রানার্স-আপেও ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা

বয়সভিত্তিক ফুটবলে বাংলাদেশ সবসময়ই ভালো দল। সেই ১৯৯০ সালে ডানা ও গোথিয়া কাপ থেকেই এই ধারা চলে আসছে। দুটি আসরের শিরোপা জিতে চারদিকে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল লাল সবুজ দল। কিন্তু এরপর থেকে আর সেই ধারাটা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

তবে এবার ভারতের মাটিতে অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিক দলকে হারিয়ে অপরাজিত থেকে ফাইনালে ওঠে পল থমাস স্মলির দল। কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে আর পেরে ওঠেনি বাংলাদেশ দল। ফাইনালে ৫-২ গোলে পরাজয় খেলোয়াড়দের কান্না ছুঁয়ে গেছে ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়। বয়সভিত্তিক এই আসরে বাংলাদেশ রানার্স-আপ হলেও ভবিষ্যতের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেছেন বাংলাদেশের যুবারা। 

ভারতের ওড়িশা রাজ্যের ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনালে ‘শক্তিধর’ স্বাগতিকদের কাছে ৫-২ গোলে হেরে আশাভঙ্গ হয়। পাঁচ দলের রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষ দুই দল আসরের ফাইনালে খেলেছে। বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বে ভারতকে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয়ের আশা বাড়িয়ে তোলে। কুড়ি না পেরুনো দলের আগের আসর বসেছিল ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৮ বয়সীদের। সেখানেও ভারতের কাছে হেরে রানার্স-আপ হতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। অথচ ফাইনালে ফেভারিট ছিল মিরাজুল ইসলামরা।

ফাইনালে উঠেও শিরোপা জয়ের খুব কাছে গিয়ে হতাশ হতে হয়েছে তাদের। যুবাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল অবশ্য টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলা। বয়সভিত্তিক এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও ফাইনালে খেলাটা বড় ধরনের সাফল্যের মধ্যেই পড়ে। অথচ অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কোনো কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরে দেখা যায়নি! জাতীয় দল যেখানে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পেরুতে পারে না, সেখানে যুবারা ফাইনালে খেলে সর্বমহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। দেশে ফেরার পর ফুল বা মিষ্টিমুখ করিয়ে তাদের উৎসাহ তো দেওয়া যেত। অথচ ফাইনালে ওঠার পর খেলোয়াড়দের নিয়ে সে কী প্রশংসা শোনা গেছে! 

একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, ফাইনালে পরাজিত হলেও মিরাজুল, তানভীররা কেউ অজুহাত দাঁড় করাননি। জাতীয় দল হলে তো এই সমস্যা, ওই সমস্যার কথা বলে ব্যর্থতা ঢাকত। এবারের আসরে শ্রীলংকাকে ১-০ গোলে হারিয়ে শুরু, এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে স্বাগতিক ভারতকে ২-১ গোলে হারিয়ে সামর্থ্যরে প্রমাণ দেওয়ার পর মালদ্বীপকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে জয়ের ধারা অব্যহত রাখে। এরপর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নেপালের সঙ্গে ১-১ ড্র করে পাঁচ দলের সাফ অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম আসরে একমাত্র অপরাজিত দল হিসেবে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচেই থেমে যায় জয়যাত্রা।

অথচ ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দুরন্ত ফুটবল খেলে হারলেও নির্ধারিত ৯০ মিনিট ২-২ ব্যবধানে ড্র রাখে। অতিরিক্ত সময়ে চাপ নিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ৫-২ গোলের বড় ব্যবধানেই হারতে হয়েছে দলকে। ভারত থেকে দেশে ফেরার পর লাল-সবুজের তরুণ ফুটবলাররা এখন প্রস্তুতি শুরু করবেন এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশিপের। আগামী ১০-১৮ সেপ্টেম্বর বাহরাইনে এএফসির এই আসরে বাহরাইন, কাতার, নেপাল ও ভুটানের বিপক্ষে খেলবেন তারা। পাশাপাশি ঘরোয়া ফুটবলের জন্য প্রস্তুতি তো রয়েছেই। কারণ সবাই খেলবেন পেশাদার লিগের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে। শুরুর অপেক্ষায় থাকা মৌসুমে দামও বেশ চড়া হবে তাদের। ভারতের ভুবনেশ্বরে সম্ভাবনা জাগিয়ে দেশের ফুটবল মানচিত্রে এক ঝাঁক তরুণের আবির্ভাব চোখ কেড়েছে ফুটবলবোদ্ধাদের। গত সপ্তাহের কয়েকটা দিনে ভুবনেশ্বরে চোখ রেখে দেশের ফুটবল জনতা শেষ পর্যন্ত নিরাশ হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। ফাইনালে ভারতের সঙ্গে ৯০ মিনিট ২-২ রেখে অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ৯ মিনিটেই ৩ গোল হজম করাই সর্বনাশ করেছে বাংলাদেশের। এটুকু বাদ দিলে প্রথমবারের মতো আয়োজিত সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলে বাংলাদেশের ফুটবল নতুন এক প্রজন্মর আগমনী বার্তাই দিয়েছে।

সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আলফাজ আহমেদ। তার কথায়, ‘ভারতের এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ফুটবলে উঠতি একটা দল তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে যাদের মধ্যে অনেককেই জাতীয় দলে দেখা যেতে পারে। এখন বাফুফের উচিত খুব যত্নের সঙ্গে এ তরুণদের অনূর্ধ্ব-২৩ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া।’ আলফাজ আহমেদ আরও বলেন, ‘আমার জোর দাবি হচ্ছে, এই দলটাই যেন অনূর্ধ্ব-২৩ হিসেবে আগামীতে খেলতে পারে সেই ব্যবস্থা করা দরকার। বাফুফে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে বলেই আমি আশা করছি। এর আগে যুব সাফে এ ছেলেদের মধ্যে ভালো সম্ভাবনা দেখেছি।’ 

নবীনদের প্রশংসা করে তৃণমূল পর্যায়ের ফুটবলার বাছাইয়ে দুর্দান্ত কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘আমি অনূর্ধ্ব-২০ দলের খেলোয়াড়দের খেলা দেখেছি। তাদেরকে আমার অনেক বেশি সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে। ওরা সাফে প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে সমীহ আদায় করে নিয়েছে। চ্যাম্পিয়নও হতে পারে বলে আশা করেছিলাম। ফাইনালে পারেনি ওই অল্প কয় মিনিট মনোযোগ হারানোর কারণে। তবে ওদের খেলায় সাহস আর উদ্যম দেখে, সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা করছি আমি।’ এর আগে অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলেছে। ২০১৫ সালে সিলেটে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্টেও।

দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ওই দলের তরুণদের পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নেবে বলেছিল। পরে দেখা গেছে, সেটা ছিল অনেকটা ‘কথার কথা’! ফলে সময়ের চোরাবালিতে তলিয়ে গেছেন অনেক তরুণ, প্রতিশ্রুতিশীল আর সম্ভাবনাময় ফুটবলার, যারা এসেছিলেন নতুন দিনের পতাকা হাতে। অকালে খেলা ছেড়ে জীবিকার টানে রিকশা ভ্যান পর্যন্ত চালিয়েছেন কেউ কেউ। এছাড়া কেউ ঝাড়ুদার, কেউবা রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। যুব থেকে জাতীয় দলে এসে নজরকাড়া ফরোয়ার্ড রবিউল ইসলাম অল্প দিনেই হারিয়ে গিয়ে চরমভাবে হতাশ করেছেন।

এছাড়া সিলেটে সাফ অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়ন দলের আলোচিত স্ট্রাইকার সরোয়ার জাহান নিপু এবারের প্রিমিয়ার লিগে মুক্তিযোদ্ধার হয়ে সব মিলিয়ে ১০০ মিনিটও খেলেননি। কোচ তার উপর আস্থা রাখতে পারেননি আর সেই দলের সাদউদ্দিন ছাড়া কেউই ভালোভাবে টিকে থাকতে পারেননি। সদ্য শেষ হওয়া সাফ যুব ফুটবলে ৪ গোল করা আলোচিত স্ট্রাইকার মিরাজুল ইসলাম বা ভারতের বিপক্ষে জোড়া গোল করা স্ট্রাইকার পিয়াস আহমেদ নোভারাও হারিয়ে যাবেন না তো? সেই শঙ্কা থাকছেই। এবার দেখার বিষয় বাফুফে এ সকল ফুটবলারের যত্নটা কীভাবে নেয়!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //