মুক্তিযুদ্ধের কথাসাহিত্য

১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার সাথে গভীরভাবে মিশে আছে। এবং বাংলাসাহিত্যের প্রতিটি অঙ্গে তা জড়িয়ে রয়েছে। কোনো জাতি তার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তেমনই বাংলাদেশের লেখক বলতেও মুক্তিযুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি অপরিহার্য অংশ তাই মুক্তিযুদ্ধ। 

কবির কলমে কবিতা, গল্পকারের গল্পে, একইভাবে উপন্যাস, ছড়া, নাটক, গান এবং প্রবন্ধে কিংবা স্মৃতিচারণায় মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে নিবিড়ভাবে। স্বদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা নিয়ে সারা দুনিয়ায় গল্প-উপন্যাস কম হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও হয়েছে যা তা খুব সামান্য।

সাহিত্যমানে তা কতটা উচ্চস্তরের সেটি কোনো কথা নয়, ঐতিহাসিকভাবে এ সৃষ্টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সকল লেখক লিখেছেন তাতে উঠে এসেছে, বাঙালির আবেগ, উৎকন্ঠা, আকুতি, সাহস, লড়াই, স্বদেশচেতনা, জীবনবোধ। 

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়েছে একালের অনেক তরুণ সাহিত্যিক-কবি লিখছেন এখন; কিন্তু একালের লেখা স্বচোখে দেখা স্বাধীনতাপরবর্তী প্রথম পর্যায়ের লেখকদের থেকে আলাদা। কারণ, এখন যা লেখা হচ্ছে তার অধিকাংশই কাল্পনিক এবং গবেষণানির্ভর।

ফলে প্রথম পর্যায়ে যারা লিখেছেন তাদের রচনার ঐতিহাসিকতা এবং সাহিত্যমান ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তবে ঐতিহাসিক মূল্যায়নে প্রথম পর্যায়ের সাহিত্য অগ্রগণ্য। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সেকালের লেখকদের স্বচোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত রচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ন।  

এখনকার লেখকরা স্বাধীনতার প্রথম পর্যায়ের লেখকদের মতো ইতিহাসের সেইসকল স্পর্শকাতর বিষয় সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে পারবেন কী, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। 

এ উপলক্ষ্যে বলা যায়- শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’-এর কথা। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ও ২৬ শে মার্চ অধ্যাপক সুদীপ্তর কাছে মনে হয়েছে দুটি রাত নয়, দুটি যুগ যেন। 

পাকিস্তানের দুই যুগের সারমর্ম। বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানীদের দুই যুগের মনোভাবের সংহত প্রকাশ মূর্তি। শাসন ও শোষণ। যে কোন প্রকারে বাংলাকে শাসনে রাখো, শোষণ কর। শোষণে অসুবিধা হলে? শাসন তীব্র কর। আরও তীব্র শাসন। আইনের শাসন যদি না চলে? চালাও রাইফেলের শাসন, কামান-মেশিনগানের শাসন। কামান মেশিনগানের সেই প্রচণ্ড শাসনের রাতেও তিনি বেঁচে ছিলেন। 

লেখক আনোয়ার পাশা ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন তার ডায়েরিতে লেখার মধ্যে, এই সুদীপ্ত লেখক নিজে। স্বচোখে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়টা কেমন? ফলে লেখকের কলমে তা সুনিপুনভাবে উঠে এসেছে। আনোয়ার পাশার রচনাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস বলা হয়। এ সময়ে আরও রচিত হওয়া উপন্যাস রয়েছে, নাটক রয়েছে, রয়েছে কবিতা, ছড়া আর গান। 

আনিসুল হকের লেখা শহীদ আজাদের মাকে নিয়ে মা নামের চমৎকার উপন্যাস রয়েছে। শওকত ওসমানের জাহান্নাম হইতে বিদায়, নেকড়ে অরণ্য, দুই সৈনিক, সৈয়দ শামসুল হকের নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, সেলিনা হোসেনের নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি, হুমায়ূন আহমেদের শ্যামল ছায়া, দেয়াল, আগুনের পরশ মণি ইত্যাদি উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের মর্মবেদনার অনেক চিত্র ভাস্বর হয়ে ওঠে। 

এসব উপন্যাস কল্পনাশ্রয়ী; বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত না হলেও মুক্তিযুদ্ধ বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন নয় মোটেও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের প্রত্যক্ষিত জীবন ও সমাজ এবং অগ্নিগর্ভ সময় ধারণ করে নির্মিত হয়েছে এসব উপন্যাস।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত বাস্তবতা ও সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত কয়েকটি উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত রূপ নিয়ে আলোচনা করা হলো এখানে ১৯৭১ সালে এপ্রিল থেকে জুন, মাত্র তিন মাসে, মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে, আনোয়ার পাশা রচনা করেন ‘রাইফেল রোটি আওরত’। 

এ দিক থেকে বিবেচনা করলে এটিই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাক বর্বররা ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। সেই কালরাতের ভোরের বর্ণনা দিয়েই উপন্যাসটির শুরু। শেষ করেন বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে। প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির জন্য হিন্দুয়ানী নাম তাকে বদলাতে হয়েছে। যুদ্ধের সময় তিনি উপলব্ধি করেন, পাকিস্তানিদের ক্ষোভ শুধু হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্টদের ওপর না, বাংলাভাষার ওপরও। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুই ভাই মালেক ও খালেকের পাকিস্তানপ্রীতি ও রাজাকার মানসিকতার নোংরা চিত্র এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। পাকিস্তানপন্থি বা রাজাকার হওয়া সত্বেও মালেককে হত্যা করে পাক আর্মি। তার স্ত্রী ও কন্যাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। অত্যাচার ও ধর্ষণ শেষে ফেরত পাঠায়। ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেয় তিনশ টাকা। তা দেখে মালেকের উৎফুল্ল, ‘আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরত পাঠাবার সময় চিকিৎসার জন্য তিন শো টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।’ এ ধরনের মানসিকতার লোক বর্তমান সমাজেও বিরল নয়। 

আনোয়ার পাশা অনুমান করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হবেই। বাঙালিকে কেউ রুখে দিতে পারবে না। কিন্তু বুদ্ধিজীবী নিধনের নীলনকশার তালিকা অনুযায়ী বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে রাজাকার ও পাকসেনারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। আনোয়ার পাশা দৈহিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও চেতনার শিখা প্রজ্বলিত হয়ে আছে।

শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’ উপন্যাসটি ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় বসে লেখা। মে মাসে তিনি সেখানে চলে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা মানুষহত্যা, ধর্ষণ, চারদিকে জ¦ালাও পোড়াও, ঘরবাড়ি লুট করে এদেশকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিল।

তাই প্রাণের ভয়ে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে কলকাতায় পালিয়ে যাচ্ছেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, স্কুলের প্রবীণ শিক্ষক গাজী রহমান। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে যেতে তিনি প্রত্যক্ষ করেন পাক বর্বরদের নির্যাতন ও ধ্বংসের জঘণ্য চিহ্ন। তার মন ভেঙে যায়। সারাক্ষণ তিনি আতঙ্কে থাকেন। বর্ডারের কাছাকাছি গিয়ে তার মনে হয় তিনি জাহান্নাম থেকে বিদায় নিতে পেরেছেন। উপন্যাসে গাজী রহমান মূলত শওকত ওসমানেরই প্রতিরূপ। 

মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনা যথেষ্ট দক্ষতার সাথে চিত্রিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড, আনিসুল হকের মা উপন্যাসে।

‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে সেলিনা হোসেন ১৯৭২ সালে একটি গল্প লেখেন। একটি পত্রিকায় ছাপাও হয় সেই গল্প। সেই গল্পটিকেই রূপ দেন উপন্যাসে।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলদিগাঁ গ্রামের কিশোরী বুড়ি। তার চেয়ে বয়সে বেশ বড় বিপত্নীক গফুরের সাথে তার বিয়ে হয়। গফুরের আগের স্ত্রীর সলীম ও কলীম নামে দুটি সন্তান ছিল। বুড়ির ঘরে জন্ম নেয় রইস নামে এক প্রতিবন্ধী ছেলে। তবু ভালোই চলছিল তার সংসার। যুদ্ধে ওলোটপালট হয়ে যায় তার সংসার। সলীম যায় মুক্তিযুদ্ধে। পাক সেনারা কলীমকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। সলীম ও তার সঙ্গীদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে বলে। কলীম কোনো তথ্য না দেয়ায় বুড়ির সামনেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলে পাক আর্মি।

বুড়ির চিন্তার জগত পাল্টে যায়। এ কেমন বর্বর মানুষ ওরা? আদৌ কি ওরা মানুষ! নিরপরাধীকে হত্যা করে! তার মধ্যে জেগে ওঠে দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধচেতনা। একদিন পাক আর্মিদের তাড়া খেয়ে দুজন মুক্তিযোদ্ধা কাদের ও হাফেজ আশ্রয় নেয় বুড়ির ঘরে। পাকসেনারাও তাদের খোঁজে এসে পড়ে বাড়ি। বুড়ি হয়ে ওঠে বাংলার মা। মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে নিজের প্রতিবন্ধী সন্তান রইসকে তুলে দেয় বন্দুকের নলের সামনে। হলদিগাঁ হয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রতীক।

উপন্যাসের নানা শিল্পগুণ বিচারে এসব উপন্যাস অনেকভাবেই সমালোচিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের কথাশিল্পীরা সেই সময়ের যে ছবি এঁকেছেন, ভাষা দিয়ে গেঁথে ফেলেছেন মানুষের যে জটিল মনোজগত, প্রকৃতি, জীবন ও সমাজচিত্র, তা আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অসামান্য দলিল। ইতিহাসের এই বাস্তবতা ও সত্য থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই পাঠমগ্নতা স্বদেশের প্রতি মমত্ব ও দায়িত্ববোধ আরও বাড়িয়ে দেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //