ভূস্বর্গে যাওয়া-আসা

উপমহাদেশে ভূস্বর্গ বলে আখ্যায়িত কাশ্মীর রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী জম্মুতে নামলাম ১০ এপ্রিল। স্টেশনের নাম জম্মু তাওয়াই। স্থানীয়রা উচ্চারণ করে জম্মু তাবী। শ্রীনগর এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং জম্মু শীতকালীন রাজধানী। তাওয়াই ও চন্দ্রভাগা নদী জম্মু শহরকে ঘিরে বয়ে চলেছে। তবে তাওয়াই নদীর নাম যুক্ত করেই স্টেশনের নাম রাখা হয়েছে জম্মু তাওয়াই বা জম্মুতাবী। বেশ বড় স্টেশন। 

নিউদিল্লি থেকে গত রাতে উঠেছিলাম ঝেলাম এক্সপ্রেসে রাত সাড়ে ৮টায়, জম্মুতে পৌঁছলাম দুপুরে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে অবাক হলাম, প্ল্যাটফর্ম প্রায় তিনতলা দালানের সমান উঁচুতে। গাড়ি থেকে নামার সময় সেটা বোঝা যায়নি। 

বাসস্ট্যান্ডে খোঁজ নিয়ে যা জানতে পারলাম তাতে আক্কেল গুড়ুম! আজ আর বাস নেই। জম্মু-শ্রীনগর রোড ওয়ান ওয়ে, একদিন যাওয়া পরদিন আসার। আজ শ্রীনগর থেকে আসার জন্য নির্ধারিত। রোদ মাথায় নিয়ে ফাঁকা বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে এলাম স্টেশনে। কলকাতায় ফেরার টিকিট রিজার্ভেশনের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। সুবিধাজনক গাড়ির নাম হিমগিরি। সুপার ফার্স্ট ট্রেন। ২০২১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় নেয় ৩৬ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটি। সপ্তাহে তিন দিন যায়। শঙ্কা আর সন্দেহ নিয়ে কিউ-এর শেষে দাঁড়ালেও নিজের পালা এলে নির্দিষ্ট দিনের রিজার্ভেশন এবং টিকিট পেয়ে যাই। 

শিয়ালকোট জম্মু রেলপথের প্রথম দিনের ট্রেন।

এবারে বসন্তকালেও কাশ্মীরের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ, তাই টিকিট পাওয়া গেল। নচেৎ এখন এই টুরিস্ট মৌসুমে তিন-চার দিনের ব্যবধানে অগ্রিম টিকিট পাওয়া অকল্পনীয়। একমাস-দেড়মাস আগেও টিকিট বুক হয়ে যায় টুরিস্ট মৌসুমে। প্রার্থিত টিকিটের ট্রেন ছাড়বে ১৬ তারিখ রাত ১০টা পঁয়তাল্লিশে। যাওয়া-আসার দু’দিন পথ খরচ বাদ দিলে হাতে থাকল মাত্র চার দিন শ্রীনগর ও আশপাশে ঘোরার জন্য। 

আজ আর যাওয়া যাবে না দেখে ভাবলাম এগিয়ে থাকি কিছু পথ। স্টেশন থেকে শহর জম্মু পাঁচ কিলোমিটার। ম্যাটাডোরে (মিনিবাস) শহরে যাই, শহরের পুরনো বাস স্টেশন থেকে উধমপুরের বাস ধরতে হবে। শহরে ঢুকতে গাছপালার ওপর দিয়ে উঁকি দিল টিলার ওপরের এক রাজবাড়ী, ছবি দেখা ছিল, তাই চকিতে দেখেও চিনতে পারলাম ‘মুবারকমান্ডি’। 

শিয়ালকোট জম্মু রেললাইনের শেষ স্টেশন জম্মু শহরের বিক্রমচক স্টেশন (বর্তমানে নেই)।

ডোগরা রাজবংশের মহারাজাদের রাজপ্রাসাদ। এই রাজবংশের নয় শতকের এক রাজার নাম ছিল জাম্বুলোচন, তার নামেই নাকি রাজ্যের নাম হয় জম্মু। 

দিনের শেষ বাসের সর্বশেষ টিকিট কেটে আসন নিতেই ছেড়ে দিল উধমপুরগামী বাস। দুপুরের খাওয়া হয়নি। বাইরে কড়া রোদ। খুব গরম। লোকাল বাসে সবাই ভারতীয়, অধিকাংশ স্থানীয়। একমাত্র আমি বাংলাদেশের। শহর পেরুতে বোঝা গেল জম্মু শহরে যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার ফুট উঁচুতে তা খুবই সত্য। 

পাহাড়ের গা-ঘেঁষে রাস্তা। ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে নিচে নামছে। উধমপুর ৬৬ কি.মি. ২-ঘণ্টায় পৌঁছাবার কথা। ভেবেছিলাম সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাব। সারা শহরটায় এক চক্কর মেরে দেখে নেব একটা নতুন পাহাড়ি শহর; কিন্তু হলো না। অর্ধেক পথ পেরুতে আকাশ অন্ধকার করে মেঘে ছেয়ে গেল। নামল মুষলধারে বৃষ্টি। বাস থামল না। তবে গতি হ্রাস পেল। স্নানহীন দিন-রত্রির যাত্রায় রুক্ষতা পাহাড়ি বৃষ্টিতে স্নিগ্ধ হলো। হাত বের করে ভিজিয়ে ভেজা হাত চোখে-মুখে বুলোলাম। তাই দেখে একজন পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, 

আপ বাঙালি হ্যায়!

হ্যাঁ। 

ক্যালকাত্তা?

নেহি। বাংলাদেশ। 

বানিহাল জওহর টানেলের প্রবেশ মুখ।

মৌনতা ভেঙে আলাপ শুরু হলো। আমি একা, এই প্রথম এবং লোকাল বাস, সব শুনে সহযাত্রীরা জানালেন আমি ভুল করেছি এভাবে পথ ভেঙে যাত্রা করে। কারণ টুরিস্ট বাস সরাসরি জম্মু-শ্রীনগর যায়। উধমপুরে থামে না। থামলেও যাত্রী নেয় না ভর্তি থাকে বলে। উধমপুর থেকে শ্রীনগর যেতে ২-৩ দিন লেগে যেতে পারে আমার। সব শুনে বুঝলাম আমি ভুল করেছি। 

উধমপুরে নামলাম দুশ্চিন্তা এবং বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। মেঘলা এবং বাদলা বলে লোক খুব কম। পাহাড়ি শহর। টিলার ওপর বাজার ও শহর। খোঁজ করে কাছেই এক সিনেমা হলের পাশে হোটেল পেলাম। নিচে কাপড়ের দোকান। সরু সিঁড়ি ভেঙে তিন তলায় আশ্রয় মিলল। সারা হোটেলে আর কোনো বোর্ডার আছে বলে মনে হলো না।

ডাবল বেডের কামরা। অচেনা জায়গা, তার ওপর নির্জন। ভয় ভয় করছে টের পেয়ে হোটেল বয় আমার নাম জিজ্ঞেস করল। শুনে বুঝল আমি মুসলমান, সে তার নাম খুরশিদ জানিয়ে আস্বস্ত করল, কোই ডর নেহি। জানা গেল মালিক হিন্দু, সাতচল্লিশে পাকিস্তান থেকে এসে বসত বেঁধেছে এখানে। 

চা চাইলে বলল, নিচে যেতে হবে। অগত্যা খুরশিদকে সঙ্গে করে নেমে তার দেখানো রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে ওপরে উঠলাম। ভোরে উঠে দেখি আকাশ একই রকম মেঘলা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সঙ্গে হাড়কাঁপানো শীত। মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে পুরো শীতের পোশাকে। রেইন কোট গায়ে বা ছাতা মাথায় দিয়ে। বোঝা গেল মর্নিং স্কুল আছে। বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি শ্রীনগর ডাইরেক্ট বাস আছে একটা। এখুনি ছাড়বে। তবে টিকিট নেই। আজকে আর বাস নেই। আগামী কালওনা।

জওহর টানেল থেকে বের হয়ে দেখা যায় এমনই মনোহর দৃশ্য।

পরশু বাস আছে তবে টিকিট শেষ। খবরগুলো পথে বসিয়ে দেওয়ার মতো; কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। টিকিট ঘরের ভেতর যেয়ে বাংলাদেশের টুরিস্ট পরিচয় দিয়ে অনুরোধ জানাই কোনোভাবে একটা ব্যবস্থা করতে। সিট না হলেও চলবে আমার টুরিস্ট ব্যাগের ওপর বসে যাব। অসহায় অবস্থা দেখে এক কেরানি বাবুর দয়া হলো। সঙ্গে করে বাসের কাছে নিয়ে কন্ডাক্টারকে কাশ্মীরি ভাষায় বোঝাল। কন্ডাক্টার প্রথমে না বললেও পরে হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় বলল, চার নম্বর সিটমে বইঠিয়ে। 

একেই বলে ভাগ্য। যেখানে দাঁড়াবার স্থান হচ্ছে না সেখানে ড্রাইভারের পেছনের সিট। পাশে এক কাশ্মীরি মহিলা। বোরকা এবং হিজাবের ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যায় তাতেই বোঝা যায় কমবয়সি কাশ্মীরি সুন্দরী। একটা দোমড়ান টিকিট দিয়ে টাকা নিল কন্ডাক্টার, নিশ্চিন্ত হয়ে আসনে বসলাম। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘ কেটে রোদ উঠল। আমার মনের মেঘও। রোদ উঠলে চারদিকের পাহাড়ের অবস্থান ও উচ্চতা দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। কাছে ও দূরে বিভিন্ন উচ্চতার পাহাড়। জম্মু থেকে উধমপুরের উচ্চতা ১২৪৮ ফুট বেশি। উত্তর-পশ্চিম ভারতে সেনাবাহিনীর বড় ঘাট এখানে। ক্যান্টনমেন্ট আছে। কারণ কাশ্মীরের মুসলমান এবং সীমান্তের ওপারে চীন। বিমান বাহিনীর স্টেশনও আছে এখানে। 

বাস ছাড়লেও শহর থেকে বেরুবার মুখে থেমে গেল। দেরি দেখে জিজ্ঞেস করে জানা গেল সামনে থেকে মিলিটারি কনভয় আসছে। তারা না ক্রস করা পর্যন্ত বাস যাবে না। জম্মু-শ্রীনগর পাহাড়ি পথ এবং ওয়ানওয়ে। যাওয়া এবং আসা পূর্ব থেকে নির্ধারিত। যানবাহন চলাচলে এই নিয়ম। এর ওপর রয়েছে জরুরি সামরিক কনভয়ের অগ্রাধিকার মুভমেন্ট। জম্মু থেকে শ্রীনগর ৩০৫ কিলোমিটারের পুরোটাই সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কিছু দূরে দূরে চেকপোস্ট। পরবর্তী চেকপোস্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া পর্যন্ত এগোবার অনুমতি পাওয়া যায় না। 

জম্মু-শ্রীনগর সড়কপথের ম্যাপ 

প্রায় দু’ঘণ্টা দেরি করে বাস ছাড়ল। এটা লোকাল বাস। অধিকাংশ যাত্রী কাশ্মীরি নারী-পুরুষ। আমি একা এবং বাংলাদেশের জেনে আশপাশের অনেকেই কৌতূহলি প্রশ্নবাণে ছেকে ধরল আমাকে। যারা প্রশ্ন করল না তারা সকৌতুক ঔৎসুক্যে শুনতে লাগল আমাদের কথোপকথন। বেশির ভাগ প্রশ্ন রাজনীতি-অর্থনীতি এবং প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে।

হাতের ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি ও কাঁধের জাপানি ক্যামেরাও তাদের কৌত‚হলী প্রশ্ন থেকে বাদ গেল না। উত্তর দেওয়ার সময় খেয়াল রাখতে হচ্ছিল মতামত আমার বা ব্যক্তিগত হলে চলবে না। এক বাস বিদেশি যাত্রীদের মাঝে আমি দেশের বেসরকারি প্রতিনিধিও বটে। তাদের প্রশ্নে এবং ধারণায় বোঝা গেল বিভিন্ন নিউজ এজেন্সির বদৌলতে তারা পায় সত্যের সঙ্গে রঙ ফলানো খবর।

প্রশ্নের গতি কমাতে আমিও পাল্টা প্রশ্ন করি। আব্দুল্লাহপুত্র আব্দুল্লাহ (ড. ফারুক আব্দুল্লাহ) কেমন? কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সম্পর্ক এবং কাশ্মীর কি স্বায়ত্তশাসন পাবে? তাদের প্রশ্নের পাশাপাশি আমার পাল্টা প্রশ্নে তারা বিব্রত বোধ করে। প্রশ্ন কমে যায়, আলাপের মোড় ঘুরে আসে। বিষয়বস্তু হয় ব্যক্তিগত। আমার গায়ে জিন্সের হাফশার্ট দেখে সহযাত্রী অনেকেই খোঁজ নিল বাড়তি শীত পোশাক সঙ্গে আছে কি-না।

নেই শুনে সমবেদনা জানিয়ে বলল, শ্রীনগরে পৌঁছতে পৌঁছতে আপনার হালতো কাহিল হয়ে যাবে। কাশ্মীরের ঠান্ডা খুব খারাপ জিনিস। একবার চেপে বসলে শয্যাশায়ী করে ফেলবে, সহজে উঠতে দেবে না। এমন কি জীবন নিয়ে ফেরাও মুশকিল হতে পারে। পরে গাইড বইয়ে দেখেছি শ্রীনগরের উষ্ণতা গ্রীষ্মকালে ১৮ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এবারে এই এপ্রিলে সেখানে শীতকালের আবহাওয়া, তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির আশপাশে। 

জওহর টানেল রাস্তা।

একে একে পেরুলাম আরও কিছু পহাড়িপথ। বাস চলছে পাহাড়ের কোমর সমান উচ্চতায়, বামে পাহাড়, ডানে গিরিখাত। অনেক নিচে সরু নদী। আঁকাবাঁকা রাস্তা। আমি এপথে নতুন, ডানে নিচে তাকালে ভয় ধরে। দুর্বল হার্টের যাত্রীরা এমন পথে যাত্রা করতে পারবে না। 

আমার পাশের কাশ্মীরি মহিলার সঙ্গে কথা বলতে যেয়ে সাড়া পাইনি। চেষ্টা করা শোভন হবে না বিবেচনায় বিরত থেকেছি। পেছন এবং আশপাশে থেকে প্রশ্ন বন্ধ হয়েছে। আমার দৃষ্টি সামনের দিকে। 

লক্ষ্য করি সামনের বাস ঊর্ধ্বমুখী, এক সময় সামনের বাস উধাও হয়ে যায় মেঘের ভেতর এবং কিছু পরে আমাদের বাসও আস্তে আস্তে ঢুকে গেল মেঘের রাজত্বে। খোলা জানালা দিয়ে দুষ্টু ছেলের মতো মেঘ ঢুকে গায়ের জামা আর্দ্র করে ফেলল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সামনে পাটনিটপ, উচ্চতা ৬৬৪০ ফুট। অল্পক্ষণ পরেই বাস যেয়ে দাঁড়াল একটা পাহাড়ের ঢালে সমতলে। সেখানে আরও কিছু বাস দাঁড়িয়ে।

কাছে ও দূরে পাইন, ওক ও দেবদারু গাছের ডালে আটকে রয়েছে পেঁজা বরফ, বেশি বরফ জমলে নিচে ঝরে পড়বে। গাছের ডাল স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে ফিরে যায় স্বস্থানে। এই জন্য শীতপ্রধান দেশের গাছের কাণ্ড ধনুকের মতো বাঁকা। বরফ ঝরে পড়লে আবার জমতে শুরু করবে তুষার। আকাশমুখী বৃক্ষ মিশেছে মেঘে। নিচে সাদা বরফের চাদর। এখানেই আছে একটা পার্ক তা আর বোঝার উপায় নেই, হারিয়ে গেছে পুরু বরফের নিচে। পেছনে অনেক দূরে বরফে ঢাকা সুউচ্চ পর্বতমালা, নাম পীর পাঞ্জাল। হিমাচল প্রদেশ থেকে আজাদ কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত। অনেক নিচে বয়ে যাচ্ছে চেনাব নদী। 

এখানে বাস থেমেছিল চা বিরতির জন্য, পাহাড়ের ঢালের অস্থায়ী দোকানে স্ন্যাক্সসহ কফি খেয়ে বাসে উঠলাম। কিছুদূর যেয়ে কুদ নামের ছোট একটা জনপদে থামল। এখানকার খাঁটি ঘিয়েভাজা শন পাপড়ি, চকলেট ও কালাকাদের নামের মিষ্টির সুনাম আছে। শন পাপড়ি আমার প্রিয়, তাই সিটে বসেই কিনে মুখে দেওয়ার আগে সহযাত্রীর দিকে তাকালাম। তাকে একইভাবে সামনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখে ‘লিজিয়ে’ বলার সাহস হলো না। 

আরও কিছু পথ যেতে পথ আড়াল করে দাঁড়াল এক পাহাড়, বুঝলাম বানিহালপাস এসে গেছি। পথরোধ করে দাঁড়িয়ে পীর পাঞ্জাল পাহাড় যা পার্বত্যময় জম্মু রাজ্যকে ওপাশের পাহাড়ি উপত্যকার সমতল ভূমির কাশ্মীর রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। পাহাড়ের পেট ফুড়ে তৈরি ২.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এক টানেল, নাম জওহর টানেলে বাস ঢুকল আর্মি চেকিংয়ের পর।

প্রবেশ মুখের দিক বানিহাল এবং অন্য প্রান্তে কাজিগুণ্ড। ২২ ডিসেম্বর ১৯৫৬ সালে চালু হওয়া এই টানেলের উচ্চতা ১৬.৫ ফুট ও প্রস্থে ১৮ ফুট এবং ৯৭৬৩ ফুট উঁচু পীর পাঞ্জাল পাহাড়ের পেট ফুঁড়ে করা কংক্রিটের সুরঙ্গ। বাস ঢুকে গেল সেই সুরঙ্গে, সামনে অন্ধকার। মাথার ওপর হ্যালোজেনের হলুদ আলো। গমগম করা শব্দে গা ছমছম করে উঠল। এই সময় আমার পার্শ্ববর্তিনী আমার হাতে গুজে দিল একটা পাকা কলা। খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালে কি বলল বুঝলাম না, তবে ইশারায় খেতে জানাল।

বাঁয়ে বানিহাল জওহর টানেলের প্রবেশমুখ ও ডানে টানেলের ভেতরের দৃশ্য। প্রায় তিন কিলোমিটারের দীর্ঘ টানেল। একসময় সামনে একটা আলোর বিন্দু ফুটে উঠল, ক্রমেই বড় হতে লাগল। বুঝলাম সুড়ঙ্গের মুখের আলো। 

জওহর টানেল পার হতে চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো কাশ্মীর উপত্যকা। বাঁয়ে পাহাড়ের গায়ে লেখা সুন্দর সুন্দর সতর্কবাণী 

যেমন:

1. Beackon, stop and enjoy first view of Kashmir vally.

2. If you are married divorce speed & enjoy Kashmir valley.

3. Darling don`t nag while I`m turning.

4. It`s not a race nor a rally, drive slow and enjoy Kashmir vally.

কাশ্মীর উপত্যকার সমভ‚মি দিয়ে যেতে পেলাম প্রাকৃতিক এক টানেল, সবুজ টানেল। প্রায় তিন মাইল দীর্ঘ রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ উইলো গাছ। আকাশমুখী গাছের সবুজ পাতার ঠাসবুনোট মাথার ওপর আকাশকে ঢেকে এই পথটুকুকে এক মনোহর প্রাকৃতিক টানেলে রূপ দিয়েছে। বাকি পথটা প্রায় সমতলভূমি। সারাদিনের বাসযাত্রার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল যাত্রীদের কলরবে। তাকিয়ে দেখি ডানে একটা পাহাড়, পরদিন নাম জেনেছি, হরি পর্বত। ডানে উজ্জ্বল আলো। বুঝলাম এসে গেছি স্বপ্নের শ্রীনগর, ভূস্বর্গ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে। 

সাত হাজার ফুট উঁচু পাটনিটপে প্রচুর বরফের দেখা পেয়ে ছোট বড় সবাই মেতে ওঠে বরফ নিয়ে খেলায়।

এটা লোকাল পাবলিক বাস, তাই থামল মাঝ শহরের এক বাজারের পাশে। আসতে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছিল তাদেরই কেউ একজন বলল লালখান বাজার, এখানেই নামতে হবে। আমার পাশের মহিলাকে নিতে এসেছে তার বাড়ির লোক, দ্রুত সে নেমে গেল, চকিতে রেখে গেল এক পলক মায়াভরা দৃষ্টি। 

ফিরে আসা

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য পূর্ব প্রোগ্রাম বদলে গেছে। চৌদ্দ তারিখ খুব ভোরে হোটেল ছাড়লাম বেড-টি খেয়ে। জিরো ব্রিজ ও রাস্তা জনশূন্য। কাছেই টুরিস্ট রিসেপশন সেন্টার। হেঁটেই রওয়ানা হলাম। 

বৃষ্টি নেই। তবে রাস্তায় কাদা ও পানি জমেছে স্থানে স্থানে। অসম্ভব শীত। গত রাতে বৃষ্টি এবং তুষার দুই-ই পড়েছে। রিসেপশন সেন্টারের কাছে আসতে একটি ছেলে বলল, বাস নাহি যায়েগা। সেন্টারে পৌঁছে দেখি সত্যিই তাই। লাউঞ্জে বহুলোক। দেশি-বিদেশি টুরিস্ট। সবারই ঘরে ফেরার ব্যগ্রতা। জিজ্ঞেস করতে হলো না। সবার আলোচনা থেকে এমনিতেই জানা গেল অবস্থা। গতকাল জম্মু থেকে কোনো বাস-ট্যাক্সি আসেনি। পথ খারাপ। খারাপ বললে কম বলা হয়। পথ বন্ধ। বাস যাবে না। 

কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে আরও দেরি হলো। আগামী কাল জম্মু থেকে আসার পালা বলে এদিক থেকে কোনো ট্রাফিক যাবে না। আজকে বাস না গেলে বাস যাবে পরশু। মাথায় বাজ পড়ার শামিল এই খবরে মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। ভিসার মেয়াদ শেষ এবং মানিব্যাগ তলানিতে এসে ঠেকেছে। আজ না গেলে আগামী পরশুর হিমগিরি ধরা যাবে না। বিকল্প ব্যবস্থার খোঁজে ঘোরাঘুরি করি। 

এয়ার ইন্ডিয়ার পরবর্তী ১০ দিনের সিট বুক হয়ে আছে। পথের কথা চিন্তা করে ট্যাক্সি যেতে রাজি হচ্ছে না। দু’একটি ট্যাক্সি যদিওবা বেশি ভাড়ার লোভে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অনিশ্চিতভাবে ছাড়ছে তাতে সিট পেলাম না। পাঁচ সিটের ট্যাক্সি। যারা রিজার্ভ করছে তাদের পুরো পাঁচজনের দল রয়েছে। হাল ছাড়লে চলবে না। হতাশা আর মনের কোণে উঁকি দেওয়া ক্ষীণ আশা। এখানে ওখানে ইতঃস্তত জোটবাঁধা অপেক্ষমান যাত্রী। শেষে আমারই চেষ্টায় ব্যবস্থা হলো। 

একটা নয় দুটি নয় পুরো তিন তিনটি ট্যাক্সি। যাত্রী পনেরো জন। কলকাতার চার ফ্যামিলির বারো, দু’জন আজমীর যাত্রী কাশ্মীরি বৃদ্ধ মুসলমান এবং আমি। দু’জন শিশু অতিরিক্ত। বাড়তি ভাড়া কবুল করে অনেকের নিষেধ উপেক্ষা করে, অভুক্ত পেটে শতভাগ অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে ট্যাক্সি ছাড়ল দুপুর ১টায়। এর মাঝে আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠল বেশ কদিন পরে। আমরা সবাই আশাবাদী, রাত ৯টা-১০টায় জম্মুতে পৌঁছে যেতে পারব। 

কাজীকুন্ড ৮৮ কিলোমিটার প্রায় সমতল ভূমির পিচঢালা রাস্তায় মসৃণগতিতে বেশ এলাম। চেকপোস্টে থামল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সারাদিনের খাওয়া সারলাম পরোটা আর ডিমভাজি দিয়ে এবং সঙ্গে বিশুদ্ধ কাশ্মীরি নিমক চা; কিন্তু ট্যাক্সি ছাড়ে না। খোঁজ নিতে যেয়ে জানা গেল সামনে পথ খারাপ, আগের চেকপোস্ট থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া পর্যন্ত ট্যাক্সি যাবে না। আগের চেকপোস্ট পর্যন্ত যেতে চাই, তার জন্য অনুমতি নিতে অফিসার ইনচার্জের অফিসের সঙ্গে লাগোয়া সরকারি বাসায় গেলাম। সঙ্গি হলো আটকে পড়া আরও কিছু যাত্রী। মেঝেয় বিছানা পেতে লেপের মধ্যে আসীন তিনি। উইলো গাছের চাঙাড়িতে আগুন পোয়াচ্ছেন এবং রাজকীয় ভঙ্গিতে তামাক সেবন করছেন। 

সব শুনলেন। ধীরস্থির। চা অফার করলেন। বিনীতভাবে জানালেন আগের স্টেশন থেকে ক্লিয়ারেন্স না পাওয়া পর্যন্ত অনুমতি দেওয়া যাবে না সামনে এগোবার। আরও জানালেন আগামীকাল যাওয়া যাবে না, পরশু-যদি রাস্তা ক্লিয়ার হয়। আশ্বাস দিলেন দরকার পড়লে ব্যারাকের হলরুম খুলে দিবেন যাত্রীদের জন্য। অতীতে ১৫ দিন আটকে পড়বার উদাহরণও আছে জানালেন। কাজেই অধৈর্য না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে দরজা বন্ধ করলেন। হতাশ হয়ে ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম। সামনে অনেক পথ। অনেকটা পথ সামনে। বিকেল হয়েছে। সূর্য সময় বুঝে আবার মেঘের আড়ালে। শীত নামছে হাড় কাঁপিয়ে; কিন্তু কথায় বলে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। 

আমাদের তিন ড্রাইভার পরামর্শে বসে। আমাদের জানাল, বিকল্প একটা পথ আছে ভেরীনাগ হয়ে বেশ ঘুরে যাওয়া যায়, এর জন্য বাড়তি পেট্রোল খরচ বাবদ মাথাপিছু অতিরিক্ত রুপি দিতে হবে। আমরা সবাই রাজি হলেও আমাদের গাড়ির সামনের দু’জন কাশ্মীরি রাজি নয়। পেছনে আমি এবং কলকাতার এক দম্পতি ৫-৬ বছরের মেয়েকে নিয়ে। অগত্যা সামনের কাশ্মীরি দু’জনের বাড়তি ভাড়া পেছনের দু’জনে দিতে রাজি আছি জানিয়ে ট্যাক্সি ছাড়তে নির্দেশ দেই। 

ঘুরপথে বেশ কিছুক্ষণ ভালোই যাওয়া গেল। হঠাৎ এক জায়গায় ট্যাক্সি থেমে গেল। তিন ড্রাইভার নিজেদের ভিতর কথা বলাবলি করে ট্যাক্সি ঘুরিয়ে গ্রামের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিসহ আমাদেরকে ফেলে উধাও। আমরা কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। হতভম্ভ হয়ে অচেনা গাঁয়ে সন্ধ্যা নামা দেখতে থাকলাম নিরুপায় হয়ে। ঘড়ির কাঁটায় আধঘণ্টা; কিন্তু মনে হলো অসীম সময়। কিছুক্ষণ পরে হাসতে হাসতে ফিরে আসে তিন কালপ্রিট।

জিজ্ঞেস করে জানা গেলে সামনে মোবাইল কোর্ট বসিয়েছিল ম্যাজিস্ট্রেট। তারা আউট অফ রুটে এসেছে। ধরা পড়লে ফাইন গুনতে হতো। শুনে আশ্বস্ত হলাম যে ম্যাজিস্ট্রেট ফিরে গেছে। রোড ক্লিয়ার। ট্যাক্সি ছাড়ল। পথ ঘুরে এসে লাভ হলো নতুন একটা স্পট ভেরীনাগ দেখা গেল। অবশ্য গাড়িতে বসে। শ্রীনগর থেকে ভেরীনাগ ৭২ কি.মি.। পাহাড়ের পাদদেশে।

একাধিক ঝরনা। জানা গেল ঝিলাম বা বিতস্তা নদীর প্রধান উৎস ভেরিনাগের এই সব পাহাড়ি ঝরনা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের তৈরি শাহীবাগান ও হামামখানা এবং বিখ্যাত অস্টকোণাকৃতি চৌবাচ্চা। একটি ঝরনাকে উৎস হিসাবে কেন্দ্র করে তৈরি। সব সময় পূর্ণ থাকে চোখের ন্যায় স্বচ্ছ নীল পানি। রাস্তার দু’পাশে স্থানে স্থানে জমে রয়েছে গত কালের বরফ। বৃষ্টির পানি তীব্র স্রোতে নিচের ঢালে নেমে যাচ্ছে। 

জহুর টানেল হয়ে বানিহালে থামতে হলো। আবার চেকপোস্ট থামিয়ে দিল। রাত ৮টা। সারাদিনে এগিয়েছি মাত্র দেড়শ’ কি.মি.। অবশ্য ঘুরপথে আরও বেশকিছু দূরত্ব মাড়াতে হয়েছে। এখানে ট্যুরিস্ট লঞ্জ ও ডরমিটরি আছে। ডরমিটরিতে আশ্রয় নেওয়া গেল। বড় হল রুমের মেঝে কার্পেটে মোড়া। জনপ্রতি ভাড়া খুবই সামান্য। বিছানা এক্সট্রা, তার ভাড়াও বেশি না। একটা নিলাম। ঘুমোবার আগে সঙ্গী ফ্যামিলির বাচ্চা মেয়েটিকে নিলাম আমার কম্বলের ভেতর। সকালে ওঠার সময় দেখি মেয়ের ওপাশে তার মা-ও গুটিশুটি হয়ে। 

পরদিন খুব ভোরে বৃষ্টি মাথায় দিয়ে যাত্রা শুরু। অবশ্য সহজে নয়। এর জন্য চেকপোস্ট ইনচার্জের ঘরে গিয়ে তার সুখের ঘুম ভাঙিয়ে ট্যুরিস্ট পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি নিতে হলো। ফিরে আসছি, অফিসার ভদ্রলোক পেছন থেকে ডেকে পরামর্শ দিলেন সঙ্গে খাবার এবং সিগারেট নিতে। পরে বুঝেছি এ পথের যাত্রীদের জন্য এটা সত্যিকার বন্ধুসুলভ পরামর্শ। 

১৬-১৮ কি.মি. যেয়ে আবার থামতে হলো। সামনের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে ব্লাইন্ড টার্ন। পুরো পথটার ওপর থেকে পাহাড় ধসে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কোনোমতেই এগোনো সম্ভব নয়, যানবাহনে না, হেঁটেও না। ৮টার দিকে সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পথ পরিষ্কারের কাজ শুরু হলো। বুলডোজার ধসেপড়া পাথর ঠেলে নিচে গড়িয়ে দেয়। কাজ শুরু হতে দেখলাম বিশালাকার বুলডোজার নেহাতই অসহায়, যেমন কখনো কখনো বিজ্ঞান ও মানুষ প্রকৃতির কাছে। পাথরের নিচে ডিনামাইট ফিট করে ডিসচার্জ করা শুরু হলো। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এক সঙ্গে দুই, তিন বা চারটি ডিনামাইট ফিট করে। হুইসেল বাজিয়ে লাল পতাকা উড়িয়ে দু’পাশের অপেক্ষমান যাত্রীদের দূরে সরিয়ে দেয়।

সাত হাজার ফুট উঁচু পাটনিটপ।

কানে তালা লাগিয়ে ফাটে ডিনামাইট। চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত হওয়ায় শব্দের সঙ্গে প্রতিধ্বনি শোনা যায় আরও কয়েকবার। পাথর ভেঙে গুঁড়া হয়ে ছিটকে ওঠে। ধোঁয়া আর আগুনের শিখাও দেখা যায়। যাত্রীরা কান চেপে বসে। পরে টুকরা হয়ে যাওয়া পাথর সরায় বুলডোজার। এই অপারেশন চলল সারা দিন। দু’পাশে আটকা পড়া শতশত যাত্রী। আমাদেরটাসহ গোটা ত্রিশেক ট্যাক্সি দু’পাহাড়ের সংযোগ ব্রিজের ওপর। চারদিকে উঁচুউঁচু পাহাড়। উচ্চতা পাঁচশ’ থেকে হাজার ফিট। রাস্তার নিচের দিকটা একদম খাঁড়া।

নিচে তাকানো যায় না বুক কেঁপে ওঠে। কেউ নিচে পড়ে গেলে সৎকারের জন্য লাশ ওঠানো সহজ নয়। ব্রিজের ডানে জলপ্রপাতের পানি পড়ছে নিরবধি। প্রচণ্ড শব্দ। গত কদিনের বৃষ্টির পানি পাথরের ঢাল বেয়ে বিভিন্ন দিক থেকে নেমে আসছে। কাকচক্ষুস্বচ্ছ পানি। ঠান্ডা। পাথরে বাধা পেয়ে নিচের পাহাড়ি নদীর পানি ফুসছে আক্রোশে। মাথায় শ্বেতশুভ্র ফেনা। জায়গাটার প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। 

কাজ নেই সারাটা দিন শুধু অপেক্ষার প্রহর গোনা। বুলডোজার ঠিক মতো কাজ করতে পারছে না। ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে পাথর। বিভিন্ন আকৃতির বড়বড় এক টুকরা মাথায় পড়লে আর জ্যান্ত ফিরে যেতে হবে না। কোনো রকমে ট্যাক্সি যাওয়ার উপযোগী করে রাস্তা পরিষ্কার করতে লেগে গেল প্রায় সারাটা দিন। শুধু ট্যাক্সি ছাড়বার অনুমতি পাওয়া গেল বিকেলে। 

আমাদের ট্যাক্সি রওনা হলো। পথে আরও দু’জায়গায় থামতে হলো। রাস্তার ওপর থেকে মাটি ধসে পড়েছে। মাটি হওয়ায় বুলডোজার সহজেই পরিষ্কার করে দিতে পারল রাস্তা। আবার সেই একই পথ। রামবান, কুদ, উধমপুর। দিনে নয় রাতে যাত্রা। দিনেই যেখানে পথচলা বিপজ্জনক সেখানে রাতের বেলায় যাত্রায় নতুন যাত্রীদের মনের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকার কেটে গাড়ি চলছে।

আকাশ মেঘলা বলে ওপরের দিকেও কিচ্ছু নজরে আসে না। গাড়ির হেড লাইটের আলোয় সামান্য পথই আলোকিত হয়। গাছ-পাথর ও পাহাড়ি বাঁকে আলোছায়ায় ভৌতিক পরিবেশ। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি সামনে পথ রোধ করে দাঁড়াবে ফুলনের মতো কোনো নারী দস্যু। না ভাগ্য তত খারাপ নয়। রাত ১টায় ট্যাক্সি পৌঁছে গেল জম্মুতাবী। অনুমতি ছাড়াই স্টেশনের রিটায়ারিং রুমের একটা খালি বেডে শুয়ে ডবল কম্বলের নিচে আশ্রয় নিলাম বাকি রাতের জন্য।

পাটনিটপে ছোট শিশুরা বরফ নিয়ে খেলছে।

 যাত্রার শেষটায় আমার জন্য ছিল আনন্দজনক সমাপ্তি। ট্রেনের নির্ধারিত আসনে বসার পরে দেখি সেলোয়ার-কামিজ পরা এক তরুণী আমাকে লক্ষ্য করছে, মুখে মিটিমিটি হাসি। ঠিক আমার সামনে আসন। তার সঙ্গী পাশে নেই। কোনো মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মুখ ঘুরিয়ে নেই; কিন্তু কৌতূহলে আবার তাকে দেখি। এবার কৃত্রিম অভিমান মেশানো গলায় বলে, কি দাদা চিনতেই পারছেন না! সেদিনতো ধাক্কা দিয়ে উল্টে ফেলে দিলেন!

আরে আপনি? আপনাকে তো চিনতেই পারিনি, সেদিন আপনি গায়ে দিয়েছিলেন ওভারকোট, মাথায় কানঢাকা উলেন টুপি। রীতিমতো একজন মহিলা। 

আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আর এখন?

আর এখন তো ক্লাস নাইন-টেন বা ফার্স্ট ইয়ারে পরা কোনো তরুণী! আপনাকে চিনব কেমন করে?

ঘটনা দু’দিন আগের গুলমার্গের। সেদিন গন্ডোলা বা রোপওয়ে বন্ধ ছিল। পর্যটকদের অনেকেই মজা করার জন্য উঠেছিল মানুষ টানা স্লেজে। গুলমার্গের পুরো উপত্যকা ছিল পাঁচ-সাত ফুট বরফে ঢাকা। 

কাঠের স্লেজে বসলে চালক রসি ধরে টেনে টিলার নিচ থেকে ওপরে তোলে। ওপরে ওঠার পরে স্লেজের মুখ ঘোরায়, চালক এসে বসে পেছনে, দিক ও নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখার জন্য। 

কাশ্মীর ডাল লেক।

ঢালুতে নামতে থাকে স্লেজে। প্রথমে ধীরে, ক্রমেই বেগ বাড়ে। বিপরীত দিক থেকে উঠে আসছে অনেকে। ওঠা-নামার পথ নির্দিষ্ট। আমার ¯স্লেজচালক আবদুল্লাহ দুষ্টমী করে আমাদের স্লেজের সামনের দিকের এককোণা বাঁধিয়ে দিল বিপরীত দিকের এক মহিলার স্লেজে। স্লেজে স্লেজে হেড অন কলিশন। 

সবাই চিটপটাং। গড়িয়ে ডিগবাজি খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। না লাগেনি। তুষারে লাগে না। মহিলা রাগতে যেয়ে যে ভাষায় কথা বললেন তা বাংলা। আমি সবিস্ময়ে বলি, আরে আপনি বাঙালি?

আমার বাংলা শুনে তিনি বললেন, আপনিওতো বাঙালি, দেশ কোথায়?

বললাম, বাংলাদেশ!

তার রাগ অদৃশ্য, খুশি গলায় বললেন, আমরাও বাংলাদেশের। 

এই সময় তার স্বামী নেমে কাছে এলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার স্ত্রী খুশি গলায় জানালেন, ইনি বাংলাদেশের। 

পরিচয় হলো, জানলাম অন্য ব্যবসার সঙ্গে তার রেশনের দোকান রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। তখন আমি চাকরি করি ফুড ডিপার্টমেন্টে, সরকারি চাকরি করি। 

সেদিনের সেই মহিলা এখন সামনের আসনে। সেই তার স্বামী ফিরে এলেন। তার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় হলো। তিনিও খুশি হলেন আমাকে পেয়ে। পুরো যাত্রাপথটা একসঙ্গে কাটল চমৎকার আনন্দে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //