কালের চক্রে

আমার বাবা কৃষক ছিলেন। কয়েকশ বিঘা জমি, গোয়ালে কয়েকটা হালের গরু আর হালচাষের জন্য একজোড়া লাঙল-জোয়াল ছিল তার সম্বল। তিনি মারা যাওয়ার আগে উত্তরাধিকারসূত্রে এ সবকিছু আমি পেয়েছি। আমার বাবার ইচ্ছে ছিল, আমি যেন বড় হয়ে শিক্ষক হই। আমি শিক্ষক হয়েছি। শিক্ষক হতে গিয়ে প্রচুর বই-পত্র পড়তে হয়েছে। আমার পড়া সব বই সংগ্রহ করে রেখেছি। বাসায় একটা লাইব্রেরিও গড়ে তুলেছি। লাঙল বা জোয়ালটাকে আমি একবার ছুঁয়েও দেখিনি।  

শৈশব-কৈশোর থেকেই নতুন জামা-জুতো কেনার শখ হয় না আমার। প্রতি মাসে নিয়ম করে বই কেনার শখ হয়। এ শখটা দুর্মর। এটাকে এক প্রকার নেশাও বলা যায়। আমার এই নেশাটা শুরু হয়েছিল হাইস্কুলে পড়ার সময় সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই অমৃত বাণী ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ পড়ার পর। হাজার হাজার টাকা খরচ করে শত শত বই কিনে আমি আলমারি ভরেছি। আমার বাবা আমার জন্য রেখে গেছে জমি, হালের গরু, লাঙল-জোয়াল আর আমি আমার ছেলের জন্য রেখে যেতে চাই বই। কিন্তু আমার একমাত্র ছেলে বই পড়তে চায় না। তার বয়সে আমি ‘আম আঁটির ভেঁপু’র যে রস আস্বাদন করেছি, সেই রস এখন পিঁপড়ায় খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে। সেদিন বইয়ের আলমারিটা খুলে দেখি কালজয়ী সব বই পিঁপড়া আর উই পোকায় কেটে ফেলেছে। ছেলেকে বললাম, ‘বই পড়, না পড়লেও মাঝেমধ্যে বইগুলো আলমারি থেকে নামিয়ে নাড়াচাড়া কর।’

কিন্তু বই পড়া দূরে থাক, কোনো বই ছুঁয়েও দেখে না সে। তার পাঠ্যবইয়ে যে গল্প-কবিতা আছে তাও পড়ে না। শুধু গাইড বই থেকে কিছু বহুনির্বাচনী ও সৃজনশীল প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়। পরীক্ষায় উত্তরপত্রে বল পয়েন্ট দিয়ে বৃত্ত ভরাট করে পাস করা প্রজন্ম ‘পথের পাঁচালী’ কিংবা ‘আম আঁটির ভেঁপু’র মর্মার্থ কী করে বুঝবে? 

সেদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আম আঁটির ভেঁপু কী, জানিস?’

ছেলে গুগলে সার্চ দিয়ে আমাকে ছবি দেখিয়ে ‘আম আঁটির ভেঁপু’ চেনাল। ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বলে আমি যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইটা বুঝিয়েছি ছেলে তা বুঝল না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘জিনিসটা আসলে কী? কোনো দিন দেখেছিস? কখনো বাজিয়েছিস?’

ছেলে মাথা নাড়ল। দেখেনি। কোনো দিন দেখেনি। বাজায়ওনি কখনো। অথচ আমাদের ফেলে আসা শৈশবে এটা ছিল পরম আনন্দের একটা জিনিস। পাকা আম খাওয়ার পর ফেলে দেওয়া বিচি থেকে মাটি ফুঁড়ে উঁকি দিত আমের চারা। এক ফুট বা তারও কম লম্বা হওয়া চারা উপড়ে আঁটির শক্ত বাকলটা ফেলে দিয়ে ভেতরে পেতাম নরম দুটো বীজপত্র। এটাকে দেয়ালে ঘষে একটা পাশ ক্ষয় করে ছিদ্র করতাম। এই ছিদ্রে ঠোঁট রেখে ফুঁ দিলে বাঁশির মতো বেজে উঠত। এটাকেই বলে আম আঁটির ভেঁপু। 

ছেলে আমাকে গুগল থেকে আম আঁটির ছবি দেখিয়েছে বটে; কিন্তু ভেঁপু কীভাবে বানাতে হয় তা তো জানে না। ছেলে যদি আমাকে আম আঁটির ভেঁপু বলতে বিভূতিভূষণের বইটাকে দেখাত কী যে খুশি হতাম! আমি জানি,  সে কখনো ‘আম আঁটির ভেঁপু’ পড়েনি। গ্রামের ধুলোমাখা মাটির পথে পথে সিম্বল রেখে যাওয়া অপু আর দুর্গার খেলা তাকে টানবে না। কারণ তার খেলা চলে মোবাইলে। কেবল আঙুল টিপে টিপে মোবাইলে খেলে, মোবাইলে কথা বলে আবার মোবাইলেই মুভি দেখে। হাতের মুঠোয় থাকা মোবাইলের ইন্দ্রজালে আটকে থাকতে ভালো লাগে তার। তাই দেখে একদিন আমি বলেছিলাম ‘এভাবে দিনরাত মোবাইলের মাঝে আটকে না থেকে পথের পাঁচালীটা একবার পড়ে দেখিস, ভালো লাগবে।’

ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘দেখেছি। ভালো লাগেনি।’

আমি খুশি হয়ে জানতে চাইলাম, ‘তুই পথের পাঁচালী পড়েছিস?’

‘না, পড়িনি, ইউটিউবে দেখেছি।’

হায়রে ইউটিউবের কাল! কালের চক্রে পথের পাঁচালী বই না পড়ে ছেলে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী দেখে। শরৎচন্দ্রের দেবদাস নয়, দেবদাস বলে জানে শাহরুখ খানকে। ঐশ্বরিয়াকে পার্বতী আর মাধুরী দীক্ষিতকে জানে চন্দ্রমুখী! 

আজকাল ইউটিউব নামের আজব এক মাধ্যম আছে, যেখানে আঙুল ছোঁয়ালেই দেখা-অদেখা ভিডিও দৃশ্য উদ্ভাসিত হয়। আর এসব দৃশ্য উদ্ভাসিত করতে খরচ হয় শত শত টাকা। সেই টাকা আবার দিতে হয় আমাকেই। আমাদের শৈশবকালে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই কিনতাম। আর এ কালের ছেলেমেয়েরা বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে কিনে গিগাবাইট, মেগাবাইট। আমরা বই কিনতে টাকা খরচ করতে দ্বিধা করতাম না। কারণ টাকা খরচ করে বই কিনতে আমাদের অনুপ্রেরণা ছিল সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই অমৃত বাণী, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’

কিন্তু আমার ছেলেকে কিছুতেই এই মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে পারি না। ইউটিউব, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমু আর হোয়াটসঅ্যাপের যুগের ছেলেকে যতই বলি, ‘টাকা খরচ করে ওসব জিবি-এমবি না কিনে বই কিনে পড়। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’

ছেলে আমাকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে বোঝায়, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া না হলেও বই পড়ে কেউ আউলিয়া হয় না!’ 

ছেলেকে বোঝাতে পারি না, বই পড়ে কেউ আউলিয়া হয় না বটে, কিন্তু বইয়ের সরোবরে একবার ডুব দিলে, মানুষ অমৃতসূধা পান করতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //