মোয়াজ্জেম হোসেন রাসেল
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২২, ০২:৩৩ পিএম
আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২২, ০৩:৫১ পিএম
ঢাকার ফুটবলে একটি কথা বেশ প্রচলিত, সেটি হলো-পাইওনিয়ার লিগে ৫০০ টাকায় ম্যাচ কেনা-বেচা হয়। বিশেষ করে পয়েন্ট টেবিলের নিচের দলের সাথে চ্যাম্পিয়ন ফাইটে থাকা দলগুলোর ম্যাচ নিয়ে এমন অভিযোগ যেন অনেকটাই নিয়মিত। মাঝের কয়েকটি মৌসুম ম্যাচ পাতানোর বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও গত মৌসুম থেকে আবারো ফুটবলের বিষবৃক্ষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের কোচ, কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একাধিক ফুটবলার বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞার শাস্তি পেয়েছেন। পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) পর এবার বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (বিসিএল) একাধিক ম্যাচ পাতানোর গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রা সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) পেশাদার লিগ কমিটি থেকে নয়, সংবাদকর্মীরা এই ধরনের অপরাধের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। চারটি ক্লাবের নাম উঠে এসেছে এরই মধ্যে সন্দেহের তালিকায়। যা নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশের ফুটবলে। এক বছরেরও কম সময় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় শাস্তি পাওয়া আরামবাগ ক্লাব থেকে শিক্ষা নেয়নি পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরের কোনো ক্লাবই।
এখন তো ঢাকার ফুটবলে বলাবলি হচ্ছে, বিসিএলই শেষ করে দিচ্ছে দেশের ফুটবলকে। একটা কিংবা দুটি ম্যাচ নয়, একাধিক ম্যাচ নিয়ে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ ওঠায় কর্মকর্তাদের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেছে। বিপিএলের আসরের তুলনায় একটু অবহেলিত এই আসর। আর এই সুযোগ নিয়ে পাতানো ম্যাচের উৎসব হয় এ লিগে। গত বছর কয়েকটি ম্যাচ পাতানো হয়েছে এই দাবি জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিল ফর্টিস ফুটবল ক্লাব। কিন্তু বাফুফে তদন্ত করে এর কোনো সত্যতা পায়নি। যার ফলে প্রিমিয়ারে ওঠা হয়নি ফর্টিসের।
উল্লেখ্য যে, অভিযুক্ত ক্লাবের বিপক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ক্লাবটির পয়েন্ট কাটা যেত। আর সেই সুযোগে প্রিমিয়ারে উঠত ফর্টিস ক্লাব। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার জের ধরে এবারো বিসিএলে চলছে পাতানো খেলা মচ্ছব। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ম্যাচ পাতানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে নিজ ক্লাবের বিপক্ষে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ করে পদত্যাগ করেছেন আজমপুর ফুটবল ক্লাবের কোচ সাইফুর রহমান মনি এবং ম্যানেজার জালাল উদ্দিন। দু’জনই আবার সাবেক কৃতী ফুটবলার এবং ভালো বন্ধু।
বেশ কয়েকটি অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে, আজমপুরের এক ফুটবলার এবং ফরাশগঞ্জের কয়েক ফুটবলার এবার দুই ম্যাচ পাতিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিসিএলে অতীতে ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে শাস্তি হয়েছিল ওয়ারী ক্লাব এবং ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের। এর আগে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে এই কারণে শাস্তি পায় আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি এবং লে. শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। কিন্তু পাতানো খেলার চক্রের দাপটটা এতই ব্যাপক যে তাদের কার্যক্রম কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ফলে এবারো হচ্ছে পাতানো খেলা নিয়ে সেই পুরনো ব্যথাটা রয়েই গেছে।
বিসিএলের এক ক্লাবের কোচ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে জানান, ‘আমাদের জুয়াড়িরা শেষ করে দিয়েছে বিসিএলের ফুটবলকে। এদের থাবাটা এতই বিস্তৃত যে একের পর এক হচ্ছে পাতানো ম্যাচ খেলা হচ্ছে।’
মতিঝিল ক্লাবপাড়ার বিসিএলের এক ক্লাব কোচ কিছুটা হতাশা নিয়ে জানান, ‘আমার দল ম্যাচ পাতিয়ে হেরেছে লিগে নবাগত এক দলের কাছে, যা মেনে নেওয়া যায় না। অথচ আমি জানতামই না এই ধরনের ঘটনা রয়েছে। যদি আমি অবগত হতাম তাহলে মাঠেই আসতাম না’।
নবাগত এই ক্লাবটি আবার অন্য কারণে আবার অনেক ক্ষমতাধর। এখন পাতানো খেলার ধরন পাল্টে ফেলেছে তারা। আগে সমঝোতার ভিত্তিতে ম্যাচ হতো ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করাতে কিংবা রেলিগেশন ঠেকাতে। এটা হতো মূলত ক্লাবের স্বার্থে; কিন্তু এখন বেটিং হচ্ছে প্রায় প্রতিটা ম্যাচে। সেখানে জুয়াড়িদের ছোবল এতটাই প্রবল আর প্রকট যে, অনেকটাই সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা। এই প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কিছু খেলোয়াড় এবং অফিসিয়ালরা। এতে নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড় ম্যাচ পাতায় বলে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে। কত মিনিটের মধ্যে কত গোল হবে, ম্যাচের স্কোর কি হবে এই নিয়ে বেটিং এবং এর সূত্র ধরে ম্যাচ পাতানো হয় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। যে তথ্য প্রথমে কোচ বা কর্মকর্তা পর্যন্ত জানতে পারেন না। পরে তারা ব্যবস্থা নিতে নিতে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে যায়।
উত্তরা ফুটবল ক্লাবের সভাপতি মিয়া ভাই আবার এই ম্যাচ পাতানো প্রক্রিয়ায় রীতিমতো ক্ষোভ ঝেড়েছেন সংশ্লিষ্টদের নিয়ে, আমাদের পক্ষে দল প্রিমিয়ারে লিগে তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। পাতানো খেলার এই প্রক্রিয়াকে স্পট ফিক্সিং বললেও এখানে অনেক উপায়ে এই কাজগুলো করা হচ্ছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ভূমিকায় রয়েছে লিগ কমিটি।
লিগ কমিটির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা আত্মসমর্পণের সুরে বলেছেন, এ বিষয়ে কিছুই করার নেই তাদের। এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে এখন পর্যন্ত শিরোপার লড়াইয়ে আছে ফর্টিস এফসি ও নোফেল স্পোর্টিং ক্লাব। বিসিএল এমন এক লিগ যেখানে প্রতি ম্যাচের জয় পরাজয় পাল্টে ফেলতে পারে পয়েন্ট টেবিলের চিত্র। একেবারে শেষ ম্যাচেও কী হবে তা আগাম বলা মুশকিল। এই যেমন প্রথম পর্বে যে দল রেলিগেশনের শঙ্কায় থাকে তারাই পরের রাউন্ডে ভালো খেলে উন্নীত হয় প্রিমিয়ারে। এই আকর্ষণই শেষ হয়ে যাচ্ছে পাতানো খেলার দুষ্টচক্রে পড়ে। সামনে যে কী অপেক্ষা করছে সেটি ফুটবল পরিচালনা করা কর্মকর্তারাও ভালো বলতে পারেন না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh