নোভি সাদ

সংস্কৃতির শহরে ভালোবাসার আনাগোনা

নোভি সাদে হোটেল পিউফিনের সামনে গাড়ি থামে, নেমে দাঁড়াই। ড্রাইভার পরে কোথায় নিয়ে যে গাড়ি পার্ক করল- চোখেই পড়ল না। ক্রিভো ইশারা করে নিচেই থাকতে বলল। রেস্টুরেন্টের নামও ‘পিউফিন’। রাস্তার এক পাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের সিকিউরিটি টিম।

সবাই দলবদ্ধ হয়ে বিড়ি ফুঁকছে। এমন ঠান্ডা পরিবেশ! এক কাপ চায়ের সঙ্গে একটা বিড়ি যে কত সুখের হতে পারে- অভাগা আমার চেয়ে কে তা আর বুঝবে? ওদের দিকে তাকালাম। সৌজন্যতার হাসি। বেচারা, ভাষার দেয়ালে আবদ্ধ কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। 

নোভি সাদের এই অংশে সব বহুতল ভবন। বড় বড় শপিং মল, বাণিজ্যিক অফিস। লোকজন কম সেই তুলনায়। শহরের মধ্য দিয়ে সড়ক, তাতেও লেন আলাদা করে দেওয়া। হাঁটার জন্য ভিন্ন লেন, পৃথক লেন রয়েছে সাইকেলের জন্যও। পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে শহর। এতটুকু কোথাও ময়লা নেই। লোকজন খাবার শেষে প্যাকেট হাতে নিয়ে ঘুরছে দূরে ডাস্টবিনে ফেলবে বলে। হাড় কাঁপানো শীত। ওভারকোট পরার পরও শরীরে কাঁপন থামে না।

যুগল কপোত-কপোতী হাফ হাতা টি শার্ট- শর্ট প্যান্ট পড়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। কারও পরনে ট্রাউজার আর স্পোর্টস জ্যাকেট। অফিসের লোকজন নরমাল ফরমাল ড্রেসে। তাদের কাছে শীতের কোনো বালাই নেই। 

নোভি সাদ হলো সার্বিয়ার দ্বিতীয় বড় শহর। স্বায়ত্তশাসিত ভোজভোদিনা প্রদেশের রাজধানীও এটি। সার্বিয়ার অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই শহর। বেলগ্রেডের মতো এ শহরটিও গড়ে উঠেছে দানিউব নদীর তীরে। এ শহরের মূল প্রাণ কেন্দ্রে আড়াই লাখের মতো মানুষের বসবাস। শহরটি আরবান এবং প্রশাসনিক- দুটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত। 

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন-ন্যামের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের আমি একজন সদস্য। সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে দেখার আয়োজন। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষাব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে সার্বিয়ার অবস্থান তুলে ধরতেই ঘোরাঘুরির এই কর্মসূচি। ট্যুর গাইড, গাড়ি, নিরাপত্তা- স্বাগতিক সার্বিয়ার ব্যবস্থাপনাতেই সব। আমাদের টিমের সমন্বয়ক দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি মিলিচা ক্রিভোকাপিচ।

আমাদের টিমের বাকি সদস্যদের নিয়ে ক্রিভো গেছেন রেস্টুরেন্টে। তাদের রেখে খানিকক্ষণ পর তিনি ফিরে আসেন। সামনে এসে সিগারেটের প্যাকেট ধরেন। একটা তুলে নেই; কিন্তু আগুন পাবো কোথায়? ভ্যানিটি ব্যাগ রেস্টুরেন্টে রেখে এসেছেন। ব্যাগেই ছিল তার লাইটার। সিকিউরিটির ওদের কাছ থেকে লাইটার নিয়ে এসে বিড়ি ধরান, আমাকেও ধরাতে সহযোগিতা করেন। ওপরের দিকে তাকাই।

‘উঁকিঝুঁকি মারছো কেন?’

‘ম্যাডামরা কি গ্লাস দিয়ে নিচে দেখতে পাবে?’

‘পাবে না মনে হয়। আনইজি ফিল করছ?’

‘আমাদের দেশের সামাজিক রীতিনীতি খানিকটা রক্ষণশীল। বসদের সামনে বিড়ি ধরানোটা সৌজন্যতার বরখেলাপ মনে করা হয়।’

‘ও আচ্ছা। এদিক এসে দাঁড়াও। দেখতে পাবে না।’

‘নোভি সাদে কি প্রায়ই আসো?’

‘প্রায়ই আসি না। অফিসের কাজ পড়লে আসি। শহরটি সুন্দর। আমার পছন্দের।’

‘একদম ছবির মতো। এই শহর না শুধু, পুরো দেশটাই যেন শিল্পীর নিপুণ হাতে তৈরি। এত সৌন্দর্যের মধ্যে তুমিও অনন্য, মনে রাখার মতো সুন্দরী।’

এবার লজ্জা পায় ক্রিভো। মাস্ক না থাকায় স্পষ্ট দেখতে পাই, ধবধবে সাদা গালে লজ্জার লাল আভা। 

নোভি সাদের লিবার্টি স্কয়ারে সিটির প্রথম মেয়র শ্বেতজার মিলেটিকের ভাস্কর্যের সামনে লেখক।

নোভি সাদ জাতিগতভাবে বহুকালের একটি রাজধানী। যেখানে কয়েক শতাব্দী ধরে হাঙ্গেরিয়ান, ক্রোয়াট, স্লোভাক এবং রোমানিয়ান জাতিগোষ্ঠীর লোক মিলেমিশে বাস করছে। বৈচিত্র্যময় এ নগরীতে চালু আছে ছয়টি সরকারি ভাষা। ১৬৯৪ সালের গোড়ার দিকে সার্ব বণিকদের মাধ্যমে গোড়াপত্তন ঘটে এ শহরের। 

পরবর্তী শতাব্দীতে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। অনেকেই এখন নোভি সাদকে ডাকে সার্বিয়ার ‘এথেন্স নগরী’। গ্রিসে এথেন্স যেমন, সার্বিয়াতে নোভি সাদ অনেকটা তাই। ১৮৪৮ সালে বিপ্লবের সময় ব্যাপকভাবে এ শহর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে এটি আবার পুনর্নির্মাণ করা হয়। সেই থেকে বর্তমান অবস্থা একই রকম। 

পেট চোঁ চোঁ করতে শুরু করে। খিদের রাজ্য অস্থির হতে শুরু করে। ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’- সুকান্ত ভট্টাচার্য ঠিকই বলেছিলেন। ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে কোনো সৌন্দর্যই ভালো লাগে না। মানুষ যখন শান্তিতে থাকে, কেবল তখনই সৃজনশীলতার অনুশীলন হয়। সে হয়ে উঠে সৌখিন। রেস্টুরেন্টটি তিনতলা পর্যন্ত। লিফট থাকলেও ক্রিভোর সঙ্গে ভেতরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠি। পিউফিনে খাবার মেন্যু রাশিয়া আর সার্বিয়ান ভাষায়। ছবি দেখে আমি কি বুঝব?

‘তুমি কিছু অর্ডার করো। আমরা আমাদের মেন্যু বলেছি।’

আমাকে বলে ক্রিভো। 

‘আমি কি বলব? ভাষা বুঝি না। ছবিও আমার কাছে স্পষ্ট না। তোমরা যা বলেছ, আমাকেও তাই দিতে বলো।’

‘ওয়াইন আর স্যুপ। তুমি খাবে?’

‘ওয়াইন খাবো না। স্যুপও খাবো না। বরং ক্যাপাচিনো আর পানি দিতে বলো।’

ক্রিভো ওয়েটারকে ডেকে তাই অর্ডার দেয়। খাবার ব্যাপারে একটু সতর্ক। ব্যাঙ, টিকটিকি না অন্য কিছুর স্যুপ বাটি ভর্তি করে দেবে? তার চেয়ে কফিই ভালো। দুধ আর চিনির নিশ্চয়তাটুকু থাকে। কি না কি খাবো, পেট খারাপ হলে ঝামেলা বাড়বে। 

ক্রিভো নোভি সাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলে খানিকক্ষণ। এর পর তার ইন্সট্রাগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সার্বিয়ার তরুণরা ফেসবুক-টুইটারে অভ্যস্ত না। 

১৭ শতকে গোড়াপত্তন ঘটে নোভি সাদের। এই শহরে প্রস্তর যুগের মানুষদের বসবাসের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। সেই হিসেবে এই অঞ্চলটি প্রস্তর যুগের বলেই ধরা হয়েছে। আভিজাতিয়ারস্কো ন্যাসেলজে নতুন বুলেভার্ড নির্মাণ করেন। তার সময়ে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫ হাজার অব্দের বেশ কয়েকটি বসতি আর নেক্রপলিসের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে এখানে। বর্তমান পেত্রোভারাদিনে আর দানিউব নদীর ডান তীরেও ছিল সেই সময়ের বসতি। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটিতে বাস করতো সেল্টিক উপজাতির মানুষেরা। বিশেষত স্কোরডিসি সম্প্রদায়ের মানুষ। দানিউব নদীর ডান তীরে একটি দুর্গও তৈরি করেছিল তারা। পরে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে এই অঞ্চলটির দখল নেয় রোমানরা। তাদের শাসনের সময় ১ম শতাব্দীতে কুসুম নামের একটি সুবিশাল দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। 

রেস্টুরেন্টে খেতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। হোটেল থেকে নেমে আসি। এবার শহর দেখার পালা। দেখতে হবে পায়ে হেঁটে। চৌরাস্তার মোড় পার হই। কারওয়ান বাজার মোড়ের মতো। ইটিভি ভবন থেকে হেঁটে বসুন্ধরা শপিং মলে যাওয়ার পথের সড়ক যেনো। তবে রাস্তা পার হয়েই মেট্রোরেলের আন্ডার সাবওয়ে। আমি ভুল করে সেখানে ঢুঁকে পড়ি। মিনিট তিনেক হেঁটে যাই আনমনে। পরে হুঁশ হয়। তাকিয়ে দেখি আগে পিছে আমার কেউ নাই। রুদ্ধশ^াসে দৌড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠি। হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। মোবাইলে সিম নেই, ইন্টারনেট নেই। হারিয়ে গেলে খুঁজে হয়তো কোনোভাবে পাওয়া যাবে; কিন্তু ভোগান্তির কথা মনে উঠলে গা শিউরে ওঠে। 

‘ইউরোপের সব শহর কি একই রকম দেখতে? লাল, হলুদ, বাদামি, পাটের রঙসহ কত রঙের ভবন। উঁচুতলার ভবন, মাঝারি ভবন, ছোট ভবন। তবে সব শহরে এসব ভবনের গঠন আর আকৃতি প্রায় একই রকম।’

ক্রিভোকে জিজ্ঞেস করি। মাথা নেড়ে সায় দেয় শুধু। অন্য কোনো ভাবনায় ডুবে আছে সে। আমাদের অভিযাত্রিক দলের সামনে গিয়ে ছবি ওঠায়। নিজে নিজে আমরাও ছবি উঠাই। সিকিউরিটির মেয়েটিকে রিকোয়েস্ট করি ছবি তুলে দিতে। সানন্দ্যে রাজি হয়। কতকগুলো ছবিও তুলে দেয়। খুশি হয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি, কোনোটার হাত কাটা, মাথা কেটে গেছে কোনোটাতে। ওর কি দোষ দেবো আর? 

নোভি সাদের এই তানুর্দজিক প্যালেসের সামনে ছবি ওঠানোর লোভ সামলানো কঠিন।

হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি টাউন হল এলাকায়। স্থাপত্যের দিক থেকে নোভি সাদ একটি সাধারণ মধ্য ইউরোপীয় শহর। এ শহরের টাউন হল এবং কোর্ট হাউস নির্মাণ করেন ইমেরিচ কিটজওয়েজার। শুরুতে রোমান নির্মাণশৈলীর ছাপ ছিল শহরের বিভিন্ন স্থাপনায়। অটোম্যান সাম্রাজ্যের আমলে তারাও কিছু কিছু নির্মাণ চিহ্ন রেখে যায়; কিন্তু ১৮৪৮-৪৯ সালের বিপ্লবের সময় শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। পুরনো স্থাপনা-ভবনের অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে। ধসে পড়ে অনেক কিছুই। পরে এ শহর পুনর্নির্মাণ হয় বটে, কিন্তু নির্মাণশৈলীর প্রাচীন সে ধারা আর থাকে নি।

বর্তমানে ১৯ শতকের নির্মাণশৈলী আধিপত্য বিস্তার করছে গোটা নোভি সাদজুড়ে। একটা সময় বহু ছোট ও পুরনো বাড়িঘরে ছেয়ে ছিল পুরো শহর। এখন গড়ে উঠছে আধুনিক, বহুতল ভবন। তারপরও নোভি সাদের মধ্যে এখনো এমন একটা ব্যাপার আছে, যা সহজেই আকৃষ্ট করে। লোকসংখ্যা বা যানবাহন কোনো অংশেই একেবারে কম নয় এ শহরে; কিন্তু পুরো শহর ঘুরে কোথাও কোনো যানজটের চিহ্ন দেখা যায় না। চলাচলের জন্য দারুণ প্রাণবন্ত। 

হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই টিআরজি স্লোবোদে, এটি লিবার্টি স্কয়ার নামেও পরিচিত। ক্রিভোকে আবার পাশে পাই। বেশ গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা বলতে শুরু করে, ‘চারপাশে প্রাচীন আমলের ঘরবাড়ি। ১৮ শতকে তৈরি করা এসব বাড়ি ঘর এখনো জীবন্ত। বড় ধরনের সংস্কার ছাড়াই টিঁকে আছে শত শত বছর ধরে। স্কয়ারের শেষ প্রান্তের ভবনকাল ১৯ ও ২০ শতকের মাঝামাঝি। পর্যটকদের পছন্দের জায়গা এটি। কফি খাওয়া, আড্ডা দেওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যও অনেকের পছন্দ।

নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবসসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদযাপনেও মেতে উঠে লিবার্টি স্কয়ার। স্কয়ারের ঠিক মাঝখানে রয়েছে এই সিটির প্রথম মেয়র শ্বেতজার মিলেটিকের ভাস্কর্য। মার্বেল স্ট্যান্ডে নির্মিত এই ভাস্কর্যের উচ্চতা সাত মিটার। আর পশ্চিম পাশে রয়েছে সুদৃশ্য টাউন হল। এখানে ভোবভোনস্ক ব্যাংক, তানুর্দজিক প্যালেস আর ঐতিহ্যবাহী ভোবভোদিনা হোটেল।’ 

পুরো শহরে পর্যটনের ছাপ। সার্বিয়ান কুটির শিল্পের নানা পণ্যের পসরা রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে। কফি শপের সামনে টেবিলচেয়ার। করোনার প্রভাব কাটেনি তখনো, বাইরের দেশের পর্যটকদের জন্য তখনো রেসট্রিকশন। দোকানপাট আর রাস্তাঘাটে যাদের দেখছি, তারা সবাই স্থানীয়। ছোটখাটো জিনিসপত্রগুলো দেখতে সুন্দর। দোকানে গেলে মিষ্টি হেসে অভ্যর্থনা জানান দোকানিরা। জোরাজুরি-টানাটানি নেই। সামনে পড়ে লাল একটি ভবন। সবাই দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দেই। দৌড়ে ভবনের আরো কাছে যাই, নেমপ্লেট খোঁজার চেষ্টা করি। কোনো নামই ছিল না, নেই সাইনবোর্ড। পরে গুগলে ছবি পেস্ট করে জেনেছিলাম এর নাম ম্যারি চার্চ বা একা দ্য ক্যাথেড্রাল। যার নির্মাণ সময় ১৮৯৪ সালে। 

শহরটিতে বেশ কয়েকটি জাদুঘর এবং গ্যালারি রয়েছে। বেশিরভাগ জাদুঘর সবার জন্য খোলা থাকে, দেখা যায় বিনা টিকিটে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কিছু গ্যালারিও রয়েছে। গ্যালারি অব ফাইন আর্টস আরেকটি দেখার মতো জাদুঘর। নোভি সাদে ঘুরতে আসলে পর্যটকরা রাজকো মামুজিয়াসের উপহার সংগ্রহ আর দ্য পাভেল বেলজানস্কি মেমোরিয়াল সংগ্রহ জাদুঘরও ঘুরে যেতে ভুল করেন না।

ক্রিভো একবার বলেছিল নোভি সাদের যাদুঘর দেখবো। সেটা কখন, তা জানিতে পারি নি। হাঁটাচলার এই রুটিনেই চলে আসি বিশাল আরেক ভবনের সামনে। ভবনের বিশাল আকারের তুলনায় দরজাটি বেশ ছোট। গেটে সার্বিয়ার পতাকা টানানো। গেট দিয়ে ঢুঁকে রিসিপশন। সেখানে ভবনটির নাম লেখা, ‘ভোজভোদিনার জাদুঘর’। রিসিপশনের সেলফে থাকে থাকে সাজানো ব্রুশিয়ার। নয়নাভিরাম

প্রকৃতি, নান্দনিক স্থাপনার ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে ব্রুশিয়ার আর লিফলেট। লক্ষ্য পর্যটক আকর্ষণ; কিন্তু সবই সার্বিয়ান ভাষায়। সব হাতড়াতে থাকি, উল্টাপাল্টা করি সব। ইংরেজি ভাষায় যদি একটাও খুঁজে পাই। একটু হন্তদন্ত ভাব মনে হয় চেহারায় ফুটে উঠে। রিসিপনশন ডেস্কে কেউ নেই। এক বয়স্ক ভদ্রলোক বের হচ্ছিলেন, এগিয়ে এলেন। ইংরেজিতে কথা শুরু করলেন।

‘কি খুঁজছ?

‘এখানে এতগুলো ব্রুশিয়ার ও লিফলেট। সুন্দর আর তথ্যনির্ভর। ইংরেজি ভাষায় না হলে এগুলো পড়তে পারবো না।’

‘সার্বিয়াতে, বিশেষ করে নোভি সাদে প্রচুর রাশিয়ান পর্যটক আসেন। তাদের জন্য রাশিয়ান ভাষায় এগুলো তৈরি করা। সঙ্গে সার্বিয়ান ভাষাও দেওয়া আছে। তবে কিছু ইংরেজি লিফলেট থাকার কথা।’

তিনিও আমার মতো করে হাতড়াতে লাগলেন। খুঁজে পেলেন না। আমাকে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেলেন। রিসিপশনিস্টকে খুঁজে নিয়ে এলেন। ভদ্রমহিলা রিসিপশনিস্ট আমাকে বার কয়েক স্যরি বললেন। ভেতর থেকে একগাদা লিফলেট আর ব্রুশিয়ার এনে রাখলেন সেলফের থাকে। এগুলো সব ইংরেজি ভাষায়। কয়েকটি তুলে নিলাম। তিনি পর্যটন করপোরেশনের বিশেষ ম্যাগাজিনটাও দিলেন। 

ভদ্রলোকের সঙ্গে পরের কথোপকথন,

‘কি কর, কোন দেশ থেকে এসেছ’

বাংলাদেশের কথা বললাম। পরিচয় দিলাম।

‘ইন্ডিয়ার পাশের দেশটা না?’

‘হ্যাঁ, তুমি গিয়েছো?’

‘একবার গিয়েছিলাম। সে সময়ে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক ফান্ড নিয়ে কাজ করতাম। তাও তো ৩০ বছর আগের কথা।’

প্রাথমিক পরিচয়ের আরো ক’টা বাক্যের পর তিনি বিদায় নিলেন। পড়লাম আরেক ফ্যাসাদে। আমাদের টিমের সদস্যরা কোথায় চলে গেলেন, কোন দরজা দিয়ে ঢুঁকলেন- খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। হারিয়ে যাবার ভয় ছিল না যদিও। রিসিপশনিস্ট মেয়েটার চোখ কম্পিউটারের স্ক্রিনে। তার হেল্প চাইলাম। তিনি আমায় নিয়ে দোতলায় গেলেন। টিমের বাকি সদস্যদের জাদুঘর দর্শন ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। 

জাদুঘর আমাকে খুব একটা টানে না। আমাদের সময়ে জাহাঙ্গীরনগরের পুরাতন কলাভবনের কথা আজও মনে আছে। বারান্দা, ক্লাস রুম, বিভাগের বাইরে খোলা জায়গায় রাখা হাড়গোর, মাথার খুলি, হাঁড়িপাতিল, আরো কত কি! মনে হয় পুরাতন সব জিনিষপত্রের সংরক্ষণ। প্রত্নতত্ত্বের বন্ধুদের জ্ঞানগর্ভ বাণী মনে পড়ে এখানে এসে,

‘একটি জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিল্পকর্মের নির্দশন শোভা পায় জাদুঘরে। সেখানে থাকে দেশের ইতিহাসের বিবর্তনের জিনিসপত্র। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, শৈল্পিক, সামরিক ও ঐতিহাসিক মূল্যবান জিনিসপত্র যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হারিয়ে যাওয়া ও দুর্লভ এসব জিনিসপত্র। এগুলো সাধারণ মানুষ, পর্যটক, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য প্রদর্শন করা হয়। একটি জাদুঘর যেনো হাজার বছরের পুরনো মানবসভ্যতার বিবর্তন তুলে ধরে, নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেয় ফেলে আসা দিনের স্বরূপ।’ 

বিশাল জাদুঘর। গাইড এক রুম থেকে অন্য রুমে যান। ভদ্র শিক্ষার্থীর মতো মনোযোগ দিয়ে গাইডের বকবকানি শুনতে হয়। মাথা নেড়ে হু হা করতে হয়। বোঝাতে হয়, ‘সব জেনেছি, সব বুঝেছি।’ করোনার প্রভাবে বিদেশি পর্যটক নাই বললেই চলে। স্থানীয়দেরই এক-দুজন করে ঘুরে দেখছেন। 

সার্বিয়ান শিল্পীর আঁকা ছবির সামনে নারী দর্শনার্থী। গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবির পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত। চেহারা দেখে সার্বিয়ানই মনে হলো। এগিয়ে যাই।

‘হ্যালো। ’

‘হাই।’

উন্নত দেশগুলোর অধিবাসীদের এই আচরণটা বেশ ভালো লাগে। কাউকে হ্যালো বললে সঙ্গে সঙ্গেই হাই বলে প্রতিউত্তর দেবে।

‘আমি ইমদাদ। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’

‘নাইস টু মিট ইউ। আমি ভেরা ল্যাপাইন। এসেছি রাশিয়া থেকে।’

‘তোমার চেহারা দেখে সার্বিয়ান ভেবেছি।’

এভাবে কথা এগোয়। উচ্ছল তরুণী। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্স ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন ইনফরমেটিক্স সায়েন্সে। ঘুরে বেড়ানো তার শখ। কোভিডের বিধিনিষেধ তার ভ্রমণযাত্রা আটকাতে পারেনি। এ পর্যন্ত ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার ২৬টি দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন।

‘আহা, এমন একটি ভ্রমণসঙ্গী যদি ভাগ্যে জুটতো, সাইবেরিয়ার বরফপ্রান্তেও না হয় থেকে আসতাম কদিন।’ 

তারে বলি, 

‘চলো ঘুরে দেখি জাদুঘরটি।’

বিনয়ের সঙ্গে সে না করে দেয়। বলে, 

‘বেশ আগে এসেছি। হোটেলে ফেরার সময় হয়ে গেছে।’

তার না আছে কোনো মোবাইল, না কোনো নোটবুক। আমার ভিজিটিং কার্ডটাই বের করে দেই। কথা দেয়, ইমেইল করে জানাবে তার ভ্রমণ বৃত্তান্ত। সুন্দরী এই কিশোরীর ইমেইলের অপেক্ষা করি আজও। 

হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস জীবন্ত করে তুলে ধরে নোভি সাদ জাদুঘরের একেকটি নিদর্শন।

ঢাকায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে মানচিত্র রুমের ডান পাশ থেকে গ্যালারি পরিদর্শন শুরু করলে এমন চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। একের পর এক গ্যালারিতে সাজানো বাংলাদেশের বিভিন্ন ফুল, ফল, পাখি, পশু, নৌকা, মাছ, গাছ, খাদ্যশস্য। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রকৃতির পুরো চিত্র ফুটে ওঠে। অন্যান্য গ্যালারিতে সাজানো সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, মনিপুরি, গারোদের নিজ হাতে তৈরি পোশাক, অলংকার ও গৃহস্থালী সামগ্রীর সংগ্রহ। রয়েছে মাটি, সিরামিক ও কাচের তৈরি জিনিস, জামদানি, নকশীকাঁথা, হাতপাখা ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ। প্রাচীনকালের মানুষদের ব্যবহৃত পালঙ্ক, পালকি, সিন্দুক, দরজা ও সিঁড়ির অংশ, হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার, পাটি, শো-পিস রয়েছে বিভিন্ন থাকে সাজানো। বাংলাদেশের গৌরবময় ঘটনা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন গ্যালারিটি বেশ তথ্যবহুল। প্রথম তৈরি শহীদ মিনারের ভাঙা অংশ, ভাষা শহীদদের রক্তে ভেজা পোশাক, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের ভাঙ্গা টুকরা, বোমা, নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলি, সেই সময়ের দৈনিক পত্রিকার পাতা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় ব্যবহৃত টেবিল- যা দেখে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সহজেই স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়। একইভাবে ভোজভোদিনার জাদুঘরে রয়েছে সার্বিয়ান ইতিহাসের ধারাক্রম আর আগের পুরাকীর্তি, শৈল্পিক নিদর্শনসহ আরো অনেক কিছু। মনোযোগ দিয়ে দেখার ধৈর্য্য ছিল না। যাই দেখি, তাতেই সার্বিয়ান ইতিহাস- ঐতিহ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। 

একা হেঁটে ঢুঁকে পড়ি আরেকটি কক্ষে। কয়েক শতক আগে সার্বিয়ার ঘরবাড়ি সাজানো কক্ষটি। আমাদের গ্রাম এলাকায় অবস্থাপন্ন লোকদের বাড়ির মতো। যদিও বাংলাদেশেও পাল্টে যাওয়ার গতিটা বেশ দ্রুত। এই তো, কয়েক বছর আগের কথা। গ্রামের ধনীদের বাড়ি বলতে বোঝানো হতো, চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পাকা বাড়ি। ইটের দেয়াল, উপরে টিনের ছাউনি। কারও বাড়িতে প্লাস্টারে সবুজ বা সাদা রঙের আবরণ। বাড়ির ভেতরে বিশাল উঠোন, আর বাইরে টঙ ঘর।

অতিথিদের জন্য রাখা ঘরকে বলা হতো টঙ ঘর। বাড়ির পাশে বিশাল পুকুর। পাশে গোয়াল ভর্তি গরু, গোয়ালের দেয়ালে ঝুলানো হাল চাষের লাঙল। বাড়ির পাশে সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন, সঙ্গে পেয়ারা বা লেবুর বড় বাগান। পেঁপে, জাম্বুরার বাগান তো ছিলই। বাংলাদেশের গ্রামীণ পুরনো এই চিত্রই যেন সার্বিয়ার বুকে ছিল কয়েক শতক আগে। এমন চিত্র দেখেছিলাম রোমানিয়াতেও। সংস্কৃতি, সামাজিক অবকাঠামোর ধরণ বা রীতিনীতি- হয়তো সময়ের সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে স্থানান্তরিত হয়েছে দেশে দেশে।

নির্জন এই কক্ষে ভাবনার ধ্যানে আচ্ছন্ন ছিলাম কি না- ধরাস করে দরজা ঠেলার শব্দে হুঁশ ফিরে। পেছনে ফিরে তাকাই। ক্রিভোর উদ্বেগ ভরা চাহনি, ‘তুমি এখানে কি করছ? তোমাকে খুঁজে মরছি। এই ঘর থেকে ওই ঘর, কোথাও তুমি নেই!’

ওর এই অস্থিরতা আমার ভালো লাগে। চোখে চোখ রাখি। তাকিয়ে থাকি। নীরবতারও তো একটা অর্থ আছে। ক্রিভো কি বুঝে সেটা?

‘এসো, আমাদের বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে।’

‘থামো কিছুক্ষণ। কদিনের বা ট্যুর! চলেই যাবো। তখন তো চাইলেও দেখা হবে না।’

‘জ্বি না জনাব, পৃথিবীটা গোল। তোমার দেশ আর আমার দেশ- বিশ্ব মানচিত্রে স্পষ্ট করে সাজানো। দেখা হওয়ার ঢের সম্ভাবনা আছে। আর, প্রযুক্তি আমাদের জীবনটা কত সহজ করে দিয়েছে। চাইলেও দেখা যায়।’

‘প্রযুক্তির আধুনিকতার সঙ্গে কৃত্রিমতারও প্রভাব স্পষ্ট। সেটা রোবটের মতো। ফল বয়ে আনে অনুভূতি ছাড়া।’

আমার দিকে এবার তাকায় ক্রিভো। মাস্কটা খুলে হাতে নেয়। সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার চোখে মুখে তার নিঃশ্বাসের বাতাস। হৃৎপিন্ডের গতিটা বাড়তে থাকে। তার চোখে চোখ রাখতে আমাকে ঘাড়টা বাঁকা করতে হয়। মানুষ এত লম্বা হয় না কি! সে বলে,

‘এতটুকু বলি শুধু, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার।’

ক্রিভোর এই আত্মবিশ্বাসটুকু আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ভালো লাগে। তার বিশাল হাতের মুঠোয় আমার আঙুলগুলো ছোট হয়ে পড়ে, বাচ্চাদের মতো। জাদুঘর দর্শনের সঙ্গে রোমান্সের খানিকটা স্মৃতি যুক্ত হয়। দেখতে থাকি ক্রিভোকে, অনুভব করি অন্য এক ক্রিভো, প্রটোকলের আবরণ ছাড়িয়ে রোমান্সে ভরপুর এক কিশোরীকে। টের পাই হৃদয়ের আকুলতা। 

ছবি: লেখক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //