শালতোড়া

গৌতম ঘোষের মা ভূমির পঞ্চাশ বছর

“আমার মনে হয় Hungry Autumn ছবিটা এখনো প্রাসঙ্গিক, কারণ সিনেমা হলো Memories of Time। শালতোড়া থেকে কলাগাছিয়া ৫০ বছর আগে কেমন ছিল ছবিতে সে সময়টা ধরা আছে। এটা সিনেমা নয় তথ্যচিত্র। একদিকে রিপোর্টাজ আর একই সঙ্গে এর কারণ বিশ্লেষণ করা ডকুমেন্টারি এটি। বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবে অনেক পুরস্কার-স্বীকৃতি পেলেও এদেশে আমরা প্রজেক্টর লাগিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাবে ছবিটা দেখাতে পেরেছি জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর। এ তথ্যচিত্র নির্মাণটাও একটা গল্প।

আমি তখন বিজ্ঞাপনের ছবি করছি, কাজ করছি সাজানো ছবির, মনের দিক থেকে তৃপ্তি পাই না। সে সময় চারদিকে এক দুঃসহ পরিস্থিতি। গ্রাম থেকে কাতারে কাতারে মানুষ শহরে আসছেন। মানুষ খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন করছে। গ্রামে লঙ্গরখানা চলছে, মৃতদেহ পড়ে আছে। অথচ শহরে বাজারে ভরা মাছ-সবজি। আর গ্রামের মানুষরা এসে ভাতের ফ্যান চাইছে, ভিক্ষা করছে। আমরা কারণ খোঁজার চেষ্টা করলাম, এটা ঠিক যে সেই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই বিপদ শুরু হয়েছিল। তার থেকেও বড় বিপদ ছিল মুষ্টিমেয় একদল মানুষ, যারা খাদ্যশস্য মজুদ করছিল। সরকার লঙ্গরখানা খুলে খেতে দিচ্ছিল এটা যেমন সত্যি, তেমনি এই মজুদদারদের পেছনে সে সময় রাজনৈতিক মদদও ছিল এটাও সত্যি। ফলে সেই মজুদদারেরাও অন্যতম দায়ী ছিল সেই পরিস্থিতির জন্য।

সে সময় রোমে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমেরিকান সেক্রেটারি বললেন, ‘খাদ্য আমাদের অস্ত্র’, সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা হিংস্রতা একদিকে আর আমাদের নিজের রাজ্যে সেই খাদ্যের বেআইনি মজুদ কালোবাজারি।

সেই পরিস্থিতিতে আমরা বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম একটা স্বাধীন তথ্যচিত্র নির্মাণ করব কোনোরকম সরকারি স্পন্সরশিপ ছাড়া। খুব জটিল বিষয় নিয়ে তথ্যচিত্র। একদিকে সমাজ ব্যবস্থা ও সিস্টেমকে বিদ্ধ করা, সঙ্গে সমস্যার প্রকৃত কারণ তুলে ধরা, এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করি।

একটা হাতে চালানো ক্যামেরা কিনলাম দুই হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নামলাম কাজে। সে সময় নানা প্রান্তে গিয়েছি। বাঁকুড়ার শালতোড়া বাসে করে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। চারদিকে জঙ্গলের মাঝে একটি নির্জন আদিবাসী গ্রাম শালতোড়া। আমরা শালতোড়া বাসস্ট্যান্ডে রাত কাটাতাম, দিনভর কাজ করতে গিয়ে দেখতাম দূর গ্রাম থেকে মানুষ লঙ্গরখানায় লাইন দিতে আসছে। মানুষের দৈনিক আয় ছিল ২৬ পয়সা, এক মাসে গড়ে ৮ টাকা।

সেটাও ছিল এই শরৎকাল, ঠিক ৫০ বছর আগে...”

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষ  শোনাচ্ছিলেন ৫০ বছর আগের তার প্রথম তথ্যচিত্র সম্পর্কে। বলা চলে, এই তথ্যচিত্র তাকে পরিচালক হিসেবে শুরুতেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। ছবিতে ধরা আছে সে সময়ের ছবি। 

৫০ বছর আগে ক্ষুধার্ত মা তার সন্তানকে খাচ্ছেন খিদে মেটাতে, মেদিনীপুর জেলার সে ঘটনা। জেলায় জেলায় অনাহার, সরকারি লঙ্গরখানার ঘোষণার খবরের ক্লিপিংস সঙ্গে কলকাতার রাস্তায় অনাহারক্লিষ্ট মানুষের ভিড়। ফ্যান চেয়ে ভিক্ষা। গ্রামে লঙ্গরখানায় খিচুড়ি সংগ্রহের লম্বা লাইন। এর মাঝে শহরে জাঁকজমক করে উৎসব।

তার কথা শুনে সেই শালতোড়া এখন কেমন আছে দেখতে সেই শরৎকালে চলে আসা। শালতোড়া একটি আধা শহর। শহরের পরিকাঠামো-সরকারি অফিস, আদালত, আইটিআই কলেজ, হাইস্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী।

এ বছরও কৃষিপ্রধান এলাকা পশ্চিমবাংলার বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া ব্লকে খুবই কম বৃষ্টি হয়েছে। ফলে জলের অভাবে অর্ধেকের বেশি জমি চাষ হয়নি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলেও তা আর চাষের কাজে লাগেনি, কারণ চাষের সময় পার হয়ে গেছে। ফলে হতাশ গোটা এলাকা। ভীষণ রুক্ষ শালতোড়ার মাটি।

দশকের পর দশক ধরে এই রুক্ষতা শালতোড়াকে অদ্ভুত রকম পিছিয়ে রেখেছে। শালতোড়া বিধানসভায় প্রায় দু লাখ মানুষ থাকেন। সকলেই কৃষিজীবী। শালতোড়ায় হাইস্কুল হয়েছে, আইটিআই হয়েছে, বাসস্ট্যান্ডে বিরাট মোবাইল টাওয়ার বসেছে; কিন্তু শ্রাবণের ভরা বর্ষা থেকে আশ্বিন পর্যন্ত কোনো ইঁদারায় জল নেই। টিউবওয়েলগুলো শুকিয়ে পরিত্যক্ত হয়ে আছে, কারণ মাটির নিচে জলস্তর নেমে গেছে। এতবড় এলাকায় যে কটা মাত্র ইঁদারায় জলস্তর আছে সেখানে জল তুলতে নিজেরা কলসি-দড়ি নিয়ে যান গৃহবধূরা। একে-অন্যের দড়ি ব্যবহার করেন না-এমনটাই অভাব এখানে। তাই ৫৫ কিলোমিটার দূরে বিরাট শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুর থাকলেও শালতোড়ায় অভাব-দারিদ্র্য এখনো  চরমে।

চলতি বছরে মাত্র তিনটি দুর্গাপূজা শালতোড়া এলাকায়। বহু কাল ধরে এই তিনটি পূজাই হচ্ছে। এর মধ্যে একটি পারিবারিক। এর বাইরে বন্ধুমহল আর তরুণ সংঘ ক্লাবের পুরনো পূজা। পশ্চিম বাংলা রাজ্য সরকার সব পূজা কমিটিকে ৭০ হাজার টাকা সরকারি অনুদান এবং অনেক কম খরচে বিদ্যুৎ দেওয়ার ঘোষণা করলেও শালতোড়ায় পূজার সংখ্যা বাড়েনি। এলাকা বেড়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু পূজার সংখ্যা বাড়ে না-এমন একটি অদ্ভুত এলাকা শালতোড়া। অদ্ভুত একটি গঞ্জ এটি, যেটি ব্লক এলাকা হলেও একটি শপিং মল বা বড় দোকান নেই। গলির মাঝে তিনটি বিউটি পার্লার কয় বছর হলো হয়েছে, সেগুলো কিন্তু চলছে। এটাই ব্যতিক্রমী ছবি।

তবে এখানে উৎসব ভীষণ রকম ম্লান। শালতোড়ার গরিব মানুষরা দিনমজুরি করতে ভোরের বাসে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে যান আবার শেষ বাসে ফেরেন। সেখানেও বাজার মন্দা, কারখানা ধুঁকছে। ফলে “মানুষের হাতে টাকা না থাকলে ধর্ম-উৎসব সবকিছু ম্লান হয়ে যায়, শালতোড়া তার প্রমাণ”-বলছিলেন জীবন মণ্ডল, একজন শিক্ষিত যুবক শালতোড়ার।

এই এলাকার বিধায়ক, সাংসদ সব ক্ষমতা এখন বিজেপি দলের। এলাকায় জল সমস্যার কথা স্বীকার করেন বিধায়ক চন্দনা বাউরি, তবে দায়িত্ব রাজ্য সরকারের দিকে ঠেলে দেন তিনি। সাংসদ সুভাষ সরকার কেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী। “তিনি নিজের দলের কোন্দলে নিজেই দলের অফিসে আটক থাকেন, ভোটের পর আর তার দেখা পাইনি।”-বলেন শিক্ষক বিনয় মণ্ডল।

তবে হঠাৎ করে কয়েক বছরে শালতোড়ায় পরিবেশ বদলেছিল তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর। এলাকায় শতাধিক পাথর খনি ক্রাশার চালু হয়েছিল। স্থানীয় হিসেবে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ কাজ করছিল সেখানে। তবে সবকটা খাদান ক্রাশার ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি এমন অভিযোগ ওঠে, এরপর রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক নানা আইনি কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে রাজ্যে ইডির হানাদারির পর। ফলে সঙ্কট আরও বেড়েছে।

শালতোড়ার প্রবীণ মানুষ শ্রীধর বাউড়ি বলছিলেন, “বাবা বিহারীনাথ জানেন সব কিছু। একসময় এই শালতোড়াকে লঙ্গরখানা বাঁচিয়েছিল। তারপর সিপিএমের সরকার এলো। তারা তো নদী আনতে পারল না, তবে প্রতিবছর গাছ লাগিয়ে বর্ষায় বৃষ্টিকে কিছুটা নিয়ে আসত, চাষটা হতো। বিহারীনাথ বাবা পর্যন্ত সবুজ গাছে ভরে গিয়েছিল। কিছু স্কুল হলো, কটা টিউবওয়েল হলো, ইঁদারা করল। কিন্তু গরম পড়লেই তাতেও জল নেই।  এরপর সিপিএমের জামানা শেষ হলো, তৃণমূল এলো। মাটি খুঁড়ে জল নয়, পাথর, কয়লা, বালি আর গ্যাস তুলে বিক্রি চলল। সবাই ঘুরে-ফিরে সে ধান্ধায় জুড়ে গেল। কয় বছর পর সব বন্ধ হয়ে গেল। কোথা থেকে সব এলো, ধরপাকড়ের ভয়ে নেতারাই পালাইল...!”

শালতোড়ার মাটির নিচে সম্পদের যেন পাহাড়। প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, কোয়ার্টজ পাথর, গ্রানাইটের স্তর সব এখানকার মাটিতে। দামোদর নদীর এপার থেকে শুরু করে সেই স্তর চলে গেছে ধানবাদ ঝরিয়া বহুদূর। 

শালতোড়া বাসস্ট্যান্ডের থেকে মধুকুণ্ডা রোড ধরে এগোলে শালতোড়া গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস। সেটা অফিস না কোনো ব্যাংকের দপ্তর বোঝা কঠিন। চতুর্দিকে হরেক কাউন্টার। সেখানে দাঁড়িয়ে মিতালি মণ্ডল, তার বাবা প্রয়াত হয়েছেন। সমব্যথী প্রকল্পে তার হাতে নগদ দু হাজার টাকা তুলে দিলেন পঞ্চায়েত কর্তা, তার ছবি তুলে রাখা হলো।

অফিসের পাশে মহিলারা স্কুল পোশাক তৈরির কাজ করছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে। যতটা আয় হয় এ বাজারে সেটাই ভরসা বলছিলেন তারা। পঞ্চায়েত অফিসের পেছনে ধু-ধু করছে জমি, তার পেছনে উঁকি দিচ্ছেন বিহারীনাথ, পাহাড় এবং প্রকৃতি দেবতা। তিনি সব ঘটনার নীরব সাক্ষী বলেন এলাকার মানুষরা।

শালতোড়া থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ভামুরিয়া গ্রাম। কয়েক হাজার কোটি টাকার অবৈধ কয়লা পাচারের মূল হোতা এক রাজার গ্রাম। তার দয়ায় শালতোড়ার গরিবরা দিন-রাত এক করে জমিতে খাটা ছেড়ে অবৈধ কয়লা, কাঠ, প্রাকৃতিক গ্যাস, পাথর বালিসহ হরেক পাচারে জুড়ে গিয়ে কয়েক মাস রোজ দু হাজার টাকা করে আয় করার মতন জায়গায় চলে গিয়েছিল। ‘হঠাৎ এই ইডি সিবিআই চলে আসায় সব ব্যবসা বন্ধ হলো। আমাদের মাথারা এলাকা ছেড়ে পালাল। কেউ জেলে গেল। এখন চারদিকে দেখুন শালতোড়ায় আবার মড়ক এসছে মনে হচ্ছে। পূজার সময় সুনসান বাজার-হাট। মানুষের হাতে টাকা নাই। এবার চাষটাও মার খেল।’-বলেন এক যুবক মনোজ মণ্ডল, তিনি নিজেও এ কাজ করে কিছু টাকার মালিক হয়েছেন, অকপটে সেকথা স্বীকার করেন।

এগিয়ে পথের কোনায় তৃণমূল ব্লক অফিস। সভাপতি সন্তোষ মণ্ডল এসি চালিয়ে বিশ্রামে। সেখান থেকে বের হয়ে বলেন, ‘২১  জুলাই কলকাতা মিটিং করে আমরা ফিরি, দাদা মানে আমাদের যুবরাজের সঙ্গে কথা বললাম, মিটিং হলো। দাদা কয়েকটা ক্রাশার কাগজ নিয়ে চালাতে বলেছেন। আশা করছি বাকিগুলো খুলবে। পূজার বাজারে এমন অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি। এখানে বিজেপির এমপি, এমএলএ,  এরা কোথায় এখন? একটা তুলসীমঞ্চও করতে পারেনি পাঁচ বছরে। তবে সেই লঙ্গরখানার দিন ফিরবে না, এটা হলফ করে বলতে পারি। পঞ্চায়েত আমাদের।’

প্রকৃতি যেমন শুকিয়ে শেষ করেছে শালতোড়াকে, অভাবও তেমন যেন চিরস্থায়ী হয়ে উঠছে এখানে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৪ সাল কার্যত শালতোড়াকে চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছিল, একদিকে প্রকৃতি আরেকদিকে মহাজনী শোষণ।

নজিবুর রহমান শালতোড়ার প্রবীণ মানুষ। তিনি বলেন, ‘সে সময় গ্রামের মানুষ জোতদার মহাজনদের কবলে পড়ে শেষ হয়েছিলেন। জমি বন্ধক দেওয়া থেকে বাড়ির কাঁসা-পেতলের বাসনপত্র সব দামি জিনিস বন্ধক দিতে দিতে ১৯৭২ সাল নাগাদ প্রায় সব শেষ মানুষের। ওদিকে বৃষ্টি নেই, চাষ করে যে খাবে মানুষ তার উপায় নেই। তখন আরও কয়েকটা গ্রামে এমন অবস্থা। না খেয়ে মরা শুরু হলো। সে সময় এই এলাকায় অনেক দিন চলেছিল লঙ্গরখানা। এই শরতে এই পূজার বাজারে মানুষ বাটি হাতে খিচুড়ি খেতে সকাল থেকে লাইন দিতেন! আমি তখন কলেজ পড়ুয়া।’

মুরলীধর প্রামাণিক ছিলেন সেই লঙ্গরখানার স্বেচ্ছাসেবক। বৃদ্ধ মানুষটি স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘শালতোড়ায় মিশনারি সংস্থা চাল-ডাল দিল। আমরা সক্ষমরা মিলে সকাল থেকে খিচুড়ি রান্না করতাম। সে এক বিভীষিকা। সরকারি লঙ্গরখানা কিছু দূরে সেখানেও এমন ভিড়। গ্রামের পর গ্রাম থেকে উজিয়ে গরিব অসহায় মানুষরা আসছে। মাসের পর মাস রোজ খিচুড়ি খেতে খেতে পা ফুলে গেল অনেকের। সে আরেক রোগ। তখন মিশনারি ডাক্তাররা এসে তার চিকিৎসা করলেন। সেই লঙ্গরখানাগুলো ছিল বলে শালতোড়ার কয়েক পুরুষ বেঁচে গেল। মরে পড়ে আছে না খেতে পেয়ে কত মানুষ-এসব দৃশ্য দেখেছি এই শালতোড়াতেই। সে সময় কয়েক বছর পূজা কোথা দিয়ে গিয়েছিল কেউ জানি না! মনে পড়ছে ৫০ বছর আগের ঘটনা এসব।’

চিত্র পরিচালকের পরিচিতি পাওয়ার আগে Hungry Autumn গৌতম ঘোষের কার্যত সিনেমা জীবন শুরুর অভিযান। তিনি বলছিলেন, “ছবিটা তৈরি করতে সাধারণ বাস-ট্রেনে যাতায়াত করে মাঠে-ঘাটে থাকতাম। তখন ওই ক্যামেরা আর ১৬ মিমি ফিল্ম। শেষের দিকে নিজেরা পকেট থেকে টাকা দিয়েও কুলোতে পারছিলাম না। জগন্নাথ গুহ ছবিটার ইংরেজি ভাষ্য লেখেন, তিনি এবং অপর্ণা সেন (তখন অপর্ণা ছাত্রী) ভয়েস ওভার দেন। সে সময় একজন বিরাট মনের মানুষ চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন বললেন, “তোমরা কী করছো, দেখাবে?” ওনাকে আমরা রাফ কাট ছবি দেখালাম। উনি দেখে বলেন, “এ তো লাতিন আমেরিকার ছবি মনে হচ্ছে দেখে। এ তো বৈপ্লবিক কাজ করে ফেলেছ তোমরা। এ ধরনের তথ্যচিত্র তো এখানে হয়নি।” আমি অকপটে মৃণাল সেনকে বললাম ১০ হাজার টাকা দরকার, না হলে এ ছবি শেষ করতে পারব না।

উত্তেজিত মৃণাল সেন তার পরিচিত এক ব্যাংক আধিকারিক মি. সান্যালকে বলে ১০ হাজার টাকা ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলেন, তিনি নিজে হলেন সে ঋণের গ্যারান্টার। সে টাকা পেয়ে  মুম্বাইয়ে ছবি স্ক্রিনিংয়ের কাজ শুরু হলো। সেখানে বিখ্যাত পরিচালক ড. এস সুখদেব ছবিটা দেখে বললেন, “চেপে যাও, এ ছবি এখন সরকারের নজরে আসলে সব নষ্ট করে দেবে ওরা, কারণ তখন জরুরি অবস্থা দেশে।” আমরা বাধ্য হয়ে চেপে গেলাম। অবশেষে জরুরি অবস্থা ওঠার পর বিদেশে দুটো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এ ছবি দেখানো প্রথম শুরু হলো। অনেক পুরস্কার সম্মান পেল ছবিটা।

এখনো শরৎকালে মনে পড়ে ৫০ বছর আগের ফেলে আসা ছবিকে। এখন গ্রামের এক অংশ অর্থবান হয়েছেন; কিন্তু দলিতরা এখনো অন্ধকারে। তাদের অবস্থা খবরে আসে না। যদি কোনো দুর্যোগ বিপর্যয় কিছু ঘটে বা তারা যদি উগ্রবাদী হয় তখন তাদের নিয়ে খবর হয়। কিন্তু কী অবস্থায় তারা আছেন তাদের ন্যূনতম পুষ্টিও জুটছে না যে সরকারের পরিসংখ্যানেই তা পরিষ্কার। 

৫০টা বছর ফিরে দেখা, এক চিত্রপরিচালকের চোখে সেই সময়, আর এ বছরেও মাটির ফাটল দেখে বিমর্ষ এলাকাবাসীর চোখে ম্লান কাশফুলের হিল্লোল আর ঢাকের শব্দ। জীবন মণ্ডল বলেন,  “এবার কটা জমিতে চাষ হলো, বেশিরভাগটাই কেউ করতে পারল না জলের অভাবে। জল চাই জল, একদম ভাসিয়ে দেবে ডুবিয়ে রাখবে জমি। সকাল থেকে রাত ব্যাঙ ডাকবে। তবে তো চাষ হবে। বাবারে ওটাই তো উৎসব আমাদের।”  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //