বিবেকানন্দ আর তার প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা

স্বামী বিবেকানন্দ সমগ্র ভারতবর্ষে খুবই সম্মানিত মানুষ। বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের কাছেও তিনি খুব শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি; কিন্তু তার এই সম্মান বা শ্রদ্ধা কীসের জন্য? কখনোই এটা কি মূল্যায়ন করে দেখা হয়েছে যে, তার মহত্ব নিয়ে যে-সব কথাবার্তা হয় তার মূল কারণটা কী।

মূলত তিনি ছিলেন হিন্দুধর্মের বা বেদ বেদাঙ্গের পুনরুত্থানবাদীদের দলে। বাংলাদেশের কট্টরপন্থি কিছু মানুষ যেমন চায় কুরান আর সুন্নাহ অনুসরণ করে দেশ চালাতে, নারীর শিক্ষা-কর্মসংস্থান বন্ধ করতে-বিবেকানন্দ তেমনই চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের কিছু ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া মুসলমান ইতিহাসকে যেমন পিছনের দিকে টানতে চাইছেন, বিবেকানন্দ ঠিক তাই চাইতেন। বিবেকানন্দ একা নন, বাংলার উনিশ শতকের নবজাগরণের প্রায় সব হোতারাই চাইতেন প্রাচীন ভারতে ফিরে যেতে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বা সনাতন ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণকালে ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক হতে পেরেছিলেন খুব কম মানুষ। নবজাগরণের পাণ্ডারা বাংলা ভাষা-সাহিত্যকে উন্নত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখলেও তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন কুসংস্কার আচ্ছন্ন, হিন্দুত্বের প্রর্বতক। সত্যি বলতে ভারতে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সৃষ্টিতে এঁদের অনেকেরই কমবেশি অবদান ছিল। বাংলার তথাকথিত নবজাগরণের সেইসব মহারথীরা একদিকে সনাতন হিন্দুধর্মকে ফিরিয়ে আনতে চাইতেন, ভিন্ন দিকে মনে করতেন ভারতে ব্রিটিশ শাসন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ সকলেই এ ব্যাপারে সমগোত্রীয়। খ্যাতিমানদের মধ্যে সেখানে বিশেষভাবেই ব্যতিক্রম ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন দত্ত। 

বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে যারা কট্টর, যারা নানাভাবে ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনের কথা বলে-বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষ তাদের সামান্য সম্মান দেখান না; কিন্তু খুবই বিস্ময়কর যে, বাংলার হিন্দু পুনরুজ্জীবনের প্রবর্তকরা সবাই খুব সম্মানিত এখানে এবং ভারতবর্ষে। বিবেকানন্দের সম্মান তো সারা বিশ্বব্যাপী। যিনি ছিলেন কট্টরভাবে সনাতনধর্মী। তিনি বক্তৃতার মঞ্চে বহুসময় মানুষের অন্তর বিগলিত করার মতো সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন কিন্তু দিনের শেষে তিনি ছিলেন নির্ভেজাল ধর্মান্ধ হিন্দু। ভারতবর্ষে হিন্দুত্বের প্রচার আর প্রসারের জন্যই তাঁর এ সম্মান। হিন্দু ধর্মপ্রচারের জন্য যদি তিনি সম্মান পেতে পারেন, তাহলে ভিন্ন মানুষরা কেন খ্রিস্টান ধর্ম বা ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সম্মান লাভ করবেন না? বাংলাদেশের গোঁড়া মুসলমানদের পক্ষ নেয়া বক্ষ্যমান প্রবন্ধকারের লক্ষ্য নয়; কিন্তু ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধান করতেই হবে। মূল বক্তব্য হলো, প্রায় একই দোষে দোষী দু’পক্ষকে দু’ভাবে বিচার করবার কারণটা কী? বিবেকানন্দ যদি পশ্চাদপদ-কুসংস্কার আচ্ছন্ন হিন্দুত্বের বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচার করে নায়ক হতে পারেন, ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য তাহলে কেন একজন মুসলমান নেতা প্রগতিশীলদের চোখে খলনায়ক বনে যাবেন? বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানবাদীদের দলে, বিবেকানন্দ লেখাগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তাই দাঁড়ায়।

এক

বিবেকানন্দের প্রতিক্রিয়াশীলতা নিয়ে আলোচনার পূর্বে আরো কিছু কথা বলে নেয়া দরকার। বিবেকানন্দের আগেই হিন্দুত্ববাদের প্রচার চলছিল। রাজনারায়ণ বসুকে বলা হয়েছে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের প্রবর্তক। তিনিই উৎসাহ দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের বাংলায় ঠাকুর বাড়ির অর্থানুকূল্যে ১৮৬৭ সালে ‘হিন্দুমেলা’ চালু করেছিলেন। হিন্দুমেলার মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার বার্তা দেয়া হয়েছিল। বাংলার মুসলমানকে সেখানে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখা হয়নি। রাজনারায়ণ বসু ভারতের মুসলমানদের ভারতীয় জাতীয়তাদের বাইরে রাখতে চেয়েছেন। ভারতের জাতীয়তাবাদ তাঁদের চোখে শুধু হিন্দুদের জন্যই-যা হিন্দু জাতীয়তাবাদ। হিন্দুমেলার নামকরণের মধ্য দিয়ে ভাবীকালের সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা লক্ষ্য করে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষন সম্পাদিত মাসিক ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকায় ‘আধুনিক ভারত’ শীর্ষক প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘আমরা মেলার অধ্যক্ষদিগের নিকট করজোড়ে এই ভিক্ষা চাই, তাহারা যেন এই মেলাকে কোন সংকীর্ণ ভিত্তির ওপর ন্যস্ত না করেন। আমাদিগের ভিক্ষা তাহারা যেন এই মেলাকে এখন হইতে হিন্দুমেলা নাম না দিয়া ভারতমেলা নাম দেন। যেন ইহা হইতে ভারতবাসী মাত্রেরই উৎসব স্থান হয়। হিন্দু ভিন্ন অন্য কোনো জাতি ইহাতে যোগ না দেন-আমরা কাঁদিব; কিন্তু ভারতবর্ষীয় কোনো ভ্রাতার বিরুদ্ধে ইহার দ্বার অবরুদ্ধ রাখিব না।’ পরবর্তী সময় হিন্দুমেলার নামকরণ হয় চৈত্র সংক্রান্তি মেলা। পরবর্তীকালে আর্যদর্শন পত্রিকাটিও তার এই অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব রক্ষা করতে পারেনি। শীঘ্রই পত্রিকাটি হিন্দুত্বের প্রচারক হয়ে দাঁড়ায়। এক দশক বাদেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রাবল্য দেখা দেয় এই পত্রিকায়। বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে হিন্দুমেলার বা হিন্দুত্বের চিন্তাদ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হন।

বিবেকানন্দের মূল নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হিসেবে পরিচিত হন। যুবক নরেন্দ্রনাথ ১৮৮০ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম বর্ষের কলা বিভাগে ভর্তি হন। পরের বছর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে চলে যান। এই কলেজে তিনি পাশ্চাত্য যুক্তিবিজ্ঞান, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় জাতিগুলির ইতিহাস সম্পর্কে গভীর পড়াশোনা করেন। নরেন্দ্রনাথের অধ্যাপকদের মতে, নরেন্দ্রনাথ ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্র। নরেন্দ্রনাথ এমন গৃহে জন্মেছিলেন যে গৃহে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে তৎকালীন সমস্ত খ্যতিমান ব্যক্তি কোনো না কোনো সময়ে পদার্পণ করেন। বিবেকানন্দ নিজেই এককালে দেবেন্দ্রনাথের শিষ্য ছিলেন। নরেন্দ্রনাথের তখন নিত্য সহচর ছিল গীতা। প্রতিদিন তিনি গীতা পাঠ করতেন। মধ্যরাত্রি পর্যন্ত প্রার্থনা ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। হিন্দু সমাজের গর্ভ থেকে যে ব্রাহ্মসমাজের উদ্ভব হয়, কলেজে থাকাকালীন নরেন্দ্রনাথ প্রায়ই ব্রাহ্মসমাজের সভাগুলোতে যোগ দিতেন। তিনি মনে করতেন ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্যগুলো ব্যক্তি ও জাতির প্রধান সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করবে। ব্রাহ্মদের মতো তিনিও সংকীর্ণ জাতি প্রথা, বহুবিবাহ এবং পৌত্তলিকতাকে অপছন্দ করতেন। তিনি ব্রাহ্মদের মতোই ঘোরতর একেশ্বরবাদী হয়ে পড়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রতি নরেন্দ্রনাথের আকর্ষণের পিছনে তাঁর সংগীতস্পৃহা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের সংগীত তাঁকে ভীষণভাবে প্রেরণা দেয়। রামকৃষ্ণ নিজেই বিবেকানন্দের গান শুনে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ব্রাহ্মসমাজ যখন দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত এবং বিবেকানন্দ ছিলেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ভক্ত। ক্ষিতিমোহন সেন বলেছেন যে, প্রথম রবীন্দ্রসংগীত তিনি শোনেন কাশীতে বিবেকানন্দের কন্ঠে। 

ব্রাহ্মসমাজের অনেক ভক্ত রামকৃষ্ণের কাছে যেতেন ধর্মতত্ত্ব শোনার জন্য। শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্রাহ্মনেতা, ব্রাহ্মভক্তদের রামকৃষ্ণের কাছে যেতে নিষেধ করেন। এমনকি শিবনাথ শাস্ত্রী নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের কাছে যেতে নিষেধ করেন। নরেন্দ্রনাথ নিরুত্তরে শিবনাথ শাস্ত্রীর উপদেশ শোনেন; কিন্তু প্রথম সাক্ষাতের কয়েক বছর পরে নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণের নিকট সম্পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করেন।  ব্রাহ্মসমাজের অনেকে বিবেকানন্দকে শত্রুজ্ঞান করতেন, তা কেবল ব্যক্তিগত কারণে নয়, তাদের সম্প্রদায়গত স্বার্থের কারণেও। ব্রাহ্মসমাজের শক্তি পূর্বে কিছুটা ক্ষয় পেলেও বিবেকানন্দের নব্য হিন্দু আন্দোলন তার ওপর চূড়ান্ত আঘাত নিয়ে আসে। এ ব্যাপারে তাঁরা রামকৃষ্ণকে দোষী সাব্যস্ত করেন। ব্রাহ্মসমাজের ভাঙনে বিবেকানন্দের ভূমিকা থাকলেও ব্রাহ্মনেতারা এ জন্য কম দায়ী ছিলেন না। ব্রাহ্ম আন্দোলনের সংহতিতে ফাটলের জন্য ব্রাহ্মনেতারা নিজেরাই দায়ী ছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের কর্মপ্রণালির দোষে সাধারণ হিন্দুসমাজের কাছে বিশ্বাসভাজন ছিলেন না। কারণ ব্রাহ্মসমাজ কাজ করেছেন উচ্চবিত্তদের নিয়ে, সাধারণের কাছে যাননি। কাজেই তাঁদের ধর্ম সংস্কারের প্রত্যক্ষ ফল জনমানসে প্রতিফলিত হয়নি। বিবেকানন্দ ব্রাহ্মসমাজ তথা ব্রাহ্মনেতা কেশবচন্দ্র সেনের কাছে ঋণী, কারণ সমাজসংস্কারবিষয়ক অনেক কিছু তিনি কেশবচন্দ্র সেনের কাছ থেকে গ্রহণ করেন। নরেন্দ্রনাথ যখন কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শে আসেন তখন বিবেকানন্দের বর্ণনাতেই কেশবচন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন ‘জগদ্বিখ্যাত’। বিবেকানন্দের সমাজ-বিবেক কেশবচন্দ্র সেন দ্বারাই প্রথম উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। শুধু সামাজিকীকরণ নয়, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অভিঘাতের প্রেরণা বিবেকানন্দ কেশবচন্দ্রের কাছ থেকে পান। বিবেকানন্দের অন্যতম প্রত্যয় ছিল, ধর্মই ভারতীয় জীবনে মূল সূত্র। তাও বলা যায় কেশবচন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া। পক্ষান্তরে আবার কেশবচন্দ্রও নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণ অভিমুখী করে তুলেছিলেন। নরেন্দ্রনাথের সাধক জীবনের সূচনা ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে দিয়ে আর তাঁর পরিসমাপ্তি ঘটে রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সাকার সাধনার দ্বারা।

বিবেকানন্দ ইতিহাসের এক নব রূপকার হিসাবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থিত হয়েছেন সন্দেহ নেই। সেই রূপকার ছিলেন আসলে একজন হিন্দুধর্মের প্রবক্তা। ফলে তিনি ভারতের বৃহৎ মুসলমান সমাজের ওপরে প্রভাব ফেলতে পারেননি। তিনি নিজে সাম্প্রদায়িক ছিলেন না; কিন্তু তিনি যে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছেন, তা স্বাভাবিকভাবেই সম্প্রদায়ের চেতনা তৈরি করে। বিবেকানন্দ যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সেই সময়টা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনে অবরুদ্ধ। বিবেকানন্দ ভারতবর্ষের পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। সেই কারণে তাঁর জাতীয়তাবাদ ভাবনার মধ্যে শুধু রাজনৈতিক দিকটিই উঠে আসেনি; তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি জাতিকে প্রকৃতভাবে গড়ে তুলতে গেলে মানুষকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তিবলে বলীয়ান হওয়া প্রয়োজন। শিকাগো মহাসম্মেলনে বক্তৃতা শেষে তিনি যখন ভারতে ফিরে আসেন, সেই সময় ভারতবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বৎসর পর্যন্ত জন্মভূমিই হোক তোমাদের একমাত্র উপাস্য দেবতা।’ তাঁর এই আহ্বানে দলে দলে দেশপ্রেমিক যুবক ভারতের পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে এগিয়ে এসেছিল। বিবেকানন্দ ইংরেজ পদানত ভারতবর্ষের অত্যাচারী শাসকদের নির্যাতন, নিপীড়নের নগ্নরূপ তুলে ধরেন। ইংরেজদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে তাঁরা ভারতবাসীর লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করেছে, ভারতবাসীর শেষ রক্তবিন্দু চুষে খেয়েছে। এ জন্য ইংরেজদের ওপর ইতিহাসের প্রতিশোধ অবশ্যম্ভাবী। বিবেকানন্দের ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা থেকে জানা যায় যে, গোড়ার দিকে দেশকে তিনি বিদেশি শাসনের কবল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় নৃপতিদের নিয়ে একটি শক্তিজোট গঠন করার পরিকল্পনা তাঁর ছিল যা বিদেশি শাসন উচ্ছেদ করবে। 

বিপ্লববাদীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছিলেন, ‘অনন্ত বীর্য, অনন্ত উৎসাহ, অনন্ত সাহস ও অনন্ত ধৈর্য চাই, তবে মহাকার্য সাধন হবে। দুনিয়ায় আগুন লাগিয়ে দিতে হবে।’ সমাজের উচ্চবর্ণের দেশপ্রেমিক যুবকদের প্রেরণাপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিবেকানন্দ। তাঁকে তাঁরা গুরুর পদে বরণ করে নিয়েছিলেন। ভারতের যুবশক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, ‘শত শত শতাব্দীর দাসত্বের ফলে তোমরা যেন একটা স্ত্রীলোকের জাতে পরিণত হয়েছ’। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষকে তিনি বলেছিলেন, ‘তোরা ওঠ, জাগ, গোলামির শিকল ছিঁড়ে ফেল, ছিনিয়ে নে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা কি এমনি কেউ দেয় রে? তা অর্জন করতে হয়। যা ভারত হারিয়েছে তা তোদের পৌরুষের বলে, মানুষের শক্তিতে আবার পুনরুদ্ধার কর। পশুও চায় না বন্দি হয়ে থাকতে। গরুকে বেঁধে রাখলে গরুও দড়ি ছিঁড়তে চায়, ছিঁড়তে চেষ্টা করে। আর তোরা কি করছিস! তোরা ওঠ, তোরা জাগ। তোরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠ। আর হাতে কৃপাণ ধর, ধর বন্দুক। চলুক গুলি-গোলা।’ তাঁর এই বাণী বিপ্লবীদের দিয়েছিল অমিত শক্তি এবং জাগরিত করেছিল তীব্র স্বাধীনতার স্পৃহা। তিনি ডাক দিয়ে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধে নেমে পড়ো। পিছু হঠো না। আকাশ থেকে নক্ষত্র খসে পড়তে পারে, জগৎ বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে, তবু যুদ্ধ করতে হবে। পশ্চাদাপসরণ করে যুদ্ধ এড়ানো যায় না।’ বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ভারতের বিশেষ করে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। তিনি আহবান করলেন দেবতার পূজা বাদ দিয়ে দেশের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে।  

রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, বিবেকানন্দের চিন্তাধারা বাংলার চরমপন্থি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত যুব সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, শাস্ত্র সব গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দাও, প্রথমে মানুষকে শেখাও কি করে খাদ্যবস্ত্রের সংস্থান হবে...। ভিন্ন দিকে তিনিই আবার অনুভব করেছিলেন যে, বেদান্তকে বাস্তবে ও কার্যের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারলেই মানবতাকে সমুন্নত করা সম্ভব হবে। বিবেকানন্দের বাণী যে বিপ্লবী আন্দোলনের নায়কদের অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের নথিপত্রেও তার সমর্থন মেলে। বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কাছে বিবেকানন্দের শক্তি সাধনার শিক্ষা হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণার উৎস। তিনি বলেছিলেন, ‘মনে রাখবে বিদ্রোহে তোমার চির অধিকার।’ ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি বিদ্রোহ করার কথা বলেছেন। ভিন্ন দিকে ইংরেজদের পক্ষে তিনিই আবার বলেছেন, ইংরেজদের কাছে তোমাদের দাবি, আমাদের লোকদের চাকরি দাও; দুর্ভিক্ষ মোচন করো ইত্যাদি। দিনরাত কেবল দাও দাও করে হল্লা করছো। বাপু আর কত দেবে? রেল দিয়েছে, তারবার্তা দিয়েছে, রাজ্যে শৃঙ্খলা দিয়েছে, ডাকাতের দল তাড়িয়েছে, বিজ্ঞানশিক্ষা দিয়েছে। আবার কী দেবে? বলি বাপু ওরা তো দিয়েছে, তোরা কী দিয়েছিস? তিনি আরো বলেন ভিখিরির অভাব কখনো পূর্ণ হয় না। খুব স্পষ্ট বক্তব্য তাঁর, ইংরেজ ভারতবাসীকে অনেক কিছু দিয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে আবার বিবেকানন্দ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুবশক্তিকে দাঁড়াতে বলছেন কেন? সশস্ত্র যুদ্ধ করতে বলছেন কেন? সবটাই কি তাঁর চিন্তার স্ববিরোধিতা নয়? বিবেকানন্দ একদিকে যুবশক্তিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরামর্শ দিচ্ছেন, ভিন্ন দিকে বলেছেন সংকীর্ণ দেশপ্রেম তাঁর জন্য নয়। কী রকম ভয়াবহ স্ববিরোধিতা! তিনি বলেন জীবনের ব্রত আমি জানি; সংকীর্ণ দেশপ্রেম আমার নয়। আমি যেমন ভারতের, তেমনি সমগ্র জগতের। বিবেকানন্দ আরও বলেন,‘সমগ্র মানবজাতির আধ্যাত্মিক রূপান্তর ইহাই ভারতীয় জীবন সাধনার মূলমন্ত্র, ভারতের চিরন্তন সংগীতের মূল সুর; ভারতীয় সত্তার মেরুদণ্ডস্বরূপ, ভারতীয়তার ভিত্তি, ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান প্রেরণা ও বাণী’। স্বভাবতই দেখা যাচ্ছে, বিবেকানন্দ যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার করেছিলেন তার মূলে ছিল এক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি।

সুতরাং, সন্দেহের অবকাশ থাকে না জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে ধর্মকেই বিবেকানন্দ জাতীয় জীবনের প্রাণশক্তি বলে বিশ্বাস করতেন। ধর্মকেই তিনি জাতীয় জীবন-সংগীতের প্রধান সুর বলে উল্লেখ করেছেন এবং সেই কারণেই দেশের জনগণকে ধর্মের মাধ্যমেই সব কার্য করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, ‘মানবজাতির ভাগ্য গঠনের জন্য যতগুলি শক্তি কার্য করিয়াছে এবং এখনও করিতেছে, ওই সবের মধ্যে ধর্মরূপে অভিব্যক্ত শক্তি অপেক্ষা কোনো শক্তি নিশ্চয়ই অধিকতর প্রভাবশালী নয়। নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখার ব্যাপারে ঋষি কিংবা পুরুষদের বহু বিবাহকে তিনি প্রকারান্তরে সমর্থন করেন। তিনি ধর্মীয় মুনি ঋষিদের বহু বিবাহের পক্ষে পর্যন্ত কথা বলেছেন। তিনি বলেন, মহাপুরুষেরা প্রত্যেকে দুইশত পত্নী গ্রহণ করিতে পারেন। আপনাদের মতো ‘দৈত্য’-কে এক পত্নী গ্রহণ করিতেও আমি অনুমতি দিব না। মহাপুরুষদের চরিত্র রহস্যাবৃত। তাঁহাদের কার্যধারা দুর্জ্ঞেয়। তাঁহাদের বিচার করিতে যাওয়া আমাদের অনুচিত। তিনি স্পষ্টভাবে ধর্মীয় নেতা বা ঋষিদের সকল ক্রিয়াকর্মকেই আধ্যাত্মিকতা বলে চালাতে দ্বিধা করেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সঠিকভাবেই বলেন, বিবেকানন্দের মৌল দার্শনিক প্রত্যয় ও তা থেকে উদ্ভূত তাঁর সমাজচিন্তার বহু গুরুতর সীমাবদ্ধতা আছে নিশ্চয়। সেই কারণে তাঁর সমাজচিন্তা এ যুগের দুঃখী মানুষের জীবনদর্শনে পরিণত হতে পারেনি। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মন্তব্য করেন যে, তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তা ছিল ‘আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যবাদ’। কারণ তিনি চাইতেন, বিশ্বের দরবারে ভারতের অধ্যাত্মভাবনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে; তাঁর বিশ্বাসে যা সমগ্র বিশ্বকে পথের নিশানা দিতে সক্ষম। বিবেকানন্দ একদিকে সাম্রাজ্যবাদের সমালোচনা করেছেন, ঠিক আবার নিজের বিশ্বাস বা ধর্মটা সারা পৃথিবীর উপরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। তিনি তখন মনে করতেন বেদ বা হিন্দু ধর্মই সারাবিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। 

বিবেকানন্দের বিশ্বাস জন্মে ছিল যে, জনগণের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ওপর কোনো জাতির বা দেশের মঙ্গল নির্ভর করে। বিবেকানন্দ মানুষ তৈরির জন্য যে শিক্ষার কথা বললেন, সেই শিক্ষা ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। বিবেকানন্দের বিশ্বাস, শিক্ষা ও ধর্মকে একাত্ম করে দেখতে হবে। কারণ, ‘শিক্ষা হচ্ছে, মানুষের ভিতর যে পূর্ণতা প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ। ধর্ম হচ্ছে মানুষের ভিতর যে ব্রহ্মত্ব প্রথম থেকেই বিদ্যমান, তারই প্রকাশ।’ বিবেকানন্দের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে যেটি প্রাসঙ্গিক তা হলো, নিজে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হবার জন্য পাশ্চাত্য জগতের রাজনৈতিক ভাবনা বা মতবাদসমূহকে তিনি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেননি। বস্তুতপক্ষে তাঁর স্বাধীনতার ধারণা ভারতের সনাতন আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বাধীনতার ধারণার পিছনে যে শক্তিটি কার্য করে সেটি হল ব্রহ্ম। বিবেকানন্দের মতে, অতীতেও ভারতে গরিমা ও প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল আধ্যাত্মিক পথেই। তিনি সেই আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। রাজনারায়ণ বসু, বঙ্কিমচন্দ্র আর অরবিন্দের চিন্তার সাদৃশ্য দেখা যায় বিবেকানন্দের সঙ্গে। তিনি বেদান্তকে ভিত্তি করে শিক্ষা, ধনার্জন, কর্ম প্রভৃতির অধিকারের কথা বলেছেন।

দুই

বিবেকানন্দের বেশির ভাগ লেখা ইংরেজিতে, সামান্য কিছু বাংলায়। বাংলা লেখার মধ্যে একটি ‘স্ত্রী-শিক্ষা’। তিনি এই প্রবন্ধে স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে জোরালোভাবে কথা বলেছেন। বিবেকানন্দকে তাই খুব প্রগতিশীল মানুষ বলেই প্রথমে ভ্রম হতে পারে। তিনি স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ভারতের অধঃপতন হইল, ভট্টাচার্য-ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণতর জাতিকে যখন বেদপাঠের অনধিকারী বলিয়া নির্দেশ করিলেন, সেই সময়ে মেয়েদেরও সকল অধিকার কাড়িয়া লইলেন।’ বিবেকানন্দ নারীর সেই অধিকার পুনরায় ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। ভারতীয় নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন। তিনি নারীদের কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে চাইছেন সেটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাচীন বৈদিক ধর্মের শিক্ষায় তিনি নারীদের শিক্ষিত করে তুলতে চান। হিন্দুত্বের জাগরণবাদী বিবেকানন্দ চাইছেন, ভারতের সকল নারী হবে সীতার মতো পবিত্র। তিনি রাখ ঢাক না করে খুব স্পষ্ট করেই এ কথা বলেছেন যে, তাঁর কাম্য নারীরা হবেন সীতা সমতুল্য। প্রত্যেক ভারতীয় নারীকে ‘সীতা’র চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার জন্যই শিক্ষা দিতে হবে। বিবেকানন্দের ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, ১৯০০ সালে বিবেকানন্দ পাসাডেনা শেক্সপিয়ার ক্লাবে রামায়ণ এবং মহাভারত সম্পর্কে দুটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। রামায়ণ সম্পর্কে বক্তৃতার উপসংহারে বলেছিলেন, ‘রাম এবং সীতা ভারতীয় জাতির আদর্শস্বরূপ। নারীর শ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষাই হলো সীতার মতো পবিত্র, পতিপরায়ণা এবং সর্বংসহা হওয়া। সমগ্র জাতির সামনে সীতা দুঃখসহনশীলতার আদর্শস্বরূপা।’ তিনি বলেন, সীতার চরিত্রচিত্রণে যে সর্বংসহা, বিনা প্রতিবাদে স্বামীর আদেশে সমস্ত দুঃখ বহনের প্রবণতা দেখানো হয়েছে পতিকেন্দ্রিক জীবনাদর্শেরই চিত্র ফুটে উঠেছে। পুরুষই শক্তির কেন্দ্র, নারীর ইচ্ছা তার অনুগত।

বিবেকানন্দ লিখেছেন, ‘ভারতীয় রমণীগণের যেরূপ হওয়া উচিত, সীতা তাহার আদর্শ; রমণীচরিত্রের যতপ্রকার ভারতীয় আদর্শ আছে, সবই এক সীতা-চরিত্রেই আশ্রিত; আর সমগ্র আর্যাবর্তভূমিতে এই সহস্র বর্ষ ধরিয়া তিনি এখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার পূজা পাইয়া আসিতেছেন। মহামহিমময়ী সীতা স্বয়ং শুদ্ধ হইতেও শুদ্ধতরা, সহিষ্ণুতার চূড়ান্ত আদর্শ সীতা চিরকালই এইরূপ পূজা পাইবেন। যিনি বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রদর্শন না করিয়া সেই মহাদুঃখের জীবন যাপন করিয়াছিলেন, সেই নিত্যসাধ্বী নিত্যবিশুদ্ধস্বভাবা আদর্শপত্নী সীতা..। ভারতীয় নারীগণকে সীতার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া আপনাদের উন্নতিবিধানের চেষ্টা করিতে হইবে। ইহাই ভারতীয় নারীর উন্নতির একমাত্র পথ।’ কট্টর মোল্লার মতো বিবেকানন্দ নারীর উন্নতির একমাত্র পথ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, বিবেকানন্দের মতে নারীর উন্নতির আর কোনো পথ থাকতে পারে না। তিনি লিখেছেন, ‘সব পুরাণ নষ্ট হইয়া যাইতে পারে, এমনকি আমাদের বেদ পর্যন্ত লোপ পাইতে পারে, আমাদের সংস্কৃতভাষা পর্যন্ত চিরদিনের জন্য কালস্রতে বিলুপ্ত হইতে পারে, কিন্তু আমার বাক্য অবহিত হইয়া শ্রবণ কর, যতদিন পর্যন্ত ভারতে অতিশয় গ্রাম্যভাষাভাষী পাঁচজন হিন্দুও থাকিবে, ততদিন পর্যন্ত সীতার উপাখ্যান থাকিবে। সীতা আমাদের জাতির মজ্জায় মজ্জায় প্রবিষ্ট হইয়াছেন, প্রত্যেক হিন্দু নরনারীর শোণিতে সীতা বিরাজমানা।’ 

বিবেকানন্দের কথার মধ্যে সবজান্তার ভাব এবং স্পষ্ট পুরোহিতের কর্র্তৃত্বকামী সুর। তিনি বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, তিনি যা বলছেন তা বেদবাক্য, তার নড়চড় হতে পারে না। তিনি সব ইতিহাস জেনে বসে আছেন। কট্টর চিন্তার ধারক আর কাকে বলে! কিন্তু তিনি ভয়াবহ কট্টর হলেও ভারতবর্ষের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত বিরাট জ্ঞানী এবং শ্রদ্ধাশীল মানুষ। ভারতীয় মার্কসবাদীদের কাছে, এমনকি ভারতের শিক্ষিত নারীদের কাছে এ হেন বিবেকানন্দ একজন আদর্শ চরিত্র। সবাই প্রায় তাঁর মহিমা প্রচারে ব্যস্ত। ভারতবর্ষে যেসব মানুষ হিন্দু ধর্মের জয়গান গেয়েছে, তারাই সবচেয়ে শ্রদ্ধাশীল মানুষ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গান্ধী আর সাভারকারের নাম একইভাবে সত্য। স্বয়ং গান্ধী রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আর গো-রক্ষা করার আন্দোলনে যোগ দেয়ার পরেও, কংগ্রেসের প্রধান নেতা ছিলেন। গান্ধীর তথাকথিত গো-রক্ষা আন্দোলনের জন্য ভারতবর্ষে হাজার হাজার দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। তবুও গান্ধী কখনো ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া বলে পরিচিত নন। ভারতে বিজেপি আজ যা করছে, আরো অনেকের সঙ্গে মিলে গান্ধী তার বীজ রোপণ করে গেছেন; কিন্তু মুসলমানরা যখন কট্টর আচরণ করে তখন তাদের নামে তকমা লেগে যায়। মুসলমানরা তখন জঙ্গি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান, জঙ্গি মুসলমানদের সমর্থন করার সামান্য কারণ নেই। খুব সত্যি কথা যে, জঙ্গি বা কট্টর মুসলমানরা ইতিহাসকে পিছনে নিয়ে যেতে চাইছে। সর্বদা তাদের সমালোচনা করবে প্রগতিশীল মানুষ সেটাই সঠিক পথ; কিন্তু বাকিরা কেন সমালোচিত হবে না? মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় নেতারা যদি কট্টর চিন্তার জন্য দায়ী হয়, ঘৃণিত হয়-ভিন্ন ধর্মের লোকরা তা হবে না কেন? 

বিবেকানন্দ তাঁর প্রবন্ধে আর কী বলেছেন? তিনি ধারণা দিচ্ছেন, ‘ভারতীয় রমণীগণ সর্বাপেক্ষা উচ্চ আকাঙ্ক্ষা-পরমবিশুদ্ধস্বভাবা, পতিপরায়ণা, সর্বংসহা সীতার ন্যায় হওয়া। সমগ্র ভারতবাসীর সমক্ষে সীতা যেন সহিষ্ণুতার উচ্চতম আদর্শরূপে বর্তমান রহিয়াছেন। সীতা যেন ভারতীয় ভাবের প্রতিনিধিস্বরূপা, যেন মূর্তিমতী ভারতমাতা। ...নারীগণের মধ্যে আমরা যে ভাবকে নারীজনিত বলিয়া শ্রদ্ধা ও আদর করিয়া থাকি, সীতা বলিতে তাহাই বুঝাইয়া থাকে।’ তিনি বলছেন, ‘জাতির জীবনে পূর্ণ ব্রহ্মচর্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে প্রথমত বৈবাহিক সম্বন্ধকে পবিত্র ও বিচ্ছেদহীন করিতে হইবে... হিন্দুগণ বিবাহকে পবিত্র ও অবিচ্ছেদ্য করিয়া বহু শক্তিশালী স্ত্রী-পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছেন। আরবদের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি চুক্তি, বলপূর্বক একটি অধিকারমাত্র। উহা ইচ্ছামতো ভাঙিয়া দেওয়া যাইতে পারে। সুতরাং আমরা তাহাদের মধ্যে ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মচারিণীর আদর্শ পাই না। ...ব্রহ্মচারী ব্রহ্মচারিণী সৃষ্টির জন্য সর্বসাধারণের বৈবাহিক জীবনকে পুণ্যময় করিয়া তোলা আবশ্যক। এদেশে প্রত্যেক বালিকাকে সাবিত্রীর ন্যায় সতী হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে-মৃত্যুও তাঁহার প্রেমের নিকট পরাভূত হইয়াছিল। তিনি ঐকান্তিক প্রেম-বলে যমের নিকট হইতেও নিজ স্বামীর আত্মাকে ফিরাইয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। 

বিবেকানন্দ বিবাহকে দু’পক্ষের চুক্তি বলে মানতে নারাজ। তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ চান না। তিনি চান সতী সাধ্বী রমণী, যিনি স্বামীর অবাধ্য হবেন না। স্বভাবতই বিবাহ বিচ্ছেদের তাহলে আর কারণ থাকে না। তিনি নারীদের শিক্ষা দিতে চান ভবিষ্যতে একান্ত বাধ্যগত পতিপরায়ণা হবার জন্য বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ যখন আর সমাজে থাকবে না। যিনি স্বামীর সঙ্গে চুক্তি করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন না-বিবাহ করবেন পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ দ্বারা। বিবেকানন্দ আস্ফালন করে যাই বলুন, ভারতীয়রা শেষপর্যন্ত তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। বাস্তবতার পথ ধরে হেঁটেছে। বিবেকানন্দের দুর্ভাগ্য যে, ভারতে বিয়ে এখন একটা চুক্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ করার আইন আছে। ফলে ভারতীয়রা আরবদের অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে-ধর্মের বন্ধন শিথিল করার জন্য। ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করেই অধিক বিবাহ হচ্ছে-কিন্তু তারা কেউ সীতা নন। বিবাহের সময় তাদের চুক্তি করবার অধিকার রয়েছে আর সেই সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের। ভারতীয়রা বিবেকানন্দের আদর্শের চেয়ে আরবদের আদর্শকে সুবিধাজনক বা প্রগতিশীল মনে করেছে। নারীর সম্পত্তির অধিকার পর্যন্ত স্বীকার করা নেওয়া হয়েছে ভারতীয় আইনে। বিবেকানন্দের কট্টর মত গ্রহণ না করলেও তাঁরা আবার বিবেকানন্দকে অন্ধের মতোই মহান বলে গ্রহণ করেছেন। এটাই হলো ইতিহাসের এক দ্বান্দ্বিক শিক্ষা।

বিবেকানন্দ কীরকম গোঁড়া ছিলেন তাঁর এই প্রবন্ধের প্রতিটি বাক্যে তা স্পষ্ট। নারীর স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করতেন না, না নারীর সমান হওয়ার অধিকারে। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র নারীর ‘সীতা’ হয়ে ওঠায়-আর মহামানব বিবেকানন্দ নারীকে সেইটুকুই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েদের একটা শিক্ষা তো সহজে দেওয়া যাইতে পারে-হিন্দুর মেয়ে সতীত্ব কী জিনিস তাহা সহজেই বুঝিতে পারিবে; ইহাতে তাহারা পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত কিনা! প্রথমে সেই ভাবটাই তাহাদের মধ্যে উসকাইয়া দিয়া তাহাদের চরিত্র গঠন করিতে হইবে-যাহাতে তাহারা বিবাহিত হউক, বা কুমারী থাকুক, সকল অবস্থাতেই সতীত্বের জন্য প্রাণ দিতে কাতর না হয়।’ তিনি লিখেছেন, ‘নারীদিগের সম্বন্ধে আমাদের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া পর্যন্ত; নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্র্জন করাইতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই নিজেদের ভাবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে।’ ‘সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা-ইঁহাদের জীবন চরিত্র মেয়েদের বুঝাইয়া দিয়া তাহাদের নিজেদের জীবন ওইরূপে গঠিত করিতে হইবে।’ বিবেকানন্দ নারীদের স্বাধীনভাবে শিক্ষিত হতে দিতে চান না, তিনি তাদের ছাঁচে ফেলে সেই মাপে গড়ে তুলতে চান। নারীদের সেই শিক্ষা দেবার লক্ষ্যে তিনি মঠস্থাপন করতে চান। সুভাষ বিশ্বাস লিখেছেন, বিবেকানন্দ নারীদের পরিচালনায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। তিনি বলেন পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে আগে মাতা ও তাঁর কন্যারা, তারপরে পিতা ও পুত্রেরা। তিনি সেই সঙ্গে বলেন পাশ্চাত্যে নারীকে স্ত্রী হিসেবে দেখা হয়, ভারতে নারীকে মা হিসেবে দেখা হয়। বিবেকানন্দ নারীকে মা হিসেবেই দেখতে চান, স্ত্রী হিসেবে নয়।

মঠস্থাপন সম্পর্কে বিবেকানন্দ কী বলেছেন? তিনি লিখেছেন, গঙ্গার ওপারে একটা প্রকাণ্ড জমি লওয়া হইবে। তাহাতে অবিবাহিতা কুমারীরা থাকিবে, আর বিধবা ব্রহ্মচারিণীরা থাকিবে; আর ভক্তিমতী গৃহস্তের মেয়েরা মধ্যে মধ্যে আসিয়া অবস্থান করিতে পারিবে। এই মঠে পুরুষদের কোনোরূপ সংস্রব থাকিবে না। পুরুষ মঠের বয়োবৃদ্ধ সাধুরা দূর হইতে স্ত্রী-মঠের কার্যভার চালাইবে।, ..জপ, ধ্যান, পূজা-এইসব তো শিক্ষার অঙ্গ থাকিবেই। যাহারা বাড়ি ছাড়িয়া একেবারে এখানে থাকিতে পারিবে, তাহাদের অন্নবস্ত্র এই মঠ হইতে দেওয়া হইবে। ..মেয়েদের ব্রহ্মচর্যকল্পে এই মঠে বয়োবৃদ্ধা ব্রহ্মচারিণীরা ছাত্রীদের শিক্ষার ভার লইবে। এই মঠে ৫/৭ বৎসর শিক্ষার পর মেয়েদের অভিভাবকরা তাহাদের বিবাহ দিতে পারিবে। যোগ্যাধিকারিণী বলিয়া বিবেচিত হইলে অভিভাবকদের মত লইয়া ছাত্রীরা এখানে চিরকুমারী-ব্রতাবলম্বনে অবস্থান করিতে পারিবে। যাহারা চিরকুমারী-ব্রত অবলম্বন করিবে, তাহারাই কালে এই মঠের শিক্ষয়িত্রী ও প্রচারিকা হইয়া দাঁড়াইবে এবং গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে শিক্ষাকেন্দ্র খুলিয়া মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারে সহায়তা করিবে।’ বিবেকানন্দের শিক্ষাবিস্তার মানে সীতার সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা। বিবেকানন্দ আশা করেন সারা ভারতের রমণীরা সকলে ‘সীতা’ হয়ে যাক। মুসলমান অনেক কট্টর ধর্মীয় নেতারা যেমন নারীর আদর্শ হিসেবে নবীর স্ত্রী ‘আয়েশা’র উদাহরণ দেন, বিবেকানন্দের কাছে নারীর উদাহরণ মানে সীতা। দুপক্ষের চিন্তায় রয়েছে নানারকম মিল, নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের পক্ষে সেগুলিকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের মোল্লাদের সঙ্গে সেখানে নারীর জীবন যাপন প্রশ্নে বিবেকানন্দের পার্থক্য কোথায়? দু’পক্ষই শেষবিচারে নারীকে পতিপরায়ণ, সতীসাধ্বী এবং সর্বংসহা বলে মনে করেন। বিবেকানন্দের কাছে নারী কখনো পুরুষের সমান নয়।

বিবেকানন্দ ভারতের নারীদের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ সীতা-সাবিত্রীর দেশ, পুণ্যক্ষেত্র ভারতে এখনও মেয়েদের যেমন চরিত্র, সেবাভাব, স্নেহ, দয়া, তুষ্টি ও ভক্তি দেখা যায়, পৃথিবীর কোথাও তেমন দেখিলাম না। পাশ্চাত্যে মেয়েদের দেখিয়া আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলিয়াই বোধ হইতো না-ঠিক যেমন পুরুষ মানুষ। গাড়ি চালায়, অফিসে যায়, স্কুলে যায়, প্রফেসারি করে! একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা বিনয় দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়।’ বিবেকানন্দ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, নারী পুরুষের মতো গাড়ি চালাবে, চাকরি করবে, অধ্যাপনা করবে তা নারীর আদর্শ হতে পারে না। নারী হবে লজ্জাবনত। বিবেকানন্দের চরিত্রের কিছুটা স্ববিরোধিতা এখানে ধরা পড়বে। তিনি প্রবন্ধটির শুরুতে নারীর অবস্থার কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। তিনি দেখিয়েছেন নারীরা সেখানে কতো ভালো আছে। তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেই দেশে দরিদ্র একরূপ নাই বলিলেই চলে এবং অন্য কোথাও মেয়েরা ওই দেশের মেয়েদের মতো স্বাধীন, শিক্ষিত ও উন্নত নহে। ইহাদের রমণীগণ সকল স্থানের রমণীগণ অপেক্ষা উন্নত। মহিলাগণ সমুদয় জাতীয় উন্নতির প্রতিনিধিস্বরূপ। পুরুষেরা কার্যে অতিশয় ব্যস্ত বলিয়া শিক্ষায় তত মনোযোগ দিতে পারে না। মহিলাগণ প্রত্যেক বড়ো বড়ো কার্যের জীবনস্বরূপ।..হাজার হাজার মেয়ে দেখিয়াছি। সকল কাজ তাহারাই করে। স্কুল, কলেজ মেয়েতে ভরা। আমাদের পোড়া দেশে মেয়েদের পথ চলিবার উপায় নেই।’ প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের সর্বস্তরে দায়িত্ব পালন করার প্রশংসা করেছেন, পরক্ষণে তিনি মনের গোপন কথাটা বলে দিয়েছেন, তেমন নারী তিনি ভারতে দেখতে চান না। তিনি চান সীতাকে, সীতার প্রতিমূর্তি গড়তে চান তিনি ভারতে।

বিবেকানন্দ বহু কিছু বলেছেন যা প্রথম বিচারে মনে হবে মহৎ বাণী। তিনি ভারতের দরিদ্র মানুষ বা নিম্নশ্রেণির মুক্তির কথা বলেছেন। দরিদ্র মানুষের শিক্ষার কথা বলেছেন; কিন্তু শিক্ষা বলতে তিনি প্রধানত বুঝতেন আধ্যাত্মিক শিক্ষা, বেদ বেদাঙ্গ সম্পর্কে শিক্ষা। বিবেকানন্দ নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে মাতৃরূপে পূজা করার কথা বলেছেন। সত্যি বলতে তাঁর এসব বক্তব্যের পিছনে ছিল চরম আবেগ, হিন্দুত্বের আবেগ। যুক্তিবোধ বা আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না। তিনি নারীর পক্ষে খুব জোর গলায় বলছেন, ‘যাহারা বিশুদ্ধভাবে, সাত্ত্বিকভাবে, মাতৃপূজা করিবে, তাহাদের কী কল্যাণ না হইবে?..শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু নারীপূজা বলিতে বুঝিতেন, সব নারী সেই আনন্দময়ী মা ব্যতীত কিছুই নহেন-তাঁহারই পূজা।..ইহাই আমাদের প্রয়োজন। মেয়েদের পূজা করিয়াই সব জাতি বড় হইয়াছে। যে দেশে, যে জাতিতে মেয়েদের পূজা নাই, সে দেশ, সে জাতি কখনও বড় হইতে পারে নাই, কস্মিনকালে পারিবে না।’ বিবেকানন্দের এ কথাগুলো নতুন কিছু নয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কট্টর নেতা মনু ঠিক একথাগুলিই বলেছিলেন। বিবেকানন্দ তা নকল করেছেন মাত্র। 

মনু বলেছিলেন, ‘যেখানে নারীরা পূজিত হন না, সেখানে দেবগণ তুষ্ট হন না। নারীকে তুষ্ট না করলে সর্ব কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। নারী অসম্মানিতা হয়ে অভিশাপ দিলে সব দিক বিনষ্ট হয়।’ কিন্তু সমগ্র মনু সংহিতায় নারী বন্দনার এই শ্লোকের কোনো প্রতিফলন নেই। মনু নারীকে কোনো রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি। নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। স্বামী বা পুরুষকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন-‘স্ত্রীলোকদের দিনরাত পরাধীন রাখবে। স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। স্ত্রীলোক কুমারী জীবনে পিতার, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে।’ মনুর বিধানে নারীর নিজের দেহের ওপর তার নিজের কোনো অধিকার ছিল না। মনু নারীর স্বভাবকে খুব মন্দ করে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নারীর স্বভাবই হলো পুরুষদের দুষিত করা।’ মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে, তিনি বিধান দিয়েছেন-মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না। নারী আর পুরুষের মধ্যে যৌনসম্পর্ক গড়ে ওঠার দায় তিনি চাপিয়েছেন নারীর স্বভাবের ওপর। পুরুষকে তিনি দায়মুক্ত করে রেখেছেন। 

মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার। মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্য বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক। মনু নারীকে শিক্ষা লাভের অধিকার দেননি। তিনি বলেছেন, দ্বিজরা শিখতে পারবে-যারা উপনয়ন গ্রহণের মধ্য দিয়ে দ্বিজ হয়েছেন। নারী এবং শূদ্রদের জন্য মনু উপনয়ন এবং শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নারী শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে না। বিবেকানন্দ নারীকে শিক্ষার অধিকার দিয়েছেন, সে কারণে মনে হতে পারে তিনি বিপ্লবী। মনে হতে পারে নারীর অধিকারের প্রশ্নে তিনি মনুর বিধানকে উল্টে দিয়েছেন। বাস্তবে নারী শিক্ষা বলতে তিনি যা বুঝিয়েছেন, ঠিক তা মনুর বিধানের সঙ্গেই মানানসই। নারীকে পুরুষের অধীনতা মানবার শিক্ষাদানের কথা তিনি বলেছেন। তিনি শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে নারীকে পতিপরায়ণা বা ধর্মপ্রচারের পুরোহিত বানিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নারীকে তিনি বিয়ে করে সংসারধর্ম পালন করার চেয়ে বৈরাগ্য পালনে অধিক উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি নারীর বৈরাগ্য পালনকে ধর্মরক্ষার পথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

তিনি সবার আগে স্থান দিয়েছেন ধর্মকে, ধর্র্ম মানে বৈদিক ধর্র্ম। তিনি লিখেছেন, ‘শিক্ষাই বলো আর দীক্ষাই বলো ধর্মহীন হলে তাতে গলদ থাকবেই। ধর্ম ভিন্ন অন্য শিক্ষাটা গৌণ হবে। ধর্মশিক্ষা, চরিত্রগঠন, ব্রহ্মচর্য-ব্রতোদ্যাপন-এই জন্য শিক্ষার দরকার। বর্তমানে ভারতে যে স্ত্রী শিক্ষা দেওয়া হয় তাতে ধর্মটাকে গৌণ করে রাখা হয়েছে-সে জন্যই শিক্ষার মধ্যে নানারকম দোষ দেখা দিয়েছে। স্ত্রীদের তাতে দোষ নেই, সংস্কারকেরা নিজে ব্রহ্মজ্ঞ না হয়ে স্ত্রী শিক্ষা দিতে অগ্রসর হওয়াতে এরকম দোষ ঘটেছে। আমি ধর্মকেই শিক্ষার সার বলে মনে করি।’ খুব স্পষ্ট বিবেকানন্দের বক্তব্য, তিনি ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা চাচ্ছেন না-তিনি চান ধর্মীয় শিক্ষা। বিবেকানন্দ যে কোনো বিচারেই একজন কট্টর ধার্মিক বা ধর্মান্ধ; বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মান্ধদের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর সামান্য পার্থক্য নেই। ধর্মান্ধদের মতো নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করাই তাঁর প্রধান কাজ। নিজধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমি পুরুষগণকে যাহা বলিয়া থাকি, রমণীগণকেও ঠিক তাহাই বলিব। ভারত এবং ভারতীয় ধর্মে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা স্থাপন কর; তেজস্বিনী হও, আশায় বুক বাঁধ; ভারতে জন্ম বলিয়া লজ্জিত না হইয়া উহাতে গৌরব অনুভব কর; আর স্মরণ রাখিও, আমাদের অপরাপর জাতির নিকট হইতে কিছু লইতে হইবে বটে, কিন্তু জগতের অন্যান্য জাতি অপেক্ষা আমাদের সহস্রগুণে অপরকে দিবার আছে। দেশীয় নারী দেশীয় পরিচ্ছদে ভারতের ঋষিমুখাগত ধর্ম প্রচার করিলে, আমি দিব্যচক্ষে দেখিতেছি এক মহান তরঙ্গ উঠিবে যাহা সমগ্র পাশ্চাত্যভূমি প্লাবিত করিয়া ফেলিবে। বিবেকানন্দের সঙ্গে বাংলার ধর্মান্ধদের চিন্তার সামান্য পার্থক্য আছে কি? নিজধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করেই তিনি ক্ষান্ত নন, তিনি সারা পাশ্চাত্যভূমিকে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করাতে চান। 

রামমোহন এবং তার পরবর্তী যুগটা ছিল হিন্দুত্ব বা বৈদিক যুগ নিয়ে গর্ব করা, প্রাচীন ভারতের সবকিছুকে বড় করে দেখা আর তথাকথিত হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের যুগ। কারণ আসলে ভারতে ‘হিন্দু’ বলে কোনো ধর্ম ছিল না, বৈদিক ধর্মকে তাঁরা হিন্দু নামকরণ করেছিলেন। 

কথাটা হলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যদি তৎকালীন বাংলার প্রগতিশীলতার লক্ষণ হয়, মুসলমানদের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কেন প্রতিক্রিয়াশীলতা হবে? সন্দেহ নেই, রামমোহন-বিবেকানন্দদের সঙ্গে মুসলমানদের ধর্মীয় বাড়াবাড়ির সামান্য পার্থক্য রয়েছে। রামমোহনরা একদিকে বিজ্ঞানচর্চা কথা বলে ভিন্ন দিকে ধর্মের পরিচয়কেই বড় করে তুলেছিলেন। ইংরেজদের কাছ থেকে পাওয়া পাশ্চাত্যের সব আধুনিকতার সুবিধা নিতে ছাড়েননি, পাশাপাশি ধর্মীয় বিলাসিতা বাদ দেননি। নিশ্চয় সে বিচারে তাঁরা কিছুটা ভিন্ন পথের লোক। বাংলাদেশের বর্তমান কট্টরপন্থিরা ধর্মের জন্য বিজ্ঞানের সব সুফল বাতিল করার পক্ষে, রামমোহন আর বিবেকানন্দরা তা করেননি। রামমোহন-বিবেকানন্দরা ইংরেজি শিখেছেন, খ্রিস্টানদের জগতে গিয়ে নিজেদের বাণী প্রচার করেছেন। পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেননি। বাংলাদেশের বর্র্তমান কট্টরপন্থিরা নিজেদের দৃষ্টিটা কল্পিত আরবমুখী করে রেখেছেন। যদিও আরব-বিশ্ব ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের সবটুকু গ্রহণ করছে, নিজেদের ক্রমশ পাল্টে ফেলছে। দ্রুতই আরব বিশ্ব পাল্টে চলেছে, বাংলাদেশের কট্টর মুসলমানরা নিজেদের পাল্টাবার কথা ভাবতেই পারছে না। বিবেকানন্দ সেখানে সুন্দর সুন্দর কথা বলে নিজেকে প্রগতিশীল প্রমাণ করে, সবশেষে কট্টর ভঙ্গিতে ফিরে যাচ্ছেন বেদান্তের কাছে।

রামমোহন বিবেকানন্দের সময়টা নিয়ে গোপাল হালদার খুব চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, বিশেষ সত্য লক্ষণীয় এই যে, উনিশ শতকের বাংলা সংস্কৃতির কাঠামোই হিন্দু, তার প্রাণ কিন্তু বুর্জোয়া সংস্কৃতির। মধুসূদনের কথাতো নেই, বঙ্কিমও প্রাণপণে চাইছেন মিল, কোৎ-এর বাণীকে স্বদেশীয় কায়দায় রূপ দিতে। বুর্জোয়া সভ্যতার মূল সত্য কথা হলো মানবতাবাদ-ধর্মতত্ত্বের ভিতরে বঙ্কিম পাশাপাশি উপন্যাসে, প্রবন্ধে ধরতে চেয়েছেন এই সত্যকে-মানবতাবাদকে পুরতে চাইছেন ‘হিন্দু কাঠামোতে’। বুর্জোয়া প্রাণশক্তিকে বাঁধতে চেয়েছেন তাঁরা হিন্দুত্বের গৌরবের ভিতরে। ব্রাহ্ম ও উদারনৈতিক সংস্কারবাদীরা এ কাঠামোকে ততটা গুরুত্ব দিতেন না। তাঁদের ধর্ম আন্দোলন ও কর্ম আন্দোলনে তা অনেকটা স্পষ্ট; কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা চাইতেন সেই জাতীয় আধারকে হিন্দু আধারে নতুন প্রাণ সঞ্জীবিত করতে। মূলত সবকিছুর পর সেটা ছিল হিন্দুত্বের পক্ষে তরবারি ধরা। রাজনারায়ণ বসু খুব সম্মানিত মানুষ অবিভক্ত বাংলার। হিন্দুত্বের পক্ষে তিনি ‘সে কাল আর এ কাল’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি বিলাতে যাইবার প্রতিপক্ষ নহি। বিলাতে যাইলে অনেক উপকার আছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, যাঁহারা বিলাত হইতে ফিরিয়া আইসেন, তাঁহারা হিন্দু সমাজের সহিত একেবারে সম্বন্ধ পরিত্যাগ করেন।’ সামান্য পরেই তিনি লিখেছেন, ‘কী এত মূঢ় হইয়াছি যে, ভারতমৃত্তিকার মঙ্গলপ্রসূনস্বরূপ ব্রাহ্মপ্রতিপাদক বেদ বেদান্ত উপনিষদাদি শাস্ত্র ত্যাগ করিব? এই সকল ধর্মভাব, এই সকল ব্রাহ্মজ্ঞানশাস্ত্র, যাহারা গুরু ভাবের সহিত শতকোটি বাইবেল, ইঞ্জিল, তওরেৎ, জবুর, কোরআন ও আবেস্তা এবং র্পার্ক, নিউম্যান, কান্ট, কুজিন 

প্রভৃতির স্তূপায়মান সমতুল্য হয় না, তাহাতে আমাদের যে আত্মীয় ও স্বজাতীয় এই দ্বিবিধ অধিকার যুগপৎ আছে, তাহা মনে করিলেও পিতামহ পুরাণ পরমেশ্বরকে শত শত ধন্যবাদ প্রদান করিতে হয়।’ 

লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে, রাজনারায়ণ অতীতকে বড় করে দেখেছেন যখন বেদ বেদান্তের প্রচুর চর্চা হতো। তিনি আরো বলছেন, বেদ বেদান্তের সমতুল্য আর কোনো গ্রন্থ নেই। তিনি কান্ট বা অন্যান্য মনীষীদের দর্শনকে পর্যন্ত বেদ-এর কাছে স্থান দিতে রাজি নন। তিনি তার পরের পঙ্ক্তিতেই লিখেছেন, ‘উল্লিখিত মহাশাস্ত্র সকলকে মূল করিয়া ধর্মসংস্কার কার্যে আমাদিগের প্রবৃত্ত হওয়া কর্তব্য। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের এমন কার্য নাই, উহার সম্বন্ধীয় এমন একটি বিশুদ্ধ মত নাই, যাহার প্রমাণ আমাদিগের শাস্ত্রে না পাওয়া যায়। ধর্ম বিষয়ে এমন একটি সদুপদেশ নাই, যাহা আমাদিগের ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না; সমাজ সম্বন্ধে এমন একটি সুরীতি নাই, যাহা প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল না, এবং যাহা এক্ষণে হিন্দুভাবে প্রচার না করা যাইতে পারে। হিন্দুভাব রক্ষা করিয়া আমরা ধর্ম ও সমাজসংস্কার কার্যে প্রবৃত্ত হইলে, আমরা ওই কার্যে সুসিদ্ধ হইতে পারি।’ রাজনারায়ণ খুব জোরের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছেন। রাজনারায়ণের সেই প্রচারের ভাষা কি বাংলাদেশের মৌলবাদী মোল্লাদের চেয়ে সামান্য রকম আলাদা? বাংলাদেশের ধর্মীয় মোল্লারা মনে করেন তাদের ধর্মগ্রন্থে সব কিছু আছে, একই রকম দাবি করছেন রাজনারায়ণ বসু হিন্দুদের ধর্মীয়গ্রন্থ সম্পর্কে। দুপক্ষের চিন্তার মধ্যে তাহলে মৌলিক পার্থক্য কোথায় কতটুকু? রাজনারায়ণ কেন তাহলে প্রগতিশীল মানুষের তকমা পাবেন আর বাংলাদেশের মোল্লারা কেন প্রতিক্রিয়াশীল তকমা লাভ করবেন? বাংলাদেশের মোল্লাদের যদি প্রতিক্রিয়াশীল ভাবা হয়, রাজনারায়ণ কেন তবে সেই একই রকম বক্তব্য রাখার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল বলে প্রমাণিত হবেন না? তিনি বুর্র্জোয়া চিন্তার আলোকে আলোকিত হয়েও, ধর্ম-প্রশ্নে বাংলার মোল্লাদের চেয়ে আলাদা কিছু নন। ভারতের বিরাট আলোচিত মনীষী, বহু মানুষের পরম পূজনীয় বিবেকানন্দও ঠিক তাই। 

তিন

রামমোহনের সংকট তিনি যথেষ্ট আধুনিক হয়েও ধর্ম বর্জন করাকে ভ্রান্তি হিসেবে দেখেছেন। ব্রিটেনে যখন সমাজতন্ত্রী রবার্ট ওয়েনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে, তিনি ধর্মহীন সমাজতন্ত্র পছন্দ করতে পারেননি। রামমোহনই সম্ভবত প্রথম ভারতীয় যার সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রবাদীদের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটে; কিন্তু ধর্মহীন সমাজতন্ত্রকে তিনি বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, সমাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষার জন্য ধর্মের সমালোচনা প্রয়োজন নেই। তিনি মনে করেন, ধর্ম মানুষের মধ্যে অনেক বেশি বদান্যতা এবং সুখ বৃদ্ধি করতে সক্ষম। ভিন্ন দিকে বিবেকানন্দ নিজেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে দাবি করে বলেন, সমাজতন্ত্র পদ্ধতিকে তাঁর কাছে নিখুঁত বলে মনে হয়নি। বিবেকানন্দ যথেষ্ট আবেগে ভেসে গিয়ে বলেছিলেন-ভারত প্রথম ছিল ব্রাহ্মণদের শাসন, পরে ক্ষত্রিয়দের শাসন, আরো পরে বৈশ্যদের শাসন-এবার শূদ্র বা কায়িক শ্রমজীবীদের শাসনের পালা। শূদ্ররাই এর পরে ক্ষমতায় আসবে। সঙ্গে সঙ্গে বিবেকানন্দ এ কথাও বলেন, শূদ্র শাসন যুগের সুবিধা এই যে এ সময়ে শারীরিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিস্তার হবে, কিন্তু অসুবিধা এই যে, সংস্কৃতির অবনতি ঘটবে। সাধারণ শিক্ষার পরিসর বাড়বে বটে, কিন্তু সমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশই কমে যাবে। শুধু শূদ্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই সামাজিক সমতা আসবে না বা উন্নয়ন ঘটবে না। এর জন্য প্রয়োজন এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে ব্রাহ্মণ যুগের জ্ঞান, ক্ষত্রিয়ের সভ্যতা, বৈশ্যের সম্প্রসারণ শক্তি এবং শূদ্রের সাম্যের আদর্শ এই সবগুলো বিদ্যমান থাকবে এবং এদের মধ্যে কোনো পারস্পরিক বিরোধ থাকবে না। তিনি বলেন, সেই রাষ্ট্রে শূদ্রদের সাম্যের আদর্শ বজায় থাকবে কিন্তু শূদ্রদের দোষগুলো থাকবে না। তিনি মনে করেন, শূদ্রদের দোষগুলি দূর হবে ব্রাহ্মণযুগের জ্ঞান আর ক্ষত্রিয়যুগের সভ্যতা দিয়ে। বিবেকানন্দের সকল বক্তবের সমাপ্তিতে গিয়ে সার কথা হলো, ব্রাহ্মণ্যযুগ আর ক্ষত্রিয়সভ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে-এই হলো ভারতে বিবেকানন্দের সমাজতন্ত্র।

মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে গভীর অনুসন্ধানের পর বিবেকানন্দ এই বিশ্বাসের বশবর্তী হন যে সমাজতন্ত্রবাদ মানুষের সকল সমস্যা সমাধনের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সমাধান করতে পারে না। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রবাদের সঙ্গে বিবেকানন্দের সমাজতন্ত্রবাদের মৌলিক পার্থক্য ছিল। বিবেকানন্দ সেই পর্যন্তই সমাজতন্ত্রবাদকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত যখন সেটি অবহেলিত জনগণের দুঃখদুর্দশা মোচন করতে সক্ষম। মার্কসবাদ সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সর্বহারা বিপ্লবের দ্বারা সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের পক্ষপাতী। অন্যদিকে বিবেকানন্দ সমাজতন্ত্রকে স্বাগত জানালেও ব্যক্তির আত্মিক পূর্ণতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি এমন এক সমাজের পক্ষপাতী ছিলেন যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি তার মধ্যে স্বর্গীয় ধারণা অনুভব করতে সক্ষম হবে এবং স্বার্থহীনভাবে অন্যের জন্য কাজ করতে উদ্ব্দ্ধু হবে। বিবেকানন্দ কখনই শ্রেণী সংগ্রামের সমর্থক ছিলেন না। এই ধারণা কখনোই পোষণ করেননি যে হিংসাত্মক বিপ্লবের দ্বারা জনগণকে জাগ্রত করা সম্ভব। বিবেকানন্দের কাছে প্রকৃত বিপ্লব হল আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিপ্লব। তিনি মনে করেছিলেন, যদি ভারতীয় জনগনের মধ্যে সামাজিক ও শিক্ষাগত সাম্যকে জাগ্রত করা যায়, তাহলে উদ্বুদ্ধ জনগণের পক্ষে অর্থনৈতিক সাম্য আনা সহজতর হবে। বিবেকানন্দ ছিলেন পরিপূর্ণভাবে অধ্যাত্মবাদী, মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিক ভাবনার সঙ্গে তাঁর সমাজতন্ত্রের সাদৃশ্য খুঁজে পাবার প্রচেষ্টা নিরর্থক।

বিবেকানন্দের এইরকম সমাজতন্ত্র চাওয়া, শূদ্রদের ক্ষমতা দখলের কথা বলা-ভারতের বিদগ্ধ সমাজের বহুজন বিনাবিচারে তাঁর এসব বক্তব্যের কারণে তাঁকে প্রগতিশীল বানাতে চেয়েছেন; কিন্তু বিবেকানন্দের এই সমাজতন্ত্র বা শূদ্রদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার ঘোষণা ছিল শর্তযুক্ত। ভিন্ন দিকে সবটাই ছিল কাল্পনিক ভাবনা-যাকে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রও বলা চলে। তিনি বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী পুরনো ব্রাহ্মণদের জ্ঞান দিয়ে নতুন ক্ষমতাধর শূদ্রসমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। বিবেকানন্দ স্পষ্ট করেই বলেন, উচ্চশ্রেণিরা বিলীন হয়ে যাবে। তাই তাদের কর্তব্য হলো নিজের সমাধি খনন করা। যত শিগগির এ কাজ তারা করবে ততই মঙ্গল। বিবেকানন্দ চান ধনীরা শূদ্রদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিক; কিন্তু তিনি সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন, শূদ্রজাগরণের ফলে সমাজের নৈতিক মান নেমে যেতে পারে। শূদ্রজাগরণের ফলে জনসাধারণের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বাড়লেও শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও, তার ফলে একইসঙ্গে ‘সমাজের অসাধারণ প্রতিভাশালী ব্যক্তির সংখ্যা কমে আসবে।’ তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে যেখানে ‘শূদ্র বিপ্লব ঘটেছে’ সেখানেই ‘সাংস্কৃতিক মান’ নেমে গেছে। ভারতে যাতে শূদ্রশাসনের এই অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেজন্য তিনি সমগ্র দেশের ওপর দিয়ে ‘একটি আধ্যাত্মিক প্লাবন’ ঘটাতে চান। বিবেকানন্দ শূদ্রের উন্নয়ন চাইলেও ব্রাহ্মণের পতন কামনা করেননি। তিনি মনে করেন, ধর্মের সারমর্ম উপলব্ধি করতে না পারার জন্যই ভারতে অস্পৃশ্যতা বিরাজ করছে। বিবেকানন্দ শেষ বিচারে ধর্ম দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করতে চান। সেটা কোন্ ধর্ম? প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-তিনি হিন্দুত্ব বা হিন্দুধর্মকে মনে করেন মুক্তির উপায়। তিনি পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যথেষ্ট নতুন নতুন জ্ঞানগর্ভ কথা বলছেন-পুনরায় ফিরে যাচ্ছেন ধর্মের অন্ধকার যুগে। হিন্দুত্বের গৌরব তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে।

বামপন্থি হেমন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসীরা বিবেকানন্দের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকতেই পারেন; কিন্তু এই সকৃতজ্ঞ স্মৃতিপূজার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভাবনা-স্বরূপের যে একটা সুনির্দিষ্ট সীমা ছিল সেদিকেও লক্ষ্য না রাখলে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। শূদ্র বিপ্লব বা সমাজ বিপ্লবের কথা বললেও তিনি নিজেই যথেষ্ট বিভ্রান্ত ছিলেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে কতগুলি জিজ্ঞাসার মধ্যে রেখে দিলেন। তিনি বললেন, বিবেকাননন্দের শূদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে হবে ব্রাহ্মণের জ্ঞান সঙ্গে নিয়ে। স্বচ্ছ দৃষ্টি, ক্ষুরধার বুদ্ধি বিজ্ঞানীসুলভী বিশ্লেষণী শক্তি, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণ কামনায় উদ্বেলিত এক দূরন্ত আবেগ, বিবেকাননন্দের এ সব কিছুই যেন এক অবসন্ন সন্ধ্যায় চূড়ান্ত অবসান খুঁজেছে বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদের প্রশান্তির মধ্যে। যে-ঈশ্বর মানুষের মুখে রুটি জোগাতে পারে না, সে-ঈশ্বরে বিবেকানন্দ বিশ্বাস করেননি কিন্তু তিনি বলেন, রুটি যেদিন জুটবে সেদিন মানুষও বুঝবে রুটির চেয়ে ঈশ্বর অনেক বড়। গঙ্গোপাধ্যায় আরো বলেন, লক্ষ্য করার ব্যাপার রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বাংলার নবজাগৃতির ঋত্বিককুলের ওপর ঔপনিষদিক ব্রাহ্মণবাদের প্রভাব ছিল অসামান্য। এর একমাত্র ব্যতিক্রম বোধহয় বীর-সিংহের সিংহশিশু ঈশ্বরচন্দ্র, যিনি ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে নতজানু হওয়ার প্রয়োজন কোনোদিন অনুভব করেননি; কিন্তু বিবেকানন্দের প্রদীপ্ত সমাজচেতনা ব্রহ্মচিন্তার ধারাস্নানে আত্মশুদ্ধি করেছে।

বাংলার নবজাগরণের সময়কালের বিভিন্ন মনীষীদের মধ্যে দুজন খ্যাতিমান মানুষ ছিলেন বিপরীত প্রান্তে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর মধুসূদন দত্ত। মধুসূদন ধর্ম-সম্পর্কে নীরব, সনাতন ধর্ম নিয়ে সামান্য অহঙ্কার নেই তাঁর। নারীর স্বাধীনতায় পূর্ণমাত্রায় বিশ্বাসী। বিদ্যাসাগরও নারীর মুক্তি চাইছেন; কিন্তু মধুসূদন চেয়েছিলেন নারীকে পুরুষের সমতা দিতে। নবজাগরণের হোতারা প্রায় সকলেই ছিলেন ইংরেজদের প্ররোচনায় ভারতের মুসলিম-শাসনবিদ্বেষী। মধুসূদন সেখানে ব্যতিক্রম, সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক তিনি। সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন প্রবন্ধ-কারণ তিনি রাজিয়ার মধ্যে দেখেছেন নারীর উত্থান। তিনি সুলতানা রাজিয়াকে নিয়ে নাটক লিখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তৎকালীন বাংলার নাট্যজগত মুসলিম চরিত্রকে প্রধান করে নাটক করতে রাজি না হলে তিনি নাটকটি আর লেখেননি। মধুসূদন সত্যি বলতে কৌশলগত কারণেই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন কিন্তু খ্রিস্টধর্মের পক্ষে কলম ধরেননি। বাংলার তরুণদের তখন খুব কমবয়সী বালিকাদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া হতো। মধুসূদনের বাবা-মা যখন মধুসূদনকে বিয়ে দেবার জন্য কমবয়সী পাত্রী দেখলেন, মধুসূদন তা মেনে নিতে পারেননি। মধুসূদন সেই যুগেই স্ত্রীকে ভাবতে চাইছিলেন বন্ধু হিসেবে, যার সঙ্গে মত বিনিময় করা যায়-সাহিত্য আলোচনা করা যায়। ফলে তিনি বাংলার তখনকার বিয়ের প্রচলিত আদর্শ থেকে সরে যাবার জন্য বাবা-মার অবাধ্য হয়েছিলেন, যদিও তিনি মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মধূসূদন বহু চিন্তাভাবনা করে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন, কারণ পাশ্চাত্যের নারী তখন তাঁর কাম্য যিনি তাঁর বন্ধু হতে পারেন। মধুসূদন তৎকালীন হিন্দু সমাজের সব বন্ধন থেকেই মনে প্রাণে মুক্ত হতে চেয়েছিলেন।

মধুসূদন আর বিদ্যাসাগর দু’জনকেই নাস্তিক বলে ধারণা করা হয়। নিজেরা যদিও তার তেমন কোনো প্রমাণ রেখে যাননি। মধুসূদনকে কেউ কখনো প্রার্থনা করতে দেখেনি, কিন্তু বিদ্যাসাগর সন্ধ্যায় প্রার্থনারত হতেন; কিন্তু বিদ্যাসাগর কখনো ধর্ম বা হিন্দুধর্মের পক্ষে কথা বলেননি। রামমোহনের মতোই তিনি ইংরেজ শাসনের ভক্ত ছিলেন, মনে করতেন নতুন চিন্তাচেতনা বয়ে এনেছে তারা; কিন্তু ইংরেজ শাসনের সবকিছু তিনি মেনে নেননি। তিনি ইংরেজ শাসনকে পছন্দ করলেও, ইংরেজদের তোষামোদ করেননি, শাসকদের সামনে নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখতেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি আর মধুসূদন কখনো সনাতন ধর্মের পক্ষে কলম ধরে ভারতকে পিছনে টেনে নেবার পক্ষে ওকালতি করেননি। বিদ্যাসাগরের চিন্তায় স্ববিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায় কম। মধুসূদন স্বভাবগতভাবেই যেন এক ধর্মহীন মানুষ। যিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেও ধর্মহীন-খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ তাঁর কাছে এক রণকৌশল মাত্র। বিবেকানন্দ ছিলেন মধুসূদনের সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তে। তিনি প্রাণ গেলেও যেন হিন্দুধর্ম বিসর্জন না দেবার পণ করেছিলেন।

বিবেকানন্দ ভক্ত অলোকনারায়ণ চৌধুরী লিখেছেন, বাংলার নবজাগরণের উদ্দেশ্য যদি হয় ভারতের ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক ভাবনাকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হওয়া, তবে সেক্ষেত্রে বিবেকানন্দ নিঃসন্দেহে ছিলেন অন্যতম একজন পথিকৃৎ। বেদ এবং বৈদিক ঐতিহ্য ছিল বিবেকানন্দের দর্শনের মূল উৎস। এই কারণেই দেখা যায় পাশ্চাত্যে তিনি বেদান্তের বাণীসমূহের সঙ্গে যুক্তি বা বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্যসমূহের বিরোধ হওয়া দূরের কথা, বিজ্ঞানের নব-আবিষ্কৃত সত্যগুলো বেদান্তের তত্ত্বসমূহ বুঝতে সাহায্যই করে। এই কারণেই বিবেকানন্দ স্পষ্টভাবেই বলেন, ‘জগতে যত শাস্ত্র আছে, তন্মধ্যে কেবল বেদান্তের উপাদেশাবলীর সহিত বহিঃপ্রকৃতির বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে যে ফল লব্ধ হইয়াছে তাহার সম্পর্ণ সামাঞ্জস্য আছে। বর্তমান জড়বাদ নিজ সিদ্ধান্তসমূহ পরিত্যাগ না করিয়া কেবল বেদান্তের সিদ্ধান্তগুলি গ্রহণ করিলেই আধ্যত্মিকতার দিকে অগ্রসর হইতে পারে।’ বিবেকানন্দ বেদান্তের মাহাত্ম্য উল্লেখ্য করে লেখেন, ‘অনাগত ভবিষ্যতে অদ্বৈত বেদান্তেই যে চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রের ধর্ম বলিয়া বিবেচিত হইবে তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই’।

বিবেকানন্দ সমাজের উচ্চাবিত্তদের দায়ী করেছেন সমাজের দারিদ্র্যের জন্য। কেননা, উচ্চবিত্তদের শোষণের ফলে সমাজের বৃহত্তর দলিত শ্রেণি এত দরিদ্র। যেখানে অর্থনৈতিক দারিদ্র্য তীব্রতর সেখানে দরিদ্রদের পক্ষে সমাজের অন্য কোনো সুবিধার স্বপ্ন দেখা বাতুলতা মাত্র। সমাজে সম্পদের উৎপাদকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও প্রতিদিন শোষিত হতে হতে তারা ত্রমে দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হয়। অথচ তাদেরই শোষণ করে সংখ্যালঘু ধনিক শ্রেণি দিনে দিনে আরো ধনী হয়। অর্থের জোরে তারা সমাজে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ফলে দরিদ্র শ্রেণি স্বাভাবিকভাবেই সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। তিনি এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আগে অন্ন, তারপর ধর্ম। যারা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে তাদের আমরা ধর্মোপদেশ শুনিয়ে যাচ্ছি। ধর্মমতবাদে কি পেট ভরে?’ তিনি মাদ্রাজের এক শিষ্যকে চিঠিতে লিখেছেন যে, ‘আমি এমন কোন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না যিনি আমাকে ইহলোকে অন্ন দিতে পারেন না অথচ পরলোক শাশ্বত শান্তির আশ্বাস দেন। ভারতকে উন্নত করতে হবে, দরিদ্রের মুখে অন্ন জোগাতে হবে, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে এবং অশুভ পুরোহিততন্ত্রকে বিনাশ করতে হবে-সবার জন্য আরো অন্ন আরো সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যে শেষপর্যন্ত অটল থাকেননি। 

বিবেকানন্দ বিভিন্নভাবে বলতে চেয়েছেন, প্রাচীন ভারতবর্ষের সব যুগেই মননশীলতা ও আধ্যাত্মিকতা জাতির প্রাণকেন্দ্র ছিল, রাজনীতি নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুনি-ঋষি এবং আচার্যগণ যে সব শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করতেন, সেগুলিকে অবলম্বন করেই জাতীয় জীবন উচ্ছ্বসিত হতো। বিবেকানন্দ পূজা করতে চেয়েছেন নরনারায়ণকে। নানা সময়ে নানাভাবে বারবার এই দরিদ্র ভারতবাসী, অপমানিত ভারতবাসী, বঞ্চিত ভারতবাসীর কথা অতিশয় বেদনার সঙ্গে তিনি বলেছেন। বিবেকানন্দের এসব বক্তব্যকে কতটা গুরুত্ব দেয়া যায়? তিনি বর্ণপ্রথা বাতিল করার বিরুদ্ধে ছিলেন। বিবেকানন্দর দরিদ্রপ্রীতি, অপমানিত ভারতবাসীর জন্য প্রীতি কি তাহলে মায়াকান্না নয়? ভারতের মানুষ বর্তমানেও জাতপাতের প্রশ্নে অপমানিত হচ্ছে, বর্ণবাদের নিয়মের বলি হচ্ছে-বিবেকানন্দ সেখানে বর্ণপ্রথা না তুলে দিয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য, বঞ্চিত মানুষের জন্য কুমীরের কান্না কেঁদেছেন। বিবেকানন্দ এবং গান্ধীর দরিদ্রপ্রীতি যে আসলে সমাজের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না, সেটা খুব ভালোভাবে স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন ভীমরাও আম্বেদকর। বাস্তবসম্মত পথ ধরে না চললে, সমাজের পুরানো ব্যধিগুলি দূর না করলে, শত শত সুন্দর বাণীতে সমাজ ব্যবস্থা পাল্টায় না। বিবেকানন্দ বক্তৃতা দিয়ে ভাসিয়ে দিয়েছেন, বঞ্চিত মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেননি-তিনি ব্রাহ্মণদের ধর্ম টিকিয়ে রাখার নিদান দিয়েছেন দিনের পর দিন। ব্রাহ্মণ্যবাদকে টিকিয়ে রেখে, বেদ বেদাঙ্গের ওপর ভরসা করে ভারতে মূল সংকটকে দূর করা যায় না। বিবেকানন্দরা আসলে বড় বড় কথার আড়ালে ইতিহাসকে পিছনের দিকে টানতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। 

বালাগঙ্গাধর তিলক লিখেছেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ ভারতীয় জাতীয়তার সত্যকার পিতা’। হিন্দু ইতিহাসবিদদের অনেকেই রাজনারায়ণ বসুকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ঠাকুরদা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইতিহাসবিদরা আবার রাজা রামমোহন রায়কে আধুনিক ভারতের জনক বলেছেন। বিবেকানন্দের কথনে-লিখনে ভারত নামের ব্যবহার সবাইকে প্রভাবিত করেছিল। বিবেকানন্দের নিরবচ্ছিন্নভাবে ভারত, ভারত নামের ব্যবহার ‘ভারত’ নামকে সর্বভারতীয় মানচিত্রে ব্যপ্তি দিতে সাহায্য করেছিল। বিবেকানন্দের মুখে শুনে অনক্ষর-নিরক্ষর দেশবাসী ভারতনাম শুনতে পেলেন। জানতে পারলেন তাঁরা ভারতবাসী। বিবেকানন্দ তাই বহু ভারতবাসীর কাছে বিরাট জাতীয়তাবাদী বা বিরাট বিপ্লবী; কিন্তু বিবেককানন্দের জাতীয়তাবাদের চেহারাটা কেমন? বিবেকানন্দের জীবনের প্রথম ব্রত ছিল মৃতপ্রায় হিন্দু ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করা-ভেদাভেদ জ্ঞানে জর্জরিত সংকীর্ণ হিন্দু সমাজকে নতুনভাবে সংগঠিত করা এবং জগৎসভায় এ ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা। তিনি নিজেকে একাজে ব্রতী রেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘কিছু না কিছু ঐতিহাসিক সত্য সকল পুরাণেরই মূল ভিত্তি। পুরাণের উদ্দেশ্য নানাভাবে পরম সত্য সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া। আর যদিও সেগুলিতে কিছুমাত্র ঐতিহাসিক সত্য না থাকে, তথাপি উহারা যে উচ্চতম সত্যের উপদেশ দিয়া থাকে, সেই হিসাবে আমাদের নিকট খুব উচ্চ প্রামাণ্য গ্রন্থ।

সব কথার পর শেষ কথা হলো, বিবেকানন্দ মনুসংহিতার সনাতন ধর্মের শাসন ভারতবর্ষে পুনপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। বিবেকানন্দ যাঁকে নিজের দার্শনিক গুরু বলে মনে করতেন সেই শঙ্কর ও তাঁর শিষ্যপরম্পরা কিন্তু অনায়াসে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটা শোষণমূলক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ব্রহ্মবাদকে দিব্যি মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। বিবেকানন্দ মনে করতেন, বুদ্ধের হৃদয় আর শঙ্করের বুদ্ধির একত্র মিলন হলেই তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত সমাজ পাবেন। গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, মূল প্রশ্নটা কিন্তু হৃদয়ের নয়, এ হলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। শুধু হৃদয়ের প্রশ্ন হলে ব্যক্তিগতভাবে তা পরোপকারের চেষ্টা করে, কতকটা সেবাধর্মের অনুষ্ঠানের মতন। সেই মিশন মার্কা পন্থা কোনোদিনই সমাজবিপ্লব ঘটাতে পারে না। গঙ্গোপাধ্যায় আরো বলেন, বিবেকানন্দ ভারতীয় সমাজের সমস্যার অনেক কিছুই বলিষ্ঠ দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রদর্শিত সমাধান-পদ্ধতিটা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের কুয়াশায় কলুষিত ছিল এ বিষয়ে কোনো বস্তুবাদীর সংশয় থাকা উচিত নয়। এ বিষয়ে শুধু বিবেকানন্দ কেন, উনিশ শতকের ভারতীয় মনীষার উজ্জ্বলতম পরিণতি যে রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রজ্ঞাদৃষ্টিও এই কুয়াশার আবরণকে ভেদ করে বাহির হতে পারেনি। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই সকল 

ভারতপথিকই আধুনিক বুদ্ধিদ্বারা পরিমার্জিত ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের মধ্যে এক পরম প্রশান্তি লাভ করেছিলেন। টোলঘরের সংস্কৃত পড়া বিদ্যাসাগরই এই ধারার বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। ভিন্ন জন মধুসূদন দত্ত।

বিবেকানন্দের দার্শনিক দৃষ্টির সামনে সব চেয়ে বড় বাধা ছিল শঙ্করের মায়াবাদ। নানা বিপ্লবী বুলি আওড়ালেও এ বাধা তিনি অতিক্রম করতে পারেননি। সেজন্যই তিনি বারবার বলেছেন, শ্রমজীবীর বিপ্লবের দ্বারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পর মানুষ বুঝতে পারবে সমাজ সংসার সব মিথ্যা, ঈশ্বরই একমাত্র সত্য। তখন ঈশ্বরানুভূতির দরজায় গিয়ে মানুষকে ধর্ণা দিতে হবে। বিবেকানন্দ বিশ্বাস করতেন, শঙ্কর-প্রদর্শিত অধ্যাত্মবাদই ভারতের সবচেয়ে বড়ো ঐতিহ্য। এই অধ্যাত্মবাদের পুনরুজ্জীবনের দ্বারাই মানুষের চরম মুক্তি সম্ভব হবে এ বিশ্বাস তিনি কখনো ছাড়তে পারেননি। বিবেকানন্দ বলেন, বিজ্ঞান মানুষের বাহ্যিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও উন্নতিতে সহায়তা করে; কিন্তু মানুষের অন্তরের উন্নতি ঘটায় আধ্যাত্মিক চিন্তা। এই বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা দুইয়ের চর্চা দরকার। তিনি বিজ্ঞান সাধনা ও ধর্ম অর্থাৎ আধ্যাত্ম-সাধনার সমন্বয়ের কথা বলেন। বিবেকানন্দ যা চাইতেন তা কি বাস্তবে সম্ভব? বিজ্ঞানের সঙ্গে কি আধ্যাত্মিকতার কখনো সমন্বয় ঘটতে পারে? তিনি আশা করেছিলেন ভারত পাশ্চাত্য থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিখবে এবং পাশ্চাত্যকে সে আধ্যাত্মিকতা শেখাবে। তিনি আসলে যুক্তি নয় ভক্তিবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি সেকারণেই বলেন, ইতিহাস প্রমাণ করে ভারতবর্ষ অন্য কোনো দেশ থেকে এখনকার মতো পিছিয়ে ছিল না, বরং সভ্যতার পুরোভাগে ছিল এবং তা সম্ভব হয়েছিল ধর্মকে বর্জন করে নয়, তাকে ধরে থেকেই। তিনি বলেন এমনটা ঘটেছিল আর্য, বৌদ্ধ, গুপ্ত, চোল এবং চালুক্য যুগে। তিনি উনিশ শতকের আর সবার মতো প্রাচীন ভারতের বর্ণবাদী সমাজের প্রতি আস্থাবান। তিনি সব বড় বড় মহৎ কথার শেষে সেই রক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল সমাজকে ফিরিয়ে আনতে চান। 

বিবেকানন্দ বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়ের প্রতিভাধর ছাত্র ছিলেন। ইতিহাসের জ্ঞান ছিল টনটনে। ইতিহাসের বহু সত্য তাঁর লেখায় উদ্ভাসিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন উদার প্রকৃতির মানুষ, ভারতবর্ষের বহু সংকটের দিকে তাঁর নজর ছিল; কিন্তু সব বড় বড় বুলির আড়ালে দিনশেষে চলে যাচ্ছেন হিন্দু জাতীয়তাবাদের কাছে। রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা সেখানে তাঁর লক্ষ্য। সে কারণেই নাম্বুদিরিপাদ বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘হিন্দুত্ব রাজনীতির প্রবক্তারা দাবি করছেন যে তাঁরা হিন্দু দর্শনের মহত্বকে তুলে ধরতে স্বামীজিকেই অনুসরণ করছেন। ভিন্ন দিকে তাঁদের বিরোধিতা করছেন যেসব দার্শনিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা, তাঁরা মনে করেন স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের অন্যতম নেতা।’ নাম্বুদিরিপাদ দেখাচ্ছেন ভারতের বাম ডান প্রতিক্রিয়াশীল সবার কাছে বিবেকানন্দ গ্রহণযোগ্য এবং যথেষ্ট সম্মানিত। হিন্দুত্ববাদীরাও তাঁকে প্রবল সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছে, পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধীরাও। কী দাঁড়াল তাহলে? বিবেকানন্দ প্রশ্নে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম। বিবেকানন্দের আকাঙ্ক্ষিত রামরাজ্য ভারতের প্রায় সব বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কাম্য। রাষ্ট্রীয়ভাবেই ভারতের শিক্ষিত-অশিক্ষিত-প্রতিক্রিয়াশীল-প্রগতিশীল সমাজের বড় অংশটাই আসলে বিবেকানন্দের হিন্দুত্বের ধারণা দ্বারা প্রভাবিত। ভারতে হিন্দু-মুসলিম সংকটের সেটাও বড় একটা কারণ। বিভিন্নভাবে উনিশ-বিশ শতকের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা মনীষীদের ‘রামরাজ্য’, গো-রক্ষা আন্দোলনকে সমর্থন করে হিন্দু-মুসলিম সংকট নিরসন সম্ভব নয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //