পুরস্কার: হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাবে

পুরস্কার শব্দটিই কি বিতর্কিত? আজকাল অধিকাংশ পুরস্কারের পেছনেই জড়িয়ে যাচ্ছে নানা কথা ও কাহিনি। অনেক সময় পুরস্কার বিতর্কিত না হলেও তা দেওয়ার-প্রক্রিয়া অথবা প্রাপকের সূত্র ধরে তৈরি হচ্ছে বিতর্ক। যা বিতর্কিত করে তুলছে পুরো প্রক্রিয়াটিকেই। ফলে পুরস্কার ঘোষণার আগে যেমন, তেমনি দেওয়ার পরও নানান কথা ও কাহিনি তার ডালপালা মেলতে থাকে। তাতে করে পুরস্কার শব্দটিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। 

এ শুধু আমাদের দেশেই নয়। তামাম দুনিয়াতেই ভারী ভারী পুরস্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে বিতর্ক। পুরস্কার প্রদানের বিষয়টিতে নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন জুড়ে দেওয়া তো হচ্ছেই, সঙ্গে থাকছে আরও হাজারো প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে- ভারী পুরস্কার যার হাতে উঠছে, তিনি ভারী তো নন-ই আবার ধারেও কাটেন না। বরং তিনি কাটেন অন্য কিছুতে। এতে করে ‘যার-তার’ হাতে পুরস্কার উঠে যাওয়ার অভিযোগ প্রচুর। 

আর যিনি পুরস্কার পাচ্ছেন (বলা হচ্ছে পাচ্ছেন না বাগিয়ে নিচ্ছেন),তার দিকে পুরস্কারবঞ্চিতরা তো বটেই সাধারণেও বাঁকা চোখে তাকান। এমনকি আড়ালে তো বটেই, প্রকাশ্যেও তাকে নানা তির্যক বাক্যে মুড়ে দেওয়া হয়। এভাবে মূল পুরস্কারটি যেমন তেমনি যে মহৎ উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে পুরস্কার দেওয়া, সেই উদ্দেশ্যও হয়ে পড়ছে বিতর্কিত। যদিও ব্যতিক্রমও রয়েছে। সে ক্ষেত্রে পুরস্কারবঞ্চিতদের অনেকে আঙুর ফল টক প্রবাদটিকেই উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করেন।

পুরস্কার কে পাবেন, কী তার যোগ্যতা-এটা নির্ধারণের মানদণ্ড রয়েছে, রয়েছে পুরস্কার দেওয়ার কমিটিও। এর পরও যদি যোগ্য কেউ পুরস্কার না পান, তখনই তৈরি হয় বিতর্ক। কিন্তু সেই বিতর্ক কারা তৈরি করেন? যারা পুরস্কার দেন, মানে পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনয়ন কমিটি, তাদেরও রয়েছে একটি নির্ধারিত মানদণ্ড। এই মানদণ্ডকে ধরেই তারা পুরস্কারের জন্য ব্যক্তিকে নির্ধারণ করেন। কিন্তু তাদের সেই নির্ধারণের বাইরে যারা বিতর্ক তোলেন, তাদের মানদণ্ডের পার্থক্য কোথায়? 

একজন যাকে যোগ্য মনে করছেন, তাকে অন্যজন যোগ্য মনে নাও করতে পারেন। একজনের চোখে যিনি সাহিত্য পুরস্কারের যোগ্য, আরেকজনের দৃষ্টিতে তাকে ভালো নাও লাগতে পারে। সাহিত্যে ভালোলাগার ব্যাপারটিই তো আপেক্ষিক। অবশ্য মহৎ সাহিত্য সম্পর্কে অধিকাংশেরই মুগ্ধতা প্রায় সমপর্যায়ে। বিতর্কের পরও, সেই মুগ্ধতার পরিসর বড়। ফলে সেখানে বিতর্ক ধোপে টেকে না। মহৎ সাহিত্যের গুণই এই।

আবার অনেক সময় যোগ্যতার বিচারের চেয়ে অন্যান্য আপেক্ষিক বিষয়কে যখন প্রাধান্য দেওয়া হয়, তখন যোগ্যরা বাদ পড়ে যেতে পারেন। তেমন উদাহরণের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও, হালে তা বাড়ছে। প্রকাশ্যে অনেকেই পুরস্কারকে অস্বীকার করেন। পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া অথবা প্রত্যাখ্যানের তালিকাও রয়েছে। তবে তা খুব দীর্ঘ না। 

আবার চেয়ে পুরস্কার নেওয়ার মতো উদাহরণও কিন্তু আমাদের সামনে রয়েছে। নামি পুরস্কারের ক্ষেত্রে যেমন প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, তেমনি অনামি পুরস্কারের বেলাতে রয়েছে নানা পরিহাসও। নানাভাবে-নানাজনের যেনতেনপ্রকারে একটি পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়ারও খবর চাউর হয় মাঝে মাঝে। যা একদিকে হাস্যরসের জন্ম দেয়, তেমনি কৌতুকেরও।

পুরস্কারের ক্ষেত্রে সাহিত্য পুরস্কারের দিকেই সবার নজর থাকে আগে। এই একটি বিষয়েরই পুরস্কার প্রাপক ও দাতা উভয়ের সংখ্যাই বেশি। যদিও উভয়ের মানদণ্ডই সেই সংখ্যাকে হাতের আঙুলে গুনে ফেলা যাবে। পুরস্কার বিষয়ে এই যে এতটা নেতিবাচক প্রচারণা, তাতে মনে হতে পারে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো স্বমহিমা হারিয়ে ফেলছে পুরস্কার। তবু দিল্লি কা লাড্ডুর মতোই পুরস্কারের প্রতি আমাদের আগ্রহ অপার-অসীম।

বাংলাদেশে উপজেলা পর্যায় থেকে রাজধানী পর্যন্ত বিভিন্ন নামে বিভিন্ন পরিচয়ে দেওয়া হয় সাহিত্য পুরস্কার। সেসব পুরস্কারের মধ্যে ব্যক্তি বা সংগঠন পর্যায়ে হাতে গোনা কয়েকটি পুরস্কার সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও অন্যগুলো আলোচনায় আসে না। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক রাষ্ট্রীয় এই দুটি পুরস্কারের বাইরে সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল।

গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া দুটি বেসামরিক পদকের ক্ষেত্রে সাহিত্য শাখায় পদকপ্রাপ্তরা বিরূপ আলোচনায় এসেছেন। একুশে এবং স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য গত দু বছরে যাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়, সুধী সমাজে তারা তেমন পরিচিত নন। তাদেরকে অনেকেই চেনেন না। এই চেনা ব্যক্তিকে নয়, বরং তার বা তাদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সাধারণের অজ্ঞতা। সাহিত্যে তাদের অবদানও প্রশ্নবিদ্ধ। 

আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে, সম্পূর্ণ অপরিচিত অখ্যাতদের হাতেও পদক তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ যোগ্যরা বঞ্চিত থেকেছেন। সেই বঞ্চিতদের অনেকেই স্বীকৃতি পেয়েছেন মৃত্যুর পর। যা তাদের কোনো কাজে আসে না। গ্রেগরীয় দুহাজার কুড়িতে একুশে পদক ঘোষণার পর গরম হয়ে ওঠে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সাহিত্য বিভাগে পুরস্কারের জন্য যিনি মনোনীত হন, সাধারণের কাছে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি তো দূরের, সাহিত্য সমালোচক বা সাহিত্য যশপ্রার্থীদের কাছেও তিনি ছিলেন অজানা নাম। 

এমনকি যাদের কাছে সাহিত্যের খবর আগে পৌঁছে তাদের হাতের নাগালের মধ্যেও ছিলেন না সেই পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি। এখন যেহেতু কেউ-ই কষ্ট করে মাঠে নামতে আগ্রহী না, তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই প্রতিবাদের বড় জায়গা। 

এখানে জনমতও গঠন করা যায় সহজে। ফলে খুব দ্রুত একুশে পদকের সাহিত্য বিভাগে যিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে নানা কথা-বার্তায় ভরে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়াল। পদকপ্রাপ্তকে সুধীসমাজ চেনেন না বলে অভিযোগের সঙ্গে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কারটি তাকেই দেওয়ার জন্য যারা যোগ্য মনে করেছিলেন, তারা কোন মানদণ্ডে তা করেছিলেন? 

সেই ব্যাখ্যা কি সুধীসমাজ চাইতে পারবে না? বা চাইলে সেই প্রশ্নের উত্তর মিলবে? সাহিত্যরসিক, সাহিত্যপিপাসু এবং সাহিত্য সমালোচকরা যাকে চিনতে পারছেন না-তার রচনা দিয়ে, সেই তাকেই যারা পুরস্কার প্রদান কমিটিতে রেখেছেন-তাকে কোন মন্ত্রবলে চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেন? এ প্রশ্ন তোলা অসমীচীন যেমন নয়, তেমনি অযৌক্তিকও নয়। 

কিন্তু বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য পেছন থেকে যারা কলকাঠি নেড়েছেন, তারা কোনোদিনই সামনে আসবেন না এ বিষয়টি নিয়ে এবং ব্যাখ্যাও দেবেন না। ফলে পুরস্কারপ্রাপ্তকে না চেনার দলের সঙ্গে যারা তার যোগ্যতা নির্ধারণ করে পুরস্কার দিলেন, এই দুই দলের ভেতরের ফারাকও কমবে না হয়তো কখনো। 

সাহিত্যরস পিপাসু মানুষ যখন একুশে পদকপ্রাপ্তের নেপথ্যের তত্ত্বতালাশ করছেন, সেই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাবার আগেইপুরস্কার যেন বিতর্কিত না হয়, পুরস্কার যেন বিতর্কিত কারও কাছে গিয়ে সম্মানহীন না হয়, পুরস্কারের সম্মান যেন নষ্ট না হয়, সেই পরিবেশ থেকে যেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারি, স্বদেশ ও সমাজকে রক্ষা করতে পারি, সেই আলোচনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যখন ত্রুটি বিতর্কের সমাপ্তি টানার সময় এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে, ঠিক তখনই সেই কূট আলোচনাকে রোধ করার পরিবর্তে আরও উসকে দেওয়া হয়। 

এবারে বিতর্ক উসকে দেওয়া হয় স্বাধীনতা পদক ঘোষণার মাধ্যমে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারটির সাহিত্য বিভাগের জন্য যিনি মনোনয়ন পেলেন, তিনি একুশে পদকপ্রাপ্তর চেয়েও অখ্যাত। একুশে পদক প্রাপ্তকে নিয়ে যেটুকু আলোচনা ছিল, এবারে সেই আলোচনা চলতে লাগল আরও জোরেশোরে। পদকের জন্য মনোনীত ব্যক্তির ছবি এবং লেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ট্রল হতে থাকল। 

উৎসাহী অনেক সংবাদ সংস্থা এ বিষয়ে নানা প্রতিবেদনও প্রকাশ করল। এমনকি পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজেও, সংবাদদাতাদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন যে এত বড় পুরস্কার তিনি পাবেন, কখনো ধারণা করেননি। এই আলোচনা-সমালোচনায় মাঝেই খবর বেরুলো সরকার সাহিত্যে স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। 

পুরস্কার প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনটি একই সঙ্গে আনন্দ এবং বেদনার। আনন্দের, কারণ-মানুষ যেভাবে যে মাধ্যমেই হোক প্রতিবাদ করেছে। সেই প্রতিবাদের ভাষা সরকার অনুধাবন করেছে। মানুষের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। 

ফলে অযোগ্য ব্যক্তির হাতে যেন শেষ পর্যন্ত পুরস্কারটি না ওঠে, সে পথ বন্ধ হয়। এই আনন্দের পাশাপাশি খবরটি বেদনার এই অর্থে, যাকে পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল, এ ক্ষেত্রে তার তো কোনো অপরাধ ছিল না। তিনি তো নিজে যেচে পুরস্কার চাইতে যাননি। বরং তাকে দেওয়ার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

পুরস্কার দেওয়ার ফলে তিনি পারিবারিকভাবে সম্মানিত হলেও সামাজিকভাবে মানুষের সাধুবাদ তিনি পাননি, এটি সত্যি। কিন্তু প্রত্যাহারের ফলে তিনি একই সঙ্গে সামাজিক এবং পারিবারিক উভয় ক্ষেত্রেই অসম্মানিত হলেন। এভাবে কোনো মানুষকে অসম্মান করার অধিকার কি আমরা রাখি?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তৃণসম দহে।’ সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি কার বা কাদের মনোনয়নে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারের জন্য অযোগ্যদের মনোনীত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত (বিশেষত সাহিত্যক্ষেত্রে) ব্যক্তিদের নিয়ে গত দু বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সংবাদ মাধ্যমে যেভাবে সমালোচনা হয়েছে, আগামীতে পুরস্কার মনোনয়ন কমিটিতে যারা থাকেন, যাদের মনোনয়নে পুরস্কার অযোগ্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাদের নিয়েও যদি একইভাবে সমালোচনার তীর ছোড়া হয়, তাহলে হয়তো পরিস্থিতি পাল্টাবে। 

অন্যথায় বারবার এভাবে ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে অযোগ্যদের যোগ্য করে তোলার চেষ্টা চলতেই থাকবে। তাই পাপকে নয়, পাপীকেই ঘৃণা করতে হবে। সময় এসেছে পুরনো চিন্তাকে নতুনে রূপদানের। শুভ চিন্তক মানুষেরা আজ মনোযোগের কেন্দ্রে আসছে। সৎ সমালোচনাকে সাদরে গ্রহণ করার উদাহরণ তৈরি হচ্ছে। এ আমাদের জন্য আনন্দের। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //