মানির বিশ্বধর্ম, তাঁর উত্থানের ইতিবৃত্ত ও পরিণতি

যিশুখ্রিস্টের বিদায়ের দুইশ’ বছর পরে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকজন ধর্মপ্রচারকের আবির্ভাব ঘটে, তিনি মানি (২১৬-২৭৬)। সিরিয়াক ভাষায় প্রকাশিত তার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দলিলাদিতে তাকে ‘মানি হায়া’ অর্থাৎ জীবন্ত মানি নামে সম্বোধন করা হয়েছে। এ আজ সত্যিই বিস্ময়কর যে, মানির ধর্ম একদা বিশ্বের প্রধানতম ও সবচেয়ে বেশি ধর্মাবলম্বীর ধর্মাদর্শ ছিল, আজ বেশিরভাগ মানুষ সেই ধর্ম এবং তার প্রচারকের নাম সম্পর্কেও জ্ঞাত নন।

দো স্তূপ ও লিউ লিখেছেন যে, এই ধর্ম একদা জন্মলাভ করেছিল দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ ব্যাবিলনিয়াতে, বিস্তৃত হয়েছিল পশ্চিম আটলান্টিকের তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে, সেইসঙ্গে দূর প্রাচ্যের প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোতেও। এর অনুসারী ছিল মিসরে, রোমক সট নিয়ন্ত্রিত উত্তর আফ্রিকায়, স্পেনে, গলে, ইতালিতে, বলকান অঞ্চলগুলোতে, এমনকি দক্ষিণ চীনের সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে।

এমনকি গত শতাব্দীতেও এই ধর্মের কিছু অবশেষ ছিল। গত শতাব্দীতে ভিয়েতনামে এই ধর্মকে নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। এই অতিন্দ্রীয়বাদী কিংবা আরও সঠিক করে বললে অতিজ্ঞানবাদী ইহুদি-খ্রিস্টধর্মের (Gnostic Judeo-Christianity) প্রধান প্রবক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা মানি, যার মতাদর্শ কালে একটি স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করে। সিরিয়াক ও নাবাতীয় বা নাবতাঈ ভাষাতে প্রকাশিত ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দলিলাদিতে মানির মতাদর্শে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ছাড়াও জরথুষ্ট্রের ধর্ম ও তার পূর্বেকার দ্বৈতবাদী ধর্মের (dualistic religion) প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

যে দ্বৈতবাদী ধর্মে জগতে সমান ক্ষমতাসম্পন্ন দু’জন ঈশ্বরের কথা আছে, যার একজন শুভময়তার দেবতা বা আহুরা মাজদা ও অন্যজন অশুভময়তার দেবতা বা আহরীমান। আহরীমানের আরেক নাম অংগ্রমৈন্যু। অবশ্য অনেক ধর্মবেত্তা ও ঐতিহাসিক মনে করেন যে, জরথুষ্ট্রের পরবর্তীকালে আহুরা মাজদাকে শক্তি ও ক্ষমতায় আহুরীমানের ওপর স্থান দেওয়া হয়েছে।

মানির ধর্মমতে, ইহুদি এবং বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও ভালোমতো লক্ষ্য করা যায়। আর মানির কোনো কোনো ধর্মীয় বিষয়াদিতে তাঁর ঠিক প্রায় তিনশত বছর পরে জন্ম নেওয়া ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক পয়গম্বর মুহাম্মদের (সা.) ধর্মমতের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য দেখা যায়। যদিও পবিত্র কোরআনে মানির কোনো উল্লেখ নেই। অবশ্য পবিত্র কোরআনে মাত্র ২৫ জন পয়গম্বর ও ৩ জন সম্ভাব্য পয়গম্বরের নাম আছে।

আর বিভিন্ন ইসলামী সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, ইসলামী বিশ্বাস মতে, পৃথিবীতে ১ লাখ ২৪ হাজার মতান্তরে ২ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বর (অবশ্য এর সপক্ষে এখন পর্যন্ত কোনো দলিল পাওয়া যায়নি) প্রেরিত হয়েছেন এবং এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে সৃষ্টিকর্তা কোনো পয়গম্বর প্রেরণ করেননি। আর পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে যে, ‘সতর্ককারী প্রেরণ ব্যতিরেকে কাউকে তিনি শাস্তি দেন না এবং রাসূল প্রেরণ ব্যতিরেকে আমরা কাউকে শাস্তি দেই না’। 

মজার ব্যাপার হলো, ইসলামের মতো মানির মতাদর্শও সমন্বয়বাদী ছিল। মানি তাঁর বচনে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতবর্ষীয় সমস্ত মহাপুরুষ এবং তাদের ধর্মমতসমূহকে আত্মস্থ করতে চেয়েছেন মানবজাতিকে এক বৃক্ষের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে, ধর্মসমূহের মধ্যকার ব্যবধান অপনোদন করে। তবে শেষ পর্যন্ত অনেকে মানির মতাদর্শকে অতিন্দ্রীয়বাদী খ্রিস্টধর্ম বলেই উল্লেখ করেছেন।

তবে সঠিকভাবে মানিকে পাঠ করলে বলা উচিত, মানি ছিলেন অতিজ্ঞানবাদী ইহুদি-খ্রিস্টধর্মের একটি বিশেষ ধারার প্রবক্তা। অর্থডক্স বিশেষত কপটিক এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মেও মানির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বলা হয় মানির মৃত্যুও হয় যিশুখ্রিস্টের মতোই। তাকেও ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়। যদিও মানির মৃত্যুর ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে। 

দুই

মানিকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে মানা সহজ। ইয়োহানিস ফান উর্ট (Johannes van Oort) মানির জন্ম তারিখ ২১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল বলে বিভিন্ন বরাতে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন, তাঁর জন্ম দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় অবস্থিত ব্যাবিলনের জোড়া নগরীতে অর্থাৎ সেলুসিয়া-স্টেসিফনে (Selucia-Ctesiphon)। এ জায়গাটি এখন বর্তমান ইরাকের বাগদাদ থেকে খুব দূরবর্তী নয়। সেকালে এই জনপদ পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

দশম শতাব্দীর বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ইবনে আল-নাদিমের বরাতে ফান উর্ট উল্লেখ করেছেন, মানির বাবার নাম ছিল ফুত্তুক, যিনি প্রাচীন ‘একবাতানা’ নগরীতে বাস করতেন, যেটি পরে হামাদান নামে পরিচিত হয়। তাঁর মায়ের নাম জানতে পারা যায় মেইস, মারমারিয়াম ইত্যাদি। অনেকে তাকে মরিয়ম নামেও সম্বোধন করেছেন। 

তৎকালীন ব্যাবিলনীয়দের মত ফুত্তুকও (অবশ্য গ্রিকরা ফুত্তুক নামটিকে পাট্টিকিওস (Pattikios) বলে উচ্চারণ করতেন) দেব-দেবীর উপাসনা করতেন। এরকমই একদিন তার ওপর গম্ভীর দৈববাণী উচ্চারিত হয়, ‘মাংস খেয়ো না, মদ পান করো না, নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করো না।’ এর পরপরই ফুত্তুক মুঘটাসিলা নামক এক সংঘের সঙ্গে যুক্ত হন, যারা তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করতে নতুন অনুগামীকে ব্যাপটাইজড করতেন। সেসময় ফুত্তুকের স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। 

বোঝা যায় এটি মেসোপটেমীয় সেই ধারাগুলোর একটি, যারা নিজেদের ইহুদি মনে করত; কিন্তু যিশুকে তাদের ত্রাণকর্তা ও মসীহ মনে করত। এর অবশ্য একটি কারণ ছিল। যিশু নিজেই বলেছেন, তিনি কোনো নতুন ধর্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসেননি। ফলে অনেকেরই মত এই যে, যিশুর ধর্ম মসীহী ইহুদি ধর্মের (Messianic Judaism) একটি ধারা। 

‘মনে করো না, আমি নবীদের আইন উৎপাটন করতে এসেছি; আমি সেগুলোকে উৎপাটন করতে আসিনি, বরং সেগুলোকে পূর্ণ করতে এসেছি। ’

অবশ্য এই ধারাতে নেস্টোরীয় দর্শন ও ইসলামকেও আব্রাহামীয় ধর্ম এবং ইহুদি-খ্রিস্ট ধর্মের ধারাবাহিকতা বলা চলে। আর পয়গম্বর মুহাম্মদ (সা.) (৫৭০-৬৩২) কিংবা নেস্টোরিয়াসও (Nestorius, ৩৮৬-৪৫০) নিজেদের চিন্তা ও বিশ্বাসসমূহকে আব্রাহামীয় ধর্ম দর্শনের পরম্পরা হিসাবেই উপস্থাপন করেছেন।

ক্যালডীয় ধর্মবেত্তা পল বেদজান (Paul Bedjan, ১৮৩৮-১৯২০) হালেও প্রচার করতেন, মেরি বা মরিয়ম স্বর্গরাজ্যেও যিশুর অর্থাৎ ঈশ্বরের মাতা বা ঈশ্বরকে ধারণকারী (গ্রিক ভাষাতে থিউটোকোস, ক্যালডীয় ভাষায় ‘ইয়ালদাত আল্লাহা’)। মূলত রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম এই বিশ্বাসের সবচেয়ে বড় প্রচারক। এই বিশ্বাসকে নেস্টোরিয়াস বহু পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, বরং মেরি যিশুকে পৃথিবীতে আনার মাধ্যম মাত্র (গ্রিক ভাষাতে ক্রিস্টোটোকোস) বলে প্রচার করেছিলেন। কপটিক অর্থডক্স খ্রিস্টধারাও অবশ্য তাই মনে করে।

ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের অনুগামীরা আজও মেরিকে স্বর্গরাজ্যে যিশুর মা অর্থাৎ ঈশ্বরের মাতা মনে করে থাকেন। আর মার্টিন লুথার ও ক্যালভিনের প্রটেস্ট্যান্ট ধারা নেস্টোরিয়াসের মতোই বিশ্বাস করে যে, মেরি শুধু পৃথিবীতেই যিশুর মা, তবে তিনি অত্যন্ত সম্মানিতা। ইসলামও মেরি যে ঈশ্বরমাতা এই বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসলামও নেস্টোরিয়াসের মতো মনে করে যে, ঈশ্বর জন্মগ্রহণ করেন না। 

তিনি কাউকে জন্ম দেন না, তিনি কারো কাছ থেকে জন্মগ্রহণ করেননি। 

আর নেস্টোরিয়াসের মতো ইসলামও মনে করে যে, কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য এবং জগতকে ধারনের জন্য আল্লাহর কোনো মাধ্যমের দরকার নেই। 

আল্লাহ তিনি, যিনি ছাড়া আর কোন প্রভু নেই, যিনি অনাদি ও অনন্ত এবং সমস্ত কিছুর ধারক। 

আর মানিও যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন যে, যিশু জরথুষ্ট্র ও গৌতম বুদ্ধের ন্যায় এক মহান পয়গম্বর। 

যাই হোক মানি যিশুর ওপর বক্তব্য রাখতেন এবং শুরুর দিকে তিনি নিজেকে যিশু প্রদত্ত পয়গম্বর বলে মনে করতেন বলে কোনো কোনো পণ্ডিত মন্তব্য করেছেন। আর তারা এও বলেছেন, তাঁর প্রথম সময়ের চিঠিগুলো এবং দাপ্তরিক সীলমোহরও সেই সাক্ষ্য বহন করে। চার্লস আলবেরি ১৯৩০ সালে মিসরে প্রাপ্ত একটি কপটিক ভাষায় লিখিত যিশুর বন্দনা-বই থেকে দুটি অনুচ্ছেদ ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। প্রথম অনুচ্ছেদটি ছিলযিশু-বন্দনা, যা নিম্নরূপ: খ্রিস্ট, আমাকে পথ দেখাও: তুমি আমার উদ্ধার কর্তা, আমাকে ভুলে যেও না। 

আমি আমার পিতার ভালোবাসা, যা দিয়ে পোশাক বানিয়ে তোমাকে আবৃত করেছি। খ্রিস্ট, আমাকে পথ দেখাও: তুমি আমার উদ্ধার কর্তা, আমাকে ভুলে যেও না। আমার ভাইয়েরা অতীন্দ্রিয় শক্তি(aeon) এবং অতীন্দ্রিয় শক্তিরও উপরে। খ্রিস্ট, আমাকে পথ দেখাও: তুমি আমার উদ্ধার কর্তা, আমাকে ভুলে যেও না। বাতাস এবং ভূভাগের আলোক- তারাও আমার সঙ্গে অতিক্রম করছে আজ কষ্টকর পথ। 

তবে মানি পরবর্তীতে তার চিন্তার পরিবর্তন ঘটান। সুজান্না গুলাসি উল্লেখ করেছেন, মানি নিজেকে ঈশ্বরের প্রধান চার পয়গম্বরের একজন বলে মনে করতেন, আর ঈশ্বরকেও তিনি আলোকের আদি উৎস রূপে চিন্তা করতেন। আলো ঈশ্বরের প্রতিনিধি, যা আলোকিত পুরুষদের জন্ম দেয় এবং সেই আলোকিত পুরুষেরা অতিক্রম করে জন্মান্তরের চক্র। তার মানে, মানি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের জন্মান্তর-চক্রকে গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য ইসলামের সুফীবাদীদেরও কেউ কেউ জন্মান্তরের বিশ্বাস লালন করেন। আরশিয়া ইসলাম থেকে আগত আলাভী ধারা এবং দ্রুজধর্মও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসকরে।

সুজান্না গুলাসি মানির ধর্ম প্রসঙ্গে লিখেছেন, মানি ধর্মের ইতিহাসকে বৈশ্বিক মানদন্ডে বিচার করতেন। তিনিএই বিশ্বাস প্রকটিত করেছেন যে, ঈশ্বর ও তাঁর আলোর পরিসর পৃথিবীতে মানুষের যে পার্থিব জীবন তা থেকে বিচ্ছিন্ন। কারণ এই পার্থিব জীবনে সর্বত্র অন্ধকার আলোর সঙ্গে একাকার হয়ে বিরাজ করছে। জন্মান্তরের অনন্ত চক্রকে ভেদ করে এবং আলো-আধারের মিশ্র অবস্থা থেকে বের হয়ে বিশুদ্ধ আলোতে পৌঁছে মহান পয়গম্বর মানির অনুসরণ করে ন্যায়বান হিসাবে ধর্মের পথে ভবিষ্যৎকে নির্ধারণ করাই মানব জীবনের কাঙ্ক্ষিত বাসনা হওয়া উচিত এবং মুক্তিও সেই পথেই।
আর এই মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে পরমেশ্বর স্বর্গীয় প্রতিনিধিদের তৈরি করেছেন এবং তাদের জন্য তিনি কর্ম নির্ধারণ করেছেন। আলোক-চিত্ত বা ‘আলোক নুজ’ (Light Nous) এরকমই এক প্রতিনিধি। তিনি সমস্ত পয়গম্বরদের পিতা এবং সমস্ত ধর্মসমূহের মুক্তির পথকে নিশ্চিত করার দায়িত্বও তার ওপর।

মানির মতানুসারে, এই দৈবসত্তা মারফতপৃথিবীর বিভিন্ন ভূক্ষেত্রে প্রয়োজনমাফিক মুক্তির দিশা দিয়ে ঈশ্বর চারজন পয়গম্বরকে পৃথিবীতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছেন; আর তারা হলেন- জরথুষ্ট্র, শাক্যমুণি (গৌতম বুদ্ধ) , যিশু ও মানি নিজে। এই চারজন তাদের ভূমিকা নিয়ে অসংখ্য পয়গম্বরদের মধ্যে আবির্ভূত হয়েছেন প্রাথমিক পয়গম্বর রূপে। এ হচ্ছে মানি দর্শনের (Manichaeism) অন্যতম বক্তব্য। 

অবশ্য এ কথাও সত্য যে, ইহুদি ধর্মের কোনো কোনো ধারায় জন্মান্তরের বিশ্বাস বহুকাল ধরেই আছে। যেমন- নিউ টেস্টামেন্টে যে ফারিজেদের সঙ্গে যিশুর সংলাপ বিনিময় হয়েছে, সেই ফারিজেরা বিশ্বাস করতেন যে, মানবাত্মা অমর এবং সৎ মানুষের আত্মার মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান হয় এবং সেনবজন্ম লাভ করে। 

আর সর্বজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও শুভময়তার ঈশ্বরকে আলো হিসাবে ভাবার প্রবণতা ইসলাম ও পবিত্র কোরআনেও আছে। আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর আলো। 

পবিত্র কোরআনে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে স্বর্গীয় কিতাবপ্রাপ্ত জাতিদের (ইসলামী পরিভাষায় আহলে কিতাব) অন্তর্গত আরও একটি সম্প্রদায়কে আমরা চিনি, যারা সাবেয়ীন বা সাবিয়ান নামে পরিচিত। আরামায়িক ভাষার মূল ধরে এগুলো নয়া-মান্ডেয়িক (Neo-Mandaic) ভাষাতে সাবী মানে ব্যাপটাইজড করা। বৃহৎবর্গে এই ধর্মকে ম্যানডেইজম (Mandaeism) বলা যায়।

অনেক ঐতিহাসিক এদেরও নিম্ন-মেসোপটেমীয় অঞ্চলের একটি ইহুদি-খ্রিস্ট দল মনে করতেন, যেমন- এলসেজীয়রা (Elcesaites)। আর আমরা মুঘটাসিলাদের কথাতো আগে বলেছি। এই সাবিয়ানরাও ঈশ্বরকে আলো হিসাবে আরাধনা করতেন, আর তার প্রকাশ তারা দেখতেন আকাশের তারকাদের মধ্যে। তারমানে মানির সদৃশ বেশ কিছু ধর্ম মানির আগে ও পরে মেসোপটেমীয় অঞ্চলজুড়ে একদা বিরাজ করত। 

তিন

এবার আলোচনা করা যাক, মানির ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাগুলোর প্রকাশ কী রকম ছিল? সে বিষয় নিয়ে। আমরা আগেই বলেছি যে, সেসময় আসিরীয় বিশেষত ব্যাবিলনীয় অঞ্চলগুলোতে ইহুদি-খ্রিস্টীয় বেশ কিছু ধারা ছিল। যারা যিশুকে মসীহ মানতো; কিন্তু নিজেদের ইহুদিই মনে করত। এরকম আরও ধারা ছিল, যেমন- হেরমেটীয়রা (Hermeticist)। হেরমেটীয়দের অনেক ধারা বিশ্বাস করত যে, যিশুর মানবসত্তা তার ঈশ্বরিক সত্তা থেকে ভিন্ন।

বলা বাহুল্য যে, অতিন্দ্রীয়বাদী খ্রিস্টধর্মের অন্যান্য শাখার চিন্তার সঙ্গে এই ধারার মিল আছে। মানি শেষ পর্যন্ত তার পিতার অনুসৃত মুঘটাসিলা সম্প্রদায়েরও অনুগমন করেননি। আল-নাদিমের বরাতে মানির ধর্মীয় ইতিহাসে যা জানা যায়, তাহলো, ১২ ও ২৪ বছর বয়সে মানি তার স্বর্গীয় যমজের (heavenly twin) বা স্বর্গীয় স্বয়ং (divine self) এর (যে তার রক্ষাকর্তাও বটে) কাছ থেকে এই প্রত্যাদেশ পান যে, তাঁকে পিতার পথ ত্যাগ করে যিশুর সঠিক পথ অনুসরণ করতে হবে।

সেইস্বর্গীয় স্বয়ং যাকেগ্রীক ভাষাতে বলা হয় সুজিগোস (Syzygos) বা তার সম্পূরক রূপ, তাকে কখনো বলা হয়েছে আলোর যিশুরূপে (the Jesus of Light) তাহলে কি মানি যিশুর অবতার? আর এই সুজিগোস কি তার আল্টার ইগো (alter ego) বা তার সহসত্তা। যে তার মানব জীবনের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে উঠেছে? একে তিনি সত্যের পবিত্রাত্মা (the Holy Spirit, গ্রিক ভাষাতে পারাক্লিটোস) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

আর এই পবিত্রাত্মাআদতে তার আত্মোপলব্ধিরই প্রকাশক। তাকে ফান উর্ট ও ফান টনগেরলু স্বর্গীয় বুদ্ধি (divine Intellect) হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (ফান টনগেরলু ও ফান উর্ট: ১৯৯৫)। আর এই বুদ্ধিবৃত্তিকসত্তা ওই ব্যক্তি মানির ভেতরেই বাস করে। ফলে মানির ধর্ম সেমেটিক অতীন্দ্রিয়বাদী ধারারই এক বহিঃপ্রকাশ। যেমনটি আমরা পবিত্র কোরআনেও পাই, অবশ্যই আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি, তার ভেতরের চিন্তার বিকাশকে জানি, আর আমরা তার গ্রীবার রগের চেয়েও নিকটে। আবার, তিনি সর্বত্রই তোমাদের সঙ্গে, যেখানেই তোমরা থাকো।

তবে মানির চিন্তার সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের প্রসারে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই সন্ত পলের চিন্তারও প্রভূত মিল আছে। মানির ধর্মও গির্জাকেন্দ্রিক। যেমন পল বলেছিলেন, গির্জা হচ্ছে যিশুর দেহ। মানির গির্জাও তার ধর্মে মানির দেহ স্বরূপ বলে প্রচারিত; কিন্তু এই সম্প্রদায়ের বিধি-বিধান চলতো তোরাহ ও অন্যান্য ইহুদি শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদি অনুসারে। ফলে শনিবারের বিশ্রাম দিবস বা ‘সাববাথ’ও মানি এবং তার অনুসারিরা মেনে চলতেন।

যেই সাববাথের বিধান খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা যিশুর ধর্ম প্রচারের পর আর মেনে চলেননি। অবশ্য মানি ও তার অনুসারিরা ইহুদি বিচারসভা বা সানহেড্রিন (Sanhedrin) দ্বারা একদা মৃত্যুদ- প্রাপ্ত হয়েছিলেন। যদিও তিনি তার পিতার হস্তক্ষেপের কারণে বেঁচে যান বলে ফান উর্ট উল্লেখ করেছেন। পরে মানির পিতাও তার শিষ্যত্ব বরণ করেন। 

চার

মানির কাছে যে প্রত্যাদেশ আসতো সুজিগোস মারফত, সেগুলো তিনি প্রকাশ করতেন কাব্যিকভাবে। মানি তার এই স্বর্গীয় প্রতিরূপের প্রতি তার প্রসন্নতাও ব্যক্ত করেছেন কাব্যিকভাবে। তিনি সুজিগোস সম্পর্কে লিখেছেন, 

আর যে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসভাজন

তাকে আমি গ্রহণ করেছি আন্তরিকভাবে

এবং তাকে আমি অধিকার করেছি আমার সম্পদরূপে। 

তাকে আমি বিশ্বাস করেছি

আর সে তো আমার

সে তো এক উত্তম ও দয়ার্দ্র পথপ্রদর্শক। 

তাকে আমি চিনেছি

এবং আমি তাকে জেনেছি যে সেই আমি

যার কাছ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন ছিলাম...

মানি প্রচলিত ধর্মীয় বিষয়াদি সংস্কারেও হাত দেন। ফলে স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের বিরাগভাজন হন তিনি। মেসোপটেমীয় ইহুদি-খ্রিস্টীয় পরম্পরাগুলোর ব্যাপটিস্ট ধারাসমূহকে তিনি সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, শুধু বাহ্যিকভাবে ব্যাপটাইজড হয়ে বা জল দিয়ে নিজেকে ধৌত করে কোন লাভ নেই, যদি অন্তর থেকে শুদ্ধ না হওয়া যায়। আর সেই আত্মিক পবিত্রকরণ সম্ভব তখনই যখন গভীর আত্মিক জ্ঞান (gnosis) অর্জিত হয়।

সেই জ্ঞানের মাধ্যমেই শুধু সম্ভব অন্ধকার থেকে আলোকে পৃথক করা। শুধু তথাকথিত বাহ্যিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। এজায়গাতেও যিশুর সঙ্গে মানির মিল পাওয়া যায়। যিশু ফারিজেদের তথাকথিত আচার সর্বস্ব ঈশ্বরভক্তিকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতেন এবং বলতেন, আমি তোমাদের বলছি, যতক্ষণ তোমাদের ন্যায়নিষ্ঠা ফারিজেদের অতিক্রম না করছে, ততক্ষণ তোমরা স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না।

কিন্তু মানির এই বয়ানের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা এবং ধর্মীয় সমাজ। মানিকে তারা ধর্মদ্রোহী, ধর্মত্যাগী ও ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে আখ্যায়িত করে। দ্রুত ডাকা হয় জরুরি সভা বা সাইনড (synod)। সিটা বা সিটাটিয়স নামক একজন এল্ডার এই বিষয়ে ধর্ম সমাজকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হন। মানিকায়েন কোডেক্স বলছে, মানির এই দুর্দিনে মহান একজন অর্থাৎ সুজিগোস আবির্ভূত হন এবং তাকে সান্ত্বনা দেন কাব্যিকভাবে এই বলে যে, 

তুমিতো শুধু এই ধর্মমত থেকে

বহিষ্কৃত হওনি, 

বরং আপামর জনতা ও সব ধর্মীয় ধারা থেকে

সেই সঙ্গে সব নগর ও জনপদ থেকে। 

তোমার দ্বারা যে আশার মূর্তায়ন ঘটেছে

তা পৃথিবীর সর্বত্র, সব মাটি-জলেই প্রচারিত হবে। 

তাই সামনে এগোও, পরিভ্রমণ করো। 

আর আমিতো তোমার সঙ্গেই আছি

তোমার সাহায্যকারী ও রক্ষাকারীরূপে

আর তা সর্বত্রই 

যেখানেই তুমি ঘোষণা করো, যা আমি তোমার কাছে প্রকাশ করেছি।

পাঁচ

মানি তার জীবদ্দশাতে প্রথমে জনগণ দ্বারা পরিত্যক্ত হলেও, শেষ পর্যন্ত তার মতাদর্শ প্রভূত জনপ্রিয় করতে পেরেছিলেন। বলা হয় তিনি তার জীবনের এক পর্যায়ে ভারতে আসেন এবং সেখানে তাঁর প্রচুর অনুসারী তৈরি করতে সক্ষম হন। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তখনকার নতুন পারস্য সম্রাট শাপুর তাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর সাম্রাজ্যে ধর্মমত প্রচারের অনুমতি দেন; কিন্তু শাপুরের পর যখন তার পুত্র হরমিজদ ও পরে অপর পুত্র বাহরাম সম্রাট হন, তখনই মানির জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। দুই পুত্রই ছিলেন কট্টর জরথুষ্ট্রের ধর্মানুসারী।

বাহরাম ১ম মানিকে বন্দি করে কারাগারে প্রেরণ করেন। ২৬ দিন তার বিরুদ্ধে বিচার চলাকালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে ঐতিহাসিক ও পর্যটক আলবিরুনী (৯৭৩-১০৫০ এর পরে) উপস্থাপন করেছেন ভিন্ন ইতিহাস। বাহরাম মানিকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে আলবিরুনী লিখেছেন। তবে আলবিরুনী এও লিখেছেন যে, মানির চামড়া তুলে ফেলা হয়েছিল এবং গুনদেশপুর শহরের প্রধান ফটকের ওপর তার মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

আর আমার মতে, মানির ক্রুশবিদ্ধ হবার ইতিহাসটি সঠিক নাও হতে পারে। যারা মানিকে যিশুর অবতার বলে ভাবতেন, তারাই হয়তো যিশুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে মানির মৃত্যুকে ক্রুশকাঠের ওপর নিয়ে ছেড়েছেন। আর আলবিরুনী তাদের কাছ থেকেই হয়তো মানির মৃত্যুর ইতিহাস সংগ্রহ করেছেন। তবে বাহরামই যে মানির হত্যার জন্য দায়ী, সে বিষয়ে হয়তো সব ঐতিহাসিক সহমত পোষণ করবেন।

সেইসঙ্গে এই প্রশ্নটিও যে কোনো বিদগ্ধ জনের মনে উদিত হতে পারে, মানিকে যারা যিশুর অবতার বানিয়েছেন, তারাই কি তার মায়ের নাম মরিয়ম বানিয়েছেন? এই প্রশ্নটি আমি তুললাম যাতে বিদগ্ধ জনেরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। ধর্ম যে আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে নয়, তার প্রমাণ হচ্ছে, চীন ও মধ্য এশিয়ায় মানিকে গ্রহণ করা হয়েছে একজন বুদ্ধ হিসেবে এবং চীনসহ প্রাচ্যে তাঁর মৃত্যুকে বলা হয়েছে পরিনির্বাণ, যে শব্দটি বুদ্ধের মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আর পশ্চিমের দুনিয়াতে প্রাপ্ত বিবরণাদিতে তাঁর ক্রুশকাঠে মৃত্যুর বিষয়টি বেশি এসেছে। আর সেখানেই খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি, আর এখনো তাই আছে। 

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //