আবু সয়ীদ আইয়ুব: স্মরণগ্রন্থের আলোকে

আবু সয়ীদ আইয়ুবকে (১৯০৬-৮২) অনেকে অভিহিত করেন রবীন্দ্রসাহিত্যের সমালোচক কিংবা রবীন্দ্রকাব্য ও রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাখ্যাকার বলে। আবার অনেকে তাকে অভিহিত করেন আধুনিক (আসলে আধুনিকতাবাদী) বাংলা কবিতার স্বরূপনির্দেশক ও সমালোচক বলে। অনেকে এমন কথাও বলেন যে, কাব্যবিচারে দার্শনিক মানদণ্ড প্রয়োগ করে তিনি কাব্যের রসোপলব্ধিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন। আমার মনে হয়, এসব কথার মধ্য দিয়ে ভাবুক হিসেবে আইয়ুবের সম্পূর্ণ পরিচয় প্রকাশ পায় না। রবীন্দ্রনাথের কাব্য, সংগীত ও আধুনিকতাবাদী কবিতার বিশ্লেষণ সূত্রে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দার্শনিক চিন্তাই প্রকাশ করেছেন। তার জীবনাদর্শ ও সাহিত্যাদর্শ সঙ্গতিপূর্ণ। আলোচনার মধ্যে যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে গেছেন সেখানেই প্রকাশ পেয়েছে তার মৌলিকতা। অন্তর্জীবন ও পরিবেশকে-মানবপ্রকৃতি ও বাহ্যবস্তুকে-দেখবার এবং বিচার করবার তার স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

আইয়ুব ছিলেন সুস্থ, স্বাভাবিক, বলিষ্ঠ জীবন-জগৎদৃষ্টির অধিকারী। আধুনিকতাবাদীদের প্রচারিত চরম নৈরাশ্যবাদের গ্রাস থেকে তিনি মানুষকে উদ্ধার করতে ও রক্ষা করতে চেয়েছেন। আধুনিকতাবাদী বাংলা কবিতার সীমাবদ্ধতা ও ভুলের দিকটিকে তিনি উন্মোচন করেছেন গভীর সহানুভূতির সঙ্গে, পাঠকদের বোধগম্য করে, এবং এর দ্বারা তিনি এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। গোটা পৃথিবীতে আর কেউ কি এমনটি করতে পেরেছেন? 

কাব্যবিচারে দার্শনিক কিংবা নৈতিক কিংবা সমাজতাত্ত্বিক কিংবা ঐতিহাসিক প্রতিমান প্রয়োগে দোষের কিছু নেই। নানা দিক থেকে কাব্যকে দেখার এবং বিচার করার সুযোগ আছে, দরকারও আছে। কাব্যকে নিছক আলঙ্কারিক বা কলাকৈবল্যবাদী ব্যাখ্যার নিগড়ে বন্দি না রেখে সব দিক দিয়ে দেখার ও উপলব্ধি করার সুযোগ অবারিত রাখা কাব্যের জন্যও মঙ্গলজনক। কাব্য যখন মানবীয় জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সংশ্রব ত্যাগ করে নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলে এবং কেবল ভাষার ও রূপরীতির চমৎকারিত্ব দিয়ে নিজের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তৎপর হয়, তখন তাতে আর প্রাণশক্তি থাকে না। কাব্য তখন শিক্ষিত সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কবিতার প্রাণশক্তি অস্তিমান থাকে বিষয়বস্তু ও রূপরীতি-যুগপৎ দুটোর মধ্যেই। দুয়ের কোনোটিকেই মুখ্য কিংবা গৌণ ভাবা যায় না। কবিতা-কাব্য ব্যাপারটিকে আইয়ুব ভালো জীবনের জন্য অপরিহার্য ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি নিজেকে আধুনিকতাবাদের জীবনবিমুখ জগৎবিমুখ নৈরাশ্যবাদী কলাকৈবল্যবাদী অলঙ্কারসর্বস্ব নিগড়ে বন্দি না রেখে রেনেসাঁসের প্রাণশক্তিসমৃদ্ধ চেতনার ব্যাপ্ত অঙ্গনে প্রসারিত দেখতে চেয়েছেন। এসব বিষয় বিবেচনা করলে স্বীকার করতে হয় যে, বিশ শতকের বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান চিন্তক আইয়ুব। কেবল রবীন্দ্রসাহিত্যের, রবীন্দ্রসংগীতের বিশ্লেষক এবং আধুনিকতাবাদী কবিতার স্বরূপনির্দেশক বললে তার পরিচয় অল্পই প্রকাশ পায়। 

রেনেসাঁসের জ্ঞানগত ও ভাবগত ঐতিহ্য, দুই বিশ্বযুদ্ধ, রুশবিপ্লব, চীনবিপ্লব, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জন, নক্সালপন্থিদের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড- ইত্যাদিকে পটভূমিতে রেখে বিকশিত হয়েছে আইয়ুবের চিন্তাধারা ও জীবনদর্শন। চারপাশের সাহিত্যাঙ্গনের মেধাবীরা যখন নৈরাশ্যবাদ অনুশীলনে ভীষণভাবে ব্যস্ত, আইয়ুব তখন আপন অন্তরের তাগিদে বাংলা ভাষার দেশে আশাবাদী জীবন-জগৎদৃষ্টি সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ সময়টাতে মার্কসবাদ ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী মতাদর্শ। আইয়ুব মার্কসবাদকে এবং মার্কসবাদীদের বোঝার চেষ্টা গোটা লেখকজীবন ধরেই করেছেন। মার্কসবাদকে তিনি সৃষ্টিশীল উপায়ে আত্মস্থ করতে চেয়েছিলেন; অন্ধভাবে গ্রহণ করতে নয়। মার্কসবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও তিনি প্রভাবিত করতে চেয়েছেন তার ইতিহাসবোধ, সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতির ধারণা দিয়ে। জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে তিনি লিখেছেন,

“মার্কসবাদকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক সত্য। অন্তত বিজ্ঞানভিত্তিক সত্য তো বটেই, এবং নববিজ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল। নবযুগের এমন বিরাট সত্যধর্মকে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের ভাবনায় আটকে রাখার মানে কি মধ্যযুগের প্রদোষান্ধকারে ফিরে যাওয়া নয়? এই তিন মহামানবের প্রতিভাদীপ্ত মার্কসবাদ মানবজাতির অগ্রগতির ইতিহাসে একটি বিরাট পদক্ষেপ, কিন্তু চূড়ান্ত পদক্ষেপ নয়। আধুনিক যুগের বিজ্ঞান তো কোথাও থেমে নেই। গ্যালিলিও থেকে নিউটন, নিউটন থেকে ম্যাক্সওয়েল, ম্যাক্সওয়েল থেকে প্লাঙ্ক, প্লাঙ্ক থেকে আইনস্টাইন, আইনস্টাইন থেকে শ্রোডিঙ্গার, শ্রোডিঙ্গার থেকে হাইডেনবার্গ তো নিরন্তর অগ্রগতির ইতিহাস যেমন বিস্ময়কর, তেমনি সুন্দর। মার্কসবাদ চিত্ত থেকে চিত্তান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়বে প্রত্যক্ষ সত্য ও বলিষ্ঠ যুক্তির জোরেই। অবশ্য যারা বর্তমান সমাজে ধনঞ্জয় ও ধনকুবের এবং যারা তাদেরই ক্ষমতায় গদিতে আসীন, এদের সবাইকে সরাতে হবে প্রহারেণ একথা মানি। কিন্তু সত্যের যাচাই তো তরবারির জোরে সম্ভব নয়। জ্ঞানতন্ত্রবাদ নব নব রূপ পরিগ্রহ করে সামনে আসবে। তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য নব নব রূপের সন্ধান দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকেও করতেই হবে। নইলে ‘ডায়ালেকটিক’ কথাটা অর্থহীন হয়ে যায়। এই মোকাবিলার ফলেই আমাদের মতবিশ্বাস সত্য থেকে সত্যতর, বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর হয়ে উঠবে। সত্যতম বা পরমতম বলে কিছু নেই।” 

মার্কসবাদীদের উদ্দেশে আইয়ুবের এই সমালোচনাকে ভুল বলা যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়ন লোপ পেয়ে গেল কেন? মার্কসবাদ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে গেল কেন? ধর্মীয় কিংবা মতাদর্শগত বিশ্বাসের বদ্ধতা আইয়ুবের কাছে অতিশয় পীড়াদায়ক ছিল। তবে মার্কস, এঙ্গেলস ও লেনিনের চিন্তাধারার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি সব সময়ই ছিল সদর্থক। মার্কসবাদের প্রতি অম্লান দত্তের দৃষ্টিভঙ্গিও এ রকমই ছিল। আইয়ুবের চালিকাশক্তি ছিল বিকাশমান বাস্তবতায় তার অন্তর্গত বিকাশমান বিবেক ও যুক্তিবোধ। সত্যতম বা পরমতম বলে কোনো কিছুর চিরস্থায়িত্ব স্বীকার না করলেও তিনি সত্য বা পরম বলে অভিহিত বিভিন্ন সত্তার দীর্ঘস্থায়িত্ব স্বীকার করতেন। তার লেখায় তার রসবোধ ও সাহিত্যবোধের পরিচয় আছে। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে তার মনীষা উজ্জ্বল। বাংলা ভাষার চিন্তার ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে যাওয়ার নয়। 

‘No poet was everyet a great poet without being at the same time a profound philosopher.’ কাব্যবিচারে কোলরিজের এই উক্তিকে আইয়ুব খুবই গুরুত্ব দিতেন। আধুনিকতাবাদীদের কাছে এ উক্তি বিরক্তিকর। কবিতার বেলায় তারা পুনঃপুন উচ্চারণ করেন, কবিতা হলো ‘best words in the best form.’ তাদের আগ্রহ শব্দের ধ্বনিগত সৌন্দর্যের দিকে, অর্থের দিকে নয়। কেবল কলানৈপুণ্য দেখে, কেবল অলঙ্কার প্রয়োগের কুশলতা দেখে তারা কাব্যের উৎকর্ষ বিচার করেন। তাদের মতে কাব্যে বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ রচনাশৈলী-উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প। তাদের দৃষ্টিতে জীবনাদর্শ ও সাহিত্যাদর্শ আলাদা। আসলে জীবনাদর্শ বা জীবনদর্শন বলে কি কিছু আছে তাদের?

কবিতায় আধুনিকতাবাদীদের নৈরাশ্যবাদ সম্পর্কে আইয়ুব উল্লেখ করেছেন, ‘দুঃখ ও পাপের মাত্রা আধুনিক কালে আগের চেয়ে বেড়েছে কিনা এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে; কিন্তু সাহিত্যের উপর তার ছায়া যে অতি বৃহৎ আকার ধারণ করেছে তাতে সন্দেহের কোনোই অবকাশ নেই। প্রতিবিম্ব বিম্বকে আয়তনে এবং বর্ণের কালিমায় বহুগুণে ছাড়িয়ে গেছে বলে আমার বিশ্বাস।’ বুদ্ধদেব বসু কথিত ‘প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, সত্যদেবতা’ বোদলেয়ার সম্পর্কে আইয়ুবের একটি মন্তব্য, “বোদলেয়ারের বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় নালিশ এই যে, তিনি প্রতিভাবান কবি অথচ তার আশ্চর্য প্রতিভা তিনি ক্ষয় করেছেন তার নিজের এবং আমাদের সকলের সর্বনাশ ঘটাতে। ... সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ এই যে, বোদলেয়ারীয় ‘আঁনুই’-এর তন্নিষ্ঠ চর্চা আমাদের যুবকদের মনকে যৌবনের প্রারম্ভেই জরাগ্রস্ত করে দিচ্ছে।” আঁনুই মানে নৈরাশ্যবাদ। আধুনিকতাবাদী সাহিত্য সম্পর্কে এমন কঠোর কথাও আইয়ুব লিখেছেন,

“সত্য-মিথ্যার ধার ধারে না কবিতা একথা যদি আধুনিকেরা বলতে চান বলুন, মানতে না পারলেও শুনতে প্রস্তুত আছি। ... কিন্তু যখন দেখি সত্যের ধার ধারেন না বলেই ছোটেন মিথ্যার কাছে বড় অঙ্কের ঋণে আদ্যোপান্ত নিজেকে জড়াতে, তখন প্রতিবাদ না করে পারি না। সমস্ত জগৎকে এবং মানুষ মাত্রকে শুভ ও সুন্দর বলে জানাটা যদি হয় স্বপ্নবিলাস, তবে সমস্ত জগৎকে এবং মানুষ মাত্রকে ঘৃণ্য ও বীভৎস বলে জানাটা দুঃখবিলাস। পাখির গান, চাঁদের আলো, সুন্দরীর হাসি নিয়ে কাব্যে বাড়াবাড়ি করা যদি ন্যাকামি বলে নিন্দিত হয়, তবে মানুষের দুঃখ ও পাপ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা কঠোরতর ভাষায় ধিক্কৃত হওয়া উচিত, কারণ সে বাড়াবাড়ির ফল হবে দারুণতর। দারুণতর হবে বিশেষত এই জন্য যে, অধুনাতন সাহিত্যিক অমঙ্গলবিলাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত দেখি মধ্যযুগের আদিপাপ সংক্রান্ত উন্মীলিতপ্রায় ডগ্মার বা তার বিকৃততর সংস্করণের পুনরুজ্জীবন। মানুষের স্বভাবে এমন এক চিরজন্মগত দোষ অবশ্যই বিদ্যমান যাতে করে কোনো কালেই সে মানুষ হয়ে উঠবে না, আত্মরতিতে, পরশ্রীকাতরতায়, কপটতায়, হিংসায় নিমজ্জিত হয়ে থাকবে দূরতম ভবিষ্যতেও, এক পাপ ছাড়লে অন্য ঘৃণ্যতম পাপে লিপ্ত হবেনবযুগের এই কুসংস্কারকে সুশিক্ষিত মানুষের মনে বদ্ধমূল করে তার কর্মপ্রেরণাকে অঙ্কুরে বিনাশ করে দেয়াটা আধুনিক সাহিত্যের এক দুরপনেয় কীর্তি।” 

আধুনিকতাবাদী লেখকদের জীবনজগৎদৃষ্টিকে আইয়ুব মনে করেছেন একপেশে-অবাস্তব। জীবনানন্দ দাশ আইয়ুবের লেখায় বিশেষ গুরুত্ব পাননি হয়তো এজন্য যে, জীবনানন্দের জীবনজগৎদৃষ্টিকে তিনি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। জীবনানন্দকে গভীরভাবে বুঝবার চেষ্টা কি তিনি করেছেন? 

আইয়ুব ছিলেন ধনাত্মক, সদর্থক, পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গির ভাবুক। ঋণাত্মক, নঞর্থক, নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি বাস্তবসম্মত মনে করেননি। নৈরাশ্যবাদ, রুগ্নতা, মরবিডিটিকে তার কাছে লেখার মূল অবলম্বন হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তার মতে, ভালো ও মন্দে পূর্ণ এই জগতে ভালোকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করা হওয়া-উচিত মানুষের মূল লক্ষ্য। আইয়ুবের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানুষ এটাই অনুভব করে। ভালোকে বিকশিত করার জন্য খারাপকে অতিক্রম করে যেতে হবে। ভালোটাকে পরিহার করে কেবল খারাপের মোকাবিলা করতে গেলে ব্যর্থতা, পরাজয় ও হতাশা অনিবার্য। আইয়ুবের মতে, নৈরাশ্যবাদ পরিহার্য; কিন্তু দুঃখ, হতাশা জীবনে দেখা দেবেই, অপরাজেয় মনোবল নিয়ে সেগুলোকে পরাজিত করে করে এগিয়ে চলতে হবে- মোকাবিলা করা না গেলে শক্তি সঞ্চয়ের ও মোকাবিলা করার উপায় সন্ধান করতে হবে। আইয়ুব মনে করতেন ব্যক্তিগত ও যৌথ প্রয়াসে মানবচরিত্র সীমাহীন রূপে শোধনীয়। আধুনিকতাবাদীদের প্রচারিত নৈরাশ্যবাদের জয়জয়কারের কালে শিক্ষিত সমাজে আইয়ুব এই জীবনজগৎদৃষ্টি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। আইয়ুবের ছিল অত্যন্ত গভীর, সূক্ষ্ম ও ব্যাপক শ্রেয়োনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি। ইংরেজিতে Poetry and Truth গ্রন্থটি তিনি রচনা করেছেন বিশ্বব্যাপী কাব্যামোদী, সাহিত্যানুরাগী, জ্ঞানানুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের মনকে তার সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে শিল্পকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে মেধাবীদের একাংশে যে নৈরাশ্যবাদের সূচনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও 

শিল্প-সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে মেধাবীদের একাংশে যে শূন্যবাদের সূচনা, মানবজাতির জীবনজগৎদৃষ্টি তা দ্বারা বিভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত হয়েছে। এই দুর্গতি থেকে উদ্ধার লাভের জন্য আইয়ুবের চিন্তা যুগান্তকারী হয়ে উঠবে যদি এ ধারার চিন্তাকে বিকশিত, সমৃদ্ধ ও কার্যকর করার চেষ্টা চলে। মানবজাতির নৈরাশ্যবাদ ও শূন্যবাদের গ্রাস থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি; সভ্যতার সঙ্কট চলছে পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে অনাস্থা, যুঢ়ড়পৎরপু, অপ্রেম ও নিষ্ঠুরতার প্রাধান্য চলছে। 

আবু সয়ীদ আইয়ুবের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যে স্মরণগ্রন্থ১ প্রকাশ করা হয়েছে তা পড়ে আইয়ুব সম্পর্কে এমনই কিছু ধারণা লাভ করা যায়। ‘আইয়ুব : স্মরণগ্রন্থ’ নামের এই গ্রন্থের সম্পাদক মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম। সাইফুল ইসলাম ঢাকার লেখক, কিন্তু তার সম্পাদিত এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা থেকে। গ্রন্থটিতে ঢাকার ও কলকাতার কয়েকজন আইয়ুব-অনুরাগী লেখকের লেখা সংকলিত হয়েছে। এতে অন্নদাশঙ্কর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, আরতি সেন, অশীন দাশগুপ্ত, স্বপন মজুমদার, সৌরীন ভট্টাচার্য, সুতপা ভট্টাচার্য, মানসী দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, বিকাশ চক্রবর্তী, অরুণ সরকার, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবুল কাসেম ফজলুল হক, আবুল হোসেন, শওকত ওসমান, রশীদ করীম, সন্জীদা খাতুন, সুস্মিতা ইসলাম, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, আফজালুল বাসার, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নাজম্-উস্-সাকিব ও আবুল আহসান চৌধুরীর লেখা আছে। সবাই লিখেছেন আইয়ুবের জীবন ও কর্মের, বিশেষ করে তার চিন্তাধারার নানা দিক নিয়ে। কেউ কেউ লিখেছেন স্মৃতিকথা। সবার লেখাতেই গুরুত্ববোধের ও আন্তরিকতার পরিচয় রয়েছে। গ্রন্থটি পাঠকের কাছে আইয়ুবের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার পরিচয় মোটামুটি পরিস্ফুট করে। গ্রন্থের শেষে সংকলিত আছে আইয়ুবের লেখা কয়েকটি চিঠি। চিঠিগুলো দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, নরেশ গুহ, বুদ্ধদেব বসু, মানসী দাশগুপ্ত, মৈত্রয়ী দেবী, শামসুর রাহমান, শিবনারায়ণ রায় ও হোসেনুর রহমানকে লেখা। চিঠিগুলোতে আইয়ুবের মানসপ্রবণতা, ব্যক্তিত্ব এবং বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ আছে।

আইয়ুবের ছাত্রী এবং পরে স্ত্রী গৌরী আইয়ুব আইয়ুবের সৃষ্টিশীল চিন্তাধারা ও মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মনে হয় তাদের দাম্পত্য জীবনে যথার্থ সৌন্দর্য ও মাধুর্য ছিল। এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে আরতি সেনসহ আরও দু-একজনের লেখায়। গৌরী আইয়ুবের সহায়তা ছাড়া আইয়ুবের লেখাগুলো এমন সুন্দর ও সূক্ষ্ম রূপ পেত কিনা সে প্রশ্নও উঠতে পারে। আইয়ুবের লেখার পেছনে গৌরী আইয়ুবের দান অপরিসীম।

সংকলিত লেখাগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে এই আলোচনার পরিসর দীর্ঘ হয়ে যাবে। এখানে দীর্ঘ আলোচনায় যেতে চাই না। সবার লেখার মাধ্যমে গোটা বইটিতে অভিব্যক্ত বক্তব্যের মর্মার্থই শুধু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আইয়ুবের চিন্তা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম আন্তরিক আগ্রহবশে লেখাগুলো সংগ্রহ করেছেন এবং গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন। তিনি শিবনারায়ণ রায় ও অম্লান দত্তের সহায়তা নিয়েছেন।

গ্রন্থটিতে একটিও ছবি দেওয়া হয়নি। আইয়ুব ও গৌরী আইয়ুবের কিছু ছবি, জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি থাকলে ভালো হতো। অনুসন্ধান করলে আরও চিঠিপত্র সংগ্রহ করা যাবে বলে মনে করি। আইয়ুব সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনামূলক লেখা অনেক পাওয়া যেতে পারে। গ্রন্থটিতে আইয়ুবের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার পরিচয় যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তা সামান্য নয়। এজন্য সম্পাদক প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। গ্রন্থটি সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। দে’জ পাবলিশিং এ গ্রন্থ প্রকাশ করে একটি মহৎ কাজ করেছে। আবু সয়ীদ আইয়ুবের রচনাসমগ্র সযতেœ প্রকাশ করা দরকার। তার প্রতিটি বই ভালোভাবে বাজারে রাখা দরকার। বাংলা ভাষার দেশে তার চিন্তার প্রভাব শুভকর হয়েছে এবং হবে। তার চিন্তা নৈরাশ্যবাদ ও শূন্যবাদের গ্রাস থেকে মানুষকে রক্ষা করে, উদ্ধার করে, এবং সুস্থ স্বাভাবিক সৃষ্টিশীল জীবনযাপনে আগ্রহী করে। বহুজনের চর্চার মাধ্যমে এ ধারার চিন্তার সর্বমুখী বিকাশ দরকার। সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে মানবজাতি যে সভ্যতার সঙ্কটে পড়েছে, তা থেকে উদ্ধার লাভের জন্য এ ধারায় চিন্তা ও তার অনুসরণে কাজ করা দরকার। দুনিয়াটাকে বদলাতে হবে। অত্যুন্নত নতুন প্রযুক্তির বিস্তার, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলয় এবং উৎপাদনবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি নিয়ে মানবজাতি আজ যে সঙ্কটে নিপতিত, তা থেকে উদ্ধার লাভ করতে হবে। 

লেখক : আহমদ শরীফ অধ্যাপক চেয়ার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১. মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম সম্পাদিত-আইয়ুব: স্মরণগ্রন্থ, প্রথম প্রকাশ-ডিসেম্বর ২০০৭, প্রকাশক- দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা ৭০০০৭৩, পৃষ্ঠাসংখ্যা- ২৪৮ (রয়েল ১/৪), মূল্য- দুশো টাকা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //