পোকা খাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত রেস্তোরাঁ ও ১০ সুস্বাদু পোকা

বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে খাদ্যের অভাবে মানুষ বাধ্য হয়ে পোকামাকড় খাবার হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে যে দেশে খাদ্যের অভাব নেই এমন অনেক দেশেও পোকা খাবার তালিকায় রয়েছে। যাইহোক পৃথিবীর জনসংখ্যা যে হারে বেড়ে চলেছে, একটা সময় হয়তো পৃথিবীর খাদ্যভান্ডার ফুরিয়ে যেতে পারে, তখন আমাদেরকেও পোকা খাওয়া শুরু করতে হতে পারে। ইতিমধ্যে বিশ্বে একটি পোকা খাওয়ার রেস্তোরাঁর অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। যাকে বলা হচ্ছে সুস্বাদু পোকা খাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত রেস্তোরাঁ। প্যারিসের একটি রেস্তোরাঁর খাদ্যতালিকার পোকা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা ‘সার্টিফিকেট’ দিয়েছেন। মানুষও মুগ্ধ হচ্ছেন পোকার নানা ধরনের রেসিপি খেয়ে।  

খাবার উপযুক্ত ১০ সুস্বাদু পোকা

জায়ান্ট ওয়াটার ব্যাটল (Giant Water Beetles)

এই পোকাটি দেহে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি পানি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। তাই এটা খাওয়ার জন্য উপযুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মানুষই এই পোকাটি খাওয়ার জন্য সংরক্ষণ করেন। মরুভূমির লোকেরা এই পোকাটির খোলস ছাড়িয়ে ভেতরের অংশটুকু খেয়ে ফেলেন। তবে অন্যান্য দেশে এটাকে আরো সুস্বাদু করার জন্য তেলে ভেজে অথবা রোস্ট করে খাওয়া হয়। থাইল্যান্ডে চিলি পেস্ট এবং টমেটো সস বানাতে এই পোকাটির রস ব্যবহার করা হয়। দেখতে তেলাপোকার মত হলেও এই পোকাটি মোটেই নোংরা বা অতটা বিষাক্ত নয়।


বড় আকারের পিঁপড়া (Giant Ants)

চকলেট ক্রিম মাখানো কেক, রোলসহ যেকোনো খাবার খেতেই আমরা কমবেশ পছন্দ করি। জায়ান্ট এন্টস বা বড় আকারের এই পিঁপড়াগুলোর রস থেকে অ্যালমন্ড ও বাদামের ফ্লেভার বানানো হয়। যা পরবর্তীতে ঘ্রাণবিহীন চকলেটকে সুগন্ধি ও সুস্বাদু করে তোলে। কলোম্বিয়ানরা বৃষ্টির মৌসুমে এই পিঁপড়াদের দীর্ঘসময়ের জন্য সংরক্ষণ করে রাখে। এর শরীর থেকে নির্গত হওয়া এসিড তারা খাবার সুস্বাদুকরণের জন্য পরবর্তীতে ব্যবহার করে।

পঙ্গপাল (Locusts)

আমাদের দেশে সাধারণত এদেরকে ঘাসফড়িং, ঝিঁঝিঁপোকা বা ধান ক্ষেতের পোকা বলে ডাকা হয়। কিন্তু এগুলো আসলে সম্পূর্ণই ভিন্ন জাতের পোকা। এদের শরীরে সবুজ পাতা থেকে সংগ্রহীত প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক উদ্ভিদরস থাকে। তাই বিভিন্ন দেশে ময়দা বানাতে এই পোকা ব্যবহার করা হয়। এই পোকাগুলোকে মেশিনে কোডিং করে পাউডার বানিয়ে ময়দার সাথে মিশিয়ে ময়দার ফ্লেভার বাড়ানো হয়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মেক্সিকোতে এই পোকাকে লবণ দিয়ে কড়াভাবে ফ্রাই করে ভেজে খাওয়া হয়।

উইপোকা (Termites)

প্রোটিনের যোগদানকারী আরেকটি পোকা হচ্ছে উইপোকা। আপনি যদি আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা হন, তাহলে আপনাকে জীবনধারণ করতে হলে এই পোকাটির সাহায্য নিতে হবে। এই দেশগুলোর মানুষেরা উইপোকা রোস্ট করে খায়। ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম, ধরুন আপনি মাংস রান্না করলেন, তখন আপনি মাংসের রোস্টের সাথে ঝাল প্রজাতির এক মুঠো উইপোকা ছেড়ে দিবেন। পায়েস বা দুধ দিয়ে মিষ্টি জাতীয় খাবার রান্না করলে সেখানে কড়ই গাছের মিষ্টি উইপোকা ছেড়ে দিলেন। আবার শাকসবজির সাথে দিলেন কাঠের আসবাবপত্রে থাকা নোনতা উইপোকা।


গর্ভবতী ঝিঁঝিঁপোকা (Pregnant Crickets)

এটি থাইল্যান্ডের অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এই পোকাটির পেট ডিমে ফুলে থাকে। তখন এর পেটে প্রায় কয়েকশ ডিম একসাথে পাওয়া যায়। ঠিক যেরকম আপনি ইলিশ মাছের ডিম রান্না করে খান। এই পোকাগুলো খাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, এর শরীরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ফ্যাট, মিনারেল এবং নিউট্রিশাস।

শুঁয়োপোকা (Larvae)

কেঁচোর মত দেখতে সাদা/হলুদ রঙয়ের এই পোকাগুলা পচা নারিকেল গাছের গুঁড়ির মধ্যে পাওয়া যায়। এগুলোকে তেলে ভেজে মচমচে করে খাওয়া হয়। আবার সালাদ এবং স্যুপের সাথেও লবণ দিয়ে মাখিয়ে খাওয়া হয়। অনেক দেশে এগুলোকে পাউডার বানিয়ে বিভিন্ন প্যাকেটজাত খাবারে ব্যবহার করা হয়। যেমন, চকলেট, ওয়েফার, নুডলস বা পটেটো চিপস। 

বিচ্ছু (Scorpions)

চীন, জাপান, কম্বোডিয়ায় বিচ্ছু কাঁচা বা তেলে ভেজে খেলেও ক্যালিফোর্নিয়ায় এগুলোকে চকলেট জেলি বানাতে ব্যবহার করা হয়। তারা বিচ্ছুর বিষদাঁত ভেঙে শরীর থেকে বিষ বের করে কিছুদিন প্রিজার্ভ করে রাখে। তারপর এটিকে চকলেটের মণ্ডপের ভেতর চুবিয়ে ললিপপ বানিয়ে বিক্রয় করে। 

ওয়েভার এন্টস এগ (Weaver Ant Eggs)

পিঁপড়ার ডিম। থাইল্যান্ডের মানুষ সারাবছর এই খাবারটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। কারণ এটি শুধুমাত্র বছরে একমাসই পাওয়া যায়। ডিম সংগ্রহের প্রক্রিয়াটিও অত্যন্ত জটিল। কারণ পিঁপড়েরা ডিম পাড়ার নির্দিষ্ট কয়েকদিন পর ডিমগুলো যখন কিছুটা বড় হয়, তখন এগুলোকে সংগ্রহ করতে হয়। নাহলে ডিমের ভেতর বাচ্চা পিঁপড়া জন্মানোর বিষাক্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়। পিঁপড়ার এই ডিমগুলোকে সালাদের সাথে মিলিয়ে খাওয়া হয়। তাদের মতে, এয়েভার এন্টস এগ তাদেরকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে।

কাসু মারজু (Casu Marzu)

কাসু মারজু আসলে পোকা নয়, তবে এটি হচ্ছে একধরণের খাবার, যার ভেতর পোকারা বসবাস করে। এটাকে পোকার বাসাও বলতে পারেন। গন্ধযুক্ত পচা পনিরের ভেতর যখন সাদা রঙয়ের ছোট ছোট লারভা (দেখতে কেঁচোর মত) বাসা বাধে, তখন এটাকে বলা হয় কাসু মারজু। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এটাকে সুস্বাদু খাবার হিসেবে ধরা হয়। পোকা সবই এই খাবারটি কচকচ করে চিবিয়ে খেয়ে ফেলা হয়।

টারান্টুলা মাকড়সা (Tarantula Spider)

সবচেয়ে বিষাক্ত এই মাকড়সাটি কামড় দেয়ার পনেরো সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু কম্বোডিয়ার মানুষেরা এতটাই অভাবগ্রস্ত যে, তাদেরকে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই এই মাকড়সা ধরতে হয় রান্না করে খাওয়ার জন্য। আমাদের দেশে রাস্তার পাশে পাওয়া পুরি-পেঁয়াজুর মত কম্বোডিয়ার স্ট্রিটফুড হচ্ছে এই টারান্টুলা। দেশটির ঘরবাড়ির আনাচে কানাচে প্রচুর পরিমাণে মাকড়সা পাওয়া যায়। মাকড়সার উপদ্রব কমাতে তারা এটিকে তেলে মচমচে করে ভেজে রান্না করে খায়। মাকড়সারা সাধারণত পিঁপড়াসহ অন্যান্য বিষাক্ত পোকা খেয়ে জীবনধারণ করে। তাই মাকড়সা খেতে গিয়ে এর পেটের ভেতর থাকা অন্যান্য বিষাক্ত পোকাও মানুষ খেয়ে ফেলে। এর ফলে প্রতিবছর দেশটির গড়ে সতেরো জনের মত মারা যায়।


যে কারণে পোকা খাওয়ার বিজ্ঞানসম্মত রেস্তোরাঁ

সারা বিশ্বে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে৷ এ আশঙ্কা দূরে রাখতেই বিকল্প খাবার খোঁজা শুরু৷ শুরুতেই বিবেচনায় আসে পোকা৷ বিভিন্ন ধরনের পোকা রান্না করে, স্বাদ পরীক্ষা করে সেগুলো রেস্তোরাঁয় পরিবেশনের জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল৷ মিলওয়ার্ম, পঙ্গপাল, ঘাসফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ বেশ কয়েক ধরনের পোকা ছিলো সেই তালিকায়৷

অবশেষে অনুমোদন

গত জানুয়ারিতে ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি এজেন্সি (ইএফএসএ) মিলওয়ার্মসহ বেশ কয়েক ধরনের পোকাকে ‘মানুষের খাওয়ার উপযোগী’ হিসেবে ঘোষণা দেয়৷ এ ধরনের পোকা বাজারে বিক্রি করার অনুমতিও দেয়া হয় মে মাসে৷

ইনোভিট: সুস্বাদু পোকা খাওয়ার রেস্তোরাঁ

ইউরোপিয়ান ফুড সেফটি এজেন্সির (ইএফএসএ) সবুজ সংকেত পাওয়ার পর লরেন্ত ভেয়েত তার ইনোভিট রেস্তোরাঁতেও পোকা রান্না শুরু করেছেন৷ ওপরের ছবিতে পোকার একটা বিশেষ রেসিপি পরিবেশন করতে চলেছেন শেফ লরেন্ত ভেয়েত৷

প্লেটভর্তি পোকা

ওপরের ছবিতে এক ক্রেতার পছন্দে রান্না করা মিলওয়ার্মের এক রেসিপি৷ ইনোভিট রেস্তোরাঁর মেন্যুতে পোকার আরো অনেক ধরনের খাবারই রয়েছে৷ কেউ কেউ সবজির সঙ্গে খাচ্ছেন কড়াভাজা পোকা, কারো পছন্দ আবার চকলেটে চোবানো ঘাসফড়িং৷

পোকা খুব পুষ্টিকর খাবার

যাদের মনে খাদ্য হিসেবে পোকা সম্পর্কে এখনো অনেক সংশয়, তাদের নিশ্চিন্ত করতে পারে স্টেফান ডি কির্সমেকারের একটি মন্তব্য৷ ইউরোপীয় কমিশনের স্বাস্থ্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক মুখপাত্র স্টেফান বলেছেন, ‘পোকা পুষ্টিকর খাবার৷ পোকা খেলে আমরা নিশ্চয়ই আরো স্বাস্থ্যসম্মত এবং টেকস কিছুই খাবো৷’ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //