আমেরিকারও কি কলোনি ছিল?

আমেরিকার জন্ম বা শুরু বলতে আসলে দুটি পর্যায় বোঝায়। একটি ১৬০৭ সালের পরের ঘটনাবলিতে যখন ইউরোপ থেকে ব্রিটিশসহ অন্য কলোনি-দখলদারেরা আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের দখল নিয়ে বসতি গড়ে তোলা শুরু করেছিল। আর পরে ১৭৭৬ সালের জুলাইয়ে যাকে আমরা আমেরিকার স্বাধীন হওয়া বলে জানি; কিন্তু এ কোন আমেরিকা? তাও আবার এর স্বাধীন হওয়ার মানেইবা কী? কে তাকে পরাধীন রেখেছিল? সবচেয়ে বড় কথা সে কার থেকে স্বাধীন হয়েছিল? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ফ্যাক্টস ও ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করব। 

সংক্ষেপে কয়েক বাক্যে বললে, ১৬০০ সাল থেকে শুরু হওয়া শতকে আমেরিকাকে পরাধীন ও কলোনি করে রেখেছিল মূলত ইউরোপীয় কলোনি-দখলদার শাসকরা; যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের মতো কলোনি মাস্টাররা। যদিও তাতে সবার চেয়ে বড় দখলদার ছিল ব্রিটিশরাই। ঠিক যেমন ব্রিটিশরা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার কলোনি-দখলদার ছিল, ঠিক তেমনই এই পাঁচ কলোনি-দখলদার শাসকরা আমেরিকাজুড়ে আসলে সাদা ইউরোপীয়দের নিয়ে এসে বসতি স্থাপন শুরু করেছিল।

এরাই আজকের সাদা আমেরিকান, যারা ইউরোপীয় অরিজিন। সেকালে এসব গরিব বা ইউরোপীয় কৃষকদের যারা জাহাজ ভরে নিয়ে গিয়েছিল, তারাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ইউরোপের কলোনি-দখলদার ব্যবসায়ী। তবে পুরনো মোগল-ভারতবর্য ব্রিটিশ কলোনি দখলদারদের দখলে চলে যাবার পরের সময়ে ভারতবর্ষকে বোঝাতে ‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া’ বলার চল শুরু হয়েছিল; কিন্তু আমেরিকার বেলায় এ বিষয়ে একটি ব্যতিক্রম ছিল। 

প্রথমত, সেই আমেরিকা ও ভারতের কলোনি-দখলদার একই, আর তা ব্রিটিশরা। তবু এ দুইয়ের দখলদারিত্বের মাঝে বিরাট কিছু ফারাক আছে। যেমন, গরিব, কৃষক বা প্রান্তিক ইউরোপীয় সাদা-মানুষের বাইরে আমেরিকা ভূখণ্ডের আদি বাসিন্দা বলে আবার আলাদা কেউ কেউ ছিল, এখনো আছে। যাদের এসব কলোনি দখলদাররা রেড ইন্ডিয়ান নাম দিয়েছে। 

এসব আদি বাসিন্দাদের তাদের বসবাসের এলাকা ছাড়া করে, আরও গহীন অরণ্যে পাঠিয়ে মূল ভূখণ্ডগুলো দখল করানো হয়েছিল যাদের দিয়ে- এরাই ছিল সেই গরিব, কৃষক বা প্রান্তিক ইউরোপীয় সাদা-মানুষ। যাদের ইউরোপের নানান শহর থেকে জাহাজে ভরে আমেরিকায় এনেছিল দখলদার ইউরোপীয় কলোনি-ব্যবসায়ীরা। 

আসলে দখলি ভূমিতে মানুষ না থাকলে ওই ভূমির মূল্য নাই। তাই কলোনি-দখলকারিরা মূলত নিজ নিজ দেশ থেকে বিনা পয়সায় জাহাজ ভরে তাদের দেশের গরিব প্রান্তিক মানুষকে-প্রত্যেককে জমি দেবে, প্রথমবার সেটেলমেন্টের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করে দেবে ইত্যাদি এসবের লোভ দেখিয়ে নিয়ে আসে। আর ওইসব মানুষদের দিয়ে তারা প্রথম দখলি জমির চাষাবাদ শুরু করেছিল। আর সবচেয়ে বড় দখলদার ছিল ব্রিটিশরা। যেমন, আজকের হিসাবে ৫০ রাজ্যের আমেরিকার ১৩ বড় রাজ্যগুলোর দখলদার ছিল ব্রিটিশ কলোনির। তাই তাদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। আর তাই পরবর্তিতে ঘটেছিল দ্বিতীয় পর্যায়।

গরিব, কৃষক বা প্রান্তিক ইউরোপীয় সাদা-মানুষদের আমেরিকায় হিজরত করার পরে এবার ইউরোপীয় কলোনি দখলদার সাদা ব্যবসায়ীদের হাত থেকে নিজের মুক্তির পর্যায়। গত ১৭৭৬ সালের আমেরিকান স্বাধীনতা বলতে এটাকেই বোঝানো হয়। এ জন্য ১৭৭৬ সালের আগের আমেরিকাকে ব্রিটিশ কলোনি বলার চল ছিল। যারা কলোনিয়াল আমেরিকার এই অতীত ইতিহাস ডিটেলে পড়তে চান তারা এখনকার আমেরিকার সরকারি সাইট কলোনিয়াল আমেরিকা (ঈড়ষড়হরধষ অসবৎরপধ (১৪৯২-১৭৬৩)) দেখতে পারেন। 

তবে ইতিমধ্যে আরও একটি ফান্ডামেন্টাল ফ্যাক্টসের দিক হলো জাহাজ ভরে শুধু ইউরোপীয় সাদা চামড়ার লোক নয়, পরবর্তিতে ১৬১৯ সাল থেকে আফ্রিকান কালো দাসদেরও ধরে প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যের পাইকারি আড়ত- মোকামে জড়ো করা, তা থেকে কিনে আমেরিকায় আনা শুরু হয়েছিল আফ্রিকান কালো দাসদেরও। মূলত বাড়তি শ্রমিকের চাহিদা মেটাতে।

আর তাতে সুবিধা ছিল, এই কালো দাসশ্রমকে নিয়ন্ত্রণ করানো হতো আগে আনা সাদা ইউরোপীয়দের শ্রমিক দিয়ে; কিন্তু আমেরিকান পুরা প্রশাসন-সমাজ মূল ব্রিটিশ-কলোনি মালিকরা তাদেরই সম্পত্তি, এই হিসাবে পরিচালিত করত। ফলে এক কথায় ওই দাস অর্থনীতির যা লাভালাভ, উদ্বৃত্ত সম্পদের খোদ মালিক হয়ে থাকে ব্রিটিশ-কলোনি মালিকরা। 

এসব কলোনি মালিকদের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র যুদ্ধ করে ১৭৭৬ সালে আমেরিকা স্বাধীন হয়েছিল। তাৎপর্যময় দিক হলো, ইউরোপের থেকে যাওয়া বাসিন্দাদের কাছে আমেরিকান বিপ্লবের খবর খুব কমই পৌঁছেছিল। এর বড় প্রমাণ হলো, ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিপ্লবের আলোড়ন তোলা ধারণা বলে মনে করা হয় ফরাসি বিপ্লবকে (১৭৮৯)। অথচ কিছু প্রসঙ্গে আমেরিকার ১৭৭৬ সালের স্বাধীনতা বিপ্লব অনেক বড় অবদান রাখা ঘটনা ও ধারণা। যেমন রিপাবলিক রাষ্ট্রের ধারণারও ওপরে আবার আমেরিকার ‘ফেডারেল’ রাষ্ট্রের ধারণা, যা আজও ইউরোপে খুব একটি বিকশিত হয়নি। 

কারণ আমেরিকায় কলোনি শাসন মুক্তির বিপরীত প্রতিপাদ্য নেহায়তই এক ‘স্বাধীন রিপাবলিক’ নয়-আরো বেশি কিছু। আমেরিকা স্বাধীনের পরে রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে রাজ্যগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে যেন ফিরে আবার নিজেরা কেউ কাউকে কলোনি-অধীনস্ত করে নিয়ে না বসে, এই ভীতি তাদের মধ্যে ছিল। এই সম্ভাবনা ও ভয়ের বিরুদ্ধে রক্ষাকবজই হল ‘ফেডারেল’ রিপাবলিক রাষ্ট্র ধারণা। 

বিপরীতে যেমন দেখতে পাব, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতে ১৯৪৭ সালে কলোনিমুক্ত স্বাধীন রিপাবলিক রাষ্ট্র হওয়াতেই গর্বে আমাদের মাঠিতে পা পড়ে নাই। তাই নেহেরুর ভারত আর ফেডারেল রাষ্ট্র জিনিসটা কী তা জীবনেও বুঝতে পারল না। আসলে চেষ্টাও করেন নাই সম্ভবত এই ভেবে যে, এটা তাঁর সমস্যা না। বরং সমস্য হলো জবরদস্তিতে হলেও কথিত এক কেন্দ্রে সবাইকে তুলে এনে জড়ো করা। উনি ভেবেছিলেন এটাই ভারত, এমনেই পিটাপাটা দিয়ে এক ভারত খাড়া করতে হয়।

যদিও মনে হচ্ছে এবার চলতি শতকে ‘হিন্দি বলয়’ নামের ভুতুড়ে ‘কেন্দ্র’ এই কুক্ষিগত ক্ষমতা ও শাসনের ভারত ভেঙে পড়ার পরেই হয়ত বুঝবে এর মর্ম কী! আর ওদিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যাবার পরেও পাকিস্তান এসব দিকগুলো স্পষ্ট বা বুঝেছে তাও মনে হয় না। কেন বাংলাদেশ আলাদা দেশ হয়েছে সেটা এখনো তারা জানে না। 

বড়জোড় ভারতের একটি প্ররোচনা ছিল, এটুকু বাদে অন্য কোনো দিক আছে কিনা তারা বুঝতেও যায়নি। অনেকের মনে হতে পারে পাকিস্তানে এখন নাকি এক (প্রাণহীন) সিনেট সিস্টেম আছে। প্রাণহীন বলছি একারণে যে, পাকিস্তানের সিনেট কার্যকর হলে বেলুচ সমস্যা বলে তো কিছু হাজির থাকত না। মূলকথাটা হলো, একটি পুরো দেশ স্বাধীন বলা ও মানা হচ্ছে, সেটা হতেও পারে; কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে এর একেক প্রদেশ অথবা জেলা আরেক জেলা বা প্রদেশের ওপর রুস্তমি করছে, আপারহ্যান্ড নিচ্ছে বা কথিত ‘হিন্দি-বলয়’ টাইপের নামে কলোনি করে চাপে ফেলে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। 

এটাই কথিত স্বাধীন সার্বভৌম সবদেশের মূল সমস্যা, অভ্যন্তরীণভাবে একে-অপরের ওপর কলোনিয়াধিপত্য কায়েম। এভাবে একটি কুক্ষিগত এবং তথাকথিত কেন্দ্রীয় ক্ষমতা যা আসলে এক কালো ক্ষমতা, সব সমস্যার মূল কারণ হয়ে লটকে থাকে। এ থেকে সমাধান হিসেবে ডিসেন্ট্রালাইজেশন, মানে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের ধারণা চর্চায় নিয়ে এসেছিল আমেরিকা। অর্থাৎ প্রদেশ বা রাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন ভোগ করেও আবার এক সমন্বিত ফেডারেলল কেন্দ্রীয় (ভুতুড়ে ক্ষমতার কেন্দ্র না) নির্বাহী প্রেসিডেন্ট ব্যবস্থা হচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে কোনো কলোনি-সম্পর্ক জেগে ওঠার বিরুদ্ধে রক্ষাকবজ!

যে কথা বলছিলাম, আমেরিকান বিপ্লব হয়েছিল ফরাসি বিপ্লবের তের বছর আগে; কিন্তু কার্ল মার্কসের কথাই যদি ধরি, তিনি ফরাসি বিপ্লব নিয়ে উচ্ছ্বসিত যত কথা বলেছেন, আমেরিকা নিয়ে কথা বলেছেন যেন ততই কম। এটা হতে পারে সেকালে তার মতো কারও পক্ষে ইংল্যান্ডে বসে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া সহজ ছিল না।

এ ছাড়া আরেকটি দিক হলো, আমেরিকান বিপ্লব বাস্বাধীনতা যুদ্ধে (১৭৭৬) হেরে যাওয়া ব্রিটিশ-কলোনি শাসকরা অথবা ব্রিটিশ রাজ-পরিবার নিজেদের হারার লজ্জা ঢাকতে মিডিয়া ম্যানেজ করেছিল কোনো জাতিবাদের জিগির তুলে। আর তাই খুব বেশি তথ্য ইংল্যান্ডে বসা মার্কসের মতো কারও কাছেই উন্মুক্ত ছিল না। ফলশ্রুতিতে খুব সম্ভবত আমেরিকান বিপ্লব নয়, ফরাসি বিপ্লব নিয়েই তাঁকে মেতে থাকতে হয়েছিল। 

তবে আমেরিকান বিপ্লবের সবচেয়ে যে পজিটিভ বৈশিষ্ট্য আমেরিকার জনগণের মনে ছেঁয়ে যায় তা হলো, কলোনি শাসন বা দখলের ব্যাপারে তাদের চরম বিরোধী মনোভাব। একেবারে আপোষহীন বিরোধিতা। কলোনি থাকার অভিজ্ঞতা তাদের এই চরম অগ্রহণযোগ্য অবস্থানে নিয়ে গিয়েছে। যার প্রভাব এতটাই যে, পরবর্তীকালে খোদ স্বাধীন আমেরিকান (১৭৭৬) রাষ্ট্রকেই তার নাগরিকরা কখনো অন্যের দেশকে কলোনি দখল করতে অনুমোদন দেয়নি, দখলদার হতে দেয়নি, দেখতে চায়নি। 

যদিও আমেরিকার (ইউএসএ) চোখে সবচেয়ে কাছের হবু কলোনি দখল এলাকা সেকালে ছিল ল্যাটিন আমেরিকা, যার পুরাটাই ও বেশির ভাগ সময়ে স্প্যানিজ বা পর্তুগিজদের কলোনি হয়ে থেকেছে ও ছিল বা জের এখনো আছে। 

আর সেই মনোভাব ও এর ধারাবাহিকতা থেকেই সম্ভবত আজ পর্যন্ত চলা দুনিয়াটিকে ‘কলোনিমুক্ত রাখা’ এবং এই অবস্থানের পক্ষে ধারাবাহিক ও আপোষহীন প্রধান উদ্যোক্তা হতে পেরেছিল আমেরিকা। যেমন মানা হয়, আমেরিকার জন্ম মূলত চরমতম কলোনি শাসনের মধ্যে, তাই কলোনিবিরোধী মনোভাব সেখানে তীব্র। তবে এটাই একমাত্র দিক নয়, আরও একটি ঘটনা ও দিক আছে। আমরা সেদিকে যাব। সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের যে কাজটি আমেরিকা করেছিল তা হলো-কলোনি দখলদার ইউরোপের মালিকদের দখলদারি ছাড়তে বাধ্য করা; কিন্তু আবার সাবধান! 

মানুষ কোনো শক্ত অবস্থান নেয় সাধারণত দুই কারণে; হয় আদর্শগত বা নীতিগত কারণে। আরেকটি হলো, স্রফে বৈষয়িক লাভালাভের স্বার্থে। 

দুনিয়াকে কলোনিমুক্ত করতে আমেরিকা নিশ্চয় দুনিয়াতে বিপ্লব করতে আসেনি। এমনকি দুনিয়াকে কলোনিমুক্ত করার কোন বিপ্লবীব্রত আমেরিকা কখনো নেয়নি অথবা আমেরিকার ছিল না। ফলে আমাদের এদিক দিয়ে ভাববার কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ নাই। 

তবে মূল কথাটা হলো, ১৯০১ সাল থেকে যে শতকের শুরু, এর আগের শতকের শেষ দশক অর্থাৎ ১৮৮০-১৯০০, এই সময়কালেই আমেরিকার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আমেরিকার অর্থনীতি একটি নন-কলোনিয়াল অর্থনীতি। মানে কাউকে কলোনি দখলের লুটপাটের ওপর দাঁড়ানো নয় এমন, যার আসল নাম কলোনি-ক্যাপিটালিজম; কিন্তু কলোনি-ক্যাপিটালিজম বিরোধী এই আমেরিকান অর্থনীতি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা তৎকালের ইউরোপজুড়ে ছড়ানো সেকালের কলোনি-অর্থনীতির শিরোমনি দেশ ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। 

কিন্তু আমেরিকা নিজের এই অভিমুখকে ধরে রাখতে চাইলে, জায়গা করে দিতে চাইলে এর প্রধান বাধা হয়ে থেকেছিল দুনিয়ায় অর্থনীতির একছত্র প্রধান ধারা হয়ে টিকে থাকা কলোনি-ক্যাপিটালিজম বা অন্যকে কলোনি দখল ও শাসনের ওপর দাঁড়ানো অর্থনীতি। এই সত্যটাই সেকালে স্পষ্ট হয়ে অন্তত আমেরিকার কাছে হাজির হয়ে যায়। 

কথাটা আরেকটু ভেঙে বলা যাক।

আমেরিকান অর্থনীতি প্রতি বছর যে পরিমাণ সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত সঞ্চয় করছিল, তা পুনঃবিনিয়োগের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছিল। আর এরই সমাধান ছিল যে হয় আমেরিকাকে ইউরোপের মতো কলোনি দখলের অর্থনীতিতে ফিরে যেতে হবে। আর নয়তো, উলটা সারাদুনিয়ায় সেকালের মূলধারা কলোনি দখলের অর্থনীতি- যাকে কলোনি-ক্যাপিটালিজম বলেছি, এই মূলধারাকেই সমুলে উৎখাতের ব্যবস্থা করতে হবে।

আর তাতেই আর কলোনি দখল করা নয়, বিদেশে বিভিন্ন মহাদেশে নিজের বিনিয়োগ-বাজার বের করে নেয়া; কিন্তু এই কল্পনার মধ্যে প্রধান যা অনুপস্থিত তা হলো, সেকালের প্রায় সারা এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিটা ভূখণ্ড তখন ইউরোপের হাতে কলোনি হয়েছিল। যেমন সেকালের ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া- এই কলোনি ভূমির নিজে সিদ্ধান্ত নিবার মুরোদ নাই যে সে আমেরিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক বা বিনিয়োগ নেবার সম্পর্ক করে। কারণ সে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, এক ব্রিটিশ-কলোনিমাত্র। 

কাজেই সেকালের আমেরিকাকে নিজের অর্থনৈতিক বিকাশ চাইলে দুনিয়াকে আগে কলোনিমুক্ত করে নিতেই হতো। এটাই প্রধান বাধা বা শর্ত হয়ে হাজির হয়েছিল। দুনিয়াটা এমন জট পাকিয়ে যায়। আমেরিকা কেন ইউরোপকে কলোনি দখল শাসনের সমাপ্তি টানতে বাধ্য করতে গিয়েছিল- এই ছিল পিছনের কারণ। 

আমেরিকা চাইলেই কী হবে?

অবশ্যই না। কারণ অন্তত বস্তুগত অবস্থা ও শর্তকে দুনিয়া থেকে ‘কলোনি দখল শাসনের সমাপ্তি’ এর পক্ষে হতে হবে। ১৯০০ সালে বসে তা তখন দেখা যায়নি; কিন্তু আমেরিকার অর্থনীতির বিকাশের জন্য কী দরকার এটা তাদের নিজেদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এটাই ছিল সেকালে আমেরিকার প্রধান অর্জন। তাই তারা তক্কে তক্কে থাকা বলতে যা বোঝায় এমন অবস্থান নিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে বসে থেকে এই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। 

কেন এভাবে কথা বলছি? কারণ ১৯০০ সালে বসে বোঝার উপায় ছিল না যে ইউরোপে একটি বড় সংকট আসছে! কী সংকট সেটা? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। মাত্র চৌদ্দ বছর পরেই যে এই বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) হাজির হচ্ছে তা তখন জানা ছিল না। ফলে দুনিয়ায় য়ে নয়া সংকটই আসুক আমেরিকার সিদ্ধান্ত ছিল সেটাকে কলোনি দখল শাসনের সমাপ্তির দিকে নিতে হবে, এতটুকুই তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে পেরেছিল। 

আজকে চীন যেমন অর্থনীতিতে আমেরিকার ছাড়িয়ে যাবার পথে; আন্তর্জাতিক হিসাব বলছে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে চীন আমেরিকার চেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনই, ১৮৮২ সালের কাছাকাছি সময়ে আমেরিকাও সেকালের বড় অর্থনৈতিক শক্তি ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আগেই বলেছি আমেরিকা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা ও সুযোগ খুঁজছিল কীভাবে কলোনি দখল যুগের অবসান টানা যায়। কারণ দেশগুলো স্বাধীন-মুক্ত হলে তবেই তারা আমেরিকান বিনিয়োগ ঋণের পক্ষে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, আমেরিকার ওয়ালস্ট্রিটের ঋণ-গ্রাহক-খাত হতে পারে। 

কমিউনিস্ট মন থেকে ওঠা আপত্তি

অনেক কমিউনিস্ট মনে ওঠা আপত্তিতে তারা এখানে আমাকে ছেড়ে যেতে চাইতে পারে। তাদের দিকটা মনে রেখে কিছু কথা খরচ করব এখন। বিদেশি ঋণ কি হারাম? অথবা বিদেশি ঋণ মানে কি কেবল ‘শোষণের’ (উদ্বৃত্ত সঞ্চয়) দুয়ার আরো বড় করে খুলে দেওয়া? এই প্রশ্নটাকে খুবই সংক্ষেপে যতটা সম্ভব স্পষ্ট করব। ভিত্তিমূলক একটি কথা হলো, যে কোনো অর্থনীতি নিজের প্রয়োজনীয় নতুন বিনিয়োগের অর্থ সঞ্চয় নিজেই জেনারেট বা অর্জন করতে সক্ষম থাকে।

ফলে বিদেশি বিনিয়োগ-পুঁজি আনার বা নেবার প্রসঙ্গটা দুনিয়ায় এসেছে কলোনি দখল ও শাসন চালু হবার পরে। সোজা কথায় আপনার দেশের নিজ অর্থনীতির সারপ্লাস যখন কলোনি দখলদারের হাতে উঠিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে চলে যাওয়া হয়েছে তখনই বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনার প্রসঙ্গ এসেছে। আর এটাকেই আমরা বলি কলোনি দখল সম্পর্ক। এতে আমাদের সব সম্পদ লুট করতে শাসক হিসাবেই চেপে বসেছে কলোনি শাসক, দুনিয়াতে এই ফেনোমেনা চালু হয়েছে। 

প্রায় দুশ বছরের কলোনি শাসনের (এটা আমাদের বেলায় ব্রিটিশ শাসনের হিসাবে, সাধারণভাবে ইউরোপের কলোনি দখল ও শাসনের যুগ সাড়ে তিনশ’ বছরের) পরে আমরা রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও বিনিয়োগ-পুঁজির অভাবে ক্ষত নিয়েই কেবল আমাদের মতো স্বাধীন দেশগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। আমরা খুব কমজনই এ দিকটা ওয়াকিবহাল ছিলাম। ফলে এই বিনিয়োগ ঘাটতি পূরণেই এবার সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা যে আমরা বিদেশি পুঁজি নিব। কারণ বিনিয়োগ ঘাটতি না মিটালে নতুন কাজ সৃষ্টির সমস্যাটা আরো প্রকট হতে থাকবে। 

কিন্তু আমরা ততদিনে এতবেশি কমিউনিস্ট হয়েছিলাম যে ‘কাজ-সৃষ্টি’ আমাদের কাছে কোন ইস্যুই ছিল না। ইস্যু একটিই সমাজতন্ত্র, সর্বরোগ-হর। অর্থনীতি মানেই উদ্বৃত্ত সঞ্চয় বা সারপ্লাস ভ্যালুর চুরি ঠেকানো, এ জন্য সরকারি মালিকানায় আনলেই অর্থনীতির সবরোগ-সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বিনিয়োগ বা কাজ-সৃষ্টি এগুলো কোনো সমস্যাই না, এটাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। অথচ সারপ্লাস ভ্যালু ফিরিয়ে আনার সমস্য মেটানো আর নিজের অর্থনীতিতে বিনিয়োগের ঘাটতি মেটানো দুটি আলাদা সমস্যা। সব সমস্যাই উদ্বৃত্ত মূল্য চুরির সমস্যা নয়। 

কমিউনিস্টদের মধ্যে যিনি এসব ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করেছেন; কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা পাবলিকলি না তুলে ধরে কাজ করে গেছেন- তিনি হলেন চীনের মাও। ১৯৫৮ সাল থেকে সেই ভিন্ন রাস্তারই পরিণতি হলো আজকের চীনের আমেরিকাকে ছাড়িয়ে বড় অর্থনীতি ও গ্লোবাল নেতা হবার পথে পৌঁছানো। আর এর শুরুটা হয়েছিল আগে ২০ বছর প্রস্তুতি পর্ব শেষে, ১৯৭৮ সাল থেকে বিদেশি-পুঁজি নিয়ে- যার বড় অংশই আমেরিকান পুঁজি, যা নিয়ে চীনের অর্থনৈতিক পরিবর্তন; কিন্তু অসুবিধা একটিই এখানে আসলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা বাইরে প্রচার করা হয়নি অথবা বাইরের যা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় উলটা এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ আর তা ফ্যাক্টচুয়ালও নয়। তবে স্পষ্টত চীনা উত্থানের পর বিদেশি-পুঁজি ইস্যুটিকে যারা প্র্যাকটিক্যাল সমাধান চেয়েছিল তারা সন্তুষ্ট হয়েছে। আমরা এখন ইউরোপীয় কলোনি দখল ব্যবসার সমাপ্তি টানতে আমেরিকা কীভাবে সুযোগ পেয়েছিল সেদিকে ফিরে যাব। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আমেরিকার প্রথম কিছু সুযোগ

একাজে আমেরিকার জন্য প্রথম ইউরোপকে কিছুটা বেকায়দার পাবার সুযোগ হিসেবে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। অর্থাৎ যারা কলোনি ক্যাপিটালিজমকে দুনিয়াতে অর্থনীতির প্রধান ধারা করে টিকিয়ে রেখেছে তারাই সেবার সংকটে পড়েছিল। এর মূল কারণ আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকেই যুদ্ধের খরচের ভারে ইউরোপের দেশগুলো বিধ্বস্ত অবস্থার মুখে পড়েছিল। নানাভাবে তারা আমেরিকান ঋণ পাবার চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু আমেরিকা খুবই সীমিত সম্পর্ক রাখছিল। এক পর্যায়ে তারা ধাপে ধাপে প্রায় সকলেই নিজ নিজ মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যায়। 

হেরে যাওয়া জার্মানির ওপর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের দায় চাপানো হয়েছিল ১৯১৯ সালের জুনে ভার্সাই চুক্তিতে। আর সেটি পরিণতি ক্রমশ জার্মানিতে ১৯৩২ সাল থেকে একজন শাসক হিটলারের উত্থান ঘটিয়ে দিয়েছিল। 

সবমিলিয়ে ১৯২৯-৩০ সালে প্রথম গ্লোবাল মহামন্দা বা রিসেশন অর্থাৎ অর্থনীতিতে আরো দুর্দিন নেমে আসে। এরই মধ্যে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়ে রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথমবার শপথ নেন। এরপর পরই আমেরিকান ডলারের অবমূল্যায়নের ঘোষণা দেন, ২৫ ডলার আউন্সের সোনাকে তিনি ৩৫ ডলার করেন। আর যুক্তি দেন যে এতে সারা ইউরোপের অবমূল্যায়িত মুদ্রাগুলোর সঙ্গে এবার ডলার সবার সঙ্গে সমান হলো। 

এভাবে সংকটের পরে নয়া সংকটের মাঝেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ১৯৩৯ সাল থেকে, তবু আমেরিকা কারও পক্ষ নেয়নি। ১৯৪০ সালের জুনেই ফ্রান্স হিটলারের দখলে চলে যায়। হিটলারের নেক্সট টার্গেট ব্রিটেন। ফলে চরম উদ্বিগ্ন ও অস্থিরতা নেমে আসে, প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ওপর। তিনি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে সাহায্য চাইলে হিটলারবিরোধী জোট করতে রাজি হন বটে; কিন্তু শর্ত হলো, যুদ্ধ বিজয়ের পরে ইউরোপের সকলকে কলোনি দখল ব্যবসা ত্যাগ করতে হবে। ফ্রান্সের প্রবাসে থাকা নেতাদের-সহ সারাইউরোপকে রাজি করাতে হবে। তবেই আমেরিকা যুদ্ধের সিংহভাগ খরচও শেয়ার করবে ইত্যাদি। 

আসলে এই দিনটার জন্য তো আমেরিকা এই শতকের শুরু থেকে অপেক্ষা করছিল। এবং সেজন্য ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলেও আমেরিকা তাতে কারও পক্ষে অংশই নেয় নাই। কেবল অপেক্ষা করে বসেছিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কখন ‘কলোনি দখল দুনিয়া থেকে সমাপ্তির’ শর্তে ইউরোপকেও তিনি ফেলতে পারেন। 

নিরুপায় চার্চিল হিটলারের হাতে নিঃশেষ ও অপমানিত হবার চেয়ে রুজভেল্টের কাছে কলোনি ত্যাগের দাসখত লিখে চুক্তিতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন। বিনিময়ে চার্চিল হিটলারের পরাজয় কিনেছিলেন, আর বাকি ইউরোপকে এভাবেই বাঁচিয়েছিলেন। কারণ রুজভেল্টের একটিই শর্ত, যুদ্ধ শেষে বিজয়ের দুনিয়া দেখতে আর কলোনি দখল হয়ে থাকা দেশ-ভূখণ্ডের দুনিয়া যেন না দেখেন। এটাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নেতৃত্ব আমেরিকার হাতে এসে পড়ার মূল কারণ। এতে দুনিয়াকে কলোনি দখল করে রাখা ইউরোপ তো বটেই, সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সবার ওপর আমেরিকার প্রভাব রাখার সুযোগ এসেছিল। আর সবচেয়ে ইতিবাচক আমেরিকান ভুমিকা ছিল সেটা। 

মূলত এ কারণেই আমেরিকার কাছে হাত পাতা, আমেরিকান কথা ও শর্ত মানতে বাধ্য হওয়া ও তার নেতৃত্ব মেনে নেয়াসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হলে এরপরের দুনিয়ায় কলোনি দখলদারেরা সবাই নিজ নিজ দখলের কলোনি ছেড়ে দিবে তাদের মুক্ত স্বাধীন করে দিবে, এই প্রতিশ্রুতি দিতেও বাধ্য হয়। এটাই ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্টের আটলান্টিক চার্টার চুক্তি। 

তাহলে আমেরিকা নিঃস্বার্থ হয়ে কলোনিমুক্ত একটি দুনিয়া দেখতে চাওয়া এমন দেশ সাজতে চায় নাই। আমেরিকার সুনির্দিষ্ট স্বার্থ ছিল। এটাই কী পরবর্তিতে এক ‘আমেরিকান সেঞ্চুরি’ দেখবার স্বপ্ন বা লক্ষ্য ছিল? হ্যাঁ ঠিক তাই! বলাই বাহুল্য আমি সবার ভালো চাই টাইপের কোন আপ্ত বাক্য দিয়ে দুনিয়া চলে না, চলে নাই কখনো। বরং সুনির্দিষ্ট বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তিতেই দুনিয়া চলতে পারে। মানে চলে এসেছে। 

আমেরিকা নিজের হাতে জমে যাওয়া বিপুল উদ্বৃত্ত-সম্পদকে বিনিয়োগে যাওয়ার উপায় বের করেছিল এভাবেই। যুদ্ধের পরে বিনিয়োগের ব্যাপক চাহিদাও তৈরি হয়েছিল। কলোনিমুক্ত স্বাধীন দেশগুলোও আমেরিকান ঋণ-বিনিয়োগ নিবার খাত হিসেবে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। দেখা যায় ১৯৬০-এর দশক অব্দি আমেরিকার এমন খাতক হয়েছিল কেবল যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউরোপ। যেটাকে অনেকে আমেরিকার ‘মার্শাল প্ল্যান’ হিসেবে দেখে বা বুঝে থাকে।

আর ১৯৪৫ সাল থেকে আরেক দিক দিয়ে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর মাধ্যমে এক গ্লোবাল অর্থনৈতিক সিস্টেম চালু করা হয়ে যায়। তবু ইউরোপের বাইরে বিনিয়োগ নিয়ে আমেরিকা তখনও যায় নাই। আর পরে সেই ইউরোপও স্যাচুরেটেড হয়ে গেলে সত্তরের দশক থেকে এশিয়া ঋণের গ্রাহক হবার সুযোগ পায়। আসলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মানে উড্র উইলসনের সময় থেকেই আমেরিকার এমন পরিস্থিতিকে টার্গেট করে নিজের পররাষ্ট্র নীতিসহ সব রাষ্ট্রীয় নীতিকে মূল কথা করে এগিয়েছিল। 

যেটি বাস্তব রূপ দেবার সুযোগ আমেরিকার হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৪-৪৫ সাল থেকে। এই প্রথম আমেরিকার নেতৃত্বে দুটি গ্লোবাল ইনস্টিটিউশন অর্থাৎ কন্ট্রোলিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ পায়। এক, গ্লোবাল বাণিজ্য বাস্তব করে তুলতে গেলে এর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক।

তবে বলাই বাহুল্য আমেরিকার একক গ্লোবজুড়ে থাকা প্রভাবের কারণে এটি আমেরিকা মুখী সংগঠন অবশ্যই, কারণ একা আমেরিকান মালিকানাই এখানে সর্বোচ্চ প্রায় ১৮%, এখন যেটা কমে প্রায় ১৬%। এটা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৯১ রাষ্ট্র সদস্যের। তাই (১৬-১৮%) মালিকানা দিয়েই পুরা সংগঠন আমেরিকার একক নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট থাকতে দেখা যায়। বরং যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ছোট-গরিব দেশগুলো আমেরিকান অর্থনৈতিক সক্ষমতার করুণা প্রার্থী। এমনকি সময়ে ইউরোপও তাই হয়েই টিকে থেকেছে। 

নয়া প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের উত্থান

অনেক পরে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের উত্থান ২০০৯ সালের পর থেকে। এই প্রথম প্রতিদ্ব›দ্বী অর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলোচীনের হাতে (যেমন বিশ্বব্যাংক-তুল্য চীনের ৩০% মালিকানার নয়া প্রতিষ্ঠান এআইআইবি [AIIB]) উঠে আসছে। যদিও সবার অলক্ষ্যে এখনো এ গ্লোবাল বাণিজ্য লেনদেন বিনিময় সম্ভব হচ্ছে পুরনো সেই একমাত্র আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। 

শত খুঁত-খামতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো বদলাচ্ছে খুব ধীরে, তা বদলাতে হবে অবশ্যই; কিন্তু বাধ্য না করলে কে আর বদলায়! এককথায় বড় বড় সব অসম-বাণিজ্যের উৎস অবশ্যই এসব গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান; কিন্তু তাই বলে প্রতিষ্ঠানটাই নাই হয়ে যাক কী নিপাত যাক ‘এটা কোনো বুদ্ধিমানের স্লোগান’ হতে পারে না। আর তা কারও কাজেও আসে নাই। কারণ, এর মানে হবে আমরা খুবই সীমিত প্রায় নাই এমন বাণিজ্য বিনিময়ের কলোনি ক্যাপিটালিজমের যুগে যেন ফেরত যেতে চাচ্ছি। 

তাই মূলকথা একদিকে যেমন দুনিয়াজুড়ে গ্লোবাল বাণিজ্য ও লেনদেন বিনিময় ব্যবস্থা ছাড়া আমাদের মুক্তি নাই, শ্রমের মুক্তি নাই। আবার অবশ্যই এই বাণিজ্য-সম্পর্কের ভিতর গভীর সব বৈষম্য লুকিয়ে ছড়িয়ে আছে। যার অবশ্যই অবসান দরকার; কিন্তু ‘নিপাত যাক’ এটা একেবারেই ভুল স্লোগান!

দুনিয়াতে এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেমের পূর্ব শর্তগুলো আর এক গ্লোবাল অর্থনীতিক ব্যবস্থার জন্ম এখান থেকেই। 

১৯৪৫ সালের আগে-পরের দুনিয়া

তাহলে দুনিয়াতে এই প্রথম একটি গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম জেগে উঠছে। এবং এটা গড়ে উঠেছিল কলোনি-দখল করা হারাম ফলে কলোনি মুক্তিরই ভিত্তিমূলক এক বয়ানকে কেন্দ্র করে। আর এই বয়ানটাই জাতিসংঘের জন্ম ঘোষণার ভিত্তি। আর ওদিকে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা মানে কার্যকর মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তোলার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসাবে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক, আর এসব মিলিয়েই দুনিয়াতে প্রথম এক গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম গড়ে উঠেছিল। এটাকে আমরা তুলনা ও কল্পনা করতে পারি একটি দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠার সঙ্গে। 

যে কোনো দেশে রাজা, সুলতান বা সম্রাটের শাসন ব্যবস্থা পর্যন্ত ওই দেশে একটি শাসন ব্যবস্থা অবশ্যই সবসময় ছিল বা থাকে; কিন্তু সাবধান। শাসন ব্যবস্থা থাকা মানে সেটা রাষ্ট্র নয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। এই ভুল অনুমান করা যাবে না। রাষ্ট্র আর শাসন এককথা বা ধারণা নয়। শাসন ব্যবস্থায় কে ক্ষমতা দিয়েছে বা কোথা থেকে কোন সূত্র থেকে শাসক ক্ষমতা পেয়েছে বা এসেছে এই উৎস বলতে পারার ওপর নির্ভর করে এটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয়েছে, নাকি কেবল এক শাসন ব্যবস্থাই যার ক্ষমতার উৎসের খবর নেই।

ব্যক্তি, নাগরিক বা জনগণ সকল রাষ্ট্র ক্ষমতার উৎস, তারা তাদের ক্ষমতা দিয়ে কাউকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দিয়েছে- এই ভিত্তিতে কেউ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ক্ষমতায় আছে, এমন প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় যদি ক্ষমতা তৈরি হয়ে থাকে, যেটাকে রিপাবলিক বলে- তখন থেকে এই শাসনকে রাষ্ট্রব্যবস্থা বলা যায়। বা পাবলিক ক্ষমতার উৎস এটা স্বীকৃত হলে এটাই জন-শাসন ব্যবস্থা বা সেটা একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে স্বীকৃতি পেতে পারে। দেশের একটি পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক ব্যবস্থা এবার একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে। 

ঠিক সেরকম দুনিয়াতে একটি গ্লোবাল পলিটিক্যাল ও ইকোনমিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ১৯৪৫ সালের পরে। আমেরিকা ১৯৪৪-৪৫ সালে গ্লোবাল পলিটিক্যাল এক স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলেছিল জাতিসংঘ।

তাতে এই প্রথম সবাইকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকে নানান কনভেনশন, আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম রেওয়াজ, যুদ্ধের পালনীয় কর্তব্য ইত্যাদি বহু গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড, ইনস্টিটিউশন তৈরি হয়েছে। আগেই বলে নেওয়া ভালো, এগুলো খুবই ভালো বা একেবারে আদর্শ অবশ্যই নয়। বরং গ্লোবাল প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা বা যোগ্যতা যে রাষ্ট্রের যত বেশি সে মোতাবেক এর কান্নি মেরে থাকার একটি ঝোঁকও আছে। তবে এটাও অবশ্যই ক্রমবিকশিত বা ইভলবিং।

ক্রমশ বিকশিত হতে সুযোগ-দেওয়া ও নেওয়া একটি প্রক্রিয়া অবশ্যই। আর নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এগুলো এসময়ে। যেমন এখন ‘রেসিজম’ যে একটি সিরিয়াস অপরাধ বলে অনেকে সোচ্চার, বলবার মতো অনেককেই পাওয়া যায়, এটুকু তো এই গ্লোবাল ব্যবস্থারই ফলাফল। আর সবচেয়ে বেশি দরকার এ ধরনের নীতি অবস্থানগুলো মানুষের মনে প্রতিষ্ঠা করা। যদিও এসব গড়তে গিয়ে, সব সময় তা ভালো বা কার্যকর ভূমিকায় হাজির থাকতে পেরেছে তা না, অনেক সময় ন্যূনতম ভালোও নয়। 

তবু এই গ্লোবাল ব্যবস্থার অর্জনও কম নয়। আর তা খুবই কার্যকর। এই তো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন কোনো কনভেনশন, আন্তর্জাতিক আইন, নিয়ম-রেওয়াজ, যুদ্ধের নিয়ম পালনীয় কর্তব্য বলতে কিছুই ছিল না। সে পর্যায়ের চেয়ে আজ এটা অবশ্যই ভালো। 

গ্লোবাল রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিউম্যান রাইটস বলে প্রসঙ্গটি হাজির হওয়া। শুধু হাজির হওয়া নয়, ইউরোপের প্রায় সবাই (৪৭ রাষ্ট্র আলাদা নিজেদের কনভেনশন ১৯৫০, আর কার্যকর ১৯৫৩) ডেকে কেউই আর নেশন-স্টেট নয়। তারা কেউই আর জাতি-রাষ্ট্র নয় বরং প্রত্যেকটাই নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করার ভিত্তিতে ও লক্ষ্যে গড়ে তোলা নতুন রাষ্ট্র।

এক হিটলারের জাতিরাষ্ট্র দেখার পরে ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা তাদের শাসকের মধ্যে হিটলারের ছায়া দেখতে পেয়েছিল। মূলত তাই এই বদল আনে তারা। ইতিমধ্যে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের ‘মানবাধিকারের চার্টার’ গৃহিত ও প্রকাশিত ও চালু হয়ে গেছে। পরবর্তিতে ইতোমধ্যে ১৯৬৬ সালের nternational Covenant on Civil and Political Rights‘ গৃহিত ও অনুমোদিত হয়েছে। 

এখানেও পরিষ্কার থাকা ভালো, এই যা কিছু নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল, এগুলো মধ্যে কোনো খুঁত বা খামতি নাই তা নয়। বরং উল্টো। তবু এটা অনেকটা একটি শহরের কথা যেন, যারা এর ভেতরের বাসিন্দা- তাদের বসবাস ও থাকা বা চলাচল ইত্যাদির জন্য নিয়মকানুন কনভেনশন আছে; কিন্তু ধরা যাক আপনি বাইরের অন্য শহরের লোক। আপনি এখন বাইরে থেকে এসে ভেতরের ওসব নিয়ম আইনের কিছুই মানেন না এমন দাবি জানালেন।

কারণ ধরা যাক এগুলো তৈরির সময় আপনার মতামত নেয়াই হয়নি। এমন কথা বলে যদি ওই শহরে ঢুকতে যান, এতে ফলাফল হতে পারে এই যে ওরা উল্টো আপনাকেই আউটকাস্ট, কি বাইরের লোক বা গোঁয়ার আনকুথ চাইকি ‘জঙ্গি’ বলেও বাইরে বের করে দিতে পারে। তাই সেক্ষেত্রে ওই শহরে প্রবেশ ও বসবাস করতে চাইলে বরং ভালো উপায়, 

প্রথমত তাদের নিয়ম মানেন বলে প্রবেশাধিকার তো নেন আগে। এরপর ওদের নিয়ম মেনেও চলেন। আর এইবার সামনে যতগুলো সুযোগ আপনি পাবেন এবং সব জায়গায় সবার মধ্যে আপনার পালটা নিয়মটা বেশি ভালো বলে প্রচার চালান। করে দেখান, আকৃষ্ট করেন। এরপর দলে ভারী বুঝলে নিয়ম বদলাবার চেষ্টার উদ্যোগ নেন। অর্থাৎ খেলার পুরনো নিয়ম গ্যালারিতে বসে বদলানো যাবে না। এর চেয়ে বরং এই সিস্টেমে প্রথমত খেলায় অংশ নিতে হবে। আর এই অংশ নিয়ে খেলতে খেলতেই একমাত্র বদলানো সবচেয়ে সহজ ও সম্ভব হতে পারে। 

সার কথায়, গত ১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘকে কেন্দ্রে রেখে এই গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি (গ্লোবাল পলিটিক্যাল সিস্টেম) গড়ে তোলা হয়েছিল। যার ভিত্তি হলো, কাউকে কলোনি দখল করা হারাম। কেবল ভূখণ্ডের বাসিন্দারাই রায় দিতে পারে শাসক বৈধ কে হবে। অর্থাৎ যে কোনো নামের আড়ালে রাজতন্ত্র কায়েমও অবৈধ। জাতিসংঘ-এর জন্ম ম্যান্ডেট তা সমর্থন করবে না। 

তবু অনেক রাজনীতিবিদ এমনকি কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদের কাছে এই ‘গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ নিয়ে ধারণাটা অপরিষ্কার। তাদের ধারণা এখন রাষ্ট্রগুলো যেহেতু সার্বভৌম, ফলে সে চাইলে যে কোনো রাজনৈতিক ধারণার চর্চা চালু করতে পারে। এমনকি তা গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা জাতিসংঘের বিরোধী হলেও। এমন ধারণা ভুল। আইনিভাবে রাষ্ট্র নিজ ইচ্ছামত রাজনীতির চর্চা করতেই পারে; কিন্তু গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার আউটরাইট বিরোধী কোনো ব্যবস্থাকে সারভাইভ করানো বা টিকানো, বিশেষ করে গ্লোবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া- এটাই সবচেয়ে সবচেয়ে অসম্ভব বিষয় হয়ে দাড়ায়। তাতে আপনি নয়া আরেক কমিউনিস্ট কি ইসলামিস্ট রাজনৈতিক ধারার হন না কেন! তাদের জন্য মূল বাধা এখানে! 

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //