সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা

এই প্রজেক্টের কথা প্রথম জনসমক্ষে আনেন থিওডর অ্যাডোর্নো ও ম্যাক্স হর্কহেইমার। ১৯৭৩ সালে। এটাও জানতে পারেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই প্রকল্প গ্রহণ করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপরই। সচেতন পাঠকরা জানেন তারা দুজনেই পূর্ব জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের বুদ্ধিজীবী। সোভিয়েত ইউনিয়নের যে অফিসিয়াল বা রাষ্ট্রীয় মার্কসবাদ চালু ছিল, সেগুলোর বড় বড় ভ্রান্তি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকরা অনেক আগেই শনাক্ত করেছিলেন।

সাবধানও করেছিলেন এই বলে যে, ওইসব ভুল পদক্ষেপ বা ক্ষতিকর পদক্ষেপ পরিত্যাগ করে সঠিক পথ বেছে না নিলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে। মস্কোর নেতৃত্বাধীন তাত্ত্বিকরা তাদের কথা কানে তো তোলেনইনি, উল্টো প্রভাব খাটিয়ে বার্লিন তথা পূর্ব জার্মানি থেকে তাদের বহিষ্কার করেছিলেন। এরা দুজন চলে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। 

দেশত্যাগে বাধ্য হলেও মার্কসবাদে আস্থা হারাননি তারা। বরং নতুন নতুন ধরনের তথ্যসংগ্রহ ও গবেষণায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন।

তারাই প্রথম জানতে পারেন যে যুক্তরাষ্ট্র ও পুঁজিবাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক সারা পৃথিবীর মানুষের শিল্পবোধ, সংস্কৃতি চেতনা, সংবেদনশীলতা ভোঁতা করে দেওয়ার জন্য ব্যাপক একটি প্রজেক্ট চালু করেছে। যার নাম তাদের ভাষায় ‘কালচারাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি’ বা ‘সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা’। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সংস্কৃতির নামে যে বিনোদন পণ্য উৎপাদিত হবে, তা মানুষকে ‘নিষ্ক্রিয় ভোক্তা’য় পরিণত করবে।

কেন এই প্রকল্প?

সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ঐতিহ্যগতভাবেই মানুষকে সচেতন করে তোলে। প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে। তাৎক্ষণিক ফলদায়ক না হলেও মানুষ ও সমাজের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে সংস্কৃতিচর্চা ও শিল্পচর্চার। সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক ও বৌদ্ধিক কর্মকাণ্ড মানুষকে সচেতন করে তোলে নিজের সম্পর্কে, নিজের পরিপার্শ্ব সম্পর্কে। সেই পরিপার্শ্ব মানবিক বিকাশের পরিপন্থী হলে তা পরিবর্তনের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পারে মানুষকে।

শিল্প-সাহিত্যের এই শক্তি সম্পর্কে পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকরা যথেষ্ট সচেতন। বলা চলে, সমাজ পরিবর্তনের যোদ্ধাদের চাইতেও বেশি সচেতন। তারা তলিয়ে দেখেছেন ফরাসি বিপ্লবের প্রভাবক হিসেবে রুশো-ভলতেয়ারের রচনাবলি, বালজাক-ভিক্টর হুগোর উপন্যাসসমূহ, বিভিন্ন শিল্পকর্ম, নাটক কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা এটাও বিশ্লেষণ করেছেন রুশ বিপ্লবের আগের একশ বছর ধরে পুশকিন থেকে শুরু করে তলস্তয়-দস্তয়ভস্কি-চেখভ-গোর্কির রচনাবলি কীভাবে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, তৈরি করেছে বিপ্লবের মানসিকতা।

পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের সব মুক্তি সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করতে ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছে শিল্প-সাহিত্য। এমনকি খোদ পুঁজিবাদী মোড়ল দেশগুলোতেও মানুষকে শ্রেণি-বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে শিল্প-সাহিত্য। গণঅসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে বারবার বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে।

ফলে তাদের সরকারও বাধ্য হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বেশি বরাদ্দ দিতে। বাধ্য হয়েছে আইনের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ধারা বিলুপ্ত বা সংশোধন করতে। এসব কোনোটাই তাদের জন্য সুখকর নয়। তারা অনেক কারণ খুঁজে বের করেছে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া এবং অবিরাম ঘটতে থাকা আন্দোলন-সংগ্রামের নেপথ্য কারণ। 

তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে বশংবদ সরকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য তৈরি করেছে এনজিও-সংস্কৃতি। এনজিওর প্রধান কাজ হচ্ছে বিপ্লব বা আন্দোলন থেকে সরিয়ে অল্পকিছু সংস্কারের মাধ্যমে মানুষকে বোঝানো যে বর্তমান ব্যবস্থাই তাদের সমস্যা লাঘব করার জন্য যথেষ্ট। সেই সঙ্গে মানবাধিকার, নারী অধিকার আন্দোলন, দলিত আন্দোলন, আইনের শাসন, ভূমি ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে পুঁজিবাদী চিন্তাধারাকে সমাজের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত করাও তাদের অন্যতম প্রধান কাজ।

পুঁজিবাদের সাফাই গাওয়া এবং সমাজ পরিবর্তনে নিরুৎসাহিত করার মতো শিল্প-সাহিত্য নির্মাণ ও সেগুলোর ব্যাপক প্রচার তারা করেছে। এখনো করে চলেছে। সেগুলো বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হয়েছে অনেক সংগ্রামী মানুষকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত মানুষের মনের অসন্তোষ তা দূর করতে পারেনি। কারণ বঞ্চনা মানুষের জীবনের সঙ্গে লেপ্টে থাকে নির্মম বাস্তব হয়ে।

সেই বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বুঝতে শেখায় সমাজ সচেতন শিল্প-সাহিত্য। তাই পুঁজিবাদের মোড়লদের দরকার হয়ে পড়েছিল বিকল্প, লাগসই, কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করা। সেই দীর্ঘ গবেষণা এবং অনুসন্ধানের ফসল ‘সংস্কৃতি নির্মাণ কারখানা’।

শিল্প-সাহিত্যকে নিছক বিনোদনে পরিণত করাই এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য। বিনোদন মানুষের কাঙ্ক্ষিত বস্তু এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। মানুষ সবসময় নিজের পেশা ও জীবনযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারে না। তার দরকার হয় ভ্রমণ, খেলাধুলা, সিনেমা, সার্কাস, থ্রিলার, বাগান করা। এসব তাকে সাময়িকভাবে স্বস্তি দেয়। ক্লান্তিমোচনে  সাহায্য করে। মানুষের প্রাত্যহিক জীবন-যাপনকে কিছুটা সহজ করে দেয়। সুস্থ বিনোদন না থাকলে মানুষ ভিড় করে মদশালায়, পতিতালয়ে, যুক্ত হয় সমাজবিরোধী বিভিন্ন ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে।

কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের উদ্দেশ্য তো শুধুমাত্র বিনোদন নয়। সাহিত্যের ভ‚মিকা হচ্ছে মানুষকে তার একেবারে ভেতরের মানুষটির মুখোমুখি করা। সাহিত্য পাঠের পর মানুষ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখে। যখন দেখতে পায় তার পরিপার্শ্ব, তার সমাজ, তার রাষ্ট্র, চলমান বিশ্বব্যবস্থা, তাকে পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে বাধা দিচ্ছে, তখন সে মনে মনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই বিক্ষুব্ধ মানুষদের মধ্যে যারা বেশি সংবেদনশীল, তারা বিপ্লবী হয়ে ওঠেন।

আন্দোলনে যোগ দেন, কখনো কখনো আন্দোলন গড়েও তোলেন। তারা দেখতে পান কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, নারী সমাজ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসবাই শোষিত। শুধু শোষিতই নয়, নানারকম সুবিধার ছিটেফোঁটা দিয়ে তাদের নৈতিক মেরুদণ্ডও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তখন কেউ কেউ সরাসরি সংগঠক হিসেবে, কেউ কেউ শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করতে থাকেন। তারা জানেন পরিবর্তন খুব রাতারাতি ঘটে না। শিল্প-সাহিত্য অনেক দূরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য কাজ করে। তবে পরিবর্তন যে অমোঘ-এই সাহসে বুক বাঁধতে সাহায্য করে মানুষকে।

অন্যদিকে পুঁজিবাদ তার সর্বগ্রাসী কাঠামোতে সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করতে পারঙ্গম। সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা অনেক আগেই শনাক্ত করতে পেরেছিল বৈশ্যতন্ত্র। এই তালিকায় বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছিল সংগীত, চলচ্চিত্র, সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও নাটক। গণসংস্কৃতি ও উচ্চাঙ্গের ধ্রুপদী শিল্প-উভয়েই একসময় স্বাধীন ছিল।

এখন সেগুলোকে বাজারের আওতায় আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব যে সংস্কৃতিকে সর্বার্থে পণ্য করে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রথম উন্মোচন করেন অ্যাডোর্নো ও হর্কহেইমার। তারা তথ্য-উপাত্ত-প্রমাণ উপস্থিত করে দেখান, সংস্কৃতি বাণিজ্যই কেবল নয়, বরং ‘সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা’ও স্থাপিত হয়ে গেছে।

সংস্কৃতি কারখানায় যেসব জিনিস উৎপাদন করা হয়, সেগুলোর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে পাঠক, শ্রোতা ও দর্শককে ‘নিষ্ক্রিয় ভোক্তা’য় পরিণত করা। এমন সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হবে, যেগুলো দর্শককে কোনো কিছু ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে না বরং তাকে কেবল নিষ্ক্রিয় বিনোদন দান করবে। এমন ধরনের উপন্যাস রচনা করা হবে, যা পাঠককে জীবন, বাস্তবতা ও নিজের মুখোমুখি দাঁড় করানোর বদলে তাকে পলায়নবাদী ভোগসর্বস্ব দায়িত্বহীন জীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করবে।

অ্যাডোর্নোর সংস্কৃতি কারখানা বিষয়ক ধারণা আমাদের বুঝে নিতে সাহায্য করে, কীভাবে এই প্রকল্প একই সঙ্গে বাজার থেকে মুনাফা তুলে আনার পাশাপাশি শাসক শ্রেণির প্রতি মানুষের আনুগত্যের নিশ্চয়তা বিধান করে থাকে। এই সংস্কৃতি উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অফিসে বসে নিয়মিত কাজ করার মতো করে কিছু নির্দিষ্ট ফর্মুলার মাধ্যমে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

অ্যাডোর্নো এটিকে জনপ্রিয় সংগীত উৎপাদনের উদাহরণ দিয়ে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে বাজারে জায়গা পেতে উদগ্রীব গীতিকারদের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তাদের সুর ও বাণী যেন নির্দিষ্ট ফর্মুলার বাইরে না যায়। 

একইভাবে উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও ফর্মুলা ও পৃষ্ঠাসংখ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। মূল কথা হচ্ছে যে, মৌলিক হওয়ার চেষ্টা কোরো না, তোমার আগে যে জনপ্রিয় হয়েছে তাকে অনুসরণ করে যাও। সব মিলিয়ে ফলাফল হচ্ছে জনরুচিকে আরও নিচুতে নামিয়ে আনা। জনরুচি যত নিচে নামবে, অরুচিকর শাসকদের কার্যকলাপ চিনতে তত বেশি ভুল করবে মানুষ; ফলে চিরস্থায়ী হবে জনগণের বিপক্ষ শক্তির শাসন।

যে কোনো মৌলিক শিল্প অনুধাবণ ও উপভোগের জন্য কিছুটা মনোযোগ ও পরিশ্রমের দরকার হয়। সেটি তাজমহলের সৌন্দর্যই হোক আর শেক্সপিয়ারের নাটকই হোক বা রবীন্দ্রনাথের নাটকই হোক, তলস্তয়ের উপন্যাসই হোক। সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা এই পরিশ্রম থেকে ভোক্তাকে মুক্তি দিয়ে তাকে আরও স্থূল চেতনার অধিকারী করে তুলতে বদ্ধপরিকর এবং অনেকাংশে সফল। এই ব্যাপারটি ত্রিশের দশকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। বুঝতে পেরেছিলেন যে সাধারণ মানুষের সঙ্গে উন্নত সাহিত্যের ব্যবধান বাড়িয়ে দিচ্ছে বাজার-ব্যবস্থা ও পণ্যায়নমুখিনতা।

তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘এদিকে দেশে লেখক বেশি নেই এবং অধিকাংশ পাঠক গভীর বিষয়ে মনকে নিবিষ্ট করতে নারাজ। উদ্বোধনের চেয়ে উত্তেজনা তারা স্বভাবত বেশি পছন্দ করে। সাধারণের সঙ্গে যদি কারবার করতে হয় তবে সাধারণের দাবি অজস্র পরিমাণেই মেটানো চাই। নইলে কাজ চলে না।

তাই লোকচিত্তরঞ্জনের ব্যবস্থা জগৎজুড়েই হালকা হয়ে গেছে। এ ব্যবসায় যারা আছেন তাদের মনে উচ্চ সংকল্প থাকলেও নিজের অজ্ঞাতসারেই আদর্শ নিচু হয়ে আসে। সাধারণের মন জোগাবার আয়োজন চারদিকে যতই বিস্তারিত হয় ততই অলস মনের শৌখিন ফরমাশ বেড়ে ওঠে। বিপদ এই, তাদেরই বাহারে বাজারদর বেশি।’

এই মনোভঙ্গি খুব মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা করেছে ‘সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা’র কুশীলবরা। নিপুণভাবে কাজে লাগিয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতিকে তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা এতদূর সফল, অ্যাডোর্নো স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে-‘সংস্কৃতি বাণিজ্য এমনভাবে শিল্পকলা উৎপাদন করে যা গণভোগের জন্য মেপে মেপে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাতে শৈল্পিক অভিজ্ঞতা নিম্নমানের হয়ে ওঠে এবং ভোক্তার বিচার ক্ষমতা দুর্বল করে তোলে।

বলা হয় গণ-সংস্কৃতিতে ব্যক্তিই প্রধান, কিন্তু সংস্কৃতি বাণিজ্যের ধ্বজাধারীরা সেই ব্যক্তির সাংস্কৃতিক প্রয়োজনগুলো পূর্বপরিকল্পিত করে রাখে বেশ কিছু কিট্শ (জার্মান শব্দ; মূল্যহীন আবর্জনা, মন্দ-রুচি, মন্দ-শিল্প বোঝাতে ব্যবহৃত হয়) প্রস্তুত করা হয়, নাটক চলচ্চিত্র বিজ্ঞাপন ও পুনরাবৃত্ত করা সংগীত।

এই বাণিজ্যে বিভিন্ন উৎপাদিত পণ্যের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য কী হবে তা নির্ধারিত করা হয় কোন শ্রেণি ও কোন ভোক্তা সেসব গ্রহণ করবে তাদের চরিত্র পূর্বে বিশ্লেষণ করে। এভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরের সাধারণ মানুষের জন্য ভিন্ন রুচির, কম-বেশি আর্থিক মূল্যের সাংস্কৃতিক পণ্য তৈরি করা হয়। এতে সমাজের প্রতিজনের জন্য বাজারে কিছু না কিছু থাকবে এবং বাজার থেকে কেউ নিস্তার পাবে না।’

অর্থাৎ এই প্রকল্প সফল করার জন্য যে ধরনের বাজার-ব্যবস্থা সৃষ্টি করা করা দরকার সেই কাজটিও নিপুণভাবে বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করেছে পুঁজিবাদী পরিচালকরা।

রাষ্ট্রের সন্ত্রাসী বা ঘাতক রূপটি আমাদের চোখে পড়ে। মামলা, হামলা, গুম-খুন, নির্বাসন আসে গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এইসব দেখে আমরা রাষ্ট্রের ফ্যাসিস্ট চরিত্রটি চিনতে শিখি। কিন্তু এগুলো হচ্ছে আইসবার্গের চ‚ড়ামাত্র। তার আট ভাগের সাত ভাগই আমরা দেখতে পাই না। সেই সাত ভাগ হচ্ছে নীরব ও অবিরাম কাজ করে যাওয়া ঘাতক। অনেক মারাত্মক, অনেক বিধ্বংসী। তাদের ত‚ণীরে নতুন তীর হচ্ছে সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানা।

মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি বিশ্লেষকরা অন্য নীরব ঘাতকদের সঙ্গে সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানাকেও চিহ্নিত করেছেন। গ্রামসি জানিয়েছেন, প্রচলিত বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে প্রচল রাখা এবং পরিপুষ্ট করার জন্য নিরলসভাবে নিরন্তর কাজ করে চলেছে তিনটি প্রধান হাতিয়ারপ্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, তরল সাহিত্য ও গণমাধ্যম। অ্যডোর্নো ও হর্কহেইমার এই তালিকায় যুক্ত করেছেন সংস্কৃতি উৎপাদন কারখানাকে।

মার্কিউস দেখিয়েছেন, এই নীরব ঘাতকরা মানুষের বেশ কয়েকটি স্থায়ী ক্ষতিসাধন করে। যেমন-১. ব্যক্তিগত ও সামাজিক স্বার্থগুলোর মধ্যে এক ধরনের ভ্রান্ত বোঝাপড়া গড়ে তোলে; ২. ব্যক্তির চাই চাই খাই খাই ভাব ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে; ৩. বিজ্ঞাপিত সৌন্দর্যের সামনে মানুষকে নতজানু করে। মানুষের নিজস্ব সৌন্দর্যবোধকে বিবশ করে দেয়; ৪. শ্রমজীবী মানুষকেও দেশজ সংস্কৃতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শেখায়; ৫. যান্ত্রিক যুক্তিবিদ্যার তথা সরলীকরণের আধিপত্য বৃদ্ধি করে।  

আমরা বলি যে সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। কথাটি মিথ্যে নয়। তবে মনে রাখতে হবে যে পুঁজিবাদও সংস্কৃতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বরং বলা যায়, তারাই অনেক বেশি সচেতন ও সফলভাবে 

সংস্কৃতির উদ্দেশ্যের রূপান্তর ঘটিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধন করছে। সমাজে বিদ্যমান দুটি বিপরীতমুখী শ্রেণি 

সংস্কৃতিকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছে, নিজের মতো করে কাজে লাগাচ্ছে। শাসকশ্রেণি মনে করে যে সংস্কৃতি তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য বজায় রাখার হাতিয়ার। অপর শ্রেণি ক্ষমতাসীনদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে 

সংস্কৃতিকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। বাস্তবে এখন পর্যন্ত একে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারছে ক্ষমতাসীন শ্রেণিই। প্রধান কারণ সংস্কৃতি সংজ্ঞা নির্ধারণে তাদের নমনীয়তা। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শক্তিরা তাদের সুবিধামতো কখনো তাদের উৎকর্ষকে, প্রযুক্তি ব্যবহারে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নকে, পাশ্চাত্য ভাবধারা ও ব্যবহারিক স্টাইলিস্টিকের অনুকরণকে উচ্চ সংস্কৃতি বলে অভিহিত করছে।

আবার তারাই অপর এক সময়ে, কখনো একইসঙ্গে পল্লীগ্রামের উৎকর্ষ, সমৃদ্ধি ও প্রযুক্তি বর্জিত দরিদ্র জীবনযাপনকে আমাদের সংস্কৃতি নাম দিয়ে তুলে ধরছে। এই নমনীয়তাই তাদের এখন পর্যন্ত সর্বত্র বিজয়ী করে রেখেছে। শাহ আব্দুল করিম, লালন ফকির, হাসন রাজা, জসীম উদ্দীনকে পর্যন্ত তারা হজম করে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে এই নমনীয়তার সাহায্যেই।

বলিউড তো বিপ্লবী সূর্যসেন, ভগৎ সিং, মঙ্গল পাণ্ডেকেও গ্ল্যামারাইজ করার মাধ্যমে বিনোদনে পরিণত করেছে। গণমাধ্যমের বিপুল প্রসার ও ব্যবহার তাদের এই বিজয়কে এমনকি প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পর্যন্ত দিতে রাজি নয়। গণমাধ্যমের প্রসার কোনো অনাহূত জিনিস নয়। কিন্তু তাদের ভূমিকা যখন হয় শাসক ও করপোরেটের স্বার্থ রক্ষা করা তখন সেই গণমাধ্যম জনগণের জন্য পরিণত হয় বিষবৃক্ষে। 

মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনুকরণে গণমাধ্যমের এই বিষাক্ত মগজ ধোলাইয়ের আওতায় এসে পড়েছে গ্রামগঞ্জের বিত্তহীন মানুষও। এখানে নিজের অন্তর্গত সংস্কৃতি-চেতনাকে পাশ কাটিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা হয় বিকৃত ভোগবাদে। গণমাধ্যমের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে আরও বেশি অনুগত ও প্রশ্নহীন করে তোলা। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমাতে সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছিলেন মগজ ধোলাই যন্ত্রের ব্যবহার।

সেই যন্ত্র আধুনিক কালে হয়ে উঠেছে মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম। এরা অবিরত মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে লক্ষিত জনগণকে এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে বাধ্য করছে যে বিদ্যমান ব্যবস্থাকেই মেনে নিতে হবে, দেশের তেল-গ্যাস-কয়লা বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়াতেই আমাদের মঙ্গল, ভারত গঙ্গা-তিস্তার পানি না দিলেও আমাদের ট্রানজিট দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো কিছু করার নেই, কারণ ভারতের কাছে আমাদের নতজানু হতেই হবে।

সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্র না চাইলে বাংলাদেশে লোক দেখানো গণতন্ত্রটুকুও থাকবে না। এইসব মেনে নিলে পাওয়া যাবে কৃপার উচ্ছিষ্ট এবং তাই নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তবে সেই উচ্ছিষ্টের উচ্ছিষ্ট পেতে চাইলেও আমাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। সেই প্রতিযোগিতায় নামার একমাত্র পথ হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ। লেখক আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে এ থেকে বেরিয়ে আসার মতো উপাদান আমাদের সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে। প্রয়োজন তাকে সংগঠিত ও সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো।  

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকে নিছক বিনোদনে পরিণত করার সুপরিকল্পিত ক্রান্ত সম্পর্কে আমাদের শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কি যথেষ্ট সচেতন? উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারার মতো পরিস্থিতিতে আমরা নেই। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //