সুফি, বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল-ফকির

বাংলা অঞ্চলের সুফি সাধকদের লেখা যেসব বই পাওয়া গেছে সেগুলো ষোড়শ শতক কিংবা তার পরে লেখা। এসব বইয়ের ভাষা বাংলা। যদিও সেই সময় মুসলমানদের ধর্মকথা প্রকাশে আরবি-ফারসি ভাষাকেই আদর্শ মানা হতো

কিন্তু সুফি কবিরা বাংলা ভাষায় এবং স্থানীয় পরিভাষা ব্যবহার করে সুফিতত্ত্ব প্রকাশ করেন। এতে করে ‘কিতাবের কথা’কে ‘হিন্দুয়ানি’ করে ফেলার অভিযোগ ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। বাংলায় লিখতে গিয়ে তাদেরকে গোঁড়াপন্থিদের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে হয়েছে। 

বৈষ্ণব সহজিয়াদেরকেও বাংলা ভাষায় লিখতে গিয়ে গৌড়ীয় গোস্বামীদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। বৈদিক ধর্মতত্ত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে সে সময় ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থেকে সংস্কৃতে লেখাই ছিল প্রথা। গোঁড়াপন্থিরা বিশ্বাস করতেন, সংস্কৃতই সত্য প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা।

সংস্কৃতে শত শত বই লিখেছেন বৃন্দাবনের গোস্বামীরা। কিন্তু সহজিয়ারা তাদের ভাবান্দোলনের সজীব ধারা এবং সপ্রাণ উদ্দীপনা প্রকাশে মুখের ভাষাকেই উপযুক্ত মনে করেছেন। এ সময়ের তত্ত্বীয় বিতর্ক এবং নতুন অভিব্যক্তি প্রকাশের পরিস্থিতি সহজিয়াদের লেখার ভাষাকে গদ্যভাষার নিকটবর্তী করে তুলেছে। 

সুফি ও সহজিয়া আন্দোলন বাংলা ভাষার বিকাশে যেমন, তেমনই এদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলে এবং এ দুটি সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে ফকির ও বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এই গায়ক-ভাবুকেরা প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের উল্টোস্রোতে চলতে থাকেন। তারা এমন কিছুর খোঁজ করেন যার মর্ম শরিয়ত কিংবা বেদভিত্তিক ব্যবস্থার মধ্যে ছিল না। 

পারসিক ও ভারতীয় সুফি ধারাগুলো বাংলা অঞ্চলে প্রবেশের পর, স্বাভাবিকভাবেই, এদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে থাকা জনবিশ্বাসগুলো সুফিমতের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে। তখন পারসিক ও ভারতীয় সুফিবাদ থেকে স্থানীয় সুফিবাদ স্পষ্টত আলাদা হয়ে পড়ে। কোনো কোনো গবেষকের ভাষায় বাংলার সুফিবাদ তখন আর ‘বিশুদ্ধ থাকিতে পারে নাই’ বা ‘বিকৃত হইয়া পড়ে’। পারসিক কিংবা ভারতীয় সুফি ধারাগুলো বুঝি বা কখনো ‘বিশুদ্ধ’ ছিল! সূক্ষ্ম 

বিচার-বিশ্লেষণে না গিয়েও দেখা যাবে, আরব থেকে পারস্যে পৌঁছার পর সুফিমতে পারসিক সর্বেশ্বরবাদ ঢুকে পড়েছে এবং পারসিক সুফি ধারাগুলো ভারতে বিস্তার লাভের পর এতে ঔপনিষদিক অদ্বৈতবাদ, শিব-শক্তিবাদ কিংবা বৌদ্ধ মতের প্রবেশ ঘটেছে। এমনকি পারসিক সুফিবাদ বিকাশের গোড়াতেও বেদান্ত মতের প্রভাব লক্ষণীয়। 

বাংলা অঞ্চলের সুফিরা যখন স্বাধীনভাবাপন্ন হয়ে সুফিতত্ত্ব প্রকাশ করতে শুরু করেন তখন এতে তন্ত্রের দেহাত্মবাদ, যোগ, বেদান্ত ইত্যাদি মতের সংশ্লেষ ঘটে। তবে যখন থেকে এই ‘অবিশুদ্ধতা’ শুরু হয়, তখন থেকেই এর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রূপের প্রকাশ স্পষ্ট হতে থাকে। এই স্বতন্ত্র রূপটাই বাংলা অঞ্চলের সুফিয়ানার নিজস্ব ধরন। 

লক্ষণীয় যে, এদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনে ধর্মের প্রভাব খুঁজতে গিয়ে কিংবা হিন্দুধর্মের বিবর্তন বুঝতে গিয়ে কোনো কোনো গবেষক বৈষ্ণব সহজিয়াদের ক্ষেত্রে তাদের অনুসন্ধান বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেন না, কারণ তাদের ভাষায় এই ধারায় ‘যৌন বিকৃতি ও অনাচার’ ঢুকে পড়েছে।

এই গবেষকেরা পরকীয়া তত্ত্বের আক্ষরিক অর্থের বাইরে আর কোনো তাৎপর্য খুঁজতে যান না। তারা রতি ও রসের সাধনাকে কেবল মৈথুনতত্ত্বে সীমিত রাখেন। সহজিয়াদের সাধনপন্থা ও তত্ত্বের অন্য কোনো লক্ষ্য আছে কিনা, কিংবা সহজিয়ারা তাদের গূঢ়তত্ত¡ নিয়ে যেসব বই লিখেছেন তাতে আদৌ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু আছে কিনা সেই আলোচনার অবকাশ এসব গবেষকের মধ্যে দেখা যায় না। 

চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের সময় থেকেই বাউল গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে থাকবে। কারণ ষোড়শ শতকে লেখা বিভিন্ন বইয়ে বাউল কথাটির ব্যবহার আছে এবং এসব ব্যবহারে বাউলদের প্রতি একটা শ্রদ্ধাভাব লক্ষ করা যায়। কাছাকাছি সময়ে উদ্ভ‚ত সুফি ও বৈষ্ণব সহজিয়াদের সঙ্গে নানাদিক থেকে বাউলমতের মিল ও অমিল আছে। আমরা দুটো ধারার সঙ্গেই বাউলমতের এক জটিল বুনন লক্ষ করি।

সুফি ও সহজিয়া বৈষ্ণব মত থেকে গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে বাউল সম্প্রদায় যেভাবে তাদের দর্শনের গভীর জায়গাটি নির্মাণ করেন তাকে সরলভাবে ‘মানবতাবাদ’ দিয়ে বোঝা যাবে না। যদিও সেই চেষ্টা করা হয়। বাউলেরা ‘সহজ মানুষ’ বলতে দেহের ভেতর যে রসিক কর্তার অনুসন্ধান করেন, সেই কর্তার সঙ্গে সর্বজনীন ‘মানব’ ধারণার কোনো মিল নেই।

এই সম্প্রদায়ের চিন্তায় ‘অভেদত্ব’ প্রতিষ্ঠার সাধনাকে ব্যাপক অর্থে না দেখে কেবল জাতভেদের ধারণায় নামিয়ে আনতে দেখা যায় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহিষ্ণুতা এসব ধারণা দিয়ে বাউল মত ব্যাখ্যা করা হয়। এসব কিছুর ভেতর দিয়ে বাউল-ফকিরেরা ক্ষমতাবান শ্রেণির মতাদর্শিক যন্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত হন। তাদেরকে জাতীয় সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ইত্যাদি অভিধা দিয়ে বর্ণনা করা হয়। 

বাংলা অঞ্চলের সুফিরা শরিয়ত মান্য করতেন। এদের ভেতর থেকে যারা প্রেম-ভক্তিকে মুখ্য করে তোলেন এবং মর্মমুখী ভাবুকতাকে তাদের সাধনার কেন্দ্রে রাখেন; কিন্তু শরিয়ত গ্রাহ্য করেন না তাদের মাধ্যমেই ফকিরি ধারা প্রবর্তিত হয়। এদেরকে বলা হয় বেশরা ফকির বা নেড়ার ফকির।

তারা যে বৌদ্ধমণ্ডলী থেকে মুসলমান হয়েছিলেন ‘নেড়া’ শব্দ থেকে সেটা বোঝা যায়। বাংলা অঞ্চলের সুফিরা নিরাকার পরমকে বলেন নিরঞ্জন বা শূন্য, যা বৌদ্ধ শূন্যবাদকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুফিদের চার মোকামের ধারণাও বৌদ্ধ চার চক্রের ধারণার নবায়ন, কেবল চার ফেরেশতাকে যুক্ত করা হয়েছে এইসব মোকামের প্রহরী হিসেবে। একইভাবে

শিব-শক্তিবাদের আদলে সুফিরা দেহের মোকামে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন নিরাকার পরমকে। বেশরা ফকিরদের এই গোষ্ঠী শরিয়ত না মানলেও মর্মমুখী চিন্তা প্রকাশ করতে সুফিদের মিশ্র পরিভাষাটাই ব্যবহার করেছেন। 

গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন থেকে আলাদা ধারা হিসেবে যে সহজিয়া বৈষ্ণবদের উদ্ভব ঘটে, তাদের চিন্তায়ও হিন্দু-বৌদ্ধ তন্ত্র ও যোগের প্রভাব দেখা যায়। সুফি-ফকিরদের কাছে যা দেহের মোকাম সহজিয়ারা তাকে বলছেন নিত্যধাম, সহজপুর বা গুপ্তচন্দ্রপুর। সুফিরা যেখানে নিরাকার নিরঞ্জনকে খুঁজেছেন সেই মোকামে সহজিয়ারা খোঁজ করেছেন সহজ মানুষকে, যিনি এক রসিক কর্তা। সহজিয়া বৈষ্ণবদের চিন্তায় সুফি ও নাথপন্থিদের প্রভাবও পড়েছে। 

বেশরা ফকিরেরা যেমন সুফিদের আচারনিষ্ঠাকে বর্জন করেন, তেমনই সহজিয়া বৈষ্ণবদের ভেতর থেকেও কিছু রসিক বৈষ্ণব বৈষ্ণবাচার পরিত্যাগ করেন। তারা আচারমুখিনতা ছেড়ে মর্মের সাধনকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেন। বৈষ্ণবাচারের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল এই রসিক বৈষ্ণবেরা বেশরা ফকিরদের অনেকটা কাছাকাছি চলে আসেন। উভয় দলই মর্ম সন্ধানী; উভয় দলই আচারসর্বস্বতা এবং প্রথা-প্রতিষ্ঠানের বিরোধী। তারা দেহের ভেতর নিগুম শহরে এক অধর কালার সন্ধান করতে থাকেন। এরাই বাংলার বাউল-ফকির। 

সুফি ও বৈষ্ণব সহজিয়া মতের সঙ্গে বাউল-ফকিরদের মতের অন্তর্বয়নের রূপটি বেশ জটিল। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে লেখা কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বইয়ে বাউল শব্দটি বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত হয়েছে। এতে চৈতন্যকে বলা হয়েছে মহাবাউল। এখানে বাউল এমন এক ‘ভাবোন্মত্ত’ বা ‘উন্মাদ’ ব্যক্তি, যিনি বিশুদ্ধ প্রেমের সুখসাগর থেকে অমৃত পান করতে চান, কিংবা কৃষ্ণমাধুর্যের অমৃতস্রোতে অবগাহন করতে চান।

বিবর্ত বিলাস নামে শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের সহজিয়া ভাষ্য লেখেন অকিঞ্চন দাস। এটি লেখা হয় ১৬২৫ সালে। ১৮৫৯ সালে কলকাতা থেকে বইটির এক মুদ্রণে এর শিরোনাম দেওয়া হয় বিবর্ত বিলাস অর্থাৎ বৈষ্ণব ও ফকিরি সম্প্রদায়ীদিগের ধর্ম্ম ও নিগূঢ় তত্ত্বাবলী। বৈষ্ণব সহজিয়া মতের বই হলেও অকিঞ্চন দাসের এ বইটিকে একই সঙ্গে ফকিরি মতের বই হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

অকিঞ্চন দাস নিজে একজন সহজিয়া সাধক। তিনি তাঁর বিবর্ত বিলাস-এ বাউল প্রসঙ্গে বলছেন, ‘প্রকট আছয়ে ভাই সেবার বিধান। মহাসুখ মহাদুখ বিবর্ত্ত সন্ধান / রূপের ধারা পাইয়া ভাই বাউল যে জন। নয়নে চিনিয়া হেন রসিকের গণ / জগতের জন তাদের দেখিতে না পায়।

দেখিতে পাইলে তবু চিনিতে নারয়’ (তৃতীয় বিলাস)। অর্থাৎ ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে এসে তাদেরকে ‘গণ’ বা গোষ্ঠী হিসেবে চেনা যাচ্ছে। এই বাউলেরা বিবর্ত সন্ধান করেন। ‘রূপের ধারা’ পেয়ে যিনি বাউল হন সাধারণ লোকেরা তাকে চোখে দেখেও দেখতে পায় না। আর দেখতে পেলেও চিনতে পারে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে অকিঞ্চন দাস বৈষ্ণব সহজিয়া মতকে চিহ্নিত করছেন বাউলগোষ্ঠীর মত বলে। আবার উনিশ শতকের মধ্যভাগে এসে একই মতকে ফকিরি সম্প্রদায়ের মত হিসেবেও দেখা হচ্ছে। 

সুফি-বৈষ্ণব ও বাউল-ফকিরদের তত্ত্ব ও চর্চার অন্তর্বয়নের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় বাংলা অঞ্চলের সুফি কবি ও সাধকদের মাধ্যমে। তারাই সুফিমতের গূঢ়তত্ত্ব প্রকাশ করতে স্থানীয় পরিভাষা ব্যবহার করেন, যেমন সুরতনামা বা নূরজামাল-এর লেখক হাজী মুহম্মদ লিখেছেন, ‘যেই আল্লা সেই খোদা গোসাঞি তার নাম।’

একই পরম ভাব প্রকাশ করতে মীর সৈয়দ সুলতান পুরুষ বা নিরঞ্জন কথাটি ব্যবহার করেন। অন্যদিকে সুফি সাধক ও কবি আলী রজা ওরফে কানু ফকির লিখেছেন, ‘শূন্যরূপে এক আল্লা সততে উজ্জ্বল।’ আলী রজা পরকীয়া তত্ত্বেরও সমর্থক ছিলেন।

অর্থাৎ ব্যাপারটি কেবল পরিভাষা ব্যবহারে সীমিত ছিল না, তত্ত্বগুলোর মর্মবস্তুকেও তারা গ্রহণ করেন। এদেশের সুফিরা সৃষ্টিতত্ত্বের বর্ণনায় সাংখ্য পরিভাষা সত্ত্ব, তমঃ, রজঃ যেমন ব্যবহার করেন, তেমনই যোগ পদ্ধতির ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, ত্রিবেণী ইত্যাদি শব্দও আত্মীকরণ করে নেন।

কিন্তু লক্ষণীয় ব্যতিক্রম এটাই যে, সুফিরা স্থানীয় পরিভাষা ও প্রতীকগুলোকে আত্মীকরণ করলেও বৈষ্ণব সহজিয়ারা সুফিদের ইসলামি পরিভাষা গ্রহণ করেন না, যেটা করেছেন বৈষ্ণব সহজিয়া কমিউনিটি থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেওয়া রসিক বৈষ্ণব বা বাউলেরা।

কেবল এই বাউল ও ফকির সম্প্রদায়ই তাদের মরমি ভাবুকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে সব সম্প্রদায়ের পরিভাষা ও প্রতীককে কাজে লাগিয়েছেন। তারা বৈষ্ণব সহজিয়াদের সহজ মানুষ, রূপ-স্বরূপ, বাঁকা নদী, স্রোতের উজান, নিত্যধাম, সদানন্দপুর, পদ্ম সরোবর, ভাব-রস-প্রেম ইত্যাদি এবং সুফিদের আল্লা-নবী, শরিয়ত-মারিফত, অচিন পাখি, মোকাম-মঞ্জিল, মুর্শিদ, লা-শরিক ইত্যাদি পরিভাষাও গ্রহণ করেন এবং এসবে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন। 

বাউল-ফকিরদের পদাবলির ভাষায় রূপক-প্রতীক এবং পরিভাষাগুলো সঞ্চরণশীল। এগুলো চিহ্নের প্রচলিত সীমানা ডিঙিয়ে যায়। যেহেতু ভাষা নির্দেশিত মর্মবস্তুটাই তাদের কাছে মুখ্য এবং তারা সীমা ডিঙানো চিহ্ন-প্রতীকগুলো দিয়ে সেই মর্মবস্তুটাকে অনুভবগ্রাহ্য এবং বিস্তৃত করে তোলেন, তাই যখন আমরা এসব ভাবগানের শ্রোতা হই, চেনা ও অচেনার এক আন্তঃক্রীড়া আমাদের হৃদয় ও মনকে সঞ্চারিত করে অর্থময়তার কোনো গভীর অঞ্চলে। বাউল-ফকিরদের পদাবলির এই উন্মুক্ততা প্রত্যেকের সাধ্য অনুযায়ী অর্থগ্রহণকে সম্ভব করে তোলে। যারা প্রকৃত রসিক তারাই এর থেকে যথাযথ ভাব ও রস গ্রহণ করতে পারেন। 

তবে বাউল-ফকিরদের তত্ত¡ ও ভাবের জগৎকে কেবল আত্মীকরণ দিয়ে বোঝা যাবে না। তাদের জিজ্ঞাসা, বিচারী দৃষ্টিকোণ, গ্রহণ-বর্জনের নিরিখ এবং নতুন তাৎপর্য সৃষ্টির মধ্যে নিহিত আছে তাদের ভাবান্দোলনের মূল মর্মবস্তু। 

তান্ত্রিক ও বৈষ্ণব সহজিয়ারা জাতভেদ ও বর্ণ প্রথা মানতেন না। বাউল-ফকিরেরা এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে এসব প্রথা অনুসরণকে দুরাচার বলে গণ্য করেন। তারা বেদ-শরিয়ত মানেন না এবং এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্ভর প্রথা ও কানুনেরও বিরোধিতা করেন। তাদের কাছে এসব বিধি-বিধান অর্থহীন এবং বোকামি। বাউল-ফকিরেরা সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথার উল্টো স্রোতে চলেন। তাদের মধ্যে জাগতিক কামনা-বাসনা নেই, আনন্দ-বেদনাও তাদেরকে স্পর্শ করে না। নিজেদেরকে তারা বলেন জ্যান্তে মরা। 

বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুফি ও বৈষ্ণব সহজিয়াদের মতাদর্শিক মিলের জায়গা এটা যে, এরা সবাই মানবদেহকে অণুবিশ্ব হিসেবে দেখেন। তারা বিশ্বাস করেন, বাহ্যজগৎ ও দিব্য সত্তার মধ্যে সংযোগের সেতু হলো মানবদেহ এবং মানবদেহের ভেতর আছে সেই মোকাম যেখানে পরম সত্তার দেখা পাওয়া যাবে। এই পরমকে তারা দেখেছেন প্রেমাস্পদ রূপে। সুফি, বৈষ্ণব সহজিয়া কিংবা বাউল-ফকির- সবকটি ধারাতেই এই প্রেমাস্পদকে পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে গুরু বা মুর্শিদ নির্ভরতা আছে। 

এক্ষেত্রে বৈষ্ণব সহজিয়াদের সঙ্গে বাউল-ফকিরদের অবস্থানের পার্থক্য এখানে যে, সহজিয়ারা কামকে প্রেমে রূপান্তর করতে চান এবং সেই প্রেম মানবীয় প্রেমেরই শুদ্ধ রূপ। সহজিয়ারা এই প্রেমের মাধ্যমে নিজেরা দিব্য সত্তা হয়ে ওঠেন। তারা কেবল ‘চিনির স্বাদ’ নিতে চান না, নিজেরাই ‘চিনি’ হয়ে উঠতে চান। অন্যদিকে বাউল-ফকিরদের প্রেম মানুষের সঙ্গে পরম সত্তার। এই প্রেমের ভেতর দিয়ে তারা স্বর্গীয় সত্তাকে উপলব্ধি করতে চান। এতে নিজেদেরকে পরম সত্তায় রূপান্তরের ব্যাপার নেই। 

রসিক বৈষ্ণব এবং বেশরা ফকিরেরা একসঙ্গে বাউল-ফকির বলে চিহ্নিত হয়েছেন, যেন তারা একই গোষ্ঠীভুক্ত। তারা নিজেরাও পরস্পরের সঙ্গে অভিন্নপ্রায় হয়ে উঠেছেন। কারণ উভয়ের পরিভাষা এবং তত্ত্ব ও ভাবের জগৎ একই রকম। উভয় দলের একীভূত হয়ে যাওয়ার পেছনে সুফি সাধকদের ভূমিকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের মাধ্যমেই বৌদ্ধ, বৈষ্ণব ও যোগের পরিভাষা আত্মীকৃত হয়েছে। বেশরা ফকিরেরা এই পরিভাষা গ্রহণ করেন, যা তাদেরকে রসিক বৈষ্ণবদের নিকটবর্তী করে তোলে।

এছাড়া উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যস্থতার কাজ করেছে বৌদ্ধতন্ত্র, দেহাত্মবাদ ও বৈষ্ণববাদ। উভয় গোষ্ঠীর মর্মমূলে শিরদাঁড়ার মতো কাজ করেছে এইসব বিশ্বাসধারা। উপরন্তু যে ব্যবস্থা ও বিধিবিধানের উপর দাঁড়িয়ে সমাজভেদ ঘটে তার কোনোকিছুই তারা মানতেন না। হিন্দু বা মুসলমান উভয় সমাজের কর্তাদের কাছেই তারা ‘অচ্ছুত’ ছিলেন। 

উপরন্তু, ষোড়শ শতকে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক যে বিরোধপূর্ণ ছিল এমন নয়। যদিও কোনো কোনো ইতিহাসকার জয়ানন্দ ও ইশান নাগরের বই থেকে

উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের চিত্র তুলে ধরেন। ব্রাহ্মণ-যবনের বিরোধ প্রসঙ্গে লিখেছেন জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে। গোঁড়াপন্থি মোল্লা ও কাজীদের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের এই বিরোধ থাকা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু সমাজের সাধারণ জনগণের মধ্যে এই বিদ্বেষভাব ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং উল্টো নজির আছে অনেক।

কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত এবং বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত থেকে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, যেমন গৌড়ের সুলতান হওয়ার আগে হুসেন খাঁ ছিলেন গৌড় অধিকারী সুবুদ্ধি রায়ের কর্মচারী। শ্রীবাসের বাড়িতে মুসলমান দর্জিরা কাজ করতেন। হোসেন শাহর সেনাপতি পরাগল খাঁ কবীন্দ্রকে দিয়ে মহাভারত পাঁচালি রচনা করান।

যখন রামায়ণ কাহিনি পাঠ করা হতো সেখানে মুসলমানরাও উপস্থিত থাকতেন এবং তারা এসব কাহিনি শ্রদ্ধা নিয়ে শুনতেন। এসব দৃষ্টান্ত হিন্দু-মুসলমানের পেশাগত এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের প্রমাণ দেয়। অবশ্য বর্তমান প্রসঙ্গে হিন্দু-মুসলমান সমাজভেদের আলোচনা খুব প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ বাউল কিংবা ফকির উভয় গোষ্ঠীই হিন্দু-মুসলমান সমাজ থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন, ব্রাহ্মণ-যবনের বিরোধ বা হিন্দু-মুসলমান সমাজভেদের প্রভাব তাদের উপর পড়ার কথা নয়। 

গত শতকের গোড়ার দিকে ঔপনিবেশিক ক্ষমতা বলয়ের ভেতর হিন্দু-মুসলিম জাতীয়তাবাদ যখন প্রবল হয়ে ওঠে এবং সামাজিক পরিসরে এর প্রভাব সুদৃঢ় হতে থাকে তখন থেকেই বাউল ও ফকিরি ধারার মাঝখানে সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা স্পষ্ট হওয়া শুরু করে। এই প্রভাব বলয়ের ভেতর থাকা

বাউল-ফকিরেরা তাদের পরিভাষাগুলোকে আলাদা করে নেন। হিন্দু-মুসলমান সমাজভেদে বাউল-ফকিরদের পরিভাষা ভিন্ন হতে থাকে। ফকিরি ধারার সাধকদের গান থেকে রাধা-কৃষ্ণ, গৌর-নিতাই বিদায় নেন। তাদের পক্ষে আর ‘খোদে খোদ আল্লা রাধা দোস্ত মুহম্মদ’-এর মতো পদ রচনা করা সম্ভব হয় না। তবে এই ভেদজ্ঞান বা এই শব্দভেদের অর্থহীন জবরদস্তি নিয়েও গান লেখেন কেউ কেউ‘করিম-রহিম রাধা-কালী এ-বুল সে-বুল যতই বলি/শব্দভেদে ঠেলাঠেলি হইতেছে সংসারে।’ 

নিশ্চয়ই, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক ক্ষমতার বাইরে থাকা বাউল-ফকিরদের এই ঠেলাঠেলি স্পর্শ করেনি। যারা এই ভেদজ্ঞানের বিরোধী, তাদের ভাবের ঘরে তালা পড়ে না।  

লেখক: শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //