কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা কবিতার আশাবাদী ধারা

রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লব ও গণতান্ত্রিক জাতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সভ্যতার যে ক্রমবিকাশ, চার-পাঁচশ’ বছরের অগ্রগতির পর বিশ শতকে এসে তা অবক্ষয় ও বিনাশের পর্যায়ে পড়ে, দেখা দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সভ্যতার স্বাভাবিক বিকাশের নয়, বিকারের লক্ষণ। স্বাভাবিক বিকাশের জন্য দরকার হয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদ। পুঁজিবাদের সম্পত্তি ও ক্ষমতা দুটিই সমাজের ক্ষুদ্র্র অংশে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এবং দুটিরই প্রবণতা থাকে মনোপলির দিকে। সংবিধি ও আইনকানুন প্রবর্তনের দ্বারা মনোপলি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও পুঁজিবাদে ক্ষমতা ও সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে মনোপলির প্রবণতা থেকেই যায়। মনোপলির সুযোগ বন্ধ করা হলে পুঁজিবাদ থাকে না। ইউরোপে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনজীবনে যে সংকট দেখা দেয়, তা থেকে মুক্তির জন্য দেখা দেয় সমাজতন্ত্রের চেতনা ও চিন্তা এবং তা বিকাশমান থাকে। 

খ্রিস্টীয় মধ্যযুগের ব্যবধান অতিক্রম করে, গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতা শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারা ধরে যেভাবে বিকশিত হচ্ছিল, তাতে মানুষ পরম আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তখন মানুষ মানুষের মধ্যে অন্তহীন সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিল। মানবীয় চেষ্টা দ্বারা পৃথিবীতেই স্বর্গ রচনা সম্ভব, দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকদের ক্ষেত্রে অনেকে নানাভাবে এমন আশা ব্যক্ত করতেন; কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধের কালে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। বিশ্বযুদ্ধ মানুষের মনে সভ্যতার সংকটের বোধকে প্রবলতর করে তোলে, এবং যুদ্ধের পর তা ক্রমবর্ধমান থাকে। সে অবস্থায় শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে modernism বা আধুনিকবাদ নামে যে মতবাদ দেখা দেয়, তার মর্মে ছিল চরম নৈরাশ্যবাদ। শিল্প সাহিত্যেও এই আধুনিকবাদ মানুষকে পরম আশাবাদ থেকে চরম নৈরাশ্যবাদে নিয়ে যেতে থাকে। প্রাতীচ্য ও প্রাচ্যেও বিভিন্ন ভাষায় শক্তিমান নবীন শিল্পী-সাহিত্যিকরা নৈরাশ্যবাদে নিমগ্ন হয়ে থাকেন। এই নৈরাশ্যবাদকে মর্মে ধারণ করে শিল্প-সাহিত্যে রূপ-রীতির উৎকর্ষ চর্চায় তারা গুরুত্ব দেন। শিল্প সাহিত্যে বিষয়বস্তু গৌণ, রচনারীতিই মুখ্য, এ কথা বলে তারা প্রচার চালাতে থাকেন এই বলে যে, কোনো তুচ্ছ বিষয় নিয়েও সার্থক, সফল, উৎকৃষ্ট শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব যদি কেবল রূপ-রীতিগত উৎকর্ষ অর্জিত হয়। তাদের এই প্রয়াস art for art’s sake, বাংলায় কলাকৈবল্যবাদ বলে পরিচিত। 

বাংলা ভাষায় আধুনিকবাদের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ জীবনানন্দ দাশ। বাংলা আধুনিকবাদী সাহিত্য আন্দোলন পরিচালনা করেন বুদ্ধদেব বসু। ওই জেনারেশনের শক্তিমান লেখকেরা সাহিত্যজীবনের শুরুতে নানাভাবে ইউরোপীয় আধুনিকবাদকে গ্রহণ করেন, অনেকে নিজের অজান্তেই আধুনিকবাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। ইউরোপ-আমেরিকার হুবহু অনুকরণ নয়, বাংলায় আধুনিকবাদ কিছুটা স্বতন্ত্র রূপ ও প্রকৃতি লাভ করেছে। 

নজরুল কলাকৈবল্যবাদে আগ্রহী হননি। আধুনিকবাদীদের রচনারীতিও তিনি গ্রহণ করেননি। তবে তার কবিতায়, গানে, উপন্যাসে শৈল্পিক উৎকর্ষ অর্জনের প্রয়াসের পরিচয় আছে। সে প্রয়াস আধুনিকবাদীর ধারায় নয়, রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্তের ধারায়। নজরুল নৈরাশ্যবাদ চর্চায়ও আগ্রহী হননি। তাঁর কবিতায়, গানে, চিঠিপত্রে, প্রবন্ধে, বক্তৃতায় দুঃখের প্রকাশ আছে, কিন্তু দুঃখবাদ নেই। তাঁর লেখায় নৈরাশ্য আছে, কিন্তু নৈরাশ্যবাদ নেই। নজরুল ছিলেন আশাবাদী, স্বভাবগতভাবে আশাবাদী, আন্তরিকভাবে আশাবাদী, স্বতঃস্ফূর্তভাবে আশাবাদী, প্রবলভাবে আশাবাদী, পরম আশাবাদী। মানুষের অন্তহীন সম্ভাবনায় ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। নজরুল ছিলেন অপরাজেয় মনোবলের অধিকারী গণ-আন্দোলনের কবি। তার চেতনা ছিল কুসংস্কারবিরোধী, প্রগতিপ্রয়াসী, পরাধীনতাবিরোধী, স্বাধীনতাকামী, সমাজতন্ত্র-অভিমুখী, অন্যায়মুক্ত, অভাবমুক্ত, সমৃদ্ধ সম্প্রীতিময় জীবন, সমাজ জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। নৈরাশ্যবাদে তাঁর মন আকৃষ্ট হয়নি। নজরুল ও জীবনানন্দ একই বছর জন্মগ্রহণ করেন। নজরুল লেখা প্রকাশ করতে আরম্ভ করেন কিছু আগে। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালকের কোনো কোনো কবিতায় নজরুলের প্রভাব অনেকে দেখেছেন; কিন্তু দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এসে জীবনানন্দ জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন। তখন থেকে তাঁকে দেখা যায় আধুনিকবাদী। দেখা যায় তাঁর স্বভাব নজরুলের স্বভাবের বিপরীত। নজরুল আধুনিকবাদের পরিমণ্ডলে বসবাস করেও আধুনিকবাদ গ্রহণ করেননি। সেটা তাঁর স্বভাববিরোধী। রবীন্দ্রনাথও শেষ পর্যন্ত আধুনিকবাদের প্রতি অপ্রসন্ন ছিলেন। তবে আধুনিকবাদীদের ভাষা, ছন্দ ও রূপে-রীতিতে কখনো কখনো আকৃষ্ট হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথেও দুঃখ আছে, দুঃখবাদ নেই; নৈরাশ্য আছে, নৈরাশ্যবাদ নেই। রবীন্দ্রনাথের জগৎ-জীবনদৃষ্টি সর্বাবস্থায় সদর্থক- positive। নজরুলেও তাই। তবে রবীন্দ্রনাথে নজরুলে পার্থক্য অনেক। 

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চার মাস আগে, নিজের মৃত্যুর আসন্নতা সম্পর্কে যখন নিশ্চিত, তখন অসুস্থ অবস্থায় লিখেছিলেন আত্মস্বীকৃতিমূলক (confessional) প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সংকট’। তাতে আবেগদীপ্ত ভাষায় আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার মহিমা কীর্তন করে শেষে উল্লেখ করেছেন : 

জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি পেছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ; কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। 

আশাদীপ্ত আবেগ যখন বাস্তবের বিরূপতার দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন যুক্তি-বুদ্ধি অবলম্বন করে বুঝবার চেষ্টা করেন। নৈরাশ্য থেকে তিনি নৈরাশ্যবাদের দিকে ধাবিত হন না, আশার আলো সন্ধান করেন। 

শৈশব থেকেই নজরুলের জীবন সব দিক থেকে দুঃখ-বেদনায় পূর্ণ ছিল। তার ওপর যে ‘শিক্ষিত-সমাজে’ তিনি বসবাস করেছেন তাঁরা তাকে স্বস্তি দেয়নি। তিনি লিখেছেন : ‘মানুষ কি আমায় কম যন্ত্রণা দিয়েছে? পিঁজরায় পুরে খুঁচিয়ে মেরেছে ওরা। তবু এই মানুষ এই পশুর জন্যই আমি গান গাই তারই জন্য আজও আমি আজও আছি বেঁচে।’ ১৯২৭ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর চিঠির উত্তরে তিনি উল্লেখ করেছিলেন :

আমি আজও মানুষের প্রতি আস্থা হারাইনি- তাদের হাতের আঘাত যত বড় এবং যত বেশিই পাই। মানুষের মুখ উল্টে গেলে ভূত হয়, বা ভূত হলে তার মুখ উল্টে যায়; কিন্তু মানুষের হৃদয় উল্টে গেলে সে যে ভূতের চেয়েও কত ভীষণ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র হয়ে ওঠে- তাও আমি ভালো করেই জানি। তবু আমি মানুষকে শ্রদ্ধা করি- ভালোবাসি। স্রষ্টাকে আমি দেখিনি, কিন্তু মানুষকে দেখেছি। এই ধূলিমাখা পাপলিপ্ত অসহায় দুঃখী মানুষই একদিন বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত করবে, চিররহস্যের অবগুণ্ঠন মোচন করবে, এই ধুলোর নীচে স্বর্গ টেনে আনবে, এ আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি, এ আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। 

স্কুলে পড়ার সময় নজরুল বিপ্লববাদীদের সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন। সৈনিক জীবন শেষ হওয়ার পরেও তিনি সেই সংশ্রব রক্ষা করে চলেছিলেন। অগ্নিবীণা কাব্য তিনি উৎসর্গ করেছিলেন অরবিন্দ ঘোষের ভাই বিপ্লববাদী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নামে। ধুমকেতু বিপ্লববাদীদের মুখপত্র বলে পরিচিত ছিল। পরের কয়েক বছর তিনি মাকর্সবাদীদের কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে ছিলেন। লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তাছাড়া ইসলামকে তিনি উপলব্ধি করেছেন বিপ্লবী আদর্শরূপে। নিজের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, সেই সঙ্গে এইসব আদর্শের প্রভাব গ্রহণ- এসবের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল নজরুলের জগৎ-জীবনদৃষ্টি। কেবল ভাবুক নন, কর্মীও ছিলেন তিনি। ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন। উন্নত জীবন, উন্নত সমাজ, উন্নত রাষ্ট্র ও উন্নত বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন ছিল তাঁর মনে। কবিতায়, গানে, ভাষণে-অভিভাষণে ছড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্ন-কল্পনা ও আদর্শবোধ। তাঁর প্রেম ও প্রকৃতিবিষয়ক কবিতা ও গানে অভিব্যক্ত হয়েছে সুস্থ, স্বাভাবিক, সমৃদ্ধ সংগ্রামীজীবনের বোধ। অপরাজেয় মনোবল নিয়ে তিনি জীবন কাটিয়েছেন। শেষে যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, যোগসাধনায় নিমগ্ন হন, তখনো তাঁর চোখে নির্যাতিত, পীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির ও উন্নত পৃথিবী গড়ে তোলার স্বপ্ন তিনি ত্যাগ করেননি। 

রবীন্দ্রনাথের জীবনকালেই রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্য রূপ লাভ করতে থাকে। তাতে এক ধারায় বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে আছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দেসহ অনেকে। অপর ধারার আরম্ভ নজরুলকে দিয়েই। এই ধারায় আত্মপ্রকাশ করেন- সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সিকানদার আবু জাফর, বুলবুল খান মাহবুবসহ অনেকে। ফররুখ আহমদও এই ধারারই কবি। কিন্তু পাকিস্তানবাদী হওয়ার ফলে তাকে বিবেচনায় ধরা হয় না। রবীন্দ্রোত্তর এই দুই ধারার একটি আধুনিকবাদী এবং অপরটি প্রগতিবাদী। আধুনিকবাদী ধারা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই, সে তুলনায় প্রগতিবাদী ধারা নিয়ে আলোচনা কম। আধুনিকবাদী ধারা ক্রমে ১৯৮০-এর দশক থেকে বিকশিত হচ্ছে উত্তরাধুনিকবাদী ধারারূপে। আধুনিকবাদ সীমাবদ্ধ ছিল স্থাপত্য-ভাস্কর্য, চিত্রকলা এবং কবিতা, গল্প, উপন্যাস নাটক ইত্যাদিতে। উত্তরাধুনিকবাদ ব্যাপ্ত হয় দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায়। এতে আধুনিকবাদের অন্তর্গত নৈরাশ্যবাদ পরিহার করা হয়; কিন্তু এর রূপ-স্বরূপ সম্পর্কে কিছুই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় না, ফলে এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। বিশ্বায়ন ও উত্তরাধুনিকবাদ নিয়ে যেসব গুরুতর সমস্যা দেখা দিয়েছে সেগুলোর সমাধানের জন্য সভ্যতার উত্থান-পতন, সংস্কৃতির চড়াই-উতরাই, রেনেসাঁস, প্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা ও সৃষ্টিশীলতা দরকার। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে উন্নত ভবিষ্যতের জন্য আজ দরকার প্রগতিবাদী ধারাটির দিকে পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া এবং তাকে নতুন কালের পটভূমিতে বিকশিত করা। 

বাংলা ভাষায় যিনি আধুনিকবাদী সাহিত্য আন্দোলনের মূল সংগঠক সেই বুদ্ধদেব বসু ১৯৫১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘চাই-আনন্দের সাহিত্য’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন: 

কী সেই বাণী, যা বিশেষভাবে একালের বলে মহাকালের খাতায় ওঠার স্পর্ধা রাখে? এ বিষয়ে আলোচনা ও গবেষণা যতই ভূরিপরিমাণ হয়ে থাক এবং হতে থাক, মার্কসীয়, ফ্রয়েডীয়, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান পরিভাষাকণ্টকিত দুষ্পাঠ্য গ্রন্থ আটলান্টিকের দুই তটে যত না বংশবৃদ্ধি করুক, সহজকে দুরূহ এবং জটিলকে জটিলতর করার পরিশ্রমে অধ্যাপকীয় বৃত্তিরক্ষা যতভাবেই সফল হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এই আসল কথাটা ধরা পড়ে যাবেই, হাজার কথার চাতুরী বলেও তাকে চাপা দেওয়া যাবে না, যে কোনো এক অর্থে এই বিশিষ্টরকম আধুনিক সাহিত্য তার কল্পিত মানুষের মতোই ফাঁপা, তাতে চিত্রিত বন্ধ্যা জীবনের মতোই নির্জীব, তাতে বর্ণিত জীবনের মতোই হতাশাচ্ছন্ন। অর্থাৎ এই সাহিত্যের তাৎপর্য নঞর্থক, এর বাণী বলতে প্রকাণ্ড একটা ‘না’ ভিন্ন কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যায় না শুধু নৈরাশ্য, শুধু বিতৃষ্ণা, মানুষের মূঢ়তার savage indignation নয়, মানুষের পতনপ্রবণতার এক ফোঁটা করুণাও নয়- শুধু প্রত্যাখ্যান, তিক্ততা, নয়তো বাঁকা ঠোঁটে দুর্বলের ব্যঙ্গ, আর নয়তো কোনো অন্ধবিশ্বাসের পায়ে নিশ্চিন্ত, অসহায় আত্মসমর্পণ। আধুনিক জীবনের ব্যর্থতার ছবি আঁকতে গিয়ে সেই ব্যর্থতারই মৌতাতে মেতে উঠলেন লেখকেরা- সেটাকেই ঘিরে ঘিরে ঘুরছেন, ঘুরতেই ভালো লাগছে, যার বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযান সেটাই যেন গ্রাস করে রেখেছে তাঁদের, কিছুতেই বেরুতে পারছেন না সেই আবর্ত থেকে, নিজেদের উদগীর্ণ জালে নিজেরাই আটকে আছেন মাকড়সার মতো। জীবনে ‘boredom’ ও ‘horror’ নিশ্চয়ই আছে এবং এটা অপূর্ব কোনো আবিষ্কারও নয় কিন্তু এই ‘boredom’-এর কবিদের রচনা পড়তে পড়তে এ সন্দেহ আমরা কিছুতেই ঠেকাতে পারি না যে তাঁরা নিজেরাই সীমাহীনরূপে ক্লান্ত এবং যেসব কথাশিল্পী আধুনিক আতঙ্কভরা কুশ্রিতা দৃশ্যের পর দৃশ্যে এঁকে চলেছেন, তাঁদেরও মনে হয় সেই আতঙ্কের মধ্যে আবদ্ধ, তার পরপরে কোনো স্বর্গের সন্ধান তাঁদের কাছে মেলে না, কিংবা যদি বা মেলে, সেটাও মানবিকতার দিক থেকে মানুষের জীবনের দিক থেকে ভুল স্বর্গ, অলীক, আত্মপ্রতারক কল্পনা। ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়িয়েছে যে ব্যাধির বিশ্লেষণ করতে করতে ব্যাধির প্রেমেই পড়ে গেছেন এঁরা, চিকিৎসার অন্বেষণের বদলে মড়কের গলা ধরে আঁকড়ে আছেন। 

এখানে ‘আধুনিক’ বলে বুদ্ধদেব বসু ‘আধুনিকবাদ’ বুঝিয়েছেন। প্রবন্ধটিতে তিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের কয়েকজন নৈরাশ্য চর্চাকারী কবি-সাহিত্যিকদের জীবন-জগৎ-দৃষ্টি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে লিখেছেন : 

মনে হয় পাশ্চাত্য কাব্যে রাগরক্ত আনন্দ-বেদনা ইয়েটসের সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেল, গদ্য রচনায় বিস্ফোরক তেজে ডি. এইচ. লরেন্সের সধর্মী কেউ রইল না, এবং স্বাধীন, সম্প্রদায়চ্যুত মনস্বিতার উদাহরণরূপে একা দাঁড়িয়ে আছেন টমাস মান। অথচ এই জীবনবিমুখ লেখকেরা শিল্পনৈপুণ্যে শ্রেষ্ঠ বলে এবং বিশিষ্টভাবে যুগলক্ষণে চিহ্নিত বলে, এঁরাই এই পরিণত বিশ শতকের প্রধান বলে স্বীকৃত; কিন্তু আর কত কাল? এই ঘণ্টা-নাড়া ঠাকুরপূজোয় ফিরে যাওয়া, এই ধূসর, রক্তহীন, হৃদয়হীন সংগীত এ আর কতকাল শুনব আমরা? আজ বিশ শতকের অধোত্তীর্ণ প্রহরে এই প্রশ্ন ঠেলে উঠতে চায় যে এই- যে আমরা এতদিন ধরে এই সূক্ষ্ম বিষ পান করলুম, তার নেশায় খোঁয়াড়ির দিন এখনো আসেনি? কোনো এক ভোরবেলায় জেগে উঠে আমরা কি বুঝবো না যে এই বিষে তিলে তিলে আমাদের প্রাণশক্তি নিস্তেজ হয়েছে? ভবিষ্যদ্বাণী করা বিপজ্জনক; কিন্তু সভ্যতা যদি টিকে থাকে আর স্বাধীন চিন্তা লুপ্ত না হয়, তাহলে বিশ শতকের অন্তীম লগ্নে বিশ্বসাহিত্যে আবার একটি যুগান্তর ঘটবে; হয়তো তার গতি হবে সরলতর, স্বীকৃতির, ও সদর্থক অঙ্গীকরণের দিকে; অন্তত তা কোনো কাল্পনিক স্বর্গলাভের আশায় রাষ্ট্র কিংবা মন্দিরের যূপে আত্মবলির পরামর্শ দেবে না, মানুষের কানে হয়তো সবচেয়ে দুঃসাহসী কথাটি উচ্চারণ করবে, ‘বাঁচ, ভালোবাস, হও। 

‘চাই আনন্দের সাহিত্য’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুর যে মানসপ্রবণতার প্রকাশ, তা আধুনিকবাদীর নয় উত্তরাধুনিকবাদীরও নয়, মনে হয় তা কোনো রেনেসাঁসদীপ্ত ভাবুকের। ঘটনাক্রমে এই রকম স্পষ্ট উপলব্ধি ব্যক্ত করা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু আধুনিকবাদ থেকে সরে যাননি। নৈরাশ্যবাদ থেকে বেরোতে চাইলেও কলাকৈবল্যবাদে অটল থাকেন। তাঁর পরবর্তী জীবনের রচনাবলি অনুধাবন করলেও এটা বোঝা যায়। 

আধুনিকবাদী সাহিত্যের স্বরূপ এবং মানবজীবনে তার প্রভাব সম্বন্ধে অসাধারণ মূল্যবান বক্তব্য আছে আবু সায়ীদ আইয়ুবের ‘আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ’ এবং ‘Poetry and Truth’ গ্রন্থ দুটিতে। উত্তরাধুনিকবাদ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু উত্তরাধুনিকবাদের স্বরূপ এবং জাতীয় জীবনে ও বিশ্বব্যবস্থায় তার প্রভাব সম্পর্কে বিশেষ মূল্যবান কোনো গ্রন্থের সন্ধান এখনো আমরা পাই না। 

প্রগতিবাদী ধারার লেখকদের মধ্যে নজরুল ও সুকান্ত ছাড়া আর কারও সম্পর্কে তেমন আলোচনা নেই। সুকান্ত সম্পর্কে যেসব আলোচনা হয় প্রায়শ সেগুলো একদেশদর্শী। জীবনবাদী লেখক হিসেবে তাঁর পরিচয় এখনো যথেষ্ট স্পষ্ট করা হয়নি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সিকান্দার আবু জাফর, বুলবুল খান মাহবুব প্রমুখও আলোচনার দাবি রাখেন। প্রগতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফররুখ আহমদ সম্পর্কেও আলোচনা হতে পারে। আর সাধারণভাবে প্রগতিবাদ ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা সম্পর্কেও আলোচনা-সমালোচনা দরকার। প্রগতিবাদকে বিকাশশীল রূপ দিতে হবে, পুরনো চিন্তায় আবদ্ধ থাকা একেবারেই উচিত নয়। 

উত্তরাধুনিকবাদ নিয়ে এবং উত্তরাধুনিকবাদের প্রভাবে বাংলা কবিতা এখন জীবনবিচ্যুত-জীবনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলা কবিতাকে জীবনবাদী ও জীবনসম্পৃক্ত হতে হলে মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সম্মুখ দৃষ্টি নিয়ে এগোতে হবে। জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসুও ঐতিহ্যের অন্তর্গত। ঐতিহ্যকে সবদিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। কোনো এক দিকে দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ করে ফেললে ভুল করা হয়। যে বিষয় যতটা গুরুত্ব পাওয়ার উপযোগী সেটাকে ততটাই গুরুত্ব দিতে হবে। সব ক্ষেত্রেই বিচারবুদ্ধিকে জাগ্রত ও সক্রিয় রাখা সমীচীন। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //