জনগণের মুক্তির প্রশ্ন

১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ এই সময়কালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রধান ধারাটি ছিল জাতীয়তাবাদী; তবে জাতীয়তাবাদের ভেতর ভয়ঙ্করভাবে প্রবেশ ঘটেছিল সাম্প্রদায়িকতার, যার ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম বিভক্ত হয়ে গেছে, এবং যে মুক্তি স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল তা অর্জিত হয়নি। মুক্তির অর্থ ছিল ধর্ম, শ্রেণি ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর মুক্তি।

একদিকে ভারতবর্ষের মানুষের তুমুল আন্দোলন, অপরদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের দুর্দশা এবং আন্তর্জাতিক (বিশেষভাবে উত্থানে-উন্মুখ আমেরিকার) চাপ ও হিটলারকে পরাভূত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল সাফল্য-এ সমস্ত কারণে ব্রিটিশ শাসকেরা বুঝতে পারছিল ভারতবর্ষে আর থাকা যাবে না। তখন তারা ঠিক করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে। বলা বাহুল্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ওই দুই রাজনৈতিক দল সৃষ্টির পেছনে ব্রিটিশের উৎসাহ-দান ছিল প্রত্যক্ষ। দল দুটির নেতৃত্বে ছিল যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সেটিও গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যেই। 

বড় আকারে ব্রিটিশবিরোধী প্রথম অভ্যুত্থানটি ঘটে ১৮৫৭ সালে। সিপাহিরা ছিলেন সে অভ্যুত্থানের মূল শক্তি, তবে দেশীয় শাসকরাও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছিলেন। এর আগে ও পরে বিক্ষিপ্ত আকারে বিদ্রোহ ঘটেছে, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কিন্তু সমগ্র ব্রিটিশ ভারতব্যাপী কোনো অভ্যুত্থান ঘটেনি। ১৮৫৭-এর অভ্যুত্থানে ব্রিটিশদের টনক নড়ল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে দখলকৃত ভারতবর্ষকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ করে ফেলা হলো। আর অভ্যন্তরে সদ্য-গঠিত মধ্যবিত্তকে উৎসাহিত করা হলো একটি রাজনৈতিক দল গঠনে। এর পেছনে কারণ ছিল দুটি। প্রথম কারণ, মধ্যবিত্তকে ক্ষোভ প্রকাশ ও আবেদন-নিবেদন জানাবার জন্য একটা বন্দোবস্ত করে দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, ভবিষ্যতের কোনো অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা। সিপাহি অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত যোগ তো দেয়ইনি, উল্টো বিরোধিতাই করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল। সুরেন্দ্রেনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হয়ে উঠছিলেন; তাদের উদ্যোগের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেওয়াটাও আবশ্যক ছিল। 

ব্রিটিশের আনুকূল্যেই তাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হলো। কিন্তু তাতেও দেখা গেল ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। ব্রিটিশ শাসকেরা তখন তাদের ব্যবহৃত ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি প্রয়োগ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করল স্বতন্ত্র একটি দল গঠনে। ফলে গঠিত হলো সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। এর আগে আদমশুমারিতে হিন্দু ও মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্রভাবে দেখানো হয়েছে, এমনকি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও হিন্দু যুগ এবং মুসলমান যুগ নামে কৃত্রিম যুগ বিভাজন খাড়া করা হয়েছে; ভাগ করো ও শাসন করো নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতাতেই ব্যবস্থা করা হলো পৃথক নির্বাচনের। নির্বাচনে ভোটাধিকার ছিল শতকরা মাত্র দুই জনের; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। চাপের মুখে ছাড় দিয়ে শাসকেরা নির্বাচনের ব্যবস্থা করল বটে, তবে স্থির করে দিল যে হিন্দুরা ভোট দেবে হিন্দুদেরকে, মুসলমানরা মুসলমানদেরকে। ওই ব্যবস্থা ১৯৪৬-এর নির্বাচন পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছিল। ভোটাধিকার বেড়েছিল সামান্য, মাত্র ১২ শতাংশ পর্যন্ত; তবে হিন্দু-মুসলমান যে এক সঙ্গে ভোট দেবে এমন সুযোগ ছিল না। 

ব্রিটিশ আগমনের আগ পর্যন্ত উপমহাদেশে সম্প্রদায় ছিল ঠিকই, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশ শাসনে সৃষ্টি। হিন্দুরা ছিল সংখ্যায় বেশি, এবং তাদের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠাও ছিল অধিকতর শক্তিশালী; কিন্তু মুসলমানরাও সংখ্যায় কম ছিল না, জনসংখ্যার তারা ছিল এক-চতুর্থাংশ, এবং এক সময়ে তারা ভারতবর্ষকে শাসনও করেছে। কাজেই দুই সম্প্রদায়ের ভেতর রেষারেষিটা যে অস্বাভাবিক ছিল এমনটা বলা যাবে না; কিন্তু তাকে তীব্র বিরোধিতায় পরিণত করা এবং সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়ার কাজটা মূলত ব্রিটিশরাই করেছে। 

ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন; কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের আর্থ-সামাজিক শক্তিটা ছিল বেশি, তদুপরি আন্দোলন যাতে কিছুতেই সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে না যায়, এবং রাশিয়ার মতো কোনো বিপ্লব যাতে ভারতবর্ষে না ঘটে তার ব্যবস্থা করার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্ব জাতীয়তাবাদীদেরকেই সমর্থন দিত, দমন করতে চাইত সমাজতন্ত্রীদেরকে। সে জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদীদের হাতেই রয়ে গেল, এবং জাতীয়তাবাদীরা হিন্দু-মুসলমান দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষ বাধিয়ে ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির নামে দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটাল। আধুনিককালে ভারতবর্ষের প্রথম ট্র্যাজেডি ১৭৫৭-তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি ১৯৪৭-এ দেশভাগ। 

১৯৪৫-৪৬ সময়টাতে ভারতবর্ষের কোথাও কোথাও প্রায় বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। শ্রমিক অসন্তোষ, ছাত্র আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, নৌ বিদ্রোহ, এবং বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর, তেভাগা আন্দোলন, তেলেঙ্গানায় কৃষক অভ্যুত্থান-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল একটি বিপ্লব আসন্ন। সেই সম্ভাবনার মোকাবিলা করবার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে ১৯৪৬-এ নির্বাচন দেওয়া হয়। নির্বাচনের আগে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তাতে ভারতবর্ষ তিন এলাকায় ভাগ হতো বটে, তবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকত। কেন্দ্রের হাতে মাত্র তিনটি বিষয়-দেশরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ রেখে বাকিগুলো প্রদেশের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব পাকিস্তানের দাবিকে কার্যত নাকচ করেই দিয়েছিল। মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর বেশি পাওয়া যাবে না দেখে ওই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। বাদ সাধলেন কংগ্রেসের সভাপতি জওহরলাল নেহরু। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রশাসনের। ফেডারেল ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব কংগ্রেসের কেউ কেউ মানতে রাজি হলেও তিনি রাজি হলেন না। ফলে ক্যাবিনেট প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল, এবং জিন্নাহ তার পাকিস্তান দাবিকে উগ্র করে তুললেন, ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবস পালনের তিনি ঘোষণা দিলেন।

সংগ্রামটা যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে সেটা বোঝা গেল, কিন্তু কার বিরুদ্ধে তা জানা গেল না। জিন্নাহ সরাসরি বললেন না যে এটি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, এমনও বললেন না যে ওর লক্ষ্য ব্রিটিশ-কংগ্রেসের ঐক্যের বিরুদ্ধে; ফলে কংগ্রেসের হিন্দু মহাসভাপন্থিরা এবং হিন্দু মহাসভা নিজে তো বটেই, সুযোগ পেল একথা প্রচারের যে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম আসলে হিন্দুদের বিরুদ্ধেই। সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলায় তখন মুসলিম লীগের শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’টা তাই বাংলাতেই সর্বাধিক প্রত্যক্ষ হবে এমন সম্ভাবনা দেখা গেল; এবং বাস্তবেও সেটাই ঘটল। বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার একটি ভুল করে বসল, তারা ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ দিবসকে ছুটির দিবস ঘোষণা করল। তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে এমন ধারণা তৈরি হলো যে সরকার চায় তারা আক্রান্ত হোক। দাঙ্গা বাধলে লুটপাটের ও গুণ্ডামির সুযোগ পাওয়া যাবে, এমন আশায় উভয় সম্প্রদায়ের গুণ্ডাপ্রকৃতির লোকেরা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে।

কোন সম্প্রদায় কতটা দায়ী এটা নিয়ে তর্ক ছিল। এখনো আছে; কিন্তু উসকানিদাতা যে ব্রিটিশরাই ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রাণ ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু ইউরোপীয়দের কোনো ক্ষতি হয়নি। সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর ঘটনা ঘটেছিল বিলম্বে। সেনাবাহিনী ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। 

১৬ আগস্টের দাঙ্গা ছিল অভূতপূর্ব রকমের নৃশংস ও অপ্রত্যাশিত। কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়। কলকাতার দাঙ্গা নোয়াখালীতে ছড়ায়। ঢাকাতেও ঘটে। কলকাতা শহর হিন্দু পাড়া ও মুসলমান পাড়ায় বিভক্ত হয়ে যায়। যেন দেশভাগেরই মহড়া। 

ইতিহাসের পাঠকরা বলেন যে ওই দাঙ্গা সামাজিক বিপ্লবের তো বটেই, প্রকৃত স্বাধীনতার লাভের যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাকেও অনেক পরিমাণে নষ্ট করে দিয়েছে এবং দেশবিভাগের ট্র্যাজেডিকে অনিবার্য করে তুলেছে। ২৯ জুলাই ১৯৪৬-এ ভারতজুড়ে ডাক ও তার বিভাগের কর্মীরা ধর্মঘট ডেকেছিলেন, সে ধর্মঘটের প্রতি ছিল সাধারণ মানুষের সর্বাত্মক সমর্থন, নেতৃত্বে ছিলেন বামপন্থিরা। ওই ধর্মঘটের মাত্র ১৮ দিন পর ঘটল ১৬ আগস্টের দাঙ্গা, এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলই, সর্বাধিক সংখ্যায় প্রাণ হারালেন মেহনতি মানুষেরাই। 

সাতচল্লিশের সর্বনাশা দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গের মানুষ ভাবতে চেষ্টা করেছে যে তারা স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল যে তারা নতুন এক ঔপনিবেশিক শাসনে নিপতিত হয়েছে। উপলব্ধিটা স্পষ্ট হতে শুরু করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ষাটের দশকে ঔপনিবেশিকতার ব্যাপারটা টের না পেয়ে উপায় ছিল না। ঊনসত্তরে তাই অভ্যুত্থান ঘটেছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশ নামে প্রতিষ্ঠা ঘটেছে নতুন একটি রাষ্ট্রের।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালিকে বাঙালি হতে শিখিয়েছে। সাম্প্রদায়িক পরিচয় ভুলে সে বাঙালি পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছে। পাকিস্তান ছিল একটি অবাস্তবিক ও অমানবিক রাষ্ট্র; সেখানে সুবিধাভোগী অবাঙালিরা বাঙালিদের ওপর শাসন-শোষণের বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান কেবল যে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তা নয়, ঘটেছে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধেই। লড়াইটা জাতীয়তাবাদী ছিল বটে, কিন্তু তার ভেতরের আকাঙ্ক্ষা ও সম্ভাবনা দুটিই ছিল সমাজতান্ত্রিক। সেটা ওই কারণে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ যেমন ধর্মীয় বিভাজন মানে না, তেমনি শ্রেণিবিভাজনকেও অস্বীকার করে। এক কথায় আশা ছিল জনগণের মুক্তির। 

অভ্যুত্থানের পর সত্তর সালে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পর পাকিস্তানের দিক থেকে গণহত্যা, আমাদের দিক থেকে মুক্তির জন্য জনযুদ্ধ ঘটেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে যে বাঙালি বাঙালি হয়ে উঠেছিল একাত্তরে সেই বাঙালিই তার মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে লড়েছে। 

কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয়। সেটা হলো যুদ্ধের সময় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে হিন্দু সম্প্রদায়ের যুবকেরা তাতে যোগদানে উৎসাহ দেখায়নি, তাদের যোগদান ছিল নগণ্য, যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ই ছিল সর্বাধিক ভুক্তভোগী। এর কারণটা ভেবে দেখবার মতো। মূল কারণ হচ্ছে পূর্ববঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের অভিজ্ঞতা। পাকিস্তান তাদেরকে মিত্র বলে ভাবেনি। তারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। সামাজিক নিরাপত্তাও পাননি। থেকে থেকে দাঙ্গা হয়েছে এবং দাঙ্গায় তাদের প্রাণহানি ও সম্পত্তিহানি দুটিই ঘটেছে। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা তো চেয়েছিলই যে বাংলাদেশকে তারা হিন্দুশূন্য করে ছাড়বে। শরণার্থী হিসেবে যারা দেশ ছেড়েছেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য। দেশে ফিরবার ব্যাপারে তাদের ভেতর হতাশা দেখা দিয়েছিল। ফিরলেও পূর্বের জীবন ফেরত পাবার ব্যাপারে সংশয় ছিল। যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা তাদেরকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় ভুলতে সাহায্য করেনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও তাই দেখা গেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ গঠিত হয়েছে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে। 

আর শ্রেণিবিভাজন? সেটা তো রয়েই গেছে। ব্রিটিশ আমলে সাম্প্রদায়িক সমস্যা, পাকিস্তান আমলে প্রথমে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও পরে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের আবশ্যকতায় শ্রেণিবিভাজনের বাস্তবতাটার পক্ষে স্পষ্ট হয়ে ওঠাটা কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সাতচল্লিশে দেশভাগের নিচে সেটা চাপা পড়ে গিয়েছিল, পাকিস্তানি শাসনেও সেটা সামনে আসতে সময় লেগেছে; কিন্তু ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে মেহনতি মানুষ যেভাবে অংশগ্রহণ করেছে পাকিস্তানের ইতিহাসে তেমনটি আগে কখনো ঘটেনি। মওলানা ভাসানী ডাক দিয়েছিলেন হাট হরতাল ও ঘেরাওয়ের। হাট হরতাল আন্দোলনকে গ্রামে নিয়ে গেছে, পাশাপাশি ঘেরাও করা হয়েছে শিল্পকারখানার মালিকদেরকে। দুর্নীতিবাজ আমলা, গ্রাম্য টাউট, বুনিয়াদি গণতন্ত্রের চেয়ারম্যান ও সদস্যদেরকেও। থানা এবং তহশিল অফিস বাদ পড়েনি। গ্রামে গণআদালত বসেছে, বিচার হয়েছে গরুচোর ও অন্য অপরাধীদের। ছাত্রদের সংগ্রাম পরিষদের শাখা গঠিত হয়েছে গ্রামে-গঞ্জে। আত্মরক্ষার প্রয়োজনে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে। 

সাতচল্লিশের আগে যেমন এবারেও তেমনি, পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল বিপ্লবাত্মক এবং সেবারের মতো এবারেও শাসকগোষ্ঠীর রণকৌশল দাঁড়াল নির্বাচন দেওয়া। সত্তর সালে পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ নির্বাচন হয়েছে। ছেচল্লিশের নির্বাচনের পর যেমন বিপ্লব না ঘটে, ঘটেছিল দাঙ্গা ও দেশভাগ। এবারেও অনেকটা একই রকমভাবে ঘটনা ঘটল। বিপ্লবের পরিবর্তে ঘটল যুদ্ধ ও রাষ্ট্রভাঙার ঘটনা। যুদ্ধটা আসলে ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যা এবং তার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গবাসীর প্রতিরোধ। দাঙ্গাতে যেমন যুদ্ধেও তেমনি প্রাণ দিলেন সাধারণ মানুষ; কিন্তু তাদের মুক্তি এলো না। 

মুক্তি না আসার কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা চলে গেছে বুর্জোয়াদের হাতে; সাতচল্লিশে যেমনভাবে গিয়েছিল ঠিক তেমনিভাবেই। সাধারণ মানুষ সেবারে হেরে গেছেন, এবারেও হেরে গেলেন। কারণও ওই একই; সাধারণ মানুষের পক্ষে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল না। সাতচল্লিশে কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনে যুক্ত ছিল, জনগণের মুক্তির জন্য আসল লড়াইটা তারাই করেছেন; কিন্তু তারা ছিলেন দুর্বল। নির্বাচনে তারাও অংশ নিয়েছেন, কিন্তু সুবিধা করতে পারেননি। আর পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর যে পরিমাণ নির্যাতন করা হয়েছে তেমন নির্যাতন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল যে কংগ্রেস দল তাদের ওপরও করা হয়নি। পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিল ১২ হাজার; সাতচল্লিশের পর কমতে কমতে এক সময়ে তা দাঁড়ায় দুই হাজারে। কমিউনিস্টরা নির্যাতনের ভেতরেও সংগঠিত হয়েছেন এবং এগিয়ে গেছেন। কিন্তু তারা সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে সেভাবে কাজ করতে পারেননি যেভাবে করলে জনগণের মুক্তি আসত। একটা কারণ তারা রুশপন্থি ও চীনপন্থি, এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। রুশপন্থিরা ছিলেন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে; চীনপন্থিরা সামাজিক বিপ্লবের কথা বলেছেন, কিন্তু তারা ছিলেন বিভক্ত এবং কেউ কেউ বিপথগামীও। 

ফলে একাত্তরে পূর্ববঙ্গ দ্বিতীয়বার ‘স্বাধীন’ হলো ঠিকই; কিন্তু জনগণ মুক্তি পেল না। বাঙালি বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে রাষ্ট্রকে নিজেদের উন্নয়নে ব্যবহার করা শুরু করল। ধনীদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকল। পুঁজিবাদের উন্নয়নের ধাক্কায় বৈষম্য বাড়ল। শাসক ধনীরা দেশের সম্পদ কেবল লুণ্ঠন নয়, বিদেশে পাচার করাও শুরু করে দিল, ঔপনিবেশিক শাসকেরা আগে দিনে যেমনটা করত। ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে শাসক ও শাসিত, মালিক ও ভৃত্যের যে সম্পর্ক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটাই টিকে রইল। আবরণটাই যা বদলাল। 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //