Logo
×

Follow Us

ফিচার

প্রশান্ত মহাসাগরে ওয়ার্ম ব্লব হুমকিতে বৈশ্বিক আবহাওয়া

Icon

এহতেশাম শোভন

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৪০

প্রশান্ত মহাসাগরে ওয়ার্ম ব্লব হুমকিতে বৈশ্বিক আবহাওয়া

পৃথিবীর জলবায়ু দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের প্রভাব প্রতিনিয়ত দেখছি, অনুভব করছি। সম্প্রতি উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যা ঘটছে, তা জলবায়ু বিজ্ঞানীদের রীতিমতো ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। এই বিশাল জলরাশি এবার তাদের উষ্ণতম গ্রীষ্মকাল পার করেছে, যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। একটি রহস্যময় সামুদ্রিক তাপপ্রবাহ, যাকে বিজ্ঞানীরা ‘ওয়ার্ম ব্লব’ বলছেন, তা এক অজানা আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য হুমকি তো বটেই, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে বৈশ্বিক আবহাওয়ার ওপরও।

রেকর্ড ভাঙা উষ্ণতা কতটা গুরুতর

বিবিসির বিশ্লেষণ এবং কোপার্নিকাস জলবায়ু পরিষেবা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিভাগের গড় তাপমাত্রা ২০২২ সালের পূর্ববর্তী রেকর্ড থেকেও ০.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। সংখ্যাটি শুনতে কম মনে হলেও এটি প্রায় ভূমধ্যসাগরের ১০ গুণ বড় একটি অঞ্চলে বিস্তৃত। এত বিশাল এলাকায় তাপমাত্রার এই বিশাল বৃদ্ধিকে বিজ্ঞানীরা ‘অবিশ্বাস্য’ বলে মনে করছেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তাপপ্রবাহ বা ‘মেরিন হিটওয়েভ’ আরো ঘন ঘন এবং তীব্র হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিশ্বের অন্যান্য মহাসাগরেও এমন ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন না কেন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর এত দীর্ঘ সময় ধরে অস্বাভাবিকভাবে গরম থাকছে। এই অতিরিক্ত তাপের রহস্য ‘ওয়ার্ম ব্লব’ কি তা এখনো পুরোপুরি উন্মোচিত হয়নি। কিছু গবেষক মনে করছেন, এর ফলে যুক্তরাজ্যে শীতকালের শুরুতে উল্টো ফল দিতে পারে। অর্থাৎ সেখানে আরো ঠান্ডা আবহাওয়ার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা বার্কলে আর্থের জলবায়ু বিজ্ঞানী জিক হাউস্ফাদার এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এত বড় অঞ্চলে এমন তাপমাত্রা বৃদ্ধি সত্যিই অভাবনীয়।

উষ্ণতা কেন বাড়ছে

সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি অবাক করার মতো কোনো ঘটনা নয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, মানুষের কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে চরম তাপমাত্রার দিনের সংখ্যা তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সমুদ্র পৃথিবীর ৯৩ শতাংশ অতিরিক্ত তাপ শোষণ করে, যা বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। কিন্তু এই শোষণ ক্ষমতার একটি সীমা আছে। যখন অতিরিক্ত তাপ শোষণ হয়, তখন সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ওপর চাপ পড়ে।

তবে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু সাধারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফল নয়। এখানকার তাপমাত্রা বেশির ভাগ জলবায়ু মডেল, যা মানুষের কার্বন নির্গমনকে বিবেচনা করে তৈরি কম্পিউটার সিমুলেশন যতটা পূর্বাভাস দিয়েছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল। বার্কলে আর্থ গ্রুপের মডেল বিশ্লেষণের ফল বলছে, আগস্ট মাসে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যে সমুদ্র তাপমাত্রা দেখা গেছে, তা যেকোনো একক বছরে হওয়ার সম্ভাবনা ছিল ১ শতাংশেরও কম। এর অর্থ হলো, কিছু অস্বাভাবিক উপাদান এখানে কাজ করছে।

শিপিং ফুয়েল থেকে বায়ুদূষণ

দুর্বল বায়ুপ্রবাহ এবং প্রাকৃতিক পরিবর্তন অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতির জন্য প্রাকৃতিক আবহাওয়ার পরিবর্তনকে আংশিকভাবে দায়ী করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, এই গ্রীষ্মে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল বায়ুপ্রবাহ ছিল। অর্থাৎ গ্রীষ্মের সূর্যের তীব্র তাপ সমুদ্রের গভীরের শীতল পানির সঙ্গে মিশে যেতে পারেনি, বরং তা সমুদ্রের উপরিভাগেই আটকে ছিল। এর ফলে উপরিভাগের পানি আরো দ্রুত গরম হয়েছে। তবে হাউস্ফাদারের মতে, ব্যতিক্রমী এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য কেবল প্রাকৃতিক পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। এটা নিশ্চিত যে শুধু প্রাকৃতিক পরিবর্তন নয়, এখানে অন্য কিছুও ঘটছে।

শিপিং ফুয়েলে পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণের একটি কৌতূহলোদ্দীপক ধারণা হলো, শিপিং ফুয়েলে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কারণে এই উষ্ণতা বাড়ছে। ২০২০ সালের আগে জাহাজের নোংরা ইঞ্জিন তেলে প্রচুর পরিমাণে সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন করত। এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হলেও এই সালফার বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র, সূর্য-প্রতিফলিত কণা তৈরি করত, যা ‘এরোসল’ নামে পরিচিত। 

এই এরোসল সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রকে শীতল রাখতে সাহায্য করত।

কিন্তু আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (ওগঙ) ২০২০ সাল থেকে জাহাজের জ্বালানিতে সালফারের পরিমাণ কমানোর নতুন নিয়ম চালু করে। এই নিয়মের উদ্দেশ্য ছিল বায়ুদূষণ এবং মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি কমানো। তবে এর একটি অপ্রত্যাশিত ফলও দেখা যাচ্ছে। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের মতো প্রধান শিপিং হটস্পটগুলোতে এই শীতলকারী সালফার এরোসলের পরিমাণ কমে যাওয়ায় মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নের সম্পূর্ণ প্রভাব এখন প্রকাশ পাচ্ছে। ড. হাউস্ফাদার বলেন, মনে হচ্ছে, এই অঞ্চলে উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে সালফারই প্রাথমিক প্রার্থী। অর্থাৎ সালফার দূষণ কমানোর ফলে বায়ুমণ্ডল কিছুটা পরিষ্কার হলেও একই সঙ্গে সেই শীতলকারী প্রভাবটি কমে যাওয়ায় সমুদ্রের তাপমাত্রা বাড়ছে।

চীনের বায়ুদূষণ কমানোর প্রভাব 

অন্যান্য গবেষণা ইঙ্গিত দেয় যে চীনা শহরগুলোতে বায়ুদূষণ কমানোর প্রচেষ্টাগুলোও প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণায়নে ভূমিকা রেখেছে। চীনের দ্রুত শিল্পায়নের সময় বায়ুদূষণ ছিল চরম পর্যায়ে এবং এই দূষিত বাতাসও সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে পরিবেশকে শীতল রাখার একই কাজ করত। বায়ুদূষণ কমানোর এই প্রচেষ্টার অনিচ্ছাকৃত ফলস্বরূপ সমুদ্রে আরো বেশি তাপ শোষিত হতে পারে। এটি ‘গ্লোবাল ডিমিং’ (এষড়নধষ উরসসরহম) প্রভাবের বিপরীত চিত্র, যেখানে দূষণের কারণে পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছানো সূর্যালোকের পরিমাণ কমে যায়। এখন যখন দূষণ কমছে, তখন আরো বেশি সূর্যালোক সমুদ্রের ওপর পড়ছে এবং এটিকে উষ্ণ করছে।

যদিও এই রেকর্ড উষ্ণতা প্রধানত অন্যান্য কারণে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, তবে বর্তমান এল নিনো পরিস্থিতিও সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এল নিনো হলো একটি প্রাকৃতিক জলবায়ু প্যাটার্ন, যা প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব অংশে সমুদ্রের পৃষ্ঠের জলকে উষ্ণ করে তোলে এবং বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরনকে প্রভাবিত করে। সাধারণত এল নিনো গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণতা সৃষ্টি করলেও এর প্রভাব পরোক্ষভাবে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরেও অনুভূত হতে পারে।

ভবিষ্যৎ আশঙ্কা

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের এই রেকর্ড উষ্ণতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি উচ্চ তাপমাত্রা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন, মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনচক্র ব্যাহত হতে পারে। মাছের প্রজনন কমে যেতে পারে, খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে যেতে পারে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রজাতির ব্যাপক স্থান পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

মৎস্যশিল্পের ওপর প্রভাব 

মৎস্য সম্পদ কমে যাওয়ার ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জীবিকা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে। বায়ুমণ্ডলীয় প্যাটার্নের পরিবর্তন সমুদ্রের অতিরিক্ত তাপ বায়ুমণ্ডলে স্থানান্তরিত হয়ে আবহাওয়ার ধরনকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন ও অন্যান্য চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোকে আরো তীব্র করতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, এই ‘ওয়ার্ম ব্লব’ মেরু অঞ্চলের বরফ গলাতেও ভূমিকা রাখতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ুব্যবস্থায় প্রভাব উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের উষ্ণতা শুধু সেই অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি বিশ্বব্যাপী সমুদ্র স্রোত, বায়ুপ্রবাহ ও জলবায়ুব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে। এটি সম্ভবত একটি ইঙ্গিত যে জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত ও অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিকার কী হতে পারে? 

এই অস্বাভাবিক ঘটনা আরো একবার মনে করিয়ে দেয় যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করা কতটা জরুরি। শুধু কার্বন নির্গমন কমানোই যথেষ্ট নয়, এর অপ্রত্যাশিত প্রভাবগুলোকেও বুঝতে হবে এবং মোকাবিলা করতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া। 

ব্যাপক গবেষণা সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণগুলো বুঝতে আরো গভীর গবেষণা চালানো। শিপিং ফুয়েল ও বায়ুদূষণ কমানোর ফলে সৃষ্ট প্রভাবগুলোও বিশ্লেষণ করা। 

নীতিনির্ধারণ পরিবেশগত নীতি প্রণয়নের সময় এর সুদূরপ্রসারী ও অপ্রত্যাশিত প্রভাবগুলো বিবেচনা করা। একটি দূষণ কমানোর প্রচেষ্টা যেন অন্য কোনো পরিবেশগত সমস্যা তৈরি না করে, তা নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, যাতে এই বৈশ্বিক সমস্যাটির একটি সম্মিলিত সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়।

উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের এই রহস্যময় উষ্ণতা প্রকৃতির এক কঠিন বার্তা। পৃথিবীর প্রতিটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের ছোট একটি পদক্ষেপও পরিবেশের ওপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাই ভবিষ্যতের জন্য একটি সুস্থ পৃথিবী নিশ্চিত করতে এখন থেকেই আরো সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫