ঋতুকন্যা হেমন্ত ও কালপরিক্রমা

বাংলা পঞ্জিকায় এখন কার্তিক মাস। ঋতুতে হেমন্ত কাল। কয়েক দিন আগেই ঋতুর পঞ্জিকা থেকে বিদায় নিয়েছে ঋতুরানি শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিনের তাপদাহ পুড়িয়েছে মাঠের ফসল, জলাশয়ের তল। প্রাণের স্বর শুকিয়ে কাঠফাটা রোদে প্রাণ নাশ হয় হয় অবস্থা! এমনটা শরতের বৈশিষ্ট্য।

বাংলা ষড়ঋতুর আলাদা আলাদা ধরন। গ্রীষ্মে যেমন সবুজের সমারোহে যৌবনোদ্দীপ্ত থাকে, প্রকৃতির সর্বশরীর, বর্ষায় ভিজে ওঠে আপাদমস্তক। শীতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে চারপাশ; ত্বকের ফাটলে প্রাণপায় নিঃসাড়তা। মৃত্যু গন্ধ বইতে থাকে বাতাসে। বসন্তে তার উল্টো। উলঙ্গ গাছের ডালের বাকল-মুখ ভেদ করে উঁকি দেয় নবজীবন। গায়ের ছলম বদলিয়ে প্রাণের নৃত্য চলে প্রকৃতির জগৎজুড়ে। জীর্ণ-শীর্ণ মরা-ধরা দখিনা বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে যেন গত জনম থেকে ফিরে আসে। এভাবেই চলে ঋতুচক্র। ভূগোল বুঝে ঋতুর চলনে তারতম্য কিছু হয় না যে, তা নয়। আমাদের ঋতুরা এমনই।

এই যে হেমন্তকাল- আকাশ নিটোল নীল। কোথাও কোথাও কোদালি মেঘ, কোথাও সাদা ভেলা, কোনো মেঘ নেই একআনা, কোনো ভার নেই, গর্জন নেই, বিজলি নেই, গোমড়া মুখ করে বসে থাকা নেই, থেমে থাকা নেই, যেন হাতের কাছেই কাচ-স্বচ্ছ তুলো, যেন মই বেয়ে একটু উপরে উঠলেই হাতে ধরা যাবে- এ তো হেমন্তেরই গুণ। এ গুণ কারও সঙ্গে মেলে না। না গ্রীষ্মের সঙ্গে, না বর্ষার সঙ্গে। হেমন্তের রূপ-গুণ কিঞ্চিৎ মিল খায় শরতের সঙ্গে, আর কিঞ্চিৎ মিলে শীতের সঙ্গে। শরতের শেষে বায় হেমন্ত, হেমন্তের অন্তে শীত বলে দুই ঋতুকেই ছুঁয়ে দেখে এই ঋতু। কেউ কেউ বলেন, শরৎ আর শীতের সেতুবন্ধ হেমন্ত। 

নগরের নাল ছেড়ে গ্রামে ঘুরে এলাম; কতদিন পর। কতদিন পর শুরুর কার্তিকে কয়েকটি দিন হা করে হাওয়ায় মেলেছি মুখ, আলে গিয়ে নিজ চোখে দেখেছি ধানের সোনালি ভার। ধানের ডগায় ডগায় ফুলে আছে ধানের ছড়া, কৃষকের ঘরে ওঠার অপেক্ষায় অধীর ধানের মন। বাতাসে দুলে দুলে কৃষাণীর হাতে ওঠার আগাম আনন্দ যেন হাসছে ধানের ক্ষেতে। সকালে কাঁচা রোদ, মিষ্টি আমেজ ছড়িয়ে বিলি করছে সতেজতা। রোদও যেন কাঁচা সোনারঙা, চিকচিক করছে আয়নার মতো। তাকালেই ভরে ওঠে নয়নযুগল। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে হেমন্ত রোদের আদিগন্ত দিকে। দুপুর বেলার আল কাত হলে শান্ত শীতের ছোঁয়া হালকা যেন ছুঁয়ে গেছে গা ঘেঁষে। আর বেলা হলে হেমন্তটা ধরা পড়েছে পুরো। হেমন্তে শীতের আগমন টের পাওয়া যায় সন্ধ্যার পরে। বিদ্যুৎ পাখার বাতাস শিহরণ জাগায়, মাঝরাতে সুইচ টিপে বন্ধ করতে হয় ফ্যান। ভোরে পাখির ডাকে ঘর ছেড়ে দেখেছি কুয়াশার আবির, দূরে জমে আছে সাদা রঙ। আহা, খালি পায়ে কত দিন পর হেঁটে দেখেছি ঘাসের গা থেকে শিশির লেগে পা ভেজা। আমি বলি, এর নামই তো হেমন্ত। ঋতুকন্যার বরণ এমনই তো হয়। 

শহরে যদিও অতটা আগে বোঝার জো নেই। রোদ কড়া হলে ঘুম ভাঙে এখানের মানুষের, তারা বোঝে না মিষ্টি রোদের স্পর্শ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের অফিস ঘরে শহুরেরা বুঝতেই পারে না কখন শীত, কখন গরম, কখন নাতিশীতোষ্ণ ঋতুর আগমন-নির্গমন। তারা পত্রিকার পাতায়, টিভির স্ক্রিনে, বাংলা উৎসব-পার্বণের খবরে বোঝে এখন এই ঋতু, ওই ঋতু। তাতে তাদের কিছুই যায়-আসে না। যেমন- হেমন্তে কৃষক ধান তোলে ঘরে; আশ্বিনে রান্ধে কার্তিকে খায়- বছরের আয় আসে তার ধান বিক্রি করে; কৃষাণীর জন্য বানায় নাকছাবি, শোধ করে পুরনো ঋণ; নবান্ন উৎসব হলে তাদের আনন্দের মিলে সুযোগ, এ বাড়ি ও বাড়ি একটু বেড়াতে পারে। তারপরও কিছু নাগরিক খোঁজ রাখে হেমন্তের। হেমন্তে তারা নেচে ওঠে আত্ম-আনন্দে। প্রকৃতির শোভা ভোগ করে উজিয়ে ওঠে আপনের ভেতর। 

নয়ন আছে, যাদের তারা দেখে হেমন্তের অপরূপ রূপের বৈভব। তারা উপভোগ করে হেমন্তের সংস্কৃতি। তারা আপন মনে গেয়ে ওঠে হৈমন্তী গীত। তারা রাতের আকাশে তাঁরার দূর চলনে নির্মেঘের সজ্জায় অভিভূত হয়, চাঁদের নির্ভার জোছনায় বিস্ময় প্রকাশ করে, মৃদু শীতল বাতাসে শরৎ তাপ থেকে উঠে এসে ফেলে শান্তির নিঃশ্বাস। হেমন্তের আরাম তারা মেখে নেয় চোখে-মুখে-বুকে। যদিও শহরে হেমন্তের প্রকৃত রূপ দেখা যায় না, হেমন্ত এখানে নিজেকে খোলার সুযোগ পায় না; কিন্তু গভীর গ্রামে এখনো হেমন্ত ধানের শোভায়, গানের শোভায়, উৎসবের শোভায়, পার্বণের শোভায়, নবান্নের শোভায় ফুটে ওঠে আধেক। কেননা সভ্যতার বিবর্তনে, কালপরিক্রমায়, নগরায়নের তুমুল প্রতিযোগিতায়, বৈশ্বিক পোড়েন ঋতুর মায়াবি মুখ এখন চোখে পড়ে না। পড়ে না হেমন্তের পূর্ণ আবিরও। সব ঋতুই এখন আসে কিছুটা আগে, নয় তো কিছুটা পরে। সর্বত্র অসময়ের অশনি! রূপের রঙের বিভাবরিতে অনেক মলিন। একদা হেমন্ত ছিল ভরা যৌবনা। টলটলা। যখন ধানের, গমের, কৃষি উত্তাল প্রকৃতি ছিল এই মহাদেশে, ছিল বৈশ্বিক উষ্ণতার করাল থাবার বাহিরে। এখন হেমন্ত গাঁথা আছে কবির ভাষায়। সাহিত্যিকের রচনায়। বর্ণনায়। হেমন্তের রঙে বিমুগ্ধ হয়ে বাংলার অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক তাদের কবিতায় লিখেছেন রূপের রসের পঙ্ক্তিমালা। যেমন দেখেছেন তেমন তুলেছেন কথায়। 

সাহিত্যের প্রচীন যুগ বৌদ্ধ সহজিয়ায় রচিত চর্যাপদে হেমন্তের বর্ণনা নেই মোটেই। কোনো ঋতুর নেই প্রাচীনে। মধ্যযুগের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম হয়ে বৈষ্ণব পদাবলি ছুঁয়ে, গোবিন্দ দাস পেরিয়ে আধুনিক কালের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ কালের কবিকুল থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে ছাড়িয়ে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক এবং সময়ের তরুণতম কবির হাতে রচিত হয়েছে হেমন্তের কবিতা, যে সাহিত্য সে বর্ণনায় তাকালে দেখা যাবে হেমন্ত ঋতুর মধু আর মাধুর্যতার ক্ষয়িষ্ণু ধারা। তারপরও কি হেমন্ত উদযাপিত হয় না এদেশে! এখনো হেমন্তে ধান ওঠে কম-বেশি। এখনো পিঠাপুলির ধুম পড়ে ঘরে ঘরে। হেমন্ত মেলা বসে গঞ্জে, ঘাটে। সড়কে, মোড়ে। এখনো হেমন্তের অবশিষ্ট আমেজ দেখা যায় প্রকৃতির মাঝে।

হেমন্তে সামান্য শিশির পড়ে শেষ রাতে, পাতা ভেজে গায়ে গায়ে, পথ ভেজে; গা শির শির করে। কাঁথাটা টেনে নিতে হয় কোমরঅবধি। সকালে রোদ চিকচিক করে সোনার মতো। দুপুর গড়ালে সূর্যটা ক্লান্ত হয় তেজে। বিকেলে সন্ধ্যা নামে আগে, দীর্ঘ হতে শুরু করে রাত। বাতাসে আরাম আরাম বোধ হয়। না শীত, না গরম। প্রকৃতির দিকে চোখ মেললে দেখা যায় অবারিত ফসলের ভরা মাঠ। কিছুটা শীতঘোর তার রঙে- শীতের যেন হাতছানি হেমন্তজুড়ে। হয়তো মানুষের আগ্রহ কমেছে ঋতুর বৈচিত্র্যে, প্রয়োজন কমেছে ঋতুভিত্তিক কর্মে; নাগরিক মস্তিষ্ক, নগর ইট-কাঠ, কারখানা, নগদ অর্থ ভুলিয়েছে ঋতুর রীতি-নীতি, দরকার তথাপিও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে, সূচি মাফিক নিয়ে আসে ঋতুর এক এক পর্ব, ধাপে ধাপে বদলায় তার বৈশিষ্ট্য- এর থেকে বদলানো যাবে না, যতই বদল হয় সভ্যতা, বদল হই আমরা। 

ঋতুর খোঁজ রাখি বা না রাখি, হেমন্তের খোঁজও রাখি বা না রাখি আরও আরও বহুকাল হেমন্ত আসবে, আকাশে-মাটিতে তার খেলা খেলবে; একান্ত আপন শ্রী নিয়ে ফুটে উঠবে হৈমন্তী উল্লাস। দুঃখ শুধু এই, ঋতুর জৌলুস থেকে বঞ্চিত আমরা, প্রকৃতির প্রতি আমাদেরই অধিক অনাচার হেতু।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //