যিনি অবলীলায় বুকপকেটে ভরে দেন স্বপ্নপোকা

হুমায়ুন আজাদ শিশুদের জন্য যে অতুল পৃথিবী গড়েছেন তা নিয়ে আলোচনা এতো কম হয় যে, হয় না বললে মিথ্যে বলা হবে না। সমাজ, রাষ্ট্র, অনিয়ম, দুর্নীতি, মোসাহেবি, চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতি, কুসংস্কার, ধর্মের নামে অনাচারের বিরুদ্ধে বলেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিতা আর কড়া কথা বলেছেন- যে বড়রা সেসব পেরিয়ে ছোটদের জন্য যে তিনি তার অনিন্দ্য ভাষায় রূপকথার মতো সুন্দর দুনিয়া তৈরি করেছেন তা নিয়ে আলোচনার ফুসরত পান না প্রায়শই।

হুমায়ুন আজাদের এই রূপকথার মতো সুন্দর জগতে কোনো রাজকুমার, রাজকুমারী, রাজা-রানী, মন্ত্রি, শাস্ত্রি, রাজবৈদ্য নেই। এখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম-রাড়িখাল। এ গ্রাম সবচেয়ে সুন্দর কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য এ গ্রামের পুবপুকুরে দেখা যায়। সেই সুন্দর দৃশ্য-শাদা সরপুঁটির লাফিয়ে ওঠার দৃশ্য দেখার জন্য অনিঃশেষ দাঁড়িয়ে থাকা যায়।

আমাদের দেশটা রূপকথার কোনো দেশের থেকে কম নয় বরং কিছু বেশিই তা আমাদের চোখের সামনে ছবির মতো তুলে ধরেছেন তো হুমায়ুন আজাদ। পুকুরের কচুরিপানা, খেঁজুরডালের ফাঁক দিয়ে দেখা পূর্ণিমা চাঁদ যে এতো মনোহর, গ্রামের সহজ মানুষের সরলতা এত এত আকর্ষণীয়, সবাই মাছ ধরার মতো সার্বজনীন উৎসব, টিনের চালের বৃষ্টির শব্দের মতো মধুর সংগীত, খেঁজুর গাছের ডালের তৈরি ঘোড়ার মতো মূল্যবান খেলনার কথা-সবই অজানাই রয়ে যেত আমাদের তিনি যদি না লিখতেন ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’ নামের মায়াবি দুনিয়ার বইটি।

হুমায়ুন আজাদ শিশুদের জন্য যখন লিখেছেন তখন তিনি নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন কথকের ভূমিকা। সেই চিরচেনা গ্রামের গল্প কথকের চরিত্র। আর কথক হিসেবে নতুন প্রজন্মকে শুনিয়েছেন মাতৃভ‚মি, মাতৃভাষা, স্বাধীনতা, সংস্কৃতির ঐশ্বর্যের কথা। আর কি মিষ্টি তার বইয়ের নাম। কোথা থেকে বাংলা ভাষা এলো তা জানাতে লিখলেন, ‘কত নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী’। বই হাতে নিয়ে বইটির নাম পড়লেই বোঝা যায় নদীবিধৌত এই পলিদ্বীপের ভাষা কত না চড়াই-উতরাই পার করে আজকের এই রূপ লাভ করেছে।

শুধু কি তাই, আপন মর্যাদা লাভ করতেও কি এ ভাষাকে বুকের রক্ত ঝরাতে হয়নি। এ ভাষায় মনিমাণিক্যের মতো যেসব সাহিত্য রচনা হয়েছে এই ভূখণ্ড জন্মগ্রহণ করার ফলে, এই ভাষায় কথা বলার ফলে নতুন প্রজন্ম যে সাহিত্য উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে তা জানাতে লিখলেন- ‘লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী’। ঠিকই তো এক একজন সাহিত্যস্রষ্টা তো এমন একএকটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমাদের অস্তি-মাংসে-মজ্জায় তার বদৌলতেই তো আমরা নিজেদের বাঙালি বলে চিনতে পারি, গৌরববোধ করতে পারি।

‘আব্বুকে মনে পড়ে’ কিশোর উপন্যাসটি এমন একটি ছেলের এবং তার বাবার গল্প মুক্তিযুদ্ধ যাদের বিচ্ছিন্ন করেছে চিরতরে; কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগে শিশুটির প্রথম তিন বছরের কার্যকলাপ বাবা লিপিবদ্ধ করে রাখেন তার দিনলিপিতে। দিন যায় শিশুটির পিতা ফিরে আসে না। শিশুটি একদিন কিশোর হয়। সে দিনলিপিকে সঙ্গীকে অদেখা পিতাকে সর্বক্ষণ সঙ্গীকে চলতে থাকে পৃথিবীর পথ। তার আব্বুকে মনে পড়ে কারণ সে পিতার সঙ্গে তার কোনো স্মৃতির কথা তার মনে পড়ে না।

একজন মানুষের সবচেয়ে আস্থার স্মৃতি, নিরাপত্তা বোধ হলো তার প্রিয়জনের সান্নিধ্য। সেটি হারিয়ে দুর্বিষহ হয়ে পড়া জীবনকে কোন নান্দনিকতায় রাঙিয়ে নিল ছেলেটি তারই এক অনন্য চিত্র ‘আব্বুকে মনে পড়ে’। মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানোর অপূরণীয় ক্ষতিকে কে-ই-বা এমন স্বল্প আঁচড়ে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারতেন। শুধু সোনালী অতীত আর গৌরবগাঁথা নয়, হুমায়ুন আজাদ তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন নিজেকে, সমসাময়িক সমবয়সী মানুষকে।

‘আমাদের শহরে একদল দেবদূত’ কিশোর উপন্যাসে তিনি রাজধানী শহর তথা দেশের অধঃপতিত অবস্থাকে তুলে আশা করেছেন একদিন আমাদের ঘরের শিশুরাই, দেবদূত রূপে আবির্ভূত হয়ে ঘুণে ধরা ব্যবস্থা ভেঙে তৈরি করবে নতুন দেশ, সমাজ, উড়বে নবকেতন, ধ্বনিত হবে নতুন জয়ধ্বনি। আর তার জন্য তিনি শিশুদের জন্য কিশোরের জন্য লিখে চলেন স্বপ্নের কথা, দেশ-জাতি-মানুষের কথা, তাদের বুকপকেটে পুরে দেন সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আলোকোজ্জ্বল জোনাকিপোকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //