আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: অতীত-বর্তমান

শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম ও বিবিধতা
প্রথম বিষয় হচ্ছে যে আগের সময় বলতে অধিকাংশ মানুষের ভাষা বা চিন্তাতে এক ধরনের স্থানচ্যুতি কাজ করে বা ফ্লুইড ভাব কাজ করে। আগের সময় বলতে কোনো কাল-নির্দিষ্টতা নেই। আবার সম্ভাবনা আছে- এই ধরনের অভিব্যক্তি খুব কাজের না। কারণ আগে এটা ছিল, এখন নেই ইত্যাদি অভিব্যক্তির কোনো সীমা নেই এবং তা নিরর্থক; কিন্তু কতকগুলো মার্কার বা স্মারক দিতে পারি। ধরা যাক, আমি বৃহত্তর সহকর্মীদের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার মান ও প্রণালি নিয়ে যথেষ্ট সজাগতা পাই না। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মধ্যে নানান ধরনের বৈষম্য আছে। বৈষম্য বলতে বোঝাচ্ছি লজিস্টিক থেকে শুরু করে পেডাগজি পর্যন্ত- মাদ্রাসা থেকে ভোকেশনাল পর্যন্ত। একটা হচ্ছে আউটলেটের ভিন্নতা, একেবারেই শিক্ষা প্রণালির যে ভিন্নতা। আরেকটা হচ্ছে একেবারেই অপেক্ষাকৃত সচ্ছলভাবে কাজ করতে থাকা মানে স্কুল-কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য- কেন্দ্রীয় স্কুল-কলেজ, বড় শহরের স্কুল কলেজ, প্রাইভেট স্কুল-কলেজ। আবার তার বিপরীতে আছে একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল-কলেজ, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিংবা ভোকেশনাল মাধ্যমগুলো। এই যে একটা বিশাল ধরনের বিভিন্ন রকমের আউটলেট, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রণালি, নানাবিধ লজিস্টিক এবং ভৌত ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু রয়েছে; শিক্ষক সংকট থেকে শুরু করে যা কিছু আছে- এসব নিয়ে যে শিক্ষকরা ভাবেন না আমি সেটা বড় গলায় আমি অভিযোগ করছি না।  বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যারা অপেক্ষাকৃত গণতান্ত্রিক ভাবনা দিয়ে আসছেন, তাদের কথাবার্তা, চিন্তা-চেতনা থেকে এই বিশাল বৈষম্যপূর্ণ তিন পর্ববিশিষ্ট শিক্ষাকাঠামোর ফলশ্রুতিতেই যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পাই, এই উপলব্ধির কম নজিরই পাই। 

সর্বশেষ যে উদাহরণ এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সেটার কথা বলি, জাতীয় খবর হয়েছে বলেই। এমপিওভুক্ত নয় এমন অনেক বেসরকারি স্কুল-কলেজে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সেখানে অনেক শিক্ষক আছেন। সালটা ২০০৯, ১০ বা ১১-এর দিকে। শিক্ষকেরা তাদের বেতন কাঠামো নিয়ে সরকারের সঙ্গে কিছু দেন-দরবার বা দাবি-দাওয়া উপলক্ষে শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছিলেন। এবং বাস্তবে যেটা ঘটেছে তা হলো- তাদেরকে জল কামান প্রয়োগ করে হটিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রজা শাসন করার জন্য খরিদ করা মরিচগুঁড়া বা পেপারস্প্রে প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করা হয় এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। খবরের কাগজ থেকে জানা যায়, অন্তত দুজন শিক্ষক এই ঘটনার পর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানসিক আঘাত নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় মারা যান। দুজনের মারা যাওয়ার ঘটনাটিকে অনেক বড় বা ছোট না করেও বলা যায় যে বিস্তর দুর্দশার মধ্যে থাকা শিক্ষকতা পেশা, এমনকি আশেপাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নিম্ন বেতন কাঠামো, তারও মধ্যে যাদের নিয়মিত বেতন ব্যবস্থা ছিল না- তারা ছিলেন সেসব শিক্ষক। এই বিষয়গুলোকে পটভূমি আকারে অনেক দীর্ঘ না করে যা বলতে চাইছি তা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল- আলোচনার স্বার্থে এমনটি যদি ধরেও নেই যে ১৫-২০ বছর আগে অনেক সুবিধাজনক ছিল, তাতেও দেখা যাবে সেগুলো অত্যন্ত নিজ স্বার্থকেন্দ্রীক বা ইন্টারেস্ট-ওরিয়েন্টেড ছিল। তাদের ভেতরে কেউ অত্যন্ত প্রশাসনমুখী, রাষ্ট্রমুখী সরকারের অনুগত থাকতে পারেন, কেউ কেউ আবার না থাকতে পারেন, সেসব মাত্রা বাদেই, আমাদের কর্মক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের এই সুবিশাল ছড়ানো-ছিটানো, বৈষম্যপূর্ণ, বহুবিধ শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সার্বক্ষণিক একটা বোধ বা উপলব্ধি আমি খুব একটা লক্ষ করিনি। এর বাইরে তো অনেকগুলো বিষয় এমনিতেও ভাবা দরকার। 

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটের ওপর নিম্নস্নাতক বিশ্ববিদ্যালয়, যাকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বলা হয়। সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো আন্তঃসংযোগ নেই, কারিকুলামগুলোর কোনো উল্লেখযোগ্য সংযোগ নেই; আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবন ও পাঠ্যসূচির সঙ্গে রাষ্ট্রবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীর ও পাঠ্যসূচির তেমন কোনো সম্পর্কই তৈরি হলো না সারাজীবনে। দূরত্বের এই সংকট দিনে দিনে বাড়ছে। তারপরও যদি ধরে নিই যে নিম্নস্নাতকের ব্যবস্থাপনা বা শিক্ষার মান কুড়ি বছর আগে অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল, তাহলে তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অপেক্ষাকৃত তীক্ষ্ণ ও প্রসারিত ছিল। কেবল একটা পূর্বানুমান হিসেবে এটা আমার বক্তব্য নয়, তারপরও সেটা ছিল এক ধরনের সংহতি-চেতনার অভাবসম্পন্ন। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ১২ বছরের শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যা পড়ে আসেন বা তাদেরকে যারা পড়াতেন সেসব শিক্ষকের জীবিকা বা নির্বাহের যে বন্দোবস্তগুলো আছে, এসবের বিষয়ে দৈনন্দিন চলাফেরার মধ্যে একটি সুগঠিত-সুচিন্তিত বোধ বা চৈতন্য কোথাও ছিল, তা আমি তেমন দেখিনি। আমি যে কমিউনিটি বা পেশাদলে কাজ করি সেখানে গুরুতরভাবে এসব নিয়ে জিজ্ঞাসা বা জিজ্ঞাসু মন অন্তত আমার নজরে আসেনি। আমরা কেউ বেশি কাজ করি, কেউ কম কাজ করি, কিংবা কেউ বাহানা খুঁজি- সেসব ভিন্নতার বাইরেই উপলব্ধি ও জিজ্ঞাসা জগতের এই আত্মমগ্নতা-স্বার্থপরতা নিয়ে আমি বলছি।

বাংলাদেশের এই বিশাল প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার  ব্যাপারে বৌদ্ধিক-যৌক্তিক প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ গ্রহণ উচ্চ শিক্ষায়তনে ঘটেনি। যদি ধরেও নেই যে ২০ বছরের আগের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল, কিন্তু দেখা যাবে তাতেও ছিল একটা সাধারণ দুর্দশা।

আর একটা উদাহরণ হবে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। কতকগুলো মৌলিক কারণেই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। যদি বাস্তবিক মেনে নেই যে একটা রাষ্ট্রের কিছু শিক্ষার্থী কেবল নিজের ভাষায়, মাতৃভাষা বা রাষ্ট্রভাষায় কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ, জ্ঞান লাভ (এ ধরনের শব্দগুলো আমার অপছন্দের) ও ডিগ্রি লাভ করতে পারেন, সেটা কোনো অপরাধ না, সেটাতে কোনো গৌণত্ব নেই। বিশ্বের বহুরাষ্ট্র একেবারেই নিজ ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে। যদিও গত ১৫-২০ বছরে এটা দ্রুত আকারে বদলেছে, মোটাদাগে বলে রাখলাম, সম্ভবত বর্তমান বিশ্ব কাঠামোতে এটাই বাস্তবতা। 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় যখন তৈরি হলো, তখন বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক অপেক্ষাকৃত নিম্ন আয়ের মানুষজনের সন্তানরা, যারা টানাটানির মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিলেন, তাদের জন্য দুর্দান্ত পরিক্ষেত্র হতে পারত। কী কী কারণে জরুরি প্রতিষ্ঠান হতে পারত তা বলছি। এক. দূরশিক্ষণ প্রণালি ছিল; দুই. বাংলা মাধ্যমের ব্যাপারে মনোযোগী ছিল এই প্রতিষ্ঠান; তিন. কাঠামোটাই অল্প আয়ের, অল্প বেতনের অল্প ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে থাকা সম্ভব ছিল; চার. যারা চাকরি বা কাজ করতেন, তাদের পক্ষে নিকটবর্তী স্যাটেলাইট কেন্দ্রে যোগাযোগ করে পড়ালেখা চালানো সম্ভব ছিল। 

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই ছিল অপেক্ষাকৃত জনগণতান্ত্রিক। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা ঘটে গেল সেটাকে নিছক দুর্ঘটনা বললে কম বলা হবে। 

প্রথমত- উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর কাছাকাছি সময়ে টেলিভিশনের একটা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি হলো, এবং সেটা টেরেস্ট্রিয়াল। তৈরি হলো বলতে এর একটা মানে হলো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দিক থেকে যেমন, টাকা-পয়সার লগ্নির দিক থেকেও সামর্থের। টাকা-পয়সার কথা বলছি কারণ এত এত কনস্ট্রাকশন হয়েছে যে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিপুল প্রকল্প বুঝতে তো বাধা নেই। রাষ্ট্র, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্তা প্রতিষ্ঠান যা আছে তারা এই শিক্ষাকে আরও টেলিভাইজ করার উদ্যোগ নিতে পারতেন। শুধু বিটিভিকেন্দ্রীক তিন-চার ঘণ্টার শিক্ষা মাধ্যমকে আরও সম্প্রসারণ করার ব্যবস্থা করা যেত এবং পুরো বিষয়টিকেই একটি কার্যকরী জনগণতান্ত্রিক উপায়ে, অপেক্ষাকৃত অল্প শিক্ষা খরচে, অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষজনের জন্য, অপেক্ষাকৃত উচ্চতর ডিগ্রিগুলো দেওয়া সম্ভব ছিল। বরং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই একই ধরনের প্রশাসনিক টানাহেঁচড়া ও চেয়ার দখলের জায়গা হয়ে পড়ল।

খুব দুঃখজনক যে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরদের মধ্যে প্রধান যে ব্যক্তি- শমসের আলী, তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে বিচার করতে থাকা হলো। ফলে সত্যি বলতে গেলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো সম্ভাবনা, যা হতে পারত, তার ধারে-কাছেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গেল না। এদের শিক্ষার্থী সংখ্যা কত বিপুল সেসব হিসাব থেকে বলছি না। আমি বলছিলাম, যে গুণমান ও পরিষেবা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হতে পারত তা বিনষ্ট হওয়ার কথা নয়। অধিকতর জনগণের জন্য যেভাবে, যে মানে, নিজ ভাষাকে অবলম্বন করে, যে ধরনের শিক্ষাদান করা সম্ভব ছিল, তা প্রদান করা হয়নি। এটা বড় একটা বিপর্যয়।

সমান্তরাল আরও উদাহরণ আছে। অনেকের মনে পড়বে বা মনে করিয়ে দিলে মনে পড়বে যে, মাত্র ২০, ৪০ বছর আগে কয়েকটা প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত্ব আবার সার্বভৌম ধরনের প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে বাংলা একাডেমি আছে, বিআইডিএস আছে; এশিয়াটিক সোসাইটি আবার আরেক ধরনের। এখন বিআইডিএস বা বাংলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা নিয়ে চুলচেরা নানা ধরনের বিশ্লেষণ হতে পারে; কিংবা এশিয়াটিক সোসাইটির উৎপাদন নিয়েও। একটা যদি খুব বেশি বাংলা সাহিত্য ধরনের হয়ে থাকে, আরেকটা খুবই কনভেনশনাল ইকোনমিক্স হয়ে থাকতে পারে। অন্যটার ইতিহাসবোধ বেশি সাবেকী হতে পারে। এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলতে পারে; কিন্তু আমি এই মুহূর্তে এগুলোর ক্রমাগত গুরুত্বলাঘবের দিকে জোর দিচ্ছি। এই গুরুত্বহানি ক্ষতিকর। যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে জানগণিক বোধ ছিল, লৌকিক তাগিদ ছিল, যেখানে দেশজ অনেকগুলো গবেষণা এজেন্ডা ছিল সেসব প্রতিষ্ঠানের যে মূল্যমান, এমনকি ফেসভ্যালু, গভীরতরভাবে তা অকার্যকর বা ভূলুণ্ঠিত হয়ে চলেছে। তাদের যে মূল্যমান তা হীনবল হয়ে পড়েছে। এর কারণটা যে শুধু বার্ষিক বাজেটের পরিমাণজনিত তা নয়, সেটা মাত্র একটা দিক। আরেকটা দিক হলো- বৈশ্বিক প্যারামিটারগুলো এত দ্রুত বদলাচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষেও তাল রাখা সম্ভব নয়। যদি কোনো কারণে ৮২ বা ৮৩ সালে বিআইডিএসের কোনো গবেষক, হোক তা ইকোনমিক্স-সেন্ট্রিক, গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করে থাকেন, সেটা উত্তরকালীন প্যারামিটারগুলোতে কিন্তু ভিন্ন বিচারে পড়ে গেছে। এখন এই ধরনের কাজে এসব প্যারামিটার এসেছে যে গবেষণায় লগ্নির পরিমাণ কতটা, দিচ্ছে কোন কোন সংস্থা, সেটা ইংরেজিতে প্রকাশ হলো কিনা, সেটার প্রকাশক একজন ব্র্যান্ডেড কিনা। তাই বলছি যে, এই নতুন ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ, মূল্যমান তো এমন প্রতিষ্ঠানে নির্ধারণী হওয়ার কথা নয়। এই কাঠামোগত হীনম্মন্যতাবোধ ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না এমন প্রতিষ্ঠানে। কারণ তা বিপজ্জনক। 

প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মচারীদের মেধার প্রসঙ্গ এখানে তুলছি না। বস্তুগতভাবে, যদি লজিস্টিক্যালি এবং দার্শনিকভাবেও ভাবি, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর যে সামাজিক, গুণগত ও বৌদ্ধিক মূল্যমান তা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। যেসব কর্মচারী এখানে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক প্যারামিটারগুলো দ্রুত গতিতে বদলানোর ফলে তারা নিজেদের কাজগুলোকে আর সেই পরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পারলেন না। যে কাজটা 

আপনি-আমি করছি, সেই কাজটা যদি আমরা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ না মনে করি তাহলে আমাদের থেকে যারা পরিষেবা পাবেন তাদের তা দিতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের কাজকে যদি আমরা খুবই অগুরুত্বপূর্ণ মনে করি, গৌণ বিবেচনা করি তাহলে সেখানে কী সম্ভাবনা আছে যে পরিষেবা দিতে পারব। নিজেরাই তো বিশ্বাস করি না যে আমরা একটা অগৌণ কাজ করছি! 

বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরিতে রিটায়ারমেন্ট করে অবসর কাটানো যায় হিসেবে মানুষজন আসেন; কিন্তু বেতনের পরিমাণ পাশের কোনো রাষ্ট্রের কারও কাছে না লজ্জায় বলা সম্ভব, না জীবন নির্বাহ করা যায়। তবে এটুকু বলা সম্ভব- হ্যাঁ এটা দিয়ে আমি চলতে পারি। বেতনের তুলনা ভারতের সঙ্গে বাদ দিলেও পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কার তুলনায়ও দৃষ্টান্তমূলক ও শোচনীয়ভাবে কম। প্রাথমিকের এই দশার সঙ্গে মানানসইভাবে অন্য পর্বগুলোরও একই দশা। আমার মনে হয় যে অনেকগুলো প্রসঙ্গ মিলিয়ে একটা মোজাইক তৈরি করলাম; কিন্তু আশা করব আমি অপ্রাসঙ্গিক থাকিনি যে, কোন পরিস্থিতির মধ্যে আমরা দীর্ঘদিন আছি।

কোভিডকালীন শিক্ষাব্যবস্থা
করোনাকালীন শিক্ষা পরিস্থিতিকে আমি অন্তত দুই-তিনটি মাত্রায় দেখতে চাই। ‘শিক্ষা ক্ষেত্রে করোনার যে প্রভাব’- এরকম একটা অফিসিয়াল শিরোনামে যদি দেখি। করোনাকালীন বা করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে যে প্রভাব বলবৎ ছিল সেটা ভয়ভীতিজনিত। মাঝখানে কিছুদিন ডেঙ্গু আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ আশঙ্কাজনক বিবেচিত ছিল। ওই সময়ের একটি মাত্রা হলো- স্বাস্থ্যগত বা সমাজ স্বাস্থ্যগত পরিস্থিতি। দ্বিতীয়- যেভাবে আমি এটা দেখি এবং তা হচ্ছে, এটা সম্ভবত গ্লোবাল গভর্ন্যান্সগত বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। করোনা জীবাণুরা সেটা নিজেরা জানে না বলেই মনে হয়। তবে এর কনসিক্যুয়েন্স হিসেবে গ্লোবাল গভর্ন্যান্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারফেস বদল ঘটেছে; কিংবা যেটাকে বলে লে-আউট।

এটা নিয়ে বলার আগে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অথচ সম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলছি। এটা গ্লোবাল গভর্ন্যান্স বোঝার প্রসঙ্গে। জুম থেকে শুরু করে নেটফিক্সকে বিবেচনা করি। একটা তথাকথিত সভা সেমিনার করার মাধ্যম আর একটা হচ্ছে চলচ্চিত্র পরিষেবা কোম্পানি। এগুলোতে যে লাভ বা মুনাফা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য; উপরন্তু আমাদের নানান রকমের অভ্যাসের রূপান্তর হয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্রের খাদন তথা কনজাম্পশন তীব্রতর ও পরিব্যাপ্ত হয়েছে। জুমে দক্ষতা বেড়েছে। এমনকি যারা ভাবতেন অনলাইনে সম্ভব না, তারাও দিব্যি অনলাইনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এখানে একটা নতুন রিডারশিপ তৈরি হয়েছে। এখানে মনোদার্শনিক ও মনোজাগতিক যে বদলগুলো, সেখানে নতুন ধরনের কারিগরি বা লে-আউট তৈরি হয়েছে। নতুন নতুন মুনাফার পাশাপাশি নতুন ধরনের মনোগত দার্শনিক বদলগুলো অনায়াসেই করোনার আগে ঠিক ম্যাথমেটিক্যালি আন্দাজ করা যায়নি। এই বদলটিকে আমি গভর্ন্যান্স প্রণালি বদল হিসেবেই দেখতে চাইছি। 

স্ক্রিননিষ্ঠতা সারা দুনিয়াতেই বিরাট একটা জীবনযাপনগত বদল, মনোজাগতিক বদল, বিশেষ করে হোয়াইটকলার পেশাজীবীদের বেলায় পর্দানিবিষ্ট পেশার উদ্ভব হয়েছে, পর্দানিবিষ্ট জীবনযাপন বেড়েছে। তা এন্টারটেইনমেন্ট ধরনের ভোগ হোক, কিংবা বুদ্ধিবৃত্তি ধরনের ভোগ। এই বিশ্বব্যাপী পর্দানিবিষ্ট চাকরির পরিমাণ এবং সেবনযোগ্য প্রডাক্ট বাড়ার মানে হলো দীর্ঘ বিশাল একটা আর্থিক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠা; একটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলা। সেটা শিক্ষা থেকে শুরু করে বিনোদন/স্ক্রিন পর্যন্ত। একেকটা নতুন দুরবস্থার মধ্যে কীভাবে নতুন ধরনের প্রান্তিকীকরণ চলে, নতুন রকমের সর্বস্বান্তকরণের বন্দোবস্ত আছে সেগুলোর একটা খতিয়ান বোঝা দরকার। এটাই হয়তো আমার ভাবনার তৃতীয় মাত্রাটি। এখানে আসলে রাষ্ট্র পরিচালনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা ছাড়া কোনো রাস্তা নেই আমাদের। চরম প্রতিকূল ও সংকটাপন্নকালেও কীভাবে আগামীদিনের শিশুরা মৌলিক ও ন্যূনতম প্রশিক্ষণগুলো পেতে পারে তার একটা আগাম পরিকল্পনাও ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গ এটা। লক্ষ করুন, আমি দুটো ধারণাই প্রয়োগ করলাম- মৌলিক ও ন্যূনতম। বাস্তবে রাষ্ট্র ও বিবিধ এজেন্সি উল্টো এসব দুরবস্থাতে দরিদ্র মানুষদের জন্য নতুন নতুন ফাঁদ নিয়ে হাজির হয়। 

একটা দুর্যোগকালীন সময় থিতু হওয়ার পর কী উপায়ে কী কী সামাজিক ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়া হবে তার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ খুবই সাধারণ প্রসঙ্গ। নাগরিকদের জন্য সেসবের সুলভতাও সাধারণ নাগরিক সুবিধা। দুর্যোগ-পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থাপনা বুঝতে পারা এমন জটিল কিছু না। ১৯৭১ সালের পরের ম্যাট্রিক পরীক্ষা আয়োজনের ঝামেলা নিয়ে লোকে জানেন, তার মান একই রকম ছিল কিনা সেই জিজ্ঞাসাটা বড় হয়ে থাকেনি। একইভাবে যেগুলোকে আমরা ‘এরশাদ ভেকেশন’ বলতাম সেগুলোরও নানান ধরনের ঝামেলা গেছে। যদি একদম প্রশাসনগতভাবেও ভাবা হয়, তাহলে বিপুল ব্যাকলগ সামলাতে হয়। কিন্তু সমাজের দারিদ্র্যের প্রসঙ্গটা স্বতন্ত্র, এটা বিদ্যা-প্রশাসনিকভাবে সামলানোর বিষয় নয়। 

এই যে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণিতে যারা, তাদের একেবারে রুটি-রুজির টানাটানি হয়ে গেছে। তাদের সংখ্যাটা বিশাল। এই অবস্থার মধ্যে তারা কীভাবে বেঁচে আছেন? আদৌ বেঁচে আছেন কিনা! গরিবের মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা সহজ নয়, ভেঙে বলাও সম্ভব না। যত সতর্কভাবেই সামাজিক ডায়াগনসিস করে আসি না কেন, বলা যাবে না যে মৃত্যু হয়েছে দারিদ্র্যের কারণে, কিংবা দারিদ্র্যটা ব্যবস্থাপনাগত। বলতে হবে- তিনি কলেরায় মারা যাচ্ছেন, কেউ ছাদ থেকে পড়ে। এর সবগুলো দারিদ্র্যের ম্যানিফেস্টেশন। কারণ মারা যাচ্ছেন তিনি হয়তো ঈদের দিন বাড়ি যেতে গিয়ে। কিন্তু ঈদের দিনই তার গাড়িতে চড়তে হলো কেন? সামান্য যে মজুরিতে তিনি শ্রমিকের কাজ করেন সেটা আগে পাননি বলে তো! গাড়ি বা লঞ্চে মারাত্মক গাদাগাদি করে ১৫০ জনের লঞ্চে ৩০০ জন উঠেছিলেন বলে তো! ৪০ সিটের বাসে ছাদসমেত জনা ৮০ ছিলেন বলেই তো! এগুলো বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানা লাগবে না, পত্রিকাতে যা-ই লেখা হোক না কেন। ওই যে বীরসা মুণ্ডার কলেরায় রক্ত বমি করতে করতে মারা যাবার প্রতিবেদনের মতো। বাংলাদেশে কারও যদি সংবেদন থাকে তাহলে তিনি জানেন যে জেলখানায় কীভাবে বীরসা মারা গেছে কিংবা কীভাবে ভবনের বা বাসের ছাদ থেকে মানুষ মারা যান। এরকম একটা পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যের দৃশ্য এক রকমের থাকে না। একই রকমের দুর্দশাতে দারিদ্র্যাক্রান্ত মানুষের জন্য দুর্দশাটা একই থাকে না। দীর্ঘ সময় ধরে এই বাস্তবতাগুলো তৈরি করা হয়েছে, যার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কোনো সম্পর্কই নেই।

এই প্রসঙ্গে লেগুনা গাড়ি নিয়ে ঢাকার মধ্যবিত্ত মনোজগতে বিশৃঙ্খলার বিষয়টি মনে পড়ল। ব্যাটারিচালিত গাড়ি নিয়েও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল, যা নিয়ে আমার কলিগ-বন্ধু মোহাম্মদ আজম কাজ করেছেন। লেগুনা ও ব্যাটারি-রিকশার সংকটগুলো একদমই স্বতন্ত্র, কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে একত্রে মনে পড়ল। আবার দুটিই দারিদ্র্যের সঙ্গে আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। করোনাকালীন শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে এমনকি অ-করোনাকালীন দারিদ্র্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বলতে হলো। যে দুরবস্থা ব্যবস্থাতান্ত্রিকভাবে, সিস্টেম্যাটিক্যালি তৈরি করা সেটাকে আলাদা করে না দেখার উপায় নেই; রাষ্ট্রকে অভিযোগ করা ছাড়াও উপায় নেই। লেগুনার প্রসঙ্গ আচমকা তুলিনি। যে বাচ্চারা এগুলোতে হেল্পারের কাজ করে তাদের বয়স ৮ থেকে ১৪ বছর। আর ১৪ বছরের উপরে হেল্পারদের পাওয়া যাবে বাসে বা মিনিবাসে। সেখানে আবার সর্বোচ্চ পাবেন ৪০-৪৫ বছরের কর্মচারী। আমরা কারও জন্য কিছু করতে না পারলেও মনুষ্যচক্ষে এগুলো অভিজ্ঞতা করে অন্তত সঠিক প্রশ্নগুলো ভাবতে পারি। ৮-১৪ এই ছয় বছরের জীবনচক্রের পর এই বাচ্চাগুলো কোন পেশায় যান, কীভাবে জীবিকা চালান। একদল অবশ্যই লেগুনার ড্রাইভার হয়েছেন, ধরে নেয়া যায়। ২২-২৫ বছরের চালকেরা। তাতেও কয়েক বছরের হিসাব মেলে না। এই অন্য সময়গুলো, তারা সকলেই বেঁচে আছেন যদি ধরেও নেই, তাতেও আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো রিডিং নেই যে তাদের নির্বাহ হয় কীভাবে। 

সকলেই শেষাবধি কবরে যাবেন তা আমরা জানি। কিন্তু কবরখানায় যাওয়ার আগের পর্বগুলোতে তারা কোথায় কোথায় যান, কীভাবে যান, নির্বাহ করেন তার উপলব্ধি ঢাকা শহরে নিবিড়ভাবে চোখসমেত হাঁটাচলা করেও সম্পন্ন হবে না। আপনি বা আমি আধাটা বা সিকিটা বড়জোর জানি। যখন করোনা ছিল না, এটা তখনকারও বাস্তবতা। তখন নিবিড় শ্রম বিক্রিকারী, অথবা শ্রমবিক্রির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকা লোকগুলোকেই বা আমরা কতটুকু জানি! তাদের ঐশী মৃত্যুর আগপর্যন্ত জীবনটা যে যাপন করেন তার বিষয়ে আমাদের উল্লেখযোগ্য ধারণা কাজ করে না। করোনাকালের প্রাক-যুগেও করত না। ধারণা নেই এখনো।

ঢাকা শহরে অনেক প্রলেতারিয়েত লোকজন আছেন যাদের সিস্টেম্যাটিক বা নির্দিষ্ট কোনো শ্রম বিক্রির জায়গা নেই। যখন শ্রম বিক্রির কথা তুলছি তখন কোনো ধরনের ‘ন্যায্য মূল্যে’র প্রসঙ্গ তুলছি না। বলছি শুধু সেই অনিশ্চয়তার কথা যেখানে গত সপ্তাহে যে কাজটা করেছে সেটা যে এই সপ্তাহে করতে পারবে সেই ধরনের কোনো নিশ্চয়তাই তার জীবনে নেই। এই ধরনের মানুষজন বা তাদের ওপর নির্ভরশীল লোকজনের সংখ্যা আমি নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না, পারার কথা নয়। সংখ্যাটা ঢাকাতেই কেবল ১৫-২০ লাখের নিচে হবে না, উপরে হতে পারে। এই যে একটা পরিস্থিতি অলরেডি প্রাক-করোনাকালেই আছে, সেখানে করোনাকালীন দশা তীব্রতা এনে দিয়েছে। 

নিম্নশ্রেণি প্রসঙ্গে উপসংহার টানি শিক্ষা কাঠামোর একটা বদল বিষয়ে বলে। এনজিওরা যখন রাষ্ট্রের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে এলো, সেখানেও ৪০-৪৫ বছরের একটি ইতিহাস আছে। কমবেশি ৮০’র দশকে শুরু করল তারা। কিন্তু কেউই তেমন ডিগ্রি বা গ্র্যাজুয়েশন দিতে পারল না। আরও সহজ করে বলতে গেলে- স্কুল-সমাপনী সনদমূলক পড়ালেখা তেমন ছিল না। নন-ফর্মাল আর ফরমাল- এ ধরনের বর্গীকরণের ভাষা কিন্তু চালু ছিল তখন। তার মানে হলো, ক্লাস ফাইভের সনদ পাবে- এ ধরনের স্কুলের সংখ্যাই অত্যন্ত কম ছিল এবং ডেজিগনেশন ছিল না স্কুলগুলোর। এটা একটা দিক, বিশেষ করে এনজিও শিক্ষা কার্যক্রমের। আর তাদের আসলে শিক্ষার ব্যাপারে কতটা আগ্রহ ছিল, বিশেষত রাজ-এনজিওগুলোর, এনজিও এম্পায়ারের- সেটা তদন্ত করে দেখার ব্যাপার। এটাকে আমি এক বাক্যে খারিজ করে বা গ্রহণ করতে চাইছি না। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের এই অদূরদর্শিতা, অপরিকল্পনাগুলো ছিল। সরকারি স্কুলগুলোতে গ্র্যাজুয়েশন বা সমাপনী পরীক্ষা আছে, তো আরেকটাতে নেই। আবার সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোতে, করোনা ব্যতিরেকেই, অজস্র শিশু আসে, যারা অন্য সময় শ্রমিকের কাজ করেন। কেউ করেন পেইড শ্রমিকের কাজ আর কেউ করেন আনপেইড কাজকর্ম বা তার বাড়ির কাজকর্ম। সেটা কাঠ কুড়ানোর মতো কাজ থেকে শুরু করে বাবার কাজে হাত লাগানো পর্যন্ত- দড়ি বানানো হোক বা জাল বোনা, কিংবা মায়ের রান্নার জন্য জ্বালানি তুলে দেওয়া। এরকম পেইড আর আনপেইড শ্রমিক শিশুরা একটা ঘুরনা দেওয়ার মতো করে স্কুলে যে আসত তাদের সংখ্যাটা কিন্তু বিপুল, এমনকি প্রাক-করোনাকালেও। করোনা এই দুরবস্থা, দুর্দশাকে মূর্ত ও তীব্র করেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে শ্রেণি নির্বিশেষে যে বিপর্যয় সেটাকে মোকাবিলা বা অ্যাডজাস্ট করতে বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে তার ধারে-কাছেও কিছু হয়নি। 

এটা স্পষ্ট করেই বলা দরকার যে বাংলাদেশের বহুদিন ধরেই শিক্ষা বিষয়ে গুরুতর কোনো এজেন্ডা নেই। যতটা টারশিয়ারি শিক্ষা বিক্রি করার এজেন্ডা, কিংবা আন্তর্জাতিক মানদ-ের মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বিক্রির এজেন্ডা লক্ষণীয়, তার ধারে-কাছেও কোনো জানগণিক শিক্ষা এজেন্ডা নিকট অতীতের বাংলাদেশে নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইউনিভার্সিটি সুলভ হচ্ছে বা মর্যাদাবান হচ্ছে। বলা উচিত আসলে সেটা ব্রিটিশ বা আমেরিকান মাধ্যমিক কারিকুলামগুলোর ক্ষেত্রেও সত্য। এসব বলার সময়ে ‘শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার’ ধরনের কোনো বাকোয়াস আমি করছি না। আরও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ করছি আরও সুস্পষ্ট জায়গায়। এই ব্যাপক অনাচার ও অগণতান্ত্রিক শিক্ষা প্রণালির মুখ্য বিতর্কে না ঢুকে অন্যান্য বিষয়ে কথাবার্তা কেবল আবোল-তাবোল হতে বাধ্য। সত্যি কথা বললে, করোনা এই প্রক্রিয়াতে নতুন করে একটা বিরাট অজুহাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। 

বাংলাদেশের শাসনযন্ত্রে অপেক্ষাকৃত গরিব, অসচ্ছল ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনের জন্য যে একটা কোনোমতে চারটা খুঁটিওয়ালা শিক্ষাব্যবস্থা ছিল সেটাকে আরও উধাও করে দেওয়ার অজুহাত এটা। কোনোক্রমে টিকে-থাকা সেই ব্যবস্থা নিয়ে কাঠামোগত উদাসীনতা ছিল। যে অনিচ্ছা, অনীহা, অনাগ্রহ, উপেক্ষা শুধু দরিদ্র মানুষজনের জন্য ছিল, তা খোদ ভয়ানক। তাতে করোনা এসে এই শ্রেণির মানুষদের শিক্ষাকে সিস্টেম্যাটিক অবহেলা করার ব্যবস্থাকে বিশাল অজুহাত তৈরি করে দিয়েছে- ‘কী করব ভাই জীবাণুর সঙ্গে তো আমাদের পারা যাবে না।’ কিন্তু সত্যি হলো, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এবং আগে থেকেই তীব্র একটা পরিস্থিতি চলছিল, যার কথা এতক্ষণ গুরুত্ব দিয়ে বললাম।

বিস্ময়ের না যে, ঝরে-পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শিশুদের সংখ্যা ‘হা রে রে’ করে বাড়ছে এখন। আমার মনে হয়, আমাদের এখানে শিক্ষা প্রণালির বিষয়ে শাসনযন্ত্রের যে দর্শন, মহা-অগণতান্ত্রিক, পণ্যাকারে সচ্ছল শ্রেণির জন্য বিপণন ও সনদপ্রদানের একটা ব্যবস্থা হিসেবে দেখার যে দর্শন, তার মোটামুটি সর্বাত্মক আয়োজন করল। দেখার সেই দর্শনকে করোনা মজবুত বানিয়ে দিয়ে গেল। 

নতুন শিক্ষা পদ্ধতি
আমার ভালো লাগত যদি বিভিন্ন সময়ে প্রাথমিক-মাধ্যমিক পাঠক্রমে কী ধরনের বদল চলছে সেই বিষয়ে মনোযোগী একটা পাঠ থাকত। নানান কারণে আগ্রহ থাকলেও তা হয়ে ওঠেনি। নতুন নতুন যে নিরীক্ষা চলে সেগুলো নিয়ে আলাদা উত্তেজনা বা আশঙ্কা- কিছুই কাজ করে না। আমি নিস্পৃহ। কারণ এগুলো নানান দিক দিয়ে দেখা সম্ভব। সেটার কারণ বরং বলি। যেমন- আমি ৮৪ সালের এসএসসির ব্যাচ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমরা যখন পড়া শেষ করছি, রাজনৈতিক হেঁয়ালি করে বললে, আমরা হচ্ছি ৭৫-পূর্ববর্তী প্রাথমিক কারিকুলামের শেষ ব্যাচ। বালক বয়সে আমার নানা ধরনের বিচিত্র কৌতূহল থাকাতে আমি নিচের ক্লাসের বদলানো বইগুলো দেখি। আমার খুব মনে নেই যে ফাইভে না সিক্সে থাকতে তা করেছি। আমার বোন আরও একটু নিচে পড়ে, ফলে ওর বই নয়। প্রথমেই মনে পড়ছে সেট মেলানোর অঙ্ক আর নিধানের অঙ্ক। এমন কিছুই হবে সেগুলোর নাম। এত বছর পরে, ৪৫ বছর পরও যে আমার মনে আছে, কারণ গণিতে এই সংযোজন দুটো আমার কাছে নতুন ছিল এবং আমার ভালো লেগেছে। এটা খুব সাধারণ আর সামান্য উদাহরণ দিলাম। সেটের অঙ্ক তো পরিসংখ্যানের প্রাথমিক দিক এবং বেশ খেলার মতো ছিল। আমার কাছে বেশ মজার লেগেছিল। আর নিধানের অঙ্ক, যদি না শব্দটা আমার ভুল হয়ে থাকে, আরও মজার ছিল। এই অঙ্কের চর্চাকারীরা এমন একটা সংখ্যার দুনিয়া কল্পনা করতে বাধ্য হবেন যেখানে ধরা যাক জগতে ৭, ৮, ৯ নেই; আছে শুধু ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ০। গাণিতিক জগৎটা তখন আদ্যোপান্ত বদলে যায় এবং প্রাথমিক এই ভাবনাটা আমাকে উত্তেজিত করে। 

আবার অনেকের অপছন্দের একটা ছড়াও মনে পড়ছে, আমার পরের ব্যাচ থেকেই বলছি- ‘মামুদ মিয়া বেকার/তাই বলে কি শখ নেই তার/বিশ্ব ঘুরে দেখার?/আসলে যখন চেকার/বললে হেসে মামুদ মিয়া/ট্রেন কি তোমার একার?’ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের পজিশন ছিল আমার এবং অন্য আপত্তিকারদের। কেউ কেউ বলেছেন যে কারিকুলামে শিশুদের চুরি করতে উৎসাহিত করছে। প্রকাশ্যে বাক্যটা ওই বয়সে না সাজাতে পারলেও আমার অনুভূতিটা পাবলিক ট্রেনে মানুষের চড়তে পারার অধিকার বিষয়ে উত্তেজনা হয়েছিল। কিন্তু সেই যুক্তিও নিশ্চয়ই কেউ কেউ কোথাও না কোথাও দিয়েছিলেন। 

আসলে কারিকুলামের বদলটা তো কোনো যান্ত্রিক প্রসঙ্গ নয়। মানে এটা কোনো ধরনের মহাদর্শনের (সামগ্রিক অর্থে দর্শন বোঝালাম) অংশ হিসেবে কোনো ধরনের নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করার কথা। সেভাবেই তখন কোনো একটা কবিতা ক্লাস সেভেন বা এইটে দেওয়া হচ্ছে এবং কোন ধরনের শিক্ষক তা বহন করছেন এবং ক্লাসে নিয়ে যাচ্ছেনএগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত। সমস্যা হলো গত অনেকগুলো বছর ভালো করে এগুলো দেখার সুযোগ পাইনি। কারণ সব কাজেই তো বিস্তর সময় লাগে। তবে বিভিন্ন সময় স্কুল-কলেজের নতুন বইগুলো দেখেছি, আচমকা। কিছু কিছু জিনিস বেশ দুর্বল, বেশ অসমন্বিত, কিছু কিছু জিনিস যদি ঘৃণাত্মক না-ও হয়ে থাকে তাহলেও অন্তত আত্মজাতিমগ্ন, আত্মগোষ্ঠীমগ্ন, নিজ ধর্মময়। কিছু কিছু প্রশ্ন ফাইনাল পরীক্ষায়, ন্যাশনাল পরীক্ষার কথাই বলছি, মানে ব্যাডলি-স্ট্রাকচার্ড এবং যেগুলোকে লজিক্যাল ডিডাকশন বলা হয়। পরের দিকে হলো যে বিভাজন হলো তা হচ্ছে সৃজনশীল, আরেকটি হচ্ছে ব্যাখ্যামূলক। এই যে সৃজনশীলতার মধ্যে এমন এমন সব অসৃজনমূলক প্রশ্ন দেখি, সব মিলে বিরক্তি আসে। সব মিলে আবারও বলি, কারিকুলাম বদলকে আমি আলাদা করে সজাগতা নিয়ে দেখি না। বিশেষত ‘আগে ভালো ছিল’ বা ‘পরে খারাপ হলো’ ঠিক এরকম সরলভাবে এটা কখনো আমাকে বিশেষ ভাবায় না। কারণ বিষয়টা অনেক কিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার মনে পড়ল, আমার কিন্তু কায়কোবাদের ওই কবিতাটা পড়তে ভালো লাগত, আজান সম্ভবত। ঢাকাতে আমার সেক্যুলার বন্ধুদের যখন ফররুখ আহমদকে নিয়ে সমস্যা হচ্ছে, মাথায় অস্বস্তি হচ্ছে, তখনো কিন্তু আমার ওই উচ্চারণগুলোতে দারুণ অনুভূতি হয়- ‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?/এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?/সেতারা, হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?/তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;/অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।’ এই যে ধ্বনি তা আমাদেরকে টানত, এখনো টানে। কিন্তু চিত্রকল্পটা ভাবুন! এটা নাকি আধ্যাত্মিকতার কবিতা, তো তাতে আমার কী আসে যায়! এটা দারুণ। 

সেদিন কবি ব্রাত্য রাইসুর সাথে দেখা হলো। কোনো পূর্বালোচনা ছাড়া আচমকা দেখা। যদিও একটা অনুষ্ঠান চলছে, কী যেন ভুলে গেছি, আমরা দুজন ফিসফিস করে কিছু কথা বলেছি। তার মধ্যে দুজনই মনে করলাম আমাদের অত্যন্ত প্রিয় কবিতা গোবিন্দ চন্দ্র দাসের ‘বর্ষার বিল’। পারভাসিভ বা পরিব্যাপ্ত দৃশ্যময়তা সেই কারণে। কোনো কোনো মানুষ কিন্তু পছন্দ করতে পারেন না তাদের ‘আধুনিক’ কবিতার চিন্তাভাবনা নিয়ে। তাদের জন্য এটা গড় কবিতা। 

কারিকুলামের বদল প্রসঙ্গে যেটা বলতে চাই, এটা একটা বাছাই মাত্র। বিশেষত সাহিত্য কারিকুলামে তো বদল আসাই বাঞ্ছনীয়। প্রতিবছর কেন এক কবিতা পড়বে? কবিতার তো বিশাল একটা ভাণ্ডার আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ত খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসকের নিয়তটা কি বদনিয়ত নাকি সৎনিয়ত? কিংবা আলাদাভাবে বাইনারির মতো হয়তো ভাবার দরকার নেই। কিন্তু কিছু একটা তো বুঝতে পারব আমরা যে হিসেবটা কী তার বা তাদের! আর সাহিত্যের ক্ষেত্রে না হয় বললাম বারংবার বদল বাঞ্ছনীয়; গণিত, পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কি একইভাবে বলতে পারব? আমার যতটুকু বোঝাবুঝি, তা বলতে পারব না। ব্যাকরণের ক্ষেত্রে বলতে পারব না। তো প্রত্যেকটা বিষয় বা শাস্ত্রের আলাদা পদ্ধতি, জিজ্ঞাসা বা যাত্রা আলাদা। সেই কারণে, আমি যত অনায়াসে গদ্যের বা পদ্যের বদল নিয়ে উৎসাহী হব, গণিতের ব্যাপারে বদলে ঠিক ততটাই সতর্ক থাকতে বলব। আমি সেই গণিত কারিকুলাম চাইব যা কল্পনাশক্তি বাড়ায়। বাংলাদেশের বাচ্চাদের জন্য গণিত কারিকুলাম এবং টিচিং মিলে যা দাঁড়িয়েছে তা মুখস্থ গণিতই বলা চলে। তাতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অধিকাংশ বাচ্চার গণিতের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে বৈরিতার ও মুখস্থের। তাহলে  সেখানে কোনো একটা বদল যদি আনা হয় খুব দুর্দান্তভাবে, তখন দরকার পড়বে সেটা যেন হুমহাম করে আবার বদলানো না হয়। গণিত আর কবিতা এক জিনিস নয়, কারিকুলাম দর্শনও একভাবে কাজ করলে চলবে না।

কারিকুলামের বদলটা যেহেতু মেকানিক নয়, বিধানিক নয়, ফলে যদি  দক্ষ কিংবা কল্পনাওয়ালা লোকের হাতে পড়ে, কিংবা নিছক কয়েকশ কোটি টাকার প্রজেক্ট হিসেবে না-দেখা লোকের হাতে পড়ে, তাহলে দারুণ ফলাফল আসতে পারে। কিন্তু প্রশাসক যদি ওই নোটের নিচের স্বাক্ষরকারীর উত্তেজনা আর অহংকার নিয়েই কেবল এক্সপেরিমেন্ট চালান তাহলে আরেক বিষয় হবে। আমার তো ভাবতে দারুণ লাগবে যদি একজন শিক্ষার্থী ১২-১৩ বছরে কল্পনা করতে শেখেন যে শূন্য গাণিতিক যেমন, ঠিক তেমনই দার্শনিক একটি বিষয়। কারিকুলামের নতুন এই জার্নিটা তাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এটা নির্ভর করবে প্রশাসকদের সৃজনশীল কল্পনার ওপর। আবার শুধু কল্পনা না, কারিকুলামটা সচল হয় ওই ১২ হাজার বা ১৫ হাজার টাকায় চলা শিক্ষা কর্মচারীর হাতে। মানে যার ওই টাকায় সংসার চালাতে হয় তারই কিন্তু কারিকুলামটার ভার বহন করতে হয়। তিনি তখন আর্থিকভাবে, বৌদ্ধিকভাবে প্রস্তুত কিনা সেই প্রসঙ্গগুলো ভীষণভাবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত। কল্পনাপ্রবণ শিক্ষার্থী একটি রচনার কারণে একজন শিক্ষকের কাছে ২০ পেতে পারেন, আবার একই রচনার কারণে শূন্যও পেতে পারেন। ক্লাসে আমি কখনো বাংলায় ভালো নম্বর পেতাম না, মানে যা পেতাম তা মহাভালো কোনো নম্বর নয়। আমি ওই বয়সে কিংবা ওর পরের বছরে মানে ১৮-১৯ বছর বয়সে এ নিয়ে আফসোস করতাম। এটা আমার বাংলা দক্ষতার অভাবে ঘটেনি, ঘটেছে এর সঙ্গে একটা বিশেষ স্কুল বা কলেজের শিক্ষকেরা কীভাবে যোগাযোগ করতেন তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে। 

বর্তমানে শাসনযন্ত্রের, সরকারের বা শাসকের, শিক্ষা ক্ষেত্রে আসলে গুরুত্বপূর্ণ কোনো মনোযোগ আছে কিনা সেই তর্কটা আজকের দিনে নিরাপদ হবে না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের দিকে যত্নবান কোনো মনোযোগ নেই যেটা অনুভব করার জন্য পণ্ডিত হওয়া লাগে না। (এই আলাপন-রচনের কয়েক মাস পর এটার পরিমার্জনা হয়েছে। কেবল একটা উদাহরণও যদি দিতে চাই, ইত্যবসরে যত হৈহৈ করে ইতিহাসের একটা বই সরকার প্রণয়ন করেছে, তার থেকে বিপুল গতিতে তা প্রত্যাহারও করেছে)। বাস্তবে রেজাল্টের যে উল্লম্ফন কিংবা বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য যে মোচ্ছব তা সব মিলে একটি ফ্যাক্টরির মতো দাঁড়িয়েছে। ২০১২-১৩ সালের পরের যে বেতন কাঠামোর বদলটা ঘটল সেটা একটা বড় কারণ এর। একটা সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তেন তাদের আগ্রহের জায়গা ছিল; অন্য একটা কালে আবার ছিল না, কারণ তত দিনে আইএনজিও/এনজিও চাকরিগুলো সামনে চলে এসেছিল। এখন আবার বিসিএসের নতুন বেতন কাঠামোতে আবার নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। 

যেগুলোকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বলা হয় তাদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্নরা পাশ্চাত্যনিষ্ঠ দক্ষ পেশাজীবী বানাচ্ছে। এখানে দেখেন একটা খেলার মতো চলছে। যেন ছায়াতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, অমনি  ছায়াটা অন্য জায়গায় সরে যাচ্ছে। ফলে আমি বলব, গত ২০ বছরের বাংলাদেশেও, বিসিএসের যে গুরুত্ব- রুটি-রুজির উপায়ের চাকরি হিসেবে বলি কিংবা সালাম পাওয়ার জন্য, কিংবা দুটোই- সেই গুরুত্বও অটুট অখণ্ড জায়গায় ছিল না। বিশেষ করে যারা পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে আসেন তাদের জন্য। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া, বিসিএসের চেষ্টা করতে থাকা এবং বিশ^বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোতে দল বেঁধে বোকা-বোকা গাইডগুলো পড়তে থাকা- এটা আসলে পুরো সিস্টেমেরই একটা অবধারিত কনসিক্যুয়েন্স।

রাষ্ট্রকে গণশিক্ষার দায়দায়িত্বে যারা দেখতে চেয়েছেন সেটা রাজনৈতিক একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। আবার বিপণন-মুনাফা-বৈষম্যের আর দুর্বল চিন্তাশক্তির খাপছাড়া শিক্ষা বিপণন রাষ্ট্রের ও এর কাণ্ডারিদের রাজনীতি। মনে করি না যে নিকট ভবিষ্যতে কাউন্টার কোনো গণশিক্ষার পাটাতন আমরা গড়ে তুলতে পারব। 

লেখক: অধ্যাপক, নৃ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //