

অন্যদিকে, ‘বোধ’ কবিতায় যে মুদ্রাদোষের কথা কবি উল্লেখ করেছেন তা মানুষের স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সত্ত্বাকে প্রশ্নবোধক করে এবং ব্যক্তির কর্তা হয়ে ওঠার বন্ধুর ও দ্বন্দময় পথকে নির্দেশ করে। (Nazmul Sultan: ‘ON ‘MUDRADOSH’: JIBANANANDA DAS AND THE PARADOX OF SUBJECTIVITY’)। মুদ্রাদোষ শব্দটি দ্বারা অভ্যাসের পৌনঃপুনিকতাকে বোঝায়, যেটা সমাজের কাছে কিছুটা হলেও দোষ বলে সাব্যস্ত হয়। আবার, এই দোষ এমন দোষ যা আসলে নিরীহ ও শাস্তিযোগ্য নয়। মুদ্রাদোষ এমন এক অভ্যাস যার ওপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ নেই, ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার এখতিয়ারও এখানে প্রয়োগযোগ্য নয়। ব্যক্তি যতই চেষ্টা করে মুদ্রাদোষ হতে রেহাই পেতে, ততই সে তালুবন্দি হয় এই মুদ্রাদোষের। ‘বোধ’ কবিতাটি শুরু হয়েছে কথকের যন্ত্রণাকাতর স্বীকারোক্তি দিয়ে। ‘হৃদয়ের ভেতরে এক বোধ জন্ম লয়’ বলে কথক ‘সহজ লোক’ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বৈষ্ণব দর্শনে ‘সহজ লোক’ বা সহজ মানুষ হলো সে যে প্রকৃতি ও নিজের সত্তার সঙ্গে একাত্ম। সহজ মানুষ কর্তা হয়না। যখন ব্যক্তি বোধাক্রান্ত হয় তখন তার চৈতন্যের দ্বিখণ্ডায়ন ঘটে। সে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং বোধের ফল হয় মুদ্রাদোষ। কথক মুদ্রাদোষকে দোষ হিসেবে দেখায় এ দোষকে কাটাবার জন্য সে সংগ্রাম করে। বোধাক্রান্ত ব্যক্তি তার প্রচেষ্টার তালিকাও দেয়। কৃষক, শ্রমিক, মৎস্যজীবী ও ব্যর্থ প্রেমিক-জীবনের এই সব সহজ ছকে নিজেকে ফেলেও এই বোধাক্রান্ত কথক রেহাই পায়না মুদ্রাদোষ থেকে। বোধাক্রান্ত কর্তা নিজেকে ভাংচুর করেও নিজের সার্বভৌম স্বাধীন ইচ্ছাকে জয়ী করতে পারে না মুদ্রাদোষের ওপর। ব্যক্তির দুইসত্তার যুধ্যমান অবস্থা তাকে গতি দেয়। 

‘উত্তর সাময়িকী’ কবিতায়ও ব্যক্তিসত্তার ঐতিহাসিক সংকট নিয়ে ভেবেছেন-

‘যে যার নিজের নামে সকলের আগে নিজের নিকটে 

পরিচিত; ব্যক্তির মত নিঃসহায়’ 

আধুনিক আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তি নিজের সঙ্গে নিজে সম্পর্কিত হয় নিজের নামের মাধ্যমে। নিজের সঙ্গে নিজের যোগাযোগসূত্র তার নাম। আধুনিক ব্যক্তি শুধু অপর ব্যক্তি থেকেই বিচ্ছিন্ন থাকে তা নয়, সে বিচ্ছিন্ন থাকে নিজের থেকেও। প্রতিটি ব্যক্তি একেকটি দ্বীপ যেনো। ব্যক্তি জনতার সঙ্গে মিশতে পারেনা কেননা ‘জনতাকে অবিকল অমঙ্গল সাগরের মত’ মনে হয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্তও বলেছেন- ‘সহে সহেনা জনতার জঘন্য মিতালী’। সুতরাং, সে নিজের আত্মকুঠুরিতে বন্দী হয়ঃ 

যে যার নিজের কাছে নিবারিত দ্বীপের মতোন 
হয়ে পড়ে অভিমানে---ক্ষমাহীন কঠিন আবেগে’( উত্তর সাময়িকী) 

দ্বীপের মত একাকী মানুষগুলোর কোনো পরমার্থিক চাওয়া নাই, অসীম সূর্যের আশা নাই। সসীম প্রয়োজন মেটানোর নিমিত্তে সময়ের তাড়া খেয়ে তারা অতীত থেকে ছুটে বেড়ায় ভবিষ্যতের দিকে। তাদের এক চোখে থাকে পুরোনো পৃথিবী, আর অন্য চোখে অনাগত নতুন দুনিয়ার স্বপ্ন। অন্ন-বস্ত্রের সসীম চাহিদার নিগড়ে বন্দি ও ছুটে চলা মানুষ যাদের এক চোখে পুরোনো আধচেনা পৃথিবী ও অন্যদিকে মনে চোখে প্রচারিত নতুন পৃথিবীর বাসনা আছে তারাই মহানেশনঃ

‘সকল নেশন আজ এই এক বিলোড়িত মহা-নেশনের
কুয়াশায় মুখ ঢেকে যে যার দ্বীপের কাছে তবু
সত্য থেকে-শতাব্দীর রাক্ষসী-বেলায়
দ্বৈপ-আত্মা-অন্ধকার এক-একটি বিমুখ নেশন। ‘(উত্তর সাময়িকী)

জীবনানন্দের কাছে নেশন সাবজেক্টিভিটিরই একটি ফর্ম। বাসনা ব্যক্তিকে কর্তাসত্তায় রূপান্তরিত করে। শতাব্ধীর রাক্ষসী বেলায় কুয়াশাচ্ছন্ন পরিচয় নিয়েও এবং একাকী দ্বীপের মত হয়েও যাদের ইচ্ছার ঔরসে জন্ম নেয় নতুন দুনিয়া, ওই কর্তাসত্তারাই মহানেশন। জীবনানন্দের নেশন কোনো রাষ্ট্র খোঁজে না যেনো। জীবনানন্দ পৃথিবী, সভ্যতা এমন বড় বড় বর্গের অধীন করে ব্যক্তির সপ্ন ও বাসনাকে দেখেন প্রায়শই। 

প্রেম ও যৌনতার মধ্য দিয়ে আমরা যে-ব্যক্তিসত্তার উদয় দেখি তা বিস্তৃত ব্যখ্যা সাপেক্ষ। 

জীবনানন্দের এই প্রশ্ন গভীর-

‘তবুও হৃদয়ে 

ভালোবাসার যৌনকুয়াশা কেটে

যে প্রেম আসে সেটা কি তার নিজের ছায়ার প্রতি?’ (অনন্দাঃ জীবনানন্দ)

জীবনানন্দের এক অনন্য সাধারণ অন্তর্দৃষ্টি এই যে, ভালোবাসার যৌন কুয়াশা কেটে গেলে প্রেম আসে। তার প্রশ্ন এই প্রেম কি ‘নিজের ছায়া’রপ্রতি কিনা? তো, প্রেমের ক্ষেত্রে নিজ ও অপর বলে কিছু নেই; বিষয় ও বিষয়ী নেই প্রেমে। দুজন মিলেই ‘নিজ’। আর এই প্রেম একটি কল্পনা, সেই অর্থে ছায়া। যাহোক, ফরাসী দার্শনিক আলা বাদিয়ুর In praise of love থেকে সাহায্য নিয়ে ‘ভালোবাসার যৌনকায়াশা’, ও ‘প্রেম’ এর অনুষঙ্গের সঙ্গে নিজ ও অপরের সম্পর্ক আলোচনা করা যায়। যৌনক্রিয়ায় ‘অপর’ দেহের মধ্যস্ততা লাগে। তো এতে যে-সুখভোগ হয় তা ‘নিজ’এর। যৌন ক্রিয়ার ক্ষেত্রে আপনি আসলে অপরের মধ্য দিয়ে নিজের সঙ্গে এক সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়ে ওঠেন। অপর আপনাকে সাহায্য করে ভোগসুখের বাস্তবতা আবিস্কার করতে। যৌন ক্রিয়া আসলে বিযুক্ত করে, এটি দু’জনের আলাদা অস্তিত্বের ঘোষণা। যৌন ক্রিয়ার মাধ্যমে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় তা পূরণ করার জন্য কল্পনা যা নিয়োগ করে তাই হলো প্রেম। প্রেমের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে যায়, আত্মরতিকে ছাড়িয়ে যায়। প্রেম সত্তার অনুসন্ধানে অগ্রসর হয়। যৌনকামনা যখন নজর দেয় বিশেষ বিশেষঅঙ্গের দিকে, তখন প্রেম নজর দেয় অপরের খোদ সত্তার ওপর, যে-সত্তা আমার জীবনে আবির্ভূত হয়েছে, তছনছ করেছে, এবং অন্যদিকে আমার জীবনকে রূপায়িত করেছে। প্রেমে থাকে দুয়ের সম্পৃক্ততা। প্রেম একটি নির্মাণ, দুয়ের প্রেক্ষিতে এখানে কল্পিত থাকে একজীবন। 

(অ) শেষ কথাঃ ‘ভাষা তার জ্ঞান চায়, জ্ঞান তার প্রেম ...’ 

জীবন, জগত, মন, মনন, ও মানবপরিস্থিতির জটিল বিন্যাস জীবনানন্দকে একবাচনিক হতে দেয়নি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যথার্থই বলেছিলেন, সুকান্ত নয় জীবনানন্দই বাংলাভাষার প্রধান বিপ্লবী কবি। জীবনানন্দ এমন কিছু একটা ঘটিয়েছেন, এমন অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির দ্বার খুলে দিয়েছেন যার ফলে বাংলা কবিতার ভাব ও ভাষা আর আগের মতো থাকেনি। লিওতারের ভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, তিনি বাংলা কবিতার জগতে একটা ‘ইভেন্ট’, তার আগমনে পূর্বাপর কবিরা পুনর্বিবেচ্য হয়ে উঠেন তার সাপেক্ষে। কবিতার অন্তর্বয়ন ও ভাবকে চিন্তার ইতিহাসের সমীপ্যবর্তী করে ফেলতে পেরেছেন বিশ্বের যে-গুটিকয়েক কবি তার মধ্যে জীবনানন্দ একজন। জীবনানন্দের অভিনিবিষ্ট পাঠ উন্মোচিত করতে থাকবে তার বহুমাত্রিক তাৎপর্য। আমাদের জ্ঞানানুসন্ধান প্রচেষ্টা কাব্যের অনুভব অর্জনে ও তার কাব্যের ভাবসম্পদ উদ্ধারে সহায়ক হলে চিন্তা ও অনুভব, জ্ঞান ও প্রাণের যোগ ঘটবে, যার কথা জীবনানন্দ বার বার বলেছেন, আর এই প্রক্রিয়ায় ও এই সূত্রে আমরা হয়তো বুঝে উঠব ভাষার অন্তর খুলে গিয়ে ভাবই কীভাবে কাব্য হয়ে ওঠে।  

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //