নজরুল কেন আজও প্রাসঙ্গিক

ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত বলেছিলেন- ‘I think, therefore I am.’ অর্থাৎ আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি। চিন্তাচর্চা একটা সময় মানুষের জীবন চর্যার অঙ্গীভূত ছিল বলেই মানবসভ্যতা পেয়েছে শিল্প সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের মতো এক-একটি বিষয়, মানুষের উন্নততর অনুভূতি ও ভাবনার ফসল। গত দুই শতকে রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামের মতো বাঙালি মনীষী ও সৃজনশীল মানুষ জ্ঞানচর্চা ও গভীর চিন্তাচর্চার মধ্য দিয়ে পরমার্থের সাধনা করে গেছেন। তারা সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করেছেন বাঙালির চেতনা জগতকে।

এখন আমরা দেখি, শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীজুড়েই বদলে গেছে এই জীবনদর্শন। এখনকার অধিকাংশ মানুষের দর্শন, ‘I consume, therefore I am.’ অর্থাৎ আমি ভোগ করি, তাই আমি আছি। আজ আমাদের সমাজে যে যত বড় ভোক্তা অর্থাৎ বিষয় সম্পত্তির মালিক, সে সমাজে তত বেশি প্রতিষ্ঠিত। এই প্রতিষ্ঠার পেছনে কোনো দুর্নীতি বা অনৈতিক কার্যকলাপ যুক্ত কিনা, তা তেমন বিবেচ্য নয়। আসলে এমনই এক ভোগবাদী জীবনদর্শন আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই, বিশেষত যাদের আমরা উন্নত বা উন্নতশীল দেশ বলে অভিহিত করে থাকি, এখন ধনতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমরা যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির রূপ দেখেছিলাম, সেই শক্তি এখন রূপ বদলে ধনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রসারে সহায়ক হয়ে উঠেছে। প্রতিটি দেশেই এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কাঠামোটিকে মজবুত করে রাখছে কতিপয় বহুজাতিক শিল্পপতি গোষ্ঠী বা শিল্পসংস্থা। দেশের সরকারকে প্রকৃতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করে এরাই এবং এরাই এক-একটি দেশকে পরিণত করেছে বাজারে। নিজেদের তৈরি ভোগ্যপণ্য ব্যবহারের জন্য এরা বিভিন্ন মিডিয়ার সাহায্যে জনসাধারণের মগজ ধোলাই করে চলেছে। জনসাধারণ এদের কাছে এক-একটি খরিদ্দার বা ক্রেতা ছাড়া আর কিছু নয়। বিশ্বায়নের নামে এই পণ্যসংস্কৃতিকে তারা ঢুকিয়ে দিয়েছে সমাজের চেতনার গভীরে। এখানে একটি সুগন্ধি বা পারফিউম যেমন পণ্য, সাহিত্য-সংগীত-চলচ্চিত্রও পণ্য, একজন নারীও তেমনি পণ্য, এমনকি পণ্য হয়ে উঠেছে এক-একটি মানবিক সম্পর্কও। এ অবস্থায় সিরিয়াস বা গভীর কোনো চিন্তা অথবা বিষয় জনসাধারণকে আর তেমন আকৃষ্ট করে না। অধিকাংশ মানুষ আজ চায় উত্তেজনা, শুধু ভোগের সুখ, হোক তা স্বল্প সময়ের জন্যও।

এই ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পৃথিবীজুড়েই এক একটি দেশের অভ্যন্তরেই বিভিন্ন স্তরে যেমন বিবাদ-বিসংবাদ ও সহিংস কার্যকলাপ বাধিয়ে রাখে, তেমনি অবিরত যুদ্ধও বাধিয়ে রাখে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে। সুকৌশলে এরা তৈরি করে অর্থনৈতিক অসাম্য। আমাদের মতো একটি দেশে এক শতাংশ মানুষের হাতে সঞ্চিত থাকে দেশের ৭৩ শতাংশ সম্পদ। আর ৬৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ বাস করে দরিদ্রসীমার নিচে। মানুষের মধ্যে এই অর্থনৈতিক ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলার দিকে। এরা আবার সাম্প্রদায়িকতাকে, ধর্মান্ধতাকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভাজন ও সহিংসতা ছড়ানোর কাজে। এর ফলে তৈরি হয় রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। নারীকে ও নারী-পুরুষের সম্পর্ককে পণ্য হিসেবে তুলে ধরে সমাজে টিকিয়ে রাখা হয় লিঙ্গ বৈষম্যকেও।

আজকে এই উপমহাদেশের এবং বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে যদি কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য-সাহিত্য ও রাজনৈতিক দর্শন বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে, তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কিংবা সাংস্কৃতিক যা-ই হোক না কেন, তাঁর সেইসব বৈপ্লবিক উচ্চারণ আজও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

আমরা জানি, খুব দারিদ্র্যের মধ্যে কেটেছিল নজরুলের শৈশব-কৈশোর। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। তিনি যখন মারা যান, নজরুলের বয়স তখন মাত্র নয় বছর। ওই বয়সেই সাংসারিক দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদের দেখাশোনা ও মোয়াজ্জিনের কাজ গ্রহণ করতে হয় তাঁকে। গ্রামের মক্তব থেকে তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ফলে অল্প বয়সেই ইসলামিক শিক্ষায় তিনি সাবলীল হয়ে ওঠেন। কোরআন পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত থেকে শুরু করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হতে থাকেন। আর এ কারণেই পরবর্তীকালে তাঁর কবিতা ও গান রচনার মধ্যে তিনি এই ইসলামিক ঐতিহ্যকে সুনিপুণভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

তাঁর বয়স যখন বারো, তিনি যোগ দেন ‘লেটো’ দলে। বর্ধমান জেলার লোকনাট্য ও গানের দল ‘লেটো’। এতে স্বতঃস্ফূর্ত নৈপুণ্যে তাৎক্ষণিকভাবেই গান বেঁধে সুর দিয়ে গাইতে হতো। এই অভিজ্ঞতাই যে সেই বয়সে নজরুলের কবি প্রতিভার স্ফূরণ ঘটিয়েছিল, এ কথা বলাই যায়। লেটোতে হিন্দু পুরাণের বহু কাহিনি এবং ইতিহাসের অনেক ঘটনাবলি নিয়েও পালাগান রচিত হতো। ফলে ওই বয়সে নজরুলের বহু পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল।

নজরুলের কবিতা ও গান রচনার স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল ঠিকই, কিন্তু রানীগঞ্জের সিয়ারসোল স্কুলে পড়ার সময় তিনি শিক্ষকদের মধ্যে পেয়েছিলেন সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলালকে যাঁর কাছে নজরুল শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম পেয়েছিলেন। শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য, হাফিজ নুরুন্নবীর কাছে পারসি সাহিত্য আর নিবারণচন্দ্র ঘটকের কাছে পেয়েছিলেন বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার শিক্ষা। একদিকে দরিদ্র মানুষের জীবনযাপন তিনি যেমন নিবিষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, নিজে সেই জীবনের পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিলেন, আবার অন্যদিকে সাহিত্য-ইতিহাস, পুরাণসহ বিভিন্ন ধর্মের ঐতিহ্যের সঙ্গেও তাঁর ঘটেছিল গভীর পরিচয়। আর এসব অভিজ্ঞতাই তৈরি করে দিয়েছিল নজরুলের সৃজনশীল মানসভূমি। এত কম বয়সে এত বিচিত্র অভিজ্ঞতা সাধারণত খুব বেশি মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। আর সেরকম অভিজ্ঞতা থাকলেও তাকে গঠনমূলক সৃষ্টির কাজে ব্যবহারও সবাই করতে পারে না।

আঠারো বছর বয়সে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর নজরুল যোগ দিলেন তখনকার ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের সেনাবাহিনীতে। ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল, এই সময়টুকু ছিল নজরুলের সৈনিকজীবন; কিন্তু এই সময়টুকুই তার জীবনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এই সেনানিবাসেই সাহিত্য ও সংগীতচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার অবকাশ যেমন পেয়েছিলেন, তেমনি এক পারসি মৌলবীর কাছে পারসি ভাষা শেখার সুবাদে পারসি ভাষায় কবি হাফিজের কবিতা পড়ার সুযোগ তার হয়েছিল। সেই থেকে তিনি হাফিজের কবিতার এবং পারসি গজলের গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন।

সেই সঙ্গে এই সেনানিবাসে বসেই তিনি রুশ বিপ্লবের কথা, লাল ফৌজের কথা এবং মধ্য এশিয়ার সংগ্রাম ও সমাজ পরিবর্তনের খবর জেনেছিলেন। সে সময় ব্রিটিশবিরোধী দার-উল-ওলামা মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মুসলিম জাতীয়তাবাদী গোপন সংগঠনের নেতা মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি কাবুলে অবস্থান করে তুরস্ক ও রাশিয়ার সাহায্য লাভ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানের সহায়তায় ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলা। ভারতীয় বিপ্লবীদের এই সব কার্যকলাপ সম্পর্কেও তিনি কোনোভাবে অবগত হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে, ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে থেকেও ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানসিকতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তার। কারণ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইটাই তার কাছে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়েছিল। রুশ বিপ্লবের এই প্রভাব পরবর্তীকালে তাঁর কবিতায়, রাজনীতিতে, পত্রপত্রিকার লেখায় তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে ব্রিটিশ সরকার বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে নজরুল চলে আসেন কলকাতায়। এর আগেই, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’য় নজরুলের কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ ও পত্রিকার সংগঠক- লেখক মুজফফর আহমদের সঙ্গে চিঠিপত্রে সখ্য তৈরি হয়। মুজফফর আহমদের পরামর্শেই তিনি কলকাতা চলে আসেন এবং তাঁর সঙ্গেই বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দপ্তরে একটি ঘরে বসবাস শুরু করেন।

রুশ কমিউনিস্ট পার্টির অনুকরণে ভারতেও তখন সাম্যবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মুজফফর আহমদ, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানবেন্দ্রনাথ রায়, নলিনীকান্ত সরকার, আবদুল হালিম প্রমুখ আরও অনেকে। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে তিনি কমিউনিস্ট ইশতেহার পেয়েছিলেন এবং আবদুল হালিমের সঙ্গে তা বাংলায় অনুবাদও করতে চেয়েছিলেন। তখন মার্কস, লেনিন, বার্ট্রান্ড রাসেল থেকে ইবসেন, এমিল জোলা কিংবা শেলি, হুইটমান আর গোর্কির সাহিত্য সবই পড়ে ফেলেছেন নজরুল। বিশ্বসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার যে তাঁর অপরিচিত ছিল না, তা তাঁর ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধটি পড়লে বোঝা যায়। উপরোক্ত লেখক-কবি-চিন্তাবিদরা ছাড়াও আর যাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন- রবীন্দ্রনাথ, যোহান বোয়ার, নুট হামসুন, আনাতোল ফ্রাঁস, পুশকিন, দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, ফ্রয়েড, বালজ্যাক, কিলিং, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, মায়াকোভস্কি প্রমুখ আরও অনেকে। এইসব বিশ্ববিশ্রুত কবি-লেখক-ঔপন্যাসিক, সমাজতাত্ত্বিকের রচনা নজরুল যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর শিল্প-সাহিত্য সাধনা, রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শ বোধের কত গভীর থেকে উৎসারিত হয়েছিল। তা নিছক আবেগের তাড়না ছিল না। কার্ল মার্কসের অর্থনীতি-নির্ভর শ্রেণি-বিভাজন সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি যে মার্কসের ‘দ্য ক্যাপিটাল’ পড়েছিলেন এবং প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি থাকতেনও ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাঁর বন্ধু মুজাফফর আহমদের সঙ্গে; কিন্তু সে সব সত্ত্বেও তিনি নিজেকে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। অথচ সাম্রাজ্যবাদী শাসক, তাদের শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা সামাজিক অসাম্য ইত্যাদির বিরুদ্ধে এবং নিপীড়িত শোষিত দরিদ্র মানুষের পক্ষে তার বৈপ্লবিক রচনাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ‘নবযুগ’, ‘ধূমকেতু’ ‘লাঙল’, ‘গণবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকায়। উল্লেখ করা দরকার, এইসব পত্রিকার পরিচালনা ও সম্পাদনার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে।

নজরুলের জীবন ও তার ঘটনাবলির দিকে পুনর্বার দৃষ্টিপাত করার উদ্দেশ্য হলো, জীবনের এক-একটি পর্যায়ে তিনি যেসব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন, যেভাবে দেশ ও বিশ্বের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক ও মানবতার আদর্শ, চিন্তা-চেতনা পরিপুষ্ট হয়েছে, সেগুলো আমরা উপলব্ধি করতে পারব এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কেন তিনি প্রাসঙ্গিক তাও বিচার করতে পারব। নজরুলের সংগ্রাম ও দ্রোহ যে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি মূলত সন্নিবদ্ধ হয়েছিল, সংক্ষেপে সেগুলো হলো- ১. সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অত্যাচার ও শোষণ। ২. ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির প্রবণতা এবং ৩. অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য সৃষ্টি।

লক্ষ্য করলে দেখব, ওই তিনটি বিষয় আজও এই উপমহাদেশে এবং সমস্ত পৃথিবীতেই প্রাসঙ্গিক। এই শোষণ, বিভাজন এবং অসাম্য সৃষ্টিকারী শক্তি আজও পৃথিবীতে প্রবলভাবেই সক্রিয়। যে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে নজরুল সুতীব্রভাবে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,/মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি- নাই সেথা ভেদ নাই।’ (অভেদম)- সেই পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা আজ প্রায় সারা পৃথিবীকেই গ্রাস করে রেখেছে। এই শাসনব্যবস্থার স্বভাবধর্মই হচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য ও সংকটের মধ্যে দিয়ে পুঁজিকে বেড়ে ওঠার, আরও বিশাল হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া। এক ধরনের নব্যউদারবাদী, মুক্ত অর্থনীতির বিশ্বে একদিকে শ্রমজীবী মানুষের, তার মধ্যে ছোট এবং স্বনিযুক্ত ব্যবসায়ীরাও আছেন, অর্থোপার্জনের পথগুলো ক্রমেই রুদ্ধ হয়ে আসছে, অন্যদিকে ফুলেফেঁপে উঠছে বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলো। পৃথিবীব্যাপী এই করোনাভাইরাসজনিত মহামারির সময়েও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের এই আর্থিক সংকট আরও বেশি করে চোখে পড়ছে।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের অধিকাংশ দেশে, এমনকি সাম্প্রতিক ভারতেও যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আধিপত্য দখল করেছে, সেখানে সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র বা মার্কসীয় অর্থনৈতিক চিন্তাধারার কোনো স্থান নেই। মার্কস দেখিয়েছিলেন, কতিপয় ধনীয় হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ সঞ্চিত হয় আর ধীরে ধীরে দেশের অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন শ্রেণিতে পরিণত হয়। মার্কসের মতে, এই পুঁজিবাদ চরম স্তরে পৌঁছলে যে সামাজিক সংকট তৈরি হবে, সেই পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদের ধ্বংস অনিবার্য এবং ব্যক্তিগত পুঁজির দিনও সেদিন শেষ হবে। জানি না, বর্তমান বিশ্বে আমরা সেই সুদিন কবে দেখব! তবে এই সুদিনের স্বপ্নই তো দেখেছিলেন নজরুল।

১৯২৫ সালে কলকাতায় যে মজুর-স্বরাজ পার্টি গঠিত হয়েছিল, তার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘লাঙল’ পত্রিকা, যা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল। আসলে তার কিছুদিন আগে থেকেই বামপন্থীরা কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের মধ্যে শ্রেণি-চেতনা জাগানোর ও শ্রেণি-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সেই উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়েছিল এই মজুর-স্বরাজ পার্টি। এই পার্টির প্রথম ইশতেহারটি প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের স্বাক্ষরসহ।

এর আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নজরুল সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতার জন্য তাঁকে ব্রিটিশ সরকার কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল; কিন্তু তাতে তো তিনি হতোদ্যম হননি, বরং নতুন উদ্যামে তিনি ব্রিটিশ শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। এবার কৃষক-মজুর অর্থাৎ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের পাশে, ধর্মান্ধতার বিপক্ষে সরব হলেন তিনি। তাঁর ‘সর্বহারা’ কিংবা ‘সাম্যবাদী’ শব্দচয়নের মধ্যেই মার্কসীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন স্পষ্ট।

আজ এই মহামারির সময়ে আমেরিকায় চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে, ভারতে সেই সংখ্যাটি প্রায় বারো কোটি। দেশে দেশে এ ঘটনা বিরল নয়। দু-তিন মাসের বেতন পায়নি বহু বেসরকারি কর্মচারী। মনে পড়ে যায় ‘কুলি-মজুর’ কবিতার (সাম্যবাদী) এই অমোঘ পঙক্তিটি- ‘বেতন দিয়াছ?- চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল।’ ভারতের টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে আমরা দেখেছি মহামারির কারণে লকডাউন ঘোষিত হলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়ে, খাবার না পেয়ে কয়েকশ’ মাইল পায়ে হেঁটে তাঁরা গ্রামে ফিরছিলেন সপরিবার। তাঁদের জন্য ছিল না কোনো পরিবহন ব্যবস্থা। কতজন অনাহারে, ক্লান্তিতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছেন। রাত্রিবেলা ট্রেনলাইনে ঘুমিয়ে পড়া শ্রান্ত শ্রমিকদের ১৬ জন কাটা পড়েছেন মালগাড়িতে। তাদের অনেকেই ভিনরাজ্যে কাজ করতে যাওয়া নির্মাণ শ্রমিক। মজুর-শ্রমিকদের এই দুরবস্থা বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় এই উপমহাদেশজুড়ে। পূর্বোক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতার পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলো অনিবার্যভাবেই স্মরণে আসে- ‘রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,/রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,/বলত এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা/ কার খুনে রাঙা?- ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা।’

আজ যেখানে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মুক্ত বাজারের মাধ্যমে বড় পুঁজিকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে নেওয়ার, ওই পুঁজিই রাষ্ট্রের সাহায্যেই অধিকার করছে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ- এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনৈতিক লড়াই। এই প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি এবং আন্দোলন সংগঠিত হলে তবেই রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধনিক শ্রেণি আর শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা ও জীবনের স্বার্থকে পদদলিত করতে পারবে না।

আজকের এই পরিস্থিতিতেও মনে পড়ে যায় নজরুলের ‘সর্বহারা’র শ্রমিকের গান, কৃষাণের গান ইত্যাদি কবিতার কথা। যেখানে ‘ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত’ জোঁকের মতোন কৃষকের রক্ত শুষে নেয় কিংবা যেখানে রাজা-উজির নিংড়ে নেয় শ্রমিকের শ্রম, সেই শ্রমিককেই ওই রাজা-উজিরদের বোঝা বইতে হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষকে লড়াইয়ের ডাক দেন নজরুল- ‘এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে/দলবি রে আয় মজুর দল।/ধর হাতুড়ি তোল্ কাঁধে শাবল।’ আসলে এ-ও তো ওই প্রতিস্পর্ধী, রাজনীতি ও আন্দোলনের ডাক, বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেও যা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়।

নারী-পুরুষের সামাজিক অসাম্য নিয়েও কলম ধরেছিলেন নজরুল। নারীবাদের অন্যতম প্রবক্তা, লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছিলেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না’। অর্থাৎ জৈবিকভাবে একজন শিশু স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে জন্মায়, এটুকুই প্রাকৃতিক সত্য। জন্মলগ্নে সে জানে না, সে নারী না পুরুষ। বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া তৈরি করে দিয়ে তার ওপর লিঙ্গের কৃত্রিম ধারণা ও বিভাজন আরোপ করে সমাজ। এই বিভাজন নারীর জন্য অসাম্য ও বঞ্চনার আপাত-অদৃশ্য চোরাবালি তৈরি করে দেয়। মেয়েদের বঞ্চনার অন্যতম মূল উৎস অর্থনীতি। পুঁজিবাদী যুগেই এই অর্থনৈতিক বঞ্চনা চরমে ওঠে। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত হয় এঙ্গেলসের সাড়া জাগানো বই- ‘দ্য ওরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’। ‘পরিবারেই আসলে নারীদের পুরুষের জন্য নিবেদিত-প্রাণ যন্ত্রে পরিণত করে, আর সেই নারীদের বলি দিয়েই পুরুষের কীর্তিসৌধ তৈরি হয়’- বলেছিলেন এঙ্গেলস। সিমোন দ্য বোভোয়া লক্ষ্য করেছিলেন পুরুষশাসিত সমাজে নারী কীভাবে ‘অন্যজীব’ হিসেবে, ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কার্ল মার্কসের মতে, নারীমুক্তির প্রথম শর্ত সমগ্র নারীজাতির কর্মজগতে পুনর্নিয়োগ।

‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে নজরুল মানুষের সাম্যের কথা বলে গেছেন। নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্যবোধও নজরুলের সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। ‘নারী’ কবিতাটি তার সার্থক উদাহরণ। তিনিই বলতে পেরেছিলেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’ নারীকেও মানুষ হিসেবে দেখার, মর্যাদা দেওয়ার যে কথা নজরুল বলে গিয়েছেন, আজও নারীদের সেই সুদিন আসেনি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নারী শুধু প্রেয়সীই নয়। জগতের বড় বড় যারা মহীয়ান হয়েছে মাতা, ভগ্নি, বধূদের ত্যাগে। তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, ‘সে-দিন সুদূর নয়-/যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।’ সময়ের বিবর্তনেই নারীর অবস্থান আগের তুলনায় বদলেছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরও প্রবেশাধিকার ঘটেছে কর্মজগতে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গ’দা যেমন বলেছিল- ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/সে নহি নহি,/হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/সে নহি নহি,/ যদি পাশে রাখো মোরে/সংকটে সম্পদে,/সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/ সহায় হতে,/পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।’

এইভাবে নারীকে চেনার এবং নজরুল-অভীপ্সিত পুরুষের সঙ্গে নারীরও জয়গান গাওয়ার সমাজ কি তৈরি হয়েছে? নারীর এই সমানাধিকারের জন্য এখনো অনেক পথ পেরোতে হবে আমাদের।

অতি-সম্প্রতি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরের একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জর্জ ফ্লয়েড নামক এক নিরস্ত্র মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গকে রাস্তায় ফেলে এক মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরে রাখে আট মিনিটেরও বেশি সময় ধরে। ফ্লয়েড বার বার বলতে থাকে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’; কিন্তু নির্বিকার পুলিশ পকেটে হাত পুরে রেখে উপভোগ করেছে ফ্লয়েডের ক্রমশ শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়া। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি এত ঘৃণা, এত বর্ণবৈষম্য! তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে এই বিদ্বেষ আজ যেন নতুন করে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সারাবিশ্বেই। কোথাও ধর্মের, কোথাও জাতের, কোথাও গাত্রবর্ণের দোহাই দিয়ে চলেছে এই হত্যালীলা। ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন- ‘শ্বেত, পীত, কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।/আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ।/তুমি বল নাই, শুধু শ্বেত-দ্বীপে/জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,/সাদা রবে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান!/সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!/ভগবান! ভগবান!’

নজরুল যেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন এখনকার এই ভয়াবহ ঘটনাটি। চমকে উঠতে হয় ‘সাদা রবে সবাকার টুঁটি টিপে’ পঙ্ক্তিটি পড়ে। স্মরণে আসে, ১১০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘অপমানিত’ কবিতায়- ‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,/সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসনের স্বার্থেই সাম্প্রদায়িকতায় যে বিষবৃক্ষটি রোপণ করেছিল এই উপমহাদেশের মাটিতে, তাদের ভারত ছাড়ার এত বছর পর তা শুকিয়ে যাবার কথা ছিল; কিন্তু তা হয়নি। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হলো দেশ, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার আগুন ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকল। আসলে ধর্মব্যবসায়ীরা যেমন এর জন্য দায়ী, তেমনি কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা ও দলের গোপন কর্মসূচি এই আগুন নিভতে দেয় না। তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে তারা মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করে রাখে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে। পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা জনসাধারণকে একত্রিত বা সম্মিলিতভাবে সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকতে দেয় না। বিভিন্ন অসদুপায়ে মানবগোষ্ঠীকে তারা বিভাজিত করে, পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ বাধিয়ে রেখে তাদের হীনবল করে রাখে। জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে শাসককুল চিরকালই ভয় পায়।

সব দেশে, সব কালেই মহান কবি-লেখকরা ধর্ম, জাত-পাতের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন মানবতাকে। আমরা যদি আমাদের দেশের দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দেখি, তাহলে দেখব তাঁরাও মানবতার আদর্শের কথা বলেছেন, মানুষের জয়গান গেয়েছেন। এঁরা দু’জনেই আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কোনো ধর্মকেই কখনো অসম্মান করেননি। বরং এক-একটি ধর্মের দর্শনকে তাঁরা মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতির পক্ষে সহায়ক বলে মনে করেছেন; কিন্তু কোনো একটি বিশেষ ধর্মের গণ্ডীর মধ্যে তাঁরা নিজেদের পরিচয় বা কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি।

কার্ল মার্কস যেমন ধর্মকে আফিমের নেশা মনে করতেন, অনুরূপ ভাবনার প্রতিফলন দেখি নজরুলের ‘বিংশ শতাব্দী’ কবিতায়- ‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা/ধ্বংস করছি ধর্ম-যাজকী পেশা’। নজরুল বুঝেছিলেন- মোল্লাতন্ত্র, আর পুরুততন্ত্র উভয়ই ধর্মের নামে মানুষের পরিচয়কে খণ্ডিত করে, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ উসকে দেয়। মানুষকে সামগ্রিকভাবে মানুষ পরিচয়ে না দেখলে এই পারস্পরিক দূরত্ব বা হানাহানি কোনোদিন ঘুচবে না। সেজন্যই তিনি এত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন ‘সাম্যবাদী’ কবিতায়- ‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান।/যেখানে মিলেছে হিন্দু- বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান!’

আজ আমাদের এই উপমহাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেড়ে গেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। বেড়েছে ধর্মীয় সংকীর্ণতা। নিজের নিজের ধর্মরক্ষার অজুহাতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বাড়ছে আক্রমণ। এসময় নজরুলের এই পঙ্ক্তিগুলো তীব্রভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন- ‘হায় রে ভজনালয়,/তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!/মানুষেরে ঘৃণা করি/ও যারা কোরআন বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!/ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!- মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ;- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’ ব্রিটিশ শাসনকালের তুলনায় এখন ধর্মীয় সন্ত্রাস আরও অনেক বেশি বেড়েছে। জানি না, এ সময় নজরুলের মতো আর কোনো কবির পক্ষে এ রকম পঙ্ক্তিমালা লেখা সম্ভব কিনা। আর লিখলেও ধর্মান্ধরা কি তা মেনে নেবে!

১৯২৬ সালে কলকাতায় পরপর হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। তারপরই কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন’-এ ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি গেয়ে নজরুল সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে দিলীপ কুমার রায় তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ এই কথাগুলো আজও যেন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়, হওয়া দরকার। জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ নয়, মানুষ ভাবতে শিখুক, বলতে শিখুক- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ বহু ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সমালোচনা সহ্য করেও নজরুল অবিচল ছিলেন তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে। সে প্রয়োজন আজও রয়ে গেছে। আর সে জন্যই নজরুলকে পুনঃপুনঃ পাঠেরও প্রয়োজন। তাঁর সাম্যও মানবতার আদর্শকে আমাদের সমাজজীবনে, আমাদের দেশে, এই উপমহাদেশে রূপায়িত করা দরকার মানুষের স্বার্থেই।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //