বাঙালি জীবনের রূপকার জসীম উদ্দীন

জার্মান দার্শনিক ও পণ্ডিত ইয়োহান জি হার্ডার বলেছেন: `Folk Poetry is the Soul of a Nation' (একটি জাতির আত্মা লোকজ সাহিত্য)। লোক কবিতার একটা অংশ ভাব-গভীর ও দার্শনিকতাপূর্ণ। এমন গভীর ভাবনা থেকে বলা যায়- জসীম উদ্দীন মূলত মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগের মধ্যেকার বিচ্ছিন্নতার সাঁকো। যে সুতা ছিঁড়ে গিয়েছে সেই সুতা কিংবা দুটি প্রান্তের সংযোগ করতে চেয়েছেন। 

সেইসঙ্গে বাংলা কাব্যকে তিনি বাংলা কাব্যের গণমুখী নিজস্ব ধারায় রাখতে চেয়েছেন। এ জন্য তাঁর সাহিত্যে তিনি তাদের কথাই বলেছেন যাদের কথা তথাকথিত ‘আধুনিক’ বা ভদ্র সাহিত্য বলে না। আধুনিক ভদ্র সাহিত্যে পাশ্চাত্য সাহিত্যের এবং জীবনচেতনার প্রভাব সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। ‘আধুনিক’ সাহিত্য যে নিচ থেকে ওপরের সাধনা করেনি, এই সাহিত্য যে ওপর থেকে নিচের সাধনা করেছে- অধিকাংশ সময় শুধু ওপরের সাধনাই করেছে- সে বিষয়ে জসীম উদ্দীন সচেতন থেকেই নিজের সাহিত্যচর্চা করেছেন। 

জসীম উদ্দীনের জন্মশত বছর হয়েছে দেড় যুগ আগে, মৃত্যুরও ৪০ বছর পার হয়েছে আর তাঁর বহুলপঠিত ‘কবর’ কবিতার প্রকাশের (১৯২৫) শতবর্ষের অল্পই বাকি আছে। নোবেল জয়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের বাইরে এরকম প্রভাব সঞ্চারী ঘটনা, শতবর্ষ উদ্যাপনের এমন উপলক্ষ্য বাংলা কবিতা তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও খুব বেশি নাই। 

লক্ষ্যণীয় যে, আধুনিক কালে শুধু জসীম নন অনেকের হাতেই রচিত হয়েছে বিশেষ ধরনের কবিতা- বাংলায় আমরা যাকে বলি গীতিকবিতা। বাংলা সাহিত্যে বিহারীলাল তো এজন্যই বিখ্যাত। খোদ বিশ্বকবির হাতেও রচিত হয়েছে-গীতিকবিতা। বিশ্বসাহিত্যের যেটুকু আলো আমাদের কাছে পৌঁছেছে তাতেও আছে Coleridge, Keats, Kipling, Oscar Wilde, Pushkin, Wordsworth বা লৌকিক জীবনালেখ্যভিত্তিক কাহিনী কাব্য রচয়িতার নাম।

আবার, প্যাস্টোরাল বা পাস্টারাল বা রাখালি কবিতাও কম পরিচিত নয় বিশ্বকাব্য মানচিত্রে; কিন্তু, যদিও কারণটি পরিস্কার নয়, জসীম উদ্দীন একটি প্যারাডক্স হিসেবে আবির্ভূত হলেন, যখন ১৯২৮ সালে তাঁর প্রথম ব্যালাড জাতীয় কাব্য বিখ্যাত ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ প্রকাশিত হলো। 

আমরাও জসীম উদ্দীনের অধিকাংশ রচনায় চোখ রেখে বলতে পারি- এক বিস্ময়কর মানবপ্রেমী; বিশেষ করে দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর, রাখালের প্রতি অসম্ভব মমতা লক্ষ্য করার মতো। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা বাংলার হিন্দু মুসলমান উভয় সমাজের মানুষের যাপিত জীবন অসামান্য দরদে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ বাস্তবতায় মানুষের জাগতিক দুঃখের রূপায়ণ করেছেন। সবসময় সহানুভূতিশীল ছিলেন নিপীড়িত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি।

সেই তুলনায় বিরলপ্রজ মানুষদের একজন, সেই সঙ্গে বাংলার মা মাটির সন্তান জসীম উদ্দীন। লোক ঐতিহ্যের রূপায়নে কবি মানসের পরিপুষ্টি। অসম্প্রদায়িক বাংলার আলো বাতাসে ‘মুসলিম তাঁর নয়নমণি হিন্দু তাঁহার প্রাণ’ আবহমান পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন দুর্লভ এই বৃক্ষ। সমন্বয়বাদী ও উদারপন্থী সাহিত্য সাধক বাংলার মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে অনবদ্য সৃষ্টি করে অমর হয়ে থাকবেন কাল থেকে কালান্তর। 

বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র যে আদর্শবাদ অনুশীলন করে চমৎকৃত করেছেন- সে গোড়া সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্র একটু অতিমাত্রায় বিদ্রোহের সুরেই বাস্তববাদের পরশ লাগিয়ে আমাদের উচ্চকিত করে তুললেন। আর রবীন্দ্রনাথ এ আইডিয়ালিজম ও রিয়ালিজমের সমন্বয় সাধন করে অতি প্রান্তিক ধারার সম্মেলনে সাধন করে একমুঠো পথের ধুলো নিয়ে বললেন সোনা হও- অমনি সোনা হয়ে গেলো। 

অন্যদিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে- মধুসূদনের মহাকাব্য গড়ে ওঠে পৌরাণিক মহাকাব্য, বাল্মীকির রামায়ণ আশ্রয় করে; কিন্তু বীজ এ দেশি হলেও রস ও সার সঞ্চারে কাজ করেছেন বিদেশি হোমার-দান্তে মিলটন- তেমনি রবীন্দ্রজ্যোতি ভেদ করে আসেন নজরুল ইসলাম। তাঁর কাব্যের মূল প্রেরণা পুঁথি সাহিত্যের ঐতিহ্য সঞ্জাত হলেও নিজস্ব অনন্য প্রতিভার অনুকরণ সমসাময়িক বা উত্তরকালে সার্থকতা মণ্ডিত হয়নি। (সাহিত্য পত্রিকা, চৌত্রিশ বর্ষ, কাজী দীন মুহম্মদ, পল্লি কবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর দুটি কবিতা)

এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, জসীম উদ্দীন জীবনকে আধুনিক রুচিসম্মত শিল্পরূপ দান করে যে কাব্যধারা গড়ে তুলেছেন, এ ধারায় তিনি এক অনন্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ ক্ষেত্রে লোকসাহিত্যের লোকগীতি ও গীতিকার আশ্রয়ে পরিপুষ্ট হলেও তাঁর সৃষ্ট মানুষ সমাজ ও ছবি সহজাত শিল্পবোধের মহিমায় উজ্জল। নাগরিক নব জিজ্ঞাসার আলোকে উদ্ভাসিত। নিজেই বলেছেন, আসলে কবি নজরুল ইসলামের প্রতিভার পূজারি ছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে যদিও আমি কোনোদিন তাঁহার লেখা অনুকরণ করিনি, কিন্তু তাঁহার সাহিত্যিক মতবাদের প্রতি আমাদের সকলের সমর্থন ছিল। (বন্ধু হাবিবুল্লাহ বাহার, জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধ সমূহ ২য় খণ্ড)

পরবর্তীতে আমরা দেখি ভীরু পদক্ষেপ; কিন্তু বলিষ্ঠ কণ্ঠে একতারা হাতে আপন মনে গেয়ে উঠলেন জীবনের গান জসীম উদ্দীন। স্পষ্টই অঙ্গীকার করেন: 

কাঁদে এই মাটি। আমি শুধু শুনি মাটিতে এ বুক পাতি

মাটির বুকের স্পন্দন শুনি, জাগিয়া দীঘল রাতি। 

রামধনুরে ধরতে পারি রঙের মায়ায় ধরব না তা, 

বিজলী এনে ভরতে পারি রঙের খাঁচায় আনব না তা, 

পাতালপুরীর রাজকন্যা সাত মানিকের প্রদীপ জ্বালি

ঘুম ঘুমিয়ে ঘুমের দেশে ঘুমলী স্বপন হাসছে খালি, 

এসব কথা ছড়ায় গেঁথে বলতে পারি বলব না তা, 

পাখির পাখায় লিখন ভরে লিখতে পারি লিখব না তা, 

লিখব আজি তাদের কথা, কথা যারা বলতে নারে, 

একশো হাতে মারছে যাদের সমাজনীতি হাজার মারে। 

(জসীম উদ্দীন: কাব্য সমগ্র)

বলা হয় মাইকেল পরবর্তী রবীন্দ্রাকাশ বাংলা কবিতার আধুনিক ধারার উন্মেষকাল; কিন্তু অধিকাংশ সৃজন কৃষক সে ছায়ায় টুকটাক হাঁটলেও নতুন কন্ঠস্বরে আজান হাঁকেন জসীম উদ্দীন। এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির মানুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। আপন জানালায় বসে চারপাশ দেখেন গভীর মমতায়। অর্থাৎ জসীম উদ্দীনের সৃষ্টি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথম থেকেই সমকালে অবস্থান করেও বিষয় ও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র্য ভাবনায় এগিয়ে গেছেন। বাংলার ভবনে কোনো ধরনের দ্বিধাহীন ও নিঃসঙ্গতায় চলেছেন আমৃত্য। যদিও তিনি বেদনাহত হয়ে আত্মস্মৃতিতে লিখেন-“সারাজীবন যাদের জন্য লিখলাম, তারা কোনো দিন আমার সাহিত্য পড়া থাক দূরে, হাত দিয়ে ধরেও দেখেনি। তবু আমি তাদের জন্য লিখেছি”। 

এই স্বপ্নক্ষয়ের কালে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গল্প নিয়ে আসেন জসীম উদ্দীন। আরও বিশেষভাবে বললে কলকাতা কিংবা ঢাকার (তাঁর কালে মফস্বল থেকে শহরের মর্যাদায় উত্তীর্ণ একমাত্র বাংলাদেশি শহর) বাইরে বিস্তীর্ণ যে বাংলাদেশ- সেখানকার ৯৯% বাঙালির জীবন ও যাপনের গল্প। ভাবনার বিষয় হলো জসীম উদ্দীনের কবি খ্যাতি যে ‘কবর’ কবিতা দিয়ে, কল্লোলে তার ট্যাগ ছিল ‘গ্রাম্য কবিতা’। বোধ করি, কল্লোলের সম্পাদকরা ভুলে গিয়েছিলেন হয়তো ‘কল্লোল’র অফিস শহরে- কিন্তু কলকতার যে তল্লাটে তাদের বাস, সেটিও গ্রামের অংশ। গ্রামে বসবাস করে কথিত শহরের ছোট্ট পকেটের তল্লাটে মাথা গোঁজার ঠাঁই থেকে নগরায়নের ভাব প্রকাশ হাস্যকর বৈকি!

আমরা এবার চোখে রাখি- যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’ কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘এক গাঁয়ে’, ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার প্রকাশকালে ট্যাগ কী ছিল? ‘গ্রাম্য কবিতা’? কিংবা বিশেষভাবে, এই সব কবিতার জন্য বাগচী, ঠাকুর, কুমুদরঞ্জনকে ‘গ্রাম্য কবি’ বলা যায়?

মনে রাখা জরুরি- জসীম উদ্দীন- যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁর কবিতা অতি-আধুনিক বলে নন্দিত-নিন্দিত ‘কল্লোল’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, যেখানে থেকে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে ঠাঁই পেয়েছে, পাশ্চাত্যে নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে সমকালেই, নিজেও মার্কসের জার্মানি ও লেনিনের রাশিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকার পথে পথে মুসাফিরগিরি করছেন, তাকে এভাবে চিহ্নিত করা বিস্ময়কর বটে। (মাসুদ রহমান, মার্কসীয় আরশিতে জসীম উদ্দীনের কাহিনীকাব্য, উলুখাগড়া ২০১৭)

ব্যাপারটিকে এবার আমরা আর একটু বড় করে দেখলে মিলবে জসীম উদ্দীনের বৈশ্বিক মিল। অনুসন্ধানে দেখলে বিশ্বের বিভিন্ন কবির সঙ্গে জসীম উদ্দীনের সাম্য ও সাদৃশ্য খুঁজে বের করা কঠিন কিছু হবে না। প্রসঙ্গত কবি জিওফ্রে চসারের (১৩৪০-১৪০০) কথাই উল্লেখ করতে হয়। চসার যেমন ইংরেজদের একমাত্র জাতীয় কবি, তেমনি জসীম উদ্দীন বাঙালি জাতীর কবি। (জসীম উদ্দীন/ এ কে এম আমিনুল ইসলাম এবং মুহম্মদ আবদুল হাই লিখিত ভূমিকা।)

ইংরেজ কবি উইলিয়ম ওয়ার্ডসওয়াথের্র সঙ্গে জসীম উদ্দীনের মন মননে অনেক মিল। কোথাও কোথাও আমূল প্রোথিত। প্রকৃতির কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ মনে করতেন কাব্যের ভাষা হবে সহজ। অশিক্ষিত জনগণ যে ভাষায় তাদের মনের ভাব ব্যক্ত করে, সেই ভাষাই হবে কবিতার বাহন। অন্যদিকে মার্কিন কবি রবাট ফ্রস্টের সঙ্গেও জসীম উদ্দীনের মিল পাওয়া যায়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কাব্য সংকলন- ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জসীম উদ্দীনের ‘রাখালী’ গীতিকাব্যের ধারায় দুটি কাব্যগ্রন্থ সমান উজ্জ্বল সময়ের ব্যবধান সত্ত্বেও । উভয় কবির কবিতাই গীতিকাব্যধর্মী, সাধারণ মানুষের বিষয় বস্তুসহ সার্বিক উভয়ের মিলটাও এখানেই। 

(জসীম উদ্দীন ও বিশ্বের অন্যান্য সমগোত্রীয় কবি/তিতাশ চৌধুরী/রাখালী ও নকসী কাঁথার মাঠ। মুক্তধারা/ ২০১২)

জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, বিষ্ণু দে বা অমিয় চক্রবর্তীর মতো পরীক্ষামূলকভাবে সময় নেননি, বিষয়বস্তুর দিক থেকে সরাসরি জাতিসত্তা নিয়ে কলম ধরেছেন। বিংশ শতাব্দীর বিশ-ত্রিশের দশকে কথিত নাগরিক জীবনের বাইরে এই অবস্থান এক দুঃসাহসিক অভিযানের মতো। তাঁর সৃষ্টি নিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন নির্দ্বিধায় বলেছেন- ‘আমি হিন্দু, আমার কাছে বেদ পবিত্র, ভাগবত পবিত্র; কিন্তু ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকখানী তাহার চাইতেও পবিত্র। কারণ ইহাতে আমার বাংলাদেশের মাটির মানুষগুলোর কাহিনী আছে।’ বাস্তব অভিজ্ঞতায় জীবনশিল্পীর মতোই ছিল জসীম উদ্দীনের কাঁচামাল। 

জসীম উদ্দীন বহুমুখী আধুনিক ব্যক্তিত্ব- একাধারে কবি, কাব্যোপন্যাসিক, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, ভ্রমণ কাহিনীকার, নাট্যকার, স্মৃতিকথক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক ইত্যাদি বহুবিধ পরিচয় বিশিষ্ট। তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ১৯৪০ এর মধ্যে একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হয়। ১৯৬৯-এ ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ইউনেস্কোর অনুবাদ প্রকল্পে দ্বিতীয় গ্রন্থ হিসেবে অনূদিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকাতে কবি লেখেন- আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলে বহু চাষি মুসলমান ও নমঃশূদ্রের বাস। তাহাদের মাঝে সামান্য ঘটনা লইয়া প্রায়ই বিবাদের সূত্রপাত হয়।

এইসব বিবাদে ধনী হিন্দু-মুসলমানরা উৎসাহ দিয়া তাহাদিগকে সর্বনাশের পথে আগাইয়া দেয়। মহাজন ও জমিদারের মধ্যে কোনো জাতিভেদ নাই। শোষণকারীরা সকলেই এক জগতের। ইহাদের প্ররোচনায় হতভাগ্য নমঃশূদ্র ও মুসলমানদের যে অবস্থা হয়, তাহা চক্ষে দেখিলে অশ্রু সংবরণ করা যায় না। পাক-রুশ মৈত্রী সমিতির সহসভাপতি ড. গস্কোওস্কির আমন্ত্রণে তিনি সোভিয়েত রাশিয়া যান। কবি নিজের ভাষায় বলেছেন, ‘সারাজীবন আমার দেশের জনগণকে লইয়া সাহিত্য করিয়াছি।

তাহাদের সুখ, দুঃখ, স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, লইয়া কবিতা উপন্যাস লিখিয়াছি। আমার খুব বড় স্বপ্ন ছিল একবার সোভিয়েত দেশে যাইব। সে দেশের রাষ্ট্র কীভাবে তার জনগণকে সব চাইতে বড় আসন দিয়াছে ও কূপমণ্ডকতা হইতে মুক্ত করিয়া ওপরে তুলিয়া ধরিয়াছে’। লেনিন, সোভিয়েত দেশ ও সমাজতন্ত্রের প্রতি কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিল। সোভিয়েতের সেই ব্যবস্থা দেখে কবি বলেছেন, ‘ইস্ আমার বাংলাদেশে যদি এমন ব্যবস্থা থাকত সকলে সোভিয়েত দেশের মতো সুখে থাকত’। 


আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা, 

ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি, জড়ায়ে মায়ের ডানা। 

ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর, 

মরণের দূত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দূর-দূর। (পল্লীজননী)

একি আমাদের চিরায়িত বাংলার দৃশ্য নয়! জীবন সংসারের শাশ্বতরূপ তো এমনি হয়। এক কথায় জসীম উদ্দীন হতে চেয়েছেন গ্রামীণ মানুষের অলিখিত জীবনের রূপকার। বরাবরই সফল- কী গদ্যে কী পদ্যে। কারণ যে সময়ে রবীন্দ্র বলয় থেকে বের হওয়া দুরহ! সেই সঙ্গে ক্যালকুলেটিভ বুদ্ধদেব বসু যখন ইউরোপিয়ান সাহিত্য অনুবাদ শুরু করেন।

পরিকল্পনাহীন কাজী নজরুল ইসলাম অনুবাদ করেন ওমর খৈয়াম, কাব্যে আমপারা। জসীম উদ্দীন স্বপ্ন-কল্পনার আচ্ছন্নতা কিংবা রূপকথার অলীক মায়ার কাছে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেননি। শিল্পের ভেতর দিয়ে নিঃস্ব-নিপীড়িত-রিক্ত-ভাগ্যহীন গ্রামীণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ ও সহমর্মিতা পোষণই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। 

প্রসঙ্গে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথা বলা যাক, মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের লোকজীবনের মধ্যে গতানুগতিকতা সত্ত্বেও যে সজীবতা ও প্রাণময়তা আছে, তাকেই তিনি রূপ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্র এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের লেখকরা যখন নিত্য নতুন উপন্যাস উপহার দিচ্ছেন, তখন তিনি ছন্দে লিখছেন কাহিনী। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কা যে ছিল না, তা বলা যায় না, কিন্তু হলো উল্টোটা। তাঁর কাব্যের আবেগের, ভাষার চিত্রকল্পের অকৃত্রিমতা-মন জয় করে নিল আধুনিকমনা বাঙালি পাঠকের, বিদগ্ধ ইউরোপীয়ের। জসীম উদ্দীনের আবির্ভাবের পর আধুনিক বাংলা কবিতার কোনো যোগ্য সঙ্কলনে তাকে অবহেলা করা ছিল অসম্ভব। (জসীম উদ্দীন: মানুষ ও কবি)

বিশ্বগ্রামের যুগে কেউ জসীম উদ্দীনকে পল্লীকবি হিসেবে প্রচার করলে তা হবে সাহিত্য চিন্তার চরম সংকীর্ণতা। তিনি গ্রামের সহজ-সরল মানুষের প্রাত্যহিক ভাবনাকে আধুনিক মনে অমায়িক দরদ দিয়ে বাঙালি জীবন বর্ণনা করেছেন। বাংলার এই অসামান্য রূপকারকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- তাঁর কাব্য-ভাব, ভাষা, চিন্তা, যুক্তি, শিল্পমানের গভীরতা, ভাষা ও কাহিনীর বুনন, কাব্য চয়ন, চিত্রকল্প, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক এবং প্রতীক বিনির্মাণে সত্যিকারের জীবনশিল্পী। গ্রামীণ জীবন তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিতো এ কথা আজো সত্য; কিন্তু বিস্ময়করভাবে শব্দচয়নে তিনি সর্বোচ্চ আধুনিকতাকেই টেনে ধরেছেন।

জীবনের সুরে, লাঙলের টানে, কৃষকের গানে, কিংবা মানুষের একাত্ববোধ নৈর্ব্যক্তিক ধারণায় নির্মাণ করেছেন। যার ফলে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন- নজরুল ইসলামের পরে জসীম উদ্দীনের আবির্ভাব যেন গায়কের পর শিল্পীর অভ্যুদয়।’ যা ছিল সত্যিকার অর্থে অনেক কঠিন। আর জসীম উদ্দীন সেই কঠিনকে নিয়েছেন নিমগ্ন সাধনা হিসেবে। রবীন্দ্র-নজরুল-কল্লোল-ত্রিশোত্তর যুগের উজ্জ্বল আলোক-সম্পাতে বঙ্গীয় সাহিত্যে যখন সমৃদ্ধ, গ্রাম-বাংলায় ধূলোর রাস্তায় রোদ-বৃষ্টির মাঝে বিনি সূতোর মালা নিয়ে চেনা পরিবেশ আওড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রতিভার স্নিগ্ধ আলো হাতে বাংলা কাব্যে এবং গানে এই মহান শৈল্পিক-কবির আবির্ভাব। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একটি স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, জসীম আমাদের গ্রাম্য জীবনকে তার তুলির আঁচড়ে মূর্ত করে তুলেছে, এবং যারা ছিল সমাজের মধ্যে অপাংক্তেয় তাদের জীবনের চিত্রকে ভদ্র জীবনের সামনে জীবন্ত করে পেশ করেছে। 

ময়মনসিংহ গীতিকা বা পুঁথিকাব্যর আহ্বায়ক প্রখ্যাত পণ্ডিত ড. দীনেশ চন্দ্র সেন কবির গানের প্রেক্ষাপটে বলেন, জসীম উদ্দীন যেমন খাঁটি কবি তেমনি করে সাধনায় ব্রত হয়ে গানকে করে তুলেছেন মানুষের মুখের ভাষা। এসবের মূল কারণ হলো ষোল আনাই পল্লী নিবেদিত প্রাণের মানুষ। তার সময়ের সকল শ্রেষ্ঠ মানুষদের বাইরে গিয়ে শুধু কবিতাই চর্চা করেন না, গানকে দিয়েছেন নতুন মাত্রা।

আবহমান বাংলার লোকজ-সাংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে শুদ্ধ পরিস্নাত এক স্বাতন্ত্র্য অধিকারী ভাস্বরে ভাস্বরে যে কবি ধান-গম-কাউন-ভুট্টা দিয়ে ক্রমান্বয়ে পর্বত বানিয়েছেন। যেখানে ধারন করেছেন গ্রাম বাংলার সহজ সরল সাধারণ মানুষের জীবন-বৈচিত্র্য, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, ছায়া-ঢাকা সবুজ দিগন্ত, বিস্তুত মাঠে শস্য, নদ-নদী-ফুল-পাখি, ধানক্ষেতসহ যার নিখুঁত কলমে তুলে আনাটা একমাত্র জসীম উদ্দীনের পক্ষে সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের মতে, জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতূন ধরনের। প্রকৃত কবির হৃদয় ছিল এই লেখকের কাছে। 

বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা কবিতা গ্রামীণ আবহের সৌরভ ছড়াতে শুরু করে। গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতির রূপায়ণই ছিল এই কবিতার উদ্দেশ্য। এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কুমুদরঞ্জন মল্লিক এবং কালিদাস রায়। তবে সমালোচকের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে: ‘মার্জিত রুচিশীল ভাষায় নিখুঁত ছন্দের কলা-কৌশলে কোনো কোনো গ্রামীণ দৃশ্য অথবা ঘটনাকে তাঁরা কাব্যগত করেছেন; কিন্তু তাঁদের শিল্পদৃষ্টির ভেতরে নাগরিক বৈদগ্ধ্য ও বিস্ময়বোধ সহজেই চোখে পড়ে।’

গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, এখানেই জসীম উদ্দীনের সঙ্গে গ্রামমুখীন এই কবিদের মূল পার্থক্য। প্রসঙ্গ ও প্রকরণ- জসীমউদ্দীন উভয়তই ছিলেন লোকজীবনের অনুবর্তী এবং লোককবির স্বভাবাক্রান্ত। তাই লোকজীবনের রূপকার হিসেবে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র ও মৌলিক। অভিন্ন নামের লেখকের সঙ্গে পার্থক্য-রচনার প্রয়োজনে দেশবাসী-প্রদত্ত যে ‘পল্লীকবি’ উপাধি তিনি গ্রহণ করেন, তা ছিল তাঁর যথার্থ পরিচিতি-জ্ঞাপক অভিধা। তাঁর অন্তরঙ্গ কবি-স্বভাব ও বহিরঙ্গের ব্যক্তি-পরিচিতি- উভয়ই যে একান্ত গ্রামীণ প্রভাবপুষ্ট, সেই বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর সাক্ষ্যে : একেবারে সাদামাটা আত্মভোলা ছেলে এই জসীমউদ্দীন।

চুলে চিরুনি নেই, জামায় বোতাম নেই, বেশবাসে বিন্যাস নেই। হয়তো বা অভাবের চেয়েও ঔদাসীন্যই বেশি। সরল-শ্যামলের প্রতিমূর্তি যে গ্রাম তারই পরিবেশ, ব্যক্তিত্বে তার উপস্থিতিতে। কবিতায় জসীমউদ্দীনই প্রথম গ্রামের দিকে সংকেত, তার চাষা-ভূষো, তার খেতখামার, তার নদী-নালার দিকে। তার অসাধারণ সাধারণতার দিকে। যে দুঃখ সর্বহারার হয়েও সর্বময়। যে দৃশ্য অপজাত হয়েও উঁচু জাতের। কোনো কারুকলার 

কৃত্রিমতা নেই, নেই কোন প্রসাধনের পারিপাট্য। একেবারে সোজাসুজি মর্মস্পর্শ করবার আকুলতা। 

বিশিষ্ট ভারততত্ত¡বিদ চেক-পণ্ডিত দুশন জব্ভিতেল জসীম উদ্দীনের কাব্য-আলোচনার ভ‚মিকায় তাঁর প্রেরণা ও ‘কল্পনা-শক্তি’র তিনটি প্রধান উৎসের কথা উল্লেখ করেছেন : ১. বাংলা কাব্যের দীর্ঘ ঐতিহ্য, ২. বাংলা লোকসাহিত্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং লোকসাহিত্য-সংগ্রহের কাজে সম্পৃক্ততা এবং ৩. গ্রামীণ মানুষের প্রতি তাঁর নিবিড় মমত্ব ও সমবেদনাবোধ। (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, কল্লোল যুগ)

লোক কবিতার মধ্যে মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এই ধারাটি বাংলা কবিতার অনন্য সম্পদ। লোক কবিতার এই দুই ধারার কবিতাকেই হার্ডারের অনুসরণে আমাদের ‘জাতির আত্মা’ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। জসীম উদ্দীন পদাবলী সাহিত্য, মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল যেমন নিবিষ্ট চিত্তে পাঠ করেছিলেন, তেমনি বাংলার লোককবিতার ভাব-সম্পদও আত্মস্থ করেছিলেন গভীরভাবে। এবং এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই খুলে যায় তাঁর নিজস্ব কাব্যভুবনের দরজা। 

লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান ‘জসীম উদ্দীন প্রতিভার উৎস অনুসন্ধান’ এই শিরোনামের এক প্রবন্ধে বলেন- ‘পল্লী কবি’ হিসাবে জসীম উদ্দীনকে ঘিরে একটা মিথ তৈরি হয়েছে। এই ‘অভিধা’ বিশাল পল্লীবাংলায় তাঁর বই বিক্রির সহায়ক হয়েছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশ হিসেবী কবি এতে বোধহয় আপত্তি করেননি; কিন্তু তিনি নিজেকে ‘পল্লীকবি’ মনে করতেন এমন মনে হয় না। ‘পল্লীকবি’র অভিধা নিকৃষ্ট কবির নামান্তর তা তিনি বুঝতেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তার ‘লালন ফকির’ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন : “লালনকে হতভাগা পল্লীকবি বলিয়া উপেক্ষা করিলে চলিবে না।” (জসীম উদ্দীনের প্রবন্ধসমূহ, ২য় খণ্ড) 

প্রসঙ্গত সলিমুল্লাহ খান বলেন: গদ্য, কবিতা, গান সব জায়গাতেই তিনি ভদ্রলোকী নিষ্ঠুরতার, প্রাণহীন স্বার্থপরতার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে আমৃত্যু মর্যাদার সঙ্গে লড়াই করেছেন। মাথা নত করতে না জানার অপর নাম তাই জসীম উদ্দীন। 

পৃথিবীর দেশে দেশে এই আধুনিকতার রূপ ভিন্ন ভিন্ন। আধুনিকতা বাংলার নিজস্ব আধুনিকতাকে কেবল বাধাগ্রস্তই করেনি; একেবারে বিস্মৃতির আড়ালে ঢেকে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়াটিই মঞ্চস্থ হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্য তার নিজস্ব ধারাবাহিক অগ্রগতি থেকে সরে গিয়ে ইউরোপীয় ভাবধারায় বিকশিত হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। জসীম উদ্দীন তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং সাহিত্যচিন্তার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের বিচ্ছিন্নতাকে জোড়া লাগাতে চেয়েছেন। কারণ তিনি মনে করতেন পৃথিবীর সব মহৎ সাহিত্যই প্রথমে নিজের ঘরকে আলোকিত করে, তারপর সে আলো ছড়ায় সারাবিশ্বে। 

আধুনিক বাংলা কবিতার ভাবপ্রকাশে ও আঙ্গিকে যাঁরা ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জসীম উদ্দীন। তিনি শুধু গ্রামীণ কবি ছিলেন না, কাহিনী কাব্য, ছন্দ ও গীতিময়তায় তিনি বাংলা কাব্যে নয়া দিগন্তের উন্মোচন করেন। তাঁকে বাদ দিয়ে আধুনিক কবিতার কথা চিন্তা করা যায় না। (সৈয়দ আলী আহসানের ভাষণ ১৯৮০, বই)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আল মাহমুদের একটি বক্তব্য : ‘আমাদের কাছে অবাক লাগলেও এবং তাঁকে যেখানে-সেখানে ‘পল্লীকবি’ বলে গাল পাড়লেও নাগরিক নৈঃসঙ্গ সহ্য করার মত খাঁটি ‘আরবান’ মানসিকতা তাঁর মধ্যে ছিল বলেই পরবর্তী ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশ দশকের ‘আরবান কবিকুলের’ যূথবদ্ধ গ্রাম্য অবজ্ঞাকে তিনি পাত্তা দেন নি। 

সাধারণত আধুনিকতা বলতে যা বুঝায়- সময়ের সঙ্গে মিশে যাওয়া, প্রাসঙ্গিক থাকা, কল্যাণকর কিংবা মানবিক হওয়া। এমন ভাবনায় নিম্নোক্ত কবিতাটিতে চোখ রাখি-

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর, 

আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর। 

যে মোরে করিল পথের বিবাগী-

পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি, 

দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর; 

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর। (প্রতিদান) 

নদীমাতৃক বাংলাদেশের লোকজীবনের রূপায়ক জসীম উদ্দীন। পল্লীবিষয়ক কবিতার রচয়িতা এ কথা সত্য- কিন্তু এই দেশের মা-মাটি-মানুষের প্রকৃতগত জীবন জসীমের হাতে রূপ পেয়েছে অনন্যভাবে। সেই সঙ্গে তাঁর জীবন ও কর্ম আধুনিক সাহিত্যেরই অংশীদার। পল্লী কবি বা আধুনিক কবি- এখানে পল্লীর সঙ্গে আধুনিকের যে সম্পর্ক বা দ্বন্দ্ব নেই তা শতভাবে উঠে আসছে।

জেনে রাখা ভালো আধুনিকতার মূল সূত্র সচেতনতা। এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে জীবনবোধের ক্যানভাস। আর এখানেই জসীমের দুলর্ভ ভাবনার উপস্থাপন এবং তার সৃষ্টি সব সময় মানুষের জন্য, ফলতো চিন্তা করেছে- অসাম্প্রদায়িক। অগ্রজ কবি কালিদাস রায় জসীম উদ্দীন সম্পর্কে বলেন- যতীন্দ্রমোহন ও কুমুদরঞ্জন বঙ্গের পল্লী 

প্রকৃতিকে দেখিয়েছেন হিন্দুর চোখে। শ্রীমান জসীম উদ্দীন বাঙালির চোখে দেখিয়াছেন অথাৎ হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দৃষ্টিতে দেখিয়েছেন।’

আমরা এই পরিচয় বিস্তৃতরূপে দেখি- ‘স্মৃতির পট’ এর নাজীর শীর্ষক রচনাটিতে। এখানে তিনি সাম্প্রদায়িক শান্তি রক্ষার্থে একাই এক বাহিনী। গ্রামীণ অভাব জর্জরিত পরিপ্রেক্ষিতহীন আধুনিক শিক্ষাবঞ্চিত সংসার থেকে আপন প্রতিজ্ঞা, প্রতিভা অথবা স্বপ্ন ও সাধনার বলে কীভাবে সচ্ছল, এমনকি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের সংঘে তিনি প্রবেশ করলেন তার সচিত্র আমাদের চোখে পড়ে। 

প্রসঙ্গত কবি নির্মলেন্দু গুণের জসীম উদ্দীনের জন্মশত বার্ষিকীর স্মারকের দুটি স্মৃতি উল্লেখ করি। একটিতে তিনি পদ্মার এক বৃদ্ধ মাঝিকে স্মরণ করেছেন। পদ্মাপাড় কালে যিনি বলেছিলেন যে, ‘আমি শুনছি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের পর জসীম উদ্দীন শেষ কবি’। অন্যটিতে তিনি তাঁর স্বর্গীয় পিতাকে স্মরণ করেছেন এই বলে যে, ‘পদ্মানদীর সেই মাঝির মতো তিনিও মনে করতেন বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীম উদ্দীন ছাড়া আর কেউ কবি নন। ’

রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মহাশ্বেতা অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু জসীম উদ্দীন যে বাংলাকে লিখেছেন তার স্বাদ ছিল বিরল আত্মজা বৃক্ষের মতো। বাংলার মা মাটির সন্তান জসীম উদ্দীন। লোক ঐতিহ্যের রূপায়নে কবি মানসের পরিপুষ্টি। তৃতীয়মাত্রায় অনুসন্ধান করলে হলফ করে বলা যায়- কবি জসীম উদ্দীন গোটা বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। সময়ের প্রয়োজনে কবি কিংবা বাঙালি জীবনের রূপকার জসীম উদ্দীনকে নিয়ে ভাবনা অত্যন্ত জরুরি। 

লেখক: কবি ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //