জীবনানন্দ দাশ: নির্জনতম বোধের আখ্যান

কবিতার বাক্যরূপ হতে পারে প্রকৃতির আখ্যান কিম্বা নির্জনতম সমাজ-চেতনা। এমনকি কবিতা কবির একান্ত মনোভঙ্গির প্রতীক। সেই সাথে কবিতায় সমগ্রতার ব্যাখ্যা দিন-দিন কবির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উঠে আসে। ভবিষ্যতের কবিতা কি রূপ হতে পারে? তা কবির কল্পনায় সূক্ষ্মভাবে সুস্থির রাখতে হয়। তবে, স্বতন্ত্রভাবে রুচিশীল পাঠকের চেতনা-বোধ মাথায় রেখে কবিতার পথে, কবি কী নিয়ন্ত্রিত? হয়তো তা না। তবে আমার মনে হয়, কবির এই নিয়ন্ত্রণ উপলব্ধিকে চক্রবূহ্যের মতো ধাঁধায় নানান বেষ্টনীতে আবদ্ধ করে। কবিকে সকল আবদ্ধতা ভেঙে সমাজ-ঐতিহ্যের আশ্রয়ে যেতে হয়। তা না হলে কবিতা একটা গণ্ডীর মধ্যে রহস্যময় জটিলতায় থাকে। কবিতার বিষয়বস্তু ও প্রসঙ্গ বিবেচনা করা কবির মনোবৃত্তির মুহূর্তের সম্মিলিত শক্তি। 

সেহেতু, জীবনানন্দ দাশের জীবনের প্রকৃতি ও সময়ের অবয়ব স্বরূপ সাক্ষ্য দেয় নানা অনুষঙ্গ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে প্রধানতম কবি। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ’ঝরা পালক’ (১৯২৭) সালে প্রকাশিত হয়। যা সত্যেন্দ্র দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার ও নজরুল ইসলামের প্রভাব লক্ষণীয়। তবে, দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ১৯৩৬ সালে প্রকাশের পর থেকেই তিনি ক্রমাগত মৌলিকতার অনুসন্ধানী। কিন্তু ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পর পাঠক ভিন্ন এক কবির কবিতার আচ্ছাদন গ্রহণ করেন। তবে, জীবনানন্দ দাশের কবি জীবনও যেন মৃত্যুর মতো রহস্যময়। তাইতো, সাড়ে আট শত কবিতার বেশি কবিতা লিখলেও তিনি জীবদ্দশায় মাত্র ২৬২টি কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও কাব্যসংকলনে প্রকাশ করেন। এমনকি রূপসী বাংলার সম্পূর্ণ প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি মজুদ থাকলেও জীবদ্দশায়, তা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেননি। ’রূপসী বাংলা’ তাঁর সমগ্র কবি জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। এছাড়াও, জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশও কবি ছিলেন। তাঁর সুপরিচিত কবিতা হলো- ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড়ো হবে’ (আদর্শ ছেলে/ কুসুমকুমারী দাশ);  যা শিশুশ্রেণির পাঠ্য। তবে, জীবনানন্দ দাশ তাঁর মায়ের ইচ্ছা যেন পুরণ করে বাংলা সাহিত্যে বিরল হয়ে আছেন। 

জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও গদ্য-সমূহ দু’বাংলার বিভিন্ন দশকের কবি-লেখক আগ্রহের সাথে পঠন-পাঠন করেন। তাদের অনেকেই আবার জীবনানন্দকে নিয়ে আলোচনা বা মন্তব্যও লেখেন। কবি শামসুর রাহমান ‘অসীমের সৈকতে’ নামে একটি আলোচনায় বলেন- “জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম নতুন করে আর সারাক্ষণ একথা মনে হতে থাকল যে, আমি যা লিখতে চাই ইনি তা আগেই অত্যন্ত স্মরণীয়ভাবে লিখে ফেলেছেন। এটা এক হিসাবে মর্মপীড়াও কারণ। আমি ’ধূসর পাণ্ডুলিপি’ পাঠ করার পর থেকেই জীবনানন্দ দাশের দখলে চলে গেলাম, যার চিহ্ন আমার প্রাথমিক পর্যায়ের ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত”। শামসুর রাহমানের এই নিজ স্বীকারোক্তি আরো প্রমাণ করে তিনি কতোটা প্রভাব বিস্তারকারী কবি। তবে, যখন হতাশা, সংশয় পরিস্ফুটিত হয় শিল্পজগৎ, ঠিক তখন শিল্প-আলোচনাও নানান ধরনের হয়ে থাকে। পজিটিভ ও নেগেটিভ উভয়ভাবে আলোচনা-সমালোচনায় গতি পায়। সে আলোচনা-সমালোচনা অনেক ভালো কবির বিপক্ষেও যায়। তিরিশের দশকের পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ আলোচনা জীবনানন্দ দাশের বিপক্ষে যায়। কিন্তু দ্যাখেন, কি আশ্চর্যের বিষয় সমকালে অনেক প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিক তাঁর কবিতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে না বোঝার কারণে, সেই সময় কঠোর সমালোচনা করেন। তবে, কেউ কেউ কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বুঝতে পারার কারণে তাঁর  কাব্যগ্রন্থ আলোচনা করেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ ও ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ দু’টি নিয়ে বুদ্ধদেব বসু আলাদা করে দুটি আলোচনাও করেন। যা পাঠককে জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রতি মনোযোগী করে। এতোসব অবতারণার কারণ হলো, জীবনানন্দ দাশের শিল্পবোধ বোঝা। তবে জীবনানন্দ দাশ যে সময়ে লেখা-পত্র প্রকাশ করেন। ঠিক সেই সময়ে রবীন্দ্ররীতি ও রবীন্দ্র-অনুকৃত আর নজরুল ইসলামের বলয় ভেঙে নতুন ধরনের কবিতা লেখা, কিছুটা দুষ্কর ছিল; কিন্তু সেই বলয় ভাঙার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ দাশ সফলতম কবি। তাই মনে হয়, কবিতা লেখার অভ্যন্তরে কবির সৌন্দর্য ইমাজিনেশন কাজ করে। সেহেতু, জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতাটি প্রকৃত উদাহরণ-

আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!/স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,/হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!/আমি তারে পারি না এড়াতে;/সে আমার হাত রাখে হাতে,/সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়,/সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়/শূন্য মনে হয়,/শূন্য মনে হয়!/(বোধ/ ধূসর পাণ্ডুলিপি)। 

জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার প্রতিটি লাইন, কবিতার নানান উপাদান প্রতীকীভাবে পাঠককে সচেতন করে। মানুষের নিঃসঙ্গ-চেতনা অনুভূতির প্রগাঢ়তাকে রহস্যময় করেন। আর তিনি চিন্তার পরিস্থিতি নিরবচ্ছিন্ন সংকটাপন্ন করে, খুব সহজেই পাঠককে ঘোরে আবদ্ধ করতে পারেন। এটা কবির কাব্যশক্তির কারণে ঘটে। কবি ক্রমাগত স্বতন্ত্র হয় তার ভাষার পরিস্ফুটিত উপাদান দিয়ে। প্রকাশভঙ্গী ও ভাষা কবির বোধকে সাক্ষ্য দেয়। জীবনানন্দ দাশ ইউরোপীয় কবিদের দ্বরাও প্রভাবিত হন। সেই ধারাবাহিকতায় র‍্যাঁবো, ইয়েটস, এলিয়ট প্রমুখ কবিরা তাঁর কাব্য জগতের আলোচনার অংশ। তাদের ভাবনা দ্বারা নিজেকে নিমজ্জিত করেন ঠিকই। কিন্তু নিজেকে স্বতন্ত্র করতে বেশি সময় নেননি। জীবনানন্দ দাশ গ্রাম বাংলার চিরায়িত রূপ আর সংস্কৃতি তুলে ধরেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিচিত্রমুখি চিত্রকল্প ও রূপকের আনাগোনায় ভরা। তিনি নানান ভাবে কবিতায় সুরঙ্গ তৈরী করেন। আবার সেই সুরঙ্গে পাঠককে প্রবেশ করান বিভিন্ন অনুষঙ্গ দিয়ে। পৃথিবীর গহ্বরের যেমন সীমানা নাই। ঠিক তেমনই যেন তাঁর কবিতার পথে নির্দিষ্ট কোন ফ্রেমের বেষ্টনী নাই। তাই, তিনি সহজেই বলেন-‘‘পায়ের পথের মতো ঘুমন্তেরা প’ড়ে আছে কত”, এখানে ’ঘুমন্তেরা ‘যদি কোন বেদনা বোধ হয়। তাহলে কি ভয়াবহ বোধ! ধূমজাল! সম্ভবত সেই বেদনার সুর ছুঁড়ে দেন। 

জীবনানন্দ দাশের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লেখেন, ‘‘পড়তে পড়তে মনে হয়, আগের বইটি, ‘ঝরা পালক’ যেন একই নামের অন্য কোনো কবির লেখা। এত আকস্মিক পরিবর্তন কী করে হলো, তা জানা সম্ভব নয়। তবে সচেতনভাবেই তিনি এই পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।” 

জীবনানন্দ দাশের কবিতার পরিবর্তনটা তাঁর জীবদ্দশায় খুব বেশী কবি স্বীকার করেননি। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের পর কেউ কেউ পরিবর্তনটা বুঝতে পারেন। তাদের মধ্যে অগ্রভাগে বুদ্ধদেব বসু।  জীবনানন্দ দাশের কবিতা বর্ণনাবহুল চিত্রে ভরপুর। তাই, বহুবিধ উপমা দিয়ে নিজস্ব বলয় তৈরী করে আজও উজ্জ্বল। তাইতো তিনি বলেন- নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারিদিকে উজ্জ্বল আকাশ;/ বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;/ কাচপোকা ঘুমিয়েছে- গঙ্গাফড়িং সে-ও ঘুমে;/আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি। (তুমি/ বনলতা সেন) 

মগ্নতার ভিড়ে নিজেকে নিমগ্ন করা কবি হলো জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতার বর্ণনা দেখে আজও কবিতা পাঠক অনুভবে মনোমুগ্ধ হয়। প্রেম, বেদনা, প্রকৃতির ক্রন্দন অন্বেষণে চিরাচরিত নিয়ম ভাঙেন। অলৌকিক এক সৌন্দর্য ভাবনার বিন্যাসের উৎস হয়। অর্থাৎ এরকম অসংখ্য বিষয়বস্তু আছে। যার কোন সঠিক ঠিকানা পাই না কেউ! এই হলো জীবনানন্দ দাশের কবিতার বৈশিষ্ট্য। যা পাঠককে বছরের পর বছর শুধু ভাবাবে। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট পটভূমিকা নেই। তবে ইন্দ্রিয় অনুভূতি আছে। জীবনানন্দ দাশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধ নিয়ে শিল্পের সারথি হিসাবে দীর্ঘকাল নিবিড় ভাবে থেকে যাবেন।

লেখক : কবি 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //