গামছা

প্রান্তজনের সখা চিত্তবৈভবমুখর বস্ত্রনামা

‘আমার বাড়ি যাইওরে বাওই 
 পথে কেদা পানি 
গামছা পইরা যাইওরে তুমি 
 তসর দিব আমি’।(১) 

সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী নাকি একবার গামছা পরে জল তুলছিলেন। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, ‘আপনি এত বড় বংশের ছেলে, আপনার বাবা এত বড় লোক, আপনি কিনা একটা গামছা পরে এভাবে জল তুলছেন?’

শিবরাম বললেন, বাপ তুললেন, বংশ তুললেন, তাতেও হলো না! শেষে গামছা তুলে অপমান করলেন?

গামছাকে কথায় তুলে আনার প্রারম্ভে যে কথা দিয়ে শুরু হলো, তার বাইরে বাড়ান্তরে নানাবিধ কথা আসবে। কথার পিঠেও কথা আসবে গামছাকে ঘিরে। প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক সকল যুগের কথায়ই গামছার প্রসঙ্গ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত গ্রামীণ জনজীবনজুড়ে মানুষের যে জীবনাচার তার কথা, কাব্যে, গানে, গল্পে, ধাঁধা-প্রবচনে সর্বত্রই গামছা তার মহিমা নিয়ে উচ্চকিত! গামছার মহিমার কথাই বেশি, তবে কথা আছে গামছার অপব্যবহার নিয়েও। এমনই গামছার গুণ!

এই আলোচনা গামছা বিষয়ের বিস্তারিত আলোকপাত নয়। কেবল প্রান্তিক মানুষের গামছার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে একটা নান্দীপাঠ। প্রসঙ্গান্তরে বাকি সব কথারা মূলত বাংলার লোকায়ত সমাজের গামছার চিত্তবৈভবমুখর বস্ত্রনামা।

‘আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা
আমার বাপের নাম কে না জানে, চাষা-মালকোঁচা
আমি গামছা-কুমোরের প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোষ্ঠী যত নিম্নজনা
ধূতি-গোয়ালারা জ্ঞাতি, আরও জ্ঞাতি খড়ম-তাঁতিরা
আমি লুঙ্গি-বাউলের নাতি, শাড়ি-কিষানির ব্যাটা’।(২) 

নিছক কথার কথা হলেও গামছার একশ’ একটা গুণের কথার বদলে তাতে সামাজিক তাচ্ছিল্য আছে সন্দেহ নেই। বাংলার যত বস্ত্র আছে তার মধ্যে গামছার জন্য এই অনাদর বরাদ্দ কেন? কে না জানে বাংলার আপামর গরিষ্ঠগণ স্কন্ধে, মস্তকে, কোমরে, খোঁপায়, গলায় আজও যে বস্ত্রখণ্ড অবলীলায় শোভা পায় তার নাম গামছা। গামছা কেবল গা মোছায় নয়, জবজবে ঘাম, ক্লান্তি মুছে যায় যেন নিমিষে। একখণ্ড সুতি বস্ত্রের সংস্পর্শে! জাদু আছে বলতে হয় এই বস্ত্রখণ্ডের। গামছাকে যারা মূলত অষ্টপ্রহর বাহারি কর্ম সম্পাদনের দায় সমর্পণ করে হাজার বছর ধরে নিশ্চিন্ত, তাঁদের মর্যাদার সঙ্গে সামাজিক শ্রেণি রাজনীতির সম্পর্কের চক্কর তবে? 

গোটা বাংলায় গামছা নামেই এই বস্ত্রের পরিচিতি। তবে ব্যবহার ভেদে কারও কারও মধ্যে এর ব্যবহারের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। অঞ্চল, জাতি ভেদে গামছার নামেও আছে ভিন্নতা। গামছাই হয়ে ওঠে অন্যত্র গামোছা, গামচা, আঙ্গছা আবার প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে গাত্রমুঞ্চন, গাত্রমার্জনী। আছে কাছলা, তঙ্গালী গামছা, খাড়ু গামছা, সেঁওয়ালি গামছা, উড়ান গামছা, সামষলী গামছা ও সাঙালি গামছা। 

রবিঠাকুর সেসব চাক্ষুষ দর্শনের কথা বলে রাখেন। সময়কে যেন জিইয়ে রাখেন গামছার খুটে বেঁধে।

‘তীরে তীরে ছেলেমেয়ে নাইবার কালে, 
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে’।

এসব থুড়ি না আরবান হয়, এসব আগাপাশতলা প্রান্তিক মানুষের ঝি, ছেলেদের নাইবার, গাইবার ঠাঁই খোঁজার কালেও গামছা সঙ্গী হয়। 

গা মোছা, মুখ মোছার দায়িত্ব ডিঙিয়ে মাথার ঘাম পায়ে পড়া শুষে নেওয়া গামছা কুটুমরা কেমন আছে? বাঙালির জীবনে গামছার তাৎপর্য কতটুকু, সেটা এককথায় প্রকাশ করতে হলে একটিই যুৎসই শব্দে উত্তর দেওয়া যায় আর তা হলো, অপরিসীম। এই অপরিসীম তাৎপর্যের বস্তুটির ব্যবহার্যতার পরিধিতে একটু নজর দেওয়া যাক। গাঁয়ে কোনো শ্রমজীবীর গামছা ছাড়া একটি সুন্দর সার্থক জীবন ভাবাই যায় না। স্নান করতে গামছা, গা মুছতে গামছা, তিন বেলা খেয়ে হাত মুখ ধুয়ে মুছতে গামছা, গরমে হাতপাখাটা কাছে নেই, একটু গা-টা জুড়িয়ে নিতে হাওয়া করতে গামছা, ঘামে গা ভিজে গেছে, গায়ের জামা খুলেই গা-টা মুছতে হবে, চাই গামছা, গায়ে এসে বসছে মশা-মাছি, ঘরে লোডশেডিং, গামছাটা কোথায় মুখ থেকে এই কথাটাই বেরিয়েই আসে সহজে? গামছার হাওয়া দিয়েই মশা মাছির সঙ্গে লড়াই, কোথাও বেড়াতে যেতে হলে খোঁজ গামছাটা নেওয়া হয়েছে তো ব্যাগে? বাড়িতে পূজার ঠাকুর মশাই এসেছেন, পূজার ফর্দ তৈরি হয়েছে তাতেও আছে গামছা। গামছার আছে নানাবিধ ব্যবহার। পথচলতি ক্লান্ত মানুষটি তাঁর নিত্যসঙ্গী গামছাটি পেতেই গাছের ছায়ায় শুয়ে একটু বিশ্রাম করে নেন। রোদ থেকে বাঁচতেও মাথায় গামছার আড়াল নেওয়া হয়। সেই গামছা যেমন ঘটাচ্ছাদনের তেমনি আবার পুরোহিত সম্মানী। ছানার জল ঝরানো থেকে জিনিসপত্র বা খাদ্যসামগ্রী বেঁধে নিয়ে যাওয়া, বিবাহ অনুষ্ঠান বা দেবতার পূজা, গামছা লাগে সর্বত্র।

‘নীলকরদের লাভজনক নীলচাষে অবাধ্য হলে চাষিদের ভাগ্যে জুটত অকথ্য অত্যাচার। চামু কামারের গানে ধরা পড়েছে নীলচাষের গান-

লাল সুতা নীল সুতা চরখায় 
কাটিলাম সুতা 
বুনাইলাম নীল গামছা 
সে গামছা হারালি কথায় সজনি 
রঙ-ওগো লীলমণি- গামছা 
ধরিয়ে করে টানাটানি’।(৩) 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৮ সালে কোট ও চাপকান নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। উনিশ শতকের শেষদিকে যে বাঙালিরা ইংরেজি পোশাক পছন্দ করেছিলেন, তারা সমালোচনার উত্তরে যেমনটা বলতেন সেটা রবি ঠাকুরের ভাষায়, ‘পুরুষের উপযোগী জাতীয় পরিচ্ছদ তোমাদের কোথায় যে আমরা পরিব? ইহাকেই বলে আঘাতের ওপর অবমাননা। একে তো পরিবার বেলা ইচ্ছাসুখেই বিলাতি কাপড় পড়িলেন। তাহার পর বলিবার বেলায় সুর ধরিলেন যে, তোমাদের কোনো কাপড় ছিল না বলিয়াই আমাদিগকে এই বেশ ধরিতে হইয়াছে। আমরা পরের কাপড় পড়িয়াছি বটে; কিন্তু তোমাদের কোনো কাপড়ই নাই-সে আরও খারাপ’।

পোশাক নিয়ে এবং বিবিধ চাপানউতোরের মধ্যে ধূতি পিরান চাদর, ধূতি পাঞ্জাবি চাদর, ধূতি নিমা চাদর, ধূতি চাদর পাগড়ি, ধূতি শার্ট, ধূতি চাদর ছেড়ে বাঙালির পোশাক নির্বাচনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই পোশাক বিতর্ক উনিশ শতকের শেষ পাদের। প্রশ্ন জাগে তার আগে ১৬, ১৭, ১৮ শতকে বাঙালি পুরুষের ব্যবহৃত সার্বজনীন পরিচ্ছদ কী ছিল? শত শত বছরে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির পোশাক বলতে আমরা কি বুঝব? পরনে খাটো ধূতি, গায়ে গামছা বা পরনে লুঙ্গি গায়ে গামছা, নাকি নেংটি গামছা? অধিকাংশ কৃষক পেশার মানুষের দেশে এমন জুতসই পোশাকই তো হওয়ার কথা! জুতসই কেন? কারণ জল কাদায়, ধুলোমাটিতে যার চাষ-বাস, চলাচল, সেই চাষি শ্রমিকসহ জল-মাটি ঘেঁষা নানা পেশার মানুষদের কর্ম সম্পাদনের নিমিত্তে মালকোঁচা জাতীয় নিম্নাঙ্গের পোশাকই তো সহজ সমন্বয়ক। চাদর কাঁধে নিয়ে যে কায়িক শ্রম করা যায় না, তা বলাই বাহুল্য। ফলে সম্পন্ন কৃষক, প্রভু গোছের লোক ছাড়া কাঁধে চাদর ঝুলিয়ে চলাফেরার কারই বা ফুরসত ছিল সেকালে! কটিবস্ত্র বলতে যদি খাটো ধূতি বা গামছার ব্যবহার বুঝি তবে কোমরে গামছার অবস্থানকেও অত্যাবশ্যক বুঝতে অসুবিধে হয় না। নানা কায়িক শ্রমের সঙ্গে গামছার সম্পর্কটি অন্য যে কোনো কাপড়ের চাইতে অনেক বেশি সম্পর্কিত। ভাবনার বিষয় চাদর নামক বস্ত্রটি যেমন করে পরিচ্ছদের অন্তর্ভুক্ত গামছা কিন্তু সেখানে অপাঙক্তেয়! 

‘গামছা পেতে খাবো দু’জন আউশ ধানের মুড়ি’।(৪) 

মালকোঁচা বা মল্লকচ্ছশ্রমজীবী বাঙালির প্রাচীন পরিধেয় বিষয়ে ড. নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইতে বর্ণিত আছে। ‘তখনকার ধূতি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে অনেক ছোট ছিল; সাধারণত হাঁটুর ওপর পর্যন্তই ছিল কাপড়ের প্রস্থ। ধূতির মাঝখানটা কোমরে জড়াইয়া দুই প্রান্ত টানিয়া পশ্চাতের দিকে কচ্ছ বা কাছা। ঠিক নাভির নিচেই দুই-তিন প্যাঁচের একটি কটিবন্ধের সাহায্যে কাপড়টি কোমরে আটকানো, কটিবন্ধের গাঁটটি ঠিক নাভির নিচেই দুল্যমান। কেহ কেহ ধূতির একটি প্রান্ত পিছনের দিকে টানিয়া কাছা দিতেন, অন্য প্রান্তটি ভাঁজ কোরিয়া সম্মুখ দিকে কোঁচার মতো ঝুলাইয়া দিতেন। এই যে ‘কটিবন্ধ’ তা কোমরে জড়ানো শক্ত সুতো, কোমরবন্ধ নাকি গামছা?’

আরবান করপোরেট দোকানদারদের সংস্কৃতি সেবক হওয়ার খোয়াবের বাইরে যা বাস্তব তা হলো কেবল মুনাফার অনৈতিক বাসনা, সংস্কৃতির এসব মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসাদারদের কোনো মুরোদ নেই গণসংস্কৃতির সেবা করে, প্রান্তজনের যে বিশাল বিপুল সংখ্যাধিক্য তারাই জেগে জেগে সংস্কৃতির পাহারাদার, এই পাহারা তো তার নিজের অস্তিত্বের জন্য, লুট লোপাটের নাগালের বাইরে থাকার লড়াই।

গামছা হালের ফ্যাশন হাইপ এর তাৎক্ষণিকতাসঞ্জাত আকস্মিকতায় যেমন জোলা তাঁতি যুগীর তাঁতে বোনা হয় নাই, তেমনি তাকে দেশ-বিদেশে পয়লা পরিচয়ের ঘটকালির যে বাদানুবাদ চলে- তা বাস্তবতাসম্মত নাকি দস্তুর মতো বিস্ময়কর? চলেন গামছা ইতিহাসের সুলুক সন্ধান করি। তার আগে জিজ্ঞাসি, কয়জন তাঁত আর লুম আলাদা হিসাবে বোঝেন, নাকি একই ভাবেন? লুমের কাপড় কী জন্য তাঁতের কাপড় না? কিংবা তাঁতের কাপড় কেন লুমের না, এই প্রশ্নের মীমাংসা করেছেন কখনো? বোঝার কোনো তাগিদ পেয়েছেন কোনোদিন?

গামছা কার হাতকাটা ব্লাউজে, শাড়ি কিংবা পাড়ে, ফতুয়া বা পাঞ্জাবিতে, ওড়না বা মাফলারে, ব্যাগে, জুতায়, মাস্কে, গহনায়, ঘরের জানালার পর্দায়, গায়ে হলুদের সজ্জায়, সেসব হুলস্থুল বিলকুল যার যার সাময়িক মনপছন্দ। আপাত শ্রেণি উত্তরিত আরবান ‘বিত্তের’ আগে উচ্চ-মধ্য-নিম্ন যাই লাগানো হোক, তাদের ‘ফোক গ্রামীণ’ ন্যাকামো হয় হোক। ফলে মাঝে মধ্যে তাদের তা হয় হোক। তবে প্রান্তজনের নৈমিত্তিক বস্ত্র সান্নিধ্য হয় গামছা। গামছার সঙ্গে তার বিরোধ হবার নয়, সে সম্পর্ক হঠাৎ পাতানোও নয়। এ সম্পর্ক সখ্যতার। বন্ধু হয়ে ঘাড়ে- কাঁধে- মাথায় থাকে। ফলে গামছা আকছার প্রান্তজনের সখা হয়ে হাজির নাজির থাকে।

চলে দূরদর্শনে রোজনামচা 
বসে দেখি চোখে বাইন্দ্যা গামছা’।(৫) 

অতি সহজ সুলভ বস্ত্র কাপড় যখন নাটক সিনেমার পাত্র-পাত্রীরা ফ্যাশন বস্ত্র হিসেবে পরিধান করে, তখন বোধ করি সাধারণ্যে যে হালকার ওপর সামান্য বিস্ময় ও হতবাক হওয়ার প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হয়, আর তারে নিয়ে ঐতিহ্যের কচলাকচলি চলে, তাতে প্রান্তের মানুষের কোনো আগ্রহ আছে? অতি সাধারণ বস্ত্রগ্রহীতা শ্রমজীবীর কাছে কিংবা প্রান্তিক মানুষের কাছে তা নতুন আত্মপ্রকাশ নয়। গামছা তাদের পুরান সম্পর্কের আত্মীয়। বর্তমানেরও। ভাবে- ভাষায়- রঙে- নকশায়- কাজে- কর্মে তাঁদের গামছার লগে দহরম-মহরম তো আর কোনো ফ্যাশনওয়ালার সৃষ্টি না। গ্রামাঙ্গনের লালিত ঐতিহ্য চিত্রশোভিত যে ছবি তা শাড়ি লুঙ্গি গামছা ছাড়া অবান্তর। ফলে গামছা কোনো ফ্যাশন হাঙ্গামার কাছে ইজারাদারি না।

গামছা কখনো কখনো নিরাপদ আশ্রয় হয়ে ওঠে প্রেয়সীকে নিকটবর্তী করে রাখার অভিপ্রায়ে। তাইতো গামছা দিয়ে বাঁধবার কথা আছে। এ আটক নয়, আদর সোহাগের মরমি বাঁধন। প্রেমাষ্পদের অবর্তমানে যৌবনকে প্রতীকী বন্ধনে হেফাজতের জন্যও গামছাতেই আশ্রয়।

চট্টগ্রামের লোকসংগীতে ধরা পড়েছে গামছা তার প্রতীকী ব্যঞ্জনায়-

‘শাড়ি চুলির আশা গরি রেঙ্গুম যাইতাম দি যদি 
সোনার যৈবন কেনে রইখ্যম গামছা দি বাঁধি’।(৬) 

আবার 

‘গামছা দি বান্ধি রাইখ্যুম তোয়ারে’(৭)

আবার প্রিয়জনকে নিমন্ত্রণে আতিথ্য দিতে তার রসনা পাতে দেবার জন্য যে মুড়কি- দৈ তা থাকে গামছা বাঁধা।

‘আমার বাড়ি যাবা মৈষালরে বসতে দিব পীড়া,
জলপান করিতে দিব শালী ধানের চিড়া।
শালী ধানের চিড়া না রে বিন্দু ধানের খই,
নতুন ছোপের কবরী কলা গামছা বান্ধা দইরে’।(৮) 

আবার হাপু গানে আছে-

‘জামাই এলো কামাই করে খেতে দিব কি?
হাত বাড়িয়ে দাও গামছা মুড়কি বেঁধে দি’।(৯) 

গহনে সংকটে সংগোপনে যতরকম গোপন ও প্রকাশ্য জলমোচনা গামছা ক্রিয়াশীল তার খবর কে ই বা রাখে! আর সে জলের কত কত বর্ণ গন্ধের কটু, নোনতা, মধুর, বিষবৎ কষ্টের নানা জলধারার তথা উৎসের।

প্রেমিক প্রেমিকার শাশ্বত নিবেদনে গামছার অনিবার্য উপস্থিতি ভিন্ন মাত্রার। আন্তরিক আত্যন্তিক সার্বিক প্রাপ্তিকালে গামছা বিছানোর আর গামছা ভিজানোর আকুতি এক আকাঙ্ক্ষিত প্রেমপ্রার্থীর প্রার্থনা যেন। 

‘খালাম না ছুলাম না আমি হোলাম দোষের দুষীরে 
সেকালে কইছিলাম বন্ধু গামছা বিছাও তলে’।(১০) 

ঘেটু গানে উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়, মনের বাসনা পূরণে কী করতে হবে বা কী চাওয়া তাও সামান্য গামছার প্রকৃত অবস্থার মধ্য দিয়ে বার্তা প্রেরণের অসাধারণ ভাষা ব্যঞ্জনা!

‘নিহারে ভিজিল রে শাড়ি 
গামছা কেনে ভিজাও না,
আমার লাল রে বরণ,
হৈল কি কারণ 
গামছা খান ভিজায়া বন্ধে 
পুরাও মনের বাসনা’।(১১) 

বৈধব্যে নারীর বস্ত্রের রঙ ফিকে হয়ে গেলেও বিধবা নারীর গামছার রঙ কিন্তু পাল্টায় না।

“উড়ছে গভীর পুড়ছে দ্যাখো বিচিত্র সেই চোখ 
উপচে দু’হাত সন্ধ্যে এলো ‘খোকার ভালো হোক’
আকাশজুড়ে রাত নেমেছে সূর্যি গেছে পাটে 
খোকা এখন গামছা বেচে গ্রামের হাটে হাটে।”(১২) 

চলমান ধাবমান উপনিবেশিক ‘মানসিকতার সাম্রাজ্য’ গড়ন, বরণ, পালন-পোষণ বড় বাংলার ক্রনিক অসুখ। এই অসুখের নানা উপসর্গের বহিঃপ্রকাশের একটি পরিচ্ছদ বস্ত্র। বাঙালির পরিধেয় ধূতি, চাদর, গামছা, লুঙ্গিকে প্রান্তিকের ব্যবহার্য্য দলিত পরিচ্ছদ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে! ইউরোপীয় ‘ভাষ’ আর ‘বাস’ স্বাঙ্গীকৃত হয়েছে বাঙালির দেহে যেমন, মগজেও তেমন।

‘আমরা চিরল পাতায় চাটাই বুনি
আসন পাতি
আমাদের কাঁসার বাসন, পাত পেড়ে খাই
কলার পাতেও
আমাগো জোতজিরেতে চাষের ফসল
ধানের গোলা
আমরার তাঁতের কাপড়, গলায় গায়ে
গামছা ভূষণ।’(১৩) 

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন রচিত জনপ্রিয় একটি লোকগানের মধ্যে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় ভালোবাসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক বা স্মৃতি হিসাবে গামছার কথা উল্লেখ করেছেন। যা বাংলার মানুষের মনে অত্যন্ত গভীর রেখাপাত করেছে।

‘যদি বন্ধু যাবার চাও
ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে
বন্ধু কাজল ভ্রমরারে
কোন দিন আসিবেন বন্ধু কয়া যাও কয়া যাও রে’।

বাংলার এমন সব লোকসংগীতের মাঝে ‘গামছা’ কথাটির অস্তিত্ব বুঝিয়ে দেয় যে, বাঙালির কাছে গামছা শুধু প্রয়োজন মেটাবার উপকরণই নয়, বরং তা আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি বা এক কথায় বাংলার শাশ্বত রূপের সঙ্গে কী নিবিড়ভাবেই জড়িয়ে আছে।

যতরকম গান বিভাজনই থাকুক না কেন, শ্রমক্লান্তি লাঘবে বাংলার অজস্র কর্ম ও পেশার মানুষের আবেগে জীবন অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাদের সংগীতে। গানের কথা, সুর, আবেগে এসেছে বৈচিত্র্য ও পার্থক্যও। ফলে সেসব গানের আমরা নানা নাম চিহ্নিত করেছি। আবার সবমিলে সেসব বাংলার লোকসংগীত। এই লোকসংগীতে গামছা এক অসাধারণ অনুষঙ্গে হাজির। প্রেম ভালোবাসা রূপক প্রতীকে কতভাবেই না উপস্থিত হয়েছে গামছা। 

গামছা শাড়িরও বিকল্প হয়ে ওঠে কোনো কোনো সময়। গোয়ালপাড়ার গানে পাই-

‘মইষ দোয়ান মোর মইষাল বন্ধু
গামছা মাতায় দিয়া’

রোদ আড়াল করতে মাঠের কৃষকের মতো বাথানের মইষালেরও নিত্যসংগী গামছা; কখনো কখনো তার প্রতিরূপও যেন সেটা। তাই আসন্ন বিচ্ছেদের কথা মনে পড়লে বিরহিণী বলেন-

‘তোমরা যাইবেন মইষ বাতানে রে
আমার পোড়ে হিয়া
তোমার ঘারোর ফুল গামোছা
আমাকে যান দিয়া, মইষাল রে’

আবার-

‘ইচ্ছা করে ও পরাণডারে
গামছা দিয়া বান্ধি, ইচ্ছা করে’।

ময়মনসিং গীতিকার কমলা পালায় দেখা যায় বাথান থেকে প্রাণের মৈষাল ফেরার অপেক্ষায় কমলা গামছা বান্দা দই নিয়ে অপেক্ষা করছে-

‘বাথানে থাকিয়া মইষাল মহিষ চড়ায়।
বাড়িতে আসিয়া মইষাল তৈয়ার ভাত খায়।।
গামছা-বান্ধা দই কন্যা যতনে পাতিয়া।
উলায় খই দিয়া খাওয়ায় সামনে খাড়া হইয়া’।(১৪) 

এককালে বাংলার পাঠশালায় ছাত্রবৃত্তি গামছাও ছিল। তারই উদাহরণ কবি উপন্যাসের নিতাই-এর পাঠশালার বৃত্তি।

‘নিতাই পরীক্ষায় ফার্স্ট হইয়াছিল বলিয়া কাপড়ের সঙ্গে একটা জামা, একখানা গামছা এবং তাহার সঙ্গে একটা লণ্ঠন পাইল। এই প্রাপ্তিযোগের জন্যই সকলে পাঠশালা ছাড়িলেও নিতাই ছাড়ে নাই। সে সময় ছেলে কাপড়, গামছা ও লণ্ঠন চার দফা পুরস্কার পাওয়াতে নিতাইয়ের মাও বেশ খানিকটা গৌরবই অনুভব করিয়াছিল’।(১৫)

‘আরে! এত কি ভাবছ রুবি? এই দেখো গামছা।’
‘ওমা! গামছা কি হবে?’
‘মানে! ঠান্ডা মানে কি চান টান একদমি করবে না?’
‘করব। কিন্তু তাই বলে গামছা?’

‘কেন? গামছার মতো আর কিছু আছে নাকি? ও! বুঝেছি! শোন রুবি। ওইসব টাওয়েল ফাওয়েল দিয়ে গায়ের জল টানে না। আর এ হলো আমাদের বেলডাঙ্গার গামছা। আহা হা! কি বাহারি রঙ। যেন অ্যাবস্ট্রাক্টআর্ট। তুমি যখন এটা খোঁপায় বেঁধে চানঘর থেকে বেরবে মনে হবে আমার দিলের রঙ তোমার কালো চুলের বুনোটে আমাদের জলঙ্গির মতো একে বেঁকে’

‘থামো তো!’। রুবিনা আলতো খোঁচা মারে শরীফ কে।(১৬) 

ঠাকুরমার ঝুলির রাজকন্যার টিয়ের বিয়েতে নাওয়াইবার জন্য দাসীদের বললে দাসীরা দুধ, হলুদ আনিয়া দিল, রাজকন্যা সোনারূপার পিড়া, পাট কাপড়ের গামছা নিয়ে টিয়াকে স্নান করাতে বসল।

গামছাই একমাত্র কাপড় যা মাথায়, গলায়, ঘাড়ে, গায়ে, পরনে, কোমরে সর্বত্র বিরাজ করে। এ ছাড়াও রকমফের ভেদে তার ব্যবহারের কোন ইয়ত্তা নেই। বাচ্চা থেকে বুড়ো, নারী কিংবা পুরুষ শ্রেণিভেদ ছাড়াই তার ব্যবহারযোগ্যতা। জন্ম থেকে মৃত্যু, অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, পূজা বা অজু গামছার উপস্থিতি সর্বত্র। অজগাঁয়ের মাঠ-ঘাঁ, খাল-বিল, নদী, বাজার-হাঁ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে রাজধানী যত্রতত্র গামছা তার স্বমহিমায় দৃষ্টি কাড়বেই। গামছা নিয়ে আবার আড় কথাও আছে যেমন, ‘পরনে নাই কাপড়, গায়ে নতুন গামছা’।

পশ্চিমবঙ্গে এবার নাকি বাজারে এসেছে ‘দিদি গামছা’! গামছার রঙ অবশ্য শুধু সবুজ বা নীল-সাদা নয়। এই স্পেশাল গামছা সব রঙেরই পাওয়া যাচ্ছে।

‘সরোজিনী কদমবিবির গামছা কবর’ গল্পে রহম মিস্ত্রির স্ত্রী কদমবিবির কথা বলতে গিয়ে লেখক আনোয়ার শাহাদাত যে আখ্যান রচনা করেছেন, তাতে গামছার অমোঘ উপস্থিতির কথা আছে। বরিশাল নিবাসী প্রান্তজনের কথায়, আচরণে, জীবনে এমনকি মরণেও গামছার যে কথা, তা আসলে গোটা শ্রমজীবী প্রান্তবাসীর কথা হয়ে উঠেছে।

‘কাজেম আলী তার সেই লুঙ্গির বানানো প্রথম পোটলা বাম বগলে চেপে দ্বিতীয় পোটলা থেকে লাল প্রধান সবুজ চেকের একখানি গামছা বের করে, লেখকের কোনো মতামত গ্রাহ্য না করে কাজেম আলী লাল রঙের গামছাখানি লেখক আবসার হাসানের দামি কার্পেটের ওপর বিছাতে থাকে। প্রায় তিন বার গামছাখানি কাজেম আলী বাতাসে ঢেউয়ের মতো করে দুলিয়ে পরে বিছায়। লেখক আবসার হাসান খেয়াল করেন গামছা বিছানোর সময় গ্রামের এই লোকটির হাত দু’খানি এমনভাবে দুলে ওঠে যেন শ্রাবণের আউশ ধানের ওপর বাতাসের ঢেউ, যে ঢেউ লেখক নিজের স্বচক্ষে কোনোদিন দেখতে পারেননি, দেখেছেন টেলিভিশনে। লেখক বুঝতে পারে যে কাজেম আলী ফ্লোরে কার্পেটের ওপর বিছানো গামছায় বসবে। গামছা বিছিয়ে কাজেম আলী লেখকের দিকে না তাকিয়েই নৈর্ব্যক্তিক বলতে থাকে, সাইবদের বাড়ি-ঘর, মোগোর মতো লোকজনের গা-গতরে থাহে রাজ্যের কাদা-মাডি।... কাজেম আলী তাঁর নিজস্ব হালকা প্রায় অদৃশ্য সবুজ চেকের লাল রঙের গামছা কোনো অভিমত ছাড়া বিছিয়ে বসতে না চাইলে তিনি ওই লোকটিকে সোফায় বসতে বলতেন কিনা।... তিনি আসলে জানেন না কী করলে কী হতো, কিন্তু এসব ভাবেন। কাজেম আলী তার গামছায় বসতে বসতে পরিতৃপ্তির সঙ্গে যে সংবাদটি লেখককে দেয় তা হলো ‘ঝালহাডির গামছা’, আমাগো দক্ষিণাঞ্চলে ঝালহাডির গামছায় অইল যাইয়া আহমনার সেরা গামছা।... কাজেম আলী নিজের গামছার ওপর থেকে দু’পায়ের পাতার ওপরে বসে তার আনা দুটি পোঁটলার ওপরেই হাত রাখে, যে-পোঁটলায় তার বসবার গামছা ছিল সেই পোঁটলার গিঁট খুলে হাতায় এবং আর একখানি গামছা বের করে, এবারের গামছাখানিও লাল তবে লালে লালে তফাৎ আছে, আগেরটি শিমুল লাল সবুজে চেকের মধ্যে আর এবারেরটা হালকা হলুদ চেকের মধ্যে শক্ত পাকা খেজুরের রঙ ও আয়তনে বসবার গামছা-খানির তিন ভাগের একভাগ। কাজেম আলী পা খুলে বসে, যেমন পায়ের বুড়ো আঙ্গুল প্যাঁচ দিয়ে গরুর গলায় বা খুঁড়ায় বাঁধার জন্য পাটের দড়ি পাকানো ভঙ্গিতে। কাজেম আলী ছোট গামছাখানি পায়ের পাতার ওপরে ফ্যালে, আসলে দু’পায়ের পাতা ছোট ওই হলুদাভ লাল গামছা দিয়ে ঢেকে দেয়।

তার আগে গামছাখানি কাজেম আলী পায়ে বিছানোর সময়ে যেন একবার গন্ধ নেয়, লেখক আবসার হাসান তেমনটিই মনে করেন। তাঁর মনে করাকে নিশ্চিত করে দিয়ে কাজেম আলী লেখককে জানায় শিশুসন্তানের মতো আরকি, মায়ের কাপড় নাকের পাশে রেখে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, শিশু মায়ের কাপড় থেকে গন্ধ পেয়ে, মা মনে করে স্বস্তিতে নিরাপদ ভেবে ঘুমায়। কাজেম আলী এভাবে ভাঙিয়ে না বললেও লেখক ইন্দ্রিয় শক্তিতে তা বুঝে নেয়। ...

আবসার হাসানের প্রত্যাশার বাইরে কাজেম আলী আরো খবর দেয় যে এই গামছাখানি আয়তনে ছোট কেন? ছোট, কারণ এই গামছাখানি তার ‘পরিবার’ শ্যামেলা বিবি চুল ঝাড়ার কাজে ব্যবহার করে থাকে। কাজেম আলী তাই দূরে কোথাও গেলে স্ত্রীর গামছা সঙ্গে নিয়ে যায়, গামছায় চুলের গন্ধ স্ত্রীর উপস্থিতি কাজেম আলীকে সঙ্গ দেয়।

ছার কইন্যা সোন্তান, আমাগো গেরামের মাইয়া সোন্তান, হের ইজ্জত রাখতে নিজের গামছাহান দিয়া ঢাইক্যা দেলাম, মাইয়া জুহুততো। ... কাজেম আলী পেছনে না তাকিয়ে বলে ছার একটা কতা, সে ঘুরে দাঁড়ায়, বুড়িগঙ্গার গাং-এ সরোজিনী কদমবিবির লাশ ভাসাইয়া দেওনের পর দ্যাশে যাইয়া ওই গামছাহানার কয়বর দেই, আমাগোর নোলোকঝোড় গেরামে ওই কইন্যার কয়বর আছে। এটুকু বলে কাজেম আলী হাঁটে...(১৭) 

শ্যামলা গামছা দেব সুবাতাস করি।‘
‘ডাক রামের, বইন রে লো 
গামছা দিতে গায় লো’(১৮) 

প্রাণের বন্ধুর মাথায় গামছা প্রণয়প্রার্থীর প্রার্থনায় এমন সাবলীল দৃশ্যই ভেসে ওঠে-

‘রাঙা জামা মাথায় গামছা প্রাণের বন্ধু যায়’
আবার টুসুর পরবে গামছায় জিলিপি বেঁধে দিয়ে টুসুর নৈবেদ্য হাজির করতে চায় সে অঞ্চলের মানুষ -
‘আন গো টুসুর গায়ের গামছা বেঁধে দিই জিলিপি।’
নদীর জলে স্নান করতে যায় নারী। এমন ‘সিনানে’ যাওয়ার রূপ বর্ণনায় গ্রাম্য নারীর হাতে থাকে গামছা-
‘তৈলের বাঁশি গামছা হাতে রে গাও সীনানে যাইও 
সান করিতে নারী পদ্মা নদীর ঘাটেরে 
 আমি কি করি’।(১৯) 

আবার রাখালিয়া গানে আছে-

‘সাঁঝের বেলা ওই মেয়েটি চলত যখন গাঙের ঘাটে
ওই ছেলেটির ঘাসের বোঝা লাগত ভারি ওদের বাটে।
মাথার বোঝা নামিয়ে ফেলে গামছা দিয়ে লইত বাতাস,
ওই মেয়েটির জল-ভরনে ভাসতে ঢেউয়ে রূপের উচ্ছ্বাস।’(২০) 

হঠাৎ আসা বাওকুড়ানি বাতাসে গামছা উড়িয়ে নিয়ে গেলে তার আক্ষেপে সুর বাঁধে গানের কথায়-

‘বাতাসে উড়াইয়া নিল 
নিঠুইড়্যা বন্ধুর গামছাখান 
ও নিঠুর বন্দের গামছাখান 
আমার বন্দেরও গামছাখান 
ডুইরয়্যা গামছাখান উড়াইয়া নিল’

মাটির সঙ্গে সূর্যের ছেলে বসন্তদেব বা লাউলের বিয়ে আর মিলনের পালাও শেষ। ঋতুরাজ পৃথিবীকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তাকে যেতেই হবে, একলাই, আবার শীতের মধ্যে বসন্ত হয়ে ফিরবেন, এখন বিদায়। কিন্তু মেয়েরা বৃথাই তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে-

‘কৈ যাওরে লাউল গামছা মুড়ি দিয়া?
তোমার ঘরে ছেইলা হইছে বাজনা জানাও গিয়া।
ধোপা জানাও গিয়া, নাপিত জানাও গিয়া, পরুইত জানাও গিয়া।’

পুত্রের নির্বাচিত সুন্দরী কন্যা অনুমোদন পেল না, টাকা দিয়ে হলেও জমিদার কন্যা চাই। এক্ষেত্রে জাতের বিচার প্রকট হয়ে ওঠে

‘জল যে খাওয়াইলা ও কন্যা সুন্দরী গো 
কহ কন্যা তোমার বাপের জাতি।
বাপ যে আমার এই ঘাটের খেওয়ানি রে 
মাও আমার ভূঁইয়া মালির বেটি।
সেই কথা শুইন্যা ও কুমার সুন্দর রে 
কান্দে কুমার গামছা মুখে দিয়া’।

আবার ‘লালন মেলায় আসবে যে, উত্তরীয় (গামছা) পাবে সে’ এমন প্রবাদ ও রেওয়াজ প্রচলিত আছে স্থানীয়ভাবে।

গামছা একেবারে নিরীহ নির্বিরোধীও নয়! ব্যাটা ছেলের কাঁধে গামছা কখনো বয়সের দোষ বলেও বিবেচিত! অবস্থাভেদে গামছায় হারিয়ে গিয়ে অপকর্মের সাক্ষী হয়েছে। নিরীহ বস্ত্রখণ্ড গামছাই সময়ে অসময়ে হয়ে ওঠে বিপদের কারণ।

‘দাদা কি বউ মারে?
গামছার বাড়ি মেরে তামসা করে’।

ভাই বৌয়ের ব্যাপারে ননদের যে মনোভাব তা এক কথায় প্রকাশিত হয়েছে। বড় ভাই তার বউকে শাসনে মারের ভঙ্গি করলেও মারে না বলে বোন ভাইয়ের সম্পর্কে এই বিদ্রুপাত্মক কথা বলছে। এর মাধ্যমে সংসারে দু’নারীর মধ্যে যে বিদ্বেষপূর্ণ সম্পর্ক সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।

‘মদ খালি হেথা সেথ্যা গামচ্যা হারালি কুথ্যা।
গামচ্যা হারালি সেত লালাত্যে’।

‘গামছা সকল কাজের কাজী’ তা কোনো আপ্তবাক্য নয়। আবার ‘সব জান্তা গামছা ওয়ালা’ বলার মধ্যে আছে হেয় সূচক দৃষ্টিভঙ্গি। গামছার এমনই উপস্থিতি নানা কথায়।

‘এক সে রাখাল গরু চড়ায় গামছা মাথায় দিয়ে 
তার মাকে নিয়ে গেল ‘বুড়া বাঁদরে।’

নাতির জন্মের সংবাদে গ্রামীণ জীবনে মরদ শিশুর জন্য আচ্ছাদন গামছা উপহার এর কথা আছে এই গানে- 

‘এইনা শুইনা দাদায় আইছে লাল গামছা লইয়ারে 
তোমরা থাকো আমরা নাচি নাতি কোল লইয়ারে’।

সাম্প্রতিক কালের কবিদের মধ্যে নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়ও ওঠে এসেছে গামছার সাত সতেরো-

‘স্নান শেষে গা মোছে, কেউ মাটিতে সঙ্গমশয্যা পাতে। 
গামছা ব্যতিত ঘর থেকে বেরুতে গেলেই তাদের পা
ঘরের চৌকাঠে আটকে যায়, ভুলে ওড়না ছাড়া ঘরের
বাইরে বেরুতে গেলে মেয়েদের বেলায় যেমনটি হয়। 
বাংলার নারীরা পুরুষদের এই দুর্বলতার কথা জানে। 
তারা পুরুষের গামছা পাহারা দেয়। তাতে কাজ হয়,
গামছার টানে অনেক সময়ই তারা ঘরে ফিরে আসে’।(২১)

‘গামছা যে রঙেরই হোক না কেন একটু হলেও লাল রঙ থাকবেই- কথাটা আমি এমনি এমনি বলি নাই- গামছার এই রক্তিম বর্ণের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নিজের তাজা রক্ত মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে বার বার। একাত্তরের ১ অক্টোবর নবীনগরের মুক্তিযোদ্ধারা মারাত্মক আহত অবস্থায় আমাকে এবং সহযোদ্ধা মিজান নামে দু’জনকে পানি থেকে প্রায় অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কাইতলা নামক গ্রামে/বাজারে নিয়ে যায় এবং হাঁটুর ক্ষতস্থানে রক্ত বন্ধ করার জন্য লাল গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়- তখন তাজা রক্ত এবং গামছার লালরঙ একাকার হয়ে যায়’।(২২) 

চাঁদপুরের আরেক যোদ্ধার স্মৃতিচারণে দেখা যায় গামছা কীভাবে সমরসঙ্গী হয়ে উঠেছিল-

‘তাঁদের বুকে গামছা দিয়ে বাঁধা লিম্পেট মাইন। সালাহউদ্দিন ও শাহজাহান সফলতার সঙ্গেই সেই মাইন পাকিস্তানি জাহাজের গায়ে লাগাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা বিস্ফোরিত হয়।’(২৩)

‘যহন বিহানবেলা লাঙ্গল কাঁধে যায় খ্যাতের কামে,
মাথায় বান্ধা লাল গামছা আমার সূর্য হইয়া যায়।
আমার জুয়ান যায়, আমার গরম ভাত যায়।
লাও ফুল আমার ভাব দেইখা বাতাসের অঙ্গে সঙ্গে দোলে।’(২৪) 

‘উপনয়ন হোক বা গায়ে হলুদ, গলায় গামছা জড়িয়ে লজ্জা লজ্জা মুখ করে কোটি কোটি উলুর মাঝে উলুখাগড়ার মতো দাঁড়িয়ে সেই গামছাই না শেষ অবধি অঙ্গ ঢাকবে! অমন যে লাজুকলতা পেরথমবার মঙ্গল ঘটের ওপর বিয়ের সময় হাতে হাত রাখা তাও তো সেই গামছা ঢেকেই! তা সে আঙ্গুলে কে কাকে পুট করে রামচিমটি কাটলে লোকচক্ষুর আড়ালে, সে কর্ম গামছা জানে! গামছা জানে প্রথম বড় হওয়ার গোপন কথাও।’(২৫) 

পুরনো অনেক কিছুই একঘেয়ে হলেও পুরনো কাঁথা গামছা কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠে না। বরং পুরনো হলেই যেন বাসনা বাড়ে, তাতে আরামের ওম বাড়ে। 

গামছার প্রতি নাগরিক দায়, তার শরীর থাকুক কার্পাসের তুলোয় বাংলার রমণীর আঙ্গুলের ছোঁয়ায় চরকা কাটা কোমল সুতায় বোনা। বাঁশের সানায়, কাঠের মাকু, বাঁশ কাঠের তাঁতের টানায় বাহারি রঙিন পোড়েনে। জীবনের শরীরে প্রাত্যহিক টানাপড়েনে গামছার রঙিন টানাপড়েন এর শরীরের স্পর্শ হোক বস্ত্র স্বাচ্ছন্দ্যের। গামছার শরীরে বিদেশি তন্তু, রঙ, মাকু, সানায় বোনা গামছার নিকুচি করি। গামছা তাঁর কৌমার্য নিয়ে জড়িয়ে থাকুক বাঙালির মায়ায় ছায়ায় সম্মানে সযতনে।

বরেণ্য ঐতিহাসিক আবদুল করিম ১৯৬৫ সালে তাঁর ‘ঢাকাই মসলিন’ গ্রন্থে লেখেন,‘গা মোছা থেকেই গামছা শব্দের উৎপত্তি। হাত, মুখ বা শরীর ধোয়ার পর গা মোছার জন্য অর্থাৎ বর্তমান কালের তোয়ালে রূপে গামছা ব্যবহৃত হত। বর্তমান কালেও গামছার প্রচলন আছে। এর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ গজ এবং চওড়া ৪.৩ থেকে ১.৫ গজ পর্যন্ত ছিল। সাধারণ লোকের টুপি এবং জামা, বিশেষ করে ছেলে মেয়েদের জামা তৈরির জন্য গামছা ব্যবহৃত হতো।’ আবদুল করিম উল্লেখিত গামছার মাপে মনে হয় গরমিল হয়ে গেছে, ফুট কিংবা হাত হিসাবে নিলেও যথাযথ হয় বলে মনে হয় না! যা হোক গামছা নিয়ে নানাবিধ গরমিল, গোঁজামিল, অমিলের, অসত্যের আলোচনা পর্যালোচনা হয়ে যাক একপ্রস্ত। আজ থেকে ৫৬ বছর আগেই গামছা দিয়ে টুপি, জামা ইত্যাদি তৈরি হতো। ফলে যারা ‘ফোক মারাতে’ পয়লা গামছা ফ্যাশন করেছে বলে অসত্য বলে, যারা এই কথায় সায় দেয়, তাদের উভয়েরই মনযোগী ইতিহাস পঠন-পুনর্পাঠন অত্যাবশ্যক। 

‘গামছা কাঁধে কেষ্টও রাঁধে’!

প্রান্তিকের গামছা, চাদর থেকেই কী উত্তরণ উত্তরীয়তে? আসলে কোন সাহেব, বিবির ফজিলত নেই বাংলায় গামছার আকছার ভালোবাসা পেতে। বিশ্বকবি, বিশ্বখ্যাত এসব বিশেষণ নিজেদের অপনোদনের গাড্ডার বাইরে দেখতে চাওয়ার কোনো অক্ষম অভিসন্ধি! গামছার বিশ্ব খ্যাতির তকমা? এ আরেক ঢ্যামনামো! বস্ত্র খ্যাতিতো বাংলার আজকের নয়, জাহাজ ভর্তি বস্ত্র পণ্য সেই ষোড়শ শতকে ইউরোপে যে পাড়ি দিত তাতে গামছা, রুমাল, কাঁথাও ছিল। গামছা চেক এ অর্বাচীন সময়ের আবিষ্কার নয়, বিবর্তিত হয়ে বর্তমানে বিচিত্রতা পেয়েছে, তা তো বটেই!

লাঙ্গলের মাহাত্ম্য কী একইভাবে ‘উত্তম’ এর মতো সেনাস্বৈরশাসকও বুঝেছিল? কিংবা আরও সব নির্বাচনী প্রতীকের মালিকরা? বাংলার প্রান্তজনের বস্ত্র নিশান গামছা। নারী পুরুষ যুগপৎ গামছা ব্যবহারকারী, ফলে অধুনা গামছা মাহাত্ম্যে কোন ‘উত্তম’ বা অধম বিবেচ্য না হলেই রক্ষে!

কতশত মাধুর্য্যস্নাত এই বস্ত্র। মানে গামছা। ডোমদের বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢাক বাদ্যের নিয়ম আছে। তার আগে ঢাককে নতুন গামছা দিয়ে ‘ঢাকমঙ্গল’ করা হয়।

হাত বাড়িয়ে নেওয়া বারোয়ারি হুক্কায় দম দেবার আগে ঘাড়ের গামছা দিয়েই একবার মুছে নেওয়া হয় নৈচা, আইচা। সিদ্ধি ও গঞ্জিকা সেবনে তপ্ত কল্কির গায়ে জড়ানো বস্ত্র আসলে ভেজা গামছাখণ্ড। এও আরেক গামছা সমাচার।

বাংলার কথায়, কাব্যে, গানে, বচন প্রবচনে, ধাঁধা, গাঁথা, গল্পে, কবিতায়, আখ্যানে গামছার সরল উপস্থিতি। যা যাপিত মানুষের জল, হাওয়া, মেঘ, খরা উজিয়ে বেঁচে থাকবার প্রকৃতিলগ্নতার ইতিহাস ঐতিহ্যে লালন করা। ফলে গামছায় সওয়ার হয়ে কত যে কথা ব্যক্ত হয়েছে! তৈরি হয়েছে গামছা বাখান।

গামছার সংক্ষিপ্ত আত্মচরিত হতে পারে এমন-

‘আমি সকল কাজের পাই যে সময়
আমারে ডাকিতে হয় না,
আমি চাহিবার সঙ্গে থাকি যখন তখন 
তাতেই সঙ্গ সুখ পাই যে।

আমি হই যত গান, গাহ মনের হরষে
তোমার মহিমা পাই যে,
আমি সকলের তরে, দিয়ে আপনা বিলায়ে
নিজেরেই শুধু পাই যে।

কেউ বা মোরে স্থুল দেখে
কেউ ভাবে তুচ্ছতর,
কান্ত বলে দেখ রে বুঝে
কেন বঞ্চিত কর স্মরণে?’

নয়া উপনিবেশিক জমানায় প্রান্তিক মানুষের তার শেকড় বাকর থেকে উম্মুল হওয়ার মতোই গামছা বস্ত্রের কোণঠাসা হওনের ইতিহাস রচিত হচ্ছে তোয়ালে সন্ত্রাসে! 

বিশ্বায়ন, উন্নয়নের ইঁদুর দৌড়ে নাজেহাল প্রান্তিক মানুষ ঘনশ্রম ক্লান্তির ঘাম মুছে আজও স্বপ্ন দেখে সুতি গামছার শীতল বাতাসে। 

‘কাঁধে তাদের 
সুতির গামছা 
যা দিয়ে ক্লান্তি মোছা যায় 
যুগি, জোলার তাঁতের গামছা 
যা প্রান্তজনের বস্ত্রনিশান হয়।’
জয় গামছা, প্রান্তজনের সখা। 

উদ্ধৃতি সূত্র

১. রাখালী, জসীমউদ্দীন। 
২. মাটি-বংশধর, আবু হাসান শাহরিয়ার।
৩. জঙ্গলমহলের লোকসংগীতে সমাজ চেতনার ধারা, জলধর কর্মকার, সৃষ্টিসন্ধান ডটকম।
৪. আমার বাড়ি, আনছার আলী।
৫. গম্ভীরা গান।
৬. ৭. চট্টগ্রামের লোকসংগীত।
৮. রাখালী, জসীমউদ্দীন। 
৯. হাপু গান। 
১০.১১. রাখালী, জসীমউদ্দীন। 
১২. সৌমিত বসু, ভ্রমকথা।
১৩. পার্থসারথি বসু।
১৪. কমলা, দ্বিজ ঈশান, মৈমনসিংহ গীতিকা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম, ২০১৫, পৃষ্ঠা ২৩০।
১৫. কবি, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৬. nutronstar.wordpress.com
১৭. সরোজিনী কদমবিবির গামছা কবর, আনোয়ার শাহাদাত, গল্পপাঠ।
১৮. পূর্ববঙ্গের বিবাহগীতিতে রামচন্দ্র, ময়ূখ ভৌমিক।
১৯. ২০. রাখালী, জসিমউদ্দীন। 
২১. গামছা, নির্মলেন্দু গুণ।
২২. যদি বন্ধু যাবার চাও, ঘাড়ের গামছা থুইয়া যাও রে, ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর। 
২৩. সালাউদ্দিন আহমেদ বীরউত্তম।
২৪. পারা ও পারাহীন আয়নায়- জাহিদ হায়দার, শব্দঘর।
২৫. কুশল ভট্টাচার্য, অক্ষরশহর। 

লেখক : চারুশিল্পী, বুনন শিল্প চর্চা ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //