বিদ্যাসাগরের জমিদার ও কৃষক

বাংলা ভাষা থেকে ইংরেজি ভাষা যেসব শব্দ গ্রহণ করেছে তার একটি হলো bhadralok অর্থাৎ ‘ভদ্রলোক’। এই ‘ভদ্রলোক’ বলতে মূলত উনিশ শতকের বাংলায় গড়ে ওঠা হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বোঝানো হয়ে থাকে। নানা লেখক নানাভাবে এই ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির সংজ্ঞা দিয়েছেন। তবে এদের একটি সাধারণ লক্ষণ হলো-এরা কোনো শারীরিক শ্রমনির্ভর কাজ না-করা শ্রেণি।

তাদের মতে শারীরিক শ্রমের কাজ ‘ছোটলোকের’ জন্য, ‘ভদ্রলোকের’ জন্য নয়। তবে চাষাবাদ না করলেও এই শ্রেণির একটি বিরাট অংশ ভূমি থেকে আসা আয়ের অর্থাৎ কৃষক-প্রজার দেওয়া খাজনার উপর কম-বেশি নির্ভরশীল ছিল অর্থাৎ পরশ্রমজীবী ছিল। জমিদার-ভূস্বামী অধ্যুষিত এই ভদ্রলোক শ্রেণির সঙ্গে গ্রামের কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অনতিক্রম্য দূরত্ব এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বৈরী সম্পর্ক ছিল। 

এই ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি মূলত তিনটি বর্ণের বাঙালি হিন্দুদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল-ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ। তবে তথাকথিত ‘নিম্নবর্ণের’ কেউ কেউ ইংরেজি শিখে চাকরি-বাকরি করলে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করে ধনবান হলে তারাও এক পর্যায়ে ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিভুক্ত হতেন। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বাংলায় একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে শুরু করে এবং হিন্দু মধ্যবিত্তদের মতো তারাও ‘ভদ্রলোক’-এর অনেক চরিত্র অর্জন করে। 

উনিশ শতকে কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যশ্রেণিকে অবলম্বন করে যে একটি সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিভিত্তিক জাগরণ হয়েছিল, যাকে অনেকে ‘বাংলার রেনেসাঁ’ বলে থাকেন, তা এই ‘ভদ্রলোক’দের একটি ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে বাংলার নিম্নশ্রেণির শ্রমজীবী মানুষের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের সঙ্গেও এই জাগরণের সম্পর্ক ছিল নিতান্তই পরোক্ষ। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণিরই একজন ছিলেন। তাদেরই একজন হয়েও নানা বিবেচনায় তিনি তাদের থেকে আলাদা ছিলেন। এখানে আমরা শ্রেণিগতভাবে তার নিকটবর্তী ভ‚স্বামী-জমিদারদের এবং শ্রেণিগতভাবে অনেক দুরবর্তী কৃষকদের প্রতি উনিশ শতকের জাগরণের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করব। 

দুই 

উনিশ শতকের ভূস্বামী ও কৃষক সম্পর্কে এই আলোচনা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিয়ে শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ উনিশ শতকের বাংলার কৃষি-কাঠামো নির্ধারিত হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা। আর এই কৃষি-কাঠামো বাংলার হিন্দু মধ্যশ্রেণির অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন, তাদের চিন্তা-ভাবনার প্যাটার্নকে প্রভাবিত করেছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খাজনা দিতে না পারায় ‘সূর্যাস্ত আইনে’ বহু জমিদারি বিক্রি হতে থাকে। 

প্রথম ১০ বছরেই বড় বড় জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে ১৮২০ সালের দিকের সরকারি রাজস্বের হিসাবে অর্ধেক বড় জমিদারি নিলামের মাধ্যমে হাতবদল হয়।১ পুরনো জমিদারদের জমিদারি নিলামে উঠলে সেগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দালালি, মহাজনি কারবার ও অন্যান্য ব্যবসা করে বিত্তশালী হওয়া কলকাতার ধনিকরা কিনে নিতে থাকেন। এভাবে পুরনো ‘অভিজাত’ জমিদার গোষ্ঠীর স্থলে একটি ‘নব্য-জমিদার’ শ্রেণি গড়ে ওঠে। 

এভাবে আঠারো শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ড যখন সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে দূরে সরে আসছে, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে এগোচ্ছে, তখনই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে বাংলাদেশ যৌথ কৃষিস্বত্ব থেকে কৃষিতে ব্যক্তিগত মালিকানার দিকে, পুরনো ধাঁচের সামন্তবাদ থেকে এক নয়া-সামন্তবাদের দিকে এগিয়ে যায়। এর ফলে বাংলার বণিক পুঁজি থেকে শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টির বদলে একদল ভুঁইফোড় জমিদার-ভূস্বামী সৃষ্টি হয়। 

মূলত শহরবাসী এসব নব্য জমিদার খাজনাপ্রাপ্তি নিশ্চিত ও নির্ঝঞ্ঝাট করার জন্য আরেকটি মধ্যস্বত্বভোগীশ্রেণি সৃষ্টি করে। যেরকম শর্তে কোম্পানি-সরকার তাদের সঙ্গে জমিদারি চুক্তি করেছিল একই ধরনের শর্তে, কিন্তু মোটা অঙ্কের সালামি নিয়ে, জমিদাররা তাদের জমিদারি ভাগ করে মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে চুক্তি করে। এদের বলা হতো ‘পত্তনিদার’। এই পত্তনিদাররা ছিলেন নিম্নশ্রেণির ভ‚স্বামী। প্রথম স্তরের পত্তনিদাররা আবার নির্দিষ্ট খাজনার শর্তে দ্বিতীয় স্তরের পত্তনিদারের কাছে জমি পত্তনি দেয়। 

দ্বিতীয় স্তরের পত্তনিদাররা তৃতীয় স্তরের নিকট, তৃতীয় স্তর চতুর্থ স্তরের নিকট-এভাবে কৃষি ভূমির উপর স্বত্ব পর্যায়ক্রমে কোনো স্থানে সাতটি, কোনো স্থানে আটটি আবার কোথাও ১৭টি বা তারও বেশি স্তরে পত্তনি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। জমিদাররা সরকারকে এবং প্রতিটি স্তরের পত্তনিদারও তার উপরের স্তরের পত্তনিদারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাৎসরিক খাজনা প্রদান করে নিশ্চিন্ত মনে ইচ্ছামতো কৃষকদের খাজনা ভোগের অধিকার লাভ করে।

হেস্টিংসের আমলে ১৭৭২ সালে বড় জমিদারের সংখ্যা একশর বেশি ছিল না। কিন্তু পরবর্তী ১০০ বছরে ছোট-বড় মিলিয়ে বাংলায় জমিদারির সংখ্যা বেড়ে দেড় লাখে দাঁড়ায়। ১৯৩১ সালের সেনসাস কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলায় জমিদার খাজনাভোগী মানুষের সংখ্যা ১৯২১ সালে ছিল তিন লাখ ৯০ হাজার; যা ১০ বছরে ৬২ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬ লাখ ৩৩ হাজারে দাঁড়ায়। 

এভাবে জমিদারি কিনে বা জমি পত্তনি নিয়ে উনিশ শতকের ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণির এক বিরাট অংশ চাকরি, ব্যবসার পাশাপাশি ভ‚মি থেকে প্রাপ্ত আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। জীবিকার সঙ্গে সামন্তবাদী স্বার্থ জড়িত হওয়ায় তাদের চিন্তা-ভাবনায়ও পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী চিন্তা-ভাবনার প্রভাব পড়ে। উনিশ শতকের বাংলার তথাকথিত ‘রেনেসাঁ’র নানা সীমাবদ্ধতা এবং ‘রেনেসাঁ’র গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণে নানা বৈপরীত্য এবং তাদের অনেকের মধ্যেই আধুনিকতা ও পশ্চাৎপদতার যুগপৎ সন্নিবেশ হওয়ার অন্যতম কারণও এখানে নিহিত আছে। 

তিন

রামমোহন রায় থেকে শুরু করে উনিশ শতকের বাংলার প্রখ্যাত হিন্দু ব্যক্তিদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ভূমি থেকে আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। সামান্য কজন এর ব্যতিক্রম ছিলেন। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তাদের একজন। বিদ্যাসাগর খুব দরিদ্র, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত পরিবারের সন্তান হলেও এক পর্যায়ে পাঠ্যবই লিখে তিনি যথেষ্ট অর্থশালী হয়েছিলেন। 

তিনি ইচ্ছা করলে অন্যদের মতো ভ‚সম্পত্তি কিনে বা পত্তনি নিয়ে নিশ্চিন্ত জমির আয় ভোগ করতে পারতেন। কিন্তু চিন্তায়-মননে আধুনিক বিদ্যাসাগরের রুচি-আদর্শে সঙ্গে পরশ্রমজীবিতার, খাজনা ভোগের কোনো স্থান ছিল না। তাই তিনি কখনো কোনো জমিদারি কেনার কথা ভাবেননি। বর্ধমানের ‘মহারাজা’ বিদ্যাসাগরকে বীরসিংহ গ্রামের তালুক দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগর যেদিন তিনি নিজে সমস্ত প্রজার খাজনা দিতে পারবেন সেদিন তালুক নেবেন বলেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।

তবে নিজে ভূস্বামী না হলেও বিদ্যাসাগরকে ছোট-বড় নানা জমিদার-ভূস্বামীদের সান্নিধ্যে থাকতে হতো। তাদের ছাড়া তার পক্ষে চলা সম্ভব ছিল না। তার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-কুটুম্বের মধ্যে জমিদার-ভূস্বামীর অভাব ছিল না। তিনি নানাসময় নানাভাবে তাদের সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ মিটিয়ে দিয়েছেন, তাদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে সহায়তা-পরামর্শ দিয়েছেন, এসব কারণে সাক্ষ্য দিতে আদালতেও দাঁড়িয়েছেন। 

আবার ‘রাজা’, ‘মহারাজা’ উপাধি পাওয়া বড় জমিদারদের অনেকেই তাকে নানা বিষয়ে নানাভাবে সমর্থন করেছেন। বর্ধমানের রাজা মহতাব চাঁদ এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজা শ্রীচন্দ্র বিধবা বিবাহের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন বলে বিধবা বিবাহ আন্দোলন অনেক শক্তি অর্জন করেছিল। 

কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ‘সেকালের সকল বড়লোক বিদ্যাসাগরের অনুগত ছিলেন। পাইকপাড়ার রাজারা তাহার কথায় উঠিতেন-বসিতেন। তাহার কথায়, কোনো security না লইয়া তাহার এক ব্যক্তিকে তিন লক্ষ টাকা কর্জ দিয়াছিলেন। বিধবা বিবাহের জন্য ঋণ করা টাকার একাংশ জরুরি ভিত্তিতে শোধ করার প্রয়োজন হলে কাসিমবাজারের রানি স্বর্ণময়ীর কাছে বিদ্যাসাগর টাকা ধার চাইলে রানি কেবল সুদমুক্ত ঋণই দেননি; বলেছিলেন, যখন সুবিধা হবে তখন এই ঋণ পরিশোধ করলে চলবে। আবার জমিদারকুলের নেতা রাধাকান্ত দেবের মতো অনেক জমিদার ও তার সমর্থকগোষ্ঠী বিধবা বিবাহ প্রচলন প্রয়াসের জন্য বিদ্যাসাগরের বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি কেউ কেউ তাকে মারার জন্যও লোক ঠিক করেন। 

জমিদারদের সঙ্গে ওঠাবসা থাকলেও, তাদের প্রভাব-সমর্থনকে নানাভাবে কাজে লাগালেও তাদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেননি বা তাদের অনুগ্রহ চাননি বিদ্যাসাগর। তিনি তাদের চালচলনে প্রভাবিত হননি, তাদের কারণে নিজের চাল-চলন বদলাননি। বর্ধমান-রাজের খুবই প্রিয়ভাজন হলেও বর্ধমানে গেলে তিনি রাজার অনুরোধ সত্ত্বেও তার বাড়িতে থাকতেন না। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, বিদ্যাসাগর একবার এক জমিদারবন্ধুর বাড়ির কাছাকাছি তার পরিচিত দোকানের সামনে চটের উপর বসে গল্প করছিলেন।

এসময় সেই জমিদারবন্ধু জুড়ি গাড়ি নিয়ে সেপথে যাওয়ার সময় এভাবে বিদ্যাসাগরকে দেখে খুবই অস্বস্তি বোধ করেন। পরে তিনি বিদ্যাসাগরকে বলেন যে এভাবে পথে-ঘাটে তার মতো লোককে বসে থাকতে দেখলে লজ্জা হয়। একথা শুনে বিদ্যাসাগর সেই জমিদারবন্ধুকে বলেন, ‘লজ্জা লাগলে আমার সঙ্গে পরিচয় না রাখলেই সব চুকে যায়’৬ শিবনাথ শাস্ত্রীকে তিনি যখন বলেন, ‘ভারতবর্ষে এমন কোন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটিজুতা-সুস্থ পায়ে ঠক্‌ করিয়া লাথি না মারিতে পারি’-তখন রাজা-মহারাজাদের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা প্রকাশ পায় না। 

কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য বলেছেন, একবার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন সরকারের কাছে কোনো এক আবেদন করে অপমানিত হয়। বিদ্যাসাগর অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের বিমর্ষভাব দেখে এসে রসিকতা করে তাদের বলেছিলেন, ‘ওহে আজ political world বড়ই gloom দেখতে পেলাম।’ এই gloom কথাটা তিনি এমন মুখভঙ্গি করে বলেছিলেন যে সেখানে উপস্থিত সকলে হেসে উঠে।

বড় জমিদারদের সংগঠন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি বিদ্যাসাগরের এমন মনোভাব জমিদারগোষ্ঠীর প্রতি তার কোনো প্রীতির ইঙ্গিত দেয় না। তিনি জমিদারি প্রথা বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পক্ষে-বিপক্ষে কিছু না বললেও এই ব্যবস্থার প্রতি তার কোনো সক্রিয় সমর্থন ছিল এমনও মনে হয় না। যে পাইকপাড়ার রাজা তার মুখের কথায় কাউকে তিন লাখ টাকা ধার দিতেন, সেই রাজা প্রতাপচন্দ্র মৃত্যুর আগে বিদ্যাসাগরকে তার সব সম্পত্তির ট্রাস্টি ও নাবালক পুত্রদের একমাত্র অভিভাবক নিযুক্ত করার অনেক চেষ্টা করলেও বিদ্যাসাগর তাতে সম্মত হননি। আসলে শোষণ-নির্ভর জমিদারি ব্যবস্থার সঙ্গে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চাননি। 

বিদ্যাসাগরের স্বার্থহীন সরল ঋজু আচরণের বিপরীতে জমিদারদের সুবিধাবাদী, স্বার্থান্বেষী আচরণ করতে দেখা গেছে। অনেকেই তাকে গাছে তুলে মই সরিয়ে নিয়েছেন। বিধবা বিবাহ যে হিন্দু শাস্ত্রবিরোধী নয় তা প্রমাণ করার জন্য বিদ্যাসাগর তার প্রথম পুস্তিকাটি প্রকাশ করার পর জমিদারদের নেতা রাধাকান্ত দেবকে পাঠিয়েছিলেন।

তিনি পুস্তিকাটি পড়ে এর প্রশংসা করেন এবং পণ্ডিতদের ডেকে একদিন এ বিষয়ে বিতর্কের আয়োজন করেন। বিতর্কে কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও রাধাকান্ত দেব বিদ্যাসাগরের তর্কপ্রণালির প্রশংসা করেন। এতে সবাই ভেবেছিলেন রাধাকান্ত দেব বিধবা বিবাহ প্রচলনের পক্ষপাতী। কিন্তু পরে দেখা গেল তিনিই বিধবা বিবাহবিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

বিধবা বিবাহ আইন পাস করতে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা নারীদের বিয়ের আয়োজন শুরু হওয়ার আগে অনেকেই এককালীন ও মাসে মাসে এজন্য অর্থ সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; কিন্তু পরে তাদের অধিকাংশই কথা রাখেননি। বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিভিন্ন বন্ধুর সহায়তায় তিনি শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন কালীমতী দেবীর মধ্যে প্রথম বিধবা বিবাহের যে আয়োজন করেছিলেন, কথা দিয়ে তাদের অনেকেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আসেননি এবং তাদের মধ্যে রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায়ও ছিলেন।

একসময় বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বহুবিবাহ রোধ করে আইন করার দাবি উঠলে ইংরেজ সরকার দুজন ইংরেজ ও বিদ্যাসাগরসহ পাঁচজন বাঙালি সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে। বিদ্যাসাগরকে অবাক করে দিয়ে কমিটির তিনজন জমিদার সদস্য এই মত দেন যে শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার হলে বহুবিবাহ এমনি উঠে যাবে, আইন বানানোর দরকার নেই! অথচ আগে তারা বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। তাদের এই মত পরিবর্তনের পেছনে ছিল বর্ধমানের মহারাজের সঙ্গে কলকাতার জমিদারদের মর্যাদার দ্বন্দ্ব। 

বহুবিবাহ রোধ করার জন্য বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে সরকারের কাছে দেওয়া আবেদন পত্রে বর্ধমানের ‘মহারাজার’ নাম সবার উপরে থাকায় ওই তিনজন এই ডিগবাজি দিয়েছিলেন। তত্ত¡বোধিনী সভা ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে বিদ্যাসাগর সংশ্লিষ্ট থাকার সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আচরণে নানা অসঙ্গতি দেখতে হয়েছে, অসুস্থ অক্ষয় দত্তের প্রতি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দয় মনোভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে।

চার

যাদের জমিদারি ছিল তাদের সঙ্গে কৃষকের স্বার্থের একটি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ছিল। এ কারণে তাদের অনেক সময়ই খোলাখুলিভাবে কৃষক স্বার্থের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে। বাংলার নবজাগরণের অনেক বড় নেতাও প্রজাপীড়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কিন্তু জমিতে বিদ্যাসাগরের কোনো স্বার্থ না থাকায় কৃষকের স্বার্থের সঙ্গে তার কোনো বিরোধ ছিল না। এ কারণে কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তাকে কখনো দেখা যায়নি। তিনি তার গ্রামের দরিদ্র রাখাল বালকদের জন্য নাইট স্কুল খুলেছেন। দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে গ্রামের দরিদ্র মানুষের জন্য অন্নসত্র, নিজ হাতে তাদের সেবা করেছেন। 

কৃষকসহ গরিব মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল অকৃত্রিম ও নিঃস্বার্থ, অন্যদের মতো লোক দেখানো নয়। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতা কলেজ স্কোয়ারে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য খোলা অন্নছত্রে আসা দরিদ্র মেয়েদের চুল দেখে বিদ্যাসাগর প্রত্যেকের জন্য দু’পয়সার তেলের ব্যবস্থা করে দিলেন। হাড়ি, ডোম, মুচি প্রভৃতি তথাকথিত ‘নিচুজাতের’ মেয়েদের তেল বিক্রেতারা ছোঁয়া বাঁচিয়ে একটু দূরে থেকে তেল দিত।

এ দেখে বিদ্যাসাগর নিজের হাতেই হিন্দুসমাজে ‘অস্পৃশ্য’ এসব গরিব-দুঃখীকে রুক্ষ চুলে তেল মাখিয়ে দিতেন! এই দৃশ্যে বিদ্যাসাগরের জায়গায় অন্য কোনো ‘ভদ্রলোক’কে কল্পনা করা যায় না। শেষ জীবনে কার্মাটারে দরিদ্র সাঁওতালদের মধ্যে তিনি যে সততা ও সরলতা দেখেছেন, তার ফলে ভদ্রলোকদের চেয়ে এই ‘অসভ্য,’ সাঁওতালদের তার অনেক আপন মনে হয়েছে। তিনি সেখানে স্কুল খুলেছেন, ঘরে ঘরে গিয়ে সাঁওতালদের চিকিৎসা করেছেন। 

কৃষকদের প্রতি বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বিতর্কটি তৈরি হয়েছে ১৯৭০ সালে রাজশাহী থেকে গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামক সঙ্কলনে বদরুদ্দীন উমরের লিখিত প্রবন্ধ এবং সেই প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়ার ১৩৯৭-এর শারদীয় সংখ্যা ‘পরিচয়’-এ প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের ‘বিদ্যাসাগর, বাঙলার কৃষক এবং মার্কসবাদ’ প্রবন্ধ দিয়ে। বদরুদ্দীন উমর সেই প্রবন্ধের জবাব দেন যা ‘পরিচয়’-এ ছাপা হয়। প্রবন্ধটি তার ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ বইয়ের পরিশিষ্টে আছে। প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য তার ১৯৭২ সালের রচনাটি কিছুটা অদলবদল করে ‘বিদ্যাসাগর এবং বেসরকারী সমাজ’ নামে তার ‘টীকা-টিপ্পনী’ (১৯৯৮) বইতে অন্তর্ভুক্ত করেন। 

কলকাতা থেকে বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষে ‘সংবর্তক’-এর বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যায় এই লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’-এর প্রথম ভারতীয় সংস্করণ ১৯৮০ সালে ভারত থেকে বের হওয়ার পর পরই তা নিয়ে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় বেশ কিছু সমালোচনা বের হয়। এর মধ্যে অশোক রুদ্রের একটি সমালোচনা ‘শতাব্দীর বিচার’ নামে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 

যেখানে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও কৃষক প্রশ্নে উমরের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। উমর ‘শতাব্দীর বিচার প্রসঙ্গে’ নামে এই সমালোচনার জবাব লেখেন, যা ‘শতাব্দীর বিচার না অবিচার’ নামে কিছু কাট্ছাঁট্ করে অনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়। ‘শতাব্দীর বিচার প্রসঙ্গে’ নামে উমর আনন্দবাজার পত্রিকায় যে লেখাটি পাঠিয়েছিলেন তা তিনি ১৯৮১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’-এর দ্বিতীয় সংস্করণের পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯৭০ সালে যখন নকশাল আন্দোলন তুঙ্গে এবং কলকাতায় নকশালীরা যখন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙছেন এমন একটি সময়ে এদেশের নকশাল আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত (কিন্তু মূর্তি ভাঙ্গা আন্দোলনের বিরোধী) কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গণশক্তির সম্পাদক বদরুদ্দীন উমরের প্রবন্ধের সুর বেশ চড়া তারে বাঁধা ছিল সন্দেহ নেই। যাকে উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁ বলা হয়, ইউরোপীয় রেনেসাঁর তুলনায় তা যে নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উপর মধ্যবিত্ত বাঙালির নির্ভরশীলতা এবং কৃষকদের স্বার্থের প্রতি তাদের বৈরী মনোভাবের কথা বলা হয় এই প্রবন্ধে।

উমর উনিশ শতকের মধ্যবিত্তের প্রগতিশীল অংশের প্রতিনিধি হিসেবে বিদ্যাসাগরের দার্শনিক ও শিক্ষা-চিন্তা, বিধবা বিবাহ প্রচলন ইত্যাদির গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। তবে তিনি বিদ্যাসাগরের চিন্তাকে সংস্কারমুখী বলে শনাক্ত করে বলেন যে তার চিন্তাধারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও ভ‚মি ব্যবস্থার উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত ছিল না। দীনবন্ধু মিত্র এবং ‘হিন্দু প্যাট্রিয়টের’ সম্পাদক হরিশ্চন্দ্রের মতো নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা ঈশ্বরচন্দ্র কোনোদিন চিন্তাও করেননি। 

তিনি কৃষক সমাজের সুখ-দুঃখের প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। পরবর্তীকালে লেখা ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’ বইতে তিনি তার বক্তব্য আর বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেন এবং বিদ্যাসাগরকে উনিশ শতকের বাংলাদেশের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণির প্রগতিশীলতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন। বইটির সুর প্রবন্ধের মতো চড়া তারে বাঁধা না হলেও দুটি রচনার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত বড় পার্থক্য নেই।

প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য ও অন্যান্য যারা বিদ্যাসাগরকে কৃষক-বান্ধব হিসেবে প্রমাণ করতে চান তারা মূলত বিভিন্ন সময়ে কৃষক ও অন্যান্য দরিদ্র মানুষের প্রতি তার দয়া-দক্ষিণা, দুর্ভিক্ষ-মহামারিতে গরিব চাষিদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলেন। নানা সময়ে নানা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর দেশের দরিদ্র-অনাহারক্লিষ্ট লোকের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে যা বলেছিলেন তার উদাহরণ দেন।

কর্মাটাঁরে সাঁওতালদের প্রতি বিদ্যাসাগর যে দরদ দেখিয়েছিলেন তার উদাহরণ টেনে এমন কথা বলতে চাওয়া হয় যেন বিদ্যাসাগর তার শ্রেণির মানুষদের ত্যাগ করে সাঁওতালদের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। প্রদ্যুম্ন ১২৮০ সালের ‘সাধারণী’ পত্রিকার একটি খবরের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে যে একসময় ‘জনরব’ উঠেছিল যে বিদ্যাসাগর এমন একটি কৃষক সভা তৈরি করতে চান যেখানে জমিদাররা থাকবেন না। 

এই ‘জনরব’কেও তিনি বিদ্যাসাগরের কৃষকপ্রীতির প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরেন। যদিও এমন কোনো সংগঠন বিদ্যাসাগর গঠন করেননি। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায় কৃষকদের উপর নীলকর-জমিদারদের অত্যাচারের কথা এবং কৃষক-প্রজার পক্ষে লেখা থাকত। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগেই ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার বন্ধু দ্বারকানাথ বিদ্যাভ‚ষণকে এই পত্রিকার সম্পাদক করা হয়। প্রথমদিকে বিদ্যাসাগর এই পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে দ্বারকানাথকে মাঝেমধ্যে উপদেশ-পরামর্শ দিতেন। এ কারণে ‘সোমপ্রকাশ’-এ কৃষক স্বার্থের অনুকূল বিভিন্ন লেখার পেছনে বিদ্যাসাগরের পরোক্ষ অবদান আবিষ্কার করা হয়। 

বিদ্যাসাগরের দুঃখী-দরিদ্রের প্রতি অপার করুণা ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাদের নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেছেন। দুর্ভিক্ষ-মহামারির সময় অনাহারক্লিষ্ট-রোগক্লিষ্ট মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু যেভাবে বিধবা বিবাহ প্রচলন, শিক্ষা প্রসার, নারী শিক্ষা, বহুবিবাহ রোধ, ভাষা নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভেবেছেন এবং নিজেকে এসব কাজে নিয়োজিত করেছেন সেভাবে কৃষকের সমস্যা তাকে ভাবিয়েছে বা এসবের সমাধান নিয়েও তিনি চিন্তিত ছিলেন এমন প্রমাণ তার লেখায় বা কাজে পাওয়া যাবে না।

তবে কেউ কেউ এ বিষয়েও বিদ্যাসাগরের লেখাও আবিষ্কার করেছেন। যেমন-পূর্বোক্ত ‘সংবর্তক’ বিদ্যাসাগর বিশেষ সংখ্যায় পূর্ণেন্দু শেখর মিত্র ‘বিদ্যাসাগর, সোমপ্রকাশ ও বাংলার কৃষক সমাজ’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার উপর প্রাথমিকভাবে বিরূপ ছিলেন না। কিন্তু কর-বিন্যাস ও জমির স্বত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জমির স্বত্ব হারিয়ে প্রজারা পথে বসবে এবং জমিদারের স্বেচ্ছাচারিতায়, করের চাপে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার সম্ভাবনা।’ তার এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি বিদ্যাসাগরের ‘বাংলার ইতিহাস দ্বিতীয় ভাগ’ (১৮৪৮) বই থেকে নিচের অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছেন: 

‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হওয়াতে, বাঙ্গালা দেশের যে সবিশেষ উপকার দর্শিয়াছে ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এরূপ না হইয়া, যদি পূর্ব্বের ন্যায় রাজস্ব বিষয়ে নিত্ত নূতন পরিবর্তনের প্রথা থাকিত, তাহা হইলে এ দেশের কখনই মঙ্গল হইত না। কিন্তু ইহাতে দুই অমঙ্গল ঘটিয়াছ; প্রথম এই যে, ভূমি ও ভূমির মূল্য নিশ্চিত না জানিয়া, বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। তাহাতে কোন কোন ভূমিতে অত্যন্ত অধিক, কোন কোন ভূমিতে অতি সামান্য কর নির্দ্ধারিত হইয়াছে; দ্বিতীয় এই যে, সমুদয় ভূমি যখন বন্দোবস্ত করিয়া দেওয়া গেল, তখন যে সমস্ত প্রজারা আবাদ করিয়া, চিরকাল ভূমির উপর উপস্বত্ব ভোগ করিয়া আসিতেছিল, নূতন ভ‚মধ্যকারীদিগের স্বেচ্ছাচার হইতে তাহাদের পরিত্রাণের কোন বিশিষ্ট উপায় নির্দিষ্ট করা হয় নাই।’ 

বিদ্যাসাগরের জীবন ও নানা রচনা পাঠ করে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাভাবনার প্রকৃতি সম্পর্কে যাদের সামান্য ধারণা হয়েছে তাদের কাছে ১৮৪৮ সালে, মাত্র ২৮ বছর বয়সের বিদ্যাসাগরের পক্ষে এরকম কথা লেখা একটু বেখাপ্পা মনে হবে। বিদ্যাসাগরের অনুবাদ গ্রন্থটি মার্শম্যানের ‘আউটলাইন অব দি হিস্টরি অব বেঙ্গল’-এর অনুবাদ, তবে অবিকল অনুবাদ নয়।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি সংযোজন-বিয়োজন করেছেন বলে বইটিতে বিদ্যাসাগরের নিজের বক্তব্য থাকা অসম্ভব নয়। কৌত‚হল বশে মার্শম্যানের মূল বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, উল্লিখিত অনুচ্ছেদ বিদ্যাসাগর হুবহু মার্শম্যানের বই থেকে অনুবাদ করেছেন। অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কৃষকদের দুর্গতির কথাটা ভেবেছিলেন ইংরেজ লেখক জন ক্লার্ক মার্শম্যান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নয়। 

কৃষকের স্বার্থের প্রতি বাংলার মধ্যশ্রেণির একটা নির্লিপ্ততা ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহের সময় এই নির্লিপ্ততা বিরোধিতায় রূপান্তরিত হয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ, ফারাজী আন্দোলন, তিতুমীরের কৃষক বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহের প্রতি বাংলার মধ্যশ্রেণির মনোভাব নিতান্তই বৈরী ছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল নীল বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহে উনিশ শতকের বাংলার মধ্যশ্রেণির সমর্থন ছিল, এক ধরনের অংশগ্রহণও ছিল। 

এর কারণ প্রথম দিকে বাংলার জমিদার শ্রেণি নীলকরদের সমর্থক ও সহযোগী থাকলেও কালক্রমে নীলকরদের সঙ্গে জমিদার শ্রেণিরও স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া নীল বিদ্রোহ জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত না হয়ে মূলত নীলকরদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। নীলবিদ্রোহ সমর্থন করা বাংলার মধ্যশ্রেণির কৃষক প্রীতির কোনো নিদর্শন যে ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় নীলবিদ্রোহের কয়েক বৎসর পর সংগঠিত সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের সময়। যেসব বুদ্ধিজীবী, পত্র-পত্রিকা নীলবিদ্রোহের সময় বিদ্রোহের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন তারাই সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহের সময় সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বিদ্রোহের তীব্র বিরোধিতায় নিয়োজিত হন।

বিদ্যাসাগর তার সময়ে কৃষক-আদিবাসী-শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন এমন ভাবার কারণ নেই। কারণ কলকাতার বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় প্রতিটি বিদ্রোহের খবরই কম-বেশি প্রকাশ হয়েছে। এসব পত্রিকার অধিকাংশই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও কোনো কোনো পত্রিকায় বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতি যে আদৌ দেখানো হয়নি তা নয়। কিন্তু বিদ্যাসাগর এসব বিষয়ে নির্লিপ্ত ছিলেন। তিনি নীলকরদের বা জমিদারদের পক্ষে যেমন কিছু বলেননি তেমনি কৃষকদের আন্দোলন-বিদ্রোহের পক্ষেও কিছু বলেননি।

পরবর্তীকালে যে কার্মাটারে সাঁওতালদের দুঃখ-কষ্ট দেখে তিনি আন্তরিক সহানুভূতি ও দরদ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সিধু-কানুর সাঁওতাল বিদ্রোহের (১৮৫৫-৫৭) সময় সেই সাঁওতালদের প্রতি তার কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তিনি নানা সময়ে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সোমপ্রকাশ’ এবং হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যুর পর ‘হিন্দু-প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব পত্রিকায় কৃষকের সমস্যা ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে নানা লেখা ছাপা হলেও বিদ্যাসাগর কোথাও কিছু লেখেননি।

আসলে বিদ্যাসাগর যেমন কোনো সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করতেন না তেমনি কোনো সাময়িকপত্রেও তেমন লেখেননি। কৃষকদের সমস্যা কেন আরও অনেক বিষয়েই তিনি কিছু লেখেননি। তিনি ছিলেন একজন কর্মবীর। যে কাজটি করার সিদ্ধান্ত নিতেন পুরো শক্তি নিয়ে, ধনুকভাঙা পণ করে সেই কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতেন, এর জন্য যখন যা প্রয়োজন নামে-বেনামে তা লিখতেন। 

পাঁচ

অতএব বিদ্যাসাগরে আমরা একজনকে পাচ্ছি যিনি উনিশ শতকে ছোট-বড় জমিদার-ভ‚স্বামীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থেকেও, তাদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা করেও তাদের থেকে চিন্তা-চেতনায়, বেশ-ভূষায়, চালচলনে দৃশ্যমানভাবে পৃথক ছিলেন। ‘ভদ্রলোক’দের বৃত্তে বসবাস করলেও সেখানে তিনি বেমানান ছিলেন। কিন্তু সেই বৃত্ত অতিক্রম করার দিশা তার ছিল না। চতুর্দিকে একটি নব্যসামন্তবাদী পরিবেশের মধ্যে একটি বুর্জোয়াসুলভ আধুনিকতা নিয়ে তিনি বিপাকেই পড়েছিলেন। 

জীবনের শেষ দিকে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘এদেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নূতন মানুষের চাষ করিতে পারিলে, তবে এদেশের ভাল হয়।’-একথা এদেশের কৃষক-শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ প্রসঙ্গে বলেননি, বলেছিলেন ‘ভদ্রলোক’, খাজনাভোগী মধ্যশ্রেণিকে সামনে রেখে। আসলে ‘পুরানো প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি’-র ‘ভদ্রলোকদের’ বাতিল করে তিনি নতুন চিন্তার আধুনিক মানুষের সন্ধান করেছিলেন। 

আমরা আরও দেখলাম দরিদ্র নিম্নশ্রেণির মানুষের প্রতি সহানুভ‚তির কোনো অভাব না থাকলেও কৃষকের সমস্যার সমাধান করা বা তাদের স্থায়ী দুর্দশার অবসান ঘটানো বিদ্যাসাগরের কর্মতালিকায় ছিল না। তার সময়ের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে সেটি আশা করাও সমীচীন নয় এবং এজন্য উনিশ শতকের মধ্যশ্রেণির সবচেয়ে প্রগতিশীল ও আধুনিক মানুষ হিসেবে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব একটুও ক্ষুণ্ন হয় না। 

লেখক: প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //