আমাদের ঢাকা থিয়েটার

শহুরে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমবিলাসী শিল্পচর্চার বিপরীতে কমিটেড থিয়েটার চর্চার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার সূচনাকালের নাট্য সংগঠনগুলোর প্রতিষ্ঠাতাদের অধিকাংশই মুক্তিযোদ্ধা-তরুণ প্রজন্ম।

ফলে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তারা যখন নাট্যচর্চায় ব্রতী হলেন, তখন তাদের থিয়েটার ভাবনা জুড়ে থাকল বাংলাদেশ। নাটকের বিষয় হিসেবে তাই বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী গল্প-কাঠামোও নতুনভাবে উঠে এসেছে মঞ্চে। মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্টাল বিরহ-বেদনানির্ভর ক্লিশে গল্পের বদলে নাট্যদর্শকের সামনে উন্মোচিত হলো বাস্তবতানির্ভর জীবনের গল্প। 

নাটকের চরিত্রগুলো ব্যক্তির ভেতর দিয়ে সমষ্টিগত মানুষের জীবন চেতনাকে উন্মোচন করে। নাটকের গল্পে বাস্তব জীবনের না পাওয়ার মানবিক হাহাকার, দারিদ্র্যের সংক্ষুব্ধ বেদনার পাশাপাশি বৃহত্তর সামাজিক জীবনের নানা বঞ্চনার কথাও অঙ্গীকৃত হয়। এটাও ঠিক যে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নাট্যকার-নির্দেশকরা শুধু স্বদেশের গল্পকাঠামোর ভেতরেই নাটক বিনির্মাণ করেননি, একই সঙ্গে তারা বিশ্ব ভ‚গোলের শিল্পভূমিতে দৃষ্টি প্রসারিতও করলেন। আর এভাবেই বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায় বিশ্ব থিয়েটার ভাবনার প্রণোদনা শুরু হলো। 

এজন্যই এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশ যেমন মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, তেমনি বাংলাদেশের নাটকও মুক্তিযুদ্ধ থেকে উৎসারিত স্বর্ণফসল। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবেই নাট্যশিল্পীদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে এ দেশের হাজার বছরের শিল্পভাবনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করা। বাংলাদেশ তাদের চেতনায় ছিল বলেই নাটকের আঙ্গিক বিনির্মাণে বাঙালির সহস্র বছরের সৃজন-প্রেরণা অঙ্গীকৃত হয়ে উঠল। আর এই সহস্র বছরের শিল্প-প্রেরণার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অঙ্গীকারের ঘোষণার মাধ্যমে এদেশে ঢাকা থিয়েটারের জন্ম। 

প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধশতকে পৌঁছে ঢাকা থিয়েটারের সালতামামি অর্জনের চেয়ে সংগঠনটির সামগ্রিক দর্শন ও শিল্পগত অর্জনকে মূল বিবেচনায় আনলে দেখা যায়, এ সংগঠনটি বাংলাদেশের নাটকের রূপরীতির বির্নিমাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সংগঠনটির ক্রমাগত উত্থানের সঙ্গে তার শিল্প ও নাট্যভাবনারও বিকাশ ঘটেছে। নাটকের আঙ্গিক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ঢাকা থিয়েটার আজ স্বাবলম্বী হয়েছে। 

সেলিম আল দীন যেমন বাংলা নাটকের বিষয় ও আঙ্গিক নির্মাণে বাংলাদেশের নাট্য ঐতিহ্যকে স্মরণে রেখেছেন তেমনি নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রায় সব প্রযোজনায় হাজার বছরের বাংলা নাট্যাভিনয়ের রূপরীতির একটি আধুনিক বিনির্মিতি এনে দিয়েছেন। সমকালীন অন্যান্য নাট্যদলের চেয়ে এখানেই ঢাকা থিয়েটার ব্যতিক্রম। 

ঢাকা থিয়েটারের নাট্যচর্চার মূল প্রবণতা হিসেবে কাজ করেছে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক ভাবনা। 

এ বিষয়ে ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য হলো, ‘আমাদের লক্ষ্য জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণ। শহরের মঞ্চে ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের মৌলিক নাটকের অপ্রতিরোধ্য বৃত্তটি রচনা করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্রমে তা প্রসারিত করেছে। গ্রামে গ্রামে গড়ে তুলেছে গ্রাম থিয়েটার। এদেশের মানুষের জীবন ও তার শিল্পিত রূপটি সমাজ রূপের মধ্য দিয়ে একদিন যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে একালের শিল্পসাধনা আগামীকালের মধ্যে পাবে পূর্ণতার আনন্দ।’ অর্থাৎ ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠাকালে এমন একটি ব্রত নিয়েছিল যে মানুষের জীবন ও তার শিল্পিত রূপটি সমাজ রূপের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেই কল্যাণময় শিল্পসাধনার পূর্ণতা ঘটবে। 

ঢাকা থিয়েটার মানুষের জন্য থিয়েটার, মানুষের কল্যাণে থিয়েটার এবং থিয়েটারের মাধ্যমে জনগণের কাছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির বার্তা পৌঁছানোর অভিলক্ষ্যে প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যে গ্রাম থিয়েটারের সাংগঠনিক যাত্রা শুরু করে। ঢাকা থিয়েটারের চার দশকে এসে ঢাকা থিয়েটারের গ্রাম থিয়েটার কার্যক্রম, জাতীয় নাট্য আঙ্গিক ভাবনা এবং দলটির নিরবচ্ছিন্ন নাট্য প্রযোজনা নিয়ে আলোচনা করা হলে দেখা যাবে যে একটি আরেকটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

ঢাকা থিয়েটার যাত্রা শুরু করেছিল সেলিম আল দীনের লেখা ‘সংবাদ কার্টুন’ (১৯৭৩) নাটকের প্রযোজনার মাধ্যমে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংক্ষোভজাত ঘটনাবলির গ্রন্থনা ছিল ‘সংবাদ কার্টুন’ নাটকের বিষয়। সত্তরের দশকে থিয়েটার চর্চায় যেভাবে সামাজিক সচেতনতা এবং রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি উঠে এসেছে তার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে ড্রামা সার্কেল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। 

এই দলটির নাট্য প্রযোজনা ও থিয়েটার ভাবনায় সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কমিটমেন্টের পরিচয় পাওয়া যায়। সমসাময়িক ইউরো-আমেরিকান নাট্যধারা দলটিকে প্রভাবিত করলেও ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান লক্ষ করা যায়। ড্রামা সার্কেলের ‘রাজা’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘রক্তকরবী’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ইডিপাস’ (সফোক্লেস) নাট্য প্রযোজনায় রূপকের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ফুঁসে ওঠা বাঙালি জাতির অন্তর্গত সংক্ষুব্ধ চিত্তের দাহের পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছে। দলটির প্রতিষ্ঠাতা একেএম বজলুল করিম (মৃত্যু: ১৯৭৭) বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারের ধারায় তাই পথিকৃৎ বলে গণ্য রয়েছেন। 

নাট্যদলগুলোর এই যে প্রয়াস সত্তরের দশকের আগে শুরু হলো তার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা জরুরি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৬ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন, ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল জারি বাঙালির চেতনায় একটি জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটায়। নাটকের ক্ষেত্রে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের মাধ্যমে বাংলা নাটকের বিষয় ও মঞ্চশৈলীতে বাঁক পরিবর্তন ঘটে।

পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় অধিকার সচেতনতা ও ভালো নাটক করার যে আন্দোলন শুরু হয় তারই পরিপূর্ণ বিকাশের অগ্রযাত্রা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক সচেতনতা যেমন বাঙালি জাতিকে সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে, তেমনি প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী নাট্যচর্চায়ও প্রাণিত করেছে। তারই উত্থান কালপর্ব ধরা যায় মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নাট্যচর্চা। 

সত্তর ও আশির দশকে ঢাকা কিংবা ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা থিয়েটার ছাড়াও অধিকাংশ নাট্যদলের নাট্য প্রযোজনার মধ্যে আমরা নতুন কালের শিল্প ও সমাজ ভাবনারই প্রতিফলন দেখি। এ সময়েই দর্শনীর বিনিময়ে (১৯৭২) নিয়মিত নাট্যাভিনয় চালু করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৬৮, প্রথম নাট্য প্রযোজনা ১৯৭২)। দেশি হোক বিদেশি হোক-মূলত ভালো নাটক মঞ্চস্থ করাই ছিল দলটির অভিপ্রায়।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা: ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৯৭২, মাইকেল মধুসূদন দত্ত), ‘বাকী ইতিহাস’ (১৯৭৩, বাদল সরকার), ‘ক্রস পারপাস’ (অনু: সৌমিত্র সরকার), ‘ভেঁপুতে বেহাগ’ (১৯৭৪, রূপান্তর: আতাউর রহমান), ‘বহিপীর’ ( ১৯৭৪, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্),‘সৎ মানুষের খোঁজে’ (১৯৭৫, রূপান্তর: আলী যাকের), ‘মাইলপোস্ট’ (১৯৭৬, সাঈদ আহমদ), ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা’ (১৯৭৭, রূপান্তর : আসাদুজ্জামান নূর), ‘অচলায়তন’ (১৯৮০, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ (১৯৮৩, সৈয়দ শামসুল হক)। 

‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণি সংগ্রামের সুতীক্ষ্ন হাতিয়ার’-এই স্লোগান নিয়ে আরণ্যক নাট্যদল নাট্যচর্চায় ব্রতী হয়। আরণ্যক প্রযোজিত নাটকগুলো হলো-‘ওরা কদম আলী’ (১৯৭৬, মামুনুর রশীদ), ‘ওরা আছে বলেই’ (১৯৮০, মামুনুর রশীদ), ‘ইবলিশ’ (১৯৮১, মামুনুর রশীদ) প্রভৃতি। আরণ্যকের প্রযোজনায় দলটির সামাজিক ও রাজনৈতিক কমিটমেন্টের পরিচয় বিধৃত। 

এই দশকে এসে তত্ত¡ নয়, জীবনের সঠিক মানে ও বাস্তব জীবনের চাওয়া-পাওয়া এবং আনন্দ-বেদনার নাট্য মঞ্চায়নে উৎসাহী হয়ে ওঠে থিয়েটার নামের নাট্যদল। থিয়েটার প্রযোজিত নাটকগুলো হলো-‘চারদিকে যুদ্ধ’ (১৯৭৬, প্রফুল্ল রায়), ‘চোর চোর’ (১৯৭৬, জিয়া আনসারী), ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ (১৯৭৬, সৈয়দ শামসুল হক), ‘সেনাপতি’ (১৯৭৯, আবদুল্লাহ আল মামুন), ‘অরক্ষিত মতিঝিল’ (১৯৮১, আবদুল্লাহ আল মামুন)। 

নিয়মিত ত্রৈমাসিক থিয়েটার প্রকাশসহ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়কে মঞ্চে উপস্থাপনের প্রয়াস গ্রহণ করে থিয়েটার নাট্য সংগঠনটি। একই দশকে ঢাকার মতো ঢাকার বাইরের নাট্যদলগুলোও নির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নাট্যচর্চায় উদ্যোগী হয়েছে। সমস্ত অবক্ষয়, হতাশা থেকে মুক্তি, নাট্যকার, নাট্যকর্মী, দর্শক সৃষ্টি ও নিয়মিত প্রগতিশীল নাটক মঞ্চায়নের অঙ্গীকার নিয়ে তির্যক (চট্টগ্রাম, ১৯৭৪) নাট্যদল প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যত্র বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন এবং মৌলবাদবিরোধী জীবনমুখী ও গণমুখী নাট্যধারা প্রবর্তনের প্রত্যয়ে খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার (বরিশাল, ১৯৬৯) নতুন করে পথচলা শুরু করে। 

এক কথায় বলা যায় যে, সত্তরের দশকের থিয়েটার সংগঠনগুলোর মধ্যে মৌল প্রবণতা হিসেবে সক্রিয় থেকেছে দেশ, জনগণ ও মানবিক কল্যাণমুখী থিয়েটার চর্চা। এই সময়ের নাট্যচর্চায় সাধারণভাবে আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসা, মধ্যবিত্ত জীবনের সংকট ও হতাশা এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। একটি সচেতন শিল্প প্রয়াসের কারণেই এই সময়ের বাংলাদেশের নাটক ছিল দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তার চেয়েও প্রাগ্রসর।

কারণ এ সময়ে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পীর অধিকাংশই অস্ত্র ফেলে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায় ও সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে নাটককে মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের এমন একটি টালমাটাল পরিবেশে নতুন প্রত্যয় নিয়ে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এ কথা আগেই বলেছি যে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অনেকেই সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 

ফলে একটি সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতরে থিয়েটার চর্চার মধ্য দিয়ে তারা আরেকটি যুদ্ধের জন্য নিজেদের তৈরি করছিলেন। আর তাদের এবারের ‘যুদ্ধ’টি ছিল শিল্পের লড়াই। যে শিল্পবোধ হাজার বছর ধরে এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন চেতনার সঙ্গে আজ অবধি অঙ্গীকৃত। 

ঢাকা থিয়েটার প্রস্তুতি পর্বের (সত্তরের দশক) নাট্যচর্চায় একটি পথ খুঁজেছিল; যার অন্বিষ্ট কিংবা অভীষ্ট ছিল নিজস্ব ভূগোল সংলগ্ন নাট্যভ‚মির অন্বেষণ। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে এই সংগঠনটির থিয়েটার চর্চার সূচনাটি ছিল একেবারেই সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়নির্ভর। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এগারো সপ্তাহব্যাপী মঞ্চস্থ ‘সংবাদ কার্টুন’ নাটকে বাংলাদেশের অস্থির সময়টি স্পষ্টরূপে উঠে এসেছে দর্শকদের সামনে। নাটকের দর্শক নাটক দেখতে দেখতে সমসাময়িক এবং প্রাত্যহিক জনজীবনের চালচিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হতো।

তবে এই নাটক শুধু সমস্যার উপস্থাপন ছিল না, সমস্যার গভীরে প্রবেশের প্রয়াস ছিল। তাই এই নাটক হয়ে উঠেছিল সমকালের সংক্ষুব্ধ জীবনচিত্র, জীবনের নাটক। সমকালের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়কে থিয়েটার চর্চার অবলম্বন করে ঢাকা থিয়েটার পা রাখে আগামীর পথে। সেই অভিযাত্রায় অনিশ্চয়তার সংকট ছিল, কিন্তু দ্বিধা ছিল না। আর এ কারণেই ক্রমাগত অভিঘাতের ভেতর দিয়ে সংগঠনটির পক্ষে সম্ভব হয়েছে বাঙালির নিজস্ব নাট্যনন্দন ভাবনার সঙ্গে চার দশকব্যাপী সম্পৃক্ত থাকা।

চার দশকের ঢাকা থিয়েটারের আলোচনা করতে গেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই দুজন মানুষ-সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের নাম সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়। ঢাকা থিয়েটারের গর্ভগৃহে তারা যে নতুন নাট্যচিন্তার বীজ বপন করেছিলেন আজ তা মহীরুহ।

ঢাকা থিয়েটার শুরুতেই অস্বীকার করেছে বাংলা নাটক ঔপনিবেশিক আমলের পাশ্চাত্য থিয়েটার ভাবনা থেকে উৎসারিত। ঢাকা থিয়েটার ইউরোপীয় নন্দনভাবনার আলোকে এদেশের নাট্যধারার মূল্যায়ন করেনি। হাজার বছর ধরে বাঙালির নিজস্ব যে শিল্প ও নন্দন ভাবনার বিকাশ ঘটেছে কাব্যে, সংগীতে, নাট্য ও আখ্যানে-তাই ঢাকা থিয়েটারের অন্বিষ্ট থেকেছে আজ অবধি। এটা সম্ভব হয়েছে তত্ত্বকার ও প্রয়োগকারের যুগল পথচলার কারণে। এজন্যই আরম্ভকালে ঢাকা থিয়েটারের ব্যক্তিকেন্দ্রিক উত্থানের চেয়ে সংগঠনকেন্দ্রিক উত্থান ঘটেছিল। শিল্পীর চাইতে শিল্পতত্ত্ব বিনির্মাণে প্রয়াসী ছিল ঢাকা থিয়েটার। নাট্যকার, নিদের্শক ও অভিনেতা-অভিনেত্রী-এই ত্রয়ীর সম্মিলন ছিল সংগঠনটির প্রাণশক্তি। 

কত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর প্রতিভাবান নাট্যশিল্পীর জন্ম হয়েছে এই সংগঠন থেকে। অভিনয়শৈলী নির্মাণের দিক থেকেও এরা কালের বিচারে টিকে থাকবেন। আমি যদি এদের নাম বলতে চাই তাহলে স্বতোৎসারিত যারা আমার বিবেচনায় তারা হলেন-রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিমূল ইউসুফ, আফজাল হোসেন, হুমায়ুন ফরীদি, জহিরুদ্দিন পিয়ার, সুবর্ণা মুস্তাফা, শহীদুজ্জামান সেলিম, ফারুক আহমেদসহ আরও অনেক প্রতিভাধর অভিনেতা-অভিনেত্রী। বড় পরিসরে অন্যদের ভ‚মিকা নিয়ে আলোচনা করব। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের অভিনয়ের ইতিহাস লেখা হলে এরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার যোগ্য। আজ প্রায় পাঁচ দশকের মূল্যায়নে এটিও ঢাকা থিয়েটারের বিরাট অর্জন। এজন্য বলেছি নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনয়শিল্পীর ত্রয়ী সম্মিলনে সংগঠনটি এগিয়ে গেছে হাজার বছর ধরে ব্যাপ্ত বাঙালির নাট্যের উৎসভূমে। 

বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চার প্রেক্ষাপটে ঢাকা থিয়েটারের অর্জনগুলো চিহ্নিত করতে চাইলে সংগঠনটির সালওয়ারি মঞ্চায়ন সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা জরুরি। 

ঢাকা থিয়েটারের কার্যক্রমের ব্যবচ্ছেদ করা আমার অভিপ্রায় নয়, আমি দেখাতে চেষ্টা করেছি অনবরত নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে সংগঠনটির শিল্প অভিজ্ঞতা কীভাবে পরিণতি পেয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, সত্তরের দশক থেকে সমাজ-অর্থনীতি ও শিল্পের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ থেকে ঢাকা থিয়েটার নাট্যচর্চা শুরু করেছে। কোনো ক্লিশে তত্ত্ব নয়, নাট্যদলটি তার নাটকে প্রবলভাবে বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক আচার-আচরণ ও কৃত্য, বঙ্গীয় জনপদের জীবন-জিজ্ঞাসা ও শিল্পভাবনাকে তুলে ধরতে চেয়েছে।

আমরা সংগঠনটির ঘোষণাপত্রে জেনেছি ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীকূলবর্তী নামহীন, গোত্রহীন মানুষের সংগ্রামী জীবনের উপস্থাপনায় বাঙালির জাতীয় নাট্যআঙ্গিক নির্মাণে অভিপ্রায়ী ঢাকা থিয়েটার।’ তাই ‘দেশজ মৌলিক নাটক মঞ্চায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ দেশের একমাত্র নাট্যদল ঢাকা থিয়েটার এ দেশের ইতিহাস, বাঙালির সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুকে বিবেচনায় রেখে অভিযাত্রী হয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।’

তবে চার দশকের শেষে এসে দেখা যায় যে সংগঠনটি কেবল ‘দেশজ মৌলিক নাটক মঞ্চায়নে’ লেগে থাকেনি; অনুবাদ নাটক, রূপান্তরিত বিদেশি নাটকের প্রযোজনায়ও দলটি ইতিমধ্যে হাত পাকিয়েছে। তবু দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ঢাকা থিয়েটার ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালির সংগ্রাম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছুকে বিবেচনায়’ রেখেই এযাবৎকাল নাট্যচর্চা করে আসছে। 

১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এ দলের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘সংবাদ কার্টুন’ (১৯৭৩, সেলিম আল দীন), ১সম্রাট ও প্রতিদ্ব›িদ্বগণ’ (১৯৭৩, হাবিবুল বাসার), ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ (১৯৭৪, সেলিম আল দীন), ‘বিদায় মোনালিসা’ (১৯৭৪, আল মনসুর), ‘মুনতাসির’ (১৯৭৬, সেলিম আল দীন), ‘চর কাঁকড়া’ (১৯৭৭, সেলিম আল দীন), ‘ফণিমনসা’ (১৯৭৭, সাজেদুল আওয়াল), ‘শকুন্তলা’ (১৯৭৮)। যে কালপর্বে এই নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছিল আমরা আগেই বলেছি তা ছিল ঢাকা থিয়েটারের অন্বেষণের পর্ব।

এই কালপর্বে ঢাকা থিয়েটার নাটকের বিষয় ভাবনা ও আঙ্গিক বিনির্মাণে পুরাণ ভাবনাকে অঙ্গীকৃত করল। ‘শকুন্তলা’ নাটকের মঞ্চায়নে ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য ছিল এমন, ‘পুরাণ নির্মাণের দৃষ্টান্ত বাংলা কাব্যে যতটা আছে, বাংলা নাটকে ততটা নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলা নাটকে পুরাণ এসেছে ধর্মীয় আবেগ থেকে। স্বর্গ ও মর্ত্যরে মিলনের দৃষ্টান্ত ‘শকুন্তলা’ কীভাবে হতে পারে। যার জন্ম বিশ্বামিত্রের তপস্যাভঙ্গের ফলে স্বর্গ-মর্ত্যরে বিরোধভ‚মিতে তার জীবন দ্বন্দ্বহীন গল্প হয় কী করে।’ ‘শকুন্তলা’ নাটকে পৌরাণিক পটভ‚মিতে জীবনের দ্বন্দ্বের গল্প উপস্থাপিত হয়েছে।

১৯৭৯ সালে ‘শকুন্তলা’র ৭৫তম প্রদর্শনীতে ঢাকা থিয়েটার তার নাট্য ভাবনার রাজনৈতিক ও শৈল্পিক অভিঘাতজাত প্রণোদনাকে সরাসরি উচ্চারণ করে এভাবে-‘মুক্তিযুদ্ধের পরোক্ষ উত্তাপ এদেশের মানুষ অনুভব করেছে নাটকের নতুন বিকাশে। বাংলাদেশ একটি জাতির নাম; একটি সংগ্রাম ক্ষুব্ধ অকুতোভয় জনপদের নাম।

যুদ্ধ ঝড় জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে এই জনপদ সমুন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রজ্বলিত করেছে তার সামুদ্রিক দুই চোখে। রক্ষণশীল নাট্যচর্চা সম্পর্কে আমরা যেমন সচেতন, তেমনি সচেতন অপসংস্কৃতি সম্পর্কে। আমরা দেখেছি পরজীবী নাট্যচর্র্চা আধুনিকতার নামে জাতীয় আঙ্গিকের ঐতিহ্যকে অবহেলা করেছে, অবহেলা করেছে নাট্য বিষয়কে। এর জন্য নাট্যচর্চায় তৃতীয় পথের অন্বেষণ অনিবার্য হয়ে পড়েছে। আজ তাই প্রয়োজন নিজস্ব নাট্যকার ও নিষ্ঠাবান মঞ্চকর্মী সৃষ্টি। তারা বিকশিত হবে গ্রæপ থিয়েটারের পদ্ধতি ও কর্মধারার মধ্য দিয়ে।’ 

শকুন্তলা নাটকে ‘দেশজ নাট্যবিষয়’ নিয়ে ভাবনা উচ্চারিত হলো। তারই রূপায়ণ ঘটে আশির দশকে এসে ‘কিত্তনখোলা’ (১৯৮১, সেলিম আল দীন) নাটক মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে। ‘কিত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ (১৯৮৫, সেলিম আল দীন), ‘হাত হদাই’ (১৯৮৯, সেলিম আল দীন)-এই তিনটি নাটককে আমি বলেছি মঞ্চের ট্রিলোজি। বিষয়ের অনুকরণ কিংবা কাহিনির ধারাবাহিকতায় নয়। এটি হলো ফর্মের ট্রিলোজি। সেলিম আল দীনের ধ্রুপদী বাস্তববাদের নাটক কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল ও হাত হদাই মঞ্চায়নের ভেতর দিয়ে ঢাকা থিয়েটার তার শুরুর কালের দেশজ নাট্য বিষয়ক ‘কমিটমেন্ট’ সম্পূর্ণ করতে পেরেছে।

ঢাকা থিয়েটার খুব সচেতনভাবে এমন প্রযোজনার ভেতর দিয়ে হাজার বছরের বাংলা নাটকের উৎসপ্রবণ হয়ে ওঠে। এই কালপর্বে এসে নাটকের আঙ্গিক বদলে গেল, পশ্চিমা ক্লিশে অঙ্ক বিভাজনরীতি থেকে সরে গেল ঢাকা থিয়েটারের নাটক। তাই স্বাভাবিকভাবেই ঢাকা থিয়েটারের সামগ্রিক মঞ্চায়নশৈলী বদলে গেল। এই সময়ে ঢাকা থিয়েটার নাট্যমঞ্চায়নের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রকাশবাদকে গ্রহণ করেছে বাংলা নাটকের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির পেক্ষাপটে।

এটা যেন বাংলা নাটকের হাজার বছরের শেকড়ের টান। ঢাকা থিয়েটার বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক খোঁজার জন্য শিকড়ে ফিরেছে, তার মানে এই নয় যে সংগঠনটি পশ্চাৎমুখিনতার রক্ষণশীল ধারার অনুকরণ করছে। ঢাকা থিয়েটার বাংলা নাটকের শেকড় অন্বেষণ করেছে, কিন্তু আধুনিক বিশ্বনাটক বাদ দিয়ে নয়। নাট্য প্রযোজনায় কিংবা নাট্য রচনায় পাশ্চাত্য যেমন আড়ালে থাকেনি, প্রাচ্যও তেমনি হারিয়ে যায়নি। শেকড় অন্বেষণ তাই ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সমন্বয় হয়ে উঠেছে। 

আশির দশকের ঢাকা থিয়েটারের নাট্য প্রযোজনাগুলোয় এমন রূপ-রীতির দেখা মেলে। ঢাকা থিয়েটার এই চার দশক ধরে বাংলা নাটকের গঠন স্বরূপটি আবিষ্কার করতে চেয়েছে নাট্যরচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ে। অনেক সীমাবদ্ধতা সংগঠনটির রয়েছে, কিন্তু বাংলা নাটকের জাতীয় আঙ্গিক অন্বেষণের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। চার দশকে এটি কম অর্জন নয়। বাংলাদেশের ভূগোলের মধ্যেই স্বয়ম্ভূ হাজার বছরের বাংলা নাটকের রূপ-রীতির অন্বেষা ঢাকা থিয়েটারের শিল্প ভাবনায় চার দশকব্যাপী প্রোজ্জ্বল থেকেছে তা কম কী। এই দশকেই ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যরীতির প্রেরণাজাত ‘কিত্তনখোলা’ নাটকে দৃশ্যের পরিবর্তে সর্গ বিভাজন এসেছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা নিয়ে। 

পাশ্চাত্য নাটকের সুতীব্র ঘটনাপ্রবাহের বদলে এ নাটকে এদেশের আখ্যান কাব্যের চিরায়ত বর্ণনাত্মক রীতিটি নতুন আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কারণেই দৃশ্য বিভাজনের চাইতে সর্গ বিভাজনের প্রক্রিয়াটি এই নাটকে অপরিহার্য বলে বিবেচিত। কিত্তনখোলা নাটকের বিষয়ে এদেশের লোকঐতিহ্য এবং সাম্প্রতিক জীবন ভাবনা সংস্থিত। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকের দৃশ্য বিভাজনের বদলে বৃত্ত পরিকল্পনা, খণ্ডে বিভাজন পাশ্চাত্যের ঘটনা সংঘাতের রীতি থেকে সরিয়ে একটি আলাদা অবয়ব দিয়েছে। ‘হাত হদাই’ নাটকের অঙ্ক বিভাজন প্রচলিত নাট্যরীতির নয়।

সমুদ্রোপকূলীয় জীবনের গল্প সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার মতোই। এই জোয়ার-ভাটার অনুকরণে নাট্যপর্ব বিভাজিত হয়েছে। নাটকে এমন নিরীক্ষা কখনো হয়নি যে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, মহাকাব্যের সর্গ বিভাজন কিংবা দোজখের বৃত্ত পরিকল্পনায় নাটকের দৃশ্য বিভাজন হতে পারে। শুধু যে আঙ্গিক গঠনেই নিরীক্ষা চালু ছিল তা নয়, অভিনয় রীতির দেশজ ধারার পুনঃসৃজনের বিষয়টিতেও গভীর মনোযোগ ছিল। 

এই দশকের অভিনয়শৈলী প্রাচ্য দেশীয় অভিনয় রীতির গীতল ও কাব্যিক বৈশিষ্ট্য অনুসৃত। বাঙালির নিজস্ব এই নাট্যআঙ্গিক, যা বর্ণনাত্মক নাট্যাভিনয় রীতি নামে হাজার বছর ধরে বাহিত হয়ে এসেছে তার আধুনিক প্রয়োগ ঘটিয়েছে ঢাকা থিয়েটার তার প্রযোজনায়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই যে নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে ঢাকা থিয়েটার অগ্রসর হলো তা শুধু নাগরিক নাট্যচর্চায় নিবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে চাইল। লোকজীবন থেকে ঢাকা থিয়েটার সংগ্রহ ও সঞ্চয় করতে চাইল বাংলা নাটকের স্বর্ণসম্ভার। আর এই প্রয়াস থেকেই আশির দশকে সূচিত হলো বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার কার্যক্রম। 

নব্বইয়ের দশকে ঢাকা থিয়েটারের নাট্য প্রযোজনা শিল্পতত্তে¡র দিক থেকে নতুন মাত্রা পায়। নব্য পাঁচালি রীতির যে নাট্যধারা সূচিত হয়েছিল তার পরিপূর্ণতা ঘটে ‘বনপাংশুল’ (১৯৯৮, সেলিম আল দীন) নাটকের মধ্য দিয়ে। ঢাকা থিয়েটারের এ যাবৎকালে নাট্য প্রযোজনা শৈলীতে যে বর্ণনাত্মক অভিনয় রীতি অঙ্গীকৃত হয়েছিল তার চিত্রময় বর্ণনা বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে এক নতুন মাত্রা দেয়। একই সঙ্গে নব্বই দশকে কথকতা রীতির নাট্যাভিনয় চালু করে ঢাকা থিয়েটার। 

এই সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো-‘চাকা’ (১৯৯১, সেলিম আল দীন), ‘একাত্তরের পালা’ (১৯৯৩, নাসির উদ্দীন ইউসুফ), ‘একটি মারমা রূপকথা’ (১৯৯৪, সেলিম আল দীন), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৫, সেলিম আল দীন), ‘বনপাংশুল’ (১৯৯৮, সেলিম আল দীন), ‘প্রাচ্য’ (২০০০, সেলিম আল দীন)। চাকা, যৈবতী কন্যার মন, প্রাচ্য এই তিনটি নাটকে ঢাকা থিয়েটার বাংলাদেশের মঞ্চে বাঙালির কথকতারীতির অভিনয়ের ধারাটিকে বর্ণনা, সংলাপ ও সংগীতে ত্রয়ী সম্মিলনে নতুন রীতির অভিনয়রূপে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের মঞ্চে এটি একেবারেই অভিনব ছিল। সেলিম আল দীন এই রীতির নাম দিয়েছিলেন কথানাট্য। কথার শাসনে বাঁধা বলে কথানাট্য। আমরা লক্ষ করেছি, যে জাতীয় নাট্যআঙ্গিক অন্বেষণের ঘোষণা দিয়ে ঢাকা থিয়েটার যাত্রা শুরু করেছিল ৮০’র দশকের ‘কিত্তনখোলা’ থেকে ৯০’র দশকের কথানাট্যে এসে তা একটি পূর্ণরূপ পরিগ্রহ করে। 

গল্পকথনরীতির ভেতর দিয়ে একটি জাতির বৃহত্তর জনজীবন কিংবা ব্যক্তির আনন্দ-বেদনার মঞ্চপ্রকাশ যে সম্ভব তা ঢাকা থিয়েটার তার এই দশকের প্রযোজনায় তুলে ধরেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ২০০০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ঢাকা থিয়েটারের প্রযোজনায় পূর্ববর্তী শিল্পরীতিরই অনুবর্তন লক্ষ করা যায়। তার মানে কি এই যে, ঢাকা থিয়েটারের তাত্ত্বিক অভিযাত্রার ছেদ কিংবা পরিসমাপ্তি ঘটেছে? তার কি এমন একটি মানে করা যায় যে, ঢাকা থিয়েটার শিল্প সফলতার চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গেছে? সংগঠনটির সাম্প্রতিক আচার সর্বস্বতা দেখে একথা ভাবা যায় যে, তবে কি সংগঠনটি স্মৃতির মিনারে বসে তাদেরই রচিত শিল্পতত্ত্ব রোমন্থন করছে। 

তবে এ কথাও সত্য যে, সেলিম আল দীনের মৃত্যুজনিত শূন্যতা ঢাকা থিয়েটারের নব্যকালের শিল্পতীর্থগামী অভিযাত্রায় নিরন্তর শূন্যতার সৃষ্টি করে চলেছে। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায় ঢাকা থিয়েটার এই ৪০ বছরে সেলিম আল দীন ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের পরে কোনো সৃজনশীল তাত্তি¡ক উত্তরাধিকার তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এ কথা অভিনয়শিল্পী তৈরির ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। এরই প্রভাব আমরা লক্ষ করি গ্রাম থিয়েটারের ক্ষেত্রেও, ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠার এক দশক পর যে সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় নাট্য আঙ্গিকের রূপান্বেষার অভিপ্রায়ে। 

১৯৮২ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে তরুণ প্রজন্মকে পরিশীলিত নাট্যচর্চায় উৎসাহিত করার জন্য গঠন করে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। একই সঙ্গে লোকশিল্পের উজ্জীবন ও লোকশিল্পীদের উদ্বুদ্ধকরণ কাজেও সংগঠনটি নিবেদিত ছিল। একটি দল এবং একটি ভালো নাটক-এই তত্ত্বটি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা থিয়েটারের সদস্যরা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছেন।

আশির দশকের বাংলাদেশে সে এক বৈরী রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজমান ছিল। আমার মনে আছে, ছাত্রজীবনে সেলিম আল দীনের সঙ্গে গ্রাম থিয়েটার গঠনে ছুটে বেড়িয়েছি কত না অঞ্চল! সেই যে শুরু, আজও মিলেমিশে রয়েছি গ্রাম থিয়েটারের সঙ্গে। যদিও সংগঠনটি ৩০ বছর পর তাত্তি¡ক ভিত্তির উপর মিনারের মতো দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। মিনারের পাশে আগের মতো দর্শনার্থীর ভিড় নেই। যারা ভিড় করে আছে এখনো, ওরা অবাক তাকিয়ে ভাবে, একদা কী বিপুল সমারোহে যাত্রা শুরু হয়েছিল গ্রাম থিয়েটারের। 

এরশাদবিরোধী আন্দোলন কিংবা যে কোনো প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের নাট্যকর্মীরা নিষ্ঠার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। একটি ভালো নাটক মঞ্চায়নের জন্য যেমন ছিল তাদের বিপুল আকুতি, তেমনি ভালো নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের কল্পনাও তারা লালন করত। আজ গ্রাম থিয়েটারের উজ্জ্বল সব কর্মীর চোখে কল্পনাটুকু টিকে আছে, কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে প্রতিষ্ঠার প্রথম ১০ বছর পরে আর এগোতে পারেনি। 

একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সংগঠন ছাড়া অন্য সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসীদের আশ্রয়স্থল ছিল গ্রাম থিয়েটার। প্রকাশ্য সংগঠন করতে পারেন না এমন অনেক রাজনৈতিক কর্মীর অংশগ্রহণে মুখর ছিল গ্রাম থিয়েটার। তবু খুব গৌরবের সঙ্গেই বলতে পারি যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিস্তার, দেশজ সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার ও বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্য আঙ্গিকের পুনরুত্থানে ব্যাপক ভূমিকা রাখার মধ্য দিয়ে গ্রাম থিয়েটার একটি নবজাগরণের সূচনা করে। 

গ্রাম থিয়েটারের সেই ব্যাপক জাগরণের কালে শ্যামল প্রান্তরের কোনো বৃক্ষ ছায়ার নিচে বাউলের একতারার টুংটাং ধ্বনি, গাজীর গানের ‘ধুম্বইল’, দীর্ঘ প্রলম্বিত কীর্তনের সুর জীবনের মানে বদলে দিত। আমরা বলতাম-আরেকটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটার অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। আর তার নাম বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার আন্দোলন। সে সময়ে আরণ্যকের মুক্ত নাটক আন্দোলনও একইভাবে শেকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রণোদনায় উৎসারিত হয়েছিল। 

তবে সাংগঠনিক কাঠামোর দিক থেকে গ্রাম থিয়েটার সারা দেশের নাট্য আন্দোলনে গভীর প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। ঢাকা থিয়েটারের উত্থান পর্বের নাট্যচিন্তা ও নাট্য প্রযোজনার সঙ্গে গ্রাম থিয়েটার আন্দোলনের সম্পর্ক রয়েছে এ আলোচনা আমরা আগেই করেছি। একই সঙ্গে একথাটাও বলা দরকার যে তৎকালীন নাট্যদলগুলোর প্রগতিবাদী চিন্তার স্পর্শও রয়েছে গ্রাম থিয়েটারের শরীরে। ঢাকা থিয়েটারের ক্রমোত্থানের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার গভীর সংযোগ রয়েছে। 

স্বাধীনতা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায় বাঙালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্যমুখিনতা এবং মৌলবাদবিরোধী প্রগতিশীল নাট্য চিন্তার যে বিস্তার ঘটে তা নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবন প্রবাহে অভিঘাত সৃষ্টি করে। এই সময়ের সামগ্রিক গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় মৌলবাদবিরোধী চেতনা নাট্যকর্মীদের ভেতরে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে গভীর সংক্ষোভের সৃষ্টি করে। ১৯৭৫ সাল হতে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রগতির বদলে প্রতিক্রিয়াশীলতাকে উৎসাহিত করা হতে থাকে এই কালপর্বে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ব্যাপক উত্থান ঘটে। রাষ্ট্রক্ষমতায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনরুত্থানে নাট্যচর্চা রূপান্তরিত হয় নাট্য আন্দোলনে। নাটকের বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন নাট্যদল একত্রে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রগতিমুখী জীবন ভাবনাকে অঙ্গীকৃত করে নাট্যচর্চাকে বেগবান করে তোলেন। আর এজন্যই নাট্যকর্মীরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছেন। এই রাজনৈতিক সচেতনতার কারণেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরায় এরশাদের সামরিক শাসন জারি হলে রাজনৈতিক ‘কমিটমেন্ট’ থেকেই নাট্যকর্মীরা তার প্রতিবাদ করে।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নেতৃত্বে দেশের প্রায় প্রতিটি সক্রিয় নাট্যদল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। মঞ্চের উজ্জ্বল আলোর নিচে যারা মেকআপ কস্টিউম সজ্জিত হয়ে দর্শকদের সামনে বিনোদনের ডালি নিয়ে হাজির হয়, সেই নাট্যকর্মীদের মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিবাদে ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়। তারা দিনের পর দিন অনশন, সমাবেশ, মানববন্ধন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পথনাটকসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা থিয়েটার নাট্যকর্মীদের সঙ্গে যেমন এই ব্যাপক প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল, তেমনি আন্দোলনের পাশাপাশি বাঙালির নাট্য ঐতিহ্যের শেকড়ের সন্ধানেও ব্রতী ছিল। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ এবং গ্রামে গ্রামে নাট্যদল গঠন করে ঐতিহ্য ও প্রতিবাদের সংমিশ্রণে ঢাকা থিয়েটার নতুন শিল্পতীর্থগামী হয়ে ওঠে। 

ঢাকা থিয়েটার যে জাতীয় নাট্যাঙ্গিক নির্মাণের ব্রত নিয়েছিল তা দেশজ নাট্যবিষয় ও রীতিনির্ভর করে বিশ্বের নাট্যরীতি এবং আমাদের নিজস্ব নাট্যশৈলীর মিথস্ক্রিয়ায় তার প্রযোজনায় ঘটিয়েছিল সচেতন ও স্বতন্ত্র শিল্পশৈলী নির্মাণের অভিপ্রায়ে। এই নাট্যাঙ্গিক নির্মাণের প্রক্রিয়ায় বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক বাসনা সক্রিয় ছিল। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শিল্পচেতনার ক্রম প্রসারের মুখে ঔপনিবেশিক চিন্তাপ্রসূত উন্মূল সংস্কৃতি ও নাট্যচিন্তার বিরুদ্ধে জাতীয় নাট্যাঙ্গিক প্রতিষ্ঠার ভাবনাটি বিশ্বনাটকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের শিল্প সমৃদ্ধিকেই মানোচ্চতা দিয়েছে। আজকের বিশ্বায়ন কিংবা বাজার সংস্কৃতির যুগে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে শিল্প-সংস্কৃতিও ব্যবহারগত উপাদান হয়ে উঠেছে।

এই জটিল সময়ে বাংলার জাতীয় নাট্যাঙ্গিক নির্মাণ এক দুরূহ কর্ম। কিন্তু তারপরও ঢাকা থিয়েটার এই বিশাল নাট্যযজ্ঞ থেকে পিছপা হয়নি। ক্রমাগত ইউরোপীয় নাটকের অনুকৃতি থেকে দূরে থেকেছে বাংলা নাটকের নিজস্ব শৈলী নির্মাণের অভিপ্রায়ে। আমরা লক্ষ করেছি, ইউরোপীয় নাট্যরীতির অঙ্ক বিভাজন এবং সংলাপ প্রতি সংলাপের ক্লিশে ধারা থেকে ঢাকা থিয়েটার নিজের প্রযোজনাকে স্বতন্ত্র রেখেছে, ইউরোপীয় নাটকের বিধিবদ্ধ নিয়মের অনুসারী হয়ে থাকেনি। 

ঢাকা থিয়েটার তার নাট্য প্রযোজনা বা নাট্যচিন্তায় উনিশ শতকের ইংরেজ শাসিত বঙ্গদেশে বাংলা নাট্যচর্চা বিদেশিদের দ্বারা সূত্রপাত হয়েছে বলে যে ধারণা আজও বদ্ধমূল তা স্বীকার করেনি। কিন্তু ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পার করে এসে সংগঠনটি পুনর্বার বিশ্ব পুঁজিনির্ভর সংস্কৃতির করাল গ্রাসে নিপতিত হয়েছে-এ কথা বলছি এ কারণে যে, আমাদের সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে পুঁজির যে বিশ্বায়ন ধারণাটি সংযুক্ত হয়েছে তা আমাদের জগৎ, জীবন ও সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করে নিতে চাইছে। কিন্তু একদিকে আমাদের শেকড়ের প্রতি টান, অন্যদিকে গ্লোবালাইজেশনের তাড়না। আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি কিংবা নাট্যচর্চা এই টানাপড়েনের মধ্যে রয়েছে। 

আজ সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বায়িত পুঁজি। এই বিশ্বায়িত পুঁজি এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতাপ্রসূত সাহিত্যতত্ত্ব আমাদের ঐতিহ্যনির্ভর সব সাহিত্যকে এক কথায় ‘ফোক’ বানিয়ে দিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের হাজার বছরের নাটক এখনো লোক নাটকের অভিধা থেকে মুক্তি পায়নি। ঢাকা থিয়েটার এই একটি জায়গায় প্রত্যয়ী এবং একাগ্র বলেই ১৭৯৫ সালে লিয়েবেদেফের মাধ্যমে বাংলা নাটকের যাত্রা সূচিত হয়েছিল বলে বাংলা নাটকের যে খণ্ডিত ইতিহাস রচিত হয়েছে তার থেকে বেরিয়ে এসে হাজার বছরের বাংলা নাটকের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় তার নাট্যতত্তে¡র ভিত্তি তৈরি করেছে। 

এর ফলে বাংলা নাটকের আদি-মধ্য-অন্ত্য সমন্বিত একটি ইতিহাসের রূপকার হিসেবে ঢাকা থিয়েটার অনন্য উচ্চতায় আসীন হতেই পারে। নাটকের চিরাচরিত আঙ্গিকের বিরুদ্ধেই জাতীয় নাট্যাঙ্গিকের সন্ধান ও প্রয়োগ ঢাকা থিয়েটারকে স্বাতন্ত্রিক মহিমা দান করেছে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে। 

লেখক: সাহিত্য সমালোচক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //