সতীদাহ: উৎপত্তি, উদ্বর্তন এবং উৎসারণ

নারীমাত্রেই জগন্মতার প্রচ্ছন্ন বিগ্রহ। কুলবধূদের মৃত স্বামীর সঙ্গে কখনোই দগ্ধ করা চলবে না। মোহবশত অর্থাৎ নিজের স্বরূপ বিস্মৃত হয়ে যে নারী স্বামীর চিতায় আরোহণ করেন তার নরকগমন অনিবার্য। (মহানির্বাণতন্ত্র: ১০: ৭৯-৮০)

মানবজাতির ইতিহাসকে আমরা যতই গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করি না কেন, তার যাত্রাপথ যতই ময়ূখময় হোক না কেন, যতই আমরা আমাদের বর্ণনায় তাকে নানা আবিরে আচ্ছন্ন করি না কেন, সভ্যতার সব উপচারই আমাদের জন্য কল্যাণকর ও সুখকর হয়নি। অনেক বীভৎসতা, ক্লেদ ও আবিলতা তাতে ছিল, আজও আছে। কোনো সভ্যতাই নিরবচ্ছিন্নভাবে শুধুই ইতিবাচক ছিল না, আবার তা শুধুই নেতিবাচক ছিল তাও নয়। রোমক ও গ্রিক সভ্যতাতে যেমন উদ্ভাস ছিল, সেই সঙ্গে তাতে তমিস্রাও কম ছিল না। সেখানে দাসপ্রথা ছিল, গোত্রবাদ প্রবল ছিল, ঈর্ষা ছিল, যুদ্ধ-বিগ্রহও সেখানে প্রতিনিয়ত ঘটত। আমরা সক্রেটিসের সঙ্গে সম্পর্কিত পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের (Peloponnesian War, 431-404 BCE) কথা জানি। রোমক বাহিনী কর্তৃক স্পার্টাকাসের আন্দোলনকে (The Spartacus Revolt, 73-71 BCE) স্তিমিত করার যে নৃশংস ইতিহাস পড়ি, তা আজও আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়। দাসপ্রথা আরব সমাজেও ছিল। পবিত্র কোরআনে দাসপ্রথা সরাসরি বিলুপ্তির ঘোষণা নেই। সেখানে দাস-দাসীদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহারের আদেশ অবশ্য আছে। তবে ইসলাম এই প্রথাকে নিন্দনীয় রূপেই দেখত। যথাসম্ভব দাসকে মুক্তি দিতেই পবিত্র কোরআনে বাণী এসেছে,
The alms are meant only for the poor and the needy and those who are in charge thereof, those whose hearts are to be reconciled, and to free those in bondage, and to help those burdened with debt, and for expenditure in the Way of Allah and for the wayfarer. This is an obligation from Allah. Allah is All-Knowing, All-Wise. (Quran: 9:60)

অন্যদিকে পশ্চিমে তো দাসপ্রথা কয়েক দশক আগেও ছিল। বর্ণবাদ পশ্চিমারা এখনো দূর করতে পারেনি। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু-তাও আবার পুলিশ কাস্টডিতে হয়, যা এই বক্তব্যের অন্যতম বড় প্রমাণ। 

তবে সভ্যতার অনাচারগুলোর সর্বকালেই প্রথম বলি নারীরা। আমরা জানি যে, অনাকাঙ্ক্ষিত নারী ও শিশুকে জীবন্ত পুঁতে ফেলার প্রথা আরবের কোথাও কোথাও ছিল (Shehadeh et al. 2011)। ইসলাম এই জঘন্য প্রথার বিলোপ সাধন করে এবং আরবে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত নারীবিদ্বেষের (misogi) ইতি ঘটায়। মধ্যযুগে ক্যাথলিক সমাজ অজস্র বুদ্ধিমতী, প্রতিভাময়ী ও প্রাগ্রসর নারীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে। সেকালে ধর্মের নামে যে কোনো ব্যক্তিকে বন্দি ও নির্যাতন করা, তার অঙ্গচ্ছেদ এবং বীভৎসভাবে মৃত্যু কার্যকর করার জন্য ক্যাথলিক গির্জা একটি আইন জারি করে। ১১৫৭ সালে সন্ত বার্নার্ড (St. Bernard) কাউন্সিল অব রেইমসে (Council of Reims) এ আইনের পরামর্শ দেন। পরবর্তীকালে বেশকিছু পোপ ও ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠান এর যথেচ্ছ প্রয়োগ করে (Lea: 1888: A History of the Inquisition In The Middle Ages. By Henry Charles Lea. Volume 1, archive.org)। গির্জার দাপ্তরিক ভাষায় অর্থাৎ সেকালের লাতিনে সেটাকে বলা হতো ইনকুইজিটিও (inquisitio), যার ইংরেজিকরণ করা হয় ইনকুইজিশন (Inquisition)। এর অর্থ অন্বেষণ বা খোঁজ। কারণ প্রকৃত ধর্মদ্রোহী ছাড়াও তৎকালীন প্রথাবিরোধী, রাজতন্ত্রবিরোধী ও স্বাধীনতাকামীদের খ্রিষ্টধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে দমন করাটা সহজতর ছিল। এদের খুঁজে খুঁজে দমননীতি প্রয়োগ করা হতো। আর এই আইনেরও প্রধান শিকার হন নারীরা। এই আইনের সবচেয়ে বিপজ্জনক যে ধারা নারীদের জন্য আবির্ভূত হয় তার নাম লাতিনে সুমিস ডেসিডেরান্টেস আফেক্টিবুস (Summis desiderantes affectibus) বা প্রবল উৎসাহব্যঞ্জক আকাঙ্ক্ষা। এই ধারাকে সবচেয়ে সুনির্ধারিতভাবে নথি আকারে প্রকাশ করেন জার্মানদেশীয় যাজক হাইনরিখ ক্রামার (Heinrich Kramer, c. 1430-1505) তার সন্দর্ভ মালেউস মালেফিকারুস (Malleus Maleficarum)-এ, যার অর্থ ডাইনিদের বিরুদ্ধে হাতুড়ি [Herbert: 1912: CATHOLIC ENCYCLOPEDIA: Witchcraft (archive.org)]। আমরা ফ্রান্সের বীর যোদ্ধা এবং ইংরেজ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অকুতোভয় জোয়ান অব আর্কের (ফরাসিতে জন দ’আর্ক, Jeanne d'Arc  c. 1412-1431) কথা স্মরণ করতে পারি। বন্দি এই নারীকে ক্যাথলিক গির্জা ডাইনি ঘোষণা দিয়ে এবং ধর্মকে কলুষিত করার ও ধর্মদ্রোহী অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে; যদিও ফরাসি জনগণের কাছে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের রক্ষাকর্ত্রী সাধ্বী। অবশ্য ১৯২০ সালে ক্যাথলিক গির্জা তাকে সাধ্বী আখ্যায়িত করে নিজেদের পাপমোচন করার চেষ্টা করেছে। এই ধারারই আরেকটি বর্বরতা ছিল সতীদাহ। কিন্তু এর প্রেক্ষিত ছিল মূলত ভারতবর্ষ।

দুই.
ভারতীয় সভ্যতা যেমন অনেক উচ্চাঙ্গের চিন্তা ও দার্শনিকতার জন্ম দিয়েছে, অনেক কুপ্রথাও কখনো কখনো তাতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, তা বোঝা যায়। তার মধ্যে শিশুবলি, নরবলি ও সতীদাহ ছিল বীভৎসতম। আজও মাঝে মাঝে ভারতে কখনো কখনো গোপনে শাক্ত ও তান্ত্রিক সাধকদের কেউ কেউ অলৌকিক শক্তি অর্জন বা কোনো মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে কোনো দেবীর উদ্দেশে শিশুবলি বা নরবলি দিয়েছেন বা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। সাধারণত শাক্তরা দেবী কালীর উপাসক বা উপাসিকা। তাই এই বলিগুলো তার উদ্দেশেই মূলত দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ ভাগ্য পরিবর্তনের আশাতেও দেবীর বেদিতে মানুষ উৎসর্গ করতে চান। যেমন- ২০০৬ সালে স্বামী পরিত্যক্তা ৪৩ বছর বয়স্কা সুমিত্রা ভূষণ তার দুই পুত্র নিয়ে প্রবল দারিদ্র্য ও ক্লেশের সম্মুখীন হন। প্রচুর ধারদেনা করার কারণে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা প্রতিবেশীর তিন বছর বয়সী পুত্র আকাশ সিংকে অপহরণ করে আনুষ্ঠানিভাবে দেবী কালীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। ভারতে প্রতিবছর এই কারণে প্রচুর শিশু অদৃশ্য হয় (McDougall: March, 2006)। বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতি আট মিনিটে একটি শিশু হারিয়ে যায়। অনেকে মনে করেন, এর অনেক কারণের একটি হচ্ছে কোনো দেবী বা দেবতাকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে শিশু অপহরণ। 

তবে সতীদাহ প্রথা হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থগুলো দ্বারা স্বীকৃত বা অনুমোদিত কিনা, তাও বিবেচনার বিষয়। কবে থেকে এই রোমহর্ষক ও বীভৎস প্রথা হিন্দুসমাজে আশ্রয় নিল, আর কীভাবেই তা বহুকাল টিকেও রইল, আবার কবে তার উৎসারণ ঘটল- এসবের ইতিহাস পর্যালোচনা করা জরুরি। সেই ইতিহাস বীক্ষণ ও তার বিচার-বিশ্লেষণ নিয়েই এ প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। 

তিন.
আধুনিককালে ১৯৮৭ সালে ১৮ বছর বয়সী রাজপুত মেয়ে রূপ কানওয়ারকে জোরপূর্বক স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মেরে তাকে সতী বলে ঘোষণার এবং তার মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলে চালানোর চেষ্টা করা হলে তা সারা পৃথিবীর নজরে আসে। ভারতীয় কোনো কোনো সমাজে অনেক মেয়েই স্বামীর চিতায় সহমরণে বাধ্য হতো। আবার সমাজ কখনো কখনো তাকে তা করতে মানসিকভাবে প্ররোচিত করত এবং একে পুণ্যকর্ম বলে প্রচার করা হতো। সদ্যবিধবাকে যে অনেক সময়ই তার আত্মীয়-স্বজন আগুনে জীবনদানে প্ররোচিত করত, তা লিখেছেন চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়। প্রয়োজনে তারা তাকে প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, ভয় প্রদর্শন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, তিরস্কার, ছল, বল, কৌশল কিছুই বাদ যেত না (মুখোপাধ্যায়: ২০২৩ : ১৯৫)। ভারতে সতীদাহবিরোধী আইন হওয়ার আগেও এই স্বেচ্ছা মৃত্যু আকাক্সক্ষী বিধবার সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাই রূপ কানওয়ার বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে মাধু কিশোয়ার লিখেছিলেন, Firstly, for all the so-called glorification of sati in certain regions, we have not witnessed autoing resembling a sati epidemic. With all the sati temples in Rajasthan, extremely few women offer themselves for immolation, including those who might bow in reverence before a sati shrine. After Roop Kanwar's immolation in 1987, there have been no more than a few cases of attempted self-immolations by widows in India. Most were averted by timely intervention. Even before the anti-sati act was passed, a very small number of women killed themselves on their husband's pyres within the last several decades (Kishwar: 2000: Don't Shackle Freedom - Hinduism Today).

সতীদাহের ইতিহাস নিয়ে ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতদের মধ্যে বিসংবাদ আছে। ঠিক কোথায় এবং কবে এর প্রচলন প্রথম শুরু হয়েছিল তা বলা দুষ্কর। বিধবা নারীকে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা, অপর পুরুষের যৌনসঙ্গী না হতে দেওয়ার আকাক্সক্ষা করা, কিংবা স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ধাপে ধাপে একটা পর্যায়ে এই অনাচার নৃশংসতার চূড়ান্তে এসে তাকে আগুনে আহুতি দেওয়ার অবর্ণনীয় প্রথা চালু করেছিল কিছু মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত ধর্মান্ধ। আর ইতিহাসে জানা যায় তা ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল সম্ভবত মধ্যযুগে। ফলে এর মধ্যে নারীকে বঞ্চিত ও পীড়নের মনস্তত্ত্ব যে সক্রিয় তা বোঝা যায়। সেই সঙ্গে বোঝা যায়, এতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে নারীকে শুধু নিজের অধিকারে রাখার আতিশয্য ও তাকে নিরঙ্কুশভাবে সম্ভোগের দানবীয় প্রয়াস; যে অধিকার ওই পুরুষ তার মৃত্যুর পরও ছাড়তে নারাজ। সুধাকর চট্টোপাধ্যায় যে কারণে লিখেছেন যে, মাতৃতান্ত্রিক সমাজে কখনো সতীদাহ ছিল না (চট্টোপাধ্যায় : ২০২৩ : ৮০)। অন্যদিকে বিধবারা যে হিন্দু সমাজে প্রবলভাবে নিগৃহীত হতেন ভারতে, তার ইতিহাস এমনকি ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেই বর্ণনা করেছেন গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডটাস (Guillemard : ২০১৫ : ১৫২)। আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখনো ভারতে দু-একটি জাতির মধ্যে সতীদাহ প্রচলিত ছিল বলে জানা যায় (মিত্র : ১৩৭১ বাংলা : ১৯)। তবে মধ্যযুগে ভারতে বিশেষত মোগল আমলে উত্তর-পশ্চিমের অভিজাত রাজপুত জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত পর্যায়ে এই বীভৎস প্রথার চল ছিল বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত (Asher, Talbot: 2006: 268)।

বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো যখন ভারতবর্ষে আসেন, এমনকি তারপরও পশ্চিমাগত পর্যটক বা ভ্রমণকারীরা ভারতে এলেই তারা সতীদাহের উপর তাদের বইতে একটি অধ্যায় রাখতেন। সেখানে তারা বর্ণনা করতেন সেই বীভৎস দৃশ্যের; যা অবলোকন করত মানুষ ভয়ার্ত চোখে, কিন্তু ধর্মীয় উন্মাদনার কারণে তাদের চোখে উদ্ভাসিত থাকত সেই পবিত্র নারীর প্রতি প্রশংসা। অধ্যাপক জন স্ট্রাটন হাউলে লিখেছেন, Yet from the time of Marco Polo until well into the nineteenth century (sati was officially abolished in Bengal in 1829), Westerners publishing diaries of their travels in India almost always included a chapter on a sati they had witnessed. These men watched their sates in horror but with admiration, too, for the courage and dignity of the women involved (Hawley: 1994: 3).

চার.
সতী (सती) সংস্কৃত শব্দ; যার উৎপত্তি হিন্দু পুরাণ থেকে। এর আদিমূল সংস্কৃত শব্দ সৎইয়া (सत्य); যার অর্থ সত্য। দক্ষকন্যা সতী তার পিতা কর্তৃক নিজের ও স্বামী মহাদেব শিবের অপমান সহ্য করতে না পেরে যজ্ঞের আগুনে নিজেকে আহুতি দেন। রামায়ণ ও মহাভারত ছাড়াও বিভিন্ন পুরাণে যেমন- শিব পুরাণ, কালিকা পুরাণ, মহাভাগবত পুরাণে এই কাহিনির বিস্তারিত বিবরণ আছে (Kinsley: 1988: 37-41)। যে কারণে স্বামী অন্তপ্রাণ বা স্বামীপরায়ণা নারীকে সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বলেন সতী নারী বা সতীসাধ্বী। মহাভারতে আমরা পাই শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর তার চারজন মহিষী দেবকী, ভদ্রা, মদিরা ও রোহিণী আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন (ব্যাস : ১৪১৮ বাংলা : ৬৭৫)। আর তার শব হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছলে তার আরও পাঁচ স্ত্রী- রুক্ষ্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও জাম্ববতী অগ্নিতে প্রবেশ করেন (উপরোক্ত : ৬৭৬)। কিন্তু এতে স্বর্গ থেকে কোনো পুষ্পবৃষ্টিও হয়নি, দুন্দুভিও বাজেনি। ফলে এ থেকে প্রমাণ হয় না যে, বিধবামাত্রই অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণত্যাগ করতে হবে। হিন্দু পুরাণ যে দেব-দেবী নির্ভর কাহিনিগুলো উপস্থাপন করে তার অনেক গূঢ়ার্থ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয়, যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। এ নিয়ে ভারতে ও পশ্চিমে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা আছে, যা আমরা এই লেখাতে দেখব। 

আধুনিককালে বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম সতীদাহের বিরুদ্ধে কলম ধরেন বাঙালি জাগরণের পুরোধা রাজা রামমোহন রায় (১৭২২-১৮৩৩), যিনি হিন্দুশাস্ত্রীয় বইপত্র ঘেঁটে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, সতীদাহ প্রথা হিন্দুর সর্বসম্মত শাস্ত্রীয় বিষয় নয়। ১৮১৮ সালে তার স্বলিখিত ও প্রকাশিত  পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘সহমরণ বিষয় : প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’। তিনি প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে এই বইতে সতীদাহ 

প্রথার অবসান ঘটিয়েছেন। সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। বাংলা ভাষাতে সতীদাহের ওপর যেসব পূর্ণাঙ্গ বই লিখিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কুমুদনাথ মল্লিকের ‘সতীদাহ’। বইটি ১৯১৩ সালে প্রথম প্রকাশ হয়। তিনি এতে সতীদাহ নিয়ে বেশ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কুমুদনাথ মল্লিক সরাসরিই বলেছেন যে, সনাতন ধর্মের স্মৃতিকারগণের মধ্যে মনুই শ্রেষ্ঠ। অথচ মনু বিধবা নারীকে সহমরণের (স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে চিতায় মৃত্যুবরণের) বিধান দেননি, দিয়েছেন ব্রহ্মচর্যের বিধান। কুমুদনাথ বলছেন, বঙ্গদেশে সহমরণ জনপ্রিয় করেছেন মনু স্মার্তরাজ রঘুনন্দন; আর এই বিধানের মহিমা কীর্তন করে তিনি একে স্ত্রীলোকের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত করেছেন (মল্লিক : ২০১৬ : ১৪)। 

নবদ্বীপের রঘুনন্দনের সময়কাল ষষ্ঠদশ শতাব্দী। তার মানে এই যে, বঙ্গে সতীদাহের হিড়িক সবচেয়ে বেশি ছিল। তবে তা সনাতন ধর্মের প্রাচীনত্বের হিসেবে সেখানে একেবারেই এক নতুন সংযোজন ছিল। কুমুদনাথ রঘুনন্দনকে কিছুটা রক্ষা করারই চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, মুসলমানী শাসনের শেষের দিকে রাজশাসন দুর্বল হয়ে পড়লে যখন কুমারী ও সধবা নারীদেরই দস্যু ও পশুপ্রকৃতির লোকদের থেকে রক্ষা করা দায় হয়ে পড়ল, তখন বিধবাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে এই বিধানের প্রবর্তন ঘটল (পূর্বোক্ত)। কিন্তু এই যুক্তির সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো, সধবা ও কুমারী মেয়েদের সম্ভ্রমহানি হলে, তাদের জন্য কেন এই বিধান কার্যকর করা হলো না? আর বঙ্গদেশেই এই ভয়াবহ বিধান কেন বেশি জেঁকে বসল? মুসলমানী শাসন দুর্বল যখন হয়েছে, সে তো সব জায়গাতেই একসঙ্গেই হয়েছে। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছেন যে, বল্লাল সেনের (১১৬০-১১৭৯) শাসনামলে যখন কুলীন হিন্দুদের মধ্যে বহু স্ত্রী গ্রহণ রীতি হয়ে দাঁড়াল, তখন স্বামীর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত স্ত্রী যাতে ঈর্ষাবশত স্বামীকে হত্যা না করেন তা নিশ্চিত করতেও এই বিধান প্রতিষ্ঠা করা হলো। এই যুক্তিও ধোপে টেকে না; কারণ প্রথমত- বল্লাল সেন ও রঘুনন্দনের সময়কালের ব্যবধান প্রায় পাঁচশ বছর। তাহলে এই পাঁচশ বছর কি বঙ্গে নারীদের সম্ভ্রম বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না? ইতিহাসে তার কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়তযদি কোনো স্ত্রী তা করেন, তবে বাকি যেসব স্ত্রী পাতকিনী নন, তারা কেন অগ্নিদগ্ধ হয়ে জীবন দেবেন, যারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যায় ২০, ৩০ এমনকি ১০০ পর্যন্ত ছিলেন? 

তৃতীয়ত- পুরাকালে অনেক হিন্দু রাজার বহু স্ত্রী ছিল, আর সে রাজারা পৌরাণিক ভাষ্যমতে ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তারা সবাই কেন এই বিধান পালন করেননি? এমনকি শ্রীকৃষ্ণের যে চার স্ত্রী সহমরণে মারা যান, তা একান্তই তাদের ইচ্ছায়। কৃষ্ণ নিজে সেরকম কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। অন্যদিকে কুমুদনাথ লিখেছেন, বিধবারা হাসতে হাসতে স্বেচ্ছায় এই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুকে গ্রহণ করতেন। এটি এককথায় অবিশ্বাস্য; কারণ যদিওবা শুরুতে এক-দুটি ক্ষেত্রে তা ঘটেও, প্রবল যন্ত্রণায় সেই আনন্দ তো দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কথা নয়। আর ওপরে মাধু কিশোয়ারের বক্তব্যের সারও এই কথার বিপ্রতীপে অবস্থান করছে। কুমুদনাথ এও বলার চেষ্টা করেছেন যে, সভ্যতার কোনো এক কালে যা সুপ্রথা বলে প্রতিষ্ঠিত, তা কালে কুপ্রথা হিসেবে পর্যবসিত হতে পারে (মল্লিক : ২০১৬ : ২৫-২৬)। তবে আমার মত হলো, মনোসমীক্ষণবাদী জায়গা থেকে এটিকে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক স্যাডিস্ট ও বিকারগ্রস্ত ফ্যান্টাসির বাইরে আর কিছুই বলা চলে না। অন্যদিকে এর পেছনে বিধবার ও তার মৃত স্বামীর সম্পদ গ্রাস করার দুর্মদ আকাক্সক্ষা তো আছেই। যদিও শেষ পর্যন্ত কুমুদনাথ সতীদাহের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছেন। 

পাঁচ.
ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা নিবৃত্তির জন্য ধর্মজগতে সংঘটিত হয়েছে এক মহাযুদ্ধ। যার পুরোভাগে ছিলেন মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়। ১৮২৯ সালে বেঙ্গল সতী রেগুলেশন পাস করেন তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। কিন্তু তার আগে হিন্দু সমাজে এই বিষয়ে যে ধর্মীয় প্রমাণাদি এর সপক্ষে ও বিপক্ষে উপস্থাপিত হয়, তার কিছু এখানে ব্যক্ত করা জরুরি। 

কুমুদনাথকে দিয়েই আবার শুরু করি। তিনি লিখেছেন, ঋকবেদের দশম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম ঋকের ভুল লিখন এবং তার ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যা দিয়ে এই কুপ্রথাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তের সপ্তম ও অষ্টম ঋক নিম্নরূপ-
ইমা নারীর বিধবাঃ সুপত্নী রাঞ্জনেন সর্পিষা সম্পৃ শন্তাম্।
অনশ্রয়ো অনমীবাঃ আরোহন্ত জনয়ো যোনীমগ্নে ॥৭॥
উদীর্ধ নায্যভি জীবলোকমিভাসুমেতমু পশেষঃ এহি।
হস্তাগ্রতস্য দিধিযোস্ত বেদং পত্যুজনিত্বমভিসম্বভুব ॥৮॥

বঙ্গানুবাদ:
“এই সকল নারী বৈধব্যক্লেশ ভোগাপেক্ষা ঘৃত ও অঞ্জন অনুলিপ্ত পতিকে প্রাপ্ত হইয়া উত্তম রত্ন ধারণপূর্বক অগ্নি মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করুক ॥৭॥ হে নারী! সংসারের দিকে ফিরিয়ে চল, গাত্রোত্থান কর, তুমি যাহার নিকট শয়ন করিতে যাইতেছ তিনি গতাসু হইয়াছেন, চলিয়া আইস, যিনি তোমার পাণি গ্রহণ করিয়া গর্ভাদান করিয়াছিলেন সেই পতির পত্নী হইয়া যাহা কিছু কর্তব্য ছিল, সকলই তোমার করা হইয়াছে ॥৮॥” 

কিন্তু সমস্যা হয় দ্বিবিধ। সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতদের একাংশের দাবি ‘যোনীমগ্নে’র স্থলে আদিতে ছিল ‘যোনীমগ্রে’। ফলে তারা পাঠোদ্ধার করেছেন নিম্নরূপে :
“এই সকল নারী বৈধব্যক্লেশ অনুভব না করিয়া, মনোমত পতিলাভ করত অঞ্জন ও ঘৃতানুলিপ্ত হইয়া গৃহে প্রবেশ করুক।”

আর অষ্টম ঋক আলাদা করে অনুবাদ করলে ঠিকই আছে। যা হোক এই দুই ঋক নিয়ে বিতণ্ডা দীর্ঘদিন ধরে চলছে এবং অদ্যাবধি তা চলমান। (মল্লিক : ২০১৬ : ২৬-২৭)

এই বিতর্ক প্রথম ইউরোপে উস্কে দেন জার্মান ভারতবিদ (Indologist) মাক্স ম্যুলার (Friedrich Max Müller, 1823-1900)। আর এই বিকৃতির জন্য ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদেরই তিনি দায়ী করেন। তার বক্তব্য ছিল :‌ 'This is perhaps, the most flagrant instance of what can be done by an unscrupulous priesthood. Here have thousands of lives been sacrificed and a fanatical rebellion been threatened on the authority of a passage which was mangled, mistranslated and misapplied.' (মল্লিক: ২০১৬: ৫২)

ইংরেজ প্রাচ্যবিদ (Orientalist) অধ্যাপক হোরেস উইলসন যখন প্রথম ঋকবেদ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তিনি সপ্তম ঋকের অনুবাদ করেন নিম্নরূপ :
'May these women who are not widows, who have good husbands, who are mothers, enter with unguents and clarified butter; without sorrow without tears, let them first go up into the dwelling.' (উপরোক্ত)

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও সংস্কৃতজ্ঞ রমেশচন্দ্র দত্ত সপ্তম ঋকের যে অনুবাদ করেছেন তাও উইলসনের কাছাকাছি :‌
'May these women not suffer the pangs of widowhood. May they who have good and desirable husbands, enter their houses with collyrium and butter. Let these women, without shedding tears, and without a sorrow,w first proceed to the house, wearing invaluable ornaments.'(উপরোক্ত, ৫২-৫৩)

আর এই ভুল সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, 'There is not a word in the above relating to the burning of widows. But a word in it Agre was altered into Agne, and the text was then mistranslated and misapplied in Bengal to justify the modern custom of the burning of widosw.' (উপরোক্ত : ৫৩)

পরে দেশি-বিদেশি আরও ভারতবিদ ও প্রাচ্যবিদও প্রায় কাছাকাছি অনুবাদ করেন। তার মধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটির প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ও গণিতবিদ হেনরী কোলব্রুক অন্যতম  ১৭৯৩ সালে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন, যার শিরোনাম ছিল 'On the duties of a faithful Hindu widow'। তিনি বোঝনোর সুবিধার্থে কিছুটা বিস্তৃতভাবে ঋকদ্বয়ের অনুবাদ করেন, 'Om! let those women, not to be widowed good wives, adorned with Collyrium, holding clarified butter consign themselves to the fire. Immortal, not childless not husbandless, excellent let them pass into the fire whose original element is water.' (উপরোক্ত)

কিন্তু ইতিপূর্বে বেদের এই ভুল লিখন ও তার অনুবাদের কারণে হাজার হাজার নারীর প্রাণ বিসর্জিত হয়েছে। কারণ বেদ হিন্দুধর্মে প্রায় সর্বজনমান্য পরম পবিত্র গ্রন্থ। 

ছয়.
আমরা ইতিপূর্বে রামায়ণ ও মহাভারতের কথা উল্লেখ করেছি। এই দুই হিন্দু মহাকাব্যও কোনো কোনো ক্ষেত্রে সতীদাহের অঙ্গার ছড়িয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণের অযোদ্ধা কা-ে আমরা পাই, রাজা দশরথের মৃত্যুতে রাম জননী কৌশল্যা সহমরণের জন্য উদগ্রীব হন। কিন্তু মহর্ষি বশিষ্ঠ তাকে অন্য নারীদের সহায়তায় নিবৃত্ত করেন। 

আবার অশোকবনে রাবণ অনুচরের মায়ার কারণে তার হাতে রামের কাটা মুণ্ডু দেখে সীতা রাবণকে বধ করতে বলেছিলেন, যাতে তার স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে তিনি একাত্ম হতে পারেন। তবে এখানে তিনি তার দেহকে দাহের কথা বলেননি। (বাল্মীকি : ২০১০ : যুদ্ধকাণ্ড : ৩২সর্গ : ৬৭৬-৬৭৯)

বিষ্ণু পুরাণে সতীদাহের আরেকটি কাহিনি পাই। দানবীর মহারাজ হরিশচন্দ্রের বংশীয় রাজা বাহু কুচক্রীদের হাতে রাজ্য খুইয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বনে যান এবং সেখানে দীর্ঘকাল বাস করেন। সেখানে দীর্ঘকাল বাস করার পর বৃদ্ধ হয়ে ওর্ব নামক এক ঋষির আশ্রমের কাছে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তখন রাজমহিষী নিজে সহমরণের প্রতি নিলে ত্রিকালদর্শী ঋষি ওর্ব (ঔর্ব্ব) তাকে এই বলে নিবৃত্ত করেন যে,
“সাধ্বী, আপনি কেন এরকম কাজ করছেন? আপনার জঠরে অখিল ভূম-লপতি, রাজচক্রবর্তী, অতি পরাক্রমশীল, বহু যজ্ঞকর্তা, অরিন্দম এক মহীপতি অবস্থান করছেন; সুতরাং আপনি কোনোভাবেই এ কাজ করতে সাহস করবেন না।” (মল্লিক : ২০১৬ : ২৯) অবশ্য নবভারত পাবলিশার্সের বিষ্ণু পুরাণের চতুর্থ অংশের চতুর্থ অধ্যায়ে এই কাহিনিটি আমি পাইনি, যেটি কুমুদ কুমার মল্লিক তথ্যসূত্রে উল্লেখ করেছেন। (পৃ. ৫৫) সেটি পড়তে গিয়ে অবশ্য অন্য একটি ঘটনা চোখে পড়ল। 

রাজা সৌদাসকে বশিষ্ঠ মুনি ভুলবশত অভিশাপ দিলে তিনি রাক্ষসে পরিণত হন। তিনি ঋতুকালে এক ব্রাহ্মণকে আহার করলে, তার স্ত্রী ব্রাহ্মণী তাকে শাপ প্রদান করতে করতে জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করেন। (ব্যাসদেব : ১৪২২ বাংলা : ২৬৫-২৬৭)

মহাভারতের আরেকটি সহমরণের ঘটনার উল্লেখ করছি। সেটি মহারাজ পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার দুই রানি কুন্তী ও মাদ্রী দুজনই সহমরণ কামনা করেন। কিন্তু মাদ্রী মৃত্যুবরণ করেন, তবে তা আগুনে প্রবেশ করে নয়, বরং শোকে। (ব্যাসদেব : ১৪১৮ বাংলা: আদিপর্ব : ৪৬-৪৯)

কিন্তু এই কাহিনিগুলোর দিকে যদি আমরা মনোযোগ দেই তবে দেখব, এগুলো কিছু আবেগতাড়িত নারীর তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তজাত। এর ওপর ভিত্তি করে কোনো বিধান প্রণীত হতে পারে না। আর অনেক শাস্ত্রকার ও পুরাণকার সতীদাহকে উৎসাহিত করতে হয়তোবা চাননি। ফলে এই কাহিনিগুলো সমস্যা করে না, যদি আমরা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারি। 

সমস্যা হয়, যখন কোনো কোনো পুরাণে এরকম ঘটনাকে উৎসাহিত করা হয়। যেমন একটি ঘটনার উল্লেখ আছে রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে। ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজ কন্যা বেদবতী পরমা চরিত্রবতী, সাধ্বী ও জ্ঞানী। তিনি পরমা রূপবতীও বটে। তার পিতা কুশধ্বজ দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র এবং তার মতোই বুদ্ধিমান। তিনি যখন বেদপাঠ করতেন, তার এই পাঠ বাক্সময় থেকে রূপময় হয়ে বেদবতীর জন্ম। আর তাই তার নাম বেদবতী রাখা হয়। বেদবতীকে রাক্ষসরাজ রাবণ সম্ভোগ করতে চাইলে, তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে জ্বলন্ত চিতার অগ্নিতে প্রবেশ করে সম্ভ্রম রক্ষা করেন। ফলে অন্তরিক্ষ হতে চতুর্দিকে দিব্য পুষ্পবৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীকালে জানা যায়, তিনিই সীতা হিসাবে পরবর্তীকালে জন্মেছেন ও রামচন্দ্রের সহধর্মিণী হয়েছেন। (বাল্মীকি : ২০১০ : সপ্তদশ সর্গ : ৮৮০-৮৮২)

এরকম আরেকটি ঘটনার উল্লেখ আছে শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে। মহাপরাক্রমশালী রাজা পৃথুর মৃত্যু ঘটলে পতিপরায়ণা অর্চিদেবী পাহাড়ের পাদদেশে চিতা রচনা করেন এবং নদীর জলেস্নান ও তর্পণাদি সেরে স্বামীর মৃতদেহের চারদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করেন। তারপর তিনি আগুনে প্রবেশ করলেন এবং স্বামীর মৃতদেহের সঙ্গে সহমরণে মৃত্যুবরণ করলেন। এতে দেবদেবীগণ সন্তুষ্ট হয়ে মন্দার পর্বতের সানুদেশে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করলেন, সঙ্গে স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্রাদিও বাজতে লাগল। (ব্যাসদেব : ২০০৯ : চতুর্থ স্কন্ধ : অষ্টম অধ্যায় : ৩৭৭)

সমস্যা হচ্ছে স্বর্গরাজ্যের আনন্দের এই ঘটনা মর্ত্যলোকের জন্য বিপজ্জনক। কারণ তা সতীদাহের বীভৎস কর্মকে উৎসাহিত করেছে। তবে সুবিধা একটাই, হিন্দুধর্মে পুরাণ অনুসরণ অবশ্যমান্য নয়। আর পুরাণগুলোর সঠিকত্ব ও প্রাচীনত্য নিয়ে বিতর্কও আছে। পুরাণ মধ্যস্থিত অনেক ঘটনাই পরবর্তীকালের প্রক্ষেপ। 

এবার আসা যাক পরাশর সংহিতায়। এতে অন্যান্য সংহিতার মতোই বেশকিছু শাস্ত্রীয় আইন-কানুন ও প্রথার বিষয় স্থান পেয়েছে। পরাশর সংহিতায় লিখিত আছে, স্বামীর মরণান্তে যে নারী ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেন, তিনি মৃত্যুর পর ব্রহ্মচারীর ন্যায়ই স্বর্গ লাভ করেন। সেই নারী, মানবদেহে যে সার্দ্ধ ত্রিকোটি সংখ্যক রোম আছে, তাবৎ পরিমাণ কাল স্বর্গ ভোগ করতে থাকেন। ব্যালগ্রাহী (সাপুড়ে) যেমন গর্ত থেকে সাপকে বলপূর্বক টেনে আনে, তেমনি সহমৃতা নারী মৃত পতিকে নরক থেকে উদ্ধার করে তার সাথে স্বর্গসুখ ভোগ করেন। (পঞ্চানন তর্করত্ন : ২০২২: অধ্যায় ৪ : শ্লোক ২৭-২৯)

কথা হচ্ছে, পরাশর সংহিতা হিন্দুধর্মে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অবশ্যমান্য কোনো গ্রন্থ নয়, যেখানে সাংখ্যরা বেদকে অস্বীকার করেও হিন্দু হিসেবে পরিগণিত হতেন।  

এখানে আরেকটি বিষয় স্মর্তব্য, আদিতে বিধবা নারীর জন্য ব্রহ্মচর্য অথবা সহগমন বা অনুগমনের বিধান ছিল পুরাণগুলোতে; যেমন বিষ্ণু সংহিতা (অধ্যায় ২৫ : সূত্র ১৪; সূত্র; মল্লিক : ২০১৬ : ৩৪, ৫৫)। সেখানে তা শুধুমাত্র সহমরণ বা অনুমরণে কীভাবে রূপান্তর হলো- তা এক বড় প্রশ্ন আমাদের জন্য।

সাত.
সুলতানী ও মুঘল আমলে এই প্রথার বিলোপ সাধনের জন্য কিছু আইন হয়েছিল; কিন্তু তার খুব বেশি বাস্তবায়ন হয়েছিল মনে হয় না। বরং স্থানীয় কাজিকে ঘুষ দিয়ে সতীদাহ কার্যকর করা হয়েছে তার প্রমাণ প্রখ্যাত পরিব্রাজক জঁ-বাপটিস্ত টেভার্নিয়ারের (Jean-Baptiste Tavernier, 1605-1689) রচনায় পাওয়া যায় (Tavernier: vol II: 211, সূত্র : মল্লিক : ২০১৬ : ৪০, ৫৭)। তবে মুঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীর এই প্রথা বাতিলে আগ্রহী ছিলেন। যোধপুরের রাজপুত্রের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সহমরণ কামনা করলে সম্রাট আকবর দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে একশত মাইল পাড়ি দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করেন। জাহাঙ্গীরও এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছিলেন। (মল্লিক : ২০১৬: ৪০) এই বীভৎস প্রথা একসময়ে প্রায় বিলুপ্তই  হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নবদ্বীপের গৌরব স্মার্ত শিরোমণি রঘুনন্দনের নবস্মৃতিতে এই কুপ্রথার প্রশংসা ও বন্দনার কারণে তা নবজীবনপ্রাপ্ত হয়। (উপরোক্ত)

তবে কুমুদনাথ মল্লিক তার বইতে একটি বিতর্কের অবতারণা করেছেন। তিনি লিখেছেন, অত্যাচারী বিলাসী মুসলমানদের হাত থেকে নিজ স্ত্রীদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে এই প্রথা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। (উপরোক্ত) কিন্তু এই যুক্তি দিয়ে কি পার পাওয়া যাবে? যদি বিলাসী মুসলমানরা সত্যিই তাই করে থাকে, তবে তার কোনো রেকর্ড আছে কি? আর হিন্দুরা সংঘবদ্ধভাবে তার প্রতিবাদ কেন করল না? নদীয়ার প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব এক সতীদাহের ঘটনা দেখে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করেন। (উপরোক্ত) তিনি কেন এর প্রতিবাদ করেননি? তিনি তো প্রতিবাদ করতে কখনো পিছপা হননি। যেসব জায়গায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ক্ষমতাবান ছিলেন, সেখানে কেন এই ঘটনা ঘটত? এমনকি কোনো কোনো হিন্দু রাজপুরুষের মৃত্যুর পরে রানী বা রাজমহিষী আগুনে জীবন দিয়েছেন, সেটি কেন ঘটেছে? তাদের তো কোনো বিলাসী মুসলমান কব্জা করতে আসেনি। আমরা ওপরে যোধপুরের রাজপুত্রের সহধর্মিণীর উল্লেখ করেছি। প্রধানত মুসলমানদের ভয়ে যে স্বেচ্ছাহুতি তাকে রাজস্থানের রাজপুতরা বলত জহরব্রত বা শাক্। (উপরোক্ত :৩৭)  কিন্তু কুমুদনাথ এখানে ভুল করেছেন। জহরব্রত বলতে দাহ বোঝায় না। তা জহর বা বিষপানে প্রাণত্যাগ বোঝায়। তিনি নদীয়ার স্বনামখ্যাত নরপতি দেবপালের পুরমহিলাগণ মুসলমানের ভয়ে এভাবে আত্মবিসর্জন দিয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। (উপরোক্ত) কিন্তু তার তথ্যসূত্রই জানাচ্ছেন যে, তারা জলে আত্মাহুতি দিয়েছেন, আগুনে নয়। (উপরোক্ত : ৫৭) যদি ধরেও নেই এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, তবে সতীর দাহে কীভাবে মুসলমান যুক্ত হলো? মহারাজ ভীমসিংহের পত্নী চিতরের রানী পদ্মিনীর রূপে মুগ্ধ আলাউদ্দিন খলজীর (আনুমানিক ১২৯৬-১৩১৬) তাকে সম্ভোগ করার বাসনার কারণে তিনি যদি জীবন দেন, তবে তাকে কেন সর্বতোভাবে আইনে রূপান্তর করতে হবে সব বিধবার জন্য, এমনকি সেখানেও যেখানে মুসলমান অর্থাৎ যবনের ভয় নেই? যেমন ১৮৩৮ সালের ৩০ আগস্ট উদয়পুরের মহারাণার মৃত্যুতে দুই প্রধান মহিষী ও সাতজন অপ্রধান পত্নী চিতায় আত্মাহুতি দেন। (উপরোক্ত : ৬৩) এখানে কোনো যবন, দস্যু কিংবা পাতকের তো আবির্ভাব ঘটেনি। কিংবা ভারতবর্ষের বা হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর বাইরেও বহু দেশে, বহু কালে, বহু যুদ্ধে বা দস্যুদলের আক্রমণে নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। সেসব ক্ষেত্রে এ ধরনের কুপ্রথার আবির্ভাব তো ঘটেনি। কেউ কেউ স্বামীর মৃত্যুর শোকে আত্মাহুতি দিয়েছেন। 

জানা যায়, কোনো কোনো দেশে এর কাছাকাছি কুপ্রথা ছিল। যেমন- মিশরে ফারাউ রাজাদের সঙ্গে দাস-দাসী, স্ত্রী হত্যা করে সাথে দেওয়া হতো। গ্রিসের থিবসে একরকম সহমরণের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। 

(সেন : ২০১৯ : ৬-৭) ব্যাবিলনের সিথিয়ান জাতির মধ্যেও এর চর্চা ছিল বলেও জানা যায়। প্রাচীন গ্রিসের ঐতিহাসিক ডিওডোরাস সিকিউলুস তার বিবরণ দিয়ে গিয়েছেন।

(মিত্র : ১৩৭১ বাংলা : ১) কিন্তু কোথাও তা ভারতের মতো এই আধুনিককাল পর্যন্ত টিকে থাকেনি। আর বিধান তৈরি করে নারীকে হত্যা করা কিংবা এই ধরনের আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা, সারা পৃথিবীতেই তা রীতিমতো অচিন্তনীয়। 

আট.
১৮১৮ সালের শেষার্ধে রামমোহন রায় তার স্বলিখিত ও প্রকাশিত  পুস্তক ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’-এ প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে বইতে সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটিয়েছেন। বহু ধর্মজ্ঞ রামমোহন অনেকটা খ্রিষ্টধর্মীয় ক্যাটেশিজমের (Catechism, লাতিন: Catechismus) আদলে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই সমস্যার মীমাংসা করেছেন। এখানে তিনি বিভিন্ন ঋষি যেমন : অঙ্গিরা, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ যেমন- পরাশরসংহিতা প্রভৃতির বিপরীতে হিন্দু মানস ও জনস্রোতে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ঋকবেদ, মনুসংহিতা প্রভৃতি এবং ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিধবা নারীর জন্য ব্রহ্মচর্যের বিধানই শাস্ত্রমতে অধিক অগ্রগণ্য। এমনকি যেসব শাস্ত্রকার শ্রুতির মাধ্যমে সহমরণ ও অনুমরণের কারণে স্বর্গসুখ লাভের বার্তা জানাচ্ছেন, তাকে রামমোহন স্বকাম শ্রুতি বলছেন, তার বিপরীতে নিষ্কাম শ্রুতির যুক্তি তিনি টেনে এনেছেন, যা অধ্যাত্ম সাধনায় অধিক মহত্তর ও উচ্চতর।  (রায় : ১৮১৯ : ৩-১০)

নয়.
কার্যকরভাবে সতীদাহের বিলোপ ইংরেজরাই করেন। ব্রিটিশদের মধ্যে ১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর লর্ড মার্কুয়েস কর্নওয়ালিস (Charles 1st Marquess Cornwallis, 1738-1805) প্রথম এই বিষয়ে মনোযোগী হন। তিনি কোম্পানির লোকদের এই কাজ কেউ করতে গেলে তাতে অমত প্রকাশ করতে বলেন, কিন্তু কার্যকর বাধা প্রদান করতে নিষেধ করেন। সম্ভবত তিনি এখানকার হিন্দুদের চটাতে চাননি। ১৭৯৯ সালে নতুন গভর্নর লর্ড মার্কুয়েস ওয়েলেসলি এর প্রতিকার করার জন্য স্বতন্ত্র আইন না করে, একে নরহত্যার আইনের পর্যায়ভুক্ত করে বন্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু তৎকালীন সর্বোচ্চ ধর্ম বিষয়ক আদালত অর্থাৎ নিজামত আদালত এই বলে তাকে পরামর্শ দেন যে, সরাসরি এভাবে আইন কার্যকর করতে গেলে তা ইংরেজ রাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বরং সহমরণ বিধবার স্বেচ্ছায় হচ্ছে কিনা, তাকে জোর করা হচ্ছে কিনা, কিংবা তাকে কোনো সিদ্ধি বা কোনো মাদকের সাহায্যে বুদ্ধিভ্রংশ করে রাজি করানো হচ্ছে কিনা, সে হিসাবে আইন-কানুন তৈরির পরামর্শ দেন। কিন্তু এর মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারার কারণে সতীদাহ আরও প্রবলতর হলো। পরবর্তীকালে স্যার জর্জ বার্লো এবং মার্কুয়েস কর্নওয়ালিসের সময় তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। নতুন আরও নিয়ম-কানুনে যেমন- নারীর বয়স ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে কিনা, সেসময় সে গর্ভবতী কিনা এসবও বিবেচ্য হলো। তাতে কাজ হলো এই, বঙ্গের বাইরে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। ১৮২৩ সালে শুধু নিম্নবঙ্গে ৬০০ জন সতীকে দাহ করা হলো। যারা সতীদাহের পক্ষে তারা সরকারি আইনকে ধর্ম বিনাশক হিসেবে জ্ঞান করল। আবার পরে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দাহ সম্পন্ন করার অনুমতি দান করা হলে, লোকে ধরে নিল সতীদাহ আইনসঙ্গত। (মল্লিক : ২০১৬ : ৪১-৪৩)

জানা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীকে জীবন্ত সমাহিত করারও রেওয়াজ কোথাও কোথাও ছিল। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস এর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেন। আর সহমরণকে তিনি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের আওতায় আনেন। 

দশ.
এর মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষিত হিন্দু সতীদাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নামেন; কিন্তু রাজা রাধাকান্ত দেবের মতো রক্ষণশীলরা সতীদাহের পক্ষে অটুট থাকেন। রাধাকান্ত দেব রামমোহন রায়ের প্রতিবাদ গ্রন্থও প্রকাশ করেন। উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর হয়ে আসার পরই তিনি আন্দাজ করতে পারেন যে, তার পূর্ববর্তীরা এই প্রথা অবসানে আন্তরিক থাকলেও সিপাহি বিদ্রোহের আশঙ্কায় তারা কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি এবং আদতেই তাদের সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ সেনা ছিলেন হিন্দু। তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ৪৯ জন সেনাপ্রধানকে এই প্রথা বন্ধের প্রতি সরকারের মনোভাব ব্যক্ত করেন। সৌভাগ্যক্রমে মাত্র পাঁচজন সেনাপ্রধান এই প্রথা অটুট রাখার প্রতি তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। ১২ জন জোরজবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ না করে জনগণকে বুঝিয়ে এই কুপ্রথা উচ্ছেদের আহ্বান জানান। অন্যদিকে ২৪ জনই কোনো কালক্ষেপণ না করে কঠিন আইন তৈরি ও তা প্রয়োগ করে এই কুপ্রথা উচ্ছেদের জোর দাবি তোলেন। অবশেষে ১৮২৯ সালে বেঙ্গল সতী রেগুলেশন প্রণয়ন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই কুপ্রথার চিরঅবসান ঘটান। (মল্লিক : ২০১৬ : ৪৫-৪৭) যদিও কোনো কোনো মননে এই কুপ্রথার প্রতি আজও শ্রদ্ধার রেশ থেকে যাওয়ার কারণে কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এই প্রথা ব্যবহার করার কারণে আধুনিককালেও রূপ কানোয়ারের মতো ঘটনা ঘটেছে। 

লেখক: গবেষক 

গ্রন্থপঞ্জি 
সুধাকর চট্টোপাধ্যায় ২০২৩, সতীদাহ, ধর্ম ও কুসংস্কার, মলাট থেকে প্রাপ্ত।
পঞ্চানন তর্করত্ন অনূদিত (২০২২) পরাশরসংহিতা, হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থাগার। ঝবব: পরাশর সংহিতা PDF (3.94 MB) পঞ্চানন তর্করত্ন অনূদিত পরাশরস্মৃতি বাংলা বই। From Muslims
স্বপন বসু (১৯৮২) সতী, পুস্তক বিপণি।
মহর্ষি বাল্মীকি (২০১০) বাল্মীকি রামায়ণ, হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত ও সম্পাদিত, তুলি-কলম প্রকাশনী, কোলকাতা।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস (১৯৭৮) ঋগ্বেদ সংহিতা, দ্বিতীয় খণ্ড, রমেশ চন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, হরফ প্রকাশনী, কোলকাতা।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস (২০০৯) শ্রীমদ্ভাগবত, সুবোধচন্দ্র মজুমদার অনূদিত, দেব সাহিত্য কুটীর, কোলকাতা ।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস (১৪২২ বাংলা) বিষ্ণু পুরাণম্, নবভারত পাবলিশার্স, কোলকাতা।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস (১৪১৮ বাংলা) মহাভারত : সারানুবাদ, এমসি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড।
কুমুদনাথ মল্লিক (২০১৬) সতীদাহ, জাগৃতি প্রকাশনী, ঢাকা।
চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (২০২৩). সতীদাহ, বঙ্গদর্শন রচনা সংগ্রহ, মলাট থেকে প্রাপ্ত।
জীবন মুখোপাধ্যায় (২০২১) প্রাচীন ভারতে সহমরণ বা সতীদাহ প্রথা, ৯১তম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, ৩৮৩-৭০৪, উদ্বোধন।
গোরাচাঁদ মিত্র (১৩৭১ বাংলা) সতীদাহ, শঙ্খ প্রকাশন।
রামমোহন রায় (১৮১৯) সহমরণ বিষয় : প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ, রামমোহন গ্রন্থাবলী, মিশন প্রেস, কোলকাতা ।
সুব্রত সেন (২০১৯) সতীপ্রথা ও পণপ্রথা : উৎস ও বিবর্তনের সন্ধানে, আনন্দ পাবলিশার্স।
Asher, Catherine B., Talbot, Cynthia (2006). India before Europe, Cambridge University Press. 
Guillemard, F.H.H. (2015). A History of Ancient Geography, Cambridge University Press Warehouse.
Hawley, John Stratton (ed) (1994). Sati, the Blessing and the Curse: The burning of wives in India, Oxford University Press, New York.
Kinsley, David (1988). Hindu Goddesses: Visions of the Divine Feminine in the Hindu Religious Tradition, University of California Press, Berkeley.
Kiswar, Madhu (2000). Don't Shackle Freedom. See: Don't Shackle Freedom-Hinduism Today
Lea, Henry Charles (1888). A History of the Inquisition In The Middle Ages, Chapter VII. The Inquisition Founded Growth of Episcopal Jurisdiction. See A History of the Inquisition In The Middle Ages. By Henry Charles Lea. Volume 1 (archive.org)
McDougall, Dan (2006). Indian cult kills children for the goddess, The Gurdian. See: Indian cult kills children for goddess | India | The Guardian
Shehadeh, Ahmad, Abdallah, Omar, Maait, Reem Farhan Odeh (July 2011). Infanticide in pre-Islamic era, International Journal of Academic Research: Phenomenon Investigation. 2. 3 (4).
Thurston, Herbert (1912). Witchcraft, The Catholic Encyclopedia, vol. 15, New York, Robert Appleton Compaû. 
Pre-Islamic Arabia: Tribes, Traditions, and Theology (historically-accurate.com)

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //